ঈদ আনন্দ ২০১৮
বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশ
সাফওয়ান হোসেন
৩০ জুন ২০১৮, শনিবার, ৫:৩৭ পূর্বাহ্ন
আশীষ ভদ্রের নেতৃত্বে ১৯৮৫ সালের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে বাংলাদেশ দল
বিশ্বকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ তো নিয়মিতই খেলে, তবে সেটি মূল আসরে নয়, বাছাইপর্বে। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব থেকে এ অবধি বাংলাদেশ ছিল প্রতিটি বিশ্বকাপেরই অংশ। বাছাইপর্বে বাংলাদেশের ফলাফলটা জেনে রাখুন, এ অবধি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ৪০ ম্যাচে মাঠে নেমে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে নয়টিতে। ২৭টিতে হেরে আর চারটি ম্যাচ ড্র করে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স চিরাচরিতই। ৪৮ ম্যাচে বাংলাদেশের গোলসংখ্যা ৩৩টি। আর ১২৩টি গোল খেয়ে প্রমাণ করেছে ফুটবলে আমাদের অবস্থানটি। সর্বাধিক আট ম্যাচে ৩২ গোল হজম করে বাংলাদেশ।
প্রথম অধিনায়ক
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্বটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম ‘বিশ্বকাপ’। ঐতিহাসিক সেই মিশনে অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল আশীষ ভদ্রের হাতে। আশীষ কেবল ওই সময়েই নয়, বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার হিসেবে পরিচিত। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে একাধিকবার অধিনায়কত্ব করেছেন কায়সার হামিদ । নব্বই ও চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপ বাছাই তার হাতে ছিল অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে। প্রথমবার বাছাইপর্বে খেলতে নেমেই ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে এক দারুণ জয় তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথম পর্বে জাকার্তার অ্যাওয়ে ম্যাচে ইন্দোনেশিয়ার কাছে ২-০ গোলে হারলেও ঢাকার ফিরতি ম্যাচে এক গোলে পিছিয়ে পড়েও ২-১ গোলের এক দারুণ জয় পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে গোল করেছিলেন আশরাফউদ্দিন চুন্নু ও কায়সার হামিদ।
একটা সময় ছিল যখন বাছাইপর্বে এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর সঙ্গেই খেলতে হতো বাংলাদেশকে। শীর্ষ বলতে এই ইরান, জাপান, আরব আমিরাত, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো। প্রথমবারের মিশনে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারত গ্রুপে থাকলেও পরের দুবার, অর্থাৎ ১৯৯০ ও ১৯৯৪-এর বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল ইরান, জাপান, চীন ও আরব আমিরাতেরমতো দেশগুলোর প্রতিটিরই কোনো না-কোনো সময় বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত ’৯৪-এর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বকেই বাংলাদেশের কঠিনতম মিশন হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। সেবার জাপান ও আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল ফুটবলে ক্রমান্বয়ে ‘শক্তিধর’ হয়ে ওঠা থাইল্যান্ড। জাপান ও আমিরাতের বিপক্ষে টোকিও ও দুবাই রাউন্ডের দুটো ম্যাচে যথাক্রমে ৮-০ ও ৭-০ গোলের হারের লজ্জাতেও পড়তে হয় বাংলাদেশকে। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে দুই রাউন্ডেই বাংলাদেশ হারে ৪-১ গোলে। দুই লেগে আটটি ম্যাচে বাংলাদেশকে গোল হজম করতে হয়েছিল ২৮টি। যদিও ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের সেই লজ্জার রেকর্ডও অতিক্রম করেছে দেশের ফুটবল। আট ম্যাচে গেলোবার ৩২ গোল হজম করেছে বাংলাদেশ।
১৯৮৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ইরানের বিপক্ষে দুটো ম্যাচেই সমান তালে লড়াই করে হেরেছিল বাংলাদেশ। ঢাকার প্রথম পর্বে ২-১ গোলের হারের ম্যাচে খেলার শুরুতেই পেনাল্টি পেয়ে যায় বাংলাদেশ। তবে সেই পেনাল্টি ক্রসবারে মেরে নষ্ট করেন রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। খেলাটিতে বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। প্রাপ্ত কর্নার থেকে আসলামের দুর্দান্ত হেডে পরাভূত হয়েছিলেন ইরানের তারকা গোলরক্ষক আহমেদ রেজা আবেদ জাদেহ। তেহরানের অ্যাওয়ে ম্যাচটি ছিল খুব সম্ভবত আশির দশকে বাংলাদেশের সেরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ। বিখ্যাত আজাদি স্টেডিয়ামে ৭০ হাজার দর্শকের গগনবিদারী চিৎকারের সামনে বাঘের মতো লড়াই করেছিলেন কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, আসলাম, সাব্বিররা। ইরানের একটি পেনাল্টিও ঠেকিয়ে দেন গোলরক্ষক মহসিন। একেবারে শেষ মুহূর্তে গেহেরগান নামের এক ফুটবলারের লক্ষ্যভেদী হেড নষ্ট হলে, ধূলিসাৎ হয় ইরানকে রুখে দেয়ার স্বপ্ন।
১৯৯৩ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে জাপানের ইয়োকোহামায় আরব আমিরাতের কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। আমিরাত সেই ম্যাচে জয় পেয়েছিল পেনাল্টি থেকে। ওই ম্যাচেই একটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক মহসিন। ১৯৮৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চীনের বিপক্ষে গুয়াংজু ও ঢাকার দুই ম্যাচেই দ্বিতীয়ার্ধে গোল খেয়ে হেরেছিল বাংলাদেশ। দুই ম্যাচেই স্কোরলাইন ছিল ২-০।
বাছাই পর্বের যত জয় বাংলাদেশের
১৯৮৫-এর বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঢাকায় ইন্দোনেশিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেবারই ঢাকায় থাইল্যান্ডের বিপক্ষে জয় এসেছিল ১-০ গোলে। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় থাইল্যান্ডকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে দেয় সাব্বির, রুপু, ওয়াসিমরা। ১৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জাপান-আমিরাত দুই পর্বেই জয় এসেছিল যথাক্রমে ১-০ ও ৩-০ গোলের। ১৯৯৭ সালে জেদ্দায় চায়নিজ তাইপেকে ২-১ গোলে হারায় জুয়েল রানা বাহিনী। ২০০১ সালে সৌদি আরবের দাম্মামে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে একটি ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল ৩-০ গোলে। তবে সব ম্যাচ ছাপিয়ে ২০১১ সালে এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঢাকায় ২-০ গোলে লেবাননকে উড়িয়ে দেয়ার ম্যাচটিই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দেয় ফুটবলপ্রেমীদের।
সবচেয়ে বেশি গোলবার আগলানোর রেকর্ড
মোহাম্মদ মহসিন সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গোলবার আগলেছেন। তিনি টানা বাংলাদেশের অংশ নেওয়া টানা তিনটি বাছাইপর্বে জাতীয় দলের এক নম্বর গোলরক্ষক ছিলেন। এ ছাড়া সাঈদ হাসান কানন, আমিনুল হক, মোহাম্মদ পনির ও বিপ্লব ভট্টাচার্য, শহিদুল আলম সোহেল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের গোলরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাছাইপর্বে মহসিনের পর সবচেয়ে বেশিবার বাংলাদেশের গোলপোস্টে দাঁড়িয়েছেন আমিনুল হকই।
চোখ ধাঁধানো গোল
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের পক্ষে গোল হয়েছে ৩৩টি। এই গোলগুলোর মধ্য থেকে সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো গোলটি বেছে নেয়া খুব কঠিন নয়। ১৯৮৫ সালের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে দারুণ এক ফ্রিকিকে গোল করেছিলেন আশরাফউদ্দিন চুন্নু। আজ থেকে ২৯ বছর আগের সেই গোল আজও চোখে ভাসে ওই প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের। ১৯৮৯ সালে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকায় প্রায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে চারজন থাই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ‘ম্যারাডোনা স্টাইলে’ অসাধারণ এক গোল করেছিলেন রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। চোখ ধাঁধানো গোলের তালিকার সেরা হতে আশরাফউদ্দিন চুন্নুর সঙ্গে জোর লড়াই হওয়ার কথা এ দেশের ফুটবলের সেরা এই প্লেমেকারের।
প্রিয় প্রতিপক্ষ
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সবচেয়ে বেশিবার থাইল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। বাছাইপর্বে অংশ নেয়ার প্রথম তিনবারই বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল থাইল্যান্ড। প্রিয় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলা ছয়টি ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে দুটিতে। দুটোই ঢাকায় ১ে৯৮৫ ও ১৯৮৯)। বাকি চারটি ম্যাচের দুটি হার ব্যাংককে। বাকি দুটো টোকিও ও দুবাইয়ে। সৌদি আরবের সঙ্গেও পরপর দুটি বাছাইপর্বে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালে কুয়ালালামপুর ও জেদ্দা ও ২০০১ সালে দাম্মামে হয়েছিল এই চারটি লড়াই। বলাবাহুল্য, চারটি ম্যাচে হারই ছিল বাংলাদেশের সঙ্গী। ২০০৬, ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাইয়ের ছয়টি ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল তাজিকিস্তান।
এক আসরে ৩২ গোল হজম
২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে জর্ডানের সঙ্গে বাছাইয়ের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ ভেসে গেছে ৮-০ গোলে। আম্মানের ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশকে যেন ফুটবল শেখায় জর্ডান। এর আগে ঢাকায় জর্ডানের সঙ্গে ঢাকায় ৪-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। এবার বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে বাংলাদেশ ৮ ম্যাচে হজম করেছে ৩২ গোল। অ্যাওয়ে ম্যাচে বাংলাদেশের জালে ঢুকেছে ২০ গোল। এমন বড় ব্যবধানে বাংলাদেশ অবশ্য এর আগেও হেরেছিল। ১৯৯৩ সালে টোকিওতে জাপানের কাছে বাংলাদেশ হারে ৮-০ গোলে। পক্ষে হয়েছে মাত্র দুই গোল। যার একটি হয়েছে আত্মঘাতী অপরটি করেছেন জাহিদ হাসান এমিলি। বাছাই পর্বে তিন কোচের অধীনে খেলেছে বাংলাদেশ।
যদিও এবারের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে শুরুটা কিন্তু একেবারে মন্দ বলা যাবে না। ‘বি’ গ্রুপে নিজেদের প্রথম হোম ম্যাচে কিরগিজস্তানের সঙ্গে ৩-১ গোলে হারে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে বাংলাদেশের পাওয়া গোলটি ছিল আত্মঘাতী। তাজিকিস্তানের সঙ্গে পরের ম্যাচেই বাছাই পর্বের এক মাত্র পয়েন্ট পায় বাংলাদেশ। ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র করে স্বাগতিকরা। বাছাই পর্বে একমাত্র গোলটি করে জাহিদ হাসান এমিলি। তৃতীয় ম্যাচেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় ক্রুইফের শিষ্যরা। পার্থের ওই ম্যাচে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৫-০ গোলে হারে মামুনুলরা। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হোম ম্যাচে অবশ্য এক গোল কম খেয়েছে বাংলাদেশ। অ্যাওয়ে ম্যাচে জর্ডানের কাছে ৮-০ গোলের লজ্জা পেলেও হোমে কিন্তু ব্যবধানটা ছিল অর্ধেক। তবে যে তাজিকিস্তানের সঙ্গে বাছাই পর্বে একমাত্র পয়েন্ট পেয়েছিল তাদের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচে তাদের সঙ্গে ৫-০ গোল হজম করে বাংলাদেশ। অ্যাওয়েতে সবচেয়ে ভালো ম্যাচটি খেলে বিশকেকে। কিরগিজস্তানের বিপক্ষে ওই ম্যাচে মাত্র ২টি গোল হজম করে ফ্যাবিও লোপেজের দল। এবারে বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব তিনজন কোচের অধীনে অংশ নেয় বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে মামুনুলদের কোচ ছিলেন ডাচ্ ম্যান লোডভিক ডি ক্রুইফ। ক্রুইফের বরখাস্তের পর পরের দুটি ম্যাচে ডাগআউটে ছিলেন ইতালিয়ান ফ্যাবিও লোপেজ। জর্ডানের বিপক্ষে বড় লজ্জার দিনে বাংলাদেশের দায়িত্বে ছিলেন স্প্যানিশ গঞ্জালো সানচেজ মরেনো।
প্রথম অধিনায়ক
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্বটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম ‘বিশ্বকাপ’। ঐতিহাসিক সেই মিশনে অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল আশীষ ভদ্রের হাতে। আশীষ কেবল ওই সময়েই নয়, বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার হিসেবে পরিচিত। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে একাধিকবার অধিনায়কত্ব করেছেন কায়সার হামিদ । নব্বই ও চুরানব্বইয়ের বিশ্বকাপ বাছাই তার হাতে ছিল অধিনায়কের আর্মব্যান্ড। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে। প্রথমবার বাছাইপর্বে খেলতে নেমেই ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে এক দারুণ জয় তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথম পর্বে জাকার্তার অ্যাওয়ে ম্যাচে ইন্দোনেশিয়ার কাছে ২-০ গোলে হারলেও ঢাকার ফিরতি ম্যাচে এক গোলে পিছিয়ে পড়েও ২-১ গোলের এক দারুণ জয় পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে গোল করেছিলেন আশরাফউদ্দিন চুন্নু ও কায়সার হামিদ।
একটা সময় ছিল যখন বাছাইপর্বে এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর সঙ্গেই খেলতে হতো বাংলাদেশকে। শীর্ষ বলতে এই ইরান, জাপান, আরব আমিরাত, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো। প্রথমবারের মিশনে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারত গ্রুপে থাকলেও পরের দুবার, অর্থাৎ ১৯৯০ ও ১৯৯৪-এর বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল ইরান, জাপান, চীন ও আরব আমিরাতেরমতো দেশগুলোর প্রতিটিরই কোনো না-কোনো সময় বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত ’৯৪-এর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বকেই বাংলাদেশের কঠিনতম মিশন হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। সেবার জাপান ও আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল ফুটবলে ক্রমান্বয়ে ‘শক্তিধর’ হয়ে ওঠা থাইল্যান্ড। জাপান ও আমিরাতের বিপক্ষে টোকিও ও দুবাই রাউন্ডের দুটো ম্যাচে যথাক্রমে ৮-০ ও ৭-০ গোলের হারের লজ্জাতেও পড়তে হয় বাংলাদেশকে। থাইল্যান্ডের বিপক্ষে দুই রাউন্ডেই বাংলাদেশ হারে ৪-১ গোলে। দুই লেগে আটটি ম্যাচে বাংলাদেশকে গোল হজম করতে হয়েছিল ২৮টি। যদিও ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের সেই লজ্জার রেকর্ডও অতিক্রম করেছে দেশের ফুটবল। আট ম্যাচে গেলোবার ৩২ গোল হজম করেছে বাংলাদেশ।
১৯৮৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ইরানের বিপক্ষে দুটো ম্যাচেই সমান তালে লড়াই করে হেরেছিল বাংলাদেশ। ঢাকার প্রথম পর্বে ২-১ গোলের হারের ম্যাচে খেলার শুরুতেই পেনাল্টি পেয়ে যায় বাংলাদেশ। তবে সেই পেনাল্টি ক্রসবারে মেরে নষ্ট করেন রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। খেলাটিতে বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। প্রাপ্ত কর্নার থেকে আসলামের দুর্দান্ত হেডে পরাভূত হয়েছিলেন ইরানের তারকা গোলরক্ষক আহমেদ রেজা আবেদ জাদেহ। তেহরানের অ্যাওয়ে ম্যাচটি ছিল খুব সম্ভবত আশির দশকে বাংলাদেশের সেরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ। বিখ্যাত আজাদি স্টেডিয়ামে ৭০ হাজার দর্শকের গগনবিদারী চিৎকারের সামনে বাঘের মতো লড়াই করেছিলেন কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, আসলাম, সাব্বিররা। ইরানের একটি পেনাল্টিও ঠেকিয়ে দেন গোলরক্ষক মহসিন। একেবারে শেষ মুহূর্তে গেহেরগান নামের এক ফুটবলারের লক্ষ্যভেদী হেড নষ্ট হলে, ধূলিসাৎ হয় ইরানকে রুখে দেয়ার স্বপ্ন।
১৯৯৩ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে জাপানের ইয়োকোহামায় আরব আমিরাতের কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। আমিরাত সেই ম্যাচে জয় পেয়েছিল পেনাল্টি থেকে। ওই ম্যাচেই একটি পেনাল্টি ঠেকিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক মহসিন। ১৯৮৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চীনের বিপক্ষে গুয়াংজু ও ঢাকার দুই ম্যাচেই দ্বিতীয়ার্ধে গোল খেয়ে হেরেছিল বাংলাদেশ। দুই ম্যাচেই স্কোরলাইন ছিল ২-০।
বাছাই পর্বের যত জয় বাংলাদেশের
১৯৮৫-এর বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঢাকায় ইন্দোনেশিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেবারই ঢাকায় থাইল্যান্ডের বিপক্ষে জয় এসেছিল ১-০ গোলে। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় থাইল্যান্ডকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে দেয় সাব্বির, রুপু, ওয়াসিমরা। ১৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জাপান-আমিরাত দুই পর্বেই জয় এসেছিল যথাক্রমে ১-০ ও ৩-০ গোলের। ১৯৯৭ সালে জেদ্দায় চায়নিজ তাইপেকে ২-১ গোলে হারায় জুয়েল রানা বাহিনী। ২০০১ সালে সৌদি আরবের দাম্মামে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে একটি ম্যাচে বাংলাদেশ জিতেছিল ৩-০ গোলে। তবে সব ম্যাচ ছাপিয়ে ২০১১ সালে এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ঢাকায় ২-০ গোলে লেবাননকে উড়িয়ে দেয়ার ম্যাচটিই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি দেয় ফুটবলপ্রেমীদের।
সবচেয়ে বেশি গোলবার আগলানোর রেকর্ড
মোহাম্মদ মহসিন সবচেয়ে বেশিবার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গোলবার আগলেছেন। তিনি টানা বাংলাদেশের অংশ নেওয়া টানা তিনটি বাছাইপর্বে জাতীয় দলের এক নম্বর গোলরক্ষক ছিলেন। এ ছাড়া সাঈদ হাসান কানন, আমিনুল হক, মোহাম্মদ পনির ও বিপ্লব ভট্টাচার্য, শহিদুল আলম সোহেল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশের গোলরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাছাইপর্বে মহসিনের পর সবচেয়ে বেশিবার বাংলাদেশের গোলপোস্টে দাঁড়িয়েছেন আমিনুল হকই।
চোখ ধাঁধানো গোল
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের পক্ষে গোল হয়েছে ৩৩টি। এই গোলগুলোর মধ্য থেকে সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো গোলটি বেছে নেয়া খুব কঠিন নয়। ১৯৮৫ সালের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে দারুণ এক ফ্রিকিকে গোল করেছিলেন আশরাফউদ্দিন চুন্নু। আজ থেকে ২৯ বছর আগের সেই গোল আজও চোখে ভাসে ওই প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের। ১৯৮৯ সালে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকায় প্রায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে চারজন থাই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ‘ম্যারাডোনা স্টাইলে’ অসাধারণ এক গোল করেছিলেন রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। চোখ ধাঁধানো গোলের তালিকার সেরা হতে আশরাফউদ্দিন চুন্নুর সঙ্গে জোর লড়াই হওয়ার কথা এ দেশের ফুটবলের সেরা এই প্লেমেকারের।
প্রিয় প্রতিপক্ষ
বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সবচেয়ে বেশিবার থাইল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। বাছাইপর্বে অংশ নেয়ার প্রথম তিনবারই বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল থাইল্যান্ড। প্রিয় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলা ছয়টি ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে দুটিতে। দুটোই ঢাকায় ১ে৯৮৫ ও ১৯৮৯)। বাকি চারটি ম্যাচের দুটি হার ব্যাংককে। বাকি দুটো টোকিও ও দুবাইয়ে। সৌদি আরবের সঙ্গেও পরপর দুটি বাছাইপর্বে মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালে কুয়ালালামপুর ও জেদ্দা ও ২০০১ সালে দাম্মামে হয়েছিল এই চারটি লড়াই। বলাবাহুল্য, চারটি ম্যাচে হারই ছিল বাংলাদেশের সঙ্গী। ২০০৬, ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাইয়ের ছয়টি ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল তাজিকিস্তান।
এক আসরে ৩২ গোল হজম
২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে জর্ডানের সঙ্গে বাছাইয়ের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ ভেসে গেছে ৮-০ গোলে। আম্মানের ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশকে যেন ফুটবল শেখায় জর্ডান। এর আগে ঢাকায় জর্ডানের সঙ্গে ঢাকায় ৪-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। এবার বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে বাংলাদেশ ৮ ম্যাচে হজম করেছে ৩২ গোল। অ্যাওয়ে ম্যাচে বাংলাদেশের জালে ঢুকেছে ২০ গোল। এমন বড় ব্যবধানে বাংলাদেশ অবশ্য এর আগেও হেরেছিল। ১৯৯৩ সালে টোকিওতে জাপানের কাছে বাংলাদেশ হারে ৮-০ গোলে। পক্ষে হয়েছে মাত্র দুই গোল। যার একটি হয়েছে আত্মঘাতী অপরটি করেছেন জাহিদ হাসান এমিলি। বাছাই পর্বে তিন কোচের অধীনে খেলেছে বাংলাদেশ।
যদিও এবারের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে শুরুটা কিন্তু একেবারে মন্দ বলা যাবে না। ‘বি’ গ্রুপে নিজেদের প্রথম হোম ম্যাচে কিরগিজস্তানের সঙ্গে ৩-১ গোলে হারে বাংলাদেশ। ওই ম্যাচে বাংলাদেশের পাওয়া গোলটি ছিল আত্মঘাতী। তাজিকিস্তানের সঙ্গে পরের ম্যাচেই বাছাই পর্বের এক মাত্র পয়েন্ট পায় বাংলাদেশ। ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ওই ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র করে স্বাগতিকরা। বাছাই পর্বে একমাত্র গোলটি করে জাহিদ হাসান এমিলি। তৃতীয় ম্যাচেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় ক্রুইফের শিষ্যরা। পার্থের ওই ম্যাচে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৫-০ গোলে হারে মামুনুলরা। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হোম ম্যাচে অবশ্য এক গোল কম খেয়েছে বাংলাদেশ। অ্যাওয়ে ম্যাচে জর্ডানের কাছে ৮-০ গোলের লজ্জা পেলেও হোমে কিন্তু ব্যবধানটা ছিল অর্ধেক। তবে যে তাজিকিস্তানের সঙ্গে বাছাই পর্বে একমাত্র পয়েন্ট পেয়েছিল তাদের বিপক্ষে অ্যাওয়ে ম্যাচে তাদের সঙ্গে ৫-০ গোল হজম করে বাংলাদেশ। অ্যাওয়েতে সবচেয়ে ভালো ম্যাচটি খেলে বিশকেকে। কিরগিজস্তানের বিপক্ষে ওই ম্যাচে মাত্র ২টি গোল হজম করে ফ্যাবিও লোপেজের দল। এবারে বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব তিনজন কোচের অধীনে অংশ নেয় বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে মামুনুলদের কোচ ছিলেন ডাচ্ ম্যান লোডভিক ডি ক্রুইফ। ক্রুইফের বরখাস্তের পর পরের দুটি ম্যাচে ডাগআউটে ছিলেন ইতালিয়ান ফ্যাবিও লোপেজ। জর্ডানের বিপক্ষে বড় লজ্জার দিনে বাংলাদেশের দায়িত্বে ছিলেন স্প্যানিশ গঞ্জালো সানচেজ মরেনো।