বিশ্বজমিন

বাংলাদেশ ও নির্বাচন

নিতিন এ গোখালে

৮ জুলাই ২০১৮, রবিবার, ১১:৪৩ পূর্বাহ্ন

ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে নির্বাচনী মৌসুম শুরু হয়েছে। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রতিবেশী পাকিস্তানে সামরিক বুটের ছায়ায় ফের নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে শিগগিরই। পূর্বের প্রতিবেশী বাংলাদেশেও সম্ভবত ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে। এই নির্বাচন এমন সময় অনুষ্ঠিত হবে যখন সমাজ ভীষণভাবে বিভক্ত। ২০১৯ সালের গ্রীষ্মে ভারতেও সাধারণ নির্বাচন হবে। আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকে শেষের মধ্যে কোনো এক সময় শ্রীলংকা প্রত্যক্ষ করবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনসমূহ কেবল সংশ্লিষ্ট দেশের জন্যই নয়, বরং এই অঞ্চলের কৌশলগত চিত্রের জন্যেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, পাকিস্তানে নির্বাচনের ফল কী হয়, তা গুরুত্বপূর্ণ, তবে অতটা তাৎপর্যপূর্ণ নয়। কারণ, বেসরকারী প্রশাসনের নেতৃত্বে যে-ই আসুক না কেন, ইসলামাবাদের ভারত নীতি নির্ধারিত হবে রাওয়ালপিন্ডি তথা সেনা সদরদপ্তর থেকে। তবে ঢাকার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য নয়। প্রচুর ত্রুটি সত্ত্বেও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বেশ গভীরে প্রোথিত। মানুষ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর ভোটাধিকার প্রয়োগে অভ্যস্ত। তবে অতি সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ এই পদ্ধতির অপব্যবহার করে বাংলাদেশে একদলীয় শাসনকে স্থায়ী রূপ দিতে চান।
এই অভিযোগ সত্ত্বেও, শেখ হাসিনা নজিরবিহীনভাবে টানা তিনবার ক্ষমতায় আসতেই নির্বাচনে লড়বেন। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে কারান্তরীন। তবে তার দল চাইলে তিনি তত্বগতভাবে নির্বাচনে লড়তে পারবেন। ২০১৩ সালে অবশ্য বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছিল।
যদি বিএনপি নির্বাচনে আসে, হাসিনা সেক্ষেত্রে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বীতার মুখে পড়বেন। কারণ, তার এক দশকব্যাপী শাসনে বহু ক্ষেত্রে প্রশংসাযোগ্য উন্নয়ন হলেও দেশে ক্ষমতাসীন-বিরোধী মনোভাব বেশ বেড়েছে।
বাংলাদেশে পরিস্থিতি কোনদিকে গড়ায় সেদিকে অবশ্যই তীক্ষ্ম নজর থাকবে ভারতের। ভারত চাইবে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসুন। কারণ, তার শাসনাধীনেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে অতুলনীয় সহযোগিতা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহী নেতাদের গ্রেপ্তার করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। অনেক সন্ত্রাসী চক্র ধ্বংস করেছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের নেতৃত্বে ভারতও বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল ও সমুদ্র সীমা নিষ্পত্তির মাধ্যমে অনেক পুরোনো এক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলে দেশে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অবস্থানও শক্তিশালী হয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে নয়াদিল্লি ও ঢাকার মধ্যকার তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।
গত মাসে ভারত সফরে আসা উচ্চ পর্যায়ের আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলকে ভারত নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। শেখ হাসিনার কাছ থেকে পাওয়া সহযোগিতা ও সাহায্যের জন্য বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ইস্যুতে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত।
আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল ভারতের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। উভয় পক্ষই এই বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে যে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা গত চার বছরে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালের এপ্রিলে হাসিনার ভারত সফর থেকে পরিস্থিতি তুঙ্গে। ওই সফরে রেকর্ড ৩৬টি চুক্তি সই করে দুই দেশ। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে ৬টি চুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক রূপরেখামূলক চুক্তি। ৫০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা ঋণ; মহাকাশ, পারমানবিক জ্বালানি, তথ্য প্রযুক্তি ও সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে একটি চুক্তি। আরও আছে ৪৫০ কোটি ডলারের আরেকটি পৃথক ঋণ চুক্তি।
উভয় পক্ষই এই বিষয়টি উল্লেখ করেছে যে নিরাপত্তা, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ৬০টির মতো যৌথ প্রকল্প দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর বাইরেও বেশ কয়েকটি বৃহৎ উদ্যোগের মাধ্যমে নয়াদিল্লি এই সম্পর্ককে আরও সামনে নিয়ে যেতে চায়।
ভারত বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নিরাপত্তা খাত ব্যতিত সবচেয়ে বড় সাফল্যের জায়গাগুলোর অন্যতম হলো বিদ্যুৎ খাত। ভারত থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে যাওয়া বিদ্যুৎ-এর পরিমাণ ১২০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নয়াদিল্লির অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ তেমন উচ্ছ্বসিত হতে পারেনি। শেখ হাসিনা বিষয়টি যেভাবে সামাল দিয়েছেন তার সঙ্গে তুলনা চলছে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া বাঙালি শরণার্থীদেরকে ভারত যেভাবে সামাল দিয়েছিল। এই রোহিঙ্গা ইস্যু নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে কিনা বা শেখ হাসিনার অনুকুলে যায় কিনা, তা এখনও নিশ্চিত কিছু নয়। তবে এটা যে শেখ হাসিনার জন্য সুবিধাজনক হবে, তা বলা যায়। ডিসেম্বর নাগাদ যখন বাংলাদেশে নির্বাচন শেষ হবে, ভারতে তখন নির্বাচনী ডামাডোল কেবল শুরু হবে। উপমহাদেশের জন্য সামনের কয়েক মাস হবে বেশ চিত্তাকর্ষক।
(নিতিন এ গোখালে একজন কৌশলগত সম্পর্ক বিশ্লেষক এবং ভারতশক্তি.ইন নামে একটি প্রতিরক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইটের লেখক ও প্রতিষ্ঠাতা। তার এই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ভারতের ডিএনএ পত্রিকায়। এটি সংক্ষেপিত অনূদিত সংস্করণ।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status