ঈদ আনন্দ ২০১৮

উপন্যাস

চাপাবাজ ঝণ্টু ও আমি

দুলাল হাসান

৩০ জুন ২০১৮, শনিবার, ৪:৪৬ পূর্বাহ্ন

সচিত্রকরণ: কাদিমুল ইসলাম যাদু

সকাল সাতটায় আমাকে ডেকে বাবা বললো- তোর ঘুম-টুম ভাঙবে না নাকি?
একটু মোড়ামুড়ি করে বিছানায় উঠে বসলাম। বললাম- কি হয়েছে? এত সকালে ডাকছো কেন বাবা?
বাবা বললো- ওঠ। পড়া-টড়া কিছু আছে, নাকি নেই?
বাবার অভ্যাসটাই এমন। কথা বলার সময় প্রকৃত শব্দের সঙ্গে একটা উদ্ভট (দুঃখিত, শব্দটা হবে টদ্ভট) শব্দ জুড়ে দেয়। যেমন- ‘ব্যবসা’র সঙ্গে ‘ট্যবসা’, ‘পড়া’র সঙ্গে ‘টড়া’, ‘খাওয়া’র সঙ্গে ‘টাওয়া’।
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আমি বললাম- আজ স্কুল বন্ধ। ছুটির দিনে একটু আরাম করে ঘুমাতে দাও। এই সাতসকালে ঘুমটা নষ্ট করো না বাবা?
এখন সাতসকাল নয়। ভোর হয়েছে সোয়া পাঁচটায়, এখন আটটার বেশি। ওঠ, কাজ আছে।
আমি বললাম- ছুটির দিন। আজ আমার পড়া-টড়া নাই। আর কাজ-টাজ থাকলে পরে করবো। এখন একটু ঘুমাতে দাও বাবা, প্লিজ।
কিছুদিন ধরে আমিও বাবার মতো কথা বলতে শুরু করেছি। তার অভ্যাসটা ছোঁয়াচে রোগের মতো আমার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। এ কারণেই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ‘পড়া’র সঙ্গে ‘টড়া’ এবং ‘কাজ’-এর সঙ্গে ‘টাজ’ শব্দটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো।
সঙ্গে সঙ্গে দাঁতে জিব কাটলাম। ভাবলাম, অনুকরণ করে কথা বলছি বলে বাবা এখনই আমার কান মলে দেবে। কিন্তু তা না করে বাবা বললো- মুখে মুখে জেরা করছিস কেন? আজকাল উকিল-টুকিলদের সঙ্গে মেলামেশা করিস নাকি? অবশ্য বর্তমানে এই পেশাটা খারাপ না। আগে বটতলার উকিল বলে তাদের একটা বদনাম-টদনাম ছিল। এখন সেটা নেই। তারা এখন অনেক উন্নতি-টুন্নতি করছে। আজকাল উকিলদের মেলা ইনকাম। যে হারে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে কথায় কথায় মামলা-টামলা হচ্ছে, তাতে উকিলদের পেশা জমজমাট। তুই চাইলে সেটাও হতে পারিস, এতে আমার কোন আপত্তি-টাপত্তি থাকবে না। তবে আমার বিশ্বাস এটা তুই পারবি না। কারণ এই পেশায় প্রতিষ্ঠা চাইলে প্রচুর যুক্তিতর্ক এবং মিথা কথা বলা শিখতে হবে। ‘তাল’কে ‘তিল’ আর ‘তিল’কে ‘তাল’ বানাতে হবে। তুই সেটা পারবি না।
বাবা যখন বিরাট বক্তৃতা দিচ্ছে আমি তখন ঝিমুচ্ছি। একপর্যায়ে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার হাত ধরে টেনে তুলে বাবা বললো- কি হলো, আবার শুয়ে পড়লি কেন। উঠতে বললাম না? নাম, বিছানা থেকে নাম। বাথরুমে যা। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে আয়। এক সঙ্গে খাবো। নাস্তা-টাস্তা খেয়ে বাজারে যাবি।
আমাকে মোটামুটি ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে বাথরুম ঢোকালো বাবা। তার কথা শুনে মা যেন আকাশ থেকে পড়লো। চোখ বড় করে বললো- বাজারে যেতে হবে মানে? ও বাজারে গিয়ে কি করবে?
বাবা বললো- সার্কাস দেখাবে।
মানে কি? তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? মা জানতে চাইলো।
বাবা বললো- আজ জিতু বাজার করে আনবে। শুধু আজই নয়, এখন থেকে প্রতিটি ছুটির দিনে ও বাজার করবে।
মা রেগে বললো- ও কি বাজার করবে? ও কি কিছু চেনে? নাকি দামাদামি করতে পারবে? আজকাল দোকানিরা যা ধান্দাবাজ, শেষে ছেলেটাকে ঠকিয়ে দেবে। পচা মাছ-তরকারি গছিয়ে দেবে।
মুখ বিকৃত করে বাবা বললো- ওই পচা-টচা মাছ-মাংসই হালুম-হুলুম করে গিলবে আর আনন্দে লাফাবে। নেচে নেচে বলবে- আহা, অমৃত খাচ্ছি, অমৃত খাচ্ছি।
বাবা অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে কিভাবে নাচতে হবে কোমর দুলিয়ে তা মাকে দেখালো। আমি হাসি চেপে রাখতে চেষ্টা করেও পারলাম না। চাপতে গিয়ে বরং হাসির গতি বেড়ে গেল। হাসিতে বিচিত্র শব্দ হলো। তাতে মায়ের মেজাজ আরও চড়া হলো। আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাসি থামালাম।  
বাবাকে মা বললো- এসব আজগুবি চিন্তা ছাড়ো। শুধু শুধু টাকাগুলো জলে যাবে।  
আমি সেটাই চাই। সিন্ধুকে, আলমারিতে, ব্যাংকে কিংবা পকেটে টাকা রাখতে দেখেছি। অবশ্য ইদানীং বালিশে, চালের ড্রামে, তোষক-টোষকের নিচেও রাখা হয়। টিভিতে মাঝে-টাঝেই এমন দৃশ্য দেখি। ছোটকাল থেকে কথাটা শুনে আসছি- ‘টাকা জলে যাবে’। কিন্তু টাকা কিভাবে জলে যায় কখনও দেখিনি। এবার সেটাই দেখতে চাই। আর পচা-টচা আনতে আনতেই টাটকা আনা শিখবে। বাজার-টাজার না করলে পচা-টাটকা চিনবে কিভাবে? কথা বাড়িও না। যাও নাস্তা নিয়ে আসো।
শেষ, আমার সব আশা-ভরসা শেষ। ছেলেটা এবার গোল্লায়ই যাবে। মানুষ করতে পারবো না। দশটা না পাঁচটা না, আমার একটা মাত্র ছেলে।
কপাল চাপরাতে চাপরাতে মা রান্না ঘরের দিকে গেল।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাস্তার টেবিলে যেতেই আদর করে মা বললো- আয় বাবা, আমার কাছে বস। আমি তোকে খাইয়ে দিই।
মাকে ধমক দিয়ে বাবা বললো- কেন, তুমি খাইয়ে দেবে কেন? ওর হাতে কি পচন ধরেছে? নাকি কুষ্ঠ হয়েছে?
মা আমাকে বুকে টেনে নিলো। আমার হাতে থুতু দিতে দিতে বললো- বালাইষাট, বালাইষাট। কি অলুক্ষণে কথা। আমার সোনামণির হাতে কুষ্ঠ হবে কেন? তোমার আজ কি হয়েছে বলো তো? ছেলেটার সঙ্গে এমন করছো কেন?
মুখ বাঁকা করে নাক ফুলিয়ে বাবা বললো- অতি আদর দিয়ে দিয়ে তুমি ছেলেটাকে লুলা বানিয়ে ফেলতে চাইছো। ছাড়ো, ওকে ওর হাতে খেতে দাও।
নাস্তা খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই দুটি পাঁচ শ’ টাকার নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাবা বললো- এই নে টাকা। যা, বাজার করে নিয়ে আয়। মাছ-টাছ- কি কি লাগবে তোর মা’র কাছ থেকে জেনে-টেনে যা।

আমাকে নিয়ে মা-বাবার এই তর্কবিতর্ক নতুন নয়। আমি এটাকে খুব উপভোগ করি। তাদের কথাবার্তা শুনে সবাই ভাববে- মা আমাকে খুব ভালবাসে, বেশি আদর করে। আর বাবা দেখতেই পারে না। কিন্তু আমি জানি- মায়ের চেয়ে বাবাই আমাকে বেশি ভালবাসে এবং আদর করে।

বাবার সঙ্গে বহুবার বাজারে গিয়েছি। একা কখনও যাইনি, এবারই প্রথম যাচ্ছি। এ কারণে মনের ভেতরে আলাদা একটা উত্তেজনা অনুভব করছি।
ব্যাগ হাতে রওনা হতেই মা ভুট্টোকে ডাকতে শুরু করলো। আমাকে বললো- ভুট্টোকে সঙ্গে নিয়ে যা।
বাবা গম্ভীরভাবে দরাজ কণ্ঠে বললো- না, কোনো ভুট্টো-টুট্টো ওর সঙ্গে যাবে না। ও একা যাবে।
মা বললো- মাছ, তরকারি- কত কি আনতে হবে। এত সদাই ও একা কিভাবে বয়ে আনবে।
সেটা ওর ব্যাপার। আমি শুধু এটুকু জানি- সব তাকেই বহন করে আনতে হবে। এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে-টাবতে হবে না। তুমি তোমার কাজে যাও।
মা চলে না গিয়ে সেখানেই বসে পড়লো। তার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেছে। মাথার চুল ধরে টানছে। সব রাগ যেন চুলের ওপর।

বাবার সঙ্গে আমি একমত। বাজারে যখন যাচ্ছি তখন আজ আমি একাই যাবো এবং সবকিছু একাই নিয়ে আসবো। দেখি কি হয়, জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা।
বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে বাবা আমাকে ডাকলো- জিতু।
আমি বললাম- জি বাবা।
এদিকে আয়।
কাছে যেতেই বাবা বললো- তোকে কত টাকা দিয়েছি।
এক হাজার।
তোর মা যা যা আনতে বললো সব ঠিকঠাক আনা চাই।
আচ্ছা।
তোর মা যেসব সদাইয়ের কথা বলেছে আমি হিসাব করে দেখেছি এক হাজার টাকাই লাগবে। এমন কি দশ-বিশ টাকা বেশিও লাগতে পারে। তবে...।
তবে...?
বাবা বললো- এখান থেকে তোকে কমপক্ষে ৩০ টাকা বাঁচাতে হবে। কিভাবে বাঁচাবি সেটা তুই খুঁজে বের করবি। কিন্তু সদাই কম আনা যাবে না। সব ঠিক থাকতে হবে। কোনো কিছু বাদ দিতে পারবি না।
এ কথা শুনে মা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। চোখ বড় করে চিৎকার দিয়ে বললো- বাঁচাতে হবে মানে কি? তুমি ছেলেটাকে চুরি করতে বলছো! বাপ হয়ে ছেলেকে চুরি শেখাচ্ছো! আমার ছেলে হবে চোর। আমি হবো চোরের মা!
চুরি করতে বলিনি। বাঁচাতে বলেছি।
ওই একই কথা। লাউ মানে কদু, কদু মানে লাউ। কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছো।  
তুমি যদি তাই মনে করো তবে তা-ই। তবে আরও শোনো, আজ চুরি করতে বলেছি, কাল ডাকাতি করতে বলবে।
নাকে কাঁদতে কাঁদতে মা বললো- রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারবো না। কেউ দেখলে একজন অন্যজনকে আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে বলবে- ওই যে চোরের মা যায়। ছি ছি ছি! মুখ দেখাবো কেমন করে? শেষ পর্যন্ত আমাকে এ-ও শুনতে হলো? ও আল্লাহ, এ কথা শোনার আগে আমার মরণ হলো না কেন? মাটিরে মাটি- ভাগ হয়ে যা, ভেতরে গিয়ে লুকাই। এ মুখ আর কাউকে দেখাতে চাই না।
 
মা এসব কথা বললেও বাবাকে দেখে মনে হলো সে কিছুই শুনতে পায়নি। মায়ের কোনো কথার উত্তর দিলো না। বাবাকে চুপ থাকতে দেখে মায়ের মেজাজ যেন আরও চড়া হলো। রেগেমেগে বললো- তোমার মতলবটা কি শুনি? তুমি কি চাইছো পরিষ্কার করে বলো?
মায়ের হম্বিতম্বিতে বাবার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শান্তভাবে বাবা বললো- দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তুমি চাইছো ছেলেকে পোল্ট্রি ফার্মের মুরগি বানাতে। আর আমি চাইছি মানুষ বানাতে, প্রকৃত মানুষ।

বাপ হয়ে ছেলেকে বাজারে পাঠাচ্ছো। আবার চুরির কৌশলও শিখাচ্ছো। এটা মানুষ বানাবার নমুনা? এ দুঃখ আমি কার কাছে বলবো? এই দুনিয়ার কোনো মানুষ বিশ্বাস করবে এ কথা? যা খুশি তাই করো। আমি কিচ্ছু বলবো না। ও আল্লাহ এমন কথা শোনার আগে আমার মরণ হলো না কেন? আমার মরণ দাও আল্লাহ, মরণ দাও।
মা কাঁদতে কাঁদতে রান্না ঘরের দিকে গেলো।
আমি ব্যাগ নিয়ে বাজারের উদ্দেশে রওনা হলাম।

বাড়ি থেকে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। কিভাবে কি করবো। প্রথম ভাবনা- বাজারে কিভাবে যাবো। রিকশায় গেলে বিশ টাকা ভাড়া গুনতে হবে। আজকাল রিকশায় পা ছোঁয়ালেও বিশ টাকার কম কোনো রিকশাওয়ালা নেয় না। আর বাবা নিশ্চয়ই রিকশা ভাড়া হিসাবে ধরেনি। সিদ্ধান্ত নিলাম হেঁটেই যাবো। বাবা বলেছে, ৩০ টাকা বাঁচাতে। আমি আরও বেশি বাঁচিয়ে তাকে বুঝিয়ে দেব- আমিও তার ছেলে!
বুক ফুলিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

গলির মুখে গিয়েই রনি, জনি, বাবু ও স্বপনের সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখে ওরা কাছে এলো। আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বাবু বললো- কিরে, হাতে এটা কি?
ব্যাগ।
ব্যাগ! ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
বাজারে।
ওরা ভূত দেখার মতো চমকে উঠে সবাই একসঙ্গে বললো- বাজারে! তুই?
বড়দের মতো ভাব করে বুক ফুলিয়ে বললাম- হ্যাঁ, আজ বাজার করার দায়িত্ব বাবা আমাকে দিয়েছে।
জনি বললো- কিন্তু এখন আমাদের মাঠে যাওয়ার কথা। সামনে ফাইনাল ম্যাচ। প্র্যাকটিস করতে হবে, আর তুই?
তোরা যা, আমি আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবো।
রনি বললো- বাজার পরে। আগে প্র্যাকটিস। মাঠে চল।
তোরা যা। আমি দেরি করবো না। বাজারটা বাসায় দিয়েই চলে আসবো।
আমার হাত ধরে স্বপন বললো- ব্যাপার কি বল তো? তোদের না ভুট্টু নামে একটা কাজের ছেলে আছে।
আমি উপরে-নিচে মাথা নাড়ালাম। হ্যাঁ আছে।
তাহলে ওকে বাদ দিয়ে তোকে বাজার করতে দিলো কেন?
বাবা ভাল মনে করেছে, দিয়েছে। অসুবিধা কি?
স্বপন বললো- ব্যাপারটা সন্দেহজনক। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে।
রহস্যটা খুঁজে বের কর, আমি এসে শুনবো। এখন পথ ছাড়, সরে দাঁড়া।
বাবু বললো- তোকে আমরা ছাড়বো না। বাজার পরে, আগে প্র্যাকটিস। এটা আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা। হেরে গেলে ইজ্জত পাংচার। আমরা চিন্তায় বাঁচি না, আর তুই কিনা ধেই ধেই করে বাজারে যাচ্ছিস।
রনি বললো- বাজারে যে যাচ্ছিস, কি কি আনতে হবে লিখে এনেছিস?
না, আমার মনে আছে।
স্বপন বললো- শেষে চিনি পাতা দইয়ের মতো সব তালগোল পাকিয়ে ফেলবি না তো?
সেটা আবার কি? আমি জানতে চাইলাম।
রনি বললো- এই সেরেছে। যা ভেবেছিলাম তাই। দাঁতখানি চাল, মসুরের ডাল, চিনি পাতা দই- কবিতার কথাটাও ভুলে বসে আছিস? সারা বছর ধরে মুখস্থ করা কবিতা। ফাইনালে দুইটা প্রশ্ন এসেছিল এই কবিতা থেকে। তাছাড়া বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই কবিতা আবৃত্তি করে সজল ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিল। যে ছেলে এমন একটা কবিতা ভুলে যায় তার বাজারের লিস্ট মনে আছে বিশ্বাস হচ্ছে না। বলতো কি কি আনতে বলেছে।
তোদের কাছে এখন আমার ইন্টারভিউ দিতে হবে নাকি? যা তো, আমাকে বাজারে যেতে দে।
বাবু বললো- দিতে পারি। যদি...।
যদি...?
যদি আমাদের সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াস তবে বাজারে যাবি। আর না হলে প্র্যাকটিসে। এখন সিদ্ধান্ত তোর।
একটু ভাবলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম- ওদেরকে ভুলিয়ে-টুলিয়ে একটু সামনে গিয়ে আমি ঝেরে দৌড় লাগাবো।
বললাম- আইসক্রিম খেতে হলে তো সামনে মোড়ের দোকানে যেতে হবে। চল ওখানে যাই।
ওরা চারজনই একসঙ্গে বললো- চল।
একটু সামনে যেতেই চোখে পড়লো আমাদের দিকে আসছে চাপাবাজ ঝন্টু। হাসি হাসি মুখ। আমি কিছুটা আঁতকে উঠলাম। সর্বনাশ! ও এসেই চাপা মারতে শুরু করবে। আল্লাহই জানে আজ কি আছে কপালে। ওর পাল্লায় পড়লে বাজার-টাজার সব গোল্লায় যাবে। সারাক্ষণ বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে। আর যার সঙ্গে কথা বলে ওর পালাবার পথ নেই। কারণ হাত ধরে রাখে। চাপাবাজ বলে তার সুনাম রয়েছে স্কুলজুড়ে। একবার শুরু করলে থামানো কঠিন। এখন কি ধরনের চাপা শুনতে হবে সে জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলাম।
কাছে এসেই গলা উঁচু করে ঝন্টু বললো- শুনছস কিছু?
কি শুনবো।
চোখ বড় বড় করে ঝন্টু বললো- কিচ্ছু শুনিস নি?
শোনার মতো কিছু কি হয়েছে? জানতে চাইলো বাবু।
বুক ফুলিয়ে ঝণ্টুু বললো- অবশ্যই হয়েছে। একদম ফাটিয়ে দিয়েছি। শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে। এক কথায় সারা বাংলাদেশে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরুতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি- সবাই চোখ বড় বড় করে বলছে- তুমি! তুমিই সেই ছেলে?
আমি বুক ফুলিয়ে বলছি- জি, আমিই সেই ছেলে, ঝণ্টু। তবে যন্ত্রণা হয়েছে কি জানিস? বড়রা তো প্রশ্ন করেই খালাস। কিন্তু ছোটরা! তাদের জ্বালায় আর বাঁচি না। দেখলেই ঘিরে ধরছে। আচ্ছা তোরাই বল, আমি একা ক’জনকে খুশি করবো? এতো অটোগ্রাফ কি দেওয়া সম্ভব? দিতে দিতে আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। কলম পকেটে রাখার উপায় নাই। এই দেখ হাতে নিয়ে ঘুরছি। কেউ খাতা, কেউ বই, কেউ বা ডায়েরি, আবার হাতেও কেউ কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছে। একটু আগে কি হয়েছে জানিস? হা হা হা...। শোনলে হাসতে হাসতে তোদের পেট ব্যথা হয়ে যাবে। মাথা ঘুরে পড়েও যেতে পারিস। হা হা হা...।
আমরা কেউ হাসলাম না। কোনো উত্তরও দিলাম না। একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। কি বলবো? আর এই চাপাবাজের চাপা কিভাবে বন্ধ করবো বুঝতে পারছি না।
আমরা কথা না বললেও ঝণ্টুর কোনো ক্লান্তি নেই। সে আবারও বলতে শুরু করলো- শোন, বাচ্চা একটা মেয়ে। খুবই ফুটফুটে। এক্কেবারে পুতুল পুতুল টাইপ। লাল টুকটুকে গালটা এগিয়ে দিয়ে বলে- আমার গালে একটা অটোগ্রাফ দাও না ভাইয়া। একবার ভেবে দেখ- কি কাণ্ড! আমি তো অবাক! কিছুতেই বোঝাতে পারি না সুন্দর গালটা কলমের কালিতে নোংরা হয়ে যাবে। মেয়েটি বলে- অটোগ্রাফ তার চাই-ই চাই। কি আর করবো, শেষে বাধ্য হয়েই দিলাম। ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং না? হা হা হা...।
আবারও হাসতে শুরু করলো ঝণ্টু। এবারও আমরা কেউ হাসির কারণ খুঁজে পেলাম না। তাই কেউ হাসলাম না। কথাও বললাম না। কিন্তু চাপাবাজ ঝণ্টুর তাতে কোন যায়-আসে না। সে হাসি থামিয়ে নতুন উদ্যমে বলতে শুরু করলো- এত বড় একটা ঘটনা। কোথায় ভাবলাম খুশিতে তোরা আমাকে মাথায় নিয়ে নাচবি। কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াবি। জোর করে কেএফসিতে নিয়ে যাবি। খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়াবি। আমাকে নিয়ে বুক ফুলিয়ে গর্ব করবি। আর তোরা কিনা...!
আমি বললাম- এবার দয়া করে থাম। মুখটা একটু বন্ধ কর। আচ্ছা এত কথা কিভাবে বলিস বল তো? কখন-কিভাবে নিশ্বাস নিস? মোবাইল কোর্ট বসিয়ে মুখে তালা দেয়া ছাড়া তোকে থামাবার আর তো কোনো উপায় দেখছি না। একেবারে সিলগালা করে দিতে হবে।
মুখটা একটু গোমড়া করে ঝণ্টু বললো- এইটা একটা কথা বললি? বন্ধু হয়ে আমার মুখে তালা দিতে চাস? এটা কি বন্ধুর পরিচয়? তোর কথা শুনে ইচ্ছা করছে রিকশার নিচে ঝাঁপ দেই। কিন্তু দুঃখিত, তা সম্ভব নয়। কারণ, তাহলে আমার এত বড় বীরত্বের কথা রিকশার চাকায় চাপা পড়ে যাবে। আমি তা হতে দিতে পারি না। আমার বিশ্বাস তোরাও তা চাস না। কিন্তু কি করবো, উপায় নেই। বন্ধুদের কথা একটু-আধটু তো হজম করতেই হবে। যদিও তোর কথাটা হজম করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এই দেখ, কষ্টে আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে।
একে একে আমাদের সবাইকে ওর চোখ দেখাল। এরপর রাজনৈতিক নেতাদের মতো আমার মুখের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বললো- সত্যি কিচ্ছু শুনিস নি?
বিরক্ত হয়ে জনি বললো- বকবক বাদ দে তো। আমাদের প্র্যাকটিস আছে, যেতে দে। সর সামনে থেকে।
ঝণ্টুু বললো- বকবক করছি মানে! যা সত্য তাই বলছি। তোরা তো জানিস আমি বেশি কথা পছন্দ করি না। আর এটাও জানিস আমি কখনও মিথ্যা কথাও বলি না। মিথ্যা আমার দুই চোখের বিষ।
আমার হাত ধরে বললো- তুই বল জিতু, আমি ঠিক বলেছি কিনা?
এতক্ষণ ধরে ঝণ্টুর চাপাবাজি শুনে আমরা সবাই কম-বেশি বিরক্ত। রনি, জনি, বাবু ও স্বপন বার বার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তারা চাইছে আমি তাকে একটা শিক্ষা দিই। আমি ওদের চোখ টিপলাম। ওরা মুচকি হেসে ইশারা করলো- দে, একটা উচিত শিক্ষা দে।
আমি বললাম- শোন ঝণ্টু, তোর ঘটনাটা ওরা শোনে নি। কিন্তু আমি শুনেছি। শুধু শুনেছিই না, দেখেছিও।
খুশিতে লাফিয়ে উঠলো ঝণ্টু। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হাত ধরে বললো- সত্যি বলছিস জিতু? খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। অবশ্য আমি জানতাম, এত্ত বড় একটা ঘটনা। সারা দেশের মানুষ যেখানে দেখেছে সেখানে তোরা না দেখে পারিস না। এইবার অন্তত একটা ধন্যবাদ আমাকে দে।
রনি-জনি বাবু ও স্বপন কথা বলছে না। আমাকে চোখ টিপলো রনি। আমার কথায় ঝণ্টু খুব উৎফুল্ল। তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করছে। খুশিতে লাফাচ্ছে।
আমি বললাম- ওরা কিভাবে দেখবে? ওদের কারো বাসায় তো রেডিও নেই।
রেডিও নেই মানে! রেডিওতে কিছু দেখা যায় নাকি? ওটাতে তো শোনা যায়। দেখা যায় টিভিতে। আশ্চর্য হয়ে চোখ বড় করে ঝণ্টু বললো।
এ জন্যই তো ওরা কেউ দেখেনি। কিন্তু আমি দেখেছি। কারণ আমার বাসায় টিভি নেই, রেডিও আছে। ওই রেডিওতেই আমি তোকে দেখেছি। তবে তোর কাণ্ড দেখে আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
একে একে আমাদের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে ঝণ্টু বললো- কি বলছিস এসব! রেডিওতে দেখা যায় নাকি? ওটাতে তো শোনা যায়। আবার বলছিস লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মুখ কালো করে বললাম- থাক, ওই কথা আমি আর কাউকে বলতে চাই না। তোরা প্র্যাকটিসে যা আর আমি বাজারে যাই।
থাবা দিয়ে আমার হাত ধরে ঝণ্টু বললো- দাঁড়া। এখান থেকে এক পা-ও নড়বি না। কি বলতে চাস তুই?
মিনতি করে বললাম- থাক না। চেপে যেতে দে। হাজার হোক তুই আমাদের বন্ধু। আমি লজ্জা পেয়েছি। ওটা আমার মধ্যেই থাকতে দে। ওরা জানলে এক কান দু কান করে সারা ক্লাসে ছড়িয়ে পড়বে। পরে লজ্জায় স্কুলেই যেতে পারবো না। প্লিজ আমায় যেতে দে।
এবার মেজাজ চড়া করে ঝণ্টু বললো- খবরদার, বাজে কথা বলবি না। আমার কি কাজে তুই লজ্জা পেয়েছিস সবার সামনে খুলে বল।
বাবু বললো- বলে দে।
বললাম- আমাকে মাফ করে দে, আমি বলতে পারবো না। বন্ধু হিসেবে আমার উচিত ঝণ্টুর মান-সম্মান রক্ষা করা।
ঝণ্টু বললো- না, তোকে বলতেই হবে।
রনি বললো- ঠিক আছে বলে দে।
স্বপন বললো- ও যখন এত করে বলছে তখন বলে দে।
আমার দিকে তাকিয়ে এবার জনি চোখ টিপল। তার মুখে কিঞ্চিৎ হাসি।
আমি চুপ করে আছি দেখে আবারও তাড়া দিল ঝণ্টু। বললো- বল, সবার সামনে বল। আজ তোকে বলতেই হবে।
আমি বললাম- তোরা সবাই আমাকে মাফ করে দে। প্লিজ, ওই কথা শুনতে চাস না। এর চেয়ে তোরা যদি বলিস জামা খুলে খালি গায়ে হাঁটতে, আমি তাই করবো। বাজার করতে বাবা এক হাজার টাকা দিয়েছে, তোরা চাইলে পাঁচ শ’ টাকা তোদের খাওয়াতে রাজি। তবুও ওই লজ্জার কথা আমি বলতে পারবো না।
আমি কাকুতি-মিনতি করছি। রনি-জনি-স্বপন মুচকি হাসছে। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে ওরা আমাকে ধমক দিয়ে বললো- না, তোকে বলতেই হবে। বল, কি করেছে ঝণ্টু। শুধু শুধু ওর মতো একটা ভাল ছেলের বদনাম করছিস।
ঝণ্টু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো- হ্যাঁ। সাহস থাকলে বলে ফেল।
আমি মুখটা এমন করলাম যেন কথাটা আমি কিছুতেই বলতে চাইছি না। শুধু ওরা জোর করছে বলে বাধ্য হয়েই বলছি- ঠিক আছে, তোরা যখন না শুনে ছাড়বি না, তখন বলছি। তবে তোদের পায়ে পড়ি, আমরা এই ক’জন ছাড়া এটা যেন আর কেউ না জানে। হাজার হোক ঝণ্টু আমাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধু। ওর ইজ্জত আমাদের ইজ্জত। আমাকে কথা দে, পেটে বোমা মারলেও মুখ খুলবি না। এ কথা আর কাউকে বলবি না।
ওরা একে অপরের মুখে দিকে তাকিয়ে বললো- ঠিক আছে, কথা দিলাম। আমরা কাউকে বলবো না।
সবাইকে হাত ইশারায় কাছে ডাকলাম। বললাম- আয় কাছে আয় বলছি, জোরে বললে রাস্তার মানুষ শুনে ফেলবে। তখন মান-সম্মান কিচ্ছু থাকবে না।
ওরা সবাই আমার কাছাকাছি এলো। ঝণ্টুকে ধমক দিয়ে বললাম- তুই দূরে কেন গাধা। মানুষকে শোনাবি নাকি।
ঝণ্টু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললো- বল, জোরেই বল। সবাই জানুক।
আমি আবারও ধমক দিয়ে বললাম- তোর মান-সম্মান না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের আছে। আয় কাছে আয়।
ঝণ্টু কাছে এলো। এরপর গলা নামিয়ে তাকে বললাম- আমার কিন্তু এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যিই কি তুই এমন কাজ করেছিস?
ডান হাত দিয়ে বুকে থাপ্পড় মেরে খুশিতে গদগদ হয়ে ঝণ্টু বললো- বিশ্বাস কর দোস, সত্যি বলছি- কাজটা আমিই করেছি। সত্যি সত্যি সত্যি- তিন সত্যি।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম- নারে, এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এমন কাজ তুই করতেই পারিস না।
আমার মুখ থেকে কথাটা শুনতে তর সইছে না ঝণ্টুর। সে আমার হাত ধরে বললো- এই তোকে ছুঁয়ে কসম করে বলছি, আমিই করেছি।
আমি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম- খবরদার আমাকে ছুঁয়ে কসম খাবি না।
উতলা হয়ে উঠেছে ঝণ্টু। বন্ধুদের কথাটা শোনাতে মরিয়া সে। আমি বারবার এড়িয়ে যেতে চাইছি। এতে তার আগ্রহ আরও বাড়ছে। অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে।
আমার কাছ থেকে সামান্য দূরে সরে গিয়ে ঝণ্টু বললো- এই আমি আমার চোখ ছুঁয়ে বলছি, মাথা ছুঁয়ে বলছি- সত্যি, কাজটা আমিই করেছি।
আমি রনি-জনি-বাবু ও স্বপনের দিকে তাকালাম। ওরা এসে আমাকে চেপে ধরে বললো- ঝণ্টু যখন কসম খাচ্ছে, তিন সত্যির দিব্যি দিচ্ছে, তখন কাজটা যে ও করেছে এটা আমরা নিশ্চিত। তুই বলে দে জিতু।
ঝণ্টু বললো- হ্যা, বল বল।
মুখটাকে একটু বাঁকা করে আমি বললাম- ঠিক আছে, তোরা যখন না শুনে ছাড়বি না। আর ঝণ্টুও বারবার স্বীকার করছে কাজটা সে করেছে। তখন বলেই ফেলি। চৌরাস্তার মোড়ে এক রিকশাওয়ালা ঝণ্টুকে কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছে।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রনি জিহ্বায় কামড় দিল। জনি ঠোঁটে আঙুল ঠেকালো। স্বপন চোখ বড় করে ফেলল। আর বাবু এসে আমার মুখ চেপে ধরে বললো- ব্যস ব্যস ব্যস, আর বলিস না। এমন জঘন্য কাজ! ছি! ছি! ঝণ্টু, শেষ পর্যন্ত তুই...।
বাবুর কাছ থেকে লাফ দিয়ে একটু দূরে সরে গেল ঝণ্টু। ওর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করলো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো- মিথ্যা কথা, মিথ্যা কথা। সব বানানো। আমি মোটেও কান ধরে উঠ-বস করিনি। জিতু বানিয়ে বলছে।
আমি কোনো কথা বলছি না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। ঝণ্টু রনির কাছে গেল। তাকে বোঝাতে চাইলো- আমি মিথ্যা বলছি। এরপর জনি, বাবু ও স্বপনের কাছে গেল। তাদেরও বোঝাতে চাইলো।
ওরা মুখ গোমড়া করে বললো- জিতুকে কোনদিন মিথ্যা বলতে শুনিনি।
ঝণ্টুর চোখে পানি এসে গেল। সে বললো- মিথ্যা। সব মিথ্যা। আমি বুঝতে পেরেছি, তোরা আমাকে মফিজ বানাতে চাইছিস। আমাকে বোকা বানাতে সবাই এক জোট হয়েছিস। আমি আর তোদের সাথে নেই।
ঝন্টু একটু দূরে গেলে আমরা একসঙ্গে হেসে উঠলাম।
চাপাবাজটাকে এরকম কুপোকাত করতে পারবো ভাবিনি। তাই আনন্দে আমাদের হাসি থামছে না।

এ সময় দেখতে পেলাম সাজু আসছে। তার ডান হাতে ব্যাগ ভর্তি বাজার। ব্যাগের ওজনে কিছুটা কাত হয়ে হাঁটছে সে। আমাদের হাসতে দেখে বললো- কিরে, কি নিয়ে এতো হাসি?
বাবু হাসতে হাসতে বললো- চাপাবাজ ঝণ্টুকে আজ আচ্ছামতো সাইজ করেছে জিতু। কমপক্ষে সাতদিন ওর চাপায় তালা থাকবে। লজ্জায় হয়তো স্কুলে আসাই ছেড়ে দেবে।
সাজু বললো- বলিস কি! কিভাবে করলি?
স্বপন পুরো ঘটনা সাজুকে বললো। শুনে সে খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো- জব্বর একটা কাজ করেছিস। থোতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েছিস। বদের হাড্ডি। ওর চাপা শুনে শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। চল, এই খুশিতে আজ আমি তোদের আইসক্রিম খাওয়াবো।
রনি বললো- তাহলে জিতুর আইসক্রিম কাল খাব।
আমরা সবাই দোকানে গেলাম। আইসক্রিম নিলাম। মুখে দেব- ঠিক এ সময় পেছন থেকে সামনে এসে হাত-পা ছুঁড়ে লাফাতে শুরু করলো ঝণ্টু। কিছুক্ষণ আগে লজ্জা বা অপমানজনক কোন কথা তাকে বলেছি, দেখে তা মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে বন্ধুদের আইসক্রিম খেতে দেখলে এভাবে লাফালাফি করতে হয়। হাততালি দিয়ে নাচানাচি করতে হয়। এটা খুবই মজার বিষয়। আমরা সবাই অবাক। একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি।
লাফাতে লাফাতে ঝণ্টু বললো- বুঝছি, এইবার বুঝছি, তোরা আমার নামে ক্যান এমন বাজে কথা বলেছিস।
স্বপন বললো- কেন?
আমাকে যেন আইসক্রিম খাওয়াতে না হয় সে জন্যে। কিন্তু সেই সুযোগ তোরা পাবি না। আমি তা হতে দেব না। আমিও খাব। দোকানদার আঙ্কেল- আমাকেও একটা আইসক্রিম দিন।
আইসক্রিম নিয়ে মজা করে খেতে শুরু করলো ঝণ্টু। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে সাজু বললো- চল, বদটাকে আরও একবার সাইজ করি।
কিভাবে?
আগের মতই গলা নামিয়ে সাজু বললো- সবাই আমার সঙ্গে হাঁটা শুরু কর।
আইসক্রিমের টাকা?
সেটাই তো সাইজ। হাঁটা শুরু কর।

দোকানদারকে চোখ টিপ দিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম।
ঝণ্টু চিৎকার করছে- তোরা কোথায় যাস? টাকা দিয়ে যা। আইসক্রিমের দাম দিয়ে যা। এই জিতু, রনি, জনি, সাজু...
সাজু আগের মতোই গলা নিচু করে বললো- পেছনে তাকাবি না। না শোনার ভান করে হাঁটতে থাক।
সবাই ধীরে ধীরে হাঁটছি। কেউ পেছনে তাকাচ্ছি না। আমরা একটু দূরে চলে এসেছি। লক্ষ্য করলাম- দোকানদারের সঙ্গে কথা বলছে ঝণ্টু। এরপর দৌড়ে এসে আমাকে ধরলো সে। বললো- এই আমি কান ধরছি, তোদের সঙ্গে আর চাপা মারবো না। এবার আইসক্রিমের দামটা দে।
আমি রনির দিকে তাকালাম। সে বললো- আমার কাছে টাকা নেই।
জনি-স্বপন বললো- আমাদের কাছেও নেই।
সাজু বললো- আমার কাছে যা ছিল সব দিয়ে দিয়েছি। আর নেই।
ঝণ্টু আমার হাত ধরে বললো- জিতু, আমার আইসক্রিমের দামটা তুই-ই দে। নইলে...।
নইলে...?
দোকানদার বলেছে...। আবারও থেমে গেল ঝণ্টু।
দোকানদার কি বলেছে?
ঝণ্টু বললো- সে কথা শুনতে চাস না। টাকাটা দে প্লিজ।
স্বপন বললো- দোকানদার কি বলেছে না বললে টাকা দেয়া হবে না।
ওই কথা শুনতে চাস না। ইজ্জতের ব্যাপার। একবার তোরা আমার ইজ্জত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস, আবার...।
বলতে না চাইলে তোর ইজ্জত নিয়া তুই থাক, আমরা গেলাম। সাজু বললো।  
আমরা দুই পা এগোতেই আমার হাত চেপে ধরলো ঝণ্টু। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো- দোস, দোকানদার বলেছে, টাকা না দিলে আমার প্যান্ট খুলে রেখে দেবে।
আমি রাগ করার ভান করে বললাম- কি! এত্তো বড় কথা! দোকানদারের এত বড় কলিজা। তোর প্যান্ট খুলে রেখে দেবে। ওই চলতো সবাই। আজ ওকে একটা শিক্ষা...
আমাকে টেনে ধরে সাজু বললো- থাক, বাদ দে। টাকা না দিলে দোকানদার তো একটু রাগ করতেই পারে। এই নে ঝণ্টু, যা আইসক্রিমের দাম দিয়ে মাঠে আয়।
টাকা হাতে নিয়ে ‘থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু’ বলে দোকানের দিকে গেল ঝণ্টু। আমরা সবাই এক সঙ্গে হি হি করে হেসে উঠলাম।
হাসি থামিয়ে সাজু বললো- তোরা মাঠে যা। বাজারের ব্যাগটা বাসায় দিয়েই আমি চলে আসবো।
স্বপন বললো- তোর বাসা তো কাছেই। যা তাড়াতাড়ি দিয়ে আয়।
জনি বললো- সবাই এক সঙ্গে না হলে প্র্যাকটিস করবো কিভাবে?
রনি বললো- আজ বোধহয় প্র্যাকটিস হবে না।
ঝণ্টুকে দেখা যাচ্ছে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। এসেই বললো- চল, মাঠে যাই।
আমি বললাম- নারে, আমাকে বাজারে যেতে হবে। তোরা গিয়ে শুরু কর। আমি পরে আসছি।
অবাক হয়ে ঝণ্টু বললো- বাজারে যাবি! তুই? তাহলেই সেরেছে... হি হি হি।
আমি ধমক দিয়ে বললাম- থাম। হাসছিস কেন?
ঝণ্টুর হাসি আরও বেড়ে গেল। হাসতে হাসতে গলে গলে পড়ছে। হাসির মধ্যেই বললো- তুই যাবি বা-জা-রে!
কেন, আমি বাঘ-ভাল্লুক নাকি যে বাজারে গেলে আমাকে দেখে সবাই পালাবে।
আগের মতই হাসতে হাসতে ঝণ্টু বললো- না ঠিক তা না। আগে কখনও বাজারে গিয়েছিস?
বহুবার গিয়েছি। তবে বাবার সঙ্গে। একা এই প্রথম।
তাহলেই সেরেছে। চাষ করা মাছ নদীর বলে তোর কাছ থেকে গলাকাটা দাম রেখে দেবে। তোকে মাছওয়ালারা ‘মফিজ’ বানাবে।
জনি বললো- তুই বার বার ‘মফিজ মফিজ’ করিস কেন? ‘মফিজ’ তোর কে হয়? সে তোর ছোট ভাই নাকি বন্ধু?
ঝণ্টু অবাক হয়ে বললো- ‘মফিজ’ মানে বুঝিস না? এখন সবাই বোকাদের ‘মফিজ’ বলে ডাকে।
আমি একটু চিন্তা করে বললাম। মাছ তো মাছই। আর মাছ কি ঘরের মধ্যে হাঁড়ি-পাতিলের ভেতরে হয়? নদীতেই তো হয়। এতে মফিজ বানাবার কি আছে।
ঝণ্টু এবার হো হো হো করে হেসে বললো- তুই তো দেখি একটা হাঁদারাম। কোনো খোঁজই রাখিস না। বাংলাদেশ এক সময় নদীমাতৃক দেশ ছিল। এখন নদীগুলো ধু ধু বালুচর। বাজারে যে মাছ পাওয়া যায় ওগুলো সবই চাষের।
তাতে সমস্যা কি? মাছ হলেই তো হলো।
ঝণ্টু বললো- শোন, মাছ হলেই যদি হতো তবে মাছওয়ালারা ‘নদীর মাছ’ ‘নদীর মাছ’ বলে গলা ফাটাতো না। চাষের চেয়ে নদীর মাছ খেতে মজা, তাই দাম বেশি। নদীর মাছ বলে যদি একবার কাউকে টোপ গিলাতে পারে তবে গলাকাটা দাম নেয়। যারা চেনে না তাদেরকে ঠকিয়ে দেয়। তুই চাইলে আমি তোকে সাহায্য করতে পারি।
তুই কি সাহায্য করবি?
আমি সব সময়ই বাজার করি। আজ তোকেও করে দেব। দামে আমাকে ঠকাবে এমন দোকানদার বাজারে নেই।
তাই নাকি?
১০০% গ্যারান্টি।
কিভাবে?
ঝণ্টু শার্টের কলার টেনে বুক ফুলিয়ে বললো- আচ্ছা ধর দোকানদার মাছের দাম চাইলো তিনশ’ টাকা। তুই কত বলবি?
আমি একটু ভেবে বললাম- আড়াইশ’ টাকা।
খিলখিল করে হেসে উঠলো ঝণ্টু। আমার দিকে আঙুল তুলে বললো- মফিজ, মফিজ। তার হাসি থামছে না।
দাম কম বলেছি ভেবে আমি বললাম- তাহলে দুইশ’ আশি টাকা। এইবার ঠিক আছে?
ঝণ্টু বললো- মোটেও না।
তাহলে?
দাম বলতে হবে আশি টাকা।
একশ’ আশি টাকা?
না, শুধু আশি টাকা।
আমি বললাম, তিন শ’ টাকার মাছ শুধু আশি টাকা বললে দোকানদার বাজার থেকে বের করে দিবে। মাইরও দিতে পারে।
স্বপন বললো- আরও একটা কাজ করতে পারে।
কি? রনি এবং আমি জানতে চাইলাম।
টাকা রেখে ব্যাগ ভরে মাছ ধোয়া পানি দিয়ে দিতে পারে।
বাবু বললো- মাছ না দিয়ে মাছের আঁশটেও দিয়ে দিতে পারে।
ঝণ্টু বললো- বাজার করা নিয়ে তোদের কারও কোন ধারণা নেই। তাই এসব কথা বলছিস। অথচ আমার জন্য কোন ব্যাপার না। দুই আঙুলে তুড়ি দিয়ে দেখালো- যার অর্থ কোনো ব্যাপার নাও হতে পারে আবার অন্য কিছুও হতে পারে।

বাসায় বাজারের ব্যাগ দিয়ে চলে এসেছে সাজু। আমরা এখনও দাঁড়িয়ে আছি দেখে বললো- তোরা এখনও মাঠে যাস নি?
বললাম- না, কিভাবে যাবো? মুগ্ধ হয়ে কান পেতে চাপাবাজের চাপাবাজি শুনছি। তার হাত থেকে তো রেহাই পাচ্ছি না।
তাহলে এখন আর বাজারে যাওয়ার দরকার নেই। মাঠে চল। প্র্যাকটিস শেষে সবাই মিলে বাজার করবো।
ওদের ছেড়ে বাজারে যেতে আমারও ইচ্ছা করছিল না। আর মাঠে যাওয়ার জন্য সবাই জোর দেয়ায় আমি মাঠেই গেলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা প্র্যাকটিস ও গল্প করলাম। বাজারের কথা ভুলে গেলাম। বাসায় ফেরার আগে মাঠের পাশে রাখা বাজারের ব্যাগটি আনতেও ভুলে গেলাম।


আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টোকে ডাকলো বাবা। তাকে একটি মোবাইল ও কিছু টাকা দিলো। আমি কখন কি করি, কার সঙ্গে কথা বলি- প্রতি মুহূর্তের খবর বাবাকে দিতে বললো।
রাস্তায় বেরিয়ে রনি-জনি-স্বপন ও বাবুর সঙ্গে দেখা হওয়া, ঝণ্টুকে সাইজ করা, আইসক্রিম খাওয়া এবং সবশেষে মাঠে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছু বাবাকে জানালো ভুট্টো।
বাজার নিয়ে যখন আমি ফিরছি না, তখন মা রেগেমেগে বাবাকে বললো- দুই ঘণ্টা হয়ে গেল বাজারের নাম-গন্ধ নাই, ছেলেরও ফেরার কোন লক্ষণ নাই, তোমার কি সে খেয়াল আছে?
রিমোর্ট হাতে টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে বাবা বললো- আছে, আছে।
কি আছে? ঘোড়ার ডিম না মুরগির আণ্ডা?
আরে আছে, সব আছে। চিন্তার কিছু নাই। ঘোড়ার ডিমও আছে মুরগির আণ্ডাও আছে। এখন মাথা ঠান্ডা করে এখানে বসো। দেখো কি মজার কাণ্ড। তাই তো বলি বাচ্চা-টাচ্চাদের কাছে টম এন্ড জেরি কেন এতো প্রিয়? হা হা হা... হা হা হা।
বাবা সোফায় কাত হয়ে টিভি দেখছিলো। হাসতে হাসতে সোজা হয়ে বসলো। বললো- জেরি একটা পুচকে হয়ে বিশাল টমকে কি নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে দেখো। হা হা হা।
বাবার হাসিতে মায়ের মেজাজ আরও খারাপ হলো। নাক কুঁচকে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বাবাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। তার আগেই বাবা বললো- বুদ্ধি, বুঝছো বুদ্ধি। যার বুদ্ধি-টুদ্ধি নাই তার জন্য দুনিয়া অচল। বুদ্ধি ও মেধা হলো এমন এক শক্তি যা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।
মুখ বাঁকা করে মা বললো- তাই, না?
হ্যাঁ, অবশ্যই।
তাহলে আজই পরীক্ষাটা হয়ে যাক।
কিসের পরীক্ষা?
তোমার বুদ্ধি-টুদ্ধির।
হ্যাঁ, হয়ে যাক। কি করতে হবে বলো?
মা মুখে ভেংচি কেটে বললো- তেমন কিছু না। অতি সামান্য-টামান্য ব্যাপার। আজ রান্না-টান্না হবে না। বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে দুপুরে খাবার-টাবারের ব্যবস্থাটা করে ফেল দেখি।
মা রেগে গেলে বাবার মতো করে কথা বলে। তাকেও রাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। তাই ‘সামান্য-টামান্য, রান্না-টান্না’ শব্দগুলো বাবাকে শোনালো।
যে উত্তেজনা ও গতিতে বাবা ‘হয়ে যাক’ কথাটা বলেছিলো মায়ের কথায় তা হঠাৎ চুপসে গেলো। হাসি হাসি মুখটা ধপ করে বন্ধ হয়ে গেল। তবে থেমে যাওয়ার লোক নয় বাবা। বরং মাকে ঘায়েল করার জন্য বললো- এবার বুঝলাম কি কারণে তোমার মাথার চুল এত লম্বা।
কি কারণে? কপাল কুঁচকে জানতে চাইলো মা।
বাবা রহস্যের ভঙ্গিতে বললো- তোমার মস্তিষ্কের ভেতরে উর্বর-টুর্বর পদার্থ আছে।
উর্বর-টুর্বর পদার্থ কথার অর্থ কি? তুমি কি বলতে চাইছো...।
মাকে কথা শেষ করতে দিলো না বাবা। বললো- উর্বর-টুর্বর পদার্থ বুঝতে পারছো না? বুদ্ধি-টুদ্ধি আর কি! মানে তোমার মগজ বোঝাই বুদ্ধি আর বুদ্ধি। এক্কেবারে কিলবিল করছে।
মা রেগে বললো- মোটেও না। তুমি বলতে চেয়েছো আমার মাথায় গোবর।
যদিও বাবা এই অর্থেই মাকে কথাটি বলেছে। তবুও স্বীকার না করে বললো- আরে না না, তুমি ভুল-টুল বুঝ না। আমি আসলে বোঝাতে চেয়েছি- যে কাজটি তুমি আমাকে করতে বলছো- বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে মানুষ এ কাজটি অনেক আগেই করে ফেলেছে। আর এ কারণেই আমরা এত মজার মজার খাবার খেতে পারছি। সবই বুদ্ধি ও মেধার কাজ।
এত কিছুর তো দরকার পড়ে না। বুদ্ধি ও মেধার যদি এতই জোর তবে একটা কাজ করতে পারলেই তো সব ঝামেলা-টামেলা মিটে যায়। পারলে ওটা করো।
কোনটা বলো তো। বাবা চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলো।
মা বললো- শুধু একটি কাজ।
বাবা নড়েচড়ে বসে বললো- একটি কাজ করতে পারলেই যদি সব চুকে-বুকে যায় তবে আজই তা করে ফেলবো। তুমি বলো- কাজটা কি?
বুদ্ধি-টুদ্ধি কাজে লাগিয়ে ক্ষুধা-কে পরাজিত করো। এমন কিছু করো যে, ক্ষুধা লাগলেই একটুখানি ‘বুদ্ধি ও মেধা’ গিলে ফেলবো, আর অমনি সুরসুর করে পালিয়ে যাবে ক্ষুধা-টুধা। তাহলে তো সকাল থেকে হাঁড়ি-টাড়ি ঠেলতে হয় না।
বাবা এবার হো হো করে হেসে উঠলো। বললো- ওই কাজটি তো আগেই সেরে ফেলা হয়েছে। মানুষ হাঁড়ি-টাড়ি ঠেলে ইচ্ছা করে। জিহ্বা সামলাতে না পেরে। যেমন তুমি পারো না।
আমি পারি না মানে? আমি কি পারি না?
জিহ্বা সামলাতে। গরুর মাংস না খেলে, সরিষা দিয়ে ইলিশ মাছের পেটি না খেলে, গলদা চিংড়ির দো-পেয়াজো না পেলে তুমি তো চোখে-টোখে অন্ধকার দেখো।
আর তুমি? তুমি কি দেখো?
আমার যে এসবের প্রতি একেবারে লোভ নেই তা না। তবে তোমার মতো না।
মা খুব রাগ হয়ে গেলো। বললো- ঠিক আছে, আজ থেকে রান্নাই করবো না। দেখি কার জিহ্বা কেমন করে?
আরে রাগ করছো কেন? শুধু তোমার আমার না, খাবার-টাবারের প্রতি সব মানুষেরই লোভ আছে। তাই মানুষ রান্না নিয়ে রীতিমতো গবেষণা-টবেষণা করে এবং মজার মজার রান্না আবিষ্কার করে। বাদ দাও এসব। এখন বলো আজ কি রান্না করবে?
বাজারের খবর নেই রান্না করবো কিভাবে?
তোমার ছেলের আশা বাদ দাও। ও বন্ধুদের সঙ্গে খেলছে। ফ্রিজে কি আছে দেখো।
জিতু বন্ধুদের সঙ্গে খেলছে তুমি জানো কিভাবে?
আরে জানি জানি। আমি আরও অনেক কিছুই জানি। এখন যাও, তাড়াতাড়ি রান্নার ব্যবস্থা করো। আমার কিন্তু ক্ষুধায় পেট চো চো করছে।
বললাম তো আজ রান্না হবে না। হোটেল থেকে নিজেও খেয়ে এসো, আমাদের জন্যও নিয়ে এসো। মুখ বাঁকা করেই মা কথাগুলো বললো।
বাবা বোধহয় এমন একটি কথার জন্য অপেক্ষা করছিলো। যে কথার সূত্র ধরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা যায় অর্থাৎ মায়ের সঙ্গে আপস করা যায়। বরাবরই বাবা এ কাজটি করেন। কোন বিষয়ে মা রেগে গেলে হঠাৎ মায়ের এমন প্রশংসা করেন যে নিমিষেই মায়ের সব রাগ উধাও হয়ে যায়। এখনও তাই হলো। বাবা বললো- আরে ধুর ধুর। হোটেলের রান্না কোন রান্না? ওসব ছাইপাঁশ কি মুখে-টুখে দেয়া যায়? যদিও ক্ষুধা সইতে না পেরে মাঝে-মধ্যে হোটেলে-টোটেলে খাই। কিন্তু ওটাকে খাওয়া বলে না। চোখ বুজে নিশ্বাস বন্ধ করে টপাটপ গিলি। আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি কখন বাসায় ফিরবো, আর তোমার হাতের রান্না তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে খাব। সত্যি করে বলো তো, তোমার হাতে জাদু-টাদু আছে নাকি? আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, আমার স্ত্রীর মতো এমন সুস্বাদু রান্না আর কেউ করতে পারে না। আমাকে ফাঁসিতে ঝুলালেও, ওই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে গর্ব করে বলবো- রান্নায় আমার স্ত্রীই সেরা, সেরা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ।
মায়ের বিগড়ে যাওয়া মেজাজে হঠাৎ যেন পানি পড়লো। ধপ করে নিভে গেল রাগের আগুন। তার মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
মা বসা থেকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো- হয়েছে, হয়েছে, আর তেল মারতে হবে না।
রান্না ঘরের দিকে গেল মা। আর বাবা মুচকি হেসে মনোযোগ দিলো টিভিতে।



বাড়ির গেটে যেতেই আমাকে দেখে দৌড়ে এলো ভুট্টো। হাত ধরে টেনে একপাশে নিয়ে গেল। হাফাতে হাফাতে বললো- এখন বাসায় যাইও না জিতু ভাইয়া।
আমি বললাম- কেন, বাসায় যাবো না কেন?
দুই হাতে অদ্ভুত ভঙ্গি করে ভুট্টো বললো- শুরু হইয়া গেছে।
কি শুরু হয়ে গেছে।
ভূমিকম্প। ঘটাং ঘটাস, ঘটাং ঘটাস। হাতের কাছে যা পায় তা-ই এক আছাড়েই খাল্লাস। ঘটাং ঘটাস কইরা শব্দ- চাইয়া দেহি দুইটা গেলাস নাই, আবার ধপাস কইরা শব্দ- দেহি দুইটা চায়ের কাপ ফিনিস। এরপর দুইটা পিরিচ এক্কেবারে গুড়াগুড়া। একটা পেলেট- চুরমার।
ভুট্টো গ্লাসকে গেলাস এবং প্লেটকে পেলেট বলে। আমি সঠিক শব্দ দুটি জানি। কিন্তু ভুট্টোকে কখনও ভুল শুধরে দিইনি। অনেক শব্দই সে ভুলভাল বলে। শোধরাতে গেলে সারা দিন ওকেই সময় দিতে হবে। তাই ভুলটা সঠিক করে দিতে ইচ্ছে হয়নি।
তার কথা আমি গায়ে মাখলাম না। এতে ভুট্টোর উত্তেজনা আরও বাড়লো। সে বললো- মনে হয় এতক্ষণে কিয়ামত শুরু হইয়া গেছে। সব লণ্ডভণ্ড।
বাবা-মা যখনই কোন বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে কথাবার্তা বলেন তখনই ভুট্টো এ ধরনের কথাবার্তা বলে।
আমি বললাম- ঠিক আছে, সমস্যা নেই। তুমি তোমার কাজে যাও।
চোখ বড় বড় করে সে বললো- সমিস্যা নাই মানে? সমিস্যায় গিজগিজ করতাছে। আর আইজকার সমিস্যা তো তুমি?
আমি! আমি আবার কি করলাম?
তোমারে বাজারে পাঠাইছে, তুমি যাও নাই। পাকঘরের পাতিলা ‘উপতা’।
‘উপতা’ কি?
মাঝে-মধ্যে ভুট্টোর কথা আমি বুঝি না। তখন ওর কাছে জানতে চাই এর অর্থ কি? সে আমাকে বুঝিয়ে দেয়। এখনও তাই করলো। শরীর কাত করে হাত ভেঙ্গে আমাকে ‘উপতা’ দেখালো। বুঝলাম, ‘উপতা’ বলতে সে উপুড় বুঝিয়েছে।
এরপর মুখ কালো করে পেট দেখিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো- খিদায় মইরা যাইতাছি। অথচ আইজ নাকি খাওন-দাওন বন্‌।
হঠাৎ আমার বাজারের কথা মনে পড়লো। জিহ্বা কামড়ে মাথায় হাত দিয়ে বললাম- সর্বনাশ! আমি তো বাজারের কথা বেমালুম ভুলে বসে আছি।
খালি কি সব্বোনাশ! মহাসব্বোনাশ। খালাম্মা ডাইল গুটনি লইয়া খাড়াইয়া আছে। গেলেই তোমার পিঠে ভাঙবো। যেইটা মাঝে-মধ্যেই আমার পিঠে ভাঙে। এই দেখো কাইল দুইটা বাড়ি মারছে, এহনও কাইলচা হইয়া রইছে।
ভুট্টো গেঞ্জি উঠিয়ে তার পিঠ দেখালো। দেখলাম, তার পিঠে কালচে দাগ। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভুট্টোর মা-বাবা নেই। পেটের দায়ে আমাদের বাসায় থাকে। যখন যে কাজ করতে বলা হয় তাই করে। কোন অলসতা নেই। তবুও মা কেন তাকে মারধর করে বুঝি না। ভুট্টোকে কিভাবে মায়ের নির্যাতন থেকে রক্ষা করা যায় তাই ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। বললাম- ভুট্টো, আয় আমার সঙ্গে।
ভুট্টো বললো- কই যামু?
যা বলছি তাই কর। চুপচাপ আমার সঙ্গে আয়। নইলে মাকে বলে আজ তোকে আবার মার খাওয়াবো।
কাঁদো কাঁদো হয়ে ভুট্টো বললো- না ভাইয়া, আমারে মাইর খাওয়াইও না। আমার খুব কষ্ট হয়। বুক ফাইট্যা কান্দন আহে। কিন্তু কানতেও পারি না।
কেন, কাঁদতে পারিস না কেন? আমি জানতে চাই।
কানলে আরও বেশি মারে। হেই ভয়ে কান্দিনা। তয় রাইত ভইরা কান্দি। মা’র কথা খুব মনে পড়ে। তোমারে খালাম্মা কত ভালবাসে। আদর কইরা বুকে টাইনা লয়। দেখলে আমার খুব ভালা লাগে। আমার মা বাইচা থাকলে আমারেও এইভাবে আদর করতো, তাই না জিতু ভাইয়া?
ভুট্টুর চোখে পানি। আমি বললাম- হ্যাঁ করতো। এখন আয় আমার সঙ্গে।
ভুট্টু আর কথা বলে না। আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকে। আমাদের বাসা থেকে একটু দূরেই একটা রিকশার গ্যারেজ। ওখানে গিয়ে ভুট্টোকে বললাম- রিকশার চাকা থেকে কালি নে। আমার পিঠে লাগা। এমনভাবে লাগাবি যেন দেখতে তোর পিঠে মারের কালো দাগের মতো দেখা যায়। বুঝতে পেরেছিস।
হ পারছি। কিন্তু কালি লাগাইবা ক্যান?
দরকার আছে। তুই খুব ভাল করে লাগা।
ভুট্টো বেশ ভাল করে কালি লাগালো। একটা কাপড় দিয়ে এমনভাবে কালি মুছে দেয়া হলো যেন হাতে না লাগে। কিন্তু দেখলে মারের দাগের মতো মনে হয়। এরপর বললাম- চল ভুট্টো বাসায় যাই।
কিন্তু এইসব ক্যান লাগাইলা জিতু ভাইয়া। খালাম্মা দেখলে রাগ করবো না?
রাগ করার জন্যই তো লাগিয়েছি। এখন চল।

বাসায় ঢুকতেই বাবার মুখোমুখি হলাম। বললাম- সরি বাবা, বাজার করতে পারিনি। বন্ধুরা...।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে বাবা বললো- জানি। কেন পারিস নি সেটাও জানি। এখন যা গোসল করে ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে আয়, তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
আমি জামা খুলে খালি গায়ে রান্না ঘরে গেলাম। মায়ের সামনে এমনভাবে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম যেন মারের দাগ তার চোখে পড়ে। আমাকে দেখে মা বললো- কিরে রান্না ঘরে ঘোরাঘুরি করছিস কেন?
আমি বললাম- খুব ক্ষুধা লেগেছে আম্মু। কিছু খেতে দাও।
গোসল করে আয়, আমি খাবার রেডি করছি।
না আম্মু, আগে কিছু খেতে দাও। খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
হঠাৎ মা আঁৎকে উঠে বললো- কিরে তোর পিঠে কিসের দাগ? তোকে কি কেউ মেরেছে?
ও কিছু না আম্মু। সেরে যাবে।
সেরে যাবে মানে? কে মেরেছে তোকে, বল।
বললাম তো তেমন কিছু না।
কালচে দাগ হয়ে আছে। অথচ বলছিস কিছু না।
আমাকে টেনে বাবার সামনে নিয়ে গেল আম্মু। বললো- শুনছো, জিতুকে কে যেন মেরেছে।
বাবা বললো- কে মেরেছে?
মা বললো- সেটাই তো জানতে চাইছি। কিন্তু ও তো কিছু বলছে না। আমার ছেলেকে যে মেরেছে আমি তাকে পুলিশে দেব। মামলা করবো। জেলের ভাত খাওয়াবো। তুই নাম বল জিতু।
আহা আম্মু, শুধু শুধু তুমি রাগ করছো। একটা সামান্য ব্যাপার।
আম্মু আরও রেগে গিয়ে বললো- সামান্য ব্যাপার! এটা সামান্য ব্যাপার?
হ্যাঁ। আমি বললাম।
মোটেও সামান্য ব্যাপার না। তুই নাম বল কে তোকে মেরেছে? আমি ওকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াবো।
না মানে, গতকাল স্কুলে পড়া পারিনি তো, তাই টিচার...।
টিচার তোকে মেরেছে? কোন টিচার তোকে মেরেছে বল। আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করবো। সে জানে না, ছাত্রদের পেটানো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
আহা আম্মু, বাদ দাও তো। সামান্য একটা ব্যাপার...।
এটা সামান্য ব্যাপার না। বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো- এই তুমি কালই স্কুলে যাবে। যে টিচার আমার ছেলেকে মেরেছে তাকে পুলিশে দেবে।
আম্মু, শুধু শুধু...।
তুই চুপ কর।
আম্মু, এ রকম ঘটনা সব জায়গাতেই ঘটে। তুমিও তো ভুট্টোকে যখন-তখন মারধর করো। আমাকে মারার জন্য যদি টিচারকে পুলিশে দিতে হয় তবে তো...।
আম্মু ধমক দিয়ে বললো- কি বললি, কি বললি তুই। ভুট্টো আর তুই কি এক হলো?
আমি শান্তভাবে বললাম। আম্মু মাথা ঠান্ডা করো। শোন, আমাকে মারলে আমি যেমন ব্যথা পাই, তেমনি ভুট্টোও ব্যথা পায়। আমি যেমন মানুষ, সেও তেমনি। আমাকে মারার জন্য আজ তুমি এত কষ্ট পেয়েছো, টিচারকে পুলিশে দিতে চাইছো, মামলা করতে চাইছো। ভুট্টোর মা বেঁচে থাকলে সেও এমন কষ্ট পেত। তোমাকে পুলিশে দিতে চাইতো। ভুট্টো গরীব ছেলে। মা-বাবা নেই। তুমি যখন যা বলো তাই করে সে। শুধু পেটের জন্য। তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আর ভুট্টোকে মের না আম্মু, প্লিজ।
মা কিছুটা শান্ত হলো। বাবাকে বললো- শোনছো তোমার ছেলের কথা।
বাবা চোখ রাঙিয়ে বললো- বেয়াদব ছেলে। কষে দুইটা থাপ্পড়-টাপ্পড় লাগাও। কত বড় সাহস, তোমাকে জ্ঞান দেয়। কোথায় সে, আর কোথায় ভুট্টো না ফুট্টো?
চোখ বড় করে বাবাকে মা বললো- আচ্ছা তোমার হয়েছে কি বলো তো? তুমি আমার ছেলেটাকে দুই চোখখে দেখতে পারো না কেন? সব সময় ধমকাধমকি, মারধর করতে পারলেই খুশি লাগে, না?
‘না’ শব্দটায় বাড়তি জোর দেয়ায় এবং নাক ফুলিয়ে মুখ বাঁকা করে বলায় সেটা ‘ম্যা’র মতো শোনালো।
আমাকে বুকে টেনে আদর করতে করতে বললো- আমার ছেলে তো ঠিকই বলেছে। অতি সত্য কথা বলেছে। আমারই ভুল। মা-বাপ নেই, এতিম ছেলে। ওকে মারধর করা উচিত হয়নি। আমি আর ওকে মারবো না বাবা। এখন যা, ভাল করে সাবান মেখে গোসল করে আয়। আমি খাবার দিচ্ছি।
মা চলে গেলে বাবা আমাকে তার কাছে বসালো। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো- পিঠে কালি লাগিয়েছিস কোত্থেকে?
দাঁত দিয়ে জিব কেটে আমি বললাম- তুমি ধরে ফেলেছো বাবা?
কাজটা নিখুঁত হয়েছে। বুদ্ধিটা হয়েছে চমৎকার। এ জন্য অবশ্যই তুই প্রশংসা পেতে পারিস। যে কাজটি আমি করতে পারিনি সেটা তুই করতে পেরেছিস। এ জন্য তোকে মেনি মেনি থ্যাঙ্কস মাই সান। মেনি মেনি থ্যাঙ্কস।
আমি মুচকি হেসে চলে যেতে চাইলে বাবা পিঠ চাপড়িয়ে আবারও বাহবা দিলো। এরপর হঠাৎ রাগি রাগি কণ্ঠে বললো- জিতু, এদিক আয়।
কথাটা একটু জোরেই বললো বাবা। যাতে মা শুনতে পায়।
কাছে গেলে বাবা বললো- তোকে বাজারে পাঠিয়েছিলাম। তুই যাসনি। আমার নির্দেশ অমান্য করে মহা অন্যায় করেছিস।
বাবার কাছে গিয়ে কাঁচুমাঁচু হয়ে বললাম- সরি বাবা।
সরি বললেই সব শেষ? এসব সরি-টরি আমি মানি না। কান ধরে এক শ’ বার উঠবস কর।
পড়িমরি করে দৌড়ে এলো মা। আমাকে কাছে টেনে বললো- বললাম না, তুমি আমার ছেলেটাকে দেখতে পারো না। এইটুকুন ছেলে, কান ধরে এক শ’ বার উঠবস করলে ওকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে? নির্ঘাত অসুস্থ হয়ে পড়বে। চল বাবা, আমার সঙ্গে চল।
যাওয়ার পথে মৃদু হেসে বাবা আমাকে চোখ মারলো। বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বললো- এই তো, এই তো, আমি কি শুধু শুধু বলি তুমি ছেলেটাকে ফার্মের মুরগি বানাতে চাইছো। তোমার জন্যে, শুধু তোমার জন্যে এই ছেলেকে মানুষ করা যাবে না।
আমাকে নিয়ে যেতে যেতে মা বললো- না হলে না হবে। দশটা না পাঁচটা না, আমার একটা মাত্র ছেলে।

স্কুল মাঠে ছোটখাটো একটা জটলা। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা দেখছে। ভাবলাম ক্লাসে ব্যাগ রেখে এসে দেখবো কি হয়েছে। কিন্তু ক্লাসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। বেঞ্চে ব্যাগ রাখার আগেই দৌড়ে এসে মুখ বাঁকিয়ে ঝণ্টু বললো- জানিস কি হয়েছে?
আমি অনুমান করলাম তেমন কিছুই হয়নি। ঝণ্টু এখনই কোন বিষয় নিয়ে চাপা মারতে শুরু করবে। ওর সঙ্গে যখনই দেখা হবে তখনই প্রথম ডায়ালগ- জানিস কি হয়েছে?
কথাটা এমনভাবে বলে যে, শুনে মনে হবে- ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেছে। অথবা অবাক করা কোন কাণ্ড ঘটেছে। আমি ওর বিষয়ে জানি বলে এ নিয়ে কোন উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। কিন্তু ঝণ্টুর তাতে কিছু যায়-আসে না। সে এবার কানের কাছে মুখ এনে বললো- রিমি আর মুন্নি। কড়া ফাইটিং। যাকে বলে চুলোচুলি। একজন আরেকজনের চুল ধরে সেকি টানাটানি। আহা হা হা চোখ জুড়ানো দৃশ্য বুঝলি। বাংলা সিনেমা ফেল। না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমি নিজের চোখে দেখেছি। ঢিসুম-ঢাসুম।
ঝণ্টু হাত দিয়ে ঘুষি মেরে ঢিসুম-ঢাসুম দেখালো। চুল ধরে টানাটানি করলে ঢিসুম-ঢাসুম শব্দ হয় আমার জানা ছিল না।
আমি বললাম- বলিস কি? কিন্তু কেন?
কেন আবার? এটা তো নতুন কিছু না। প্রতিদিনই হয়।
কই, আমি তো কিছুই জানি না।
তুই দেখিস নি, তাই জানিস না।
কিন্তু কি নিয়ে তারা প্রতিদিনই ঢিসুম-ঢাসুম করে?
প্রতিদিনই যা নিয়ে করে। কিন্তু আজ আর রক্ষা পায়নি। পড়বি ফের মালির ঘাড়ে। যেই ঢিসুম-ঢাসুম শুরু আর অমনি মিহির স্যার এসে হাজির। ব্যস, আর যায় কোথায়। দুইজনকেই কান ধরে রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আর ছোট ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তা নিয়ে খুব মজা করছে। চারপাশে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে টিপে হাসাহাসি করছে। ইজ্জত পাংচাররে জিতু, ইজ্জত পাংচার। স্কুলে আর মুখ দেখানোর উপায় নেই।
ঝণ্টুকে ধমক দিয়ে বললাম- আহ্‌, চাপা বন্ধ করে আসল ঘটনাটা খুলে বল।
গলা খাকারি দিয়ে ঝণ্টু বললো- ওই একই কিচ্ছা-কাহিনী। ফ্যানের নিচে কে বসবে। রিমি বলে আমি বসবো, মুন্নি বলে আমি। রিমি বলে আমি আগে এসেছি আমি বসবো। মুন্নি বলে আমি রোজ এখানে বসি। আজও আমিই বসবো। এভাবেই শুরু। প্রথমে মুখ। মুখ থেকে ধাক্কা। ধাক্কা থেকে খাতা দিয়ে বাড়ি। ওই খাতা কেড়ে নিয়ে পাল্টা বাড়ি। এরপর কোস্তাকুস্তি। কোস্তাকুস্তি থেকে চুল ধরে এয়সা টান। ঝণ্টু হাত দিয়ে এয়সা টান দেখালো আর মুখে ‘এঁইও’ বলে একটা শব্দ করলো। যার অর্থ নৌকায় বৈঠা চালানোও হতে পারে আবার কোমর দুলিয়ে নাচানাচিও হতে পারে।
কিন্তু আমাদের ক্লাসের ফ্যানটা তো নষ্ট। লক্কড়-ঝক্কর। বেচারা কত কষ্ট করে ঘোরে। আর গরুর গাড়ির চাকা কিংবা তেল ভাঙ্গার ঘানির মতো ‘গ্যাচর গ্যাচর’, ‘গটর গটর’ আবার কখনো ‘কিচ কিচ’ শব্দ হয়। আর যেভাবে কোমর দুলিয়ে ঘোরে আমার তো ভয় হয়, কখন ওটা ছিঁড়ে মাথার উপরে পড়ে। তাছাড়া ফ্যানের বাতাসও তো গায়ে লাগে না। ওটা নিয়ে এত কিছু?
তবে আর বলছি কি? লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। মাঠের মধ্যে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা। ছি! ছি! ইজ্জত পাঞ্চাররে জিতু, ইজ্জত পাঞ্চার। স্কুলে আর মুখ দেখাতে পারবো না।
কাল থেকে মুখে রুমাল দিয়ে স্কুলে আসিস। অবশ্য একটা কাপাইড় হলে ভাল হতো।
কাপাইড়! সেটা আবার কি?
অন্যের ক্ষেতের শস্যে যেন মুখ দিতে না পারে সে জন্য গরুর মুখে যেটা লাগায়।
যাহ্‌। কি যা তা বলছিস? আমি কি গরু নাকি?
না, তার ছোটটা। যেটা যেখানে যা পায় তাই মুখে দেয়।
সেটা আবার কি?
চিনিস নি? যে সারাক্ষণ ম্যা... ম্যা... করে। ছাগল কোথাকার।
তুই আমাকে ছাগল বললি জিতু? বন্ধু হয়ে বন্ধুকে ছাগল বলতে পারলি!
এটা যদি তোর পছন্দ না হয়ে থাকে তবে কি নাম দেয়া যায় সেটা নিয়ে পরে ভাববো। এখন বল মিহির স্যার কোনদিকে গেছেন।
লাইব্রেরির দিকে।
লাইব্রেরিতে মিহির স্যারকে পাওয়া গেল না। খুঁজতে খুঁজতে হেড স্যারের রুমে পেলাম। বললাম- স্যার, আসবো?
হেড স্যার বললেন- এসো।
স্লামালেকুম স্যার।
অলাইকুম সালাম। কি ব্যাপার?
স্যার, আমাদের ক্লাসের ফ্যানটা দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। এ জন্য আপনার কাছে একটা দরখাস্তও দিয়েছি স্যার। কিন্তু ফ্যানটা এখনও ঠিক হয়নি। গরমে আমাদের খুব কষ্ট হয়। দয়া করে যদি ফ্যানটা...।
হ্যাঁ তোমাদের দরখাস্ত পেয়েছি। শুধু তোমাদের ক্লাসের না, আরও কয়েকটা ফ্যান নষ্ট হয়ে আছে। আমি চেষ্টা করছি। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদনপত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও কোন উত্তর পাইনি।
স্যার, অনেকদিন হয়ে গেল। তাছাড়া ওই ফ্যানটা চালালে ছিঁড়ে পড়ে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পরে। তাই বলছিলাম...।
বাবারে, সরকারি স্কুল। যারা ফ্যান বরাদ্দ দেবে তারা ‘কিছু’ আশা করে। কিন্তু আমি ‘কিছু’ কোথায় পাবো, কোত্থেকে দেব? তুমি এসব বুঝবে না। আমি দুঃখিত। আগামী সপ্তাহে আমি আবার যাবো। দেখি যদি কিছু হয়। তুমি ক্লাসে যাও।
জি স্যার।
হেড স্যারের কথা এবং তার মুখ দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের ফ্যানগুলো ঠিক করতে না পারা এবং অসহ্য ভ্যাপসা গরমে ছাত্রছাত্রীদের কষ্ট তাকেও কষ্ট দিচ্ছে- এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
হেড স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার সঙ্গে মিহির স্যারও বেরিয়ে এলেন। আসার সময় মিহির স্যারকে রিমি মুন্নির কথা বললাম। তিনি ওদের ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে বললেন- জিতু, মন খারাপ করিস না। স্কুলের বেশ কিছু ফ্যান নষ্ট। তীব্র গরমে তোরা যেমন কষ্ট করছিস তেমনি হেড স্যারও কষ্ট করছেন।
কেন স্যার? হেড স্যার কেন কষ্ট করছেন? উনার ফ্যানও কি নষ্ট? আমি জানতে চাইলাম।
মিহির স্যার বললেন- না, হেড স্যারের ফ্যানটা নষ্ট নয়। কিন্তু তোদের ফ্যান ঠিক হচ্ছে না বলে তিনি তার ফ্যানটি চালান না। আমরা সব টিচার মিলে স্যারকে অনেক অনুরোধ করেছি। তিনি কি বলেন জানিস?
কি স্যার?
হেড স্যার বলেন- যেদিন আমার ছাত্রদের ক্লাসের সব ফ্যান ঠিক হবে, যেদিন ওরা ফ্যানের বাতাস পাবে আমিও সেদিন আমার ফ্যান চালাবো। এর আগে নয়।
মিহির স্যারের কথা শুনে আমার দু চোখ অশ্রুতে ভরে উঠলো। মিহির স্যারকে বললাম- স্যার, আপনি যান। হেড স্যারকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমি আবার একটু উনার কাছে যাবো। কথাটা বলেই চলে আসবো।
মিহির স্যার বললেন- এমন কিছু বলিস না জিতু, যাতে উনি কষ্ট পান।
না স্যার, এমন কিছু বলবো না।
আমি অনুমতি নিয়ে আবার হেড স্যারের রুমে গেলাম। স্যার বললেন- কিরে বাবা, আর কিছু বলবি?
আমি বললাম- না স্যার, কিছু বলবো না। আপনি যদি দয়া করে একটু উঠে দাঁড়াতেন স্যার।
কেন?
আমি কাছে গিয়ে বললাম- প্লিজ স্যার, একটু উঠে দাঁড়ান।
স্যার দাঁড়ালেন। আমি তার পা ছুঁয়ে সালাম করে বললাম- স্যার, আমাকে ক্ষমা করে দিন। না জেনে আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি।
তুই আবার কখন আমাকে কষ্ট দিলি?
আমি জানতাম না স্যার, আমাদের জন্য ফ্যান বন্ধ রেখে আপনিও কষ্ট করছেন। জানলে আমি কখনো এসে ফ্যানের কথা বলতাম না। আমাকে ক্ষমা করে দিন স্যার।
আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্যার বললেন- ওরে, সন্তানের কষ্ট কোন মা-বাবাই সইতে পারে না। তোরা আমার সন্তান। সন্তানকে গরমে রেখে বাবা কি করে ফ্যানের বাতাস খায়, বল্‌?
স্যারের চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু আমার গালে পড়লো। আমার চোখও ভিজে উঠলো।


স্কুলের ফ্যানের বিষয়ে কি করা যায়, কার কাছে গেলে বা কিভাবে ফ্যানের ব্যবস্থা হবে তা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বুঝতে পারছি না কি করবো। বই খুলে বসে আছি, কিন্তু পড়ায় মন নেই। বাবার সঙ্গে পরামর্শ করবো ভাবছি। ঠিক ওই মুহূর্তে বাবা ডাকলো। প্রতিদিনই এ সময় বাবাকে পত্রিকা পড়ে শোনাতে হয়। নিজে পড়তে পারলেও বাবা কেন আমাকে দিয়ে পড়িয়ে শোনে, তা জানি না। একদিন জেনে নিতে হবে। বাবার রুমে যেতেই আমার হাতে পত্রিকা দিয়ে বললো- নে, পত্রিকার হেডিংগুলো পড়ে শোনা। পত্রিকার সব খবর বাবা শোনে না। প্রতিটি হেডিং শোনে। কোনোটি তার পছন্দ হলে শুধু ওই সংবাদটির পুরোটা পড়তে বলে।
আমি বললাম- বাবা, পত্রিকা একটু পরে পড়ি। তার আগে আমার একটি বিষয় জানা দরকার।
বাবা বললো- কি বিষয়?
সরকারি স্কুলে যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে কোথায় যোগাযোগ করতে হয়?
বাবা বললো- এটা অনেক জটিল ব্যাপার। সরকারি অফিসের কাজ। খুব জটিল। হঠাৎ তুই এটা জানতে চাইছিস কেন?
আমাদের স্কুলে বেশ কয়েকটি ক্লাসের ফ্যান বহুদিন ধরে নষ্ট। হেড স্যার অনেক চেষ্টা করেও এ বিষয়ে কিছুই করতে পারছেন না। তাই স্যারের মনে খুব কষ্ট। জানো বাবা, আমরা ছাত্রছাত্রীরা গরমে কষ্ট করি বলে স্যার নিজেও কষ্ট করেন।
কেন, হেড স্যারের ফ্যানও নষ্ট?
না বাবা। ফ্যান ভাল, কিন্তু স্যার চালান না। আজ আমি স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি অনেক কথা বললেন। মিহির স্যারের কাছ থেকে জানতে পারলাম আমাদের কারণে স্যার নিজের ফ্যানটি বন্ধ রাখেন। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। স্যারের কাছে ক্ষমা চাইতে গেলে তিনি এক পর্যায়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। বললেন, তোরা আমার সন্তান। যেদিন তোদের ফ্যান ঘুরবে, সেদিন আমারটাও ঘুরবে। এর আগে নয়।
বলিস কি?
হ্যাঁ বাবা। স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর বিষয়টি আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। তুমি কি জানো বাবা, কোথায় গেলে ফ্যানের ব্যবস্থা হবে?
থানা শিক্ষা অফিসারের কাছে আবেদন করতে হয়। সেখান থেকে ফাইল মন্ত্রণালয়ে যায়। অনুমোদনের পর তা বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক জটিল বিষয়। অনেক সময়ের ব্যাপার।
অনেক বলতে কতদিন বাবা? আমাদের ফ্যানগুলো দুই বছরের বেশি সময় ধরে নষ্ট হয়ে আছে। কোন কোনটি চললেও গটর গটর শব্দ করে। এমন ভাবে হেলেদুলে ঘোরে যে, যেকোনো মুহূর্তে ছিঁড়ে মাথার ওপর পড়তে পারে। যদি এ রকম হয় তাহলে কি সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটবে বাবা, তুমিই বলো।
হ্যাঁ তা-তো ঠিকই। বড়ই চিন্তার কথা।
বাবা, আমি কাল স্কুলে না গেলে তুমি কি রাগ করবে?
কেন, স্কুলে যাবি না কেন?
থানা শিক্ষা অফিসারের কাছে যাবো। আমাদের কষ্টের কথা তাকে বুঝিয়ে বলবো। তাহলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা হবে তাই না বাবা?
হয়তো হবে, হয়তো হবে না। দেখ চেষ্টা করে।
আমার মনটা ভাল হয়ে গেল। বাবাকে ধন্যবাদ দিয়ে পত্রিকা পড়তে শুরু করলাম।
বাবা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো। থাক, আজ আর পত্রিকার খবর জানতে ইচ্ছে করছে না। কোথাও কোন ভাল সংবাদ নাই। খালি দুঃসংবাদ আর দুঃসংবাদ।
বাবা উঠে বাথরুমের দিকে গেল। আমি টেবিলে গিয়ে একটি দরখাস্ত লিখলাম।
পরদিন দরখাস্ত নিয়ে থানা শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করলেন এবং বললেন এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যবস্থা করবেন।
আমি খুশি হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। সব শুনে বাবা খুব খুশি হলো। আমার সাহসের প্রশংসা করলো। এরপর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম। কবে এক সপ্তাহ শেষ হবে। কিন্তু এক সপ্তাহ নয়, প্রায় এক মাস কেটে গেল। কোনো কিছুই হলো না।

প্রতিদিনের মতো আজও বাবাকে পত্রিকা পড়ে শোনাচ্ছি। আর মনে মনে ভাবছি কি করবো। পড়ার মাঝেখানে বাবাকে বললাম- থানা শিক্ষা অফিসার বললেন এক সপ্তাহের মধ্যে ফ্যানের ব্যবস্থা করবেন কিন্তু এক মাস কেটে গেল, কিছুই হলো না বাবা।
বাবা বললো- বললাম না, সরকারি কাজ খুব জটিল। দপ্তর থেকে দপ্তর, টেবিল থেকে টেবিলে ঘুরে বহু লোকের হাত হয়ে তবেই...।
হঠাৎ আমার মনে পড়লো হেড স্যার বলেছিলেন, যে লোক ফ্যানের বরাদ্দ দেবেন তিনি ‘কিছু’ আশা করেন। এই ‘কিছু’টা কি বাবার কাছে জানতে চাইলাম।
বাবা বললো- এই সেরেছে রে জিতু, এ কথা আগে বলিস নি কেন? ‘কিছু’ মানে তো ‘ঘুষ’। ওই লোক ‘ঘুষ’ চায়। হেড স্যার ভদ্রলোক। তাই ‘ঘুষ’ কথাটা মুখে আনেননি।
কিন্তু বাবা, হেড স্যার ঘুষ দিবেন কোত্থেকে? আর কেনই বা দেবেন। এটা তো স্যারের ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নয়।
তা ঠিক? তুই এক কাজ কর জিতু, আমি তোকে কিছু টাকা দিচ্ছি, কাল গিয়ে তুই ঘুষটা দিয়ে আয়। দেখবি সুরসুর করে ফ্যান চলে এসেছে।
ঘুষ দেয়া এবং নেয়া দুটোই তো অন্যায় বাবা।
বাবা হাসতে হাসতে বললো- আমাদের দেশে এটাই ন্যায়। বড় হলে সব বুঝবি। এখন পত্রিকার বাকি অংশটা পড়।
আমি পত্রিকা পড়ে বাবাকে শোনাতে লাগলাম। হঠাৎ পত্রিকার এক পাতায় আমার চোখ আটকে গেল। ওখানে কিছু চিঠি ছাপা হয়েছে। পাঠকের চিঠি। দুটি চিঠি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। বাবার কাছে জানতে চাইলাম- বাবা, যে কেউ চিঠি পাঠালে কি পত্রিকায় তা ছাপা হয়?
বাবা বললো- হ্যাঁ, ছাপার উপযোগী হলে অবশ্যই ছাপা হয়।
হাত থেকে পত্রিকা ফেলে আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। দৌড়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম। লিখে ফেললাম চিঠি। আর তা লিখলাম শিক্ষামন্ত্রীর কাছে। পাঠিয়ে দিলাম ৫-৬টি দৈনিক পত্রিকায়।
চিঠিটি এরকম-
শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী,
আমার নাম মাইনুল শাহিদ জিতু। আমি ইসলামিয়া গভঃ হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের স্কুলের সাতটি ক্লাসের ১০টি ফ্যান প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে নষ্ট। দু-একটি চললেও সেগুলো চালানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় ওই ফ্যানগুলো খুলে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের প্রধান শিক্ষক গত দুই বছরে আবেদনপত্র নিয়ে বহুবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করেছেন। অনুরোধ করেছেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু কোনো ফল পাননি। আমি নিজেও থানা শিক্ষা অফিসারের কাছে আবেদন নিয়ে গিয়েছি। তিনি আমাকে সাত দিনের মধ্যে ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও কিছুই হয়নি।
মাননীয় মন্ত্রী,
এবার আমি এক পিতার মনোকষ্টের কথা আপনাকে জানাবো। যিনি সন্তানের কষ্টে অত্যন্ত ব্যথিত। তিনি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান। আমরা ছাত্রছাত্রীরা গরমে কষ্ট করি বলে তিনি তার সচল ফ্যানটি চালান না। আমরা তাকে বহুবার অনুরোধ করেছি। কিন্তু তার এক কথা- ‘সন্তানকে অসহ্য গরমে কষ্টে রেখে কোন পিতা ফ্যানের বাতাসে আরাম করতে পারে না। আমিও পারবো না।’ যতদিন পর্যন্ত আমাদের ক্লাসের ফ্যানগুলো ঠিক হবে না, ততদিন পর্যন্ত তিনি নিজের ফ্যানটি চালাবেন না বলে সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী,
আমাদের প্রধান শিক্ষকের কাছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ‘কিছু’ আশা করেন। এই ‘কিছু’টা কি আমি জানি না। শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন- আমি ছোট মানুষ, ওসব বুঝবো না। মাননীয় মন্ত্রী, হয়তো ওই ‘কিছু’টা কি তা আপনি জানেন। তীব্র গরমে আমাদের খুব কষ্ট হয়, তাই বাধ্য হয়ে আপনার শরণাপন্ন হলাম। বিনীত অনুরোধ করছি- আমরা শিশু, আমাদের কষ্ট দেবেন না। প্লিজ, একটা কিছু করুন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।

ইতি
মাইনুল শাহিদ জিতু
অষ্টম শ্রেণী
ইসলামিয়া গভঃ হাইস্কুল

চিঠি পাঠানোর দু’দিন পর দু’টি পত্রিকায় ছাপা হলো। এর একদিন পর আরও একটি পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে চিঠিটি প্রকাশ হলো। আনন্দে আমার মনটা ভরে উঠলো। আশায় বুক বাঁধলাম- হয়তো এবার কিছু হবে।
(সংক্ষেপিত)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status