অনলাইন

বিশ্বকাপ ফ্রান্সের, বিশ্বহৃদয় ক্রোয়েশিয়ার

রূপায়ণ ভট্টাচার্য, মস্কো

১৬ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ১:০৯ পূর্বাহ্ন

গ্যালারির লাল-সাদা ঢেউয়ের মধ্যে একটা ব্যানারে ক্রোট ভাষায় কথাটা লেখা ছিল। প্রশ্নের মধ্যে জেগেছিল আকুল আকুতি। কান্না। আজ না পেলে আর কবে বিশ্বজয় করবে ক্রোয়েশিয়া?
হয়তো একদিন হবে। তবে এখন হল না। চলুক অপেক্ষা।
নতুন চ্যাম্পিয়ন ফরাসিরাও বলতে পারতেন, এখন না হলে আর কবে হবে? এত প্রতিভা তাঁদের টিমে। সামনে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা-জার্মানির মতো বাঘ-ভালুক ছিল না।
আধা পর্তুগিজ, আধা জার্মান আঁতোয়া গ্রিয়াজমানের হাত ধরে ফরাসিরা নিয়ে গেল বিশ্বকাপ। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ সমস্ত দিক দিয়ে ফিরিয়ে এনে। সেই বিশ্বজয়ী টিমের লঁরা ব্লাঁ, মার্সেই দেসাই, লিলিয়ান থুরামের সামনে নতুন প্রজন্ম বিশ্বজয় করল আবার। আবার ক্রোটদের কাঁদাল। আকাশ কার জন্য কাঁদল? ম্যাচ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই এত ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, ভিজে জবজবে হয়ে ফিফা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পুরস্কার দিলেন রাশিয়া, ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়ার রাষ্ট্রনায়করা। আগে এই বিরল দৃশ্য দেখেনি বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপ ফ্রান্সের, বিশ্বহৃদয় ক্রোয়েশিয়ার। অনেক বছর কলকাতার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে দেখা যায়, একটা দল দারুণ খেললেও জিতে যায় অন্য টিম। সেই ম্যাচ নিয়ে পরের দিন হেডিং হয়, ‘খেলল ইস্টবেঙ্গল, জিতল মোহনবাগান।’ বা উল্টোটা। বিশ্বকাপ ফাইনালের স্কোর ৪-২ হলেও হেডিং এমন হতে পারে।
ম্যাচটার আগে মনে হয়েছিল, দুটো ফাইনালিস্ট টিমের মধ্যে থেকে সেরা টিম গড়তে গেলে ফ্রান্স ৮-৩ এগিয়ে থাকে। ফাইনালের পর মনে হচ্ছে, ওই সেরা এগারোয় ক্রোয়েশিয়ার ফুটবলার থাকবেন ৮ জন। ম্যাচটা শুরুর আগে মাঠে শিল্পীদের নাচের সঙ্গে ড্রাম বাজাচ্ছিলেন রোনাল্দিনহো। স্বর্গীয় দৃশ্য। খেলা শুরু হতেই সেই ছন্দে ঝাঁপালেন মদ্রিচ, রাকিতিচ এবং পেরিসিচরা। ফাইনাল শেষে পরিসংখ্যান দেখছি, ক্রোয়েশিয়া বল পজেশনে এগিয়ে ৬১-৩৯। গোলে শটেও তারা দ্বিগুণ বেশি নিয়েছে (১৫-৮), কর্নারও তাই (৬-২)। পাস? ফরাসিদের ২৬৮ পাসের পাশে ক্রোটদের পাস ৫৪৭। ম্যাচ শেষে সোনার বল হাতে বিষণ্ণ মদ্রিচকে দেখে কষ্টই হচ্ছিল।
ফরাসিদের সবচেয়ে মজবুত জায়গা ৪-২-৩-১ সিস্টেমে পোগবা এবং কন্তের ডিফেন্সিভ স্ক্রিন। এমবাপে, গ্রিয়াজমান প্রচার নিয়ে গেলেও, দেশঁর আসল অস্ত্রভাণ্ডার এটাই। মদ্রিচরা প্রথম থেকেই সেটা ফুটো করে দিলেন। কন্তেকে এক ঘণ্টার আগেই তুলে নিতে হল। মাত্র ১৯টা টাচ খেলেছেন কন্তে। অবিশ্বাস্য। তেমনই অবিশ্বাস্য, সারা টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা হুগো লঁরিসের হাস্যকর গোল হজম।
মস্কো বিশ্বকাপ ফাইনাল অবশ্য অনেক অন্য রকম ছবি দেখাল। ভাগ্যের উত্থান-পতন যে অনিবার্য, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর জন্যই যেন এ ম্যাচ। সেমিফাইনালে যিনি অবিশ্বাস্য গোলে ক্রোটদের জেতালেন, সেই মান্দজুকিচের নামের পাশে এ দিন আত্মঘাতী গোল। যে পেরিসিচ দুর্দান্ত গোলে ১-১ করেছিলেন, তাঁর জন্যই পেনাল্টিটা। যে লঁরিস ম্যাচেও দুটো তিনটে দুর্দান্ত সেভ করলেন, তিনিই হজম করলেন টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বাজে গোলের একটা। ক্লিয়ার করতে গিয়ে গোল। কাপ ফাইনালের পরের বৃষ্টিটাও কী কম অবাক করা?
 ফাইনালের ম্যান অফ দ্য ম্যাচ গ্রিয়াজমান ঠিক দু’দিন আগে বলেছিলেন, ‘খারাপ খেলেও আমার দুটো স্টার চাই জার্সিতে।’ তাই বলে পুরো টিম এত খারাপ? গ্রিয়াজমানই লড়ে গেলেন একা। ফ্রান্স প্রথমে যে দুটো গোল পেল, দুটোই রীতিমতো বিতর্কিত স্টাইলে। গ্রিয়াজমান ফ্রিকিক পান একেবারে ‘নেইমার’ স্টাইলে অভিনয় করে। ফাউলটা তাঁর হয়নি। আর যে পেনাল্টিটা ভিএআরের সাহায্যে দেওয়া হল, সেটা নিয়েও হাজার প্রশ্ন। ওই হ্যান্ডবলকে আদৌ ইচ্ছাকৃত বলা যায়?
এই বিশ্বকাপকে ভিএআর এবং সেটপিসের বিশ্বকাপ বলা হচ্ছে। ভিএআর ৮০ শতাংশ সংক্রান্ত সমস্যা দূর করেছে ঠিক। কিন্তু অনেক ‘আপেক্ষিকতা’ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি। যেমন পেরিসিচের হ্যান্ডবল। ওটা কি ইচ্ছাকৃত হ্যান্ডবল, না অনিচ্ছাকৃত? ইউরোপের দুটো টিম খেলছে বলে আর্জেন্তিনার রেফারি পান্তানাকে ম্যাচ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর এত জটিল ম্যাচ খেলানোর অভিজ্ঞতা কি আছে? জটিল ম্যাচ মানে এখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এই দুটো গোল না হলে খেলা হয়তো অন্য পথে গড়াত। স্টেডিয়ামের প্রধান গেটে লেনিনের মূর্তির পাশে লাল রঙের বন্যা সকাল থেকে। যদিও সে সব কোকাকোলা এবং বিয়ারের স্টলগুলোর। এই লাল রঙে খুশি হতেন না তিনি। আবার লাল জার্সিই বিষণ্ণতায় ডুবে ফিরল। ক্রোট এবং ফরাসিদের জাতীয় পতাকার তিনটে রং একেবারে এক। ফুটবল জার্সির রং অনেক আলাদা।
নেপোলিয়ান বেঁচে থাকলে খুশি হতেন রাশিয়ায় ফরাসিদের বিশ্বজয়ের খবর শুনে। ভিআইপি বক্সে কত অভিভূত করা চরিত্র। উসেইন বোল্ট, দিয়েগো মারাদোনা, মিক জ্যাগার থেকে তোত্তি, দ্রোগবা, লাম, এটো, সুকের। গ্যালারিতে কোন দেশের জার্সি পরা মানুষ নেই? ব্রাজিলের সূর্যমুখী, আর্জেন্তিনার আকাশ নীল, জার্মানির রক্ত সাদা, পর্তুগালের মোহনবাগান, স্পেনের ইস্টবেঙ্গল সব রঙের জার্সি পরা মানুষ আনন্দের শরিক সেখানে। যেন নতুন চ্যাম্পিয়নকে কুর্নিশ করার জন্য হাজির সবাই। ‘আমরা পারিনি, তোমরা করে দেখাও’, বিশ্বক্রীড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনে সৌজন্য বড় করে দেখায় ‘দাদা’রা। ভাইয়েরা কী কম? কত দেশের জার্সি পরা মানুষ যে দেখলাম, যাঁরা বিশ্বকাপে খেলেন না, কিন্তু ফাইনালের শহরে, ত্রিভুবনের আনন্দযজ্ঞে পুজো দিতে এসেছেন। হংকং, গুয়াতেমালা, ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জ, হাইতি, সুদান, বাংলাদেশ, ভারত। সবার গায়ে জাতীয় টিমের জার্সি। শুধু ভারতীয়দের গায়ে একটাও জাতীয় টিমের জার্সি দেখলাম না। এঁদের অধিকাংশই ফিরলেন ক্রোয়েশিয়ার জন্য বুকের ভিতর দলা পাকানো একটা কষ্ট নিয়ে। ও সব পুরোনো কথা থাক। বিশ্বকাপ নতুনদের। ম্যাচের পর দিদিয়ের দেশঁকে আকাশে তুলে ছুড়ে দিচ্ছিলেন গ্রিয়াজমান-পোগবাদের নতুন প্রজন্ম। একজন আবার জল দিয়ে ধুইয়ে দিচ্ছিলেন দেশঁর মাথা।
বেকেনবাউয়ার, জাগালোকে ছোঁয়ার পক্ষে তিনিই উপযুক্ত কোচ। নতুন অনেক ফুটবলারকে দেশঁ যোগ্য বিশ্বজয়ী কোচের মতো প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেলেন। যে ভাবে তিনি মাঠের ভিতর গিয়ে প্রতিটি ক্রোট ফুটবলারকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন, তা এক ধাক্কায় তাঁর ভাবমূর্তি আইফেল টাওয়ার সমান করে দেয়। গতবার ইউরো ফাইনালে দেশঁ ভালো খেলেও কেঁদেছিলেন। মস্কো তাঁর প্রতি ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ দেখাল। পুরস্কার বিতরণের ঠিক আগে ফরাসি ফুটবলাররা গ্যালারি থেকে জাতীয় পতাকা নিয়ে গোটা মাঠ দৌড়ে বেড়ালেন বালকসুলভ। সাদা, কালো, বাদামি সব ফুটবলার এক রকম আনন্দে ভাসছিলেন ফরাসি সুগন্ধী ছড়িয়ে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ভিজে কাক। তবু নাচছেন। সত্তরে পেলের ব্রাজিলের গড় বয়স ছিল ২৫ বছর ৯ মাস। গ্রিয়াজমানদের ফরাসিদের গড় বয়স ২৫ বছর ১০ মাস। ফুটবল মানে কিন্তু অন্য শক্তিদের সঙ্গে ফ্রান্সকেও ধরুন। কুড়ি বছরে দুটো বিশ্বকাপ, একটা বিশ্বকাপ রানার্স, একটা ইউরো কাপ, একটা ইউরো রানার্স। জিজুদের মতো গ্রিজুরাও পরপর বিশ্বকাপ, ইউরো কাপ ফাইনাল খেললেন। তাই তাঁরা নাচ থামাচ্ছিলেন না বৃষ্টিতেও। ইন্টারনেটে তখন পরপর ভেসে আসছে প্যারিসের সঁজে লিজের রাজপথে হাজার হাজার ফরাসির এক হয়ে যাওয়ার ছবি। উদ্বাস্তু, শরণার্থী, আসল নাগরিক, নকল নাগরিক সব একাকার। সেই সময় মনে হল, রাশিয়ান বিপ্লবের শতবর্ষে বিশ্বকাপ আদর্শ জায়গায় গিয়েছে। নীল ঢেউ সমুদ্রের রং, তারুণ্যেরও।

সূত্রঃ এই সময়
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status