প্রথম পাতা

ইতিহাস না পুনরাবৃতি লুঝনিকি স্টেডিয়ামে

সামন হোসেন, মস্কো (রাশিয়া) থেকে

১৫ জুলাই ২০১৮, রবিবার, ১০:৪৬ পূর্বাহ্ন

‘বাস্তিল ডে’ উপলক্ষে বর্ণিল সাজে সেজেছে গোটা ফ্রান্স। গতকাল এই দিনটিকে ঘিরে উৎসব হয়েছে। বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি জিতে জাতীয় দিবসের এই উৎসবকে রঙিন করতে চাইছেন ফরাসি ফুটবলাররা। ঘটাতে চাইছেন ১৯৯৮ সালের পুনরাবৃত্তি। এদিকে মাত্র পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলতে এসেই বিশ্বজয়ের খুব কাছে দাঁড়িয়ে ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলতে এসে সবাইকে চমকে দিয়েছিল তারা। বড় বড় দলগুলোকে পেছনে ফেলে সেবার তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৩তম স্থানে থাকা দলটিকে। এবার সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে নবম দল হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালের মঞ্চে ক্রোয়েশিয়া। নবম দেশ হিসেবে এই মঞ্চ থেকে ট্রফি নিয়ে ইতিহাস গড়তে চায় ক্রোয়াটরা। দুই দলের ট্রফি জয়ের প্রত্যাশার ফাইনাল আজ মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায়।

মস্কোর অলিতে গলিতে দেখা মিলবে ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকদের। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেট্রো কিংবা বাসে চলাচল করছে ওরা। দু’দলের সমর্থকদের মাঝে সেকি উত্তেজনা। উত্তেজনা দেখা দিয়েছে দু’দলের ফুটবলারদের মাঝেও। গতকাল লুঝনিকি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচের কথাতেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর তার নাকি রাতে ঘুমই হয়নি। সারারাত উৎসব করে কাটিয়েছে ক্রোয়াট ফুটবলাররা। পরক্ষণেই একটু গম্ভীর হয়ে যান দালিচ। ‘আমাদের ছোট্ট একটি দেশ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত  দেশটির জনগণের উৎসবের উপলক্ষ্য খুব একটা নেই।

আমরা ট্রফি জিতে অন্তত তাদের একটি উৎসবের উপলক্ষ্য এনে দিতে চাই। এজন্য যা যা করার দরকার মাঠে আমরা করবো’-বলেন তিনি। ১৯৯৮ সালের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে দালিচ বলেন, ২০ বছর আগে ওদের কাছে হেরেই আমাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল। এবার আশা করি সেটা হবে না। দলের ফুটবলারদের ফিটনেস নিয়ে দালিচ বলেন, আমরা টানা তিন ম্যাচ ১২০ মিনিট করে খেলেছি। অতিরিক্ত চাপের কারণে পেরিসিচসহ বেশ কয়েকজনের ছোটখাটো কিছু ইনজুরি সমস্যা ছিলো।

তবে দু’দিনের বিশ্রামে তারা এখন সুস্থ। ১৯৯২ সালে ক্রোয়েশিয়া যখন স্বাধীনতা পেয়েছিল তখন লুকা মদরিচের বয়স ছিল মাত্র ছ’বছর। তিনি বড় হয়েছেন তুমুল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম দেখে। সার্বিয়ান বাহিনী মদরিচের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এমনকী তার দাদাকেও জীবন দিতে হয়েছিল এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। পেরিসিচ সুইজারল্যান্ডে এবং মানজুকিচ জার্মানিতে রিফিউজি হয়ে তাদের পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সুতরাং ক্রোয়েশিয়ার এই সোনালি প্রজন্মের ফুটবলারদের কারও শৈশবই মসৃণভাবে এগোয়নি। একমাত্র ফুটবলই এদের জীবন বদলে দিতে পেরেছে।

সেটা স্মরণে এনেই মাত্র ৪২ লাখ জনসংখ্যার দেশের প্রতিনিধি হয়ে মাঠে নামার কথা বলেন ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক লুকা মদরিচ। বাছাই পর্বে গ্রিসের সঙ্গে প্লে-অফ খেলে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া ক্রোয়েশিয়া গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ওঠে দ্বিতীয় রাউন্ডে। এরপর টানা তিনটি ম্যাচ ১২০ মিনিট খেলে জয় ছিনিয়ে এনেছে ক্রোয়েশিয়া। আজ অবধি কোনো দল নকআউট পর্বের তিন ম্যাচ অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত খেলে জিতে ফাইনালে পৌঁছতে পারেনি। সেদিক থেকে ইতিমধ্যেই ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ক্রোয়েশিয়া। ফাইনালে অনন্য নজির স্থাপনের দিকে নজর তাদের।

জাতীয় দিবসের প্যারেড মানের ফুটবলারদের সরব উপস্থিতি। গতকাল ছিলো ফ্রান্সের জাতীয় দিবস ‘বাস্তিল ডে’। এবার বিশ্বকাপের কারণে বাস্তিল ডে’র প্যারেডে থাকতে পারেননি গ্রিজম্যান, জিরুরা। তবে ট্রফি জিতে ফিরতে পারলে তাদের নিয়ে আবার প্যারিসে প্যারেড হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ফ্রান্স সরকার। এটাকে বিরাট সম্মান হিসেবে দেখছেন ফরাসি ফুটবলাররা। এ নিয়ে ফরাসি সংবাদ মাধ্যমে গ্রিজম্যান বলেন, এমন একটি দিনের জন্য আমরা সকলে মুখিয়ে আছি।

ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে এর বাস্তবে রূপ দিবো। গ্রুপ পর্ব থেকে অপরাজিত থেকে নকআউট পর্বে উঠেছে ১৯৯৮ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। রাউন্ড অব-১৬-এ আর্জেন্টিনাকে ৪-৩ গোলে এবং কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়েকে ২-০ গোলে হারিয়ে সেমির টিকিট কাটে। সেমিফাইনালে দারুণ ফর্মে থাকা বেলজিয়ামকে হারিয়ে গত ২০ বছরে তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে ওঠে ফরাসিরা। আর এই তিন ফাইনালের সাক্ষী ফ্রান্সের বর্তমান কোচ দিদিয়ের দেশম।

১৯৯৮ সালে অধিনায়ক হিসেবে দেশকে ট্রফি উপহার দিয়েছেন। ২০০৬ সালে ইতালির কাছে হেরে যাওয়া ফাইনালে দলে ছিলেন সাবেক এই তারকা ফুটবলার। এবার কোচ হিসেবে ট্রফি জয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দেশম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফাইনাল অনেক বড় ম্যাচ। এতে অনেক চাপ থাকে। যারা চাপ সামলে নিজেদের মেলে ধরতে পারবে, তারাই সোনালি ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরতে পারবে। গত তিনদিন অনুশীলনে আমি ফুটবলারদের সেটাই অনুধাবন করানোর চেষ্টা করেছি।

আমার বিশ্বাস মাঠে আমার শিষ্যরা ঠিক কাজটি করবে। দেশমের অন্যতম ভরসার জায়গা হচ্ছেন তরুণ কিছু ফুটবলাররা। বিশেষ করে কিলিয়ান এমবাপ্পে এই বিশ্বকাপে শিহরণ জাগানো এক খেলোয়াড়। অবিশ্বাস্য গতি আর দক্ষতার জন্য নজর কেড়েছিলেন বিশ্বকাপের আগেই। আর বিশ্বকাপে এসে ১৯ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড যেন আরো পরিপক্ব।

শেষ ষোলোয় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তার জোড়া গোল তাকে স্থান দিয়েছে রেকর্ড বুকে। ৩ গোল করা এ ফরাসি কিশোর বিশ্বকাপে ফিরিয়ে এনেছেন পেলের স্মৃতি। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে পেলের পর প্রথম ‘কিশোর’ ফুটবলার হিসেবে এবার ন্যূনতম দুটি গোল করেন এমবাপ্পে। এছাড়া ফ্রান্সের আন্তোইন গ্রিজম্যান, পল পগবার দিকেও নজর থাকবে। বিশ্বকাপে ইভান রাকিটিচের অবদানও কম না। ক্রোয়েশিয়ার ফাইনালে ওঠার পেছনে অসামান্য অবদান রয়েছে মদ্রিচের।

৩২ বছর বয়সী এই ক্রোয়াট মিডফিল্ডার এই বিশ্বকাপে করেছেন ২ গোল। শেষ ষোলোয় ডেনমার্কের বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে পেনাল্টি মিস করলেও টাইব্রেকারে লক্ষ্যভেদ করে তা পুষিয়ে দিয়েছেন। রাশিয়া বিশ্বকাপে সবচেয়ে ‘দৌড়ানো খেলোয়াড়টিও মদরিচ। ক্রোয়েশিয়ার এই ৬ ম্যাচে তিনি দৌড়েছেন ৬৩ কিলোমিটার। এখানেই শেষ নয়। দলের এই ৬ ম্যাচের ৩টিতেই ম্যাচসেরা হয়েছেন মদরিচ। এই বিশ্বকাপে আর কোনো খেলোয়াড়ই ৩ বার ম্যাচসেরা হতে পারেননি। এখন তরুণ অভিজ্ঞতার এই লড়াইয়ে শেষ হাসি কে হাসে সেটাই এখন দেখার বিষয়। ইতিহাস কিংবা পুনরাবৃত্তির এই ফাইনাল দেখতে আজ লুঝনিকিতে হাজির হবেন ৮৫ হাজার দর্শক।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status