বাংলাদেশ কর্নার

ব্যক্তি অপরিহার্য নয় ব্রাজিল দলে

কাফি কামাল

৫ জুলাই ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৪:৩১ পূর্বাহ্ন

দৃশ্যটা এখনও লেগে আছে ফুটবলপ্রেমীদের চোখে। ২০১৪ সালের ৪ঠা জুলাই। নিজ দেশের বোলে হরিজন্তের মিনেইরাও স্টেডিয়ামে মাঠে নেমেছে ব্রাজিল। দলে নেই সেরা তারকা নেইমার। নেই নিয়মিত অধিনায়ক ও রক্ষণের প্রাচীর থিয়াগো সিলভা। প্রতিপক্ষ ‘দ্য মেশিন’ খ্যাত দুধর্ষ টিম জার্মানি। নেতৃত্বের আর্মব্যান্ড বাহুতে জড়ানো ঝাঁকড়া চুলের লুইসের চোখে জল। আগের ম্যাচেই কলম্বিয়ার জুনিগা’র আঘাতে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে নেইমারের। কার্ডের খড়গে পড়ে মাঠে নামতে পারেননি রক্ষণ প্রাচীর ও নেতা থিয়াগো সিলভা। স্বাগতিক দেশের জন্য কী এক হতাশা! লুইসের আবেগ সেদিন ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো স্টেডিয়ামে। আবেগের অতিশয্যায় নুইয়ে পড়া খেলোয়াড়রা শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসে অঙ্কিত করে এক লজ্জ্বার তিলক। নেইমার বড় তারকা হয়ে উঠার পর তাকে কেন্দ্র করেই ব্রাজিলকে সাজানো হচ্ছিল। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের কোয়ার্টারে নেইমার আহত হয়ে মাঠ ছাড়ার পর ভঙ্গুর ব্রাজিল আর এগোতে তো পারেনি। সেদিন থেকে শিক্ষা নিয়েছে ব্রাজিল। ব্যক্তিনির্ভরতা নয়, সেলেকাওরা টিমওয়ার্কেই খেলবে। টিমওয়ার্কের কৌশলকে প্রাধান্য দিয়েছেন নতুন কোচ তিতে। খেয়োয়াড় হিসেবে বড় মাপের নাম হলেও কোচ হিসেবে যে কৌশলী ও বড়মাপের সেটার প্রমাণ ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।

ব্রাজিলের বর্তমান টিমে কেউ অপরিহার্য নয়। বিশ্বফুটবলের মহাতারকা নেইমার কিংবা তারকাপুঞ্জের ফিলিপে কুতিনহো, গাব্রিয়েল জেসুস, পাউলিনহো, মার্সেলো কেউই নয়। ব্যক্তিনির্ভর নয়, ব্রাজিল এখন একটি সমন্বিত ফুটবলের টিম। দলটির কোচ তিতের মন্তব্য, ‘আমাদের দলে ভারাসাম্য রয়েছে। তাই যে কোনও জায়গায় বিকল্প খুঁজে নিতে সমস্যা হয় না। একটা দলের কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ ভারসাম্য প্রসঙ্গে মার্সেলোর উদাহরণ টেনে তিতে বলেন, ‘শুরুতেই মার্সেলো চোট পেল। আর আমরা অবলীলায় ওর পরিবর্ত নামিয়ে দিলাম।’ তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ব্রাজিলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কাসেমিরো বলছেন, ‘ফুটবলে একজন খেলোয়াড় নিয়ে সব সময়ই আলোচনা একটু বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্ত দরকার একটি ভালো দল। গড় মানের ওপরে থাকা নেইমারকে নিয়েই কথা বলবে লোকে, এটা অনিবার্যই। কিন্তু আমরা ভুলতে পারব না যে, আমাদের আরও অনেক দারুণ ফুটবলার আছে।’ কথাগুলো মিথ্যা নয়। প্রথম পর্বে তিতের টিমে নিউক্লিয়াস হয়ে উঠেছিলেন বার্সেলোনার ফরোয়ার্ড কুটিনহো। নকআউটে অবশ্যই আলোর রেখাটি নিজের দিকে টেনে নিচ্ছেন নেইমার। পাউলিনহোর সঙ্গে কুটিনহোর চমৎকার বোঝাপড়া স্বস্তি দিচ্ছে ব্রাজিল সমর্থকদের। আবার রক্ষণে চাপ কমাতে তিতের হাতে বিকল্প আছে ফারনানদিনহো। প্রথম চার ম্যাচে গোলখরা কাটাতে পারেননি নতুন সেনসেশন গাব্রিয়েল জেসুস। তিতের চিন্তা নেই, বেঞ্চে আছেন দুরন্ত ফিরমিনো। দানি আলভেজের অভাব পূরণ সহজ নয়। মার্সেলোর অভাব থেকে ছাপ ফেলেছে খেলায়। কিন্তু তারপরও দানির অভাব লুইস এবং মার্সেলোর অভাব খুব একটা টের পেতে দেননি পাগেনার।

আশির দশকে ব্রাজিলের যে ফুটবল প্রজন্ম জোগো বনিতার সঙ্গে আপস করেননি তাদের অন্যতম জিকো। বর্তমান ব্রাজিল দল নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এই ব্রাজিলীয় অনেক কিছুর মিশ্রণে তৈরি। নেইমারের শিল্প, কুটিনহোর টাচ, পাওলিনহো-জেসুসের দৌড়, পাগেনার, ফিলিপে লুইস ও ফার্নান্দিনহোর তিকিতাকা এবং মিরান্দা-থিয়াগো সিলভার নির্মমতা নিয়ে এ এক নতুন ব্রাজিল। বিবর্তিত ব্রাজিল দলের খেলায় হয়তো আগের মতো সুন্দর নয় কিন্তু এই দল চোখে লাগার মতো ফুটবল খেলতে পারে। যারা বিশ্বকাপের মঞ্চে নিজেদের ধ্বংস করতে আসেনি, জিততে এসেছে। এই ব্রাজিল দলটায় কেউ অপরিহার্য নয়। সার্বিয়ার বিরুদ্ধে মার্সেলো যখন শুরুতেই চোট পেয়ে বেরিয়ে গেল, ফিলিপে লুইস নেমে পড়ল এবং প্রমাণ করে দিয়ে গেল, ও কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। এমনকি, মার্সেলোর চেয়েও ভাল খেলতে পারে। আমি এই ব্রাজিলকে দেখে নিশ্চিত যে, যদি নেইমারকেও বেরিয়ে যেতে হয়, আমরা ওর অভাব অনুভব করব না। কারণ, ওর পরিবর্ত তৈরি আছে। ফিলিপে কুটিনহো এই বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত ব্রাজিলের সেরা ফুটবলার। কিন্তু তাকেও তো তুলে হলো ম্যাচের শেষদিকে। তারপর বাকি সময়ে কি আমরা কুটিনহোর অভাবও অনুভব করেছি? না, করিনি।’



যেকোনো বিশ্বকাপেই গোলদাতারাই থাকেন আলোচনায়। কিন্তু বিশ্বকাপ জেতে সেই দলগুলো, যাদের রক্ষণ সেরা। ২০১৪ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, ২০১০ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন স্পেন ও ২০০৬ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ইতালির মূল অস্ত্র হয়েছিল রক্ষণদৃঢ়তা। ব্রাজিল সবসময় আক্রমণাত্মক ফুটবলের পূজারি। বিশ্বকাপ জিততে আক্রমণভাগই সবকিছু নয়, আরও কিছু লাগে। সেটির নাম ইস্পাতকঠিন রক্ষণ। তিতের দলে গোল ঠেকানোর লোকগুলোও দারুণ। ব্রাজিলের এবারের রক্ষণভাগ যথেষ্ট ধারাবাহিক। সর্বশেষ ২৮ ম্যাচে ব্রাজিল রক্ষণ গোল খেয়েছে মাত্র আটটি। এই রক্ষণের কাজটা শুধু চার ডিফেন্ডার ও একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের নয়। কাসেমিরো বলেন, ‘ব্রাজিলের রক্ষণটা আসলে শুরু গ্যাব্রিয়েল জেসুস থেকে তারপর নেইমার-উইলিয়ান হয়ে আলিসন। ১১জনই ডিফেন্ডার, ১১ জনই আক্রমণে।’ সেন্টার ব্যাক থিয়াগো সিলভা বলেছেন, ‘আমাদের দলটি খুব ভারসাম্যপূর্ণ, মেধাবী ও দৃঢ়।’ থিয়াগোর কথাটি যে কথার কথা নয় সেটার প্রমাণও রেখেছেন তারা। সার্বিয়া যখন বারবার ব্রাজিলের ডিফেন্স পরীক্ষার মুখে পড়ছিল। তখন দুই স্টপার মিরান্দা ও থিয়াগো সিলভা দেয়াল হয়ে সব আক্রমণ রুখে দিল। এক গোলে পিছিয়ে থাকা সার্বিয়া যে ম্যাচে ফিরে আসতে পারল না, তার কারণ মিরান্দা ও থিয়াগো। দুইজনই নিশ্চিত দুটি গোল বাঁচিয়েছেন। নকআউট পর্বে মেক্সিকোর বিপক্ষে তারা তো রক্ষণের দিকেই মনোযোগী ছিলেন বেশি। আর ব্রাজিল দলের গোলকিপার আলিসন বেকার উপাধি পেয়েছেন গোলকিপারদের পেলে। যেনতেন লোক নয়, এ উপাধি দিয়েছেন খোদ ব্রাজিলের ১৯৯৪ বিশ্বকাপজয়ী দলের গোলরক্ষক ক্লডিও তাফারেল। রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানী, রানারআপ আর্জেন্টিনা ও সাবেক চ্যাম্পিয়ন স্পেন যখন বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফিরে যাচ্ছে দেশে তখন ব্রাজিলকে স্বস্তি দিচ্ছে এ টিমওয়ার্ক। ওয়ান ম্যান আর্মি হয়ে নয়, টিমওয়ার্কে খেলুক তিতের দল। সেলেকাওদের পায়ে বিকশিত হোক জোগো বনিতার নান্দনিকতা, পূর্ণ হোক হেক্সা মিশন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status