দেশ বিদেশ

ইবির শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁস

ইমরান শুভ্র, ইবি থেকে

১৬ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ১০:০৬ পূর্বাহ্ন

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের অডিও ফাঁস নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য ২০ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন এক প্রার্থী। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত চক্রের পরিচয়সহ শনিবার বেশকিছু অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। ইতিমধ্যে এই প্রতিবেদকের হাতে লেনদেন সংক্রান্ত ৪টি অডিও এসে পৌঁছেছে। পুরো অডিও থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক, শাখা ছাত্রলীগ, ঊর্ধ্বতন দুই প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি ও স্থানীয় এক সংসদ সদস্যের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলেছে।

সূত্র মতে, গত ১৩ই জুলাই ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হয়। এতে কুষ্টিয়ার এক স্থানীয় প্রার্থী নিয়োগের জন্য ২০ লাখ টাকা উৎকোচ দেন। এ লেনদেনে প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল। তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর ড. শাহাদত হোসেন আজাদ। তারা ইতিহাস বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং শাখা ছাত্রলীগের সঙ্গে নিয়োগের চুক্তি করেন। এদের মাধ্যমে ট্রেজারার হয়ে ভিসির সঙ্গে ওই প্রার্থীর নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করার চেষ্টা করেন। এছাড়া পুরো নিয়োগে প্রভাবশালী এক এমপির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল বলে ফাঁস হওয়া রেকর্ড থেকে জানা গেছে। চাকরি প্রার্থী ও তার স্বামীর ফোন রেকর্ডের এসব তথ্য পুরো ক্যাম্পাসে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ওই প্রার্থী নিয়োগ না পেলেও তাদের কথোপকথনে বিভিন্নভাবে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের প্রমাণ মিলেছে। এতে জানা যায়, প্রার্থী থেকে জুনিয়র ওই শিক্ষক টাকা নেন। তার থেকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। ৪টি রেকর্ডের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।

ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল ও প্রার্থী ফারজানা আক্তারের ১ম রেকর্ড: ফা: আসসালামু আলাইকুম স্যার। বি: হ্যা, দেখ বাবু আমি..। ফা: স্যার আমি তো আপনাদের কথা শুনে একদম ডিপেন্ডেবল। কালকে আপনারা আমাকে এত করে বললেন, জাহাঙ্গীর স্যার যখন বলল, আপনার মাধ্যমে টাকাটাও ডিল-ট্রিল করবে। আপনার কথা শুনে আমি একদম বিশ লাখ টাকাও হাতে ধরিয়ে দিলাম। তুলে দিলাম। আশা করলাম। স্যার কেন এমনটা করল? জাহাঙ্গীর হোসেন (ইতিহাসের সভাপতি) স্যার। বি: আরে বাবু, না না, আমি তো জাহাঙ্গীর স্যারের সঙ্গে কেবলই উঠে এলাম। এখন এই জিনিসটা মামুন ভাই (ফারজানার স্বামী) বারবারই জানতে চাচ্ছে। আমি তাকে জানাচ্ছিলাম না। কালকে সিন্ডিকেটের পরে জানাবো। কিন্তু আগে জানিয়েই আমি আরো বিব্রত হলাম দেখছি। ফা: জী স্যার, আপনি আমাকে কনফার্ম করলেন। তোমার এইটটি পার্সেন্ট হয়ে গেছে। অসুবিধা নেই। এর জন্য আপনি যখন যে শর্ত দিয়েছেন, টাকা দেয়া বলেন, জাহাঙ্গীর স্যারের কথা অনুযায়ী। কোন সত্যতা যাচাইও করতে যাইনি। আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে টাকাটা পে করে দিয়েছি। সব করে দিয়েছি স্যার।

২য় রেকর্ডে ড. বিকুল ও মামুনের কথোপকথন: বি: হ্যা, মামুন ভাই আমি বলছিলাম, হানিফ ভায়ের ওই ডিও লেটারের কপিটা কার কাছে? মা: হ্যা, আমার কাছে আছে। বি: আচ্ছা একটু কপিটা নিয়ে আসেন তো। মা: আমি টাকা নিতে চাচ্ছি না স্যার আল্লার দোহাই। বি: ধুর ওসব বাদ দেন তো রে ভাই। আপনি আমাকে ডিও লেটারটা দেন তো ভাই। মা: ওকে আমি নিয়ে আসতেছি। স্যার এখানে মনে হয় আপনাদের একটু ফল্ট হয়েছে। বেয়াদবি নিবেন না আমি একটু বলি স্যার। সেটা হচ্ছে, আপনি কালকে কিন্তু ইনশিউর করছেন যে, আপনি ছাত্রলীগকে টাকা দেবেন। কিন্তু আমি এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। বললো, ছাত্রলীগ হাতে কোন টাকা না পাওয়ার কারণে কাজ করে নাই। বি: না, আপনি আসেন মুখোমুখি বলছি। ওরা ক্যান্ডিডেট (প্রার্থী) নিয়েছে। ওরা তো এ ক্যান্ডিডেট (ফারজানাকে) নেয়নি। মা: হ্যা, ওরা ক্যান্ডিডেট নিয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু আপনি যদি টাকাটা দিতেন। বি: আগেই কনফার্ম হয়েছে। আপনি আসেন আমি ফোনে এতো কথা বলতে পারছি না। মা: আচ্ছা।

৩য় রেকর্ডে ড. বিকুল এবং মামুনের টাকা ফেরত নেবার স্থান নির্ধারণ হয়। এতে রাতের বেলা না নিয়ে সকালে টাকা ফেরত নেবার কথা বলেন মামুন। পরে ড. বিকুল তাকে রাতেই কুষ্টিয়া থেকে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দেবার নিশ্চয়তা দিয়ে ডেকে নেন।
৪র্থ রেকর্ডে প্রফেসর ড. আজাদ এবং ফারজানর ফোনালাপ: ফা: আপনি কি আজাদ স্যার বলছিলেন? আমি ফারজানা বলছিলাম, ক্যান্ডিডেট। আ: জি, জি বলো। ফা: কালকে আপনারা এত কিছু করলেন, আমাকে আশ্বস্ত করলেন, আম্মু তোমার চাকরি হয়ে গেছে। তুমি টেনশন করো না। আ: শোন শোন, সে ভাবেই কথাবার্তা ছিলো। কিন্তু জাহাঙ্গীর স্যার বললেন অন্যান্য বোর্ডে ভিসি এভাবে রোল প্লে করে না, জোর করে নেয় না। কিন্তু কালকে ভিসি রংপুরের একটা প্রার্থী নিয়েছে এবং সালেহ স্যারের যে ভাগনী, যেটা নেয়ার কথা ছিল না, যেটার বিষয়ে অনেক কম্পেলেন। রাবির জামায়াতের আমির সালেহ স্যারের শশুর। ওই মেয়েকে প্রক্টর ঢুকিয়েছে। ফা: কিন্তু স্যার, আমি আপনাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে টাকা-পয়সা সব পে করলাম, কথা সব ঠিক চলছিলো, স্যার আমিতো টাকা-পয়সা দিয়েছি ফেরত নেয়ার জন্য নয়, চাকরি নেয়ার জন্য দিয়েছি। আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে টাকাটা দিয়েছি। আপনারা চেয়ারম্যানের উপর চাপ প্রয়োগ করে এটা করবেন। কারণ চেয়ারম্যান (ড. জাহাঙ্গীর) স্যার নিজে আমাকে হ্যান্ডেল করেছে। চেয়ারম্যানের নিজের ক্যান্ডিডেট ছিলাম আমি। সে আপনাদের কথা আমাকে বলেছে, না হলে কি আমি আপনাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে পরতাম? আমি সব ডিল করলাম, আমি সব কিছু করলাম।

ফাঁস হওয়া রেকর্ড নিয়ে ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল বলেন, ‘আমার সাথে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। আমি উপকার করতে গিয়ে শত্রু হয়ে গেলাম। এখানে যা হয়েছে তা সম্পূর্ণই দুরভিসন্ধিমূলক।’ এ ব্যাপারে ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘টাকা লেনদেনের বিষয়ে আমি জানি না। বিকুল আমার কাছে এক প্রার্থী নিয়ে আসছিল হানিফের সুপারিশ নিয়ে। আমি বিষয়টি দেখবো বলেছিলাম।’ ভিসি প্রফেসর ড. রাশিদ আসকারী বলেন, ‘ঘটনাটি শুনেছি। আমি এর যথাযথ মুলোৎপাটন করবো। দুর্নীতিবাজ কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।’
অডিও ফাঁসের ঘটনায় তদন্ত কমিটি

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ লাখ টাকা লেনদেনের অডিও ফাঁসের ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। ইতিহাস বিভাগে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ তদন্তের জন্য এ কমিটি করেছে ভিসি ড. রাশিদ আসকারী।  রোববার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তিন সদস্যের ওই কমিটি করা হয়। রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে, কমিটিতে ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মাহবুবুর রহমানকে আহ্বায়ক এবং ছাত্র উপদেষ্টা প্রফেসর ড. রেজওয়ানুল ইসলাম ও ইংরেজি বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. আক্তারুল ইসলামকে সদস্য করা হয়েছে। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভিসি ড. রাশিদ আসকারী বলেন, ‘বর্তমান প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। অডিও ফাঁসের অভিযোগটি আমলে নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি করে দিয়েছি। প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status