ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

আত্মজনের শামুকবাস

অপু শহীদ

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৪:৪৩ পূর্বাহ্ন

তিনজন। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছে। মা-বাবা মেয়ে। স্বামী স্ত্রী সন্তান। নারী পুরুষ কিশোরী। তিনজন। আলাদা। ঝড় বৃষ্টির দিনে এদিকটায় কেউ বেড়াতে আসে না। হোটেলগুলো প্রায় ফাঁকাই পড়ে থাকে। এ সময়টায় প্রায় অর্ধেক ভাড়ায় রুম পাওয়া যায়। তারমধ্যে সমুদ্র থেকে বেশ দূরে হওয়ায় এদিকে ভ্রমণবিলাসীদের ভিড় একটু কম।
বেশ সস্তায় দোতলায় তিন বেডের এক রুম পাওয়া গেল। এখান থেকে সমুদ্র পেরিয়ে দিগন্তের অনেক দূর দেখা যায়। দেখে মনে হয় দূরে কালো কালো পাহাড়। মেঘ হয়ে উড়ে যাচ্ছে। আবার মনে হয় হিম বরফের ভেলা ভেসে যাচ্ছে।
মুনমুন আর কবির তাদের কন্যা কবিতাকে নিয়ে এখানে এসেছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছে। ইউনিভার্সিটি পাস করা দুই শিক্ষিত মানব-মানবীর পাকা সিদ্ধান্ত। হত্যা করার চেয়ে অনেক মানবিক সিদ্ধান্ত। হাজার হোক অন্তত আধুনিক মানুষ হিসেবে তো তারা অমানবিক হতে পারে না। তাই তারা শেষ পর্যন্ত সহমত পোষণ করেই এখানে এসেছে। তবু মাঝে মাঝে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
একটা সময় ছিল তখনো কবিতার জন্ম হয়নি। বিয়ের প্রথম বছর। একজনের যা ভালো লাগে আরেকজনের তাই ভালো লাগে। একজনের ফুচকা খাওয়া দেখে আরেকজনের জিভে পানি আসে। একজন কাবাব খেলে আরেকজন লাফিয়ে ওঠে। তারপর মিলগুলো হারিয়ে গিয়ে শুরু হলো অমিল। একজন আলো জ্বালিয়ে ঘুমায় তো আরেকজন আলো বন্ধ করে। একজনের চা বেশি মিষ্টি তো আরেকজনের চিনি ছাড়া চাই। এসব পর্বও বেশ অনেক দিন পার হয়ে গেছে। এখন সামাজিক সম্পর্ক কিছুটা থাকলেও মানসিক বা শারীরিক সম্পর্ক শূন্যের কোঠায়। তবু এভাবেই হয়তো দিব্যি চলে যেত তিরিশ চল্লিশ বছর। অন্যদের যেভাবে যায়। তাছাড়া পুরুষতন্ত্র আর নারীবাদ নিয়ে চাপানো-উতোর খেলতে খেলতেও কয়েকটা বছর পার করে দেয়া যায়। কিন্তু গোল বেঁধেছে অন্যত্র।
কবিতা।
খাবার টেবিলে মুনমুন ফিসফিস করে বলছিল।
-এত নির্জনতা আমার কেমন ভয় করছে।
-হ্যাঁ,সত্যিকারের নির্জনতা মানুষকে নির্মম আর খুনি করে তোলে।
-তা তোমার তো ভালই লাগার কথা।
-আর তোমার?
-ভালবাসলে কেউ কখনও খুন করতে পারে না।
-পারে।
-না। পারে না কবির।
-ওথেলো খুন করেছিল দেসদিমোনেকে ভালবেসে।
-আসলে কি ভালবাসা ছিল। আর সেটাতো ছিল নাটক।
-আর আমাদের এটা জীবন। না! আহা জীবন! পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসার জীবন।
এরপর কেউ আর কোনও কথা বলেনি। চুপচাপ খাওয়া শেষ করেছিল।
শূন্য মাঠ।
মাঠের পর মাঠ। বালুর পর বালু। বিস্তীর্ণ নীল আকাশ। হু হু করে বাতাস বইছে। কাছাকাছি সমুদ্রের তটরেখা। বালিতে পা আটকে যাচ্ছে। বাতাসের শব্দ যতটা না কানে লাগছে তারচেয়ে বেশি বুকে বাজছে। তারা এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে।
মাথার উপর একঝাঁক পাখি উড়ে যায়। মুনমুন ভাবে পৃথিবীটা হয়তো একসময় পাখিদের ছিল। সে নিজেই হয়তো পাখি ছিল। ঈগলের মতো। ডানা মেলে নীল আকাশে উড়ে বেড়াতো। এখন সে সবের কিছুই মনে নেই। রোমান্টিকতা আসতে গিয়েও আসে না। কণ্ঠনালীতে ঢোক গিলতে কেমন ব্যথা অনুভব করে।
কবিতার জন্মের পর আরও তিন বছর বেশ ভালই কেটেছিল তাদের। তারপর ধীরে ধীরে অশান্তিগুলো দেখা দিতে শুরু করে। এর পরিবারের লোকেরা ওকে দায়ী করে। ওর পরিবারের লোকেরা একে দায়ী করে। মুনমুনের এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। নার্সিংহোমে কবিতা যেদিন জন্ম নেয় সেদিন ছিল হরতাল। শিশুর রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ। মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ। ডাক্তার বলেছিল জরুরি ইনজেকশান দিতে হবে দুজনকেই। দেশে তখন বেশ ঘন ঘন হরতাল হতো। হরতালের মধ্যেই কবির বেশ অনেকটা পথ হেঁটে গিয়ে ওষুধ জোগাড় করে এনেছিল। এসেই প্রথম মেয়েকে দেখেই চোখ কান আর আঙুলগুলো গুনে ফেললো। হাসি মুখে বলেছিল- না, সব ঠিক আছে।
ছেলে নাকি মেয়ে হবে আমরা আগে থেকেই জানতে চাইনি। নাম ঠিক করে রেখেছিলাম গল্প আর কবিতা। ছেলে হলে গল্প আর মেয়ে হলে কবিতা। উভয়ের শ্বশুরবাড়ির দিককার সবাই খুশি হয়েছিল। ওদের পরিবারে মেয়ের সংখ্যা কম। আর আমার ছোট বোনের মেয়ে না হওয়া পর্যন্ত অনেকদিন ধরে কবিতাই ছিল তিন খালার এক মেয়ে।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। তিন বছরের মাথায় স্কুলে ভর্তি করার পর সবকিছু পাল্টে গেল। জানতে পারলাম কবিতা অন্য বাচ্চাদের মতো নয়। তার একটা অন্য জগৎ আছে। সে ভিন্ন জগতে আমাদের প্রবেশ নিষেধ। আর আমরা যাকে স্বাভাবিক জগৎ বলি সে জগৎ তার মনে কোনও দাগ কাটে না। কবিতার জন্য অন্য ধরনের স্কুল খুঁজতে শুরু করলাম। সেখানে সকলেই প্রতিবন্ধী।
কবিতা কবিতার মতই বেড়ে উঠতে থাকে। তার জগৎ এমনিতেই আলাদা ছিল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে জগৎ আরও কাছের আর আমাদের জগৎ আরও দূরে সরতে থাকলো। চিৎকার, ভাঙচুর ক্রমে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। মুনমুন নিজেই জানে না কোনও একসময় মেয়ের গায়ে হাত তুলতে শুরু করলো।
কবির প্রায় রাতে বাড়ি ফিরে দেখে ঘর যেন যুদ্ধক্ষেত্র। মা-মেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আছে। মেয়ে মার খেয়ে হাঁপাচ্ছে। মায়ের গলা মুখে খামচির দাগ।
-তুমি আবার মেয়ের গায়ে এভাবে হাত তুলেছো?
মুনমুন চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
-ও আসলে মানুষ নয়, জন্তু।
-তাই বলে এভাবে তুমি।
-সারাদিন পর রাতের বেলা বাড়ি ফিরে এমন আলগা দরদ দেখানো যায়। পারলে দায়িত্ব নিয়ে দেখাও।
-দরদ দেখাবা না?
-সারাদিন রাখো তবে বুঝবে।
-আমার পক্ষে সম্ভব হলে ঠিকই রাখতাম।
-কেন সম্ভব নয়? বল? কেন সম্ভব নয়? তুমি যেমন চাকরি করে ভাবছো সব দায়িত্ব শেষ। তেমনি আমিও পারি।
-কী বলছো এসব!
-কেন সত্যি কথা শুনতে কি কষ্ট হচ্ছে? আমাকে হাত পা বেঁধে ফেলে রেখেছো সংসারের ঘানি টানতে। আর জন্তু পয়দা করে তাকে লালন পালনের দায়িত্ব দিয়েছো। আমার এরকম জীবন হওয়ার কথা ছিল না। আমি একা থাকলেও এর চেয়ে ভাল জীবনযাপন করতে পারি।
-যাও না যাও। কেউ তোমায় বেঁধে রাখেনি। তোমার জীবন নিয়ে তুমি নতুন করে ভাবতে পারো। কেউ আটকাবে না।
এরপর কয়েক বছর তারা চাকরি আর সংসার ওলট পালট করে দেখেছিল। এবেলা ওবেলা দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছিল। প্রথম প্রথম কবির বলতো আমার আগে যেন ওর মৃত্যু হয়। তারপর মনে মনে পিতার আগে সন্তানের মৃত্যু কামনা করতো। স্বাভাবিক মৃত্যু হবে না জেনে উভয়ে আবার হাঁপিয়ে ওঠে।
এভাবে পণ্ডশ্রম দিয়ে তো কোনও লাভ নাই। যার নিশ্চিত কোনও ভবিষ্যৎ নেই তার পিছনে কেন অন্যদের জীবন নষ্ট হবে। যে সন্তান দুমুঠো ভাত দেবে না। মুখে পানি দেবে না। মৃত্যুকালে কোনও কাজেই আসবে না। শামুকের মতো যে গুটিয়ে থাকে তাকে লালন পালন করে, তার জন্য মায়া কান্না কেঁদে, ভালবেসে কী লাভ! এ বিষয়ে স্বামী স্ত্রী উভয়ে একমত।
পরিবার অথবা নাপরিবারটি সমুদ্রের কাছাকাছি চলে এসেছে। কবিরের চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। পুরু মোটা গোঁফ। মুনমুনের চোখে রোদ চশমা। কানের পাশের চুল বেয়ে এক ফোঁটা ঘাম নামছে।
দূর সমুদ্রে একটা পাখি ডুবে গিয়ে আবার উড়ে গেল। মাছ নিয়ে উড়লো কিনা ঠিক বোঝা গেল না। কবিতা লাফিয়ে উঠলো।
অবাক! অবাক!
অল্প কয়েকটা শব্দ মাঝে মাঝে বলে। যেমন অনেক গভীর থেকে বলে সুন্দর। কিন্তু ঠিক সুন্দরকে সুন্দর বলছে কিনা বা আমাদের সুন্দর ওর সুন্দর কিনা বোঝা অসম্ভব। আমাদের কাছে ওর সুন্দর কেবল মাত্র একটি শব্দ।
কবিতার পরনে শার্ট। ট্রাউজার। সে বাবাকে শার্ট পরতে দেখে তাই সে শার্ট পরবে। বাবা বলতে সে একটা লোককে বুঝে। সে একটা যে কোনও লোক। হয়তো রোবট হলেও হয়। একটা ঝোকের মধ্যে থাকে সে। একবার কিছু একটা করার ঝোক উঠলে করতেই থাকবে। কিছুতেই থামবে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই কাজ করবে। ঘড়ির পেন্ডুলামের দিকে তাকিয়ে ঝুলন্ত গোলকটা ডানে বামে ঝুলতে দেখলো। যদি মনে ধরে গেল। ব্যাস এইবার গোলকের সাথে তাল রেখে নিজেই দুলতে থাকলো। তখন আর বাধা দেয়া যায় না। ভয়ানক হ
য়ে উঠবে। হাঁটতে শুরু করলো তো হাঁটতেই থাকলো। কাঁদতে শুরু করলো তো কাঁদতেই থাকলো।
এদিকটায় মাঝে মাঝে ফনিমনসার ঝোপ। জগৎ সংসারে ফনিমনসা কী কাজে দেয় জানা নেই। এই যে কত কত বৃক্ষ ফল দেয় না। কাঠ দেয় না। ফুল দেয় না। তবু প্রকৃতি তাদের বাঁচিয়ে রাখে। সমুদ্রে হাজার লক্ষ প্রাণী। আপন খেয়ালে পার করে দেয় গোটা জীবন। মানুষের জীবন কেবল অর্থবহ হতে হবে! এ কার ভাবনা। খামখেয়ালি মানুষদের মেনে নিতে বুদ্ধিমান মানুষদের ভীষণ কষ্ট।
কবিতাকে মাঝখানে বসিয়ে তারা সমুদ্রের পশ্চিম দিগন্তে সূর্য দেখছে। সূর্যটা অনেক বড়। বিরাট ডিমের লাল কুসুম সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে। ঢেউগুলো একটা আরেকটার গায়ে উঠে যাচ্ছে। পৃথিবীতে পনের বছর পার করে এই প্রথম আরেকটি শব্দ উচ্চারণ করলো কবিতা। প্রায় ফিসফিসিয়ে। শব্দটি বাতাসে হারিয়েই গেল।
সঙ্গম।
সমুদ্রের ঢেউ ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে। দু’পাশ থেকে দুজনেই পিছিয়ে আসে। কবিতা একাগ্রতা নিয়ে বসে আছে। সমুদ্র জল কবিতাকে ছুঁয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। কবিতা হাত তালি দেয়।
অবাক। অবাক।
সুন্দর। সুন্দর।
মুনমুন আর কবির আরও কিছুটা পিছিয়ে আসে। কবিতার সেদিকে কোনও খেয়াল নেই। মানুষের কাজ মানুষ করছে। সে তো আর মানুষ নয়। সে তো জন্তু। সে নতজানু হয়ে আসা আকাশ দেখে। জলে স্নান করতে নামা সূর্য দেখে। ঝাঁক বেঁধে হারিয়ে যাওয়া পাখি দেখে। সমুদ্রের ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে ধাক্কা দেয় কবিতার ভিতরে। অনেক কিছুই তার চেনা মনে হয়। সে তো এখানেই ছিল। কোটি কোটি বছর পিছিয়ে পড়ে সে। মনে পড়তে থাকে সব। কোনও এক শামুকের ভিতর গুটিয়ে ছিল সে। মুখ বাড়িয়ে আলোর নাচন দেখে আবার ভিতরে গুটিয়ে যায় সে। তার সেই শামুকঘর একদিন ভেঙে পড়ে। সমস্ত সমুদ্র লাল হয়ে ওঠে। সমুদ্রের লাল আভা শরীরে টেনে নিতে থাকে। এই প্রথম নিজের ভিতরে ভিজে ওঠা টের পায় সে। আবার বলতে থাকে।
অবাক। সুন্দর। সঙ্গম।
কবির আর মুনমুন অনেক দূর চলে আসে। এখান থেকে কবিতাকে আর দেখা যায় না। হাজার বালু কণার বিন্দুর মতো একটা বিন্দু হয়ে গেছে কবিতা। দুজনে দৌড়াতে থাকে। বালুময় ভূমি শেষ হয় না। নির্জনতা শেষ হয় না। সমুদ্রের গর্জন শেষ হয় না। তারা লোকালয়ে ফিরতে চায়। কিন্তু কোথাও কোনও পথ নেই।
নির্জনতা বড় নিষ্ঠুর। সমুদ্র বড় নিষ্ঠুর। নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এর চেয়ে নগর অনেক সভ্য। সব ঢেকে ঢুকে রাখে। নগ্ন হতে দেয় না। নির্জনতা পোশাক খুলে ফেলে। মুখোশ খুলে ফেলে। এমনকি চামড়া ধরে টান দেয়। লোকালয়ে ফিরতেই হবে। কিন্তু চারিদিকে শুধু্‌ ধূ ধূ বালুচর। অন্ধকার নেমে আসছে। অন্ধকারে দুজন দুদিকে ছুটতে থাকে। নগরের সন্ধানে। পিছনে ধাওয়া করে সমুদ্রের গর্জন আর নীরবতা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status