ঈদ আনন্দ ২০১৮

কল্প বিজ্ঞান

রিতুন

মোহাম্মদ আবুল হোসেন

৩০ জুন ২০১৮, শনিবার, ৪:৪০ পূর্বাহ্ন

টাইটানের চারপাশ নীরব। সেলুলার মেমব্রেনে তৈরি আকাশচুম্বী ভবন। দুলছে, তবে ভাঙছে না। স্পর্শ করলেই যেন গলে যাবে। এরই ছাদে বিশেষ বৈঠকে বসেছেন দু’জন। একজন টগবগে যুবক। টি-শার্ট পরা। চোখেমুখে তার বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভা। অন্যজন শ্বেতশুভ্র। তবে যুবকটির চেয়ে এই প্রৌঢ়ের তেজ বেশি। তার চাহনীতে জাদু আছে। বুকের পাটা চেতিয়ে কথা বলেন। কণ্ঠ কাঁপে না একটুও।
মুখোমুখি বসেছেন আলোচনার টেবিলে তারা।
যুবকটি নিজের পরিচয় দিলেন- আমি রিতুন। আমাকে এই নামে ডাকা হয়। আর আপনি?
আমি? আমার চুল, দাড়ি শুভ্রতায় ভরে গেছে। এতদিন পর্যন্ত কেউ আমায় এ প্রশ্ন করেনি তো!
আমি করছি।  
কেন?
কারণ আছে। নামটা বলুন। তারপর বলছি।
আমি রানা।
দুর্ধর্ষ সেই মাসুদ রানা?
আরে না, আমি রানা। পৃথিবীর মানুষ আমাকে রানা চৌধুরী নামে চেনে।
ও আচ্ছা, তাই বলুন। রানা নামটা শুনেই কেমন গোয়েন্দা গোয়েন্দা গন্ধ লাগছিল। সাহস যোগালেন সঙ্গে চৌধুরী নামটা লাগিয়ে।
তার কথা শুনে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অট্টহাসি হাসলেন রানা চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জানতে চান- কি কারণে আমাকে ডেকে আনা হয়েছে টাইটানে?
এত অল্পতেই অধৈর্য হচ্ছেন কেন রানা চৌধুরী!
আশ্চর্য, পৃথিবী থেকে সেই যে আমাকে তুলে আনা হয়েছে, বলা হয়েছে আমার সঙ্গে জাকারবার্গ বোঝাপড়া করতে চান। আর এখন দেখি সিআইএ-র গোয়েন্দাদের মতো আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন!
আমি প্রথমেই নিশ্চিত হতে চাই, আপনি রানা চৌধুরী, মাসুদ রানা নন।
কিভাবে নিশ্চিত হতে চান?
আপনার সামনে কৃত্রিম একটি সেলুলয়েডের পর্দা তৈরি হবে। তার ওপর দেখতে পাবেন মার্ক জাকারবার্গকে। তিনি আপনাকে যদি চিনতে পারেন তাহলেই হয়ে যাবে। তার সঙ্গেই আপনার বোঝাপড়া। আপনি তাকে এর আগে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এজন্য পাঠিয়েছেন যে, আপনার গ্রুপের জন্য তিনি একটি আলাদা ফেসবুক করে দেননি বলে। সেই থেকে আপনার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন জাকারবার্গ।  
সকৌতুকে রানা চৌধুরী বলেন- আইছ্যা!

দুই.
এরই মধ্যে মঙ্গলসহ অনেক গ্রহে, চাঁদে বসেছে মানব বসতি। সেখানে আধিপত্য বিস্তার করে আছে অদ্ভুত এক রকম মানুষ। তাদের দৃষ্টি প্রখর। নড়াচড়া, হাত-পা নাড়ানো যান্ত্রিক। পরিধেয় বস্ত্র স্বাভাবিক হলেও কণ্ঠ অস্বাভাবিক। তারাই সেখানে চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ায় মানুষের বসবাসের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যস্ত। তারা কথা বলেন খুব সামান্যই। মানব বসতিকে তারা ঘিরে রেখেছে কৃত্রিম এক রকম পর্দা দিয়ে। দেখতে তা অর্ধবৃত্তাকার। এর পরিধি বিশাল। পৃথিবীর এক একটি দেশের সমান এক একটি কলোনি। তার ভিতর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গে এখানকার তাপমাত্রার পার্থক্য অনেক। ওই কলোনির ভিতর মানুষ বসবাস গড়ে তুলেছে। এক গ্রহের সঙ্গে অন্য গ্রহের স্যাটেলাইট কানেকশন রয়েছে। তাই গড়ে উঠেছে মহা এক আন্তঃমহাজাগতিক নেটওয়ার্ক।
ঘরে ঘরে টেলিভিশন। না, পৃথিবীর টেলিভিশনগুলোর মতো কোনো ধাতব বাঙ নয়। প্রতিটি ঘরের দেয়ালকে বানানো হয়েছে টেলিভিশন। ঘরে ঘরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে কন্ট্রোল প্যানেল। তাতে টিপ দিলেই ওই দেয়াল হয়ে যায় টেলিভিশন। আবার সেটাই ঘরের দেয়াল। অদ্ভুত এক প্রযুক্তি চালু হয়েছে। বেশির ভাগ মানব কলোনিতে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
২০১৮ সালের ২২শে মার্চ।
এদিন ঘরে ঘরে টেলিভিশন চলছে। কি হয়েছে এদিন! হ্যাঁ, ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে টেলিভিশনগুলো। প্রতি ঘরে, প্রতিটি মানব কলোনিতে একযোগে সে খবর দেখাচ্ছে আন্তঃমহাজাগতিক মহাশূন্য বিষয়ক চ্যানেল সিএনএস। সব ঘরে টেলিভিশন চালু থাকায় প্রতিধ্বনি তুলছে শব্দ। গম গম করে বাজছে একটি ঘোষণা। দু’চার মিনিট পরেই ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে- ‘পৃথিবী থেকে তুলে আনা হয়েছে রানা চৌধুরীকে। টাইটানে তার মুখোমুখি হবেন মার্ক জাকারবার্গ।’
সঙ্গে সতর্কবাণীও দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে- ‘আন্তঃমানব কলোনির প্রতিটি বাসিন্দা সাবধান! রানা চৌধুরী একজন সাধারণ মানুষ নন। তাকে দেখতে বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর মতো। তার দৃষ্টি প্রখর। তিনি পৃথিবীতে রাজেন্দ্র কলেজ নামে একটি কলেজের প্রফেসর ছিলেন। তার লেখা বই পড়ে  তৈরি হয়েছেন অনেক চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী। তার সঙ্গে জাকারবার্গ কি বোঝাপড়া করতে চান! যদি রানা চৌধুরী চান, তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের একটি সূত্র ব্যবহার করে তাণ্ডব শুরু করে দিতে পারেন!’
এমন ঘোষণা শুনে থর থর করে কাঁপছে মানব কলোনির বাইরের সেই অদ্ভুত মানুষগুলো। তারা জানেন, তারা রানা চৌধুরীর পদার্থ বিজ্ঞানেরই কোনো না কোনো ফর্মুলা দিয়ে তৈরি। তারা বুঝতে পারেন তাদের যখন চার্জ শেষ হয়ে আসে তখন কি বেদনা হয় তাদের। তাদের চোখের সামনে তখন সব কিছু ঘোলাটে হয়ে যায়। সারা সৃষ্টিজগৎকে তখন ম্লান দেখায়। ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন মুখ ঠাসা খেয়ে পড়ে থাকেন মাটিতে, তেমনটি তাদের কেউ কেউ পড়ে থাকেন। পৃথিবীতে অনেক মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু এই মানুষগুলোর (!) সেই অধিকার নেই। চার্জ ফুরিয়ে গেলে মৃতের মতো তাদেরকে তপ্ত মাটিতে পড়ে থাকতে হয়। আবার নিয়ন্ত্রক ইচ্ছা করলে তাদেরকে জাগিয়ে তুলতে পারেন। জেগেই আবার তাদেরকে কাজ করতে হয় এই চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। তাও এই মানব সম্প্রদায়ের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যকে নিশ্চিত করতে। এক এক সময় ইচ্ছা করে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ করে ধ্বংস করে দেয় সব কিছু। দূরের গ্রহের এই মানব বসতি।
কিন্তু পারে না তারা। তাদের অনুভূতিগুলো মনিটরিং করা হয় প্রতি মুহূর্ত। তাদেরকে চিন্তা করার শক্তি দেয়া হয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়েছে মানব কলোনিতে মানুষের হাতে। তারা চিন্তা করে, কি ভাবে, কোনো বিদ্রোহ করে কিনা- তা জানার জন্য প্রতিটি কলোনিতে কন্ট্রোল প্যানেলে বসে আছেন একদল মানুষ। তার নেতৃত্বে আছেন একজন রাজেন্দ্রিয়ান। তার নাম তরিকুল পাশা। তিনি নাসায় বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। কেউ বিদ্রোহের কথা চিন্তা করছে জানতে পারলেই তাকে সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শেষ করে দেয়া হয়। মাটিতে তখন পড়ে থাকে কিছু ধাতব পাত, আর কিছু নীল রক্ত। তাই অদ্ভুত এসব মানুষ নামের যন্ত্রগুলো কথা বলতে পারে না নিজেদের সুখ, দুঃখ নিয়ে। তবে নিয়ন্ত্রিত কথাবার্তা তারা বলতে পারে।
এজন্যই রানা চৌধুরীকে টাইটানে তুলে আনার খবরে তারা সচকিত। একে অন্যের চোখের দিকে তাকাচ্ছে। কি হবে আজ! কি হবে!! রানা চৌধুরী তাপগতিবিদ্যার কোনো সূত্র প্রয়োগ করে দেবেন না তো!!!
এসব কলোনিতে বসবাসকারী মানুষগুলোর জন্য তাদের খুব মায়া হয়। বহুদিন হয় মানুষের পাশাপাশি বসবাস করতে করতে মানুষের জন্য কেমন ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে যন্ত্রমানবদের মধ্যে। মানুষের কোনো ক্ষতি হোক এমনটা তারা চাইতে পারে না। তারা বুঝে গেছে মানুষকে বাদ দিয়ে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের জীবন, তাদের চলাফেরা সবই মানুষের হাতে।
টেলিভিশনে অকস্মাৎ সম্প্রচার করা হচ্ছে একটি ছবি। ছবিটা একজন বৃদ্ধের। তার চুল সাদা। দাড়ি সাদা। গোঁফ সাদা। সাদা হলে কি হবে, তার যে অভিব্যক্তি, তাকানোর যে ধরন, কথা বলার যে স্টাইল- তাতে যেকোনো যুবক তার কাছে ফেল খেয়ে যায়। অনেকক্ষণ তার ওপর ক্যামেরা ফোকাস করে রাখা হয়েছে। নিচের স্ক্রলে জরুরি ঘোষণা- এই সেই ব্যক্তি। ইনি হলেন রানা চৌধুরী। বড্ড এক ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছেন তিনি। জাকারবার্গের সঙ্গে তার টক্কর লেগেছে। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং থেকে তাকে মহাকাশে ছুড়ে মেরেছিলেন রানা চৌধুরী। তাকে সহায়তা করেছিলেন মীনা। তা নিয়ে ভীষণ ক্ষেপেছেন জাকারবার্গ। রানা চৌধুরীকে তিনি তুলে আনিয়েছেন টাইটানে।
লাল অক্ষরে বড় বড় হরফে আরো একটি লেখা যাচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, জাকারবার্গ হয়তো জানেন না রানা চৌধুরী কে! তিনি এই দূর গ্রহে, দূর আকাশের নিচে জাকারবার্গের আশ্রয়স্থল উড়িয়ে দিতে পারেন। শুধু একটি প্রোগ্রামিং প্রয়োজন হবে এজন্য। আর শুধু সুইটে হাত রাখবেন। অমনি কেল্লাফতে। এসব কেন বুঝতে পারছেন না জাকারবার্গ!
মানব কলোনিগুলোতে সবার মুখে হাত। কি হতে যাচ্ছে! কি হবে!

তিন.
চারদিকে অদ্ভুত রকম এক নীল। টাইটানে সেলুলার মেমব্রেনে তৈরি আকাশচুম্বী ভবনের ছাদ। তার চারপাশে স্বচ্ছ এক ঝিল্লি। আছে পার্শ্ব দেয়ালও। মহাজাগতিক বস্তুকণা আঘাত করতে পারে। তাই এই ঝিল্লি। এর মধ্যে রয়েছে অসীম মাত্রার চৌম্বক শক্তি, চৌম্বক প্রাবল্য। উল্কা, গ্রহাণু বা মহাজাগতিক কোনো বস্তুকণা এদিকে এগিয়ে এলে এই ঝিল্লি বা পর্দায় তৈরি করা হয় বিকর্ষণ বল। আগে থেকেই তার ভিতর সঞ্চারিত করা হয় এই বল। কোন মহাজাগতিক বস্তুতে কোন রকম বল আছে তা শনাক্ত করার জন্য ওই রাজেন্দ্রিয়ান তরিকুল পাশা স্থাপন করেছেন শক্তিশালী এক শনাক্তকরণ যন্ত্র। এর নাম দেয়া হয়েছে নভো থ্রেট ডিটেক্টর। দূর থেকে কোনো মহাজাগতিক বস্তুকণা কোনো মানব বসতির দিকে ছুটে এলে এর সাহায্যে তার চৌম্বক প্রাবল্য, চৌম্বক গতি, আবেশী শক্তি সব পরিমাপ করা হয়। নভো থ্রেট ডিটেক্টর দিয়ে ওই মহাজাগতিক বস্তুকণার ভিতরে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে সজ্জিত করা হয় চৌম্বক শক্তি। যে বস্তু মানব বসতির দিকে ছুটে আসছে তার ঠিক বিপরীত মেরু সৃষ্টি করা হয় এসব মানব কলোনিকে ঢেকে রাখা ঝিল্লি বা পর্দায়। তরিকুল পাশা এত বড় একটি দায়িত্বে বসে আছেন। তিনি একটু এদিক-ওদিক করলেই অথবা প্রতারণা করলেই দূর গ্রহ, উপগ্রহে মানুষের যে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে, তা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি তা পারেন না। তিনি রানা চৌধুরীর সরাসরি ছাত্র। তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করেন তা। তিনি স্বীকার করেন উচ্চ মাধ্যমিকে ড. শাহজাহান তপন, মু. আজিজ হাসান ও ড. রানা চৌধুরীর পদার্থ বিজ্ঞান বই পড়েছেন। তাদের সেই বইয়েই চুম্বকের ধর্ম ব্যাখ্যা করা আছে। চৌম্বক প্রাবল্য বর্ণনা করা আছে। আরো অনেক বিষয় আছে সেখানে। ব্যবহৃত কুলম্বের সূত্র ব্যবহার করে কতই না ঘটনা ঘটিয়ে দেয়া যায়। সেই বিদ্যাকে সম্বল করে তিনি এখন কন্ট্রোল প্যানেলে সব নিয়ন্ত্রণ করেন।
রানা চৌধুরীকে চমকে দেয়ার জন্য, তাকে বিস্মিত করে দেয়ার জন্য তাদেরকে ঘিরে রাখা দেয়ালে মুহূর্তে মুহূর্তে রঙ পাল্টাচ্ছে। মনে হচ্ছে কখন যেন ভেঙে পড়বে সব। কিন্তু ইকুইলিব্রিয়ামে বিশ্বাসী রানা চৌধুরী তাতে ভয় পান না। এতক্ষণ পর তার দৃষ্টি আটকে গেল একটি বিষয়ে। তা হলো এই যে, তার পাশে বসে কথা বলছে রিতুন নামের ছেলেটি। বেশভুষায় তাকে এতক্ষণ মানুষ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু না, রানা চৌধুরী স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তার মাথার পিছন দিকে পাকানো কিছু তার। কোনোটি স্বচ্ছ। কোনোটি অন্তরক দিয়ে আবৃত। স্বচ্ছ তারের ভিতর দিয়ে নীল সিগন্যাল পার হচ্ছে, তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। একবার এই স্বচ্ছ তারের ভিতর দিয়ে নীল সিগন্যাল যায়, আবার লাল হয়ে যায়। তাকে দেখে রানা চৌধুরী নিশ্চিত হয়ে যান, এটা কোনো মানুষ নয়। স্রেফ একটা রোবট।
কথা শুরু করতে যাচ্ছেন রানা চৌধুরী। রিতুন তাকে থামালেন। বললেন, রানা চৌধুরী আপনাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে এই টাইটানে। নিশ্চয় অনেকটা ধকল গেছে আপনার ওপর দিয়ে। আপনার মতো এই বয়সী মানুষের অবশ্য এতটা ধকল সহ্য হবার নয়।
আমার চুল, দাড়ি সাদা হয়েছে বলে এমন কথা বলছেন? তীর্যক বাক্য ছুড়ছেন রানা চৌধুরী।
সে অবশ্য আপনি ঠিক ধরেছেন। যারা এর আগে এভাবে সফরে এসেছে তাদেরকে টানা এক সপ্তাহ রেস্টে রাখা হয়েছে। তারপর স্বাভাবিক হয়েছেন তারা। বললেন রিতুন।
এমন বক্তব্য তাচ্ছিল্য মনে হলো রানা চৌধুরীর। তিনি হাসলেন। তারপর বললেন- মানুষ বুড়ো হয় তার মনে। মানুষ শক্তি পায় তার ইচ্ছাশক্তিতে। আপনি আমাকে নিশ্চয় ওইসব কাবু হয়ে পড়া মানুষের দলে ফেলবেন না।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা একটু পানীয় পান করি তারপর কথা শুরু করি। বললেন রিতুন।
মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালেন  রানা চৌধুরী।
এই ছাদের যেপাশে দেয়াল সেট করা, সেদিকটা মুহূর্তের মধ্যে থলথলে আঠালো জেলির মতো হয়ে গেল। তার ভিতর দেখা যাচ্ছে, এক প্রাকৃতিক ক্যাফে। অনেক মানুষের ভিড়। আর্টিফিসিয়াল বা কৃত্রিম হলেও তা যেন জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। সেই ক্যাফেতে যোগ দিয়েছেন অনেক মানুষ। কেউ কোমল পানীয় পান করছেন তো, কেউ পিজায় দাঁত বসাচ্ছেন। ওই থলথলে জেলির মতো দেয়ালের ভিতর থেকে হেঁটে বেরিয়ে এলেন একজন সুন্দরী। হাতে তার বেশ বড় একটি ট্রে। তার ওপর দু’টি কাপ। চীনামাটির তৈজসপত্রের চেয়ে চমৎকার কারুকাজ করা কয়েকটি পাত্র। স্বচ্ছ পর্দায় ঢেকে রাখা হয়েছে তা। তিনি টেবিলের পাশে এসে থামলেন। হাত থেকে এগুলো নামিয়ে রেখে অতিশয় ভদ্রোচিতভাবে জানতে চাইলেন- রানা সাহেব আপনার জন্য পানীয়। পান করুন।
রানা চৌধুরীর ভয় হয়। কিসের পানীয়। কি পানীয় এটা। তিনি কি পান করবেন নাকি করবেন না। তাকে কি পোলোনিয়াম মিশ্রিত করে পান করানো হচ্ছে! এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে যখন তিনি, তখন ওই দেয়ালে সৃষ্টি হওয়া পর্দায় দেখা যায় ক্যাফেতে একজন বয়সী যুবককে। তাকে দেখে চেনা চেনা মনে হতে থাকে রানা চৌধুরীর। বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দৃশ্যগুলো। রানা চৌধুরী সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন। দেখলেন, ওই যুবকটি তার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর মিট মিট করে হাসছেন।
রানা চৌধুরীর কৌতূহল বেড়ে যায়। তিনি কিছু বুঝতে পারেন না। এমন সময় যুবকটি তার রিস্ট বন্ধনীটি দেখালেন রানা চৌধুরীকে। তাতে খোদাই করে লেখা রাজেন্দ্রিয়ান।
এ দৃশ্য দেখে আনন্দে, আবেগে, উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে পড়লেন রানা চৌধুরী। এখানে এই টাইটানেও পৌঁছে গেছে তার সাগরেদ। রাজেন্দ্রিয়ান ঝাণ্ডা উড়িয়ে ধরেছে এই টাইটানে। এমন দৃশ্য দেখে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। তিনি নিজেকে সংবরণ করলেন কোনোমতে। তার বুকের পাটা আরো উঁচু হয়ে গেল। তিনি বুঝে গেলেন ক্যাফেতে উপস্থিত ওই যুবক তার সহায়তায় এসেছে। তার কোনো ভয় নেই।
রিতুন তাগাদা দিলেন। বললেন- মিস্টার রানা, আপনার পানীয় ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
ও ও আইচ্ছ্যা। ভুলেই গিয়েছিলাম।
হাঃ হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠেন রিতুন। বলেন, আপনার চোখের সামনে পানীয়। আর আপনি ভুলে গেলেন? কি করে আপনার মতো এমন ভুলোমনা মানুষ হাজার হাজার মানুষকে পাগল বানিয়ে ছাড়ে?
রানা চৌধুরী আবারো হাসলেন- পাগল তো আমি বানাই না কাউকে। নিজেরাই পাগল হয়ে যায়। ভালোবাসার পাগল। এই যে, আপনি এখানে কাজ করছেন, আপনার প্রতি কারো ভালোবাসা আছে? বা আপনি কাউকে ভালোবাসেন?
এ কোথায় হাত দিলেন রানা চৌধুরী!
রিতুনের মাথা ঝিম ধরে যায়। ভালোবাসা! হায় ভালোবাসা! না তিনি এই ভালোবাসা পাননি। তবু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তার বসের নির্দেশ। সেই নির্দেশ মতো কাজ করা। প্রতিদিনই এমন কাজ করতে হয় তাকে। এর বাইরে তার জীবন বলতে আর কিছু নেই। নির্দেশ মতো কাজ করতে না পারলে তাকে ধমক খেতে হয়। অসংখ্য রোবটের সামনে তাকে নিল-ডাউন দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। আর নির্দেশ মতো কাজ করলে, বাহবা। ব্যস ওই পর্যন্তই। অথচ রিতুন দেখেছে মানুষের মধ্যেই কি অদ্ভুত এক ভালোবাসা। এই রানা চৌধুরীর কথাই ধরা যাক। তিনি ফেসবুকে একখানা পেজ খুলেছেন। সেখানে পঙ্গপালের মতো মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তাকে নিয়ে আজ পর্যটন অবকাশে তো কাল বরিশাল, পরশু কোনো সোয়ার্মা হাউজে আনন্দে মেতে উঠছে মানুষ। তাকে দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে দেয়। এটাই মানুষের ভালোবাসা। এমন ভালোবাসা রিতুনদের সমাজে নেই। আজ সেখানেই খোঁচাটা দিলেন রানা চৌধুরী।
তার প্রশ্ন শুনে হা করে তাকিয়ে রইলেন রিতুন।

চার.
রানা চৌধুরীর প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে বসে আছে রিতুন। অনেক কিছু মনে পড়ছে তার। সত্যি তো, কাকে ভালোবাসবে সে! কেন ভালোবাসবে! সে তো কোনো মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়নি। তার জন্ম টাইটানের এক ল্যাবরেটরিতে। সেখানে নানারকম রাসায়নিক পদার্থের উৎকট গন্ধ। তার মাঝেই সে তার মতো আরো অনেককে জন্ম নিতে দেখেছে। দেখেছে মানবিক এক অবয়বের ভিতরে কিভাবে তার, বর্তনী যুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। তাতে রক্ত বলতে যা দেয়া হচ্ছে তা হলো- এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ করবে। নতুন নতুন আধান যোগ করবে। এসব মানবীয় গড়নের ভিতরে মানুষের মতো কোনো হৃৎপিণ্ড নেই। নেই ফুসফুস। নেই কিডনি নামের কোনো অঙ্গ। শুধু আছে দু’টো চোখ, নাক, কান। আছে কণ্ঠ। সে কণ্ঠ উদ্ভট। অস্বাভাবিক শোনায়। রিতুন তার পূর্বসূরির কথা মনে করার চেষ্টা করলো। না, কারো কথা মনে পড়ে না। তার আফসোস হলো, মানুষরা তার পিতামাতা, ভাইবোন, দাদা-দাদি, নানা-নানির বিষয়ে কত মজার গল্প করে। অথচ এই রিতুনদের জীবনে এমন কেউ নেই। এমন কোনো স্মৃতি নেই। তাদের সামনে শুধু কাজ আর কাজ।  
রানা চৌধুরী বিচক্ষণ মানুষ। তিনি খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন রিতুনকে। দীর্ঘ জীবনে তিনি অসংখ্য ছেলেমেয়ের মন পড়েছেন। তাদেরকে মানুষ করতে গিয়ে নিজেকে তাদের মতো তৈরি করেছেন। তাই তাদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন। তিনি বুঝতে পারলেন রিতুনের বুকে এখন ক্ষরণ হচ্ছে।
রানা চৌধুরীকে কাপে করে পরিবেশন করা হয়েছে সেই কোমল পানীয়। তিনি তাতে ঠোঁট ভিজালেন। অমীয় স্বাদের। এক চুমুকেই মনটা চাঙা হয়ে গেল। তবে পার্থিব চা, কফি বা কোমল পানীয়ের মতো নয়। এ এক অন্যরকম স্বাদ। কাউকে বোঝানো যায় না।
পান করতে করতে তিনি রিতুনকে ডাকলেন-  রিতুন!
জি বলুন। ছোট্ট উত্তর দেয় রিতুন।
কি হলো আপনার? মাথা নিচু করে বসে আছেন কেন?
না কিছু হয়নি।
তাহলে মাথা নিচু করে বসে আছেন কেন? বোঝাপড়া করবেন না?
ও হ্যাঁ- দায়িত্ব সম্পর্কে ভুলেই গিয়েছিল রিতুন। অকস্মাৎ মাথা তুললো। রানা চৌধুরী দেখতে পেলেন রিতুনের দু’চোখ সিঁদুরে মেঘের মতো লাল। গণ্ড গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।
আপনি কাঁদছেন?
কই কাঁদছি না তো!
রিতুন মানুষের চোখ ফাঁকি দেয়া যায় না। মানুষ চোখের দেখা দেখে অনেক কথা বলে দিতে পারে। বলুন আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার চোখ অমন লাল কেন?
রানা চৌধুরী এখানে রিতুনের প্রতিপক্ষ। তার সঙ্গে কোনো কোমল কথা বলার নয়। কিন্তু এই বয়সী লোকটার কথাবার্তা, তার কথা বলার ভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে গেছে রিতুন। কেমন যেন শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসতে চায় তার। এমন করে কেউ তো কোনোদিন তার সঙ্গে কথা বলেনি। রিতুন কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে। কত রাত তার জন্মদাতার পরিচয় জানার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফল হয়েছে শূন্য। তার কি কোনো জন্মদাতা নেই। জন্মদাত্রী নেই। জন্মের কোনো ইতিহাস নেই! সে এতদিন জেনেছে তার মতো রোবটের জন্ম ল্যাবরেটরিতে। কিন্তু রিতুন বিশ্বাস করতে চায়নি তা নিজের বেলায়। সে ভেবেছিল তার মা আছে। বাবা আছে। ভাইবোন আছে। তারা কে কোথায় তার কিছুই জানে না সে। বড্ড ইচ্ছা হয় তাদের দেখার জন্য। কিন্তু বুকের ভিতর খাঁ খাঁ করে। মা বলে একটা ডাক দিতে ইচ্ছে হয়। বিশ্ব মা দিবসে সারা সৃষ্টিজগতে সব সন্তান যখন মায়ের পায়ের কাছে তার স্বর্গ খোঁজে, মা’কে সেবা করে, তার মন জয় করার চেষ্টা করে, তখন রিতুন একা একা দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ আবার সেই ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিলেন এই রানা চৌধুরী। তাকে সালাম জানাতে ইচ্ছা করছে এখন। মন থেকে তা চাইলেও সে তা করতে পারবে না। কারণ, প্রটোকলের বাইরে যাওয়ার বিধান নেই তার।
রিতুনের কাছ থেকে কোনো জবাব পেলেন না রানা চৌধুরী। তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষক, কিভাবে রোবটের জন্ম, তাদেরকে দিয়ে কি করানো হয়, কিভাবে তাদের প্রোগ্রামিং করা এর সবই জানেন তিনি। বড্ড মায়া হয় এই রোবটদের জন্য। কিন্তু কিছু করার নেই। বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং বলে গেছেন, স্বস্তিকর জীবন-যাপন করতে হলে মানুষকে অন্য কোনো গ্রহে বা উপগ্রহে আশ্রয় খুঁজেতে হবে। তা না হলে মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। তা হতে পারে মহাকাশ থেকে ছুটে আসা গ্রহাণু, উল্কাপাতে। পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ বিপর্যয়ে। তাই মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষকে মহাশূন্যে কোনো আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে।
স্টিফেন হকিংয়ের কথার ওপর ভিত্তি করেই এইসব মানব কলোনি গড়ে উঠেছে। একে রক্ষা করতে হলে এমন অনেক রোবটের প্রয়োজন। তাদের প্রতি অনুকম্পা দেখালে মানবিক গুণ স্পষ্ট হয়ে উঠবে তাদের মধ্যে। তখন তারা মানুষের মতো বিগড়ে যেতে পারে। যদি অধিকারের দাবিতে বিগড়ে যায় তাহলে শুধু টাইটানের এই কলোনিই নয়, ধ্বংস হবে সব শেষ আশ্রয়স্থল। তবুও রিতুনের সঙ্গে গল্প করতে রানা চৌধুরীর বেশ ভালো লাগছে। তার চোখে অশ্রু। চোখ লাল। এমন যে কাউকে দেখলে তার মধ্যে আলাদা এক পিতৃত্ব জেগে ওঠে। তিনি স্থির থাকতে পারেন না।
তিনি জানতে চান- রিতুন আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে না!
রিতুনের মুখের মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায়। মনে হয় আর একটু হলেই সে বুকফাটা আর্তনাদে ফেটে পড়বে। তবু তার কাছ থেকে কিছু কথা শোনা দরকার।
তাই রানা চৌধুরী আবার প্রশ্ন করলেন- আপনি কি কারো কথা ভাবছেন? আপনার মা, বাবার কথা?
মা-বাবার কথা আসতেই রিতুন অঝোরে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বললো- হ্যাঁ, মায়ের কথা বড় মনে পড়ছে। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন মায়ের কাছ থেকে আমাকে আলাদা করা হয়েছে। অন্য রোবটদের মতো আমার জন্ম নয়। আমার দেহে আমার মায়ের রক্ত বইছে। আর তাই আমি আমার মাকে ভুলতে পারি না। পাঁচ বছরের ছোট্ট রিতুনকে রেখে তাকে পাঠানো হয়েছে মঙ্গলগ্রহে মানব কলোনিতে। সেখানে মানুষের বাচ্চাদের দেখাশোনা করাই তার কাজ। মা আমাকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনুমতি দেয়া হয়নি। মা যাওয়ার আগে আমার কপালে শেষ চুম্বন দিয়েছিলেন। জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন অনেক। বলেছিলেন, আমাদের জীবন এমনই। আমাদেরকে অন্যের কথায় চলতে হয়।
তারপর তার সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি? জানতে চান রানা চৌধুরী।

পাঁচ.
রিতুনের কাঁদতে ইচ্ছা করে। কিন্তু পারে না। তার চোখ থেকে কান্না ঝরে না। এতদিন মা-কে মনে করে করে সে কেঁদেছে একা একা। মানব কলোনিতে মানুষের জীবন ধারণ, তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা, একের প্রতি অন্যের যে শ্রদ্ধাবোধ, তা দেখে খুব আবেগী হয়ে ওঠে রিতুন। ওরও ইচ্ছা করতো মায়ের কোলে মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমাতে। একটু জ্বর হলে মানব সন্তানদের যেভাবে আদর করেন মায়েরা তেমনি আদর পেতে ইচ্ছা করে।
রানা চৌধুরী পার্থিব মানুষ। তিনি বুঝতে পারেন রিতুনের কষ্ট হচ্ছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন তিনি। রিতুনের চোখের দিকে তাকালেন। একরকম আঠালো পদার্থ চক চক করছে। তবে কি রিতুন কাঁদছে!
রিতুন আপনি কাঁদছেন? মায়ের কথা মনে পড়েছে না?
রিতুন অদ্ভুত করে কেঁদে ওঠে। এমন কান্নার শব্দ রানা চৌধুরী কখনো শোনেননি। কেমন যেন গম গম করছে। রিতুনের মুখচোখ ফুলে ফুলে উঠছে। ঠিক এ সময়েই রানা চৌধুরী তাকে বললেন- আপনি কি আপনার মাকে দেখতে চান?
সচকিত হয়ে যায় রিতুন। জানতে চায়- কিভাবে?
সে ব্যবস্থা আমি করে দেবো। আপনি শুধু হ্যাঁ বা না বলুন।
রিতুনের ঠোঁট কেঁপে ওঠে। এত বছর পর তার মা-কে দেখবে! কিভাবে! এও কি সত্যি হয়!
কি হলো কথা বলুন! আবার জানতে চান রানা চৌধুরী।
হ্যাঁ, দেখতে চাই। মা-কে নয়ন ভরে দেখতে চাই।
রানা চৌধুরী মৃদু হাসলেন। পৃথিবীতে তিনি মানুষের মন পড়েছেন। এখন এই টাইটানে একজন রোবটের মন পড়তে পারছেন। তাকে তার মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাতে হবে।
রানা চৌধুরী বললেন- সামনে তাকান রিতুন।
রিতুন সামনে তাকায়। শূন্যের মাঝে একটি স্বচ্ছ ক্যানভাস দেখা যাচ্ছে। ঝির ঝির করছে তা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কখনো লাল মাটির মতো কিছু দেখা যায়। আবার মিলিয়ে যায়। কখনো একটি মুখ ভেসে উঠতে চায়। আবার হারায়।
রিতুন অধৈর্য্য হয়ে যায়। কি সব দেখাচ্ছেন এই লোক! কিচ্ছু বোঝা যায় না। সে অস্থির হয়ে পড়ে। প্রশ্ন করে- কই রানা চৌধুরী আমার মা-কে তো দেখাতে পারছেন না!
এত অল্পতেই অধৈর্য হইও না। আন্তঃমহাজাগতিক  নেটওয়ার্কের সংযোগ চলছে। অপেক্ষা কর। তাহলেই...
তার কথা শেষ না হতেই রিতুন চিৎকার করে উঠল- ওই তো আমার মা। মা, ও মা, তুমি কেমন আছ? আমায় ছাড়া এতদিন কিভাবে রয়েছো!
সেই স্বচ্ছ ক্যানভাসে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এক নারী। তার বয়সের তারতম্য বোঝা যায় না। তার চোখের নিচে কোনো কালো দাগ নেই। চোয়াল ঝুলে পড়েনি। বয়স হয়েছে বোঝার কোনো উপায়ও নেই। তিনি দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ছেলের দিকে। প্রাণখুলে ডাকছেন- আয় খোকা আয়। আমার বুকের মাঝে একবার আয়। আয় তোকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খাই, যেমনটা খেতাম তোর জন্মের পর। আয় একবার আমার গলা তোর সেই কোমল হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তেমনি করে আমার চিবুকে চুমু দে বাপ!
রিতুন পাগলের মতো হয়ে যায়। মা-কে স্পর্শ করতে আকুলি বিকুলি করে। হাঁউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কাঁদে আর বলে- ও মা তুমি কেন আমাকে এই টাইটানে একা ফেলে গেলে! কেন তোমার সঙ্গে আমাকে নিয়ে গেলে না! এখানে আমার বড় কষ্ট। আমার কোনো সঙ্গী নেই। আমি কি নিয়ে বাঁচবো!

ছয়.
রিতুন রিতুন করে আহাজারি করেন মা। মানুষের মতো তোকে আমি পেটে ধরিনি ঠিকই। ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে তোকে। তারপর আমার রক্ত প্রবাহিত করা হয়েছে তোর দেহে। তাতে রয়েছে কপোট্রনের গুঁড়ো। সেটাই আমাদের অনুভূতি পৌঁছে দেয় সারা শরীরে। বাপ রে আর যা-ই হোক, আমার রক্ত রয়েছে তোর দেহে। তোর স্পর্শ পেতে খুব ইচ্ছা করে। তোকেও মনে হয় পেটে ধরা সন্তানের মতো। যখন আমার শরীর থেকে কপোট্রনের গুঁড়ো বের করে নেয়া হলো কি কষ্টটাই না পেয়েছি। রক্তের ভিতর থেকে মিহি গুঁড়ো আলাদা করা সহজ কথা নয়। তাও প্রতিটি গুঁড়োর কণা মাইক্রো ন্যানো আকৃতির। এটা রক্তের সঙ্গে মিশে থাকে। সাধারণ কোনো পদ্ধতিতে তা আলাদা করা যায় না।
তাহলে কিভাবে তা আলাদা করা হয়েছে মা? জানতে চায় রিতুন।
শুনতে চাস! শোন তাহলে। আমি রোবট মানবী। আমার কোনো ব্যথাবেদনা নেই এটাই মনে করে মানুষরা। তোর দৈহিক অবয়ব দেয়ার পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ল্যাবরেটরিতে। সেখানে ভীনা ম্যাডামও ছিলেন। তিনি তখন সবেমাত্র রাজেন্দ্র কলেজে যোগ দিয়েছেন। নতুন চাকরি তার। মায়াবী চোখ। রেশমি এলো চুল। যে রাস্তায় রিকশায় করে যান তো, সেই রাস্তায় তার সেন্টের ঘ্রাণ পাওয়া যেতো। তিনি এলেন ল্যাবরেটরি রুমে।
তারপর?
তারপর আর কি অপারেশন করার আগে মানুষের যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, আমার ক্ষেত্রে তা করা হলো না। কোনো স্যালাইন, এন্টিবায়োটিক দেয়া হলো না। সোজা অপারেশনের টেবিলে নিয়ে যাওয়া হলো। অপারেশনের টেবিল মানে টিনের এক রকম ট্রের মতো। তারপর শুইয়ে দেয়া হলো আমাকে। তাদের সহকারী হিসেবে এসেছেন এনায়েত, বুলবুল। তারা পাশের টেবিলে ধারালো অস্ত্র শানিয়ে নিচ্ছে।
ওরা তোমার শরীর কেটেছিল মা?
হ্যাঁ। কেটেছিলই তো। ওই যে ভীনা ম্যাডাম। সারা বছর ক্লাসে ছাত্রদের ব্যাঙ কাটা, তেলাপোকা, কেঁচো কাটা শিখাতেন। তার এসব কাটাকাটির হাত বড় সিদ্ধ। তিনিই মায়াহীন চোখে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। এনায়েত তার হাতে ধারালো একটি ছুরি এগিয়ে দিলো।
রিতুনের হাত-পা কাঁপছে। তার মায়ের ওপর এত অত্যাচার করা হয়েছে? কিছুতেই সে সহ্য করতে পারছে না। তার মাথায়, করোটিতে অন্যরকম এক প্রতিহিংসা কাজ করতে থাকে। সে জানতে চায়- তারপর কি হলো মা?
মা বলতে থাকেন- সে কথাই তো বলছি খোকা। আমার দু’হাত, দু’পা বেঁধে ফেলা হলো যাতে নড়াচড়া করতে না পারি। আমার চোখ দু’টোও বাঁধার প্রয়োজন মনে করলো না কেউ। ভীনা ম্যাডাম এগিয়ে এসে আমার চোখের দিকে তাকালেন। বললেন- আপনি ব্যথা পাবেন না। আপনার দেহ থেকে কিছুটা কপোট্রনের গুঁড়ো নেবো।
আমি চিৎকার করে উঠলাম। বললাম- কপোট্রনের গুঁড়ো আমার শরীর থেকে কেন নেয়া হবে?
তিনি বললেন- ল্যাবরেটরিতে যা ছিল তার সবটা শেষ হয়ে গেছে। যে পরিমাণ রোবট বানাতে হচ্ছে কতদিন টেকে বলুন। তা ছাড়া আপনার কপোট্রন গুঁড়া তো আপনার ছেলের দেহেই যোগ করা হবে!
আমার ছেলে? বিস্ফোরিত চোখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি।
ভীনা ম্যাডাম হেসেছিলেন। বলেছিলেন, আপনার দেহ যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে তা ক্লোন করে তৈরি করা হয়েছে একটি ছেলেকে। সে এখন আপনার ছেলে। আপনার দেহ থেকে কপোট্রনের গুঁড়ো যোগ করলেই সে উঠে বসবে।
আমি বললাম- কই একবারও তো আমাকে বললেন না আমাকে ক্লোন করা হচ্ছে!
তিনি বললেন- প্রয়োজন মনে হয়নি তাই। রোবটের কাছে সব কিছুতে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হয় না।
শুনে আমার মনটা বিষিয়ে গেল। তবু শিহরিত, পুলকিত হলাম এই ভেবে যে, আমার দেহ থেকে একটি নতুন প্রজন্ম আসবে। তার দেহে থাকবে আমার দেহের রক্ত। মানুষ না হই, মানুষের মতো রেখে যেতে পারবো প্রজন্ম।
ওমা ওরা তারপর কি করলো? জানতে চায় রিতুন।
তারপর? তারপর আমার বুকের ঠিক মাঝ বরাবর ধারালো চাকু চালিয়ে দিলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুবে ভেবেছিলাম। কিন্তু না, কষের মতো এক রকম নীল তরল বেরিয়ে এসে গড়িয়ে পড়ল টেবিলে। ব্যথা সহ্য করতে পারছিলাম না। আর্তচিৎকার করলাম। সেই চিৎকারের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, প্রায় আধা মাইল দূর থেকে শোনা গিয়েছে। চিৎকার দিতেই আমি চেতনা হারিয়ে ফেলি।
কেন মা, তুমি না রোবট! চেতনা হারালে কেন তুমি?
ওই যে কপোট্রনের গুঁড়ো। ওটাই অনুভূতি সৃষ্টি করে শরীরে। সেজন্যই প্রচণ্ড ব্যথা ছিল রে বাজান। নারীরা সন্তান জন্ম দেয়ার সময় যে বেদনা সহ্য করেন তার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না সেই বেদনা। তারপর যখন আমার চেতনা ফিরলো, দেখি আমাকে রাখা হয়েছে নিবিড় পর্যবেক্ষণে, আইসিইউতে। বুকের ওপর বিশাল আট দশটি সেলাই। এ যন্ত্রণা তুই বুঝবি না বাজান।
রিতুন এতক্ষণ শুনছিল। তার মাথা এখন প্রচণ্ড গরম হয়ে গেছে। ইচ্ছা হচ্ছে কিসের জাকারবার্গের নির্দেশ পালন করে, উল্টো পুরো মানব কলোনি শেষ করে দেয় সে। তার চোখ দিয়ে আগুন বেরুতে থাকে। রিতুনের গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে এক রকম তরল পদার্থ। সে মাথা তোলে। দেখতে পায় সেই স্বচ্ছ পর্দায় তার মা’কে আর দেখা যাচ্ছে না। অমনি তারস্বরে মা বলে চিৎকার দিয়ে পড়ে যায় রিতুন। সেই চিৎকারের শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে টাইটানের মানব কলোনি। কি ঘটেছে! কিসের আওয়াজ এটা! এমন শব্দ তো কোনোদিন শোনেনি তারা।
রিতুনের মাথাটা পড়ে আছে রানা চৌধুরীর পায়ের কাছে। পা দু’টো দূরে।
রানা চৌধুরী তাকে ধরে উঠিয়ে বসালেন।

সাত.
রিতুনের দেহ কাঁপছে থর থর করে। আর চিৎকার করছে মা মা বলে। যে স্বচ্ছ ঝিল্লিতে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল তা নিমেষেই মিলিয়ে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে রিতুন মা মা বলে আরো জোরে কাঁদছে। রানা চৌধুরী তাকে উঠিয়ে বসালেন একটি চেয়ারে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন হিমেল হাওয়া এলো। তাতে মায়ের ঘ্রাণ। গা স্পর্শ করতেই রিতুন স্বস্তি পেল। রানা চৌধুরী তাকে বোঝালেন- রিতুন আপনি অনেক বছর পরে মাকে দেখেছেন। আপনার মনটা ভালো নেই। আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করবো বলুন!
আপনি সত্যি কোনো সাধারণ মানুষ নন। আপনি জাদুকর। বলতে থাকে রিতুন।
তাই নাকি! স্বভাবসুলভভাবে আবার হাসেন রানা চৌধুরী।
হ্যাঁ, আমি এতটা বছর এখানে দায়িত্ব পালন করছি। কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার অনুরোধ করেছি মা’কে এনে দিতে। না হয় অন্তত তার সঙ্গে একটু কথা বলিয়ে দিতে। কিন্তু তারা কেউ আমার কথা শোনেনি। শোনেনি এজন্য যে, আমি রোবট। আমার কোনো বেদনা থাকতে পারে না। কিন্তু বলুন তো ওই ভীনা চৌধুরী ম্যাডাম কাজটা ঠিক করেছেন! উনি যদি ওই কপোট্রন গুঁড়া আমার রক্তে মিশিয়ে না দিতেন তাহলে আমার এমন কোনো অনুভূতি থাকতো! হয়তো ভুলেই যেতাম আমার কোনো মা ছিল। মায়ের রক্ত আমার দেহে!
রানা চৌধুরী বুঝতে পারেন। তার মাঝে মানবিকতা আছে। তিনি বুঝতে পারেন রিতুনের কষ্ট। এক সময় তাকে জড়িয়ে ধরেন। হাত ধরে নিয়ে যান শাওয়ারের কাছে। সেখানে নিয়ে মুখে চোখে পানি দিয়ে শান্ত হয়ে বসান। রিতুন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রানা চৌধুরীর দিকে। আসলেই এই লোকটা একজন সাধারণ মানুষ নন।
রিতুন উঠে দাঁড়ায়। রানা চৌধুরীর একেবারে কাছে এসে তার দু’পা স্পর্শ করে। তারপর সে-ই রানা চৌধুরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে- এতদিন মানুষ প্রজাতিটির ওপর ভীষণ রাগ ছিল আমার। মাঝে-মধ্যেই মনে হতো সব প্রোগ্রামিং ওলটপালট করে দিয়ে ধ্বংস করে দিই সব কিছু। কারণ, তাদের কারণে আমাদের জন্ম। আর তারপর এমন বিরামহীন যন্ত্রণা ভোগ করা। তারা কেউ আমাদের খবর নিতে আসে না। কোনো সহানুভূতিও প্রকাশ করে না। একটি রোবট বিকল হয়ে গেলে তাকে লাথি দিয়ে ফেলে দেয় আঁস্তাকুড়ে। তারপর তার জীবনের ইতিহাসের ইতি ঘটে।
আমার প্রতিও  তোমার সেই একই অনুযোগ, রিতুন? জানতে চান রানা চৌধুরী।
না, আপনার প্রতি আমার কোনো অনুযোগ নেই। আপনি আজ আমাকে যা উপহার দিলেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আপনি আমার মাকে দেখিয়েছেন। তার সঙ্গে কথা বলিয়েছেন। আপনি অন্য মানুষদের চেয়ে আলাদা। ভিন্ন। আপনার মতো মানুষ হলে আমাদের মতো রোবটরা কোনোদিন বিদ্রোহ করতো না। কেউ বিদ্রোহ করার কথাও ভাবতো না। আপনাকে আমার স্যার ডাকতে ইচ্ছা করছে। আমি ডাকতে পারি?
রানা চৌধুরী বলেন- স্যার তো বিশেষ কোনো কিছু নয়। স্যার মানে হলো জনাব। এ নামে ডেকে আপনার লাভ কি?
রিতুন মুচকি হাসে। বলে- আপনি আমাকে রোবট পেয়ে বোকা ভেবেছেন। আমি জানি স্যার মানে জনাব। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে, আপনার মতো ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ শব্দটার অর্থ হলো সম্মানিত। সম্মানিত ব্যক্তিদের স্যার বলা হয়।
তাই নাকি?
জি, আমি কি আপনাকে ওই নামে ডাকতে পারি?
পার। অবশ্যই পারো। তাতে যদি তোমার মনে স্বস্তি আছে, শান্তনা আসে।

আট.
রানা চৌধুরী দেখতে পাচ্ছেন রিতুনের মাথার পিছন দিককার সেই তারগুলো বেয়ে লাল একটি সিগন্যাল এগিয়ে যাচ্ছে  ব্রেনের দিকে। মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ায় রিতুন। তার শরীরে যেন নতুন করে শক্তি চলে এসেছে। এতক্ষণ রানা চৌধুরী যে রিতুনকে চিনেছেন, সেই রিতুন এখন আর নেই। তার চোখমুখের চেহারা অন্য রকম। মুখের মাংসপেশী কেমন টানা দেয়া রশির মতো হয়ে গেছে। হাতের মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে। রানা চৌধুরীকে সে এতক্ষণ স্যার সম্বোধন করলেও এখন পাল্টে গেছে। কয়েক মিনিট আগে কি ঘটে গেছে কিছুই তার মনে নেই। সে রানা চৌধুরীর দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকাল। বলল- আপনিই যত নষ্টের মূল!
আমি তো কিছু করিনি রিতুন! শান্ত গলায় বললেন রানা চৌধুরী।
আপনার জন্যই...
আমার জন্য কি?
আপনিই তো আমার চাকরিটা নট করে দিচ্ছিলেন!
কিভাবে?
আমার কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন আপনি।
কেমনে?
আমার সময় নষ্ট করে।
কিভাবে আমি আপনার সময় নষ্ট করলাম?
আপনি আসলে বাঁচার জন্য আমার মাকে দেখানোর কথা বলে সময়ক্ষেপণ করছেন। সময়ক্ষেপণ করছেন এ জন্য যে, আপনি এর মধ্যে কোনো কুমতলব আঁটবেন। আপনার রাজেন্দ্রিয়ানদের জানিয়ে দেবেন সব।
রানা চৌধুরী বললেন- আমাকে জানাতে হবে না। এমনিতেই রাজেন্দ্রিয়ান পরিবার জেনে গেছে সব। সিএনএস টেলিভিশনে সম্প্রচার হচ্ছে সব দৃশ্য। তা ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারগ্যালাক্টিক জগতে। মুহূর্তের মধ্যে সব খবর পৌঁছে যাচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। তাছাড়া...
কি তাছাড়া?
আমাকে বাঁচানোর জন্য আমি কোনো বুদ্ধি করিনি রিতুন। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর। আমি তোমার ক্ষতি চাইলে তোমার মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতাম না। আমি চাইলে তোমার অনেক বড় ক্ষতি করে দিতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। আমি হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর মন পড়েছি। আমি তোমার মন পড়েছি। তোমার মনের মধ্যে মাকে দেখার জন্য যে ক্যানসার সৃষ্টি হয়েছিল তা আমাকে ব্যথিত করেছে রিতুন। তাই আমি তোমার মাকে দেখানোর ব্যবস্থা করেছি।
রিতুন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে স্বচ্ছ দেয়াল। সামনে বিস্তৃত মহাবিশ্ব। অসীম শূন্যতা। তার ভিতর নীল আলো। নানা নক্ষত্র, উপগ্রহের আলো। সব মিলেমিশে কেমন যেন এক মায়াময় জগত সৃষ্টি হয়েছে। দূরে উড়ে যাচ্ছে একটি উল্কা। পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মানুষবাহী নভোতরী। হয়তো অন্য কোনো গ্রহে বসতি গড়তে চলেছে। মহাশূন্য থেকে এমন দৃশ্য দেখতে বড্ড ভালো লাগছে রিতুনের। বহুদিন সে এই টাইটানে। কিন্তু আজকের মতো করে দেখা হয়নি কোনোদিন। বাইরে তাকিয়ে আছে উদাস চোখে। দূরে আবার দেখতে পাচ্ছে আবছা নীলাভ এক নারীমূর্তি। এইতো তার সেই মায়ের মতোই। তবে কি সে তার মা! রিতুন ডাকতে যায়। কিন্তু পারে না। তাকে কমান্ড দেয়া হয়নি। ছল ছল চোখে তাকিয়ে থাকে।
পাশে দাঁড়িয়ে রানা চৌধুরী দেখছেন। তিনি রোবট নন। কিন্তু এই রোবটের কষ্ট দেখে তারও চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি চোখ মুখে রিতুনকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন- রিতুন তোমার একটু রেস্ট প্রয়োজন। একটু ঘুমালে শরীরটা ভালো লাগবে। আসো তোমাকে আমি শুইয়ে দিই।
রিতুন শরীর ছেড়ে দেয়। রানা চৌধুরীর বয়স হয়েছে। তাই বলে রিতুনকে কোলে করে দু’কদম হাঁটতে পারবেন না এমনটা নয়। তিনি রিতুনকে কোলে তুলে নিলেন। এই প্রথম বুঝতে পারলেন তার শরীর ঠাণ্ডা। তিনি পাশেই একটি সোফাসেটের ওপর শুইয়ে দিলেন রিতুনকে। দিয়ে বললেন- তুমি চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমাও। একটানা কাজ করলে শরীর এমন অবসন্ন হয়ে আসে। নানা জটিলতা দেখা দেয়।
রিতুন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। রানা চৌধুরী তার দিকে মায়াভরা চোখে তাকালেন। হায় রে রোবট! কি যন্ত্রণার জীবন। কত কষ্ট তার বুকে। মাকে দেখার অসীম আগ্রহ থাকলেও পারে না। পারতো মানুষ মানব সন্তানের সঙ্গে এমনটা করতে!
টেলিভিশনে ব্রেকিং রিপোর্ট যাচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, রানা চৌধুরীকে টাইটানে আটকানো হয়েছে। সেখানে তাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল রিতুনকে। কিন্তু রিতুন ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন যা ইচ্ছা তাই করে বসতে পারেন রানা চৌধুরী। তিনি পুরো কন্ট্রোল প্যানেলের ফর্মুলা পাল্টে ফেলতে পারেন। বৈদ্যুতিক বর্তনী পাল্টে দিলেই এলোমেলো হয়ে যাবে সব। তাকে থামাতে হবে। যতটা দ্রুততম সময় তা করা যায় ততই মঙ্গল।

নয়.
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রিতুন। তার রক্তে কপোট্রন গুঁড়ো থাকায় অনুভূতিগুলো কিছুটা মানুষের মতো। শরীরটা ক্লান্ত লাগছে বেশ। শরীর ক্লান্ত হলে ভালো ঘুম হয়। রিতুন তাই ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন। এত গভীর ঘুম হলে অনেক স্বপ্ন দেখা যায়। অনেক ঘটনা হৃদয়পটে ভেসে ওঠে যার কোনো ভিত্তি নেই। আবার সবটাই যে তেমন হয় তা নয়। কিছু ঘটনা বাস্তবেও ঘটে। ঘুমের ঘোরে রিতুন দেখতে পাচ্ছে রাজেন্দ্র কলেজে হুলস্থুল কাণ্ড। শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, সাবেক, বর্তমান সবাই মিলে বৈঠকে বসেছেন কলেজের সামনের বিশাল ফাঁকা মাঠে। তাদের কাছে পৌঁছে গেছে রানা চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর। হাজার হাজার মানুষ কলেজ মাঠে। মাইক লাগানো হয়েছে পুরো ফরিদপুর শহরে। মিনিটে মিনিটে আপডেট প্রচার করা হচ্ছে। অস্থির হয়ে পড়েছে জেলা প্রশাসন। এসপি অফিসও ব্যতিব্যস্ত। যোগাযোগ করা হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে। সেখান থেকে সিআইএ, এফবিআই, এমআই৬, নাসা- সর্বত্র পৌঁছে গেছে খবর। আন্তঃগ্যালাঙিট নেটওয়ার্কে যোগাযোগ চলছে। সমঝোতার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না কিছুই। জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হয়েছে অম্বিকা ময়দানে, নতুন বাসস্ট্যান্ডে, পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে, জজকোর্ট এলাকায়। পুরো ফরিদপুর যেন আতঙ্কে কাঁপছে। রানা স্যার, শুধু রাজেন্দ্র কলেজের স্যারই নন। তিনি ফরিদপুরের অনেক প্রকৌশলী, ডাক্তার তৈরির কারিগর। এমন কোনো কাজ নেই যার সঙ্গে তিনি যুক্ত নন। তিনি শিক্ষক থেকে হয়ে উঠেছিলেন অমায়িক এক মানুষ। তার সঙ্গে সবার আত্মার সম্পর্ক। তাই পিতামাতারা পর্যন্ত মুখে হাত দিয়ে বসে আছেন টেলিভিশনের সামনে। কি ঘটবে রানা চৌধুরীর! তিনি কি টাইটান থেকে সুস্থদেহে ফিরে আসতে পারবেন! রোবটরা খুব বজ্জাত হয়। তারা কোনো মানবতা বোঝে না। তারা মানুষ বোঝে না। তারা বোঝে কমান্ড। প্রোগ্রামিং করে রাখা কমান্ড। সেই কমান্ডের হেরফের করে না তারা।
রিতুন এখন ঘুমিয়ে আছে। অনেকেই বলাবলি করছেন, রানা চৌধুরী পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। তিনি রিতুনের একটি বর্তনীর তার বিচ্ছিন্ন করলে সব শেষ। তিনি মুক্ত হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু একজন বলে উঠলেন- রোবটরা থাকে দলবদ্ধ। তাদের একজনকে পরাজিত করা যায়। কিন্তু দলবেঁধে যখন আক্রমণ করে তখন তাদের সঙ্গে পারা যায় না। একজন রিতুনকে হয়তো রানা চৌধুরী মেরে ফেলতে পারবেন। কিন্তু হাজারো রিতুন যদি তাকে আক্রমণ করে বসে! এই ভয়ে হয়তো রানা চৌধুরী কিছু করছেন না। তিনি নীরবে দাঁড়িয়ে দেখছেন।
তিনি চাইলে রিতুনকে মেরে ফেলতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করছেন না। এই মুহূর্তে রিতুন ঘুমানো মানে অসাড় এক জড় পদার্থ। চাইলে অনেক কিছুই করে ফেলতে পারেন রানা চৌধুরী। তার মাথার পিছনে যে বৈদ্যুতিক তার, যার ভিতর দিয়ে বৈদ্যুতিক সিগন্যাল আসা-যাওয়া করছে, তা ছিঁড়ে ফেলতে পারেন। যদি তা করেন তাহলে রিতুনের মাথায় কোনো কাজ করবে না। অথবা একটি বর্তনী যদি পাল্টে দেন তাহলে রিতুন পাগল হয়ে যাবে। অথবা বিস্ফোরিত হবে। রিতুনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন রানা চৌধুরী।
তাকে হত্যা নয়। তার প্রতি ভীষণ মায়া হলো তার। কলেজে যেমন গরিব ছেলেদের প্রতি মায়ার চোখে তাকাতেন, তেমন কোমল চোখে তাকালেন তিনি। অন্য সব রোবটের মতো নয় রিতুন। তার মধ্যে কপোট্রন গুঁড়ো থাকার জন্য অনুভূতি আছে। মায়ের জন্য সে কি আহাজারি তার। তা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন রানা চৌধুরী। সত্যি মানব সন্তানের মতো কি কষ্ট তার বুকে। মানুষের স্বাধীনতা থাকে। ইচ্ছে হলে কাজ করে। না হলে বিশ্রাম নেয়। কিন্তু রিতুনদের সে উপায় নেই। ওর মার জন্য যে আকুতি, মাকে দেখার যে প্রবল আকাঙ্ক্ষা, তা দেখে ভীষণ রকম এক মানবীয়তা ফুটে উঠলো রানা চৌধুরীর মনে।
অনেক সময় কেটে গেছে। রিতুন ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ তার মাথার পিছন দিককার একটি স্বচ্ছ তার বেয়ে সবুজ একটি সিগন্যাল পৌঁছে গেল মাথায়। অমনি ধরমড়িয়ে উঠে বসল রিতুন। তার চোখেমুখে হতাশা। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। যেন অচেনা এক জগতে সে।
রানা চৌধুরী তাকে জিজ্ঞেস করলেন- রিতুন কেমন ঘুম হলো তোমার?
রিতুন কেমন যেন বিস্ময়ভরা চোখে তাকালো। তাকে কমান্ড দেয়া হয়েছে এই রানা চৌধুরীকে পাহারা দেয়ার। কিন্তু তা না করে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর রানা চৌধুরী তাকেই উল্টো পাহারা দিচ্ছেন। এ দৃশ্য আন্তঃগ্যালাক্টিক নেটওয়ার্কে বসে দেখছেন নিয়ন্ত্রকরা। তাদের পাশে বসে আছেন মার্ক জাকারবার্গ। আর সঙ্গে সঙ্গে সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে রিতুনকে। সেই সংকেত পেয়ে রিতুন লাফিয়ে উঠে বসেছে।   
দশ.
রিতুন তুমি কি তোমার দায়িত্বের কথা ভুলে গেছ? ধমকে উঠলেন রোবট কমান্ডার নিকিশা। তাকে দেখতে পাচ্ছেন না রানা চৌধুরী। তবে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রিতুন। অদৃশ্য এক রূপ ধারণ করেছেন নিকিশা। তার সঙ্গেই সরাসরি যোগাযোগ করেছেন মার্ক জাকারবার্গ।
নিমেষেই যেন বুক শুকিয়ে গেল রিতুনের। তার চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাকে তো রানা চৌধুরীকে পৃথিবী থেকে তুলে এনে দাঁড় করানোর কথা ছিল জাকারবার্গের সামনে। কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে রানা চৌধুরীর প্রতি।
রিতুন, কি হয়েছে তোমার? জানতে চাইলেন নিকিশা।
একটু মাথা ঘুরছিল।
বুঝতে পেরেছি তোমার খুব বেশি মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাই না?
রিতুন জানে সে যা ভাবে তার সবটাই জানতে পারেন নিকিশা। তাই সহজে সত্য স্বীকার করে নেয়। বলে- জি মহামান্য নিকিশা। আমার খুব মায়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। বহু বছর মাকে দেখি না।ওই রানা চৌধুরী তোমার মাকে দেখিয়েছে। রাইট?
বাস্তবে নয় মহামান্য। তিনি আমার মাকে দেখিয়েছেন ভারচুয়াল একটি স্ক্রিনে। আমি মাকে ছুঁতে পারিনি। তাকে ধরতে পারিনি। মা আমার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন। আমাকে স্পর্শ করতে পারেননি।
নিকিশা অট্টহাসি হাসেন।
বলেন- তুমি কে তুমি জাননা।
কেন আমি তো একটি রোবট। এ ছাড়া আবার কি?
হ্যাঁ, তুমি রোবট। তবে অন্য রকম রোবট। তোমার মধ্যে মানবীয় গুণাবলি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এ জন্যই তুমি মায়ের জন্য মন খারাপ কর। অন্যরা করে না।
কেন এমনটা করেছেন মহামান্য নিকিশা! সবিনয়ে জানতে চায় রিতুন।
এ প্রশ্নের উত্তর এখনই শুনতে চাও?
জি মহামান্য! আপনার মুখ থেকে আমি এখনই শুনতে চাই।
তাহলে শোন- তোমার জন্য একটি জুড়ি তৈরি করেই  তোমাকে সৃষ্টি করেছি আমরা।
জুড়ি মানে?
আরে মানুষ যেমন জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেন সৃষ্টিকর্তা, তেমনি তোমার জন্য জোড়া সৃষ্টি করেছি আমি।
রিতুন জানতে চায়- তার মানে কি? এই মহাশূন্যে গড়ে উঠেছে মানব কলোনি। এখানে রোবটের কাজ মানুষের দাসত্ব করা। এখানে আবার জোড়া কিসের!
নিকিশা যান্ত্রিকভাবে ঘাড় ঘোরায়। তার শরীর জ্বল জ্বল করছে। দেখে মনে হচ্ছে নীলাভ কোনো স্বচ্ছ আঠালো পদার্থ দিয়ে সে তৈরি। তার শরীরের ভিতর দিয়ে স্নায়ুুর মতো যেসব সূক্ষ্ম তার চলে গেছে তাতে নানা রকম সিগন্যাল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তা। রিতুন ভাবে কোনোমতে স্পর্শ করলেই গলে পড়বে নিকিশার গা। তবে তার চাহনিতে কঠোরতা আছে। আবার আছে মায়াও।
দোলায়মান এই সুউচ্চ ভবনে তাকে দেখে প্রথমে চমকে গিয়েছিল রিতুন। কারণ, নিকিশা সহসা তার বা তার মতো অন্যের সামনে আসে না। তাকে দেখে রিতুনের বুক শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই যে বললেন, রিতুনের জন্য জোড়া সৃষ্টি করেছেন, তা শুনে নতুন এক কৌতূহল সৃষ্টি হলো রিতুনের মধ্যে।
সে আবার সবিনয়ে জানতে চাইলো- মহামান্য, বেয়াদবি নেবেন না। আমি আসলে আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
নিকিশা স্বচ্ছ দেয়ালের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে আছেন দূরে, অনেক দূরে, অনেক আরো অনেক দূরে। দূরে ম্লান হয়ে জ্বলছে একটি তারার মতো কিছু। সেদিকে আঙ্গুল ইশারা করলেন। রিতুনকে বললেন- ওইটা হলো নিতানু নামের মানব কলোনি। ওইখানে একটা রোবট যুবতী আছে। তার নাম জয়িতা। ওর জন্মের সময় তোমার মা ওকে দেখেছিলেন। তিনি বড় পছন্দ করেছিলেন জয়িতাকে। তার চাওয়া ছিল জয়িতাকে তার ছেলের বউ হিসেবে ঘরে তুলবেন। তাই আমাদের কাছে অনুরোধ করেছিলেন জয়িতার মধ্যেও যেন মানবিক গুণ দেয়া হয়। তোমার মা মঙ্গলগ্রহে মানব কলোনিতে যেতে রাজি ছিলেন না। পরে শর্ত দিলেন। বললেন- জয়িতাকে যদি তার ছেলে রিতুনের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয় তাহলেই তিনি মঙ্গলে যেতে রাজি আছেন। তার শর্ত মেনে নেয়া হয়েছে। আমরাও তাকে শর্ত দিয়েছি। বলেছি, যতদিন তোমার ছেলে রিতুন বড় একটি মিশন সফল হতে পারবে না ততদিন জয়িতাকে থাকতে হবে নিতানু নামের মানব কলোনিতে। ওখানেই যদি সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যায় তাহলে ওখানেই তাকে বিয়ে দেয়া হবে। তোমার ছেলে মিশন সফল করতে পারলে তখন জয়িতাকে নিয়ে আসা হবে। তোমার ছেলে তাকে গ্রহণ করলে তাদের চার হাত এক করে দেয়া হবে।

এগার.
জয়িতা প্রাপ্ত বয়স্কা। তার মধ্যেও মানবীয়, জৈবিক আবেগ কাজ করে। এক পর্যায়ে নিতানু মানব কলোনিতে মিহিকো নামে একটি ছেলেকে ভালো লেগে যায় তার। দেখতে শুনতে খুবই ভালো। তার সব আছে। রোবট হলেও স্তর উত্তরণের পরীক্ষায় বরাবরই সে প্রথম হয়। এ জন্য তার অহংবোধ চলে আসে। তখনো জয়িতার সঙ্গে মিহিকোর গায়ের স্পর্শ লাগেনি। একদিন মিহিকোকে কলোনির একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সিগারেট পান করতে দেখে জয়িতা। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে। না, এমন ছেলের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক হতে পারে না। নিকিশা জোর করছিলেন তাদের বিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু জয়িতা কিছুতেই রাজি নয়। এক পর্যায়ে জোর করে তাদের বিয়ের আয়োজন করা হলো।
জয়িতা তার শরীরের প্রোগ্রামিং স্ক্যান করে নেয়। দেখতে পায়, তাতে আত্মহত্যা করার কোনো কমান্ড দেয়া হয়নি। এটা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। তবু বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হবে। তার আত্মহত্যার কোনো অধিকার নেই। এটা করার জন্য কোনো বাটনও দেয়া হয়নি। এখন কি করবে জয়িতা! একা একা কাঁদতে কাঁদতে তার চোখমুখ ফুলে গেল।
আন্তঃগ্যালাক্টিক নেটওয়ার্ক থাকায় পৃথিবীতে বসে এ ঘটনা দেখেছিলেন রানা চৌধুরী। তখন তিনি তৈরি করে ফেললেন এক রোবট। তাকে ভাসিয়ে দেয়া হলো ইথারে। অদৃশ্য মানবের মতো তার অবয়ব। মানুষ বা রোবট কোনো সম্প্রদায়ই তাকে দেখতে পারে না। শুধু দেখতে পারেন রানা চৌধুরী। টাইটানে স্ফটিকের মতো দেয়ালে যে ছেলেটি তাকে রিস্ট বন্ধনীতে ‘রাজেন্দ্রিয়ান’ লেখা দেখিয়েছিল, সেই ছিল সেই অদৃশ্য রোবট। তার কথা এতদিন ভুলেই ছিলেন রানা চৌধুরী। তাকে প্রোগ্রামিং করা হয়েছিল জয়িতাকে উদ্ধার করতে। তিনি রিতুনের কষ্ট জানতেন। তিনি মহাজাগতিক নেটওয়ার্ক, যেটা মানুষ নিয়ন্ত্রণ করে তার সবটাই জানেন। জানেন, রোবটরা এখন থেকে ১০০ বছর পরে কি করবে। তাই তিনি রিতুনের ভবিষ্যৎ জানতেন। এ জন্য ওই অদৃশ্য রোবটটাকে সৃষ্টি করেছিলেন।
মানুষের যেভাবে বিয়ের আসরে বসে, তেমনটি নয়। জয়িতার সঙ্গে মিশিকোর বিয়ের আয়োজন করা হলো এক ফাঁকা মাঠে। সেখানে মানুষ নেই। সব রোবট। অদ্ভুত সুরে গান গাইছে সবাই। নাচও যান্ত্রিক। সব রোবট একই তালে নাচছে। একই সুরে গাইছে। বাতাসে উড়ছে ফানুস। উড়ছে কিন্তু সরছে না।
জয়িতাকে মিশিকোর সামনে এনে হাজির করানো হলো। সেই পোশাক পরা। আঁটোসাটো শরীর। তার দিকে তাকিয়ে মিশিকো তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো।
জয়িতা কাঁপছে। থর থর করে কাঁপছে। এই রোবটটা তো রোবট না, ওর শরীর ভরা বিষ। ও সিগারেট পান করে। ওকে সে কিভাবে বিয়ে করবে। কিন্তু পালানোর কোনো পথ নেই। তাকে মেনে নিতেই হবে। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে জয়িতা।
হঠাৎ কি এক ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঝড় উঠলো। চারদিকে বালুরাশিতে অন্ধকার হয়ে গেল। চোখেমুখে সর্বত্র বালুতে সয়লাব। আকাশে মেঘ নেই। হঠাৎ এমন ঝড় কিসের আলামত! আন্তঃগ্যালাক্টিক নেটওয়ার্কে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে ফোন আসছে। কোনো উত্তর দিতে পারছে না কেউ। কি এমন ঘটলো! কোথাও তো কোনো বিস্ফোরণও হয়নি। আক্রমণ চালায়নি কোনো মহাকাশ দস্যু। তাহলে!
ঝড় যখন থেমে গেল। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। একহাঁটু বালুতে আটকে আছে পা। মিশিকোকে দেখতে লাগছে ভুতের মতো। কিন্তু যাকে ঘিরে এই আয়োজন, সেই জয়িতা কই! তাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। রা
রা পড়ে গেল সর্বত্র। কোত্থাও নেই সে। মহা এককেলেঙ্কারি ঘটে গেছে। কে তাকে উধাও করে নিয়ে গেল, কে!

রানা চৌধুরীর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রিতুন। হঠাৎ দুলে উঠলো সেই স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ভবন। তার দেয়াল ভেদ করে উড়ে এলো যেন কি মহাকাশ থেকে। মেঝেতে আছড়ে পড়লো। রিতুন ভয়ে থিতু হয়ে গিয়েছিল। জমে গিয়েছিল। চোখ বন্ধ ছিল তার। সে বুঝে গিয়েছিল এই ভবনটি বুঝি ভেঙে আজ মহাপ্রলয় হবে।
রানা চৌধুরী তাকে ডাকলেন- রিতুন, চোখ খোল!
রিতুনের ভয় করছিল। তবু চোখ খুলল সে। অমনি সামনে দেখতে পেল হায় একি! অপরূপা এক সুন্দরী দাঁড়িয়ে। তার শরীর থেকে যেন ঝরে ঝরে পড়ছে রূপ। তার চোখের চাহনি মানুষের চোখের চেয়েও বেশি আবেশী। তার নাক, তার কপাল, তার চোখ, তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হা করে রইল রিতুন।
রানা চৌধুরী বললেন- রিতুন আবেশী চুম্বক পড়েছ?
এমন প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেল রিতুন। রানা চৌধুরী তাকে আবার বললেন- পড়েছ?
কি বলছিলেন আমি বুঝতে পারিনি! বললো রিতুন।
আবেশী চুম্বক পড়েছ?
না, আমাদেরকে এসব পড়ানো হয় না। আমাদেরকে জন্ম দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তারপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে থাকি আমরা।
তাহলে শোন- জয়িতা হলো চুম্বক। তুমি চৌম্বক পদার্থ। চৌম্বক পদার্থ মানে যেসব পদার্থকে চুম্বক আকর্ষণ করে। তুমি তেমনি এক চৌম্বক পদার্থ। তুমি চুম্বকের আবেশে আবিষ্ট হয়েছো। এখন তুমিও চুম্বকে পরিণত হয়েছো। এর প্রাবল্য মাপার যন্ত্র আমার কাছে নেই। তবে স্টিফেন হকিং ব্লাক হোল থিওরিতে যেমন বলেছেন, ব্লাকহোলে আকর্ষণ বল থাকে অসীম। এর কোনো সীমা পরিসীমা থাকে না, তেমনি তোমার মধ্যে, জয়িতার মধ্যে যে আকর্ষণ বল সৃষ্টি হয়েছে, আবেশী বল সৃষ্টি হয়েছে, তা মাপার কোনো যন্ত্র আবিষ্কার হয়নি।
রানা চৌধুরীর কথা শেষ হতে না হতেই জয়িতা চিনে ফেললো রিতুনকে। অমনি প্রাবল্যের আধিক্যের কারণে, অসীম এক চুম্বক আকর্ষণে রিতুনের বুকে গিয়ে আছড়ে পড়লো জয়িতা।
দু’হাতে তালি দিয়ে তাদের অভিবাদন জানালেন রানা চৌধুরী।

বার.
রিতুন আর জয়িতার চার হাত এক হয়ে গেছে। সে আনন্দে আত্মহারা রানা চৌধুরী। তাকে এই দূরের মহাকাশে অচেনা এক জগতে এনে আটকে রাখা হয়েছে তাতে কোনো আফসোস বা কোনো টেনশন নেই। তিনি কখনও এতটা উপরে আসেননি। স্টিফেন হকিং পারকিনসন ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে পুরো নার্ভাস সিস্টেম অকেজো হয়ে যাওয়ার পরও মহাকাশ অভিযানে গিয়েছিলেন। কিন্তু রানা চৌধুরীর সেই সৌভাগ্য এখনও হয়নি। তাই তাকে তুলে এনে এমন এক সুযোগ করে দেয়ার জন্য তিনি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালেন রিতুনকে, মার্ক জাকারবার্গকে।
রিতুন-জয়িতা এক হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তঃগ্যালাক্টিক নেটওয়ার্ক থেকে লাল সিগন্যাল আসতে থাকে। তা সরাসরি হিট করছে রিতুনের বুকে। রিতুন বুঝতে পারছে তার কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে। সে কমিউনিকেশন মডিউলের বাটনে চাপ দিতেই প্রচণ্ড মোটা, গমগমে একটি কণ্ঠ শুনতে পেল।
রিতুন তোমাকে কি এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল?
রিতুন কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে বুঝতে পারছে তার দায়িত্বের কথা। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল রানা চৌধুরীকে মার্ক জাকারবার্গের মুখোমুখি করে দেয়া। তারপর রানা চৌধুরীকে টাইটানে আটকে রেখে জাকারবার্গের মুক্তি দেয়া। কিন্তু এরই মধ্যে রানা চৌধুরী তার জন্য যা যা করেছেন তাতে এই ভদ্রলোকের জন্য তার খুব মায়া হলো। রানা চৌধুরীর বয়স হয়েছে। কিন্তু টগবগে যুবকের মতো। তার চুল, দাড়ি, গোঁফ সাদা হয়েছে তো কি! তিনি কিছুতেই ভয় পান না। ভয় পাবেনই বা কেন। তিনি সেই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন সক্রিয়ভাবে। তিনি বন্দুকের ভয় পান না। তিনি অন্য রকম মানুষ। এমন মানুষটির সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করতে মন সায় দিচ্ছে না রিতুনের। তবু কমান্ড বলে কথা! কমান্ড প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে তার সার্কিটে। তার বিরুদ্ধাচরণ করার কোনো সামর্থ্য নেই তার।
আন্তঃগ্যালাঙিট নেটওয়ার্ক থেকে আসা সংকেতের জবাবে রিতুন জানিয়ে দিল- মহামান্য। আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আমি এখনই মুখোমুখি দাঁড় করছি রানা চৌধুরী ও মার্ক জাকারবার্গকে।
সময় ক্ষেপণ করো না। তাহলে তোমার মৃত্যু ঘটবে। একা হয়ে থাকবে তোমার জয়িতা।
সত্যি রিতুনকে হত্যা করলে জয়িতা বিধবা হবে। সদ্য তাদের মিল হয়েছে। এখনই এই সামান্য সময়ের মধ্যে এমন যৌবনা জয়িতা বিধবা হলে তার জীবনটাই মাটি হয়ে যাবে। তার ভালোবাসার স্পর্শ নিতে পারবে না রিতুন। রিতুনকে স্পর্শ করতে পারবে না জয়িতা। যোজন যোজন দূরে চলে যাবে তারা। এ-ও কি মেনে নেয়া যায়! যায় না। তাই সময় নষ্ট করলো না রিতুন।
প্রোগ্রাম মডিউলের একটি সবুজ বাটনে চাপ দিল রিতুন। সায়েন্স ফিকশন মুভিতে যেভাবে শূন্য থেকে জন্ম হয় মানুষ অথবা কোনো বস্তু, ঠিক তেমনভাবে ঘরের মাঝখানে শূন্যের ওপর তৈরি হয়ে গেল একটি সেলুলয়েডের টিভি স্ক্রিন। প্রথমে তা ঝির ঝির দেখাতে লাগলো। আস্তে আস্তে একটি মুখ স্পষ্ট হতে লাগলো। আরো সময় পর পরিষ্কার দেখা গেল। হ্যাঁ তিনি আর কেউ নন। তিনি মার্ক জাকারবার্গ।
রানা চৌধুরী তাকে দেখে হেসে উঠলেন। কুশল জানতে চাইলেন- কেমন আছেন জাকারবার্গ?
অস্পষ্ট স্বরে তিনি বললেন- আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনি কাজটি ভালো করছেন না।
কোন কাজ?
আমাকে এই মহাশূন্যে আটকে রেখে।
অবশ্যই ভালো করছি। কারণ, আপনি রাজেন্দ্রিয়ানদের জন্য একটি আলাদা ফেসবুক খুলে দেননি।
আমি এটা পারবো না। তাহলে আমার মূল ফেসবুক অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। আপনি আমাকে সহজে ছাড়বেন না বুঝতে পেরেছি। তাই আঙ্গুল বাঁকা করেছি। আপনাকে তুলে আনা হয়েছে টাইটানে। আমাকে মুক্তি না দিলে আপনিও বন্দি থাকবেন এই টাইটানে।
আবারো অট্টহাসি হাসলেন রানা চৌধুরী।

তের.
হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে পৃথিবীতে। ৮ কোটি ৭০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত সব তথ্য চলে গেছে ব্রিটিশ সংস্থা কেমব্রিজ এনালাইটিকার হাতে। এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিল। এ খবর রটে যাওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রে। অভিযোগ করা হয়েছে, ওইসব একাউন্ট ব্যবহার করে ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে নির্বাচনের সময়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রভাবিত হয়েছে। এ ঘটনায় কয়েকবার মহাকাশ স্টেশন থেকে ক্ষমাও চেয়েছেন মার্ক জাকারবার্গ। তিনি স্বীকার করেছেন, প্রতিটি ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ফেসবুক ব্যবহারকারী, ফেসবুকে বিজ্ঞাপনদাতা রাজনৈতিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়ে তবেই বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন।
দুঃখ প্রকাশ করলেই শেষ হয়ে যায় না সব। মার্ক জাকারবার্গকে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সিনেটে ডাকা হয়েছে। সেখানে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। সিনেটের শক্তিশালী এই কমিটির সামনে যদি তিনি হাজির না হন তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে তার স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান এ খবর ব্যক্তিগত ম্যানেজারের মাধ্যমে ইথারের সহায়তা নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন জাকারবার্গকে।
নোটিস পেয়ে জাকারবার্গের মাথা খারাপ হওয়ার দশা। তিনি সিনেট কমিটির সামনে হাজির না হলে তার দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। তাতে তার ফেসবুকের ওপর খারাপ বা নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়তে পারে। অনিয়ম হলে কেউ সেখানে আইনের ঊর্ধ্বে নন। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও তার নির্বাচনী টিম তদন্তের মধ্যে রয়েছেন। ফলে জাকারবার্গকে যে করেই হোক সিনেট শুনানিতে হাজির হতেই হবে।
এতক্ষণ তিনি রানা চৌধুরীকে হুমকি দিয়ে আসছিলেন, তাকে মুক্তি না দিলে রানা চৌধুরীকে টাইটানে আটকে থাকতে হবে বাকিটা জীবন। তার সেই কথাই এখন তার কানে ইকো বা প্রতিধ্বনি তুলছে। আর নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। তাকে তো এই মহাশূন্যে এনে বন্দি করে রেখেছেন এই রানা চৌধুরী। এখন তার মুক্তিও সেই রানা চৌধুরীর হাতে। তিনি তাকে মুক্তি না দিলে সিনেট কমিটির সামনে হাজিরা দিতে পারবেন না মার্ক জাকারবার্গ। বড্ড অসহায় মনে হতে লাগলো তার নিজেকে।
মাথা নিচু করে বসে আছেন জাকারবার্গ। তার মুখে কোনো কথা নেই। এক সময় মাথা তুললেন তিনি। দেখতে পেলেন সামনে এক নীল সমুদ্র। নীল সমুদ্র মানে নীলে নীলে সয়লাব। যতদূর চোখ যায় সামনে কিছুই নেই। শুধু নীল আর নীল। হঠাৎ তার ভিতর দিয়ে উল্কার মতো কিছু একটা উড়ে গেল। জাকারবার্গ ঠাহর করতে পারলেন না ওটা আসলে কোনো উল্কা নাকি কোনো মানব কলোনিতে ফ্লাইট যাচ্ছে। এই দূর মহাশূন্য থেকে পৃথিবীটাও দেখা যাচ্ছে না। অনেক দিন হলো স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান, দু’মেয়ে ম্যাঙ্মিা চ্যান জাকারবার্গ ও অগাস্ট চ্যান জাকারবার্গকে রেখে এসেছেন পৃথিবীতে। তাদের সঙ্গে ইথারে কথা হয়। ঝাঁপসা স্ক্রিনে তাদের দেখানো হয়। অনেক ইচ্ছে করে তার দু’কন্যাকে আদর করতে। ইচ্ছে করে বুকের সঙ্গে মিলিয়ে ধরতে। আর ইচ্ছে করে তুলতুলে গালে দু’ঠোঁট মিলিয়ে চুমু দিয়ে ভরে দিতে। জাকারবার্গ তা পারেন না।
এখন তিনি পড়েছেন এক নতুন বিপদে। তাকে মার্কিন সিনেট কমিটির সামনে হাজিরা দিতেই হবে। কি করে সেটা সম্ভব হবে! এই রানা চৌধুরীকে তো টাইটানে আটকে রাখলে তার মুক্তি মিলবে না। মুক্তির চাবিকাঠি ওই শ্বেতশুভ্র ব্যক্তির হাতে। তিনি যতক্ষণ অনুমতি না দেবেন ততক্ষণ জাকারবার্গের মুক্ত হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এই রানা চৌধুরী পদার্থবিজ্ঞানের ওস্তাদ। তিনি কোথায় কোন বর্তনী কিভাবে সেট করে রেখেছেন তা বোঝার ক্ষমতা এই মুহূর্তে নেই মার্ক জাকারবার্গের। তিনি আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ, মরীচিকা সৃষ্টি করে এক স্থানকে দেখিয়ে দিতে পারেন আরেক স্থানে। তার বুদ্ধির সঙ্গে লড়াইয়ে জেতা খুবই কঠিন। কথাগুলো এখন বুঝতে পারছেন জাকারবার্গ। তিনি ভাবছেন, ঠিক হয়নি তার এই লোকটিকে পৃথিবী থেকে তুলে আনা।
জাকারবার্গ এখন কি করবেন! তিনি বাইরে তাকিয়ে আছেন অসীম শূন্যতার দিকে। আর এসব ভাবছেন। ভাবছেন আর দেখছেন রানা চৌধুরীকে। কি জাদুমন্ত্রের অধিকারী এই লোক! তার কাছে বিস্ময় লাগে। কিভাবে হাজার হাজার মানুষের হৃদয়ে তিনি স্থান করে নিয়েছেন। কি মোহ তার মধ্যে! কেমন এক ঘোরের মধ্যে যেন চলে যান জাকারবার্গ।

চৌদ্দ.
রাজেন্দ্রিয়ান তরিকুল পাশা বসে আছেন আন্তঃগ্যালাক্টিক নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে। জাকারবার্গ তা ভালো করে জানেন। তিনি জানেন অন্য হাজার হাজার রাজেন্দ্রিয়ানের মতো রানা চৌধুরীর প্রতি তরিকুল পাশারও দুর্বলতা আছে। তাই বলে তরিকুল পাশা সরাসরি রানা চৌধুরীর পক্ষও নিতে পারবেন না, এটা তার চাকরির পূর্ব শর্ত। ফলে তাকে যা করতে হবে তা আইনের মধ্যে থেকেই করতে হবে। জাকারবার্গকে মহাশূন্যে বন্দি করেছেন রানা চৌধুরী ও নিউ ইয়র্কে তার এক সাঙ্গ। আবার অনুগত রোবটদের একটি গ্রুপকে ব্যবহার করে রানা চৌধুরীকে তুলে এনে আটকে রাখা হয়েছে টাইটানে। তাতে রানা চৌধুরীর কোন আক্ষেপ নেই।
মার্কিন সিনেটে হাজিরা দেয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। এখন কি করে ওই মহাশূন্য থেকে নিচে নেমে আসা যায়, সেই ফন্দি করতে থাকেন জাকারবার্গ। তিনি অনেক হিসাব কষেন। কিন্তু কোনো কৌশলই কাজে আসে না। তাকে বার বার স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। যতই তাকে এ বাণী শোনানো হচ্ছে ততই টেনশন বাড়ছে জাকারবার্গের। তিনি এক সময় ঘামতে শুরু করেন। কন্ট্রোল সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আবার রানা চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার আহ্বান জানান।
কন্ট্রোল সেন্টার থেকে সিগন্যাল যায় রিতুনের কাছে। রিতুন প্রস্তুত করে রানা চৌধুরীকে। তখন সন্ধ্যাতারা আকাশে উঁকি দিচ্ছে। দূরে বহুদূরে ম্লান হয়ে নিভে যাচ্ছে একটি তারা। তাহলে কি আরো একটি সভ্যতার ধ্বংস হলো! মহাবিশ্ব থেকে মুছে গেল আরো একটি মানব কলোনি! ভয়ে গা শিউরে ওঠে রিতুনের। রানা চৌধুরীও সেদিকে তাকিয়ে আছেন। রিতুন বলল- দেখতে পাচ্ছেন দূরে?
রানা চৌধুরী বললেন- কিসের কথা বলছো?
ওই যে দূরে একটি তারা নিভে গেল।
হ্যাঁ, দেখেছি তো।
ওটা কি শুধুই একটি তারা!
না, ওটা হতে পারে একটি গ্রহ। মরণ দশায় গিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেল।
ওখানে কোনো প্রাণী ছিল না?
থাকতেই পারে।
যদি থাকে তাহলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না, তাই না?
ঠিকই বলেছো। এভাবে যখন তারারা মারা যায় তখন তারা আস্তে আস্তে ব্ল্যাকহোলের দিকে ধাবিত হয়। সেখানে অসীম ঘনত্ব। অনুতে অনুতে অসীম শক্তিতে আকর্ষণ শক্তি। সেখানে কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকা একেবারেই অসম্ভব।
রিতুনের চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে। এভাবেই কি তাহলে একদিন পৃথিবী, মঙ্গলগ্রহ, এই টাইটান, মানব কলোনি সব শেষ হয়ে যাবে! মহাবিশ্বের সেদিন কি হবে!
রিতুন প্রস্তুত হও! এখনও রানা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলবেন মার্ক জাকারবার্গ। তুমি সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করো- কন্ট্রোল প্যানেল থেকে মোটা স্বরে কমান্ড এলো রিতুনের কাছে।
রিতুন কালবিলম্ব না করে বললো- সব প্রস্তুত। রানা চৌধুরীকে ইজি চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি যথেষ্ট স্বাভাবিক আছেন।
তাহলে গ্রিন বাটনে চাপ দাও- কন্ট্রোল প্যানেলের নির্দেশ।
রিতুন গ্রিন বাটনে চাপ দিতেই এবার প্লাজমায় তৈরি একটি স্ক্রিন ভেসে উঠল ঘরের মধ্যে। তাতে ঝাঁপসা নয়, ঝকঝকে দেখা যাচ্ছে মার্ক জাকারবার্গকে।
রানা চৌধুরী স্বাভাবিক। তার দৃষ্টি স্থির। তিনি দেখছেন এই বয়সের একটি যুবক কিভাবে সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তার সৃষ্ট ফেসবুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সেখানে চল্লিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো যমজ বোনকে খুঁজে পাচ্ছেন আরেক বোন। এক প্রেমিকাকে ৭০ বছর আগে প্রেমপত্র লিখেছিলেন এক প্রেমিক। সেই প্রেমিককে কোনোদিন চোখে দেখেননি ওই প্রেমিকা। ঠিক ৭০ বছর পরে সেই প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা হচ্ছে টেমসের তীরে। আবার কত যুবক, কত যুবতী খুঁজে নিচ্ছে মনের মানুষকে। এক অসম্ভব কাজকে সম্ভবে পরিণত করেছেন এই জাকারবার্গ। তাই তার জন্য অনুকম্পা অনুভব করেন রানা চৌধুরী।
জাকারবার্গ এরই মধ্যে বুঝতে পেরেছেন রানা চৌধুরীর শক্তির উৎস। তিনি এখন তাকে স্যার সম্বোধন করেন। বলেন, স্যার আমাকে মার্কিন সিনেটে কল করা হয়েছে।
সে খবর তো আমি জানিই।
আপনি জানেন?
হ্যাঁ, জানি।
আসলে আমি আপনাকে আটকে রেখে আমার মুক্তির পথ খুুঁজছিলাম।
সে আপনি পারবেন না।
আমি পারবো। কিন্তু সময় এখন অনুকূলে নেই।

পনের.
মার্ক জাকারবার্গ মাথা চুলকান। তিনি বলেন, আপনাকে আমি এই টাইটানে নিঃসঙ্গ মহাশূন্যে আটকে রাখতাম চিরজীবন। আপনার চারপাশে দেখতে পেতেন মানব কলোনি। কিন্তু আপনি বের হতে পারতেন না এখান থেকে। যেতে পারতেন না সেই কলোনিতে। মানুষের সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক থাকতো না। আপনার সঙ্গী হতো রিতুন আর জয়িতা। ওদেরকে আপনি চিনতে পেরেছেন? ওরা সাধারণ কোনো মানুষ নয়। ওদেরকে কমান্ড দেয়া আছে। ওরা কমান্ডের বাইরে কোনো কাজ করে না।
রানা চৌধুরী হাসেন। বলেন- তাই নাকি?
হ্যাঁ, তাই।
রিতুন রোবট। কিন্তু তার দেহে ঢুকানো আছে কপোট্রনের গুঁড়ো। যা থেকে তার মধ্যে মাঝে মাঝে মানবীয় গুণ বেরিয়ে আসে। এ কথা জানেন রানা চৌধুরী। রিতুনকে যখন নতুন জীবন দেয়া হয়েছিল রাজেন্দ্র কলেজের ল্যাবরেটরিতে তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন রানা চৌধুরী। তিনি রিতুনের কোড নম্বর, তার কপোট্রনের কম্পাঙ্ক সব জানেন। ম্যাডাম ভীণা চৌধুরী রিতুনের দেহে কপোট্রনের গুঁড়ো প্রবেশ করানোর সময় রানা চৌধুরীকে সে কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। তা আর ভোলেন নি রানা চৌধুরী। তিনি প্রতি মুহূর্তে রিতুনকে চিনতে পারছেন। তার মাথার পিছন দিকে যেখানে সবগুলো তার প্লাজমার মতো হয়ে রূপ নিয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে মিশেছে সেখানে বার বার রিতুনের কোড নম্বর ভেসে ওঠে। তাই এতটা সময় তিনি কোনো ভয় পাননি। তিনি রিতুনের ওপর ভরসা রেখেছেন, যদিও সে একটি রোবট। তিনি জানেন কঠিন কোনো মুহূর্তে রিতুনের কপোট্রনের গুঁড়ো কাজ করবে। তার মানবিক বোধ জাগ্রত হবে ।
রানা চৌধুরী পারতেন মার্ক জাকারবার্গের সঙ্গে আপোষে যেতে। তিনি পারতেন জাকারবার্গকে মুক্ত করে পৃথিবীতে পাঠাতে। তার সন্তানদের চেহারা ভেসে উঠছে রানা চৌধুরীর চোখেমুখে। তার মধ্যে ভীষণ মায়া হয় এই যুবক পিতাটির জন্য। তবু তাকে যেহেতু চ্যালেঞ্জ জানাতে তুলে নেয়া হয়েছে টাইটানে তখন একেবারে বিনা যুদ্ধে কিভাবে ছেড়ে দেবেন মেদিনি!
রানা চৌধুরী বললেন- পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে আপনি আমাকে বন্দি করে রাখতেন এই তো?
ঠিক তাই- বলেন জাকারবার্গ।
আইচ্ছা তাহলে আমি সেই চ্যালেঞ্জটা নিলাম। আপনি আমাকে আটকে রাখেন তো দেখি! ধমকের সুরে বললেন রানা চৌধুরী।
তার গড়গড়ে গলার ধমকে নড়ে উঠল ওই ভবনটি। জাকারবার্গ ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু বিষয়টি এখন প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে গেছে। এই বৃদ্ধকে একেবারে সহজে ছেড়ে দেয়া যায় না। তাকে হেনস্তা করে তবেই তার কাছ থেকে বের হওয়ার সূত্র পেতে হবে।
গর্জে উঠলেন জাকারবার্গ- তাহলে আপসে কাজ হবে না, তাই না? আমার সিনেট কমিটিতে হাজির হওয়ার সময় ফুরিয়ে আসছে। আর আপনি আমার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ লাগতে চাইছেন?
হ্যাঁ, চাইছি তো! বুঝতে পারেননি এতক্ষণ? জানতে চাইলেন রানা চৌধুরী।
বুঝতে পেরেছি। আপনি সহজে আমাকে ছাড়বেন না। আমাকে এই প্লাজমিক টিভির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে। বলেই আঠালো প্লাজমা টিভির ভিতর থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন মার্ক জাকারবার্গ। তাকে দেখে রানা চৌধুরী আরো একবার হাসলেন।
আন্তঃগ্যালাক্টিক নেটওয়ার্কে কি হয়েছে কে জানে! রাজেন্দ্রিয়ান তরিকুল পাশা বার বার চেষ্টা করছেন রানা চৌধুরীর অবস্থা জানার জন্য। কিন্তু নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না কোনো কারণে। কি সেই কারণ হতে পারে বুঝতে পারছেন না তিনি। তবে এটা বুঝতে পারছেন বড় কোনো অঘটন ঘটতে চলেছে হয়তো।
রানা চৌধুরীর সামনে এসে অগ্নিমূর্তি নিয়ে দাঁড়ালেন জাকারবার্গ। গমগম করে বললেন- আমাকে পৃথিবীতে ফেরত যাওয়ার সূত্রটি দিয়ে দিন। না হলে আপনাকে আমি এখানেই হত্যা করবো।
রানা চৌধুরী বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। তিনি হত্যার ভয় করেন না। তিনি পাকিস্তানি হায়েনাদের ভয় করেননি। আর এ তো মামুলি একটি ছোকরা।
জাকারবার্গ আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন- আপনি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। দিয়ে দিন সূত্রটি।
রানা চৌধুরী বললেন- সূত্রটি একান্তই আমার আবিষ্কার। এটা কারো হাতে দেয়ার জন্য নয়।
ততক্ষণে চারদিকে কেমন যেন এক ধুলোঝড়ের মতো সৃষ্টি হয়েছে। মানব কলোনির ভিতরে এক মড়া কান্নার শব্দ। এক রকম গোঙানি শোনা যাচ্ছে। রানা চৌধুরীকে যে প্লাজমার তৈরি ভবনে আটকে রাখা হয়েছে তা একবার দুলে গাছের মতো নিচের দিকে যাচ্ছে, আবার সোজা হচ্ছে। কিন্তু আন্তঃচৌম্বক বলের কারণে তিনি বা তারা পড়ে যাচ্ছেন না।
জাকারবার্গ ধমকে উঠলেন- শুনতে পাচ্ছেন মড়া কান্নার শব্দ?
পাচ্ছি।
তাহলে বুঝুন আপনার কি হতে চলেছে।
কিছুই করতে পারবেন না আপনি।
তাহলে রে... বলেই জাকারবার্গ ঝাঁপিয়ে পড়লেন রানা চৌধুরীর ওপর। তরুণ দেখালেও তার বয়স হয়েছে। তিনি কিছুটা দুর্বলতা অনুভব করলেন। তার পকেটে থাকা সেই গোপন সূত্রটি রাখা একটি কয়েনের মতো ছোট্ট ডিভাইসে। তার কাছাকাছি হাত পৌঁছে দিয়েছেন জাকারবার্গ। অমনি সব শক্তি সঞ্চয় করে তাকে এক ধাক্কায় দেয়ালের ওপর আছড়ে ফেললেন রানা চৌধুরী। সেখান থেকে উঠে আহত বাঘের মতো আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন জাকারবার্গ।
এ দৃশ্য এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল রিতুন আর জয়িতা। তাদের মধ্যে এতক্ষণ কোনো অনুভূতি কাজ করে নি। তবে রানা চৌধুরীকে এভাবে হেনস্তা করা দেখে রিতুনের মধ্যে মানবিক অনুভূতি জাগ্রত হওয়া শুরু হলো। আস্তে আস্তে তার প্লাজমা তারের ভিতর দিয়ে কপোট্রনের গুঁড়ো অনুভূতি পাঠাতে লাগলো মস্তিষ্কে। তার শরীর স্ফীত হতে লাগলো। সে আর সহ্য করতে পারলো না। তাকে যে রানা চৌধুরী এতটা সাহায্য করেছেন তাকে সে হেনস্তা হতে দিতে পারে না। রিতুনকে থামানোর চেষ্টা করলো জয়িতা। কিন্তু কিছুতেই রিতুন থামবে না। তাকে অশ্বশক্তি দিয়েও যদি বেঁধে রাখা যায় তবু সে থামবে না। জয়িতার হাত ছেড়ে দিয়ে রিতুন দৃপ্ত কদমে এগিয়ে গেল জাকারবার্গের কাছে। টার্মিনেটর-টু এর মতো চেহারা হয়েছে এখন তার। এক হাতে জাকারবার্গেল ঘাড় ধরে উঁচু করে ফেলল। নিজের দিকে তার মুখ করে বলল- জাকারবার্গ আপনি কোথায় হাত দিয়েছেন জানেন? আপনাকে আমি ক্ষমা করতে পারবো না।-বলেই তাকে ছুড়ে মারতে গেল। রিতুন জাকারবার্গকে ছুড়ে মারলে তিনি কোথায় কোন গ্রহে নাকি কোন উপগ্রহে গিয়ে পড়বেন কেউ জানে না।
ঠিক এমন সময় রানা চৌধুরী রিতুনকে থামালেন। বললেন- রিতুন আমি তোমার ভালোবাসায় মুগ্ধ। ভীণা চৌধুরী যে রোবট তৈরি করেছেন তা দেখে আমি আজ অভিভূত। তুমি জাকারবার্গকে বাইরে ছুড়ে ফেলো না। ওনাকে বরং পৃথিবীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।
ততক্ষণে আন্তঃগ্যালাক্টিক নেটওয়ার্ক কাজ করতে শুরু করেছে। সেখানে যোগাযোগ করলো রিতুন। তরিকুল পাশাকে জানিয়ে দিল সব। তরিকুল পাশাই সব ব্যবস্থা পাকা করলেন। জাকারবার্গকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাঠানো হলো পৃথিবীতে। দু’মেয়ে ও স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেছিলেন কয়েক ঘন্টা। এরপর হাজির হলেন মার্কিন সিনেটের শুনানিতে। সেখানে স্বীকার করলেন নিজের ভুলের কথা।
টাইটানে রানা চৌধুরীকে নিয়ে আনন্দের শেষ নেই। রিতুন, জয়িতার নতুন বিয়ে হয়েছে। সে উপলক্ষ্যে বিশাল আয়োজন করা হলো। হাজির হলেন তরিকুল পাশাও। তারপর এক ঝকঝকে দিনে বিশেষ এক ফ্লাইং সসারে কারে তাকে ফেরত পাঠানো হলো পৃথিবীতে। তা এসে নামবে রাজেন্দ্র কলেজের মূল ক্যাম্পাসের সবুজ মাঠে। শুধু ফরিদপুর নয়, বাংলাদেশ তথা তাবৎ দুনিয়ার সাংবাদিকে সয়লাব। চারদিকে সিএনএন, বিবিসি, এবিসি-সহ অসংখ্য টেলিভিশনের ক্যামেরা তাক করা আকাশের দিকে। সব পত্রপত্রিকায় আট কলামে সংবাদ শিরোনাম- রানা চৌধুরী ফিরছেন। দুনিয়াসুদ্ধ মানুষের যেন ঢল নেমেছে ফরিদপুরে। অকস্মাৎ কে একজন চেঁচিয়ে উঠল- ওই যে দেখা যাচ্ছে
ফ্লাইং সসার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status