প্রথম পাতা
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে একই সূত্রে গাঁথা
কূটনৈতিক রিপোর্টার
১৫ জুলাই ২০১৮, রবিবার, ১০:৪৬ পূর্বাহ্ন
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন- বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা এবং অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে একই সূত্রে গাঁথা। ঢাকার উদ্দেশে দিল্লি ছাড়ার মুহূর্তে দেয়া এক টুইট বার্তায় তিনি এ কথা বলেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকায় আসা রাজনাথ সিং গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সরকার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর অপর টুইট বার্তায় তিনি বলেন- ‘আজ ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে।
আমরা অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে রাজনাথ সিং তার নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে একসঙ্গে দু’টি টুইট করেন। সেখানে তার বার্তাটি ছিল এ রকম- ‘তিন দিনের সফরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করছি। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা এবং অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে একই সূত্রে গাঁথা।
বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধনকে ভারত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করে। দুই দেশের স্থল সীমান্ত এবং সমুদ্র সীমায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছি। বন্ধুত্ব ও আস্থার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আমাদের এ সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করতে এখন কেবলই সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছি।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গতকাল দুপুরে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে যান। সেখানে ভারত সরকারের অর্থায়নে নির্মিত অত্যাধুনিক ফরেনসিক ল্যাবের উদ্বোধন করেন। ঢাকায় ফিরে সন্ধ্যায় বিজিবি সদর দপ্তর পরিদর্শন করেন। সেখানে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আয়োজিত নৈশভোজে অংশ নেন।
আজ সকালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। পরে তিনি পূজা দিতে যাবেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। এরপর যাবেন সচিবালয়ে। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠকে অংশ নেবেন। ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে- নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সহযোগিতা এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যৌথ নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় এবং আনুষ্ঠানিক ওই বৈঠকে।
আলোচনায় সমস্যার সমাধান চায় বাংলাদেশ- প্রধানমন্ত্রী: এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশ সবসময় আলোচনার মাধ্যমে এ অঞ্চলের সকল সমস্যা সমাধান করতে চায়। বাংলাদেশ সফররত ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ গতকাল সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত প্রেস সচিব নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তিসহ বিভিন্ন চুক্তি বাস্তবায়ন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ, তার ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে কখনোই কোনোভাবেই কোনো সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করতে দেবে না। বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতসহ কোনো প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদী কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদ সমূলে উৎপাটনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে আঞ্চলিক পর্যায়ে আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকলে এ সামাজিক ব্যাধিকে মোবাবিলা করা সম্ভব।
তবে তিনি বলেন, এ অঞ্চলের কোনো কোনো দেশের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে রাজনাথ সিং বলেন, ৭.৭৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভবত বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং দ্রুত বর্ধনশীল জিডিপি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠকের কথা স্মরণ করে বলেন, সে বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছিল।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল সেক্রেটারি বর্ডার ম্যানেজমেন্ট ব্রজরাজ শর্মা, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রীংলা এবং বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দীন আহম্মদ চৌধুরী এবং পুলিশের আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের নিজ গৃহে স্থায়ীভাবে ফেরাতে সহায়তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভারত: ওদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সাক্ষাতের বিষয়ে হাইকমিশনের তরফেও একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের নিরাপদ, দ্রুত এবং স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ভারতের অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইন থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের বাসিন্দাদের বিষয়ে আলোচনার বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উল্লেখ ছিল না। হাইকমিশনের ভাষ্য মতে, ভারতের গৃহমন্ত্রী শ্রী রাজনাথ সিং ১৪ই জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। উভয় পক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে ওই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। গৃহমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠানো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁছে দেন।
ভারতের গৃহমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনীতির ৭.৭৮% এর অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- ভারত ও বাংলাদেশ একযোগে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদ প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করে বিশেষ সাফল্য লাভ করেছে বলে দুইনেতা উল্লেখ করেন। যে সব দেশ সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদ দ্বারা আক্রান্ত তাদেরও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগুলো সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধে কাজ করা উচিত। গৃহমন্ত্রী (রাজনাথ সিং) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সরকারের নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবিলায় সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
দুই নেতা গত একবছরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের বিষয়ে আলোচনা করেন। ভারতের গৃহমন্ত্রী এই বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের নিজ বাসস্থানে দ্রুত, নিরাপদে ও স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়ার জন্য সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানান। এই প্রসঙ্গে, ভারত রাখাইন রাজ্যে প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড হাউজিং নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্পে কাজ করছে, যাতে বাস্তুহারা মানুষগুলোর প্রয়োজন মেটাতে পারে।
ভারত সরকার ত্রাণ সামগ্রী ও সরবরাহ প্রদান অব্যাহত রাখবে, যাতে বাংলাদেশ সরকার ত্রাণ ক্যাম্পে তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যৌথভাবে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ভবন উদ্বোধন করেন। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
এটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি উন্নয়ন সহযোগিতা প্রকল্প। নতুন উদ্বোধনকৃত এই ভবনে রয়েছে অত্যাধুনিক ফরেনসিক ল্যাবরেটরি, ছদ্ম অপরাধ দৃশ্য, নকল থানা, কম্পিউটার ল্যাবসহ আইটি সেন্টার। সেখানে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনায় পারস্পরিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা এবং প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী বিনিময়ের জন্য হায়দরাবাদের সরদার বল্লভভাই প্যাটেল ন্যাশনাল পুলিশ একাডেমি এবং রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির মধ্যে একটি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে জানিয়ে হাইকমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- সরদার বল্লভভাই প্যাটেল ন্যাশনাল পুলিশ একাডেমির পরিচালক শ্রীমতি ডি আর ডলি বর্মণ ও বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নজিবুর রহমান, এনডিসি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। এটি বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের জন্য ভারতে আয়োজিত সক্ষমতা বর্ধন কর্মসূচিগুলোতে অন্যমাত্রা যোগ করবে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে
স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী থেকে জানান, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ‘আজ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। আর এ সম্পর্কের বর্তমান অবস্থাকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সোনালী অধ্যায় বলে আখ্যায়িত করেছেন’। গতকাল দুপুরে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে তিনি একথা বলেন।
তিনি বলেন, দুটি দেশ অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধনে এক বিশেষ সম্পর্ক বহন করে। ভবনটির নামই বলে দিচ্ছে আমাদের সম্পর্কের মূল সুর। তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসী শক্তির মোকাবিলায় সবসময় হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ প্রশংসা করছি।
রাজনাথ সিং আরো বলেন, আমি খুশি যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীসমূহকে প্রশিক্ষণ দিতে আমাদের সহযোগিতামূলক কর্মসূচি ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে আমরা বাংলাদেশের ৬৮১ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বাংলাদেশ যদি চায়, আমরা আরো এব্যাপারে সাহায্য করতে পারলে খুশি হবো।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদার অধ্যক্ষ মজিবুর রহমান, ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রীংলা ও রাজশাহীস্থ সহকারী হাইকমিশনার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
আমরা অভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে রাজনাথ সিং তার নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে একসঙ্গে দু’টি টুইট করেন। সেখানে তার বার্তাটি ছিল এ রকম- ‘তিন দিনের সফরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করছি। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা এবং অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে একই সূত্রে গাঁথা।
বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধনকে ভারত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করে। দুই দেশের স্থল সীমান্ত এবং সমুদ্র সীমায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছি। বন্ধুত্ব ও আস্থার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আমাদের এ সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করতে এখন কেবলই সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছি।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গতকাল দুপুরে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে যান। সেখানে ভারত সরকারের অর্থায়নে নির্মিত অত্যাধুনিক ফরেনসিক ল্যাবের উদ্বোধন করেন। ঢাকায় ফিরে সন্ধ্যায় বিজিবি সদর দপ্তর পরিদর্শন করেন। সেখানে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আয়োজিত নৈশভোজে অংশ নেন।
আজ সকালে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করবেন। পরে তিনি পূজা দিতে যাবেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। এরপর যাবেন সচিবালয়ে। সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠকে অংশ নেবেন। ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে- নিরাপত্তা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, অবৈধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সহযোগিতা এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যৌথ নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় এবং আনুষ্ঠানিক ওই বৈঠকে।
আলোচনায় সমস্যার সমাধান চায় বাংলাদেশ- প্রধানমন্ত্রী: এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশ সবসময় আলোচনার মাধ্যমে এ অঞ্চলের সকল সমস্যা সমাধান করতে চায়। বাংলাদেশ সফররত ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ গতকাল সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন। সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত প্রেস সচিব নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তিসহ বিভিন্ন চুক্তি বাস্তবায়ন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ, তার ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে কখনোই কোনোভাবেই কোনো সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করতে দেবে না। বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতসহ কোনো প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদী কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদ সমূলে উৎপাটনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে আঞ্চলিক পর্যায়ে আলোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকলে এ সামাজিক ব্যাধিকে মোবাবিলা করা সম্ভব।
তবে তিনি বলেন, এ অঞ্চলের কোনো কোনো দেশের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে রাজনাথ সিং বলেন, ৭.৭৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভবত বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং দ্রুত বর্ধনশীল জিডিপি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠকের কথা স্মরণ করে বলেন, সে বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছিল।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল সেক্রেটারি বর্ডার ম্যানেজমেন্ট ব্রজরাজ শর্মা, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রীংলা এবং বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দীন আহম্মদ চৌধুরী এবং পুলিশের আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের নিজ গৃহে স্থায়ীভাবে ফেরাতে সহায়তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভারত: ওদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সাক্ষাতের বিষয়ে হাইকমিশনের তরফেও একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের নিরাপদ, দ্রুত এবং স্থায়ীভাবে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ভারতের অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইন থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের বাসিন্দাদের বিষয়ে আলোচনার বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উল্লেখ ছিল না। হাইকমিশনের ভাষ্য মতে, ভারতের গৃহমন্ত্রী শ্রী রাজনাথ সিং ১৪ই জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। উভয় পক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে ওই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। গৃহমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠানো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁছে দেন।
ভারতের গৃহমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনীতির ৭.৭৮% এর অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- ভারত ও বাংলাদেশ একযোগে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদ প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করে বিশেষ সাফল্য লাভ করেছে বলে দুইনেতা উল্লেখ করেন। যে সব দেশ সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদ দ্বারা আক্রান্ত তাদেরও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগুলো সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধে কাজ করা উচিত। গৃহমন্ত্রী (রাজনাথ সিং) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সরকারের নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবিলায় সহযোগিতার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
দুই নেতা গত একবছরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের বিষয়ে আলোচনা করেন। ভারতের গৃহমন্ত্রী এই বাস্তুচ্যুত বাসিন্দাদের নিজ বাসস্থানে দ্রুত, নিরাপদে ও স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়ার জন্য সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানান। এই প্রসঙ্গে, ভারত রাখাইন রাজ্যে প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড হাউজিং নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্পে কাজ করছে, যাতে বাস্তুহারা মানুষগুলোর প্রয়োজন মেটাতে পারে।
ভারত সরকার ত্রাণ সামগ্রী ও সরবরাহ প্রদান অব্যাহত রাখবে, যাতে বাংলাদেশ সরকার ত্রাণ ক্যাম্পে তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারে। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যৌথভাবে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ভবন উদ্বোধন করেন। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।
এটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি উন্নয়ন সহযোগিতা প্রকল্প। নতুন উদ্বোধনকৃত এই ভবনে রয়েছে অত্যাধুনিক ফরেনসিক ল্যাবরেটরি, ছদ্ম অপরাধ দৃশ্য, নকল থানা, কম্পিউটার ল্যাবসহ আইটি সেন্টার। সেখানে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনায় পারস্পরিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা এবং প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী বিনিময়ের জন্য হায়দরাবাদের সরদার বল্লভভাই প্যাটেল ন্যাশনাল পুলিশ একাডেমি এবং রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির মধ্যে একটি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে জানিয়ে হাইকমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- সরদার বল্লভভাই প্যাটেল ন্যাশনাল পুলিশ একাডেমির পরিচালক শ্রীমতি ডি আর ডলি বর্মণ ও বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নজিবুর রহমান, এনডিসি সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। এটি বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের জন্য ভারতে আয়োজিত সক্ষমতা বর্ধন কর্মসূচিগুলোতে অন্যমাত্রা যোগ করবে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে
স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী থেকে জানান, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ‘আজ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। আর এ সম্পর্কের বর্তমান অবস্থাকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সোনালী অধ্যায় বলে আখ্যায়িত করেছেন’। গতকাল দুপুরে রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে তিনি একথা বলেন।
তিনি বলেন, দুটি দেশ অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবার ও আত্মীয়তার বন্ধনে এক বিশেষ সম্পর্ক বহন করে। ভবনটির নামই বলে দিচ্ছে আমাদের সম্পর্কের মূল সুর। তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসী শক্তির মোকাবিলায় সবসময় হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ প্রশংসা করছি।
রাজনাথ সিং আরো বলেন, আমি খুশি যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীসমূহকে প্রশিক্ষণ দিতে আমাদের সহযোগিতামূলক কর্মসূচি ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে আমরা বাংলাদেশের ৬৮১ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বাংলাদেশ যদি চায়, আমরা আরো এব্যাপারে সাহায্য করতে পারলে খুশি হবো।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদার অধ্যক্ষ মজিবুর রহমান, ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রীংলা ও রাজশাহীস্থ সহকারী হাইকমিশনার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়।