দেশ বিদেশ

ভ্যাট ফাঁকি রোধে আসছে নতুন প্রযুক্তি

এমএম মাসুদ

১৪ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ৯:৪৭ পূর্বাহ্ন

মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আদায়ে ফাঁকি রোধ ও রাজস্ব আহরণ বাড়াতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। খুব শিগগিরই নতুন এই প্রযুক্তি অর্থাৎ ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস বা ইএফডি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই সিস্টেমে কেন্দ্রীয়ভাবে সরাসরি মনিটরিং করা যাবে সারা দেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, নতুন সিস্টেম চালু করার জন্য পরিবর্তন করতে হবে চলমান ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) মেশিন। বর্তমানে বুলগেরিয়া, জর্জিয়া ও চীনের ২৪টি প্রদেশসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ডিভাইস ব্যবহারে এসেছে সফলতা। এনবিআর ওই উদাহরণকে সামনে নিয়ে এই সিস্টেমকে বাস্তবায়ন করতে চায়। এনবিআর মনে করছে, নতুন এ সিস্টেম বাস্তবায়ন করতে পারলে একদিকে ব্যবসায়িক লেনদেনে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি মূসক আদায় বৃদ্ধি পাবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। এ সিস্টেম চালু হলে ক্রেতা বা বিক্রেতার লেনদেনের তথ্য সরাসরি এনবিআরের কাছে আসবে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সব তথ্য এক জায়গায় বসে পর্যবেক্ষণ করা।

এনবিআর সূত্র মতে, ভোক্তার কাছ থেকে আদায়কৃত ভ্যাট ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো সরকারের কোষাগারে জমা দিচ্ছে না, এমন পর্যবেক্ষণ থেকেই ২০০৮ সালে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইসিআর বাধ্যতামূলক করে একটি সাধারণ আদেশ জারি করে এনবিআর। তবে ভ্যাট আদায়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইসিআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করলেও স্বয়ংক্রিয় মনিটরিং বা অটোমেশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তা ভেস্তে যেতে বসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এজন্য সবার আগে বর্তমান বাজারে বিদ্যমান সব ইসিআর পরিবর্তন করতে হবে। কারণ বর্তমান ইসিআরে ওই ডিভাইস সংযুক্ত করা সম্ভব নয়।

আরেক কর্মকর্তা বলেন, ইসিআর বাধ্যতামূলক করা হলেও এতদিনে ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনয়নে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে স্বয়ংক্রিয় মনিটরিং বা অটোমেশনের বিকল্প নেই। আর অটোমেশনের অংশ হিসেবেই আমরা ডিভাইস বেইসড নতুন ইসিআর মেশিনের ব্যবহারের দিকে যাচ্ছি।
আদেশ অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ১১টি ব্যবসা ও সেবার ওপর ইসিআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি তথ্যানুসারে, সারা দেশে মোট দোকানের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ এবং তার ৩০ শতাংশ অর্থাৎ ৭ লাখ ৫০ হাজার দোকান ইসিআর ব্যবহারের উপযোগী। এ হিসাবে ৯৯ শতাংশ দোকানেই এখনো ইসিআর নেই। এনবিআরের হিসাবেই সারা দেশে ইসিআর ব্যবহারযোগ্য প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে ১ লাখ। বিপরীতে ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ৮ হাজার।
তবে ভ্যাট ব্যবস্থা অনলাইন করতে ৫০ হাজার ইসিআর ন্যায্যমূল্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ব্যবসায়ীদের বিরোধিতায় দুই বছরের জন্য ভ্যাট আইন-২০১২ বাস্তবায়ন স্থগিত করায় এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে এনবিআর।
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, অনেকেই ভোক্তাদের কাছ থেকে ঠিকই ভ্যাট আদায় করছেন। কিন্তু সেটি সরকারকে দেন না। এজন্য ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন এবং লেনদেনে প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকার রেস্তরাঁগুলোতে দেখা গেছে, নিয়মানুযায়ী খাবারের বিলের সঙ্গে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট যোগ করেন তারা। কিন্তু অনেক নামিদামি শপিং মলের ফুড কোর্টগুলোসহ হাজার হাজার হোটেল রেস্তরাঁই খাবার বিক্রির পর ক্রেতাকে কোনো রশিদই দিতে চান না।
এ বিষয়ে কাওরান বাজারের একটি রেস্তরাঁর কর্মকর্তা বলেন, তারা ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার ব্যবহার করেন। যা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভ্যাটের দৈনিক ও মাসিক হিসেব পাওয়া যায়। মাস শেষে ভ্যাটের অর্থ তারা কর কর্মকর্তাদের দিয়ে দেন।

এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলছেন, হোটেল-রেস্তরাঁ ছাড়াও যাদের একটি প্যাকেজ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, তাদেরও অনেকে ঠিকমতো ভ্যাট দেন না। ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে এটাই বড় সমস্যা। রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, খুব দ্রুতই ইলেকট্রনিক লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন তারা। তিনি বলেন, সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেন ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস ক্রয় করে সেটি বাধ্যতামূলক করা হবে। এগুলো এনবিআরের কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। তাহলে ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকবে না।
এনবিআর তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থ বছরের বাজেটেও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট ও আয়করের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় সমান। আবার গত পাঁচ বছরেও যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে, তার মধ্যে ভ্যাট থেকে এসেছে ৩৬ শতাংশ আর আয়কর থেকে এসেছে ৩৫ ভাগ।
এদিকে সদ্য বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। তবে আগেরবারের চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এনবিআরের সাময়িক হিসাবে দেখা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরে ২ লাখ ৫ হাজার ৯০৩ কোটি টাকার শুল্ক, কর ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আদায় হয়েছে। এনবিআরের এবার সংশোধিত লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
নতুন অর্থবছরেও ভ্যাটে প্রায় এক লাখ কোটি ও আয়কর খাতে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশের একটি জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী মোবাইল অ্যাপ, ভ্যাট চেকার, সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায়। এনবিআর-এর ডেটাবেজে সংযোগ না পাওয়ায় ভ্যাট চেকার কাজ করছে না বলে জানিয়েছেন এই অ্যাপের ডেভেলপাররা। ভ্যাট চেকার অ্যাপ ব্যবহার করে খদ্দেররা কোনো দোকান বা রেস্টুরেন্টের মতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে জানতে পারতেন যে প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে ভ্যাট দেয় কি না। ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার প্রমাণ পাওয়ার পর গ্রাহকই রাজস্ব বোর্ডে এব্যাপারে অভিযোগ করতে পারতেন। চালু হওয়ার পর গত দু’বছরে এই অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহকরা এনবিআর-এর কাছে ১১,০০০ অভিযোগ দায়ের করেছেন। এতে সরকার অন্তত ২০০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি রোধ করা গেছে বলে জানান অ্যাপ নির্মাতা জুবায়ের হোসেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status