ফেসবুক ডায়েরি

মা'র কাছে শিখেছিলাম, কাউরে ভাতের খোটা দিতে নাই

রাজু নুরুল

১৪ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ৩:২২ পূর্বাহ্ন

রাতে ভাল ঘুম হয় নাই। প্রায় সারা রাত জেগে ছিলাম। এটা শরীর খারাপের জন্য হতে পারে। কয়েকদিন ধরেই সিজনাল অসুখ-বিসুখে ভুগছি। কিন্তু সারারাত ধরেই একটা বিষয় মাথার মধ্যে ঘুরেছে। কোনমতেই সেটা হজম হচ্ছে না। যখনই মনে পড়ছে, তখনই শরীর গুলিয়ে উঠছে। সম্ভব হলে দীর্ঘ সময় ধরে যদি বমি করে সব অপমান ঝেড়ে ফেলতে পারতাম?
আমি এই দেশের আশীর্বাদপুষ্ট মানুষগুলোর একজন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে, কলেজ, ইউনিভার্সিটি- সবই প্রায় নামমাত্র খরচে পড়ালেখা করে বড় হয়েছি। স্কুল-কলেজে বেতনের কথাতো অপ্রাসঙ্গিক, বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন ছিল ৫ টাকা! প্রতি বেলা খাবারের দাম ছিল ৮ টাকা।
খাবার মানে, যত ইচ্ছা ভাত, গামলা ভরা ডাল, আর এক পিস মাছ অথবা মাংস! মাছ এতো সুক্ষ্ম করে কাটা হতো যে, আমরা মজা করে 'ব্লেড দিয়ে কাটা হইছে' বলে খোঁচাখুঁচি করতাম। তবুও এই খাবারটা বহু ছেলেমেয়ের কাছেই অমৃত সমান লাগতো!
দুপুরে হলের ডাইনিংয়ে খাবার শুরু হতো ঠিক একটায়। চলতো দুইটা পর্যন্ত! তার মিনিট দশেক আগেই, বেশ কয়েকজন গিয়ে ডাইনিংয়ে বসে থাকতো! খাবার দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা প্লেট ভরে ভাত নিয়ে সেখানে ওই একবাটি তরকারির পুরোটা ঢেলে দিয়ে একপাশ থেকে খাওয়া শুরু করতো! এই পরিমাণ ভাত প্লেটে নিতো যে, মনে হতো প্লেট উপচে পড়বে, অথবা ও যদি এখনই ভাত দিয়ে প্লেট ভরে না রাখে, তাহলে অন্য কেউ নিয়ে নেবে।
আসলে ঘটনাটা অন্য। এদের প্রায় অনেকেরই পকেটে সকালে নাস্তা করার টাকা থাকতো না। সাড়ে আটটায় শুরু করে, প্রায় ১টা পর্যন্ত না খেয়ে ক্লাস করে ক্লান্ত হয়ে হলে ফিরেই দুপুরের খাবারের জন্য অপেক্ষা করতো। এদের অনেককেই চিনতাম, ডাইনিংয়ের ওই দুই বেলা খাবারই ছিল যাদের দিনের একমাত্র খাবার। এই খাবারটুকু ছিল বলেই এরা দরিদ্র, কৃষক, শ্রমজীবী পরিবার থেকে ইউনিভার্সিটির মতো বিশ্ব পরিমণ্ডলে পা রাখার সাহস করেছে! আর এটাই হলো রাস্ট্রের সৌন্দর্য! রাস্ট্র থাকে বলেই এটা সম্ভব হয়।
আমরা তখন জানতাম, এই খাবারের অতিরিক্ত যে দাম, সেটা আসে জনমানুষের দেয়া খাজনা, কর, বিদেশী অনুদান- এসব থেকে। এটাও জানতাম যে, এডুকেশন কিংবা হেলথ এর মতো বিষয়গুলোর দায়িত্ব সবসময় রাস্ট্রকেই নিতে হয়। ব্যক্তিমালিকানায় গেলে তাতে ব্যবসা ঢুকে যায়। শিক্ষা বা স্বাস্থ্য নিয়ে আর যাই হোক, ব্যবসা চলে না।
কৃষক তার সামান্য এক টুকরো ধানী জমি, এক চিলতে পুকুরের জন্য বছরে একবার খাজনা দেয়, বাড়িওয়ালা তার বাড়ির জন্য কর দেয়। পায়ের স্যান্ডেল থেকে মাথার ক্লিপ, যা কিছু কিনতে যাই- সেখানেই ট্যাক্স/ ভ্যাট দিতে হয়। এই ট্যাক্স জন্ম থেকে মৃত্যুর খরচ পর্যন্ত- সবখানে বহাল আছে। কারো বছরে আয় আড়াই লাখের উপরে হলেই ট্যাক্স দিতে হয়। বেতন যত বেশি, ট্যাক্সও তত বেশি!
যেই ছেলেটা ওই হাভাতের মতো ভাত উপচে পড়া প্লেট নিয়ে দুপুরে খেতে বসতো, সে একদিন বড় হয়। ওর টাকায় ওর ছোট ভাই বোনেরা একইরকম হাভাতের মতো দুপুরে প্লেট ভরে ভাত আর ডাল খায় সারা দেশের অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং হলে। ভাত আর ডাল খেয়ে ক্লাসে যায়, গণরুমে শুয়ে দেশটাকে বদলে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়। রাষ্ট্র শুধু কুশীলবের ভূমিকা পালন করে। মধ্যস্থতার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব রাস্ট্র তার পক্ষ থেকে একটা সরকারকে দেয়! আর কিছু না। ব্যস! এইটুকুই!
আমরা জানতাম, এইযে হাজারো ছেলেমেয়ে গণরুমে অমানবিক জীবন যাপন করে, প্রায় খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়, দিনের পর দিন ভাত-ডাল আর নলা মাছের ঝোল খেয়ে দেশ বদলের আশা বুনে, তারজন্য নিশ্চয় রাষ্ট্র লজ্জিত! আমাদের ধারণা ভুল। আমরা জানলাম, রাষ্ট্র দাবি করছে এই টাকা তার নিজের। অতএব তার টাকা খেয়ে লাফালাফি করা যাবে না। লাফালাফি করলে তার টাকা ফেরত দিতে হবে। কার টাকা?
মানুষ নাকি খুব বিপদে পড়লে অন্যের কাছে হাত পাতে। আমার মা'র কাছে খুব ছোটবেলায় শিখেছিলাম, কাউরে ভাতের খোটা দিতে নাই। ভাতের দায় নাকি বড় দায়! সেই দায় কিন্তু আমরা শোধ করছি। দেশের মানুষের জন্য কাজ করছি। সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না। এই দেশের লাখো মানুষ পৃথিবীর নানা দেশে কুলি মজুরের কাজ করে কোটি কোটি ডলার দেশে পাঠায়। সেই টাকায় তার স্বজনেরা পেট ভরে ভাত খায়!
সেই টাকাই কিন্তু লুটপাট হয়, রিজার্ভ চুরি হয়, পুকুর চুরি হয়, ব্যাংক নিজেই চুরির গর্তে হারিয়ে যায়, ৭৫ হাজার টাকার মোবাইল আমদানির প্রস্তাব হয়। এই গোটা টাকাটা আমাদের! আমাদের সুবিধা হলো, আমরা কাউকে খোটা দেই না। কখনো দেবোও না! কারণ, আমরা এই দেশটাকে কোন কিছু না পাওয়ার বিনিময়ে ভালবাসি!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status