বিশ্বজমিন

নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের বাজার থেকে কেন উধাও ডন পত্রিকা

বিবিসি

৭ জুলাই ২০১৮, শনিবার, ৮:৫৮ পূর্বাহ্ন

পাকিস্তানের লাহোর থেকে সাংবাদিক আহমেদ রশিদ বিবিসি ওয়েবসাইটে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে সকালে ঘুম থেকে ওঠে যদি দেখা যায়, নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাটি নেই, সংবাদপত্র বিক্রির সব স্টল বন্ধ এবং হকাররা পত্রিকা বিলি করতে পারছে না, তাহলে কেমন হতে পারে সেটা একবার কল্পনা করে দেখুন।
পাকিস্তানের অবস্থা এখন অনেকটা সেরকমই। গত কয়েক মাস ধরে পাকিস্তানি বহু নাগরিক এরকম বোধ করছেন, কারণ দেশটির সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ডন তাদের বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেছে। আর এই অবস্থা তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আগামী ২৫শে জুলাই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তার আগে টেলিভিশন চ্যানেল থেকে শুরু করে সংবাদপত্র, এমনকি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের উপরেও কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, দেশটির সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ একজোট হয়ে সংবাদ মাধ্যম এবং কিছু কিছু রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই অভিযোগ সাংবাদিকদের দিক থেকে যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকেও।
পাকিস্তানের সাবেক সরকারি দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং এই দলের নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ- দুর্নীতির মামলায় যাকে গত বছর ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে- তিনিও এই অভিযোগ করেছেন। মি. শরীফকে আজীবনের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করেছেন আদালত। এসব অভিযোগ অবশ্য সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। তবে, ইংরেজি দৈনিক ডন এবং এস্টাবলিশমেন্টের (সরকারি কর্তৃপক্ষ) মধ্যে গত কয়েক মাস ধরে যে লড়াই চলছে সেটাই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই পত্রিকাটি পাকিস্তানের ব্যবসায়ী, কূটনীতিক এমনকি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের মধ্যেও জনপ্রিয়। এর সম্পাদকীয় প্রভাবও উল্লেখ করার মতো। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সমাজে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি তৈরিতে এই পত্রিকাটির রয়েছে বিশেষ ভূমিকা।
এছাড়াও পাকিস্তানে মানুষের মধ্যে এই পত্রিকাটির প্রতি একটা বিশেষ শ্রদ্ধা রয়েছে- কারণ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারত ও পাকিস্তানের আলাদা হয়ে যাওয়ার (দেশ বিভাগ) আগে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই পত্রিকাটি প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে মুসলমানদের একটি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা। তখন থেকেই এই পত্রিকাটিকে পাকিস্তানের প্রভাবশালী মহল বা এস্টাবলিশমেন্টের কাগজ বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে।
অভিযোগ উঠেছে যে ডন সংবাদ মাধ্যমটিকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে এর সংবাদ কর্মীদের, হকাররা যাতে এই পত্রিকাটি বিলি করতে না পারে সেজন্য প্রত্যেক শহরের সেনানিবাসগুলোতে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ডন টিভি যাতে বাড়িতে বাড়িতে দেখা না যায় সেজন্যে কেবল অপারেটরদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও এই পত্রিকায় ও টেলিভিশনে যেসব প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয় তাদেরকে বলা হয়েছে সেখানে পণ্যের প্রচারণা না চালাতে। এর ফলে ডনের আয়-উপার্জনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। ডন ছাড়াও অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমের লোকজনকে অপহরণ করারও অভিযোগ উঠেছে। রহস্যময় কিছু লোক নিজেদের নাম পরিচয় গোপন রেখে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে শারীরিকভাবেও।
কারা এসব করছে সেগুলো প্রকাশ করতে কোনো সংবাদ মাধ্যমও সাহস করছে না। কিন্তু সাংবাদিক আহমেদ রশিদ বলছেন, সংবাদ জগতের মোটামুটি সবাই জানে যে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরাই এসবের সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে এতদিন মুখ খোলেনি ডন। তারা নীরব থেকেছে। কিন্তু পত্রিকাটি খুব সমপ্রতি একটি খোলামেলা ও শক্তিশালী সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে।
সম্পাদকীয়তে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে নওয়াজ শরীফ সরকারের শাসনামলে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে বড় রকমের ফাটল তৈরি হয়েছিল। এসব বিষয়ে খবর প্রকাশ করা হয়েছিল পত্রিকাটিতে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় সামরিক বাহিনী। কিন্তু চাপের মুখেও ডন পত্রিকাটি তাদের খবরের উৎস বা সোর্সের নাম প্রকাশ করেনি। ডন পত্রিকার সম্পাদকয়ীতে লেখা হয়েছে, “ডন পত্রিকা এবং তার সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব মিথ্যা তথ্য, ঘৃণা, সম্মানহানির প্রচারণা এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানো হয়েছে, তাতে কিছু বিষয় বলা দরকার। রাষ্ট্রের ভেতরের একটি অংশ সংবিধানে দেয়া স্বাধীনতাকে ধরে রাখছে না।” ডন পত্রিকাটি বলছে, ২০১৬ সালের শেষের দিক থেকে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে। তবে এই আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে গত মে মাস থেকে।
সাংবাদিক আহমেদ রশীদ লিখছেন, গত বছর এই একই ধরনের ভয়ভীতি ও আর্থিক চাপের মুখে পড়েছিল জনপ্রিয় উর্দু পত্রিকা জং এবং তাদেরই সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেল জিও। তাদের অবস্থা এমন হয়েছিল যে তিন মাস তারা তাদের সাংবাদিক এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন দিতে পারেনি। কিন্তু তারা তাদের অবস্থানে ডনের মতো অনড় থাকেনি। তাদের ঊর্ধ্বতন সম্পাদকরা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের আপস সমঝোতা করে ফেলতে সক্ষম হন। তিনি আরো লিখেছেন, সংবাদপত্র ও টেলিভিশন ছাড়াও আরো বেশি আক্রমণের শিকার হচ্ছেন ব্লগাররা যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার। সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে এসব ব্লগার রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু সামরিক বাহিনী সংবাদ মাধ্যমের উপর তাদের হস্তক্ষেপের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা বলছে, পাকিস্তানে একটি মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে তারা বদ্ধপরিকর। তবে সামরিক বাহিনী স্বীকার করেছে যে তারা সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নজর রাখছে। সাংবাদিক আহমেদ রশিদ লিখেছেন, পাকিস্তানে বিভিন্ন চরমপন্থি গ্রুপকে কেন এস্টাবলিশমেন্ট থেকে বিশেষ সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে এবং কেন তাদেরকে রাজনীতিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে সেসব বিষয়ে  সংবাদ মাধ্যমগুলো কিছু বলতে ভয় পায়। “কিন্তু একই সঙ্গে সুপরিচিত নারী ব্লগার গুল বুখারিকে লাহোরের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যিনি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সমালোচনায় সোচ্চার ছিলেন।”
তিনি বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বলা যায়, ডন পত্রিকাটি কবে থেকে আবার মানুষের বাসাবাড়িতে প্রত্যেক দিন সকালে নাস্তার টেবিলে দেখা যাবে সেটা বলা খুব কঠিন। তবে পাঠকের হাতে এই পত্রিকাটি পৌঁছাতে এবং সাংবাদিকদের আর ভয়ভীতি দেখানো হবে না, শারীরিকভাবে হয়রানি করা হবে না- দেশটিতে এরকম পরিস্থিতি ফিরে আসতে আরো বহু সময় লাগবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status