ঈদ আনন্দ ২০১৮

বিচিত্রিতা

আইনের ফাঁকে-ফাঁকে

আলম তালুকদার

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৫:৪৫ পূর্বাহ্ন

মাননীয় আদালত কার্যবিধির ২৪১ এ ধারার বিধান মোতাবেক আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে তো অভিযোগ (চার্জ) গঠন হবেই না বরং আমার মক্কেল এই মামলার অভিযোগ হতে অব্যাহতি (ডিসচার্জ) পাবে। কারণ; এক নম্বর কারণ দয়া করে নোট ডাউন করবেন স্যার।
এক নম্বর পয়েন্ট। স্যার, বাদী পক্ষে দণ্ডবিধির ৪০৬/৪২০ ধারায় মাননীয় আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছে। একই সঙ্গে একই কাজের জন্য এই দুই ধারায় চার্জ হতে পারে না। এইটা স্পষ্টতই আইনের পরিপন্থি। যেহেতু ঘটনা সত্য নয় সেহেতু ডাবল মিথ্যার সংযোজন করে আইনি বিষয়টা বেআইনিভাবে সাজানো হয়েছে। যা একান্তই উদ্দেশ্যমূলক এবং হয়রানিমূলক।
নাম্বার দুই; আমার মক্কেল বাদিনীর নিকট হতে চেকের মাধ্যমে টাকা গ্রহণ করেছিল এবং সেই টাকা যথারীতি যথাসময়ে গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে বাদিনীকে ফেরৎ প্রদান করেছে। এই সম্পর্কে স্বাক্ষীরা মাননীয় আদালতে এফিডেভিট জমা প্রদান করেছে। মজার ব্যাপার হলো বাদিনীর মানীত স্বাক্ষীরাও হলফ করে টাকা ফেরৎ প্রদানের কথা ঘোষণা করেছে। এই ঘটনায় এবং দলিলে খুব সাধারণভাবেই বুঝা যায় এই মামলাটি মিথ্যা, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যমূলক। এটা অত্যন্ত জোরালোভাবেই প্রমাণিত হয় যে মামলাটির কোন ভবিষ্যৎ নেই, কাজেই বিজ্ঞ আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট না করে ন্যায় বিচারের স্বার্থে  For the end of Justice, sir, এই মামলার আসামিকে এই মামলার অভিযোগ হতে অব্যাহতি প্রদান করা যেতে পারে।
নাম্বার তিন হলো; কথার কথা, যদি মাননীয় আদালত ধরেই দেন বাদিনীর সাজানো মামলার ঘটনাটি বাদিনী তার আপন মনের মাধুরী মিশায়ে আমার মক্কেলকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থে সত্য বলে মিথ্যা মামলা সাজানো হয়েছে। তাহলে আমাদের মহামান্য হাইকোর্ট কি বলেন? মহামান্য হাইকোর্ট রুল দিয়েছেন “ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির যদি দেওয়ানী আদালতে প্রতিকারের বিহিত থাকে তবে ঐ বিষয়ে ফৌজদারি কোনো আদালতে মোকদ্দমা হতে পারে না।” ডি এল আর- ৩০, পৃষ্ঠা নং -৩৩১।
স্যার এই বিজ্ঞ আদালতে এই মামলাটি গ্রহণ করতেই পারেন না। অভিযোগ গঠন তো দূরের কথা। বাদিনীর বিজ্ঞ আইনজীবী তার মক্কেলকে উপযুক্ত দেওয়ানি আদালতে আশ্রয় নেওয়ার সুপরামর্শ দিতে পারতেন। বাই দ্য বাই স্যার, মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ নিম্ন আদালতসমূহ অবশ্যই পালন করতে বাধ্য। এই বিষয়েও মহামান্য হাইকোর্টের রুলিং আছে স্যার।
“প্রদেশের ভিতরে যে সমস্ত নিম্ন আদালত আছে তাদের উপর হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।” ডি এল আর ১০ পৃষ্ঠা নং- ৩৬৬।
তাহলে স্বাভাবতই প্রশ্ন মাননীয় আদালত, কি কারণে কিসের ভিত্তিতে, কোন উদ্দেশে এই মামলা? বিজ্ঞ আদালত। আরো একটি বিবেচ্য বিষয় হলো, বাদিনী তার মামলায় দাবি করেছে ৩০ হাজার টাকা প্রতারণা করে আত্মসাৎ করেছে। যদি তাই হয়ে থাকে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণে মামলাটি প্রমাণ হয়ে যায় তাহলে কি বিজ্ঞ আদালত ৩০ হাজার টাকা আসামিকে জরিমানা করে বাদিনীকে প্রদান করার আদেশ দিতে পারবেন? এই রকম আদেশ প্রদানের এখতিয়ার বিজ্ঞা আদালতকে দেয়া হয়নি। যদিও কার্যবিধির ৫৪৫ ধারায় বাদিকে জরিমানা আংশিক বা সম্পূর্ণ জরিমানা আদায় সাপেক্ষে প্রদানের আদেশ দিতে পারেন।
এখন প্রশ্ন বাদিনী যেখানে তার টাকা ফেরৎ পেতে পারেন অর্থাৎ আদালতে আশ্রয় না নিয়ে এই ফৌজদারি আদালতের আশ্রয় গ্রহণের পরামর্শ আমার প্রতিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী বন্ধু কেন দিলেন তার অন্তর্নিহিত কারণ কি? কারণ একটাই, আমার মক্কেলের মান-সম্মানে, আভিজাত্যে আঘাত করা। জেল-জরিমানাই এর প্রকৃত উদ্দেশ্য। টাকা ফেরৎ পাবার উদ্দেশ্যে এই মামলাটি নয় মাননীয় আদালত। এই আইনের মারপ্যাঁচ আমার প্রতিপক্ষের আইনজীবী বেশ ভালো করেই জানেন। জানেন এই কারণে বলছি কারণ আমরা একই গুরুর শিষ্য। তিনি বাদিনীর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে আমার সম্মানীত মক্কেলকে হেস্তনেস্ত করতে চাচ্ছেন। কিন্ত আমি তুলা ওরফে কটন মিয়া বেঁচে থাকতে সেটা কি করে হয় স্যার?
মাননীয় স্যার। আমার বিজ্ঞ বন্ধু জনাব তুলন্দর রশিদ তুলা ওরফে কটন মিয়া এতক্ষণ তার মক্কেলের দেয়া যে বস্তা পঁচা তথ্য বা ডাটা মাননীয় আদালতের সামনে উপস্থাপন করলেন তাতে তিনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন তা তিনিই ভালো করে বুঝতে পারছেন কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভাবটা এমন যেন আমি এবং আমার মক্কেলই আসামি। তিনি যা বলেছেন অতন্ত গুরুতরভাবে বেশি বলেছেন। আমি স্যার বেশি কথা বলে মাননীয় আদালতের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবো না। কম করে আমি পয়েন্টে পয়েন্টে কথা বলবো স্যার।
বাদী পক্ষের আইনজীবী গলায় একটু রাগ-রাগীনির সুর তুলে চমৎকার বাচনভঙ্গিতে পাল্টা যুক্তি আদালতের সামনে পেশ করেন। বাদীপক্ষের আইনজীবী বদিউর রহমান বদি ওরফে ফুটন মিয়া বলতে থাকেন-
ঃ ইয়ুর ওনার স্যার। আমার ভয়াবহ প্রতিপক্ষের চমৎকার উপস্থাপনায় এক ধরনের দুষ্টতা ও ধৃষ্টতা আছে। তিনি আমার আস্ত মামলার নথি, আর কি সব আচানক কথা মালায় আমাকে ভাসিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তার সাহস এবং বাগ্মীতার প্রশংসা করতেই হয়। তবে তার ভাষ্যে মনে হয় দোষটা যেন আমারই।
একটু চিপা কাশি কেশে আবার বলতে থাকেন-
ঃ মাননীয় আদালতের একটি মামলায় অন্যতম দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি কী? ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং ন্যায়বিচার হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা। আবার ন্যায়বিচার খালি করলেই হবে না, ন্যায়বিচার হয়েছে পক্ষগণ যেন তা দেখতে পায় এবং অনুভব করতে পারে। এখন যদি এই মামলার আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন না করেই ডিসচার্জ করা হয় তাহলে ৪০ মাইল দুর হতে আসা আমার মক্কেল কি করে ভাবতে পারবে এবং অনুভব করতে পারবে যে ন্যায় বিচার করা হয়েছে। শুরু করার আগেই তো শেষ করা যায় না। আর এটাই যদি মামলার ললাট লিখন হয় তাহলে আমার মক্কেল ভাববে সামথিং ইজ রং। বাট ইউ নো ভেরী ভেরী ওয়েল। নাথিং ইজ রং।
আর এই কারনেই শুধু এই কারনেই অসামীর বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন হওয়া একান্ত জরুরি। দ্যাটস অল ইয়্যুর অনার স্যার।
এইটুকু বলে বাদীপক্ষের আইনজীবী বদিউর রহমান ফরফে ফুটন মিয়া তৃপ্তির হাসি হেসে বসে পড়েন। তখন আসামীপক্ষের আইনজীবী দিয়ে দাঁড়িয়ে পাল্টা কিছু বলার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু আদালত ইশারায় তাকে বসে যেতে বলেন।

আদালতে এক ধরনের নীরবতা বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ বিজ্ঞ আদালতের বিচারক নথিপত্র দেখলেন। অতঃপর বাদীপক্ষের আইনজীবীকে আসামির বিরুদ্ধে কি চার্জ হবে তা পাঠ করতে বললেন। বিজ্ঞ আইনজীবী চার্জ শুনান-
‘আপনি হিরণ মিয়া গত ১৪/০৬/২০০০ইং তারিখ সকাল ১১-০০টার সময় বাদিনীর বাড়ি হতে ৩০ হাজার টাকার একটি চেক গ্রহণ করেন। দেই দিচ্ছি করে অদ্যাবধি ঐ টাকা ফেরৎ দেননি। আপনি প্রতারণা করে ঐ টাকা আত্মসাৎ করে দঃ বিঃ ৪০৬/৪২০ ধারায় অপরাধ করেছেন।’ এই পর্যন্ত বলার পর বিজ্ঞ আদালত তার কথার রেশ ধরে বলতে থাকেন যে, আপনি আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শুনেছেন। এখন বলুন আপনি দোষী না নির্দোষ?
আসামি হীরন মিয়ার জীবনে এটাই প্রথম মামলা। শুরু হতেই সে বিভিন্ন রকমের ভয়ে ভীত। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়।
কোর্ট আবার প্রশ্ন করেন- বলুন আপনি দোষী না নির্দোষ?
হীরন মিয়া বলেন, আমি টাকা তো দিয়া দিছি। দোষী কিসের জন্য? তার আইনজীবি তাকে সাহায্য করেন-
ঃ হীরন মিয়া এক কথায় প্রকাশ করেন। বলেন ‘আমি নির্দোষ। বিচার চাই।
ঃ হ স্যার আমি নির্দোষ, আমি কঠিন সাচ্চা বিচার চাই।
বিজ্ঞ আদালত তখন সাক্ষ্য গ্রহনের উদ্যোগ নেন। বাদিনীকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় তোলার জন্য হুকুম দেন।
স্যার, স্যার। আমার একটা বিনীত আরজী আছে স্যার। আমি কিন্ত জবানবন্দীর পর জেরা করতে পারবো না। আর কে কে স্বাক্ষী দিবে তার পূর্ণ তালিকা বিজ্ঞা প্রতিপক্ষ আমাকে সরবরাহ করেননি। কাজেই আমি সাক্ষীর স্বভাব চরিত্র সম্মন্ধে পূর্ব ধারনা না পওয়া পর্যন্ত ন্যায় বিচারের স্বার্থে জেরা করা সম্ভব নয়। এই বলে আসামী পক্ষের আইনজীবি একটি দরখাস্ত পেশকারের নিকট হস্তান্তর করেন।
মাননীয় বিজ্ঞ আদালত আমার বন্ধু যদি আজকে জেরা করতে অপ্রস্তুত থাকেন তবে প্রস্তুত হয়েই আসুক। আমি সাক্ষীদের তালিকা দিচ্ছি। জবানবন্দী আজকে মুলতবি থাকুক। আমি আবেদন করছি স্যার। এই বলে বাদিনীর আইনজীবী পেশকারের নিকট তার আবেদন পেশ করে বসে পড়েন।
ঐ মামলার আসামির সঙ্গে আমার কাকতালীয়ভাবে দেখা। তার দুঃখের বয়ান আমাকে খুব ধৈর্য সহকারে শুনতে হয়েছে মামলা হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে। এখনো সাক্ষী প্রদান শুরুই হয়নি। বাদিনী পক্ষের সাক্ষী এবং জেরা তারপর আসামির ডিফেন্স সাক্ষী ও জেরা এবং সব শেষে উভয়পক্ষের আরগুমেন্ট তারপর না রায়ের প্রশ্ন। তার মানে ছয় মাসও লাগতে পারে।
হীরন মিয়া এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। বংশের এবং আত্মীয়-স্বজন শিক্ষিত এবং অনেকেই চাকরিরত। তার ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতার ভাব লক্ষ্য করি। সে বলেছে আজকে আমার উকিল নেই। কালকে তার উকিল নেই পরশু হাকিম সাব নেই। আবার হয়তো হরতাল র্ধমঘট। এর মাঝে হয়তো কোনদিন নিকট আত্মীয় পগার পার। এই ভাবে বার বার তারিখ ধার্য হচ্ছে। আমরা আসছি যাচ্ছি। হতাশায় ক্ষোভে ভাসছি। এর ফি, ওর ফি, কোর্টের ফি, উকিল স্যারের ফি, সব মিলিয়ে আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। এই মামলায় আমি সব হারাতে বসেছি। ব্যবসা পাতি লাটে উঠেছে। উকিল সাব বলেন উচ্চ আদালতে মোশান রিভিশন করে ২-৩ বছরের তরে মামলা নিখোঁজ করে দেই। কি করি, কারে ধরি, বাবাজি আমাকে একটু সৎ পরামর্শ দেবেন কি? এলাকায় সবাই জানে এই মামলাটি মিথ্যা এবং বানোয়াট। তবু আমি নিরন্তর সাফার করছি। কেন? কি কারণে? এটা কোন আধুনিক সমাজের সিষ্টেম হলো? একজন দুশ্চরিত্র মহিলা বিনা দোষে আমাকে খুব অপমানকরভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে।
এসব বলে হীরন মিয়া দম ছাড়ে। আমি তার কথাগুলো পানের মতো চিবুচ্ছি। তাকে সঠিক উত্তরের ভাষা এবং চাতুরী কোনটাই খুঁজে পাই না। চিন্তা করি একজন নারী যখন প্রকাশ্যে এবং আড়ালে দৃশ্যমান তাহলে যত সহজ সরল বলা হচ্ছে আদতে তা নয়। একটু জটিলতা কূটিলতার দুর্গন্ধ যে আছে তা সহজেই অনুমেয়।

আমি তাকে ভোট চাওয়ার সময়ের আন্তরিকতা এবং গুরুত্ব প্রদর্শন করে চা-মিষ্টি খাওয়াই। সে আবার বলে, আমাদের হাকিম সাবরে তুমি চিনতে পারো। তোমাদের জুনিয়ার টুনিয়ার হবে। আমি বলি চিনি না। মনে মনে প্রমাদ গুনি। চিনলেই কি? হাকিম তো সিস্টেমের বাইরে গিয়ে স্ব উদ্যোগে কিছু করতে পারবেন না। তো না চিনাই ভালো। কিন্তু তার কথায় বুঝতে পারি যে ঐ হাকিম সাবকে আমি চিনি এবং সেও আমাকে চেনে। হয়তো বা। ছোট্ট একটা দেশ। কে কাকে চিনে না। এটা একটা প্রশ্ন নয়। জানা বা চেনা থাকাটাই উত্তর। চা খেতে খেতে সে আমাকে একটা হিসাব দেখালে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। আরো কত যে হবে তার হিসাব গুনতেই মাথা উল্টা পাল্টা!
আমি বলি কি ‘ঐ বেটির সঙ্গে আপস রফা করে ফেললেই তো পারেন। খামাখা টাকা পয়সা ভূত পেত্নীদের দিয়ে লাভ কী?
ঃ বাপু সে চেষ্টা কি মনে করছ করিনি। করেছি, কিন্ত ফেল মারছি। টাউট বাটপার যে আকাশে বাতাসে বিরাজমান তাদের মহা-মূল্যবান রাজকীয় শুভ ইচ্ছার বাণী উচ্চরিত না হলে এই সমাজ অচল এবং নিরুপায়। লুইচ্চা-বদমাশদের উলঙ্গ অশ্লীল উৎসবে এই সমাজ চেঙ্গিতে পড়ে খালি কোহাচ্ছে। তারা কিভাবে কোন যোগ্যতায় যে সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে তা ধারণাতীত।
আমাকে খুব আগ্রহ করে তার বাড়ি নিয়ে যায়। হীরন মিয়ার অনেক গুণ ছিল। বাসায় দেখলাম বাঁশের বাঁশি। বিভিন্ন সাইজের বেঞ্জু, হারমোনিয়াম, তবলা। সব যন্ত্রপাতির উপর ধুলার একচ্ছত্র উপস্থিতি এই হীরন মিয়াকে অনেক ছেলে ফলো করতো। তার বাঁশির সুরে অনেকেই মোহিত হতো। আমাদের এলাকায় সেই প্রথম বেঞ্জু নামক যন্ত্রটি আমদানী করেন। চমৎকার অভিনয় করতো। জীবনের বাস্তবতায় তার অভিনয়ের কলাকৌশল কোন কাজেই আসছে না।
মনে মনে চিন্তাকে আরো গভীরে প্রবেশ করাই। তার সুকুমার গুনাবলি, নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি সব একজন নারীর কারনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাকে বিনা পয়সায় ভালো ভালো উপদেশ দেই। বলি, বাপু বারো মুশকিল তেরো আসান। কোনোভাবে নিজেকে বাঁচান। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। ইত্যাদি ইত্যাদি বলে আমি প্রায় পালিয়েই আসি। সে খুব পীড়াপীড়ি করছিল। কিন্তু অবস্থাটা স্বাস্থিকর নয়, তাই বিদায় নিলাম।
ঘর হতে বের হলেই অবারিত সবুজ। গাছে গাছে সবুজ ঝুলে আছে। সবুজ চাখতে চাখতে হাটতে থাকি। এলাকার একজন মুরব্বী একজন ডাকসাইটে মাতব্বরের সাথে সবুজ বিভ্রাট। দেখি সব সবুজরা পালিয়ে গেল। তিনি আমাকে পাতাবিহীন গাছের ছায়ায় দাঁড় করিয়ে বলতে থাকেন-
ঃ বাবাজি ছুটি কয় দিন?
ঃ আর দুই দিন।
ঃ তা বাবাজি তুমি তো বড় চাকরী করে বেশ মোটাতাজাই হচ্ছ। আমাগো দিকে একটু নজর দিও। আমরা পাইকা জুনা হইয়া গেলাম গা। আমাগো দিকে কেউ ফিরা তাকায় না। বাবাজি তোমার চাকরি আছে। আমাগো তো আর মাস গেলে কেউ বেতন দেয় না। আমরা চলি কিভাবে, হেইডা কি চিন্তা করছ? আমি ভিতরে ভিতরে ঘামতে থাকি। তিনি ফটর ফটর করে বলেই যাচ্ছেন-
ঃ বাবাজি তোমার কাম তো খালি আপস করানি। তা বাবাজি কইনছেন দেহী আপস করলে আমাদের কি হবে?
তার কথায় চাবুক খেয়ে চমকে উঠি। তিনি বলেই যাচ্ছেন- ‘বাবাজী তোমার এই সবে নাক না গলানডাই বালা্‌ তুমি আইছ আমরা খুশি বেরাও টেরাও কুশলাদি পর্যন্ত থাকো্‌। আমরা আছি না, সমাজের ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আমাদের না? তুমি তোমাতেই থাকো। এই এলাকা আমাগো। আমরাই এর দেখভাল করমু। আমরা যেমুন চাই তেমুন চলবে। কি কও বাবাজি? হাচা কইছি না? তুমি বুদ্ধিমান মানুষ, বেশী বলার দরকার কি? আরে বাবাজি সমাজে রাষ্ট্রে যদি মামলা-মোকদ্দমা, কাইজা-ফ্যাসাদ নাই থাকবে তো থানা, কোর্ট-কাছারী, উকিল-মুহুরী কি করবে? তারা কী না খাইয়া থাকবে নি? আর এই মন্দার বাজারে আমরাই বা চলমু কেমনে?  সমাজে দেন -দেরবার সালিশ-নালিশ না থাকলে আমরা যে আছি তা বুঝমু কেমনে? যদি খালি আপস কইরা দেও তো আমাগো কোন দাম থাকবে? কদর  থাকবে? চিন্তা কইরা তারপর কও। আমি কি মিচা কইছি? দশ গ্রামে কোন হালার পুত নাই যে কইতে পারে টাকু মাতবর কোন দিনে একটা মিছা কইছে। আমি আমার বাপের বেটা। হাচা কইতে দারোগা পুলিশরেও খাতির করি না। বুঝলা বাবাজী মামলা আপস অইলে ক্ষতিডা কার? ক্ষতিডা আমার একার না। আমি বাঁইচা না থাকলে এই কথাডার মাজেজা কী?
মামলা চললেই মোরগের রান। মামলা চললেই পোড়াবাড়ির চমচম। এই সব কি এমনি এমনি? কাজ করে পরিশ্রম করে বুদ্ধি খরচ করে আদায় করতে হয়। বাপের পয়সায় আর কতদিন ফুটানি চলে?
আমি মাতব্বরের মহা-মূল্যবান ঐশী বাণী শুনে কিছুক্ষণ তবদা মেরে থাকি। কিছু না বলেই চলে আসি। একটি দীর্ঘশ্বাস অজান্তে বাতাসে কেড়ে নেয়। দীর্ঘশ্বাসের সন্ধানে আমার অক্ষম চোখ দুটি গাছের সবুজ পাতায় আছাড়া খায়। আমি গাছকে বলি, আকাশ কে বলি, পরিচিত রাস্তাঘাটকে বলি, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”। এই চরণটি কি উচ্চারণ করার সৎ সাহস এবং যোগ্যতা আমাদের আছে? আমার নেই? কারো তো নিশ্চয়ই আছে। আমি তার অপেক্ষায় থাকবো। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে থাকি, হাঁটতেই থাকি। 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status