ঈদ আনন্দ ২০১৮

উপন্যাস

একাকী জীবন

সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন

৩০ জুন ২০১৮, শনিবার, ৪:৫৭ পূর্বাহ্ন

আজ ‘আকাশ প্রদীপ’ নামক সবচেয়ে বড় বিমানটায় ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছে পাশা। বাংলাদেশ বিমানের লেটেস্ট আমদানি। বারোই ফেব্রুয়ারি উনিশ শ চৌদ্দ সালে প্রথম যাত্রা শুরু করেছে। মোট চারশত উনিশ জন যাত্রী বহনে সক্ষম বিমানটি। পাশারা মাত্র শ’খানেক যাত্রী আজ। ফ্লাইটটি লন্ডন থেকে এসেছে। গুটি কয়েক যাত্রী বাদে সবাই নেমে গেছেন। সেদিন একটা নিউজ পড়েছিল পাশা- লন্ডন প্রবাসী শতকরা পঁচানব্বই জন বাঙালি হচ্ছেন সিলেটি। আজ প্লেনে উঠে তাই অনুধাবন করলো। পাশারা সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য প্লেনে চেপে বসেছে। পাশার সিট নম্বর এইট সি। এইট এ তে একটা ইয়াং মেয়ে আর সেভেন এ এবং বি তে একটা কাপল।
প্লেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগেই সবাই চড়ে বসেছে এয়ার ক্রাফটে। তখনও সবার মোবাইল চালু। আর কথা তো চলছেই সবার মোবাইলে। আর এতে পাশার ভাবনার খোরাক ও চিন্তার খোরাক অনেক অনেক জড়ো হয়ে গেল।
মেয়েটির নাম সোপা। বিবিএ করছে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে। সোপা মাকে মোবাইলে জানালো সে প্লেনে উঠেছে, চল্লিশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে ঢাকা, গাড়ি যেন এয়ারপোর্ট থাকে। তারপর রনি নামক একটা ছেলেকে ফোন করলো। ফিসফিস করে কথা বললো। মোবাইলসহ সকল ইলেট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার বন্ধ রাখার ঘোষণা নাদেয়া পর্যন্ত কথা সে কথা বলতেই থাকলো। ঘোষণা আরম্ভ হওয়া মাত্র পাশা শিক্ষক সুলভ অভ্যাসবশত একটু মাথা কাত করে মেয়েটি আর তার মোবাইলের দিকে তাকালো। তাতেই কাজ হলো। মেয়েটি লজ্জিতভাবে মুচকি একটি হাসি দিয়ে কথা বলা বন্ধ করে ফ্লাইট মোডে নিয়ে নিলো মোবাইলটি। পাশাও ফ্লাইট মোডে নিলো মোবাইলটি। আর হারিয়ে গেল নতুন এক রাজ্যে তথা কল্পনার রাজ্যে।
সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সাতদিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছিল সোপা সিলেটে, খালার বাসায়। মুন্সীগঞ্জের মেয়ে। ধানমন্ডিতে বাসা। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে সোপা। পড়ালেখায় খারাপ না। কিন্তু পাবলিক ভার্সিটিতে পড়তে হলে ঢাকার বাইরে যেতে হবে তাই ঢাকার নামকরা প্রাইভেট প্রথম তিনটি ভার্সিটির একটিতে এডমিশন নিয়েছে। তবু তো ঢাকায় থাকা হলো। বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা হলো। সাইন্সের ছাত্রীই ছিল সোপা। কিন্তু মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং কোনোটাতেই পড়ার শখ ছিল না তার। তাই তো শেষমেশ এই বিবিএ। ভালোই লাগছে নতুন ধরনের এই পড়া। ওখানেই এমবিএ-র ছাত্র রনির সঙ্গে তার পরিচয়।
প্রথম সেমিস্টারে থাকা অবস্থায় করিডর দিয়ে হেটে কেন্টিনে যাচ্ছে একদিন সোপা। সঙ্গে ক্লাস মেট বান্ধবী তানি। দু’জনে আলাপ করতে করতে যাচ্ছে। এমন সময় ঝড়ের বেগে এগিয়ে এলো একটা ছেলে। হাত বাড়িয়ে দিল। শুধালো- ‘সোপা না? গ্লেড টু মিট ইউ।’ আর সঙ্গে সঙ্গে মনের ভুলে অবচেতন ভাবে সোপার হাতটিও উঠে এলো। পরস্পর হ্যান্ড শেক করলো। পরক্ষণেই ছেলেটি কিছু না বলে উধাও হয়ে গেল। সেদিন আর সোপারা ঐ ছেলেকে খুঁজে পায়নি। তবে খবর নিয়ে জেনেছে, ওর নাম রনি, এমবিএ-র ছাত্র। খুবই দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে। তবু সাহসী সোপাও কম যায় না। পরদিন তানিসহ আরো বান্ধবীদের নিয়ে গিয়ে রনিকে সে চার্জ করলো- ‘ভাইয়া কাল আপনি আমার সঙ্গে ওরকম আচরণ করলেন কেন?’
কোনোরকম রাখঢাক না রেখে সরাসরি উত্তর রনির- ‘সরি সোপা, আই এম এক্সট্রিমলি সরি ফর ইয়েস্টারডেস বিহেভিয়ার। বন্ধুদের সঙ্গে একটা বাজি ছিল, তা-ই।’
‘হোয়াট?’
‘না মানে, বন্ধুরা বলেছিল ঐ মেয়েটার সঙ্গে হ্যান্ড শেক করতে পারলে চাইনিজ খাওয়াবে। তাই এই রিস্কটা নিতে হলো আমায়!’
‘পাগল, আস্ত পাগল!’- বলে সেদিন চলে এসেছিল সোপা। একটা খটকা তার মনে রয়ে গিয়েছিল অনেকদিন। নামটা পেল কোথায়? নাম ধরে যদি না বলতো, তবে তো কোনোমতেই হ্যান্ডশেক করতো না সে। নাম বলায়ই তো তার মনে হলো পরিচিত কেউ হবে হয়ত!
পরে অবশ্য আস্তে আস্তে মনের অজান্তেই রনির সঙ্গেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সোপা। তখনই জানতে পারে, বাজি ধরার পর রনি অফিসে গিয়ে সোপার নাম ও ঠিকানা জেনে আসে। নামে কাজ না হলে তখন ‘ধানমন্ডির সোপা না?’ ু বলে পরবর্তী প্রশ্ন করে তাকে তাক লাগিয়ে কাজ উদ্ধারই ছিল তার মূল উদ্দ্যেশ্য। বুঝা গেল, রনি বুদ্ধিমান ছেলে। আর তাই রনির প্রতিটা বাড়তেই থাকে সোপার। সম্পর্কটা যে গভীর ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়েছে সিলেটের এই সাত দিনে তিলে তিলে টের পেয়েছে সে।
দূরে থাকলেই ভালোবাসা বেশি টের পাওয়া যায়, ভালোবাসার মানুষের অভাব অনুভব করা যায় ক্ষণে ক্ষণে। আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছাকাছি গেলে কেন যেন মনের মানুষটাকে কাছে পেতে আরো উতলা হয় প্রাণ। আর তাইত প্লেনে উঠেই বিকেলে রনির সঙ্গে দেখা করার সময় ঠিক করে নিলো সোপা।
সিলেটে সাত দিন অবশ্য বেশ আরামেই কেটেছে সোপার। ওর তিন খালা আর এক মামা। মামা আমেরিকায় আর ছোট খালা সিলেটে আর সবাই ঢাকায়। ছোট খালা সিলেট বেড়ানোর প্রস্তাব দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় সোপা। প্রকৃতপক্ষে ভ্রমণপ্রিয় মানুষ মাত্রই দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটের নান্দনিক সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ। তাইতো সবাই সময় পেলেই বেড়াতে আসে সিলেটে। সোপাও তাই।
প্রথম দিনই বিছনাকান্দি আর রাতারগুল বেড়াতে গেল সোপারা। তারপর একে একে জাফলং, লালাখাল, মাধবকুণ্ড, মালনীছড়া ও লাক্কাতুরা চা বাগান, পানথুমাইসহ সব সুন্দর সুন্দর জায়গা ঘুরে বেড়ালো ওরা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে দেখে মুগ্ধ হলো সোপা। সোপার খালাতো ভাই বোনেরা সিলেটে অর্থাৎ কাছাকাছি বসবাস করে বিধায় বারবার যেতে হয় জাফলংসহ সব এলাকায়; তবুও কটা দিন সোপার সঙ্গে আবারো ঘুরে তারা খুশি আর তৃপ্ত।  
সোপার ছোট খালার চার ছেলেমেয়ে- তনিমা, জেনি, তুর্য আর মুনিম। একমাত্র মুনিম বাদে সবাই সোপার চেয়ে বড়। সবাই খুব মিশুক আর সোপার জন্য অন্ত্যপ্রাণ। সোপার থেকে পাঁচ বছরের বড় তনিমা। স্কুলশিক্ষিকা। একটা হাই স্কুলে ইংরেজি পড়ায়। স্বামী গ্যাস কোম্পানিতে চাকরি করেন। দু’বছরের একটা ছেলে আছে তনিমার। নাম নিলয়। সবাইকে মাতিয়ে রাখে সারা দিন।
তুর্য। ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স করে একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে কাজ করে। ক্লাস আর রিসার্চ ওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকে বেশির ভাগ সময়। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে সেমিস্টার ফাইনালের পর কিছুদিনের জন্য ভার্সিটিতে কাজের চাপ কম ছিল। তাই রিলাক্স টাইম খুঁজে বের করে সোপাকে নিয়ে চুটিয়ে বেরিয়েছে। আর সুপ্ত বাসনাও যে কিছু ছিল না-তা নয়। একদিন তো সোপাকে একা পেয়ে তুর্য প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসলো। ঘর বাঁধার স্বপ্নের কথা জানালো। সোপা প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। কিছু একটা বলার আগে কিছুটা সময় নিলো। তারপর শান্ত গলায় বললো- ‘তুর্য ভাইয়া, আমি যে আমার ভার্সিটির একজনকে কথা দিয়ে ফেলেছি, আপনার বোন হিসেবে তার সঙ্গে কথার বরখেলাপ করা কি ঠিক হবে?’ এ কথা শুনে কি যেন বলতে চাচ্ছিল তুর্য। এমনি সময় জেনি এসে হাজির। দু’জনেই চুপ হয়ে গেল। আর চারদিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকনের অভিনয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জেনিকে কেন যেন ভয় পায় সবাই। প্রচণ্ড রাগী ও জিদি মেয়ে। অল্পতেই মাইন্ড করে বসে। কথা বেশি বললেও বিরক্তি বোধ করে, আবার কথা কম বললেও মাইন্ড করে। তাই তাকে হেন্ডেল করা বেশ টাফ। জেনির বিয়ে হয়েছিল এক ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে। নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছিল, দু’বছর সংসারও করেছে জেনি। কিন্তু টিকলো না সংসারটি। একদিন রাগ করে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে এলো বাবার বাড়ি। আর সে ওমুখো হতে নারাজ। অনেক চেষ্টা তদবির করেও শেষ রক্ষা হলো না। অবশেষে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। তারপর থেকেই তার এই আমুল পরিবর্তন। সারা রাত জেগে ছেলেদের সঙ্গে চেট করে, উল্টা পাল্টা ছবি দেখে। আর কত কি! একবার তো বাধালো মহা ঝামেলা। বিরাট ধনী এক লোকের সঙ্গে পালিয়ে গেল। বাড়ি থেকে বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছে বলে বেরিয়ে উধাও হয়ে গেল জেনি। তুলকালাম অবস্থা। থানা, পুলিশ, র‌্যাব সবাইকে খবর দিতে হলো। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে ধরে আনা হয়েছিল বাসায়। সেদিন সোপার ছোট খালার এই বাসাটি মরা বাড়ির মতো হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো কাঁদেন সোপার এই খালাটি।
বিবিএ পাস করা মেয়ে জেনি। দেখতে খুবই সুন্দরী, স্মার্ট। তাই সবাই মিলে তার জীবনকে আবারো সেটেল্ড করার জন্য মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি জেনিকে ব্যাংকের চকরিতে ঢুকিয়ে দেন। ভালো পদে চাকরি, জুনিয়র অফিসার। অপরদিকে তাকে এক্সিকিউটিভ এমবিএ কোর্সেও ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। ওখানে গিয়েও একই অবস্থা শুরু করে দেয় জেনি। জুনিয়র সিনিয়র সবার সঙ্গে সমান তালে আড্ডা দেয়া, আর অশ্লীল গান শোনে, অশ্লীল মুভি দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে সবসময়। প্রতিদিনই বাবা মা-ভাই-বোনদের কাছে জেনির নামে শুধু নালিস আসতে থাকে। চাকরিরও যায় যায় অবস্থা।
একরাত্রে বাসায় অতিরিক্ত মেহমান আসার কারণে সোপাকে জেনির রুমে রাতযাপন করতে হয়েছিল। সে রাত্রের অভিজ্ঞতা সোপা জীবনে ভুলবে না। ঘুমের ভান করে শুয়ে শুয়ে সে রাত্রে জেনির কান্ডকীর্তি অবলোকন করেছে সোপা। রাত বারোটার পর থেকে বিভিন্ন লোকদের সঙ্গে চেটিং শুরু করে জেনি। কাউকে সে অশ্লীল গান শোনায়, কাউকে আবার নাচ দেখায়, কাউকে কাউকে আবার বিভিন্ন পোজে ছবি পাঠায়। এ এক এলাহী কাণ্ডকারখানা। সোপা তো ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গুটিয়ে থাকে আর ভাবে- সকালে হয়ত মোবাইলে কথাবলা বা নেটে যোগাযোগ করা লোকগুলো বাসায় এসে হাজির হবে?
জেনি সোপার থেকে বড় হলেও সমসাময়িক। তাই সোপা জেনির ব্যাপারে বেশ সেনসেটিভ। এ কারণেই সোপা মনে মনে ভাবে খালাকে বলে জেনির আবার বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলে বোধহয় এথেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। যাই হোক সিলেটে কিছু না বলে ঢাকা থেকে এক ফাঁকে টেলিফোনে খালার সঙ্গে এব্যাপারে আলাপ করবে ভেবে নিলো সোপা।
মুনিম। সোপার চেয়ে একবছরের ছোট। মেডিকেলে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। স্কলার ছেলে। চটপটে স্বভাবের আর মিশুক। ঘোরাফেরা করে অভ্যস্থ। সব জায়গায়ই তার চেনা। সেও সোপাকে সঙ্গ দিয়েছে সর্বত্র। সবাই সোপার জন্য সময় বের করে নিল, তাকে নিয়ে সিলেটের এত এত জায়গায় ঘুরে বেড়াল। কেউ বোর ফিল করেনি। সিলেট ভ্রমণ করে সোপা তাই তৃপ্ত।
প্নেনে সিট বেল্টটা ঠিকমতো লাগিয়ে প্লেন টেইক অফ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের সঙ্গে এয়ার ফোনটার সংযোগ করে গানের টিউন অন করলো সোপা। বেজে উঠলো রাসেল প্লাটেনের ‘কজ ইউ মেইক মি স্পিচলেস, ইউ কুয়াইট মাই ডেমন্স, সোয়ালো মি হোল টু নাইট অ্যান্ড জাস্ট কিল মি সাইলেন্টলি, আই ডোন্ট নিড এ রিজন, হোয়াই ইউ মেইক মি স্পিচলেস......কাম অন বেবি মেইক মি স্পিচলেস....’। আর মানস পটে ভেসে উঠলো রনির চেহারাটা।
রনি ওর ডাকনাম। আসল নাম রওনক জাহান। দেশের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ঢাকায় বাবার নিজের বাসা অর্থাৎ ফ্লাট। গুলশানের নিকেতনে। মা বাবা ও দুই ভাই বোনের ছোট সংসার। বোনটি বড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এপ্লাইড ফিজিক্সে মাস্টার্স করে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো জব করছে। আমেরিকায় সেটেল্ড এক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। দু’বার ঘুরে এসেছে আমেরিকায়। পারমানেন্টলি যাওয়ার প্রচেষ্টায় পাইপলাইনে আছে। রনির বাবা সরকারি ব্যাংকের বড় অফিসার, জিএম। সৎ ও কর্মঠ অফিসার হিসেবে বেশ সুনাম আছে রনির বাবা আলতাফ হোসেন সাহেবের। এখন শুধু ছেলেটার একটা গতি হলেই তার সাফল্য পরিপূর্ণতা খুঁজে পাবে। তাই ছেলেটা কোথায় যায়, না যায়- খবর রাখেন সবসময়। পড়ালেখা কখন শেষ হবে, কিভাবে কি করবে- এসব নিয়ে সবসময়ই আলাপ-আলোচনা চলে পরিবারের সবার সঙ্গে। পুরোপুরি সুখী এবং স্বাধীন রনির ছোট পরিবারটি। এসব খুঁটিনাটি সব খবরই সোপা জেনে নিয়েছে রনির কাছ থেকে, আর তাই সোপার এতো ভালো লাগে এদেরকে।
আবহাওয়াটা একটু খারাপ মনে হলো, বেশ বাম্পিং করছে ‘আকাশ প্রদীপ’। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি হচ্ছে প্লেনটিতে আজ। পাশার একটু ভয় ভয় লাগে যদি কোনো এক্সিডেন্ট হয়? বউ ছেলে মেয়ের কি হবে? ছেলে মেয়ে দুটোর কিছু একটা গতি না করার আগে যদি কিছু হয়ে যায়? প্লেন এক্সিডেন্ট হলে তো সব শেষ। বাচার কোন আশাই নাই। তাই আল্লাহ্‌র নাম নেয়া শুরু করে পাশা। কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তার সহায়তা কামনা করতে থাকে। পাইলটের পক্ষ থেকেও ঘোষনা দেয়া হয়- ‘আমরা কিছুটা প্রতিকুল আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করছি’।
পাশের মেয়েটার কোনো বিকার নাই দেখে একটু বিরক্ত হয় পাশা। পাশা ভাবে এখনকার যুগের ছেলে মেয়েগুলো এমন কেন? কোনো কিছুকেই সিরিয়াসলি নিতে চায় না, এই এয়ার ফোনের কারণেই? দুটো কানকেই তারা যন্ত্র লাগিয়ে ব্যস্ত রাখে যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ। এনিয়ে নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গেও অনেক ক্যাচাল হয় পাশার। মেয়েটার কানের নলটা খোলানো আর আসন্ন বিপদের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তাই প্রশ্ন করে পাশা- ‘তোমার বাড়ি কোথায় যেন মা?’
আস্তে করে এয়ার ফোনটা খুলে সোপা জবাব দিলো-‘ মুন্সীগঞ্জে। কেন আংকেল?।’
‘না, এমনিতেই জিজ্ঞাস করলাম।’
তারপর আর কে পায় পাশাকে। ভয় কাটানোর জন্য গল্প জুড়ে দেয়। সোপার নাড়ি নক্ষত্র সবকিছুই একে একে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয় পাশা।  ইতিমধ্যে বাম্পিংটা বা ঝাঁকুনিটাও কমে আসে। মনটা চিন্তামুক্ত হয়ে আসে পাশার। তাই নিজেরও যা যা গল্প করার সবই বক বক করে শেয়ার করে নেয় মেয়েটির সঙ্গে অর্থাৎ সোপার সঙ্গে। সোপাকে নিজের ভিজিটিং কার্ডটা দিতে ভুলে না পাশা।
প্লেন বিপদমুক্ত হওয়ার পর পাশার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে সোপা কিছুটা সময় রেস্ট নেয়ার চেষ্টা করে। চোখ বুজে হারিয়ে গেল রনির রাজ্যে, যেখানে আর কারো প্রবেশাধিকার নাই; শুধু সে আর রনি, রনি আর সে মিলে মিশে একাকার। স্বপ্ন গড়ার স্বপ্নে বিভোর দু’জনা। আর ক’টা দিন, রনির এমবিএটা শেষ হলেই ঢুকে যাবে চাকরিতে। আর তারপরই বিয়ে করবে তারা। সোপার পড়া কিছুটা বাকি থাকবে বটে, তবুও  তা-ই করবে তারা। কারণ, তাদের আর তর সইছে না। আর ওদিকে সোপার বাবা-মার মতিগতিও ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। কবে না আবার বর একটা ধরে এনে বলবে একে বিয়ে করতে হবে, না হয় আমরা বাচবো না। তখন তো সোপা পড়বে মহা ঝামেলায় তাই আগে ভাগই মা বাবাকে বলে এই ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলবে ভাবছে দু’জন। তারপর। তারপর কি ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যায় সোপা- স্বামী, সংসার, শ্বশুড় শ্বাশুড়ী, আর আর...আর ভাবতে পারে না। লজ্জা লাগে যেন।  
পাশা আর কম যায় কিসে? সেও ভাবনার সাগরে ডুবে গেল। চোখ বুঝে ভাবতে থাকে তার সেই জুইয়ের কথা। তখন কতই বা বয়স হবে পাশার! ছাব্বিশ কি সাতাশ। পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে। জুই আর তার বান্ধবী লতা সবসময় একসঙ্গেই থাকে। লতা একটু বেশিই বন্ধুবৎসল। বেশ ক’জন বন্ধু তার। একসঙ্গে ছয় সাতজন বন্ধু-বান্ধবী ঘুরাফেরা করে তারা, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সিনেমা দেখে, বাইরে রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। পাশাও তখন এদের সঙ্গে যোগ দেয়। কম কথা বলা পাশা শুনতেই বেশি পছন্দ করে, বলে খুব কম। অনেকটা ইন্ট্রোভারট। সেই পাশাই তার বন্ধুদের সহায়তায় এগিয়ে যায় জুঁইয়ের দিকে। আর জুঁইকেও সব বন্ধু মিলে দুর্বল করিয়ে দেয় অন্তর্মুখী পাশার দিকে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, প্রেম থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসা। আর ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ খেলতে খেলতে ওটা পরিণত হয়ে পরিণয়ে বা বিয়েতে রূপান্তরিত হয়। ডাক্তারি পাস করে ইন্টার্নশিপ ট্রেনিং শেষ করেই বিয়ে করে পাশা আর জুই।
পাশার ভাবনা আর এগুতে পারলো না। দশ মিনিট বাকি থাকতেই পাইলটের ঘোষণ শোনা গেল- অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকায় অবতরণ করতে যাচ্ছি......।’ পাশা নড়েচড়ে বসে সিটবেল্টটা বেধে নিল।
সুরেলা কণ্ঠে- ‘ভদ্র মহিলা ও মহোদয়গণ এইমাত্র আমরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকায় অবতরণ করেছি। বিমান সম্পূর্ণ না থামা পর্যন্ত...’- ঘোষণা শুনে আস্তে ধীরে নামার প্রস্তুতি নিল সবাই। পাশা ক্ষণিকের পরিচিত সোপা আর আশপাশের অন্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিল আর বললো- ‘যোগাযোগ রেখো।’ পাশার আপন আপন আচরণে তারা খুবই উৎফুল্ল। বললো- ‘অবশ্যই, উই আর প্লিজড আপন ইউর বিহেবিয়ার জেন্টেলম্যান।’
পাশা বিশ্বাস করে কর্মব্যস্ততার অপর নাম জীবন। তাই স্বাভাবিকভাবে মফস্বলের নিজস্ব শহরটায় ফিরে এসেই আবার ব্যস্ততায় গা ভাসিয়ে দিলো পাশা। এভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ঝরে যায়। মাঝে মাঝে বিষণ্নতা পাশাকে চেপে ধরে। কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ হয়ে যায়। বিশেষ করে কোন কাজ না থাকলে অথবা একা থাকলে। শুক্রবার দিন। ছুটির দিন। জুঁই ছেলেমেয়েকে সঙ্গ দিতে ঢাকা গেছে, বাসায় কেউ নেই। একা বসে কতক্ষন আর মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকা যায়। ড্রাইভারটাও বাড়ি গেছে। নাহলে একটু বাইরে যাওয়া যেত। দিবা নিদ্রার চেষ্টা করবে নাকি তাই ভাবছে। এমনি সময় বেরসিক মোবাইটা বেজে উঠলো। পাশার ক্লিনিক থেকে থেকে কল এসেছে। ডিউটিরত ডাক্তার অপু কল করেছে। ডা. অপু বললো- ‘স্যার, আপনার একজন আত্মীয় ভর্তি হয়েছে। হিস্ট্রি অফ ফল ফ্রম হাইট। কি করবো স্যার?’
‘কোথা থেকে এসেছে?’
‘হাউজিং এস্টেট থেকে স্যার।’
‘কোনো ফ্রেকচার আছে বলে মনে হয়, অপু?’
‘না স্যার, তেমন কিছু মনে হয় না। রুগী আপনাকে না দেখিয়ে কোনো কনসালটেন্ট দেখাতে চায় না।’
‘ওকে, এ্যাম্বুলেন্সটা বাসায় পাঠিয়ে দাও, আমি আসছি।’
পাশা গিয়ে দেখে সোপা। আকাশ প্রদীপের সেই মেয়েটি। বছর তিনেক আগের কথা, তাই প্রথমে পাশা চিনতে পারেনি। তবে সোপার কথা বলার স্টাইল দেখেই পাশার মনে পড়ে গেল সব। সঙ্গে সঙ্গে পাশা প্রশ্ন করলো- ‘তুমি সিলেট কবে এলে? কিভাবে ব্যথা পেলে?’
সে তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসলো আর তার সামনে বসে থাকা মহিলাকে ইংগিত করে বললো- ‘আংকেল উনি আমার খালা আর উনার বড় ছেলে তুর্য আমার হাসবেন্ড। আমিতো তিনবছর যাবত সিলেটেই থাকি। বাথরুমে আছাড় খেয়ে পড়ে গেছিলাম, বেশ ব্যথা পেয়েছি।’
সোপার কথার ধরন দেখে মনে হলো ও কথা লুকাতে চাচ্ছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা আর এক্সরে’র উপদেশ দিয়ে পাশা চলে এলো। আর ডিউটিরত মহিলা  ডাক্তারকে বলে এলো- রুগীকে একা নিয়ে ভালো করে হিস্ট্রি নিতে আর শরীরের যে যে অংশে ব্যথা আছে তা সরাসরি পরীক্ষা করে দেখতে।
পাশা যা ভেবেছিল তাই। ডা. রেবেকা রাতে ফোন করে জানালো- ‘স্যার ইটস এ কেস অব এসল্ট। হাজবেন্ড মেয়েটাকে মেরেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে স্যার।’ চিন্তায় পড়ে গেল পাশা। এসল্ট কেইস তো ক্লিনিকে রাখা ঠিক না। সরকারী হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হবে। কারন এটা তো পুলিশ কেইস, পুলিশকে অবশ্যই ইনফর্ম করা দরকার। এর আগে সোপার সঙ্গে একটু আলাপ করা দরকার। পাশা রেবেকাকে বললো- ‘মেয়েটার সঙ্গে একা একটা কথা বলা দরকার, তুমি এরেঞ্জ করে আমাকে জানিও, ডিওডি রুমে বসবো আমরা।’ রাত আটটায় সোপাকে নিয়ে বসলো পাশা আর রেবেকা। প্রথমেই কান্নায় ভেঙে পড়লো সোপা। কেঁদে কেঁদে যা বললো তা শুনে পাশা যেন আকাশ থেকে পড়লো, বিশ্বাস করতেও কষ্ট লাগলো।
সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়ার পরই সোপার জীবনে নেমে আসে ঝড়ের তাণ্ডব। এই আকস্মিক ঝড় সোপার জীবনটা ওলট পালট করে দেয়। সিলেটের বেড়ানো শেষ করে যাওয়ার দিন প্লেনে বসেই সে রনির সঙ্গে দেখা করার একটা সময় ঠিক করে নেয়। সে অনুযায়ী তারা দেখাও করে। কিন্তু রনির মধ্যে কেমন যেন পরিবর্তন টের পায় সোপা। রনি কি যেন বলতে চেয়েও বলতে পারছে না? আবার আগের মতো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও দেখাচ্ছে না। কিছুটা তাড়াহুড়া করে চলে যেতে চাচ্ছে বলে মনে হলো। তাই তেমন কথা না বাড়িয়ে সোপা সেদিনের মতো রনির কাছ থেকে বিদায় নেয়।
বান্ধবী তানিকে ডেকে পাঠায়। সন্দেহের কথা বলে, বুদ্ধি চায়।  
তানি খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে। সোপাদের ক্লাসের ২৭ জন মেয়ের মধ্যে সেই সবার বুদ্ধিদাতা। কেউ কোন প্রব্লেমে পড়লেই তার শরনাপন্ন হয়। ক্লাসের সব ছেলে মেয়ের সঙ্গে তার খাতির। সে অবশ্য প্রেমট্রেম বিশ্বাস করে না। বেশ প্রপোজাল পেয়েছে, কিন্তু সবাইকে বুঝিয়ে বলেছে-‘ বাবা মায়ের পছন্দের ছেলেকেই আমি বিয়ে করবো, প্রয়োজনে ওটাকেই একটু দেখে শুনে বুঝে  নেবো। কিন্তু বিয়ের আগে প্রেম নয়, বিয়ের পরেই প্রেম।’ কিন্তু মেয়েটি খুবই বন্ধুবৎসল ও বন্ধু অন্তপ্রাণ। কারো জন্মদিন, কারো রিজাল্ট সেলিব্রেশন, কারো প্রপোজালে সহায়তা কিংবা কারো ব্রেকআপ থেকে উদ্ধার করা- সবকিছুতেই একটিভ তানি। ন্যায়ের পক্ষে যে কাউকে কিছু বলতেও পিছপা হয় না তানি নামের এই মেয়েটি। তার এত সাহসের পেছনের কারণও আছে বটে। কারণ হচ্ছেন তাদের ভার্সিটির প্রোভিসি মহোদয়। উনি তানির সম্পর্কীয় চাচা। তাই তানিকে অনেকেই ভয় পায় আর সমীহ করে। সোপার সমস্যাটা চিন্তার ফেলে দিল তানিকে। সে ভাবছে- ‘রনি কি অন্য কোথাও রিলেশনে জড়ালো?’ ‘নাকি সোপার কোন আচরণে ব্রেকআপে যেতে চাচ্ছে?’ ‘নাকি অন্যকোনো কিছু?’ ‘কিভাবে খোঁজ নেয়া যায়?’ ভেবেচিন্তে তানি সোপাকে বললো- ‘তুই নিজ থেকে এখন আর রনির সঙ্গে যোগাযোগ করিস না প্লিজ, আমি খবর নিয়ে নেই কি ঘটেছে বা ঘটছে, তারপর না হয়ে আমিসহ বসবো রনির সঙ্গে।’ সব
সোর্স কাজে লাগিয়ে তানি সোপার কাজে লেগে গেল। খুঁজতে খুঁজতে সঠিক মানুষও পেয়ে গেল।
রেহনুমা। আজিমপুর গার্লস স্কুলে তানির সঙ্গে পড়তো। তখন খুবই বন্ধুত্ব ছিল দু’জনার। এসএসসির পর রেহনুমা চলে যায় হলিক্রসে। তারপর থেকে আর যোগাযোগ নেই রেহনুমা-তানির। হঠাৎ করেই সেদিন তানির ছবি দেখে রেহনুমা মেসেঞ্জারে রিকোয়েস্ট পাঠায় কথা বলার জন্য। তানি কল করে। গড়গড় করে অনেক কথা বলে রেহনুমা। এইচএসসি পাস করে ফ্যামিলি প্রব্লেমের কারণে আর পড়ালেখা করেনি রেহনুমা। স্মার্ট, লম্বা ও সুন্দরী রেহনুমা একটা নতুন এয়ার লাইন্সে ট্রেইনি এয়ার হোস্টেস হিসেবে জয়েন করে। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে একটা নামকরা এয়ারলাইন্সে যোগ দেয়। আর সেই সুবাদে আজ এদেশে, তো কাল ওদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই থেকে আবার শুরু। তানিকে প্রায়ই ফোন করে রেহনুমা। দীর্ঘক্ষণ আলাপ করে।
‘কোন পুরুষ প্যাসেঞ্জার বা কলিগ কেমন আচরণ করে?’ কিংবা ‘কোন দেশের পুরুষগুলোর নেচার কেমন?’ অথবা ‘কখন কোন লোক চান্স পেলেই ব্রেস্টে হাত দেয়’ অথবা ‘বেখেয়ালে শরীরের গোপন অঙ্গে স্পর্শ হয়ে গেলে কে কেমন আচরণ করে?’ কিংবা ‘সে নিজে এইগুলোকে কিভাবে এঞ্জয় করে?’- এসব অনেক গোপন ও অসভ্য কথাও অকপটে শেয়ার করে তানিকে। একদিন তো এক কাহিনী বলতে বলতে তানির কান গরম করে ফেলে।
রেহনুমা তখন এয়ার লাইন্সে নতুন চাকরি নিয়েছে। একটা ফ্লাইট নিয়ে তারা গেছে দুবাই। আবহাওয়ার কারনে ওখানে প্লেনের সিডিউল বিপর্যয়। কম করেও বারো ঘন্টা সময় বেশি থাকতে হবে। সে আর তার কলিগ স্বর্ণা সমবয়সী। তাই সে নিজেকে স্বর্ণার সঙ্গে টেগ করে নিয়েছে। এয়ারপোর্ট সংলগ্ন পাঁচতারা হোটেলে সকল ক্রুর থাকার ব্যবস্থা হলো। রেহরুমা আর স্বর্ণা পেয়েছে একটা টুইন ডিলাক্স রুম। লাগেজ খুলে নতুন চাকরি পাওয়ার পর নতুন কিনা স্লিভলেস নাইটিটা গায়ে জড়িয়ে নিল রেহনুমা। আয়নায় নিজেকে একটু দেখে নিল। নাইট ড্রেসটাতে তাকে ভালোই মানিয়েছে। কিন্তু এটা তো আর সব জায়গায় পরা যাবে না! এই বিদেশে এলেই একটু পরতে হবে। রাত তখন বারোটা। ঘড়িতে ছ’টায় অ্যালার্ম সেট করে বেডে গেল রেহনুমা। স্বর্ণার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে শোবার অল্প সময়ের মধ্যেই তাই ঘুমের রাজ্যে চলে গেল রেহনুমা।
বা’দিকে কাত হয়ে শুয়ে থাকা রেহনুমার হটাত ডান স্তনে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘুম ভাঙলো। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। কারণ রুমে কোনো আলো নেই, ঘুট ঘুটে অন্ধকার। জানালার পর্দাগুলোতেও বিন্দুমাত্র ফাঁক নেই। আর যে তাকে জড়িয়ে ধরেছে সে পিঠের দিক থেকে তাকে একেবারে জাপটে ধরে আছে আর গায়ের সঙ্গে একেবারে আঠার মতো লেগে আছে। তদুপরি ব্ল্যাংকেট দ্বারা দুজনেরই শরীর আবৃত করে রেখেছে বিধায় বুঝতেও পারছে না- মানুষটা কে? এতো ভয় পেলো যে, কয়েক সেকেন্ড কিছুই ভাবতে পারলো না রেহনুমা। পরক্ষনে চিন্তা করলো- ‘স্বর্ণা কি হোমো সেক্সুয়েল? স্বর্ণা কি তাকে ঝাপ্টে ধরেছে?’ কিন্তু না। পরক্ষনেই শরীরের গঠনগত বিভিন্ন দিক খেয়াল করে বুঝতে পারলো- তাকে জড়িয়ে ধরা মানুষটা পুরুষ। ভয়ে হিম হয়ে এলো শরীরটা।
এদিকে এতটুকু পর্যন্ত শুনে ভয়ে তানির হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। কাপতে শুরু করে দিলো। টেলিফোনে চিৎকার করে উঠলো-‘তারপর, কি করলি?’
বিরাট হোটেলের বিশতলার উপরে এয়ার টাইট রুমের ভিতরে থেকে চিৎকার করলেও কোন লাভ হবে বলে মনে হলো না রেহনুমার। তাই একটু ভেবেচিন্তে নিজেকে সেইভ করার পন্থা বের করে নিলো রেহনুমা। বহু কষ্টে গলা স্বাভাবিক করে ঠান্ডা মাথায় বললো-‘হু ইজ হেয়ার? বি ইজি, বি কুল।’  মিষ্টি কথায় কাজ হলো মনে হলো। সঙ্গে সঙ্গে শক্ত বাধন কিছুটা হালকা হলো। ঐ হাত আর শরীর রেহনুমার শরীর থেকে কিছুটা আলাদা হলো। ঘাপটি মেরে পিছনে শুয়ে থাকা লোকটি ভরাট গলায়  বলে উঠলো- ‘আই এম রাকিব, আই লাভ ইউ নুমা।’
কয়েক সেকেন্ড সময়কেই কাজে লাগালো রেহনুমা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, জানালার পর্দা টান দিল, চাদের আলোতে ঘর কিছুটা আলোকিত হলো। চারদিকে তাকিয়ে লাইটের সুইচটা দেখে মাস্টার সুইচটা অন করে দিল। আর তখন গলা দিয়ে ঘৃণা আর ভয় মিশ্রিত শব্দ বেড়িয়ে এলো-‘দিস ইজ নট দ্যা ওয়ে অফ লাভ মিঃ রাকিব।’ তড়িৎ গতিতে আপেল কাটার ছুরিটা হাতে নিলো রেহনুমা, আর চিৎকার করে উঠলো-‘গেট আউট রাকিব, গেট আউট। আদার ওয়াইজ আই উইল কিল ইউ।’ দুইহাত জোড় করে মাথা নিচু করে ‘সরি, রেহনুমা, সরি’ বলতে বলতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল রাকিব। রেহনুমা তখনো কাঁপছে। দ্রুত উঠে দরজাটা বন্ধ করলো। তারপর প্রথমেই কল করলো স্বর্নাকে-‘এ তুই কি করলি স্বর্ণা?’
হাঁপাতে হাঁপাতে স্বর্ণা রুমে এলো। রেহনুমা দরজা খুলে স্বর্ণাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো আর কাঁপতে লাগলো। কোনো কথাই বলতে পারছিল না সে। স্বর্ণাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়া। ২০২০ নাম্বার রুম অর্থাৎ রেহনুমা-স্বর্ণাদের রুমটার ছিল একটিমাত্র কি কার্ড। রুম লক করলে বা কার্ড নিয়ে গেলে ইলেকট্রিসিটি অফ হবে, রেহনুমার ঘুমে ডিস্টার্ব হবে। আবার নক করলেও রেহনুমা ঘুমাতে পারবে না, তাই স্বর্ণা রুমটা লক না করেই দরজাটাকে বুদ্ধি করে ভিজিয়ে তন্ময়কে নিয়ে স্মোকিং জোনে গিয়েছিল। স্বর্ণা তন্ময় আর রাকিব রেহনুমার কলিগ। তন্ময় আবার রাকিবের বন্ধু। দু’জন হোটেলেও একই রুমে উঠেছে। তন্ময়ের সঙ্গে স্বর্ণার একটু ‘ইয়ে ইয়ে’ মানে প্রেম ভালবাসার সম্পর্ক। তাই সুযোগ পেয়ে একটু নিরিবিলি সময় কাটানো আর সিগারেটের নেশা নিবারণই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। কিন্তু একি হলো? নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করলো স্বর্ণা।
ঘটনার বিস্তারিত জানার পর স্বর্ণা শক্ত সিদ্ধান্ত নিলো দেশে ফিরে হেড অফিসে লিখিত কমপ্লেইন করে রাকিবকে চাকরিচ্যুত করতেই হবে। নচেৎ এই সকল মানবরুপী দানবদের হাত থেকে কেউই রেহাই পাবে না। কিন্তু না। স্বর্ণা এটি আর করতে পারেনি। কারণ, রেহনুমা। রেহনুমার শ্রেফ একই কথা- ‘ওতো আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি, তবে কেনো আমি তার ক্ষতি করবো?’
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে তানি বলে উঠলো- ‘তুই কি পাগল রেহনুমা? এত ঘটনার পরও এই ছেলেটাকে ছেড়ে দিলি?
‘ছেঁড়ে দিলাম কই? রাকিব তো এখন আমার একটা পালিত ভেড়া বা দাসই বলতে পারিস। আমি উঠতে বলে উঠে, বসতে বললে বসে? যা ইচ্ছে তা-ই ওকে দিয়ে আমি করাতে পারি এখন। আরো অনেক কিছু ঘটনা আছে রে বন্ধু! পুরুষদের তুই অত শত বুঝবি না! ওদের নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আমার এখন বেশ ভালোই লাগে রে বন্ধু। অন্যদিন তোকে অন্য আরো ঘটনা শুনাবো বন্ধু।’ - বলেই হাসিতে ফেটে পড়লো রেহনুমা।            
তানি ভাবে- মেয়েটা তো বড় বেয়াঢ়া ও অসভ্য টাইপের হয়ে যাচ্ছে? কখন কি বলে বসে? ‘যোগাযোগ রাখা কি ঠিক হচ্ছে?’ ‘ছোট্টবেলার স্কুলের বান্ধবী, রেসপন্স না করেই বা করি কি?’- নিজেকে নিজেই বুঝায় তানি।
‘যাই হোক, সব চেয়ে সাচ্চা কথা- নিজে ঠিক তো সব ঠিক।’
এই রেহনুমাকে আজ দরকার পড়ে গেল তানির। রেহনুমা একদিন বলেছিল- ‘তানি, তোর ইউনিভার্সিটিতে আমার এক ডিস্টেন্ট কাজিন পড়ে। আমাদের সিনিয়র, কোনো দরকার লাগলে বলিস।’
তাই রেহনুমাকে কল করলো তানি।
‘আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এ মুহূর্তে বন্ধ আছে।’
মনে হচ্ছে সে দেশে নাই। মেসেঞ্জারে চেষ্টা করলো তানি। তাও পাওয়া গেল না, নেটওয়ার্কের বাইরে। এয়ারক্রাফটে হবে হয়তো। মেসেঞ্জার আর মেসেজ দুজায়গায়ই জানিয়ে রাখলো, কল বেক করার জন্য। রাত্রেই রেসপন্স পাওয়া গেল।
মাসকাট এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে অফিসিয়াল সব ফর্মালিটি শেষ করে রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল রেহনুমা। কয়েকঘণ্টার রেস্ট তারপর আবার ফিরতি ফ্লাইট। ওয়াইফাই অন করার সঙ্গে সঙ্গে মেসেঞ্জারে আর মিসকল এলারটে তানি নাম ভেসে উঠলে দেখে চিন্তিত রেহনুমা সঙ্গে সঙ্গে কল করলো তানিকে।
‘কি রে বন্ধু, কি এমন ইমারজেন্সি পড়লো, বিদেশ বিভূঁইয়ে বন্ধুকে স্মরণ?’
‘তুই কি ব্যস্ত রেহনুমা? আমার কিছু দরকার ছিল।’
‘না বন্ধু। আমি এখন ওমানের রাজধানী মাসকাটের এয়ারপোর্টসংলগ্ন একটা রেস্ট হাউসে বিশ্রামে আছি বন্ধু। বল, কি বলবি?’
‘ও মাই গড, ওমান? দেখিস আবার রাকিবের পাল্লায় পরিস না?’
‘হা হা হা, তোর দেখি সব কিছুই মনে আছেরে তানি। রাকিব টাকিব এখন আমার কাছে পান্তা ভাত। কত রতি মহারতিই এখন আমার হাতের মুঠোয় রে তানি।’
‘কবে ফিরবি?’  
‘বন্ধু এই তো রিটার্ন ফ্লাইটেই ফিরবো, চার ঘণ্টা পর আবার ফ্লাইটে উঠবো, দেশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আগামীকাল, কেন বলতো তানি?’           
‘তুই যে একদিন বলেছিলি তোর এক কাজিন আমাদের ভার্সিটিতে পড়ে, তার নাম কি রে? কোন সাবজেক্টে?’
‘কেনো? বিয়ে করবি? প্রেম করবি? না অন্য কোনো কিছু?’
‘না রে, ওরকম কিছু না, আমার এক বান্ধবীর একটা রিলেশন নিয়ে একটু সমস্যা মনে হচ্ছে, মূল ব্যাপারটা জানার জন্য একটু হেল্প দরকার।’
নাম শুনে তো তানির আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। রনিই রেহনুমার কাজিন।
সোপার সঙ্গে রিলেশন সম্পর্কেও সব জানে রেহনুমা।
‘এই রিলেশনে তো কোনো ঝামেলা হবার কথা নয় তানি। কারণ কাজিনটিকে আমি একটু আধটু ধরার বা পটাবারও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সোপার সঙ্গে তার প্রেম তো কাঁঠালের আঠার মতো, কিছুতেই নড়চড় হওয়ার নয়। তবুও কাল দেশে এসে সব কিছু জেনে তোকে জানাবো। আগামীকাল আমার অফ আছে বন্ধু।’
সোপার ব্যাপারে রেহনুমার কথা শুনে তানি আশ্বস্ত হলো আর নিশ্চিত হলো সমস্যার হয়তবা একটা সমাধান হবে। আর সোপাকে রিং করে আশার কথাটা জানাতেও ভুললো না।
কিন্তু সোপার মনের খুঁতখুঁতানি তো কোনোমতেই কাটতে চায় না। সে তো এতদিন যাবত রনিকে চিনে। তার বিহেবিয়ার তার হাড়ে হাড়ে জানা। যে ব্যবহার সে করলো, তা অবশ্যই অস্বাভাবিক। সামথিং রং। সোপা ভাবে- ‘সিলেট এই ক’দিন থেকে আসার কারনে মাইন্ড করলো কিনা।’ আরো ভাবে ‘তুর্য ফোন করলো কিনা?’ ‘কিছু বললো কিনা?’ ‘কোনো ঝামেলা পাকালো না তো আবার?’ ‘কিন্তু তুর্য বা সিলেটের কেউই তো রনির নাম্বার পাওয়ার কথা নয়, তাহলে কি হলো রনির?’
ভেবে কুলকিনারা পায় না সোপা। এখন একমাত্র ভরসা রেহনুমা, যে কিনা রনি আর সোপার ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। তাই সোপার মনে শক্তি সঞ্চিত হলো এই ভেবে যে, রেহনুমা নিশ্চয়ই একটা পজেটিভ খবর নিয়ে আসবে শীঘ্রই। কিন্তু সময় তো আর কাটতে চায় না। কখন খবর আসবে তা নিয়েই অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলো। তানিকে রিং করলো কয়েকবার। আবার ভয়ও লাগে যদি তানি বা রেহনুমা মাইন্ড করে বসে। তাহলে তো সব শেষ। অনেক রাতে তানি টেলিফোন ধরে বলে ‘একটু ঘুমা সোপা, দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।’
পরদিন রেহনুমা দেশে এলো। সব খবরাখবর নিয়ে তানিকে কল করে সোপা আর তানির সঙ্গে কনফারেন্স কলের মাধ্যমে আলাপ হলো। যে রিজাল্ট রেহনুমা শুনালো, তা তিনজনকেই বেদনায় ভরিয়ে দিল। সবার চোখেই পানির আনাগোনা পরিলক্ষিত হলো। সব কথার শেষ কথা হিসেবে জানা গেল- আগামী শুক্রবারে রনির বিয়ে; রনির বাবার এক্স কলিকের আমেরিকা সিটিজেন মেয়ের সঙ্গে। আপাতত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রনি আর নববধূ দেশে থাকবে। যেইমাত্র পরীক্ষা শেষ তখনই হায়ার স্ট্যাডির জন্য রনি চলে যাবে আমেরিকা। বিদেশে পড়ানোর এই স্বপ্ন নিয়েই রনির বাবা ছেলেকে পড়ালেখা করিয়েছেন। এখন উনার আর্থিক যা অবস্থা, তা দিয়ে কোনোক্রমেই ছেলেকে বিদেশে পড়ানো সম্ভব নয়। তাই নওফেল সাহেব ইচ্ছা পোষণ করা মাত্রই রাজি হয়ে গেলেন। বিরাট ব্যবসায়ী নওফেল সাহেব। আগে চাকরি করতেন রনির বাবার সঙ্গে। পরে চাকরি ছেড়ে দেন আর ব্যবসায় ফুলটাইম মনোনিবেশ করেন। কিছুদিন পর সফল ব্যবসায়ী হিসেবে চলে যান আমেরিকা এবং ওখানেই সেটেল্ড করেন। এবার দেশে এসেছেন মেয়েটাকে বিয়ে দেবেন বলে।  এসেই জানতে পারেন আলতাফ হোসেন সাহেব ছেলেকে বিদেশে বিয়ে করাতে চান। তাই তিনি ঘটক লাগান বিয়েটা ঠিক করে দেয়ার জন্য। কারণ আলতাফ সাহেবের এই ছেলে আর এই ফ্যামিলি সম্পর্কে নওফেল সাহেবের সবই জানেন, সবই উনার জন্য পজেটিভ। আলতাফ সাহেবও খুশি হয়ে মেনে নেন প্রপোজালটা। কিন্তু রনি খবর পেয়েই বেকে বসে। মাকে বলে- এ বিয়েতে তার কোনো মত নেই। তার ভালবাসার পাত্রী সোপাকে ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করবে না। মা পড়েন বিপদে। ছেলেকেও বুঝানো যায় না, আবার ছেলের বাবাকেও বুঝানো কঠিন। শেষ পর্যন্ত একদিন রনির বাবা রনিকে নিয়ে বসলেন। বললেন- ‘বাবা রনি, আমার তো বয়স শেষ হয়ে আসছে, এখন তোমাকে কিছু দায়িত্ব দিতে চাই। জীবনে তুমি যা চেয়েছো, তা-ই আমরা তোমাকে দিতে চেষ্টা করেছি, কক্ষনো কোন কিছুতে না করিনি। এখন আমি একটা কিছু চাইবো- আশা করি না করবে না?’ রনি চোখ নিচু করেই কাচুমাচু হয়েই জিজ্ঞাসা করে- ‘তোমারা কি আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইলিং করতে চাচ্ছ বাবা?’
‘না, ব্ল্যাক মেইলিং কেনো বলছো? আমি তো বাবা মায়ের প্রতি তোমার ইমোশনটাকে পূজি করে তোমার উপকার করতে চাচ্ছি অর্থাৎ তোমার উন্নতি চাচ্ছি। আমরা তোমার ভালো চাই বাবা।’ ‘তুমি আমাদের একটি মাত্র ছেলে। আমাদের আশা ভরসাকে, আমাদের ইচ্ছাকে কি তুমি পূর্ণ করতে দিতে চাও না?’
‘আমার খুব ইচ্ছা তুমি বিদেশে পড়ালেখা করে অনেক বড় হও, আর এজন্যই আমার এ প্রচেষ্টা। তুমি যদি আমার একথা না শোনো তবে আমি ভীষণ কষ্ট পাবো। যে কোনো অঘটনও ঘটে যেতে পারে বাবা।’
‘প্লিজ বাবা, প্লিজ এভাবে বলো না।’- একথা বলেই রনি কেঁদে দেয় আর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সোপা আশেপাশে থাকলে তার কাছেই চলে যেত। কিছু কথাবার্তা বলে নিজেকে হাল্কা করার চেষ্টা করতো। কিন্তু সে তো ঢাকাতেই নাই। বেড়াতে গেছে সিলেটে। টেলিফোনে তেমন কিছু শেয়ারও করা যায় না, কারন ফোনের অপরপ্রান্তের পরিবেশটা যে একেবারেই অপরিচিত। তাই রনি বেশ সমস্যাই আছে। ওদিকে রনির বাবা ছেলের কাছ থেকে কোনো জবাব না পাওয়া পর্যন্ত জল স্পর্শ করা থেকেও বিরত রইলেন অর্থাৎ তাঁকে চরম চাপে রাখছেন তার বাবা।
রনি কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মায়ের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। বরং বাবার শরীরের দিকে খেয়াল রাখার জন্য বলছেন, মানে বাবার কথা মেনে নেয়ার জন্য ইন্ডাইরেক্টলি চাপ দিচ্ছেন। চাপে চাপে থাকতে থাকতে আর সোপাবিহীন থাকতে থাকতে কেমন যেন বদলে গেল রনি। অনেক কষ্টে মনকে বুঝিয়ে নিল। বাবা মায়ের লক্ষ্মী ছেলে হয়ে গেল। আর সোপার জীবনে নেমে এলো সর্বনাশ।  
হ্যাঁ, রেহনুমার কাছ থেকে সব জেনে সোপা একেবারে চুপ হয়ে গেল। কথা বলা বন্ধ করে দিলো, খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিল। তানি ফোনে সোপার মাকে সব জানিয়ে দিল। সবাই রেড এলারট হয়ে রইলো। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না। রাতে সোপাকে খাবার জন্য ডাকতে গিয়ে দেখা গেল তার ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পরে দরজা ভেঙে দেখা গেল সোপা অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তড়িগড়ি করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হলো। হাসপাতাল। স্টমাক ওয়াস। স্যালাইন।
দুদিন পর হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলো সোপা। সাইকাটিস্ট সোপাকে সাইকোথেরাপি এডভাইজ করলেন। সোপার বাবা মা একমাত্র মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
পরদিন সোপার বাবা নভোএয়ারের টিকিট কাটলেন। সোপার মা আর এক খালাকে নিয়ে সোজা কক্সবাজার। সমুদ্রতীরের একটা হোটেলে উঠলেন। রুমে বসেই সমুদ্র দেখা যায়, সমুদ্রের বিশালতা অনুধাবন করা যায়। দু-একদিন থেকে দেখলেন সোপার ভালোই লাগছে। তাই সোপার মা খালাকে কক্সবাজার রেখে উনি ঢাকা চলে গেলেন। মা খালা সোপাকে নিয়ে ঘুরেন আর সোপার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। তাদের মন বলে ভালো একটা ছেলের সঙ্গে সোপাটার বিয়ে হয়ে গেলে ভালোই হতো, সোপাটা সুস্থ হয়ে যেত। মনে মনে ছেলে খুঁজতে থাকেন। ইস্টাবলিস্ট ছেলে ফ্যামিলিতে কেউ আছে কিনা তা নিয়ে গবেষণায় লেগে গেলেন দু’বোন। আবার সোপার মন মানসিকতা নিয়ে বিশ্লেষণে মেতে উঠলেন। দেখলেন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে সোপাটা। সোপার মা খালা তাই তুর্যের সঙ্গে সোপাকে মিল করিয়ে দেয়া যায় কিনা ভাবতে শুরু করে দিলেন।
‘একটু আলাপ করে দেখবেন কিনা সোপার সঙ্গে?’
‘আবার রিয়েক্ট করে কিনা কে জানে?’
তবুও সোপার খালা একটু ইংগিত দিয়ে দেখার উদ্দেশ্যে বললেন- ‘সোপা, তুর্য রিং করেছিল, ওর ভার্সিটি বন্ধ, আমাদের সঙ্গ দিতে কক্সবাজার আসতে চাচ্ছে, ফিরার সময় ওকে নিয়েই ফিরবো আমরা। তোর কোনো অসুবিধা নাই তো?’
মার দিকে তাকিয়ে একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলো- ‘কেন, আমরা কি একা ফিরতে পারবো না? কেন অযথা সমস্যা বাড়াতে চাচ্ছ?’ এই বলে সোপা উঠে চলে গেল অন্যত্র। যা বুঝার উনারা বুঝে গেলেন। আরো কিছুদিন ওখানে থাকার পর সবাই ফিরলো ঢাকায়। ফিরেই জানা গেল রনির বিয়ে হয়ে গেছে আর সেও বউকে নিয়ে কক্সবাজার গেছে। সোপার মা খালারা ভাবেন বেশ ভালোই হলো ওদের দেখা হয়নি কক্সবাজারে। নাহলে সোপাকে নিয়ে সমস্যায়ই পড়তে হতো?
সবাই সকাল সন্ধ্যা বুঝিয়ে সোপাকে বিয়েতে রাজী করালেন। তুর্যদের পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি প্রপ্রোজাল আসলো। সোপা তুর্যের সঙ্গে কথা বলে নিলো। তুর্য বললো-‘আমি শ্রেফ ভালোবাসবো, আরো অনেক বেশি ভালবাসবো, এতো ভালবাসবো যা তুমি কল্পনাই করতে পারবে না সোপা- কথা দিলাম।’
দুসপ্তাহের মধ্যেই সোপার সঙ্গে তুর্যের বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়েতে বেশ মজা হলো। যদিও আত্মীয়তার মধ্যে আত্মীয়তা বা বিয়ে, তবুও সব অনুষ্ঠান ঠিক ঠিক পালন করার তাগিদ এলো সোপার পরিবার থেকে। তাদের অকাঠ্য যুক্তি- একটিমাত্র মেয়ের বিয়ে, সবকিছু ক্লাস ওয়ান হওয়া চাই। হলোও তাই। প্রচুর ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল ঢাকার লেডিস ক্লাবে। তারপর ঢাকা-সিলেট বিকালের ট্রেনে চেপে বসলো বর-কনেসহ সিলেটের সবাই, প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জনের একটা বহর। বর-বধূর জন্য একটা সিঙ্গেল কেবিন নেয়া হলো, ওখানেই শুরু হয়ে গেল তুর্য সোপার বাসর ঘরের টুকিটাকি। তুর্যই প্রথম মুখ খুললো। কনেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে গালে চুমু দিয়ে আস্তে করে বললো
-‘মহারানী শেষপর্যন্ত আমার ঘরে এলেন?’
হাত দিয়ে আলতো করে সরিয়ে সোপা বলে উঠলো- ‘হা-হা- এটা করো কি? এটা তো ঘর নয়, এটা যে ট্রেন। আর এখনই এতো তাড়াতাড়ি এতো এডভান্স, বাকি জীবন না জানি কি আছে আমার কপালে?’
‘বাহ, তুমি আমার বিয়া করা বউ না? আজ থেকে একটু যন্ত্রনা তো পোহাতে হবেই।’
সোপার দুজন কাজিন, যারা তার সঙ্গে সিলেট যাচ্ছে তারা, আর তুর্যের ভাই বোনরা এসে সন্ধ্যার আগে ওদের রুমে হানা দিলো। আড্ডা দিলো আর নাস্তা সারলো। যাবার সময় তুর্যের দুলাভাই সোপার কানে কানে বলে গেলেন-‘দেখো শালিকা, এখানে আবার কোন ঝামেলা পাকিয়ে দিয়ো না, বাসায় তোমাদের জন্য ভালো এরেজম্যান্ট রাখা আছে, যা করার ওখানে। একা রুম পেয়ে রাস্তা ঘাটে কিছু করো না কিন্তু?’ সোপা ইঙ্গিতে তুর্যের দিকে উনাকে ইশারা করলো। আর তখন তিনজনই হু হু করে হেসে উঠলো। কিন্তু ওরা যাবার পরই দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে দিল তুর্য। আর দুলাভাই যে কাজটা করতে নিষেধ করেছিলেন, তাই শুরু করে দিলো। আর ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে তারাও চলতেই থাকলো। ট্রেন সিলেটে থামলে তারাও থামলো। বাসায় গিয়ে ডিনার সেরে সবাই চলে গেল ঘুমাতে। আর দরজা বন্ধ করেই তুর্য তার মিশন আবারো শুরু করে দিলো। ট্রেন থামলেও তুর্য সোপা আর থামেনি রাতভর। ভোর রাতে একটু ঘুমের ভাব এসেছিল সোপার। কিন্তু না পাশের লোকের শরীরের বর্ধিত তাপে আবারো রেসপন্স করতে হলো। কোর্সটা কমপ্লিট করে গোসল সেরে ফ্রেস হয়ে নিলো সোপা। চোখে মুখে তার আনন্দের বন্যা। সার্থক যুগল জীবনের শুরু আর একাকী জীবনের পরিসমাপ্তি সোপাকে করে তুলেছে পরিপূর্ণ। তুযের্র ভালবাসার আশ্বাসে বিশ্বাসী সোপা প্র্যাক্টিক্যাল ভালবাসার প্রথম স্বাধ ভোগ করে তাই খুশিতে টুইটুম্বুর। ভালবাসা যে এত মধুর আগে তা কল্পনাই করতে পারেনি সোপা।
এভাবে হাসি খুশির আবহে কেটে গেল কয়েকটা মাস। সোপার বাবা মা, তুর্যের বাবা মা সবাই সুখী এই জুটির সফলতায়। কিন্তু না। ‘শুধু ভালোবাসবে’ বলে যে কথা তুর্য দিয়েছিল- সে কথা সে রাখেনি বা রাখতে পারেনি। বিয়ের মাস তিনেক পর থেকেই কথায় কথায় রনির প্রসঙ্গ টেনে এনে সোপাকে হেনস্তা বা ছোট করার চেষ্টা করা শুরু করে। প্রতি পদে পদে সন্দেহ করে। ‘কোন ছেলের সঙ্গে কি করে ফেলে?’- ভুয়া সন্দেহ করে কোথাও বেড়াতে পর্যন্ত নিয়ে যায়নি তুর্য।
সবকিছু মেনে নিয়ে সংসারটাকে আকড়ে ধরতে চেয়েছে সোপা। বিয়ের বছর খানে পরেই সোপার কোল আলো করে তাঁদের ছেলে হিমেলের আগমন ঘটেছে। তাতেও শান্তি আসেনি সোপার সংসারে। তুর্যের বোনদের কাছ থেকেও তেমন কোনও সহায়তা বা সাহস পায়নি সোপা। তবে তুযের্র মা অর্থাৎ সোপার ছোট খালা সব সময় বলতেন-‘মা ধৈর্য ধর, দেখবি-একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সোপাও তাই ঠোঠ কামড়ে পড়েছিল সংসারে। তার বিশ্বাস- ‘একজন মায়ের নিজের ছেলে সম্পর্কে ধারনা সত্য হতে বাধ্য।’ কিন্তু এ কি হলো? সোপার শ্বাশুড়ি কয়েকদিনের জন্য গ্রামে গেছেন জমিজমার খবরাখবর নিতে। এরই ফাঁকে মোবাইলে ‘অলকে’র সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পরার ব্লেইম দিয়ে ঝগড়া শুরু করে তুর্য। অলক সোপার ক্লাসমেট। সোপার খবরাখবর নেয়ার জন্য ফোন করেছিল। অনেক দিন পর ভার্সিটির ক্লাসফ্রেন্ডের ফোন পেয়ে সোপা যারপরনাই আনন্দিত হয়ে অনেকক্ষণ আলাপ করেছে, সবার খবরাখবর নিয়েছে। কে কোথায় আছে? কি করছে?- সব জেনে নিয়েছে। আর এই ফোনালাপের খবরটাই অতিরঞ্জিত হয়ে তুযের্র কানে পৌঁছেছে। ঘরে ঢুকেই ঝগড়া বাধিয়ে দেয় তুর্য। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তুর্য অত্যন্ত বাজেভাবে সোপার গায়ে হাত তুলে। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সবাই আসেন। সোপার খালা কাম শ্বাশুড়িও গ্রাম থেকে চলে আসেন। ডাক্তারের সঙ্গে মৌখিক আলোচনা করে প্রথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয়। ঢাকায় অর্থাৎ সোপার বাবা মাকে না জানানোর অনুরোধ করেন সোপার খালা খালু। কিন্তু সঠিক চিকিৎসার জন্য রুগীকে হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন বলে জানিয়ে দেন ডাক্তার। আবার প্রেস্টিজ রক্ষার্থে কাউকে সঠিক ঘটনাও জানানো সম্ভব হচ্ছে না বিধায় সোপা নিজের লোক হিসেবে পাশাকে স্মরণ করে। আর তাই পাশার হাসপাতালে চলে আসে সোপা।  
কথা বলতে বলতে সোপার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝড়েছে। ডাক্তার রুমের পরিবেশটা একেবারে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। সবার চোখ ছল ছল করতে থাকে সোপার দুঃখে। রেবেকাতো কেঁদেই ফেলে আর পাশাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে-‘স্যার এর একটা সঠিক বিচার হওয়া উচিত স্যার।’ পাশারও চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। রেগে বলে-‘ ইটস এ পুলিশ কেইস, প্লিজ কিন্তু সোপা এটা চায় না। এখনই চরম কোন একশনে যেতে চাচ্ছে না সোপা। আর তাই সে নিজের লোক হিসেবে পাশার বুদ্ধি ও সাহায্য চাচ্ছে, যাতে করে সাপও মরে, আবার লাঠিও না ভাঙ্গে। পাশা ভাবে এটা কিভাবে সম্ভব? একটা শিক্ষিত ছেলে কিভাবে এ কান্ড ঘটায়? এখন সে কি করবে? কিভাবে সোপাকে সাহায্য করবে? আইনের দিক বিবেচনা করলে অবশ্যই তুর্যকে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া উচিত। পরে যা হবার হবে। অন্যদিকে সোপার দিকটা দেখা দরকার। সে তো সবে মাত্র শক থেকে উঠেছে, তারপর ছেলেটাও একেবারে ছোট। সব দিক চিন্তা করার জন্য একটু সময় নিলে কেমন হয়? তাই করলো পাশা। সোপাকে বললো-‘তুমি দু’তিন দিন হাসপাতালে থাকো, দেখি কি করা যায়?’  রেবেকাকে আলাদা করে ডেকে পাশা বলে দিলো- ‘ডক্টর তোমাকে সোপার সঙ্গে আবারো আলাপ করে ওদের কঞ্জুগেল লাইফের বর্তমান অবস্থাটা একটু জানতে হবে, কোন ডিপ্রেশন আছে কিনা? ম্যাক্সিমাম সমস্যা শুরু হয় ওখান থেকেই। প্রয়োজনে সাইকাটিস্ট দেখানোর এডভাইজ দিতে হতে পারে।’ মাথা নেড়ে সায় দিলো ডা. রেবেকা।
পরদিন চেম্বারে বসে বসে বাদাম খাচ্ছে পাশা। কোন কাজ ছাড়া বসে থাকলে এই জিনিসটা খুবই উপকারী। বাদামের খোসা খোলে পরিষ্কার করে তারপর চিবিয়ে সময় পার করা যায়। পাশা এ কাজে মগ্ন। এমনি সময় এটেনডেন্ট উত্তম এসে বললো- ‘স্যার, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান।’
‘রুগী।’
‘না, স্যার।’
‘ঔষধ কোম্পানি?’
‘না, স্যার।’
‘তাইলে একটু বসাও।’
বাদামের সরঞ্জাম সব গুছিয়ে রেখে লোকটাকে ডাকলো পাশা।
সুন্দর সৌম্য চেহারার এক পুরুষ প্রবেশ করলো পাশার রুমে। দেখলেই ভালো লাগার মত চেহারা যাকে বলে। কথাবলার আগেই পাশার খুবই ভাল লাগলো লোকটাকে। মাঝে মাঝে এমন হয় পাশার। কাউকে কাউকে দেখলে ভাল লাগে, তার জন্য ভাল কিছু করতে ইচ্ছে হয়। রুগীদের ক্ষেত্রেও এমন হয়। আজ কেনো যেন একে দেখে তেমনই মনে হলো পাশার।
‘আসসালামু আ’লাইকুম, বসেন।’- পাশা বললো।
‘ওয়া লাইকুমাস সালাম, একটু কথা ছিল?’- লোকটি বললো।
‘ওকে, বলেন।’
বলতে যেয়েও কথা বলতে পারছে না দেখে পাশার মনে একটু সন্দেহ হলো। ‘কে লোকটা?’ সুন্দর মানুষটা চেয়ার থেকে উঠে পাশার পায়ের দিকে এগুচ্ছে দেখে পাশা দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে আটকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-‘কি ব্যাপার?’
সে জোর করে পাশার পায়ে ধরে ফেললো আর বললো- ‘আমাকে মাফ করে দেন আংকেল, আমি তূর্য।’
ইলেক্ট্রিক শকের মতো উঠে দাড়ালো পাশা। আর তার মুখ দিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন বেরিয়ে এলো- ‘কি ব্যাপার বলেন তো?’
‘কেনো মাফ চাচ্ছেন?’ ‘কি করেছেন আপনি আমার সঙ্গে?’
তূর্য এবার পাশার হাত চেপে ধরলো আর শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে দিলো। পাশা তূর্যের আচরনে অবাক হয়ে গেল আর বললো-‘কান্নার কি প্রয়োজন? বসেন। বসে বলেন, কি কথা আপনার?’
কান্নারত অবস্থায়ই তূর্য অনেক কথা বললো। তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলো। ভবিষ্যতে এরকম কাজ তার দ্বারা আর কক্ষনো হবে না মর্মে ওয়াদা করলো।
পাশা বললো- ‘এসব কথা তো আমাকে বলে লাভ নেই তূর্য। আমি হচ্ছি গিয়ে থার্ড পারসন। আপনি আপনার স্ত্রী, বাবা মা উনাদের সঙ্গে আলাপ করেন অথবা আইনের হাতে ধরা দেন। আমি তো প্রথম জানার পরই আইনের আশ্রয়ের কথা বলেছি সোপাকে। সে অবশ্য আপনাকে ঐ বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে। সো থিংক ইউরসেলফ। যা করেন স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই করেন।’
রাতে রেবেকা সোপার পজেটিভ রিপোর্ট নিয়েই পাশার কাছে আসে। সোপা তুযের্র যুগল জীবন বা কঞ্জুগেল লাইফ তথা সেক্সুয়াল লাইফ উভয়ের কাছেই আকর্ষণীয় আর উপভোগ্য। ‘দে এনজয় ইট মোর দেন এনাফ’। সোপা রেবেকাকে এসব ব্যাপারে এমন রগরগা বর্ণনা দিয়েছে যে, সে লজ্জায় পাশার সামনে অনেক কথা উচ্চারণই করতে পারছে না। তবুও যেহেতু ডাক্তার, তাই আকারে ইঙ্গিতে হলেও  ব্যাপারটা পাশাকে বুঝাতে চাইছে রেবেকা। সোপার মতে এব্যাপারে তুর্যও একই মতামত প্রদান করবে তথা দুজনই এ জীবনে সুখী; যুগল জীবনে কেউ কারো থেকে কম যায় না।
পাশা কিছুটা আশ্বস্থ হলো। কিন্তু ডা. রেবেকার মনে প্রশ্ন- এসব দিয়ে কি করবে পাশা? কি করতে চায়? শেষে জিজ্ঞাসাই করে বসলো-‘এসল্টের সঙ্গে এটার কি সম্পর্ক স্যার?’
পাশা বললো- ‘সেক্সুয়াল ডিসফাংশন ইজ দা মেইন কজ অফ সেপারেশন এন্ড এসল্ট ইজ দা ফার্স্ট সাইন অফ সেপারেশন ইন এ কঞ্জুগাল লাইফ।’ অর্থাৎ যৌন অতৃপ্তি আলাদা জীবনযাপনের প্রধান কারন আর গায়ে হাত তোলা হচ্ছে আলাদা হওয়ার প্রথম লক্ষণ। পাশা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল তখন রেবেকার আবার প্রশ্ন-‘এদের ক্ষেত্রে তো অতৃপ্তি নেই তবু কেনো এ অবস্থা?’
‘তুমি যা জানালে তাতে আমি নিশ্চিত যে ওদের ব্যাপারটা শীঘ্রই মিটমাট হয়ে যাবে, তবে ভাবনার বিষয়-এসব ঘটনা রিপিটেডলি ঘটতে থাকলে সংসারটা টিকবে কিনা চিন্তার ব্যাপার? দে বউত আর সেনসেটিভ গাই।’
ঠিকই পরদিন সোপা পাশাকে তার কেবিনে ডেকে পাঠালো। একজন শিক্ষিত লোক তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে। সেই স্বামী স্ত্রী দুইজনই পাশার হেল্প চাচ্ছে- এমতাবস্থায় পাশার কি করণীয় ভাবতে ভাবতে সোপার কেবিনে প্রবেশ করলো পাশা। দরজায় দাড়িয়েই পাশা দেখে সোপা স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে পাশার জন্য অপেক্ষা করছে। পাশার উপস্থিতিতে অর্থাৎ পাশাকে সাক্ষী রেখে তূর্য তাঁর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায়। আর কখনো সোপাকে কষ্ট দেবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে। আর তূযের্র বাবা মা তা মনিটরিং করার দায়িত্ব নেন। বাহ কি সুন্দর সমাধান! পাশা মনে মনে বেশ খুশিই হয়। সোপার দিকে তাকায়। সোপা বলে-‘আংকেল, আমার বাবা মায়ের ইচ্ছা এখন থেকে সিলেটে আপনি আমার ওভার অল দেখাশুনা করবেন।’
‘ইন-শা-আল্লাহ্‌?, সবই আল্লাহ্‌?র ইচ্ছা মা।’ -পাশার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
সকলের উদ্দেশে একটা কড়া কথা বলেই যবনিকা টানলো সোপা- ‘আমার শেষ কথা আপনাদের সবার প্রতি- আর কখনো এব্যাপারে অর্থাৎ আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে অন্যথা হলে বা উনিশ থেকে বিশ হলে আমি সোজা ঢাকা চলে যাবো, আর কখনোই কারো কথায় এমুখো হবো না কিন্তু।’
পাশা পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য বলে উঠলো-‘ওকে মা, ওকে। কিছুদিন বাইরে ছুটি কাটিয়ে আসো, দেখবে ভালো লাগবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’    
দিন যায় মাস যায়। আর কোন সমস্যা নাই ভেবে পাশা আর যোগাযোগ করে না ওদের সঙ্গে। আর অনেকদিন যাবত যোগাযোগ না করতে করতে পাশা মূলত ভুলেই যায় সোপা-তূযের্র কথাটা। একদিন ক্লিনিকে রোগী দেখার জন্য রাউন্ডে বেড়িয়েছে পাশা। সঙ্গে ডা. রেবেকা। সে কথা প্রসঙ্গে বললো- ‘স্যার, আপনার সেই এসল্টের রুগীকে গত পরশু  গ্রিনলাইনে দেখলাম। বাচ্চা নিয়ে ঢাকা যাচ্ছে। মহিলাকে একটু পাজল্ড এন্ড ডিপ্রেসড মনে হল। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ আছে স্যার?’
আসলে তো কোন যোগাযোগ নাই, তাই একটু লজ্জিত হয়ে ‘না’ সুচক মাথা নাড়লো পাশা। কিন্তু মনে একটু খচখচানি তো রয়েই গেল। তাই কাজ শেষ করেই পাশা ফোন করলো সোপাকে। সঙ্গত কারণেই সোপার অনেক অভিযোগ পাশার উপর। ঐ ঘটনার পর থেকে সোপার আর কোন খোঁজই নেয়নি পাশা। তাই প্রচন্ড অভিমানের সূরেই কথা বললো সোপা। আরো জানান দিলো যে সোপা একেবারেই সিলেট ছেঁড়ে চলে এসেছে অর্থাৎ তার দেয়া শেষ কথাটা সে রেখেছে। ঢাকা ছেঁড়ে আর কক্ষনো সিলেট মুখো হবে না। ছেলে হিমেলকে নিয়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিবে। কারন তুর্য আবারো ঐ ঘটনা ঘটিয়েছে। ‘এমন অপমানজনক যন্ত্রণাদায়ক যুগল জীবনের চেয়ে একাকী জীবন ঢের ভালো’- সোপার শেষ বক্তব্য। মোবাইলে কথা বলতে বলতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো পাশার। আর অজান্তেই ফুটফুটে ছোট্ট হিমেলের চেহারাটা ভেসে এলো তার চোখের সামনে। সোপা-তুর্যের সেপারেশন ঠেকানোর ব্যর্থতার কথাটা মনে হলো পাশার।
অবচেতন মনে চোখ খোলে উপরে  তাকালো পাশা। যেন খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে হিমেলের জন্য আর সোপার পরবর্তী জীবনের জন্য সাহায্য চাইলো পাশা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status