প্রথম পাতা

তরিকুলের লড়াই

মরিয়ম চম্পা

১৩ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার, ১০:২৫ পূর্বাহ্ন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতার হাতুড়িপেটার শিকার হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামের সামনে অনিশ্চিত জীবন। শরীরজুড়ে ব্যথা। হাসপাতালের   
 বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছেন মাঝে মাঝেই। ওষুধ খেতে পারছেন না। ওষুধ খেতে গেলেই বমি করছেন। এর বাইরে রয়েছে দরিদ্র্যতার ছোবল। হতভাগা তরিকুলের দরিদ্র পরিবার চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। বাকিতেই চলছে চিকিৎসা। তবে কতদিন এভাবে চলবে তা জানা নেই তাদের। অন্যদিকে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। নিরাপদে নেই পরিবারের লোকজনও। লেখাপড়া শেষ করে এই মেধাবী শিক্ষার্থী হতে চেয়েছিলেন পরিবারের অবলম্বন। কিন্তু এখন সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার। এই অবস্থায় তরিকুল ও তার পরিবারের সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল ইসলামের এক বন্ধু জানান, গত ৯ই জুলাই সোমবার ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তরিকুলের পায়ের সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা দুই বন্ধু সার্বক্ষণিকভাবে হাসপাতালে তরিকুলের সঙ্গে রয়েছি। এই হাসপাতালের চিকিৎসকরা খুবই আন্তরিক। উন্নত চিকিৎসার জন্য গত রোববার অ্যাম্বুলেন্সযোগে রাজশাহী থেকে ঢাকায় আনা হয়েছে। পরদিন দুপুর আড়াইটার দিকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। ওইদিন বিকাল পৌনে ৫টার দিকে অপারেশন সম্পন্ন হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন, আপাতত ঝুঁকিমুক্ত হলেও পুরোপুরি সুস্থ হতে কমপক্ষে ৬ মাস সময় লাগবে। বর্তমান শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। কোমরে আঘাতের স্থানে এখনো অনেক ব্যথা ও জ্বালা যন্ত্রণা হয়। সারা শরীরে মারের ব্যথা তো আছেই। ডাক্তার বলেছেন, শরীরের ব্যথা কমতে ১ থেকে দেড় সপ্তাহ সময় লাগবে। এর মধ্যে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওষুধ খাওয়াতে গেলেই বমি করছে।
তরিকুলের বন্ধু বলেন, পরিবারের সদস্যরা ওর অবস্থা দেখে নার্ভাস হয়ে গেছে। তাই তাদেরকে হাসপাতাল থেকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, তরিকুলরা দুই ভাই এক বোন। সে মেজো। ছোট বোন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ছে। আর্থিক সংকটে বড় ভাই পড়াশুনায় একটু পিছিয়ে আছে। তিনি মার্কেটিংয়ে  অনার্স করছেন। বাবা মো. খোরশেদ আলম কৃষি কাজ করেন। মা তাহমিনা বেগম গৃহিণী। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হচ্ছেন তাদের বাবা। এ ছাড়া বন্ধু-বান্ধব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক মিলে সবাই তরিকুলের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত পরিমাণে সাহায্য করছেন। বর্তমানে যে হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার পুরো টাকাই বাকি রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরে বাকি পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে। কিছু কিছু ওষুধ আছে যেগুলো খুবই দামি ও ব্যয়বহুল। এ ছাড়া হাসপাতালের কেবিন ও বেড ভাড়াসহ দৈনিক সাড়ে ৩ হাজার টাকা বিল আসে। সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক খরচ। তরিকুলের বন্ধু আরো জানান, তার পায়ের ভেতর রড দিয়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। মাথার আঘাত গুরুতর হওয়ায় ফোনে কথা বলা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তার। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তরিকুল বন্ধুদের বলেছেন, আমি আহত হয়েছি, মার খেয়েছি, তাতে কোনো দুঃখ নাই। কিন্তু যে উদ্দেশে আন্দোলনে গিয়েছি সেটা যেন সফল হয়। এটাই আমার চাওয়া।

রাবি’র ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম গ্রাজুয়েশন শেষ করে সরকারি চাকরি নয়, আইটি সেক্টরে কাজ করতে চেয়েছিলেন। ভালোলাগার জায়গা থেকে সম্প্রতি ওয়েব ডিজাইনের ওপর ৩ মাসের একটি কোর্স সম্পন্ন করেছে। অনার্স-মাস্টার্স করলেই যে সরকারি চাকরি করতে হবে এমনটা মনে করতেন না তরিকুল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই আন্দোলন করেছেন তিনি। তরিকুলের হামলার স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে এই সহপাঠী বলেন, ওকে যখন এলোপাথাড়িভাবে মারা শুরু করে, তখন দাঁড়িয়ে থাকা এক হামলাকারীর দিকে মাথা হেলে দিয়েছিল। আর বলছিল, আমাকে আর মাইরেন না, আমারতো মাথা ফেটে গেছে, রক্ত বের হচ্ছে। তখন সে তার কথা শোনেনি। আরেকজনর হাতে থাকা লাঠি নিয়ে দ্বিতীয়বার আঘাত করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও করার ৩-৪ মিনিট আগে থেকে তাকে হামলাকারীরা বেধড়ক পেটাতে থাকে। এ সময় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তরিকুলকে নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে মানববন্ধনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সহায়তায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে জোর করে ছাড়পত্র দেয়ার পর বেসরকারি হাসপাতাল রয়্যালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৮ই জুলাই রোববার ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানেও নিরাপত্তাজনিত কারণে হাসপাতালের ইউনিট বদল করা হয়েছে।         

উল্লেখ্য, কোটা সংস্কারের দাবিতে পতাকা মিছিলের সময় ৪ঠা জুলাই তরিকুলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনে রাস্তায় ঘিরে ধরে পেটায় ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন মিলে যখন লাঠি নিয়ে তরিকুলকে পেটাচ্ছিল তখন আবদুল্লাহ আল মামুন লোহার হাতুড়ি দিয়ে তার পিঠে ও পায়ে আঘাত করে। তরিকুল এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। এখন ডান পায়ের ভাঙা দুই হাড়, মাথায় আটটি সেলাই ও সারা শরীরে আঘাতের ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় দিন যাচ্ছে তার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status