বাংলারজমিন
ঢাকার ওভারব্রিজে আশ্রয় নেয়া পরিবারটির ঠাঁই হলো পাঁচগাছিতে
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে
১৫ জুলাই ২০১৮, রবিবার, ৯:০৫ পূর্বাহ্ন
ঢাকায় ওভারব্রিজে আশ্রয় নেয়া অসুস্থ মা, তার স্বামী ও সন্তানদের অবশেষে ঠাঁই হলো কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নে। জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুক্রবার সকাল ১১টায় পরিবারটিকে সদর ইউএনও আমিন আল পারভেজ, এনডিসি সুদীপ্ত কুমার সিংহ এবং কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু তাদের পাঁচগাছিতে নিয়ে যান। এরআগে রাতের কোচে ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন ঢাকাস্থ কুড়িগ্রাম সমিতির মহাসচিব সাদুল আবেদীন ডলার। সকাল সাড়ে ৭টায় পরিবারটি কুড়িগ্রাম শহরে পৌঁছলে তাদের কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবে নিয়ে আসা হয়। এখানে নিজের জীবনের কথা শোনান ফরিদা বেগম (৪০) ও তার স্বামী আনছার আলী (৬০)। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ইসলামপুর মৌজার মরাকাটি গ্রামে বাড়ি ছিল ফরিদার স্বামী আনছার আলীর। ছিল দুই একর ধানী জমি। দুধের ব্যবসা করে ভালোই চলছিল পরিবারটি। চরের মধ্যে প্রতিদিন ২ মণ দুধ সংগ্রহ করে ১৫ কিলোমিটার বাই-সাইকেল মাড়িয়ে কুড়িগ্রাম শহরে হোটেলগুলোতে সরবরাহ করত সে। এভাবেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন ২০১৬ সালে একমাসের মধ্যে বাড়িঘর, আবাদি জমি সব গ্রাস করে ফেলে। গৃহহীন হয়ে পরে গৃহস্থ পরিবারটি। তাদের সঙ্গে দেড়শ পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে ফেলে। শেষে আশ্রয় মেলে ইসলামপুরে জ্যাঠাত ভাইয়ের গোয়ালঘরে। সেখানে একমাস থাকার পর ৪০ হাজার টাকা ঋণের দায়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। অভাবের কারণে কেউ ধার দেনাও দিচ্ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে অনিশ্চিত ভাগ্যের আশায় ঢাকায় চলে আসে পরিবারটি। ফরিদা বেগম জানান, বাবারে অনেক কষ্টের জীবন মোর। জন্মের ৭ দিনের মাথাত মোর মাও বলে মরি যায়। জন্মিয়া শোনং মোর বাপ নাই। মরিগেইছে না বাছি আছে তাও জানোং না। কাইয়ো খোঁজ দিবার পায় নাই। মা মরা, বাপ হারা এতিম ছওয়ার কাইয়ো দায়ভার নেয় নাই। পাঁচ বছর বয়সোত অভাবোত পরি মোর নানি কুলসুম আর খালা তারামনি মোক সিতাইঝাড়োত ছিন্নমুকুল এনজিওত থুইয়া আইসে। সেটে সাত বছর থাকপের পর ক্লাস ছিকসোত পড়বের সময় ছিন্নমুকুল ভাঙি দেয়। মুই নানির বাড়িত ফিরি আইসং। সেটে মোর বিয়ে দেওয়া হয়। তিন মাসের মাথাত মোর বিয়া ভাঙি যায়। ইয়ার দুই বছর পর আনছার আলীর সাথে মোর বিয়াও হয়। ওমারও এটা দ্বিতীয় বিয়াও। ওমার প্রথম বউ আমেনা ডায়রিয়া হয়া মরি যায়। এই হলো ভাঙনকবলিত আনছার আলী আর ফরিদা বেগমের জীবন কাহিনী। অভাব-অনটন আর মাথা গোজার ঠাঁই না পেয়ে তারা নভেম্বর মাসে ঢাকায় পাড়ি দেয়। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শেষে আশ্রয় নেয় কলাবাগান ওভারব্রিজের নিচে পলিথিন বিছিয়ে। এখানে ধানমণ্ডি ক্লাবে দাড়োয়ান জামালের সহযোগিতায় মাঠের পাতা কুড়ার কাজ করে দিনে আয় হয় দুশো থেকে আড়াইশ টাকা। সেই অর্থেই চলছিল মানবেতর জীবন যাপন। মাঝখানে কাজটাও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় প্রায় না খেয়ে থাকতে হচ্ছিল পরিবারটিকে। সন্তানদের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ শরীর নিয়ে নিজেই ভিক্ষাবৃত্তি করতে বেড়িয়ে পড়েন ফরিদা বেগম। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে আকলিমা (১১) একজন প্রতিবন্ধী (বামন), দ্বিতীয় কন্যা সন্তান আখিতারা (৭) কে তারা গ্রামের বাড়িতে চাচির কাছে রেখে এসেছেন। একমাত্র ছেলে ফরিদুল (সাড়ে ৩) তাদের কাছে থাকে। ফরিদা বেগম জানান, ঘটনার দিন দু’সন্তানকে নিয়ে কলাবাগান থেকে ল্যাব এইডের দিকে ভিক্ষা করতে বের হন। অসুস্থ শরীর নিয়ে বের হওয়ার ফলে ল্যাব এইডের কাছে অসুস্থ হয়ে ফুটপাতেই পরে যান তিনি। সেই স্মৃতি মনে করে ফরিদা বেগম জানান, ছওয়া দুইটা না খায়া আছে। মা হয়া কেমন করি বসি থাকং। অসুস্থ শরীর নিয়া ভিক্ষা করার জন্যে বের হয়া পড়ং। ঘোড়ের মইধ্যে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় চোখমুখ আন্ধার দেখি সেটেই উল্টি পড়ং। মনে হবার নাগছিল আজক্যা মনে হয় মোর শ্যাষ দিন। বড় বেটি মোক ধরি থাকে। আর ছোট বেটা মাথাত পানি ঢালে। তারপর কি হইল কাই জানে। মোক পরদিনোত লোকজন হাসপাতালোত নিয়ে যায়। এ্যালা ডিসি আফা হামাক কুড়িগ্রাম আইনছে। দোযখ থাকি বাচি গেইলোং। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া কুড়িগ্রামের এই পরিবারটির ভরন-পোষণের দায়িত্ব নেন জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন। সন্তানসহ পুরো পরিবারটি কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবে আসলে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র দেন সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম। এ সময় প্রাথমিকভাবে পরিবারটির খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, লবণসহ সমস্ত উপকরণ সরবরাহ করেন কুড়িগ্রাম গণকমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন জানান, সরকার প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সবার উচিৎ সরকারের এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ানো। অসহায় ফরিদার পরিবারকে জমিসহ স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। একই সঙ্গে করা হবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও।