ঈদ আনন্দ ২০১৮

ভ্রমণ

প্রকৃতির মানসকন্যা

ইমাদ উদ দীন

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৬:৫৩ পূর্বাহ্ন

কি নেই ওখানে। বাদ পড়েনি প্রকৃতির সঙ্গে মিতালীর কোনো উপকরণই। দৃষ্টি জুড়ে মনখোলা নৈসর্গিক প্রকৃতির লীলা নিকেতন। প্রকৃতির এমন উজাড় করা রুপ মাধুর্য আকৃষ্ট করে যে কাউকে। শীত আর গ্রীষ্ম। দু’মৌসুমে এখানকার প্রকৃতির দু’ধরনের রূপ। সারা বছরই পর্যটকদের মুগ্ধ করতে প্রস্তুত সবুজ প্রকৃতির ‘মানসকন্যা’ মৌলভীবাজার।
প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে প্রকৃতিকে উপভোগ করার মজাই আলাদা। প্রকৃত প্রকৃতিপ্রেমীরা সুযোগ পেলেই পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। তাই প্রতি বছর ঈদ ও পূঁজোর ছুটিতে প্রকৃতির লীলাভূমি পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময়ী জেলা মৌলভীবাজারের নানা দর্শনীয় স্থান দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে। এসকল দর্শনীয় স্থান দেখতে সমাগম ঘটে লাখো পর্যটকদের। ওখানকার হাওর বাওর। আর পাহাড়ি ঠিলার অপরূপ সৌন্দর্য মন কাড়ে আনন্দ আবেগে। মনকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন চা বাগানগুলোর মনোহর দৃশ্য, হাকালুকি হাওরের বিস্তীর্ণ সফেদ জলরাশি, লাউয়াছড়ার দুর্লভ জীববৈচিত্র্য, দেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড ও দুর্গম পাহাড়ের জলকন্যা হামহাম আর নয়নাভিরাম শতাধিক চা বাগান, রাবার বাগান, আগর বাগান, সি.আর.পি, লালমাটি ঠিলা, পান পুঞ্জি, কমলা বাগান, লেবু বাগান, মাধবপুর লেকসহ এ জনপদের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ সকল সৌন্দর্যের ডালি প্রকৃত প্রকৃতিপ্রেমীদের আনন্দ ভ্রমণের দেয় নিমন্ত্রণ। প্রতি বছরই ঈদ, পূঁজো ও জাতীয় দিবসগুলোতে এসমস্ত দর্শনীয় স্থান মুগ্ধ করে পর্যটকদের। জেলা প্রশাসনের অনুমানভিত্তিক হিসাব হচ্ছে মৌলভীবাজারের দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি প্রায় ২ লাখ পর্যটক এই জেলায় আসেন। পর্যটনকে কেন্দ্র করে গত ১০ বছরে জেলায় প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে পাঁচ তারকা মানের গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ এবং দুসাই রিসোর্ট এন্ড স্পা এই দুটি হোটেল ও শতাধিক ছোট বড় কটেজ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য এজেলায় যেসব উপাদান রয়েছে তার মধ্যে সবুজে ঢাকা উঁচু-নিচু টিলা ও পাহাড়, সবুজ বনানী, হরেক রকমের পাখ পাখালি, চা বাগান, লেক, হাওর, ঘন জঙ্গল, খনিজ গ্যাসকূপ, আনারস, লেবু, পান, আগর, রাবার বাগান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি আর ঐতিহাসিক স্থান। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি শীত প্রধান অঞ্চল আবার সবচেয়ে বৃষ্টি প্রধান অঞ্চল হিসাবেও এ জেলা পরিচিত। বৃষ্টিতে ভিজতে কিংবা কনকনে শীত অনুভব করতে দু’টো মৌসুমেই পর্যটকের ভিড় লক্ষণীয়। পর্যটক আকর্ষণের জন্য জেলায় যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই), চা জাদুঘর, চা কন্যা ভাষ্কর্য, সাতরঙ্গা চা, মাধবপুর লেক, ভাড়াউড়া লেক, রাজঘাট লেক, হরিণছড়া লেক, সাতগাঁও লেক, আগর-আতর, রাবার বাগান, খাসিয়া পানের বাগান, বাংলা পানের বরজ, শীতলপাটি, হাকালুকি হাওর, হাইল হাওর, বাইক্কা বিল, কাউয়াদীঘি হাওর, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবছড়া ও পাথারিয়া পাহাড়, জলপ্রপাতের মধ্যে, মাধবকুন্ড, পরিকুন্ড, হামহাম জলপ্রপাত, ফুল ঢালনী ঝেরঝেরি ও ইটাহরী ফুলবাগিচা জলপ্রপাত, ঐতিহাসিক দীঘিগুলোর মধ্যে, কমলা রানীর দীঘি (ঘরগাঁও, রাজনগর), কালিদীঘি বা বেগদালি দীঘি (ঘরগাঁও, রাজনগর), দেওয়ান দীঘি, (টেংরা, রাজনগর), জামাল খাঁর দীঘি (রাজনগর), খোঁজার দীঘি (গয়গড়, মোস্তফাপুর), রাজচন্দ্রের দীঘি (সাধূহাটি, মৌলভীবাজার), হিয়ালী দীঘি (সম্পাশী, মৌলভীবাজার), দত্তের দীঘি (মোস্তফাপুর, মৌলভীবাজার), নবাব দীঘি (পৃথিমপাশা, কুলাউড়া), বড়দা ঠাকুরের দীঘি (নাছনি, ব্রাহ্মণবাজার, কুলাউড়া), ছয়ছিরি দীঘি (রহিমপুর, কমলগঞ্জ), রাজদীঘি (পতনউষার, কমলগঞ্জ), কুলাউড়ার গগন টিলা, শ্রীমঙ্গলের ওফিং হিল, বড়লেখার মাধবছড়ার কেরোসিন টিলা, কুলাউড়া-জুড়ীর লাঠি টিলা, কমলগঞ্জের মোকাম টিলা, কালেঞ্জী খাসিয়া টিলা, গারো টিলা ও আদমপুর বনবীট টিলা। কুলাউড়ার কালাপাহাড়। নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে, খাসিয়া, গারো, সাঁওতাল, ওঁরাও, ভূঁইয়া, নায়েক, গড়, কাহার, গঞ্জু, অলমিক, পাসি, হাজরা, দোসাদ, ননিয়া, রবিদাস, পরাধান, বাউরি, পান, পবর, তেলেগো, ভূমিজ, ঘাসি, হাজং, বড়াইক, মুণ্ডা, তাতি, লোহার, তুরি, মহালি, কিসান, নাগিসিয়া, রাজগন্দ, মালপাহাড়িয়া, খারওয়ার ও খবিয়া। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি,উৎসব ও ভাষা। মণিপুরি, খাসিয়া, সাঁওতাল, টিপরা ও গারো সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র জীবনাচার এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন ও সংস্কৃতি দেখলে ক্ষণিকের জন্য হলেও পর্যটকদের পাহাড়ি হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে মন চাইবে। মৌলভীবাজার জেলার ৭টি উপজেলায় ছড়িয়ে আছে বহু স্মৃতি জাগানিয়া শতাধিক পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থান। যেখানে পর্যটকের মন হারিয়ে যাবে ইতিহাসের অন্য এক খেরোপাতায়। মৌলভীবাজার শহরের তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে গয়ঘর নামক গ্রামে মধ্যযুগের ঐতিহাসিক নিদর্শন পাঠান বীর খাজা ওসমানের দীঘি, গড় ও দুর্গ। ১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত উপমহাদেশের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর অন্যতম খোজার মসজিদ। মৌলভীবাজার শহরের দরগামহল্লায় ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রহ.)-এর মাজার। সদর উপজেলার জগৎসী গ্রামে দোল গোবিন্দ আশ্রম। জেলা শহরের পশ্চিমবাজার মনু নদীর জাহাজ ঘাট। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাগাবালা ইউনিয়নে কামরূপ রাজ ভগদত্তের উপ-রাজধানী দিনারপুর ভগ্নাবশেষ। পাক-হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর টর্চার সেল পিটিআই এলাকায় ভূগর্ভস্থ বাংকার। সদর উপজেলার পাগুলিয়ায় দিল্লির পীর সাহেবের মসজিদ। সদর উপজেলার বিরাইমবাদ গ্রামে আছে সাধক অজ্ঞান ঠাকুরের দেয়াল। কুলাউড়া উপজেলায় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের তীর্থস্থান রঙ্গিরকুল আশ্রম। বর্তমানে এখানে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ ইসকন মন্দির। প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কুলাউড়ার পৃথিমপাশা নবাববাড়ি, ৪০০ বছরের আদি নির্দশন নবাব বাড়ির সামনের মসজিদে ফুলেল নকশা ও ইমামবাড়া পর্যটকদের কাছে এক আকর্ষণীয় স্থান। সমগ্র বাংলা ও আসামের প্রখ্যাত সমাজসেবক জমিদার আলী আমজদ খাঁ শিয়া সম্প্রদায় হওয়ায় এখানে প্রতি বছর ১০ মহরম সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয় এই নবাববাড়িতে। ইরানের শাহান শাহ রেজা শাহ পাহলভীর আগমন উপলক্ষে লংলা ও শমসেরনগর রেল স্টেশনে নির্মিত সুরম্য তোরণ। কুলাউড়ার নন্দ নগরের সতীদাহ মন্দির। শ্রীমঙ্গল বিজিবি সেক্টর হেড কোয়ার্টার সংলগ্ন সাধুবাবার বটতলী বধ্যভূমি। শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৪০০ বছরের পুরনো শ্রীশ্রী নিমাই শিববাড়ী। শ্রীমঙ্গলের কালাপুরের শতাব্দী প্রাচীন রাধা গোবিন্দের মন্দির। বিলাস নদীর লঞ্চ ঘাট। যাদের নামে শ্রীমঙ্গল সেই দুই ভাই ‘শ্রী চন্ডি’ এবং ‘মঙ্গল চন্ডি’র প্রাচীন মন্দির। সীতেশ দেবের বন্য প্রাণি সেবা ফাউন্ডেশন। মাগুরছড়া ও কালাছড়া গ্যাস ফিল্ড। শমসেরনগর ব্রিটিশ নির্মিত বিমানবন্দর ও তৎসংলগ্ন ১৯৭১ সালে গণহত্যার বধ্যভূমি। পতনউষার দুর্গের ধ্বংস্তূপ। বড়লেখা উপজেলার পাথারিয়ায় হযরত সৈয়দ ইয়াকুব (রহ.)-এর মাজার। শাহবাজপুর মোঘল আমলের সালেগড় দুর্গ। মাধবকুন্ড জলপ্রপাত সংলগ্ন প্রাচীন শিব মন্দির। রাজনগর উপজেলার কমলা রানীর দীঘি ও তৎসংলগ্ন রাজা সুবিধ নারায়ণের রাজ পরিবারবর্গের সমাধিস্থল। তারাপাশার শতাব্দী প্রাচীন তীর্থস্থান বিষ্ণুপদ ধাম। পাঁচগাঁও বাংলা সংবাদপত্রের আদি পুরুষ গৌরিশংকর ভট্টাচার্যের বাড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী বিপ্লবী লীলা নাগের বাড়ি। পাঁচগাঁও শান্তিময় দাসের বাড়িতে প্রাচীন শ্রীশ্রী দুর্গা পূজামণ্ডপ। কুলাউড়া, রাজনগর ও বড়লেখার পাখী বাড়ি মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে শতাধিক পর্যটন স্পট। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয় ২৭৯৯.৩৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন এবং প্রায় ২০ লাখ লোকের আবাস ভূমি প্রবাসী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলা বহু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের  ধারক ও বাহক। অসাম্প্রদায়িক এই জেলা একদিকে যেমন হযরত শাহ মোস্তফা (রহ.) সহ বহু ওলি-দরবেশ, পীর-আউলিয়ার পুণ্যস্পর্শে ধন্য, তেমনিভাবে এখানে রয়েছে হিন্দুদের তীর্থস্থান বিষ্ণুপদ ধামসহ শতাধিক মন্দির-দেবালয়। পুরনো যুগের হিন্দু ধর্মগ্রন্থে মনু নদীর নাম রয়েছে, রামায়ণ ও মহাভারতে উল্লেখিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল বলে প্রাচীন শ্লোক থেকে জানা যায়। ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমার গোবিন্দশ্রীর মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ মনু নদীর তীরে উত্তর পাশে যে বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালক্রমে তা ১৮৮২ সালে দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমার, ১৮৮৭ সালে মৌলভীবাজার পৌরসভা এবং ১৯৮৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজার জেলা হিসাবে  আত্মপ্রকাশ ঘটে। বর্তমানে ৭টি উপজেলা, ৫টি পৌরসভা, ৬৭টি ইউনিয়ন ও ২১৩৪টি গ্রাম নিয়ে মৌলভীবাজার জেলার বিস্তৃতি। জেলার অন্যতম দর্শনীয় পর্যটন স্থানের সংক্ষিপ্ত রূপ বিবরণ।
হাকালুকি হাওর: স্থানীয়ভাবে প্রবাদ আছে হাওর মানে হাকালুকি আর সব কুয়া (কূপ), ব্যাটা (পুরুষ) মানে মান মনসুর আর সব পুয়া (ছেলে)। প্রকৃতির এই বিশাল দুনিয়ায় কি নেই। নানা প্রজাতির মিঠা পানির দেশীয় মাছ, পাখি, পরিযায়ী পাখি, শাপলা-শালুক,ঝিনুক,শত-শত প্রজাতির জলজ প্রাণী। আর হাওরের সফেদ পানির মাঝ খানে গড়ে ওঠা হিজল, কড়চ, বরুন, আড়ং, মূর্তা, কলুমবনসহ সবুজের ঢেউ জাগানিয়া মনকাড়া পরিবেশ। বর্ষা মৌসুমে থৈ থৈ পানি। আর শীত মৌসুমে পাখির খেলায় বিমোহিত রূপ মাধূর্যে কাছে টানে প্রকৃতিপ্রেমীদের। এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকির সীমানা মৌলভীবাজার ছাড়িয়ে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত। ২ জেলা ও ৫টি উপজেলা জুড়ে ২৩৮টি বিল নিয়ে এ হাওরের আয়তন ২০ হাজার ৪ শত হেক্টর। হাওরের বিলগুলোর তীরবর্তী এলাকায় চাষ হয় বোরো, আউশ ও আমন ধান।  জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হাকালুকি হাওরে রয়েছে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির দেশীয় ও পরিযায়ী লক্ষাধিক পাখী, ১৪১ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ১০৭ প্রজাতির মাছ। এরমধ্যে রয়েছে পাবদা, দেশি পুঁটি, বাইম, গুতুম, বোয়াল, চিতল, গজার, শউল, রাণী ইত্যাদি ৩২ প্রজাতি বিপদাপন্ন মাছের প্রজাতি। এছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের কীটপতঙ্গ, জলজ ও স্থলজ ক্ষুদ্র অনুজীব। রয়েছে হাওরপাড়ের বাসিন্দা পেশাজীবী মানুষের ইতিহাস, সামাজিক আচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। পর্যটকদের সুবিধার্থে হাকালুকি হাওরে মধ্যে রয়েছে ৩টি সুপরিসর পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (ওয়াচ টাওয়ার)।
বাইক্কা বিল: হাইল হাওরের পূর্বদিকে ১০০ হেক্টর আয়তনের একটি জলাভূমির নাম। হাইল হাওরের প্রাণই হল বাইক্কা বিল। বাইক্কা বিলে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলায় দেশের বিলুপ্তপ্রায় রুই, গইন্না, কালিবাওস, দেশি সরপুঁটি, পাবদা, আইড়, গুলশা, চিতলসহ ২০-২৫ প্রজাতির মাছের দেখা মিলে।  দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের মাছের সঙ্গে রয়েছে প্রচুর কচুরিপানা, শাপলা আর পদ্মফুল। বিলের পানিতে ওই সকল ফুলের উপর চলে রঙিন ফড়িংয়ের ওড়াওড়ি। বিলের পাড়ে বন ফুলের পাশে নানা রং ও জাতের পতঙ্গ দলের লাফ ঝাঁপ মন কাড়ে আনন্দ আবেগে। শীত মৌসুমে ওখানে ঠাঁই নেয় বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি। বিলের উল্লেখযোগ্য পাখি-পানকৌড়ি, কানিবক, ধলাবক, গোবক, ধুপনিবক, রাঙ্গাবক, দলপিপি, নেউপিপি, পানমুরগি, বেগুনিকালেম, কালোমাথা, কাস্তেচরা, শঙ্খচিল, পালাসি, কুড়া, ঈগল। শীতের অতিথি হয়ে এই বিলে আসে অনেক জাতের সৈকত পাখিও। এদের মধ্যে আছে গেওয়ালা বাটান, মেটে মাথা চিটি, কালাপঙ্খ ঠেঙ্গী, ধলা বালিহাঁস, পাতি সরালি, রাজসরালি, মরচেরং হাঁস, ভূতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঙ্গাহাঁস, গুটি ঈগল। বসত গড়েছে  সাপ-ব্যাঙসহ নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ। বাইক্কা বিলে মিলে সুস্বাদু মাখনা, বেটফল, শালুকসহ নানা স্বাদ ও নানা বর্ণের জলজ ফল। পর্যটকদের সুবিধার্থে পাখি দেখার জন্য বাইক্কা বিলে পানির উপরে তৈরি করা হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এ টাওয়ার থেকে শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বিলের পাখিদের খাবার সংগ্রহের ব্যস্ততা, ওড়াউড়ি, ডুবসাঁতার, ঝগড়া, জলখেলা, খুনসুটি কাছ থেকে দেখার রয়েছে সুযোগ।
মাধবকুন্ড জলপ্রপাত: দেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড। জেলার বড়লেখা উপজেলার কাঠালতলী বাজার থেকে ৪ কি. মি. পূর্ব দিকে এগোলেই কানে আসবে ক্রমাগত জল গড়ানোর শব্দ। সেই সঙ্গে থাকবে সবুজ চা পাতার তাজা গন্ধ। প্রায় ২০০ ফুট পাথারিয়া পাহাড়ের উপর থেকে ছোট-বড় পাথরের বুক চিরে আছড়ে পড়া জলরাশির ঝর্ণাধারার দৃশ্যে মন নাচে আনন্দ আবেগে। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের চারদিকে পুরো বনজুড়ে রয়েছে নানা জাতের পাখপাখালি, বন্যপ্রাণী, বৃক্ষ, উদ্ভিদ, লতাগুল্ম বনবনানী- জীববৈচিত্র্যের এ জেলায় আগত পর্যটককে এক অনাবিল মোহময়তায় আচ্ছন্ন করবে।
জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়া: জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের সমৃদ্ধতম বনগুলোর একটি। প্রায় পাঁচ হাজার একরের এই বন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণবৈচিত্র্যের এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। ওখানে রোদের আলো ঢাকা পড়ে গাছ গাছালির ছায়ায়। লাউয়াছড়ায় দিনেই মিলে রাতের অন্ধকারের আবহ। বনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই নানা ধরনের বন্যপ্রাণী, পাখি, কীটপতঙ্গের হাকডাকের শব্দ শোনা যায়। বনের মধ্যে প্রায় সারাক্ষণই সাইরেনের মতো শব্দ হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এটি এক ধরনের ঝিঁঝি পোকার কোরাস ডাক। লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর বসবাস। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এ বন বিখ্যাত। বনের মধ্যে কিছু সময় কাটালেই উল্লুকের ডাকাডাকি শুনতে পাবেন। উল্লুক ছাড়াও এখানে রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, হনুমান, চশমাপরা বানর, বানর, শিয়াল, বনবিড়াল, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভাল্লুক, মায়া হরিণ (বার্কিং ডিয়ার), অজগরসহ নানা প্রজাতির জীবজন্তু। এ বনে দুর্লভ প্রজাতির সাদা বাঘও দেখা যায়। উদ্যানের বন্য পাখির মধ্যে সবুজ ঘুঘু, বনমোরগ, তুর্কি বাজ, সাদা ভ্রু সাতভায়লা, ঈগল, হরিয়াল, কালোমাথা টিয়া, কালো ফর্কটেইল, ধূসর সাত শৈলী, পেঁচা, লক্ষ্মীপেঁচা, ফিঙ্গে, লেজকাটা টিয়া, কালোবাজ, হীরামন, কালোমাথা বুলবুল, ধুমকল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
আগর বাগান: বড়লেখার আজীমগঞ্জ ও সুজানগর এলাকায় বিশাল বিশাল আগর বাগান আর তা থেকে নানা দৃষ্টিনন্দন প্রক্রিয়ায় সুগন্ধি সংগ্রহের দৃশ্য কৌতুল জাগায়। ওখানকার উৎপাদিত আগর সুগন্ধির চাহিদা মিটাচ্ছে দেশ-বিদেশের।
দুর্গম হামহাম: গহীন অরণ্যের দুর্গম হামহাম জলপ্রপাত। ১৫০ ফুট পাহাড়ের উপর হতে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানি আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের গায়ে। হামহাম জলপ্রপাত কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহীন অরণ্যে। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০কি. মি. পূর্ব-দক্ষিণে আয়তন ৭ হাজার ৯৭০ একর। এলাকার পশ্চিমদিকে চাম্পারায় চা বাগান, পূর্ব-দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। এই বনবিটের প্রায় ৯ কি. মি. অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন এই হামহাম জলপ্রপাত। প্রায় ১০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পায়ে হেটে পৌঁছাতে হয় এই ‘ঝর্ণা সুন্দরী’র আঙ্গিনায়।

মাধবপুর লেক:  মাধবপুর লেক। নয়ন জুড়ানো এই লেক জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর চা বাগানের পাদদেশে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পাহাড়ি ও সমতল পথ পেরিয়ে চা বাগানের ভেতরে দেখা মিলে সাপের মত আঁকা-বাঁকা প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটারের আকর্ষণীয় এই লেকের। লেকের ভেতর অসংখ্য শাপলা আর শালুকের মাঝে ভেসে উঠে চিতল, রুই, কাতলাসহ ছোট বড় মাছ। এখানে নানা জাতের মাছ ও পাখির নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ন্যাশনাল টি কোম্পানির মালিকানাধীন চা বাগানের ভেতরে মাধবপুর লেক নিজের রূপ মাধুর্যে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নয়ন কাড়ে।
পাথারিয়া ফুল ঝেরঝেরী ও ফুলবাগিচা জলপ্রপাত: অ্যাডভাঞ্চারপ্রিয় পর্যটকদের মুগ্ধ করতে এই দু’টি জলপ্রপাতের তুলনা নেই। সম্প্রতি লোকচক্ষুর সামনে আসা পাথারিয়ার ফুল ঝেরঝেরী ও ফুলবাগিচা জলপ্রপাত। জেলার বড়লেখা সদর ইউনিয়নের আওতাধীন এ জলপ্রপাত দু’টির রূপ মাধুর্য এখন সবার মুখে মুখে। এই দুই জল সুন্দরীর কাছে পৌঁছাতে দুর্গম পাহাড়ি পথে মিলে পাহাড়ি টিলার পাদদেশে বয়ে চলা ছড়ার স্বচ্ছ শীতল পানি, বুজ প্রকৃতি, বনফুল, চাষনী লেবুর সুবাস, পাখি ও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। এ যেন প্রকৃতির এক অন্যরকম আবেশ। গন্তব্য পথে নানা অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির হাতছানি। দৃষ্টিনন্দন চা বাগান: বাংলাদেশের ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ৯২টি চা বাগানের অবস্থান এ জেলায়। চা বাাগানগুলোর মোট জমির ৪৪ শতাংশ ভূমিতেই তৈরি করা হয়েছে চায়ের বাগান। এ যেন সবুজ দুনিয়ায় চায়ের রাজ্যে। চা বাগানের আওতাধীন ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩০০ একর জমির ৮৫ হাজার ১৪০ একর ভূমিতে গড়ে তোলা এই চা বাগানগুলো বার্ষিক প্রায় সাড়ে ৪ কোটি কেজি চা উৎপন্ন করে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চা বাগানের নৈসর্গিক সৌন্দর্য, শ্রমিকদের পাতা তোলার অসাধারণ কৌশল, কারখানায় চা উৎপাদন প্রক্রিয়া এসব কিছুই পর্যটককে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়।
কমলা, আনারস ও লেবু বাগান: জেলার জুড়ী ও বড়লেখার পাহাড়ি টিলাগুলোতে মনোহর কমলার বাগান। এর সঙ্গে আদা, কাটা ও জাড়া লেবুর বাগান পর্যটকদের মনতুষ্টি আনে। শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের পাহাড়ি টিলাগুলোতে আনারস, লেবু আর নাগা মরিচের বাগান দৃষ্টি কাড়ে যে কারো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status