ঈদ আনন্দ ২০১৮
বিশেষ রচনা
শূন্য থেকে শিখরে
আবদুল্লাহ আল মোহন
২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৪:৩৮ পূর্বাহ্ন
ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক অসামান্য গুণবতী, ব্যক্তিত্বময়ী অভিনেত্রীর নাম কাননবালা দেবী। অতি সামান্য অবস্থা থেকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে কিংবদন্তি গায়িকা-নায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অন্যের বাসায় বাসন মেজে, ঝিগিরি করে যাকে একসময়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে, কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে, তিনিই হয়ে উঠেছেন পরবর্তীকালে বাংলা সিনেমার ও সংগীতের সম্রাজ্ঞী ‘কাননবালা দেবী’। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম কাননবালা দেবী প্রথম বাঙালি অভিনেত্রী হিসেবে প্রথম দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার অর্জন করেন।
আলোহীন জগৎ থেকে উঠে আসা এক নারী আপন প্রতিভা ও তন্ময় সাধনায়, অনেক অবহেলা, লাঞ্ছনা, চিত্র জগতের ক্লেদ, আর গ্লানি অতিক্রম করে দীপ্তিময়ী হয়ে উঠেছিলেন। সে এক বিস্ময়কর আলোয় ফেরার কাহিনী। আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্থে কানন দেবী লিখেছেন ‘মরণ পণ করে যে জীবন সৃষ্টি করতে চেয়েছি তাকে নিয়ে আর যাই হোক ছেলেখেলা করা যায় না। ...জীবনের কাছে আমি চেয়েছি মধুর শান্তিনিলয়। স্বপ্নভরা আরামকুঞ্জ, উদার আকাশ”। সংশয় নেই, জীবন বোধে উজ্বল ছিল তার দীর্ঘ শিল্পী ও সামাজিক জীবন। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ছেষট্টি বছর এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে বিজড়িত ছিল একটা নাম কানন দেবী। বলতে গেলে ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণের ১০০ বছরের ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই লেখা আছে তার নাম। শুধু অভিনয় ও সংগীত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এমন নয় প্রযোজনা, পরিচালনা, বিচারক মন্ডলী, ডিরেক্টর বোর্ড, সিনেমা শিল্পের প্রতিটি বিভাগের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন সুদীর্ঘ সময়। দুস্থ মহিলা শিল্পীদের সাহায্যার্থে গঠন করেছিলেন ‘মহিলা শিল্পীমহল’। যুক্ত ছিলেন সামাজিক নানান কল্যাণকর সংগঠনের সঙ্গে। ১৯৯২ সালে কলকাতায় মৃত্যু হয় কানন দেবীর ছিয়াত্তর বছর বয়সে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের ডাক বিভাগ কানন দেবীকে শ্রদ্ধা জানাতে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। তারপর ১৯৭৬ সালে পান চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার ।
২
বাংলা চলচ্চিত্রের এক মর্যাদাময় ব্যক্তিত্ব কাননবালা দেবীর আত্মকথার অনুলেখিকা সন্ধ্যা সেনের ভাষ্যমতে, ১৯১৬ সালের ২২শে মে (বাংলা ৮ জ্যৈষ্ঠ) ভারতীয় চলচ্চিত্রের জ্যোর্তিমণ্ডলের এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের জন্মদিন। সেই হিসেবে ২০১৬ সালেই তাঁর জন্ম শতবার্ষিক ছিল অথচ উপমহাদেশের গোটা চলচ্চিত্র জগতের নীরবতা দেখে ব্যথিত হয়েছি। কারণ কেবল অভিনয় কিংবা সংগীত সাধনাই নয়, সারাটি জীবন তিনি মানবসেবামূলক কাজেও নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। বিশেষত দুস’ ও বয়স্ক শিল্পীদের সাহায্যের জন্য তিনি সব সময়ে সক্রিয় ছিলেন। সেই মানুষটিকে স্মরণ না করাটা মোটেই ভালো কাজ নয়। কারণ কেবল অনিয় কিংবা গানই নয় ১৯৪৯ সালে চলচ্চিত্র প্রযোজনায়ও নামেন কানন দেবী, গঠন করেন শ্রীমতী পিকচার্স। প্রথম ছবি ‘অনন্যা’। তারপর একের পর এক শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’, দর্পচূর্ণ’, নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘অন্নদা দিদি, ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত’ প্রভৃতি, প্রযোজনা কানন দেবীর শ্রীমতী পিকচার্স আর পরিচালনায় স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য। অন্নদা দিদির ভূমিকায় অভিনয়ের পর কানন আর কোনো ছায়াছবিতে অভিনয় করেননি। অভিনয় করেননি, কিন্তু সিনেমা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন আমৃত্যু। উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালের ১৭ই জুলাই কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৩
অনন্য কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক এই শিল্পী বিভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন: কানন দাস, কাননবালা, কাননবালা দেবী। তবে সংক্ষেপে কানন দেবী কিংবা তিনি সাধারণে ‘কাননবালা’ নামেই সুপরিচিত ছিলেন। অভিনেত্রী, কণ্ঠশিল্পী কাননবালা দেবী পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রতন চন্দ্র দাস এবং মায়ের নাম রাজবালা দেবী। তবে জানা যায়, রাজবালা ছিলেন রতন চন্দ্র দাসের রক্ষিতা, বিবাহিত পত্নী নন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় কাননবালা দেবীর বহুল পঠিত ও জনপ্রিয় আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’। জীবনী থেকেই জানা যায় তার জীবনের কঠোর পরিশ্রম, একনিষ্ঠ সাধনা, একাগ্রতার কথা, স্বপ্ন আর প্রবল আশাবাদী সংগ্রামী যোদ্ধার কাহিনী। জানা যায়, ছবি করা ছেড়ে দিলেও দুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত? অভিনেত্রীদের জন্যে আমৃত্যু তার চিন্তাভাবনা কখনও থামেনি।? তৈরি করেছিলেন ‘?মহিলা শিল্পী মহল’?। সাহায্য করেছেন বহু শিল্পীকে। একসময় নিজে কষ্ট করে বড় হয়েছেন তাই অন্যের কষ্ট দেখলে পাশে দাঁড়াতেন সঙ্গে সঙ্গে। তবে, এসব কথা ঘটা করে বলেননি কখনও। কিন্তু নিজের যাত্রাপথের সত্যকে গোপন করেননি তাঁর আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’?তে। এমন এক মহৎ জীবনকে আমাদের সামনে আনার জন্যে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ এই বইয়ের অনুলেখিকা সন্ধ্যা সেনের কাছে। আরেকটি জীবনীগ্রন্থের কথাও উল্লেখ না করলেই নয়। মেখলা সেনগুপ্তার . KANAN DEVI: THE FIRST SUPERSTAR OF INDIAN CINEMA, । এক সময় সারা ভারতবর্ষ জুড়ে দুর্বার আকর্ষণ ছিল বঙ্গললনা কাননবালার প্রতি! আর তাই কাননবালার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে, কোন এক বিশেষ আকর্ষণে বিশ্বখ্যাত ‘লন্ডন বিজনেস স্কুল’-এর গ্রাজুয়েট মেখলা সেনগুপ্তা জার্মান ব্যাংকের লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে কাননবালার জীবনী লিখতে উদ্বুদ্ধ হন। গ্রন্তুটির লেখিকা মেখলা সেনগুপ্তা প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এই মহানায়িকার জীবন সংগ্রামের অনেক অজানা কাহিনী।
৪
রূপোলি জগতের বাইরে একটু নজর দিলে দেখতে পাবো সেকালে যার সূক্ষ্ম রুচিবোধকে যামিনী রায় থেকে বিষ্ণু দে সম্মান করে চলতেন সেই ডাকসাইটে আইসিএস অফিসার অশোক মিত্র স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ১৯৪১ সালে তিনি যখন কৃষ্ণনগরে, স্বামীর সঙ্গে তখন কানন এলেন শ্বশুরালয়ে। কেবল তার অপরূপ রূপ বা কোকিলবিনিন্দিত সুর নয়, তার কথা-বলা হাঁটাচলার মধ্যে অপূর্ব রুচিবোধের হদিস পেয়েছিলেন অশোক মিত্র। তিনি প্রশ্ন করেছেন, উত্তরও খুঁজেছেন- কোত্থেকে পেলেন কানন এই রুচিবোধ? এ-ও পরিশীলন, তার সুর ও অভিনয়ের মতো। আর জনপ্রিয়তার কথা? ‘চলো, তোমাকে আমার কলেজ দেখিয়ে আনি’, বলে বিলেত ভ্রমণকালে কাননের ননদাই বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ তাকে ক্যাম্ব্রিজে নিয়ে গেছেন। সেদিন বোধহয় ক্যাম্ব্রিজের সব ক্লাসই মুলতবি হয়ে গেল, ভারতীয় ছাত্রেরা ভিড় করে কাননবালাকে দেখতে এসেছে বলে। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে। মেট্রো গোল্ডুইন-মেয়ার স্টুডিও দেখে বেরিয়েছেন, লস এঞ্জেলসের কাগজ হেডিং করলো, ‘ভারতের গ্ল্যামার কুইনকে এসকর্ট করে নিয়ে এসেছেন এক স্টাটিস্টিশিয়ন!’ হ্যাঁ, এ রকম সব নানা রকমের ‘ছুট্কাহানী’ (anecdote)-তে ভরা মেখলা সেনগুপ্তার বইখানি। তিনি উল্লেখ করেছেন- ব্রাহ্মসমাজ ও শান্তিনিকেতনের গণ্ডী ছাড়িয়ে রবীন্দ্রসংগীতকে আমবাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ায় কাননের কৃতিত্ব পঙ্কজকুমার মল্লিকের সমতুল্য। বইটিতে অবধারিত এসেছেন তার সহানুভূতিশীল (দ্বিতীয়) স্বামী নেভি-অফিসার হরিদাস ভট্টাচার্যের কথা, সফল ফিল্ম-প্রযোজনা ব্যবসায়, কাননের অগাধ দানের প্রসঙ্গ, তার আধ্যাত্মিক জীবন। ১০০ বছর আগের এক নারী, যার প্রসঙ্গে সেই সময়ের নবীন-প্রবীণেরা একই সুরে গাইতেন, ‘আমি বনফুল গো...’ যেন চোখের সামনে কাননবালা মূর্ত হয়ে ওঠেন এই বই পড়তে পড়তে। আজকের বাঙালি প্রজন্মের জন্যে ইংরেজিতে লেখা বইটি পড়ে নানান তথ্য জানতে পেরে শ্রদ্ধা বেড়ে যায় কারণ ভারতের শ্রেষ্ঠ মহানায়িকা ছিলেন এই বাংলারই, কলকাতার, আদতে এক ঘরহীনা কুলহীনা ধনহীনা নারী, যাকে কাননবালা থেকে কাননদেবী-তে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিলেন তার অগণ্য ভক্তকুলই, যাদের উদ্দেশ্যে সেই মহীয়সীর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’।
৫
‘কে বাবা কে মা দিয়ে কী হবে! আমার কাননবালা পরিচয়ই যথেষ্ট’। এক সময় স’ান ছিল নিষিদ্ধ পাড়ায়, পরিচারিকার কাজও করেছেন জীবনে। তাঁর বাবার প্রকৃত পরিচয় জানেন না কেউ! কাননদেবীর শতবর্ষ স্মরণে সেই শিল্পীকে নিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য যথার্থই লিখছেন, ‘কাননদেবীকে সুচিত্রা সেনের আগের জমানার ‘সুচিত্রা সেন’ বললে খুব একটা ভুল হয় না। সেই অপরূপ মুখশ্রী! মুহূর্তের পর মুহূর্ত আলো নেওয়া আর ক্যামেরার লেন্সে উদ্ভাসিত হয়ে থাকার ক্ষমতা! পরের পর ছবি হিট করানো, রুপোলি পর্দা ও পর্দার বাইরেও সমানভাবে নায়িকা থাকা, ইন্ডাস্ট্রির মাথাদের কব্জায় আনা, নিজেকে প্রায় একটা ব্র্যান্ডে গড়ে নেওয়া! এবং সর্বোপরি, কয়েক প্রজন্মের পুরুষের স্বপনচারিণী হয়ে ভেসে থাকা সুচিত্রার কেরিয়ারের নীল নকশাই যেন তৈরি করে গেছিলেন কানন দেবী। চাইলে সুচিত্রাকেও পরের যুগের কানন বললে সিনেমার মানহানি হয় না।’
৬
বাংলা চলচ্চিত্রের এক মর্যাদাময় ব্যক্তিত্ব কানন দেবী। কাননবালা থেকে কাননদেবী। তখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নিতান্তই শৈশব। কাননের জন্মের তিন বছর আগে সবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথচলা শুরু হয়েছে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃত দাদা সাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’-এর মুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯১৩ সালে। কলকাতায় পার্শি ব্যবসায়ী জে.এফ. ম্যাডান গঠন করেছেন চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক প্রদর্শনের পথিকৃত প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাডান থিয়েটার’। এক সহৃদয় ব্যক্তির হাত ধরে ১০ বছরের কিশোরী কানন পা রাখলেন ম্যাডান থিয়েটারের স্টুডিওতে, সংস্পর্শে এলেন পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেটা ১৯২৬ সালের কথা, তখনো চলচ্চিত্র শব্দহীন, নির্বাক যুগ চলছে। দশ বছরের কিশোরী কাননের প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’ এ ‘রাধা’ চরিত্রে। পারিশ্রমিক পেলেন পাঁচ টাকা। চলচ্চিত্রজীবনে কাননের প্রথম উপার্জন। এর পর ‘শঙ্করাচার্য’তে অভিনয় করলেন কানন, সেটিও নির্বাক ছবি। ১৯৩১ সালে বাংলা ছায়াছবি কথা বলতে শুরু করলো, ১৯৩১ সালের ১১ই এপ্রিল সবাক কাহিনিচিত্র অমর চৌধুরী পরিচালিত ‘জামাই ষষ্টি’ মুক্তি পেল। ঐ বছরেই কাননের প্রথম সবাক চিত্রে অভিনয় ম্যাডান থিয়েটারের ‘জোর বরাত’ ছবির নায়িকা চরিত্রে। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩১ সালের ২৭শে জুন। এরপর ১৯৩৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শ্রী গৌরাঙ্গ’ চলচ্চিত্রে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ চরিত্রে অভিনয় ও গানে কানন শিল্পীর সম্মান ও প্রতিষ্ঠা পেলেন। ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ মুক্তি পাওয়ার পর কাননের গানের খ্যাতিও বিস্তৃত হলো, ডাক পেলেন গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে। কাননদেবী তার আত্মকথায় লিখেছেন ‘এই সময় স্টুডিও থেকে ক্রমশ গ্রামোফোন কোম্পানি অবধি কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হোল...গান এসে আমার অভিনয়ের পাশে দাঁড়াতেই মনে হলো আমার জীবনের এক পরম পাওয়ার সঙ্গে শুভদৃষ্টি ঘটল। ... নিজেকে যেন নতুন করে চিনলাম” (‘সবারে আমি নমি’)। তারপর কত ছবি, কত গান- কানন হয়ে উঠলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার, ‘মহা নায়িকা’। চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের বাইরে গ্রামোফোন রেকর্ডে কানন দেবীর কণ্ঠের কিছু গান তো ‘লিজেন্ড’ হয়ে আছে শ্রোতাদের কাছে। ‘আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে...’, ‘সাপুড়ে’ ছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’, ‘সাথী’ ছবিতে সায়গলের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ‘বাবুল মোরা নৈহর ছুটল যায়’ এখনও তন্ময় সংগীতপ্রেমীদের মুগ্ধ করে। কাননের আরো একটি গান ‘লিজেন্ডে’র মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৪৭ সালের অগস্ট মাসে লন্ডনের ‘ইন্ডিয়া হাউস’-এ তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে। ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন তখন লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার। সেখানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে কানন গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু, এখন ওগো কর্ণধার তোমারে করি নমস্কার’ গানটি।
৭
১৯৩৬ সালে রবীন্দ্র-কাহিনী নয় এমন চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র সংগীতের প্রয়োগ করলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে কানন দেবী গাইলেন ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ এবং ‘আজ বিদায় বেলার মালাখানি’। এই সুবাদে কানন হয়ে গেলেন শান্তিনিকেতন ঘরানার বাইরে রবীন্দ্র-গানের প্রথম মহিলা-কণ্ঠ। তারপর অজস্র ছায়াছবি ও গ্রামফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন কানন। সেকালে রবীন্দ্রনাথের গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে পঙ্কজকুমার মল্লিকের মত কানন দেবীরও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সংগীতপ্রধান ছবি ‘বিদ্যাপতি’ (১৯৩৮)তে অভিনয় ও গায়িকা রূপে কানন খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেছিলেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কানন না সংগীত শিল্পী কানন- কে বড় সে প্রশ্নের মীমাংসা হবার নয়। কাননের নিজের কথায় “আজ আমার অভিনেত্রী পরিচয়টাই সকলের কাছে বড়। কি আমার নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি দামি আমার গানের মহল ...” (‘সবারে আমি নমি’)। পণ্ডিত আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন। গান শিখেছেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের কাছে। সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, ‘কানন কিন্তু একাই এক নিখুঁত, অতুলনীয় প্যাকেজ। আর গান বলে গান! কার নয়? আর হায়, কী গান! কী বাংলায়, কী হিন্দিতে। রবীন্দ্রনাথ সিনেমায় তার গানের চিত্ররূপ অনুমোদন করলে সেই প্রথম গানটি ছিল কাননের ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে’। গান নিয়ে করা প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবি দুরন্ত হিট হওয়ার পর হিন্দুস্তান রেকর্ডজে কবিকে প্রথম দেখা কাননের। প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ আলাপ করাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এ হল কানন, তারকা অভিনেত্রী।’’ কানন প্রণাম করতে রবীন্দ্রনাথ ওঁর ঠোঁট ছুয়ে বলেছিলেন, ‘‘কী সুন্দর মুখ তোমার! গান করো?’’ এ ঘটনা ‘বিদ্যাপতি’ ছবির সময়কার। কবির মনে ছিল না এই মেয়েটিই ‘মুক্তি’-তে ওঁর গান গেয়েছে। প্রশান্তচন্দ্র তখন যোগ করলেন, ‘‘ও তো আপনার গান গেয়েই বিখ্যাত।’’ রবীন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, ‘‘তাই? তা হলে একবার শান্তিনিকেতনে এসে গান শুনিয়ো আমাকে।’’ সেই সৌভাগ্য কাননের আর হয়নি।’ ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর করা একখানি ছবি উপহার পান কানন দেবী। এ সংবাদটি কেমন করে যেন পৌঁছেছিল কলকাতার উঁচু মহলে। এ প্রসঙ্গে কানন দেবী বলেছিলেন ‘ কি যেন একজন ফোনে জানাল অভিনেত্রীর কবির নাম স্বাক্ষরিত ছবি রাখার অধিকার নেই।’
৮
অথচ মাত্র নয় বছর বয়সে তার পিতা মারা যায়। অসহায় মাতা দুই কন্যাকে নিয়ে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িত আশ্রয় নিয়ে ঝিয়ের কাজ করেন। সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর মা-মেয়েতে মিলে ঝিয়ের কাজ করেন। তার আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্তেু তাঁর বড় হয়ে ওঠার এসব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ছোটবেলায় পরের বাড়িতে লাথি-ঝাঁটা খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে হয়েছে। খাবার জুটত না দু’বেলা। বাবা রতনচন্দ্র দাস মার্চেন্ট অফিসে কাজ করতেন। একটা ছোটখাটো সোনা-রূপার দোকানও ছিল। কিন্তু নানান কুঅভ্যাসের জন্যে আয়ের চেয়ে ব্যয়ই ছিল বেশি। ফলে, প্রচুর ধারদেনা রেখে যখন অকালে মারা গেলেন রতনচন্দ্র, তখন সেই ঋণ শোধ করতে ছোট্ট কাননের মাকে সর্বস্ব বিক্রি করে পথে নামতে হলো। সেই কাননই পরবর্তীকালের বাংলা সিনেমা ও গানের কাননবালা থেকে অদ্বিতীয়া কানন দেবী হয়ে ওঠেন। জীবনের এইসব অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করেননি কানন দেবী। বরং সেই কঠিন অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে আরও বেশি খাঁটি, আরও বেশি মানুষ হয়ে উঠেছেন তিনি। তবে, সেইসব কথা স্বীকার করার মতো তেজ ও সততা তার ছিল। তাই, এমন কথাও তিনি স্বীকার করেছেন, বড় হয়ে তিনি কারও কারও কাছে শুনেছেন, বাবার বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন না তার মা। এর উল্টো কথাও শুনেছেন। কিন্তু, নিজের আত্মকথায় তিনি বলেছেন, ‘এ নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমি ‘মানুষ’, সেই পরিচয়টাই আমার কাছে যথেষ্ট। শুধু দেখেছি, বাবার প্রতি তার আনুগত্য ও ভালবাসা কোনও বিবাহিত পত্নীর চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। হয়তোবা সেই ভালবাসা-জাত কর্তব্যবোধের দায়িত্বেই বাবার সমস্ত ঋণভার অম্লানবদনে মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। তাই দরিদ্রের সংসারের যা কিছু সোনা-দানা ও বিনিময়ে অর্থ পাওয়ার মতো জিনিসপত্র ছিল, সব বিক্রি করে বাবার ঋণ শোধ করলেন।’ ‘এরপরই শুরু হল চরম দুরবস’া। একবেলা আহার সব দিন জুটত না। জীর্ণতম বস্ত্র মায়ের অঙ্গে, আমার অবস’াও একইরকম।’ এই সবই কানন দেবীর নিজের কথা।
৯
তারপর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে কাকুতি-মিনতি করে আশ্রয় জোটানো। কিন্তু, কানন আর তার মা আশ্রয় নেওয়ার পর সেই আশ্রয়দাতা বাড়ির ঝি, রাঁধুনি দুই ছাড়িয়ে ছিলেন। এই সব কাজ করতে হতো কানন আর তার মা-কে। এবং প্রতি মুহূর্তে অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা শুনতে হতো তাঁদের। একদিন মায়ের হাত থেকে চায়ের প্লেট পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল। তখন বাড়িসুদ্ধ সবাই তেড়ে মারতে গেল মা-কে। দশ বছরের কানন মায়ের হাত ধরে সেদিন আবার রাস্তায় নেমে আসে। এর চেয়ে উপোস করে মরাও ভালো, এটাই মা-কে বলেছিল সেই ১০ বছরের মেয়েটা। এরপর বারো ঘর এক উঠোনের এক বাড়িতে ঠাঁই। তখনই পরিচিত এক ভদ্রলোক তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা। তাকে কাকাবাবু বলত ছোট্ট কানন। কাননের মিষ্টি মুখ, মায়াবী চোখ দেখে ছবিতে কাজ করার জন্যে তিনি নিয়ে যান বিখ্যাত পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বাংলা চলচ্চিত্রের তখন শৈশব অবস’া। বুলি ফোটেনি। নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’-এ সুযোগ হলো রাধার চরিত্রে অভিনয় করার। ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেডের সেই ছবিতেই প্রথম ফুল ফুটল কাননের অভিনয়ের। সেটা ১৯২৬ সাল। এই ছবির পর চার বছর ছিল কাননের প্রস’তি পর্ব। ম্যাডান কোম্পানির ব্যানারেই তৈরি হলো বাংলার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র ‘ঋষির প্রেম’। এই ছবিতে উৎপলার ভূমিকায় অভিনয় করলেন, গানও গাইলেন কাননদেবী। সেটা ১৯৩১ সাল। ওই বছরেই ছোট ছবি ‘জোর বরাত’-এ তিনি নায়িকা এবং ‘প্রহ্লাদ’ ছবিতে তিনি নারদের ভূমিকায়।
১০
অভিনয় ছাড়াও দশকের পর দশক তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও বাংলা সংগীতজগতে অসাধারণ অবদান রাখেন। সুকণ্ঠের জন্য তিনি শৈশব থেকেই সুনাম পেয়ে এসেছেন। কিন্তু আর্থিক দুরবস’ার জন্য তার মা তাকে ভালো শিক্ষকের কাছে গান শেখানোর ব্যবস’া করতে পারেননি। তার সহজাত সংগীত প্রতিভার বদলে তিনি ছবিতে কণ্ঠদান করতে‘ পেরেছিলেন। পরে অবশ্য কাননদেবী ওস্তাদ আল্লা রাখার কাছে তালিম নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত এবং আধুনিক বাংলা গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সেকালের বিখ্যাত গায়ক, সুরকার এবং সংগীত শিক্ষক রাইচাঁদ বড়াল, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, পঙ্কজ মল্লিক, অনাদিকুমার দস্তিদার, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র প্রমুখের কাছে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে গান শিখেছিলেন। তার গাওয়া নজরুলসংগীত ‘আমি বনফুল গো’ এক সময়ে যেমন অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, আজো রসিক শ্রোতার মনে সমান দোলা দেয়। তার গাওয়া জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে’, ‘তার বিদায় বেলার মালা খানি’, ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’, ‘তোমার সুরের ধারা’ আমার বেলা যে যায়’, ‘বারে বারে চেয়েছি, পেয়েছি যে তারে’, ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’, ‘সেই ভালো সেই ভালো’, ’একদিন চিনে নেবে তারে’, ‘কাছে যবে ছিল হলোনা যাওয়া’, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’, ‘এত দিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে’।
১১
কানন দেবী অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। কাননদেবী যখন চলচ্চিত্রে আসেন, তখন অভিজাত ঘরের মেয়েরা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আসতেন না। এমনিতে কাননবালা ছিলে অভাবী ঘরের, অন্য দিকে ছিলেন রক্ষিতার কন্যা। এই কারণে, তাঁর সামাজিক মূল্য ছিল অতি নিম্ন। চলচ্চিত্রে আসার পর, তার এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। পরিচালকরা তাঁকে দিয়ে প্রায় নগ্নদশায় পর্দায় উপস্থিত করার চেষ্টা করেন। তার পুরোমাত্রার অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। তার প্রথম সবাকচিত্র ‘জোর বরাত’ (১৯৩১)। রাধা ফিল্মসের সবাক ছবি ‘জোরবরাত’-এ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই ছবির পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে নায়ক জোর করে তাকে চুম্বন করেন। এই আচরণে তিনি ক্ষুব্ধ হলেও, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তাঁর বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। এরপর তিনি অভিনয় করেন ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘শঙ্করাচার্য’, ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’, মা ছবিতে। ১৯৩৫ সালে সতীশ দাস গুপ্তের ‘বাসবদত্তা’ ছবিতে তিনি প্রায় নগ্ন হয়ে অভিনয় করতে বাধ্য হন। অথচ শোনা যায়, ছবি নির্মাতারা তাকে অভিনয়ের সম্মানীও ঠিকমতো দেন না।
১২
১৯৩৫ সালে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে অভিনয় করে সুখ্যাতি লাভ করেন। এই ছবিতে তিনি নিজের কণ্ঠে গীত গানের সাথে ঠোঁট মেলান। এ সময়েই তিনি কাননবালা থেকে কানন দেবীতে পরিণত হন। অপরূপা কানন এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যে, রাস্তার ধারে তার আলোকচিত্র বিক্রি হতে শুরু করে এবং তার পোশাক, অলঙ্কার, চলাফেরা ইত্যাদি নারীদের জন্যে ফ্যাশনে পরিণত হয়। ১৯৩৬ সালে দেবকী বসুর ‘বিদ্যাপতি’ তাকে অসাধারণ জনপ্রিয়তা দেয়। আর, প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ তো বাংলা ছবির ইতিহাসেই অবিস্মরণীয় সংযোজন। মুক্তি-র সংগীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। এ ছবিতে কানন দেবীর অভিনয়ও যেমন, তার গলার রবীন্দ্রসংগীতও বিদগ্ধ দর্শক, শ্রোতাদের কানন-অনুরাগী করে তোলে। কাননদেবীর কণ্ঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে’ শুধু মুক্তি-র রবীন্দ্রসংগীত হয়ে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। তবে, তার কণ্ঠে দ্বিভাষিক ‘শেষ উত্তর’ বা ‘জবাব’ ছবির ‘তুফান মেল’ গান মাতিয়েছিল সারা ভারতের মানুষকে। ‘শেষ উত্তর’-এর ‘আমি বনফুল গো’ গানটাও বাঙালি কোনওদিন ভুলবে না। ভোলা যাবে কানন দেবীর গাওয়া ‘যদি ভালো না লাগে তো দিয়ো না মন’? না, ভোলা তো যাবেই না, সেই চল্লিশের দশকে সুশীল মজুমদারের ‘যোগাযোগ’-এ তার কণ্ঠে এ গান শুনে আপামর বাঙালি মন দিয়েছিল তাকে।
১৩
আগেই জেনেছি, দেবকী বসু পরিচালিত ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে অভিনয় করে কাননবালা খ্যতির শীর্ষে উঠে আসেন। এই বছরেই মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মুক্তি’ ছবির মাধ্যমে তিনি প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সেকালের প্রখ্যাত নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে ‘মুক্তি’ এবং আরও কয়েকটি ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন। এই বছর থেকে দরিদ্র সস্তা অভিনেত্রী ‘কাননবালা’ থেকে তিনি সম্ভ্রান্ত ‘কাননদেবী’ হয়ে উঠেন। আর্থিক দুরবস্থার কারণে, এই সময়ে বাছবিচার ছাড়া তিনি বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৩৬ সালে ‘কৃষ্ণ সুদামা’, ‘কণ্ঠহার’, ‘বিষবৃক্ষ’ খুনি কৌন (হিন্দি) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। এই বছরে তিনি নিউ থিয়েটার্স-এ যোগদান করেন। ১৯৪১ সালে কানদেবী নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে নিজের পছন্দমতো বইয়ে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৪২ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘শেষ উত্তর’ ও তার হিন্দি ‘জবাব’ ছবিতে তিনি বিশেষ সাফল্য পান। বিশেষ করে তার ‘তুফান মেল’ গানটি তাকে অভিনেত্রীর পাশাপাশি গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত হিন্দি বাংলা মিলিয়ে বেছে বেছে অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেন। তার জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে আছে বিদ্যাপতি, সাথী, পরিচয়, শেষ উত্তর, এবং মেজদিদি। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের ভিতরে তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো ছিল ‘স্ট্রিট সিংগার সাথী (১৯৩৮), সাপুড়ে (১৯৩৯), জওয়ানি কি রাত (১৯৩৯), পরাজয় (১৯৪০) ইত্যাদি অন্যতম। ১৯৪৮ সালে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করেন, প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রীমতী পিকচার্স’ এবং এই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনার দিকে মন দেন। এই সময় তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরিতে মনোযোগী হন। ১৯৫৯ সালে তিনি শেষবারের মতো অভিনয় করেন ‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদা দিদি’। তিনি এ সময় পর্যন্ত বিশেষত মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
১৪
তেইশের তরুণী কানন চেয়েছিলেন জীবনকে শুদ্ধ, সুন্দর করে গড়ে তুলতে। তখনকার সমাজ নিদারুণ আঘাত করেছিল কাননের প্রথম প্রেমকে। সেই পরম পাওয়ার আনন্দসুধা অঞ্জলি ভরে পান করতে পারেননি তিনি। ১৯৩৯ সালে তেইশ বছরের তরুণী কানন বিবাহ করেন প্রখ্যাত ব্রাহ্মসমাজী শিক্ষাবিদ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পুত্র অশোক মৈত্রকে। ভিক্টোরীয় শুচিতার প্রতীক হেরম্ব মৈত্রের পুত্রের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে সখেদে কানন লিখেছেন ‘সমাজ আমাদের মিলনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সম্ভ্রমের বরণডালা দিয়ে বরণ করেনি। ... আমাদের দুঃসাহসের সাক্ষী হয়েছে, কিন্তু উৎসবের আলো জ্বালিয়ে একে অভিনন্দিত করেনি ...। আজও মনে পড়ে, বারান্দায় দাঁড়াতে সাহস করতাম না, পাছে কারো কোন বিরূপ মন্তব্য কানে আসে। নানান কুরুচিপূর্ণ কদর্য ভাষার প্যামফ্লেট ছাপিয়ে উঁচু স্বরে হেঁকে বিক্রি হ’ত আমারই বাড়ির সামনে ...। নিঃসম্বল অসহায় একটা মেয়ে। কত ঝড় তুফান পেরিয়ে ছুটছে আর ছুটছে। কিন্তু তার সেই বিরামহীন চলা, গ্রন্থিহীন তপস্যার এতটুকু মূল্য কেউ কোনদিন দেয়নি। চেয়েছে তাকে ব্যর্থতার সমাধিতে নিশ্চিহ্ন করে দিতে” (‘সবারে আমি নমি’)। সে বিবাহ স্থায়ী হয়নি, বেশিদিন টেকেনি। সেকালীন রক্ষণশীল সমাজ প্রবল নিন্দাবাদ করেছিল বংশগৌরবহীন একজন চিত্রাভিনেত্রীর সঙ্গে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিবাহে। জানা যায়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি তাদের বিবাহে আশীর্বাণী ও প্রীতি উপহারস্বরূপ একটি ছবি পাঠিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। এক চিত্রভিনেত্রী রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর করা ছবি পাবে কেন! বিয়ের সময় কাননের কাছে শর্ত ছিল বিবাহের পর চিত্রাভিনয় ত্যাগ করতে হবে। ব্যক্তিত্বময়ী কানন সম্মত হননি। ১৯৪৫ সালে কানন তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ নেন। বিবাহ-বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সত্ত্বেও প্রথম স্বামীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন, অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা তাঁকে প্রথম সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য। পরবর্তীকালে, অশোকের দিদি রানী মহলানবিশ, তার স্বামী প্রখ্যাত পরিসংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ কিংবা অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গে কাননের অন্তরঙ্গতা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিল না ।
১৫
কানন দেবীর জীবন সংগ্রাম, প্রেম ও বিবাহিত জীবন নিয়ে অনেক কাহিনি জানতে পারা যায় শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের রচনায়। তিনি লিখছেন, ‘কানন দেবী তাঁর আত্মজীবনীতে একটি নাম উচ্চারণই করলেন না। তার প্রথম স্বামী অশোক মৈত্রের! এক অতীব অকিঞ্চিৎকর পরিস্থিতি থেকে এই বিয়ে হয়েছিল আভিজাত্যে ওঠার এক স্বর্গীয় সিঁড়ি। কারণ শ্বশুরবাড়ি মৈত্র পরিবার ছিল বাঙালি সমাজের ক্রেম দ্য ল্য ক্রেম। মান্যতার ফিরিস্তিটা একবার শুনুন।’... তার স্বামী অশোক অক্সফোর্ড ফেরত। দেশে ফিরে কবির বিশ্বভারতীতে পড়ানো শুরু করেছেন। ওঁর পাশাপাশি তখন ওখানে পড়াচ্ছেন বলরাজ সাহনি। অশোকের বোন রানীর বিয়ে হয়েছিল সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সঙ্গে। আর বাবা? এই এক মহৎ পরিচয় ও বৃহৎ সমস্যা। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ও সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। হেরম্বচন্দ্র সম্পর্কে চমৎকার গল্প আছে শিক্ষিত মহলে। তার একটা হল তিনি শ্যামবাজারের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। এক ছোকরা ওঁকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, স্টার থিয়েটারটা কোন দিকে?’’ থিয়েটার হলের খোঁজ চাওয়ায় রাগে গরগর হেরম্বচন্দ্র বললেন, ‘জানি না!’ বলেই হেঁটে চললেন। খানিক গিয়েই দোটানায় পড়লেন নীতিবাদী অধ্যাপক। সে কী, একটা নির্দেশ দেবেন না বলে মিথ্যে বললেন! সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ফিরে ছোকরাকে গিয়ে ধরলেন আর বললেন, সেই নীতিবাদী টোনে, ‘‘জানি, কিন্তু বলব না!’’ হেরম্বচন্দ্রের অন্য গল্পটাও অদ্ভুত। কলেজে অপূর্ব নিষ্ঠা ও আবেগে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা পড়ান অধ্যাপক। হঠাৎ এক দিন কবির জীবনীতে হোঁচট খেলেন একটি তথ্যে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার সৎবোন অগাস্টার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে ছিলেন! ব্যস, সে দিন থেকে তার প্রিয় কবির কবিতা পড়ানো বন্ধ করে দিলেন।
১৬
বলা বাহুল্য, জীবনের শেষ দিন অবধি কাননের সঙ্গে পুত্রের বিবাহ মেনে নেননি হেরম্বচন্দ্র। তাই ওঁর জীবিতকালে অশোক, কাননের সম্পর্ক থাকলেও বিয়ে হয়নি। অশোক ও কাননের প্রথম আলাপও যেন বায়োস্কোপ থেকে তোলা। অশোক শান্তিনিকেতনে পড়ান। আর ফুরসত হলেই কলকাতা চলে আসেন ফুর্তির খোঁজে। সাহেবি আমলের কলকাতা বলে কথা! অশোক রাইফেল হাতে পাকা শিকারি। এক সময় ওঁর মন গেল প্রণয়ের শিকারে। ওঁ কল্পনা ও আবেগ জুডাত তখন একটাই মুখ, একটাই মানুষ। কাননবালা! তো এক বার কলকাতা সফরে অঢেল পান হল্লার পর নেশায় চুর অশোক বলেই দিলেন, ‘‘এখন এই সন্ধ্যায় চাওয়া-পাওয়ার কী-ই বা বাকি রইল, শুধু কাননকে পাশে পাওয়া ছাড়া।’’ সঙ্গীসাথীরা বন্ধুর এই বাসনাটুকুও বাকি রাখতে চায়নি। তাই ওঁকে প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় বৌবাজার পল্লীর কাপালিতলা লেনে কাননের বাড়ির দোরগোড়ায় ফেলে চম্পট দেয়। সেই সুদর্শন, সুবেশ, নিদ্রিত পুরুষটিকে বাড়ির বাইরে ভোরবেলা আবিষ্কার করেন কাননই। ওঁর মাথাটা তুলে নিয়েছিলেন নিজের কোলে। আধো ঘুম ও খোঁয়ারির মধ্যে চোখ মেলে নায়িকাকে দেখে অশোকের মনে হয়েছিল স্বপ্নেই আছেন। কানন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আপনি কে? কেমন করে এখানে আসা হলো?’’ অশোক তখন নাকি চোখ মুদে বলেছিলেন, ‘‘চলে যান, স্বপ্ন ভাঙবেন না। আমি এখন কানন বালার সঙ্গে আছি।’’ বলা বাহুল্য, এর পর অশোক-কাননের প্রেম দানা বাঁধতে সময়ে নেয়নি। কিন্তু বিয়ে করা যাচ্ছে না, চিনের প্রাচীরের মতো সম্মুখে হেরম্বচন্দ্র। ওঁরা রাজভবনে হাতার মধ্যে এজরা ম্যানসনে মিলিত হতে লাগলেন। এ ছাড়া সিনেমা দেখা ছিল। আর সময় হলেই গাড়ি হাঁকিয়ে লং ড্রাইভ। কত যে ট্রিপ হয়েছে এ ভাবে! শুধুই ফলতা বন্দর! যাওয়া হয়েছে কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ। হাঁটা হয়েছে নিজামত ইমামবাড়াচত্বরে। কানন দেবী লিখেছেন, ‘‘আমি সামাজিক স্বীকৃতিকেই আমার প্রেমের মুকুট করতে চেয়েছিলাম। সেটা পেলামও। কারণ ও-ও বিয়ে চেয়েছিল।’’ কাননকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবী। সুন্দর সম্পর্ক হয়েছিল রানী ও প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে, তবু অপেক্ষা করতে হয়েছিল হেরম্বচন্দ্রের মৃত্যু অবধি। সে-বিয়ে হলো ১৯৪০- সালের ডিসেম্বরে। অশোকের বয়স যখন ছত্রিশ, কাননের পঁচিশ। অনুরাগীদের আশঙ্কা ছিল ১৯৩৯-এ গায়িকা-নায়িকা উমাশশী যেমন বিয়ে করে গান ও অভিনয় ছেড়েছেন কাননও হয়তো তাই করবেন। আর কানন সেটা করলেন না বলেই কালো মেঘ জমল সম্পর্কের আকাশে। কানন দেবী স্বীকার করে গেছেন, যে-অশোককে তিনি দেবতার মতো পুজো করেছেন, ওঁর সংস্পর্শে এসে জীবনের রূপরসগন্ধের স্পর্শ পেয়েছেন, পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গে দীক্ষা পেয়েছেন, জেনেছেন ভালবাসা কারে কয়, সেই ঘরের মানুষটিই বিবাগী হয়ে গেল স্ত্রী যে কাজটা ভালোবাসে সেটাই করে বলে! তখনকার অভিনেত্রীদের বিবাহিত জীবনে অবিরত যেটা হতো, তাই হলো কাননের জীবনে। পাঁচ বছরের মধ্যে বিয়ে ভাঙল। অশোকের বরাবর ধারণা ছিল, কানন যে শেষ অবধি ডিভোর্স ফাইল করেছিলেন, সেটা রানী ও প্রশান্তচন্দ্রের পরামর্শে। অশোক মামলা কন্টেন্ট করেননি। এত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যে অশোক মৈত্রর প্রতি, তাঁর নামই কেন করলেন না কানন দেবী তাঁর জীবনীতে? বলা মুশকিল এবং উত্তরও নেই।’
১৭
কানন দেবীর সাথে ১৯৪৯ সালে পশ্চিবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপালের সঙ্গে আলাপের সূত্রে পরিচয় হয় রাজ্যপালের নেভাল এ.ডি.সি হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রণয় এবং বিবাহ ঐ বছরেই। ‘দ্বিতীয় বিয়ে হতেই কেচ্ছা শুরু’ শিরোনামে কানন দেবীর আরেক জীবন নিয়ে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘আমরা কানন দেবীর যে অতি রূপবান, ভারী ভদ্র, উচ্চমনা ও রসময় স্বামীটিকে দেখেছি, তিনি হরিদাস ভট্টাচার্য। সত্তর দশকের শেষ দু’বছর এবং আশির দশকের শুরুর বছর খানেক ওঁকে কয়েক বার দেখেছিলাম আনন্দবাজারের অপিসঘরে। স্নিগ্ধ, সুপুরুষ প্রৌঢ় এসে বসতেন গৌরকিশোর ঘোষের টেবিলে। আমারও একটা জায়গা ছিল সে-ঘরে তখন। প্রথম দিন গৌরদা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী রে, চিনিস এঁকে?’’ বললাম, ‘‘আলাপ হয়নি। তবে চিনি।’’ সঙ্গে সঙ্গে হরিদাসবাবু পিছনে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী করে চিনলেন?’’ বলেছিলাম, ‘‘আপনার করা ছবি দেখে।’’ বাড়াবাড়ি করছি না, কিন্তু সে দিন ওই কথায় ওঁর সোনালি ফ্রেমের চশমা ও কাাঁপাকা চুলের (বেশিটাই পাকা) সুন্দর মুখে যে ভাললাগার ছোঁওয়া দেখেছি, তা ভোলার নয়। গৌরদাও পরে বলেছিলেন, ‘‘তুই যে শুধু কানন দেবীর বর বলে ওঁকে চিনিস না, সেটা ওঁর ভাল লেগেছে।’’ ১৯৪৯-এ কানন দেবীর বর হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু হরিদাস ভট্টাচার্য কেউকেটা। যখন বিয়ে হচ্ছে, তখন তিনি ক্যাপ্টেন হরিদাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ড. কৈলাসনাথ কাটজুর এডিসি। কলকাতার মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলারদের এক। মেয়েরা ওঁকে বর আর তাদের মায়েরা ওঁকে জামাই করতে চায়। কিন্তু হঠাৎ একদিন এই যুবকের চোখ পড়ল কাননবালার ওপর।’
১৮
আর হরিদাস ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘‘এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ড. কাটজুর সঙ্গে। সেখানেই দেখা কানন বালার সঙ্গে। প্রায় বাধ্য হয়েই সেখানে এসেছিল ও। সারাক্ষণ মঞ্চে থেকেও একটি কথাও বলেনি।’’ এরপর তাদের দ্বিতীয় দেখা রাজভবনে গান গাইতে এলেন যখন কানন। সেই আমন্ত্রণও হরিদাসই জানিয়েছিলেন। এর পর ফের সাক্ষাৎ যখন নায়িকার ছবির শ্যুটিঙের পারমিশন জোগাড় করে দিলেন রাজ্যপালের এডিসি। কারণ লোকেশন হল সরকারি ঘেরাটোপের ফলতা। কাননের প্রেমের সঙ্গে আবার জুড়ে গেল ফলতা। কানন দেবী বলেছেন, একজন জীবনসঙ্গীর কাছে যা কিছু তার চাওয়ার ছিল, সবই পেয়েছিলেন হরিদাসের কাছে। সব চেয়ে বড় পাওয়া হরিদাসের মনের জোর। কাননের অতীত নিয়ে কোনওই প্রশ্ন বা কৌতূহল ছিল না ওঁর। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে যা চর্চা লেগে গেল এবং কাগজপত্রে যা লেখালেখি শুরু হলো তাতে বিয়ে টেকানো তো তিন দিনের প্র্যাকটিসে ট্র্যাপিজের খেলায় নামার সামিল। কাননের বুকটা দমে যেত হরিদাসের কথা ভেবে। কিন্তু হরিদাসকে টলায় কে! তোয়াক্কাই করলেন না এসব কেচ্ছার কেত্তনের। বর-বৌয়ের সব ব্যাপারেই যে মতের মিল একই রকম। হরগৌরী যোগ, তাও নয়। কিন্তু ওঁদের সুন্দর ভাবে বেঁধে রাখল তিনটে জিনিস- ভেতরের টান, বাগানের নেশা আর সিনেমার প্রেম।
১৯
কানন ও হরিদাসকে নিয়েই একটা স্বতন্ত্র বৃত্তান্ত হয়, এবং সে-জন্য কানাঘুষোর ওপর নির্ভর করতে হয় না। ওঁদের দ্বৈত পরিচালনার শ্রীমতী পিকচার্সের ছবি তো বাংলা সিনেমার ইতিহাসে জায়গা নিয়েছে। প্রযোজিকা হিসেবে কানন দেবী এবং পরিচালক হিসেবে হরিদাস ভট্টাচার্য এক দুরন্ত হিট জুটি। শ্রীমতী পিকচার্সের প্রথম হিট ‘মেজদিদি’-তে হরিদাসসহ পরিচালক। তিনি স্বাধীনভাবে পরিচালনায় এলেন ‘নববিধান’ ও ‘দেবত্র’-য়। ‘দেবত্র’-য় একবারই মাত্র কানন দেবী, উত্তম ও সুচিত্রা ত্রয়ী একসঙ্গে পর্দায় এলেন। তবে হরিদাস ভট্টাচার্যকে আমরা ভুলিনি, ভুলব না, ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদি’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ এবং থ্রিলার ছবি ‘শেষ অঙ্ক’-র জন্য। আর কানন দেবীকে তো বাঙালি প্রেমে পড়ে, নিন্দে করে, ভালোবেসে, গাল পেড়ে, তারপর বুকে ধরে কাটিয়ে দিয়েছে যুগের পর যুগের পর যুগ। ‘আমি বনফুল’ গেয়ে বাঙালিকে এক কালে মাতিয়েছিলেন যে-নায়িকা তাকে আর প্রশ্ন করার ছিল না ‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা’? শেষ দিন অবধি অবশ্য হরিদাস ও কানন একসঙ্গে থাকতে পারেননি। ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। যদিও তার মাত্র ক’বছর আগে কানন দেবী আত্মকথায় লিখছেন, ‘‘যখন হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ে করি তখন লোকের ধারণা ছিল এ বিয়ে পনেরো দিন টিকবে হয়। সেই বিয়েই তো চব্বিশ বছর টিকে গেল।’’ ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে হরিদাস ও কাননবালা গিয়েছিলেন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে। কানন দেবী সে দিন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিলেন। আর ১৯৮৯ সালের এক দিন ওঁর টাকা-পয়সা, কাগজপত্র, শখের পিস্তল ও রিভলভার গুছিয়ে হরিদাস ওঁদের ১নং রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। কিছু দিনের মধ্যে কানন দেবীও ১৭ই জুলাই, ১৯৯২-এ বেল ভিউ ক্লিনিকের এক নির্জন কেবিনে প্রায় চুপি চুপি সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। সেই কেবিনের আশেপাশের কোনও একটিতে বছর কুড়ি বাদে জীবন শেষ করলেন সুচিত্রা সেনও। ওপর তলায় বসে এ সব স্ক্রিপ্ট কে লেখে কে জানে!যত দোষ বাংলা বায়োস্কাপের!
২০
জীবনে সম্মান, মর্যাদা কেউ কারো হাতে তুলে দেয় না। অতি সহজ বস্তুও পাবার পথে বহু বিঘ্নতায় ভরা। অনেক পোড় খেয়ে, অনেক বেদনা বয়ে, অনেক রক্ত ঝরা অন্তর্দ্বন্দ্বের বন্ধুর পথে চলে কাননবালা দেবীর মতোন মানুষেরা বোঝেন পৃথিবীটা মোটেই সরল নয়। কঠিন পর্বতের মতো এবড়োখেবড়ো। গাঁইতি দিয়ে কেটে কেটে তাকে সমতল করে নিজের চলার পথ নিজে তৈরি করে নিতে হয়। এই পথের বিবরণ জানাবার তাগিদ পাওয়া যায় তার আত্মজীবনীতে। জীবনে কোনো কাজের সাফল্য লাভই যে কঠিন নয়, সেটা সুষ্পষ্ট হয় তার স্মৃতিচারণ পাঠে। পথের মেয়ে থেকে তিনি জেদ, সংগ্রাম এবং আত্মবিশ্বাসে হয়ে উঠলেন বাংলা ছবির সম্রাজ্ঞী। সত্যিই এমন একটা মহৎ জীবন আমাদের বহু কিছু শিক্ষা দেয় আজও। বাংলা ছবির হার্টথ্রব নায়িকা-গায়িকা, উনিশ শতকের প্রথম মহা তারকা কানন দেবীর স্মৃতির প্রতি অবিরল জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(তথ্যসূত্র: অনুশীলন, বাংলাপিডিয়া: গোলাম মুরশিদ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক আজকাল, ইন্টারনেট)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা
আলোহীন জগৎ থেকে উঠে আসা এক নারী আপন প্রতিভা ও তন্ময় সাধনায়, অনেক অবহেলা, লাঞ্ছনা, চিত্র জগতের ক্লেদ, আর গ্লানি অতিক্রম করে দীপ্তিময়ী হয়ে উঠেছিলেন। সে এক বিস্ময়কর আলোয় ফেরার কাহিনী। আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্থে কানন দেবী লিখেছেন ‘মরণ পণ করে যে জীবন সৃষ্টি করতে চেয়েছি তাকে নিয়ে আর যাই হোক ছেলেখেলা করা যায় না। ...জীবনের কাছে আমি চেয়েছি মধুর শান্তিনিলয়। স্বপ্নভরা আরামকুঞ্জ, উদার আকাশ”। সংশয় নেই, জীবন বোধে উজ্বল ছিল তার দীর্ঘ শিল্পী ও সামাজিক জীবন। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ছেষট্টি বছর এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে বিজড়িত ছিল একটা নাম কানন দেবী। বলতে গেলে ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণের ১০০ বছরের ইতিহাসের প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই লেখা আছে তার নাম। শুধু অভিনয় ও সংগীত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন এমন নয় প্রযোজনা, পরিচালনা, বিচারক মন্ডলী, ডিরেক্টর বোর্ড, সিনেমা শিল্পের প্রতিটি বিভাগের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন সুদীর্ঘ সময়। দুস্থ মহিলা শিল্পীদের সাহায্যার্থে গঠন করেছিলেন ‘মহিলা শিল্পীমহল’। যুক্ত ছিলেন সামাজিক নানান কল্যাণকর সংগঠনের সঙ্গে। ১৯৯২ সালে কলকাতায় মৃত্যু হয় কানন দেবীর ছিয়াত্তর বছর বয়সে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের ডাক বিভাগ কানন দেবীকে শ্রদ্ধা জানাতে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। তারপর ১৯৭৬ সালে পান চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার ।
২
বাংলা চলচ্চিত্রের এক মর্যাদাময় ব্যক্তিত্ব কাননবালা দেবীর আত্মকথার অনুলেখিকা সন্ধ্যা সেনের ভাষ্যমতে, ১৯১৬ সালের ২২শে মে (বাংলা ৮ জ্যৈষ্ঠ) ভারতীয় চলচ্চিত্রের জ্যোর্তিমণ্ডলের এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের জন্মদিন। সেই হিসেবে ২০১৬ সালেই তাঁর জন্ম শতবার্ষিক ছিল অথচ উপমহাদেশের গোটা চলচ্চিত্র জগতের নীরবতা দেখে ব্যথিত হয়েছি। কারণ কেবল অভিনয় কিংবা সংগীত সাধনাই নয়, সারাটি জীবন তিনি মানবসেবামূলক কাজেও নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। বিশেষত দুস’ ও বয়স্ক শিল্পীদের সাহায্যের জন্য তিনি সব সময়ে সক্রিয় ছিলেন। সেই মানুষটিকে স্মরণ না করাটা মোটেই ভালো কাজ নয়। কারণ কেবল অনিয় কিংবা গানই নয় ১৯৪৯ সালে চলচ্চিত্র প্রযোজনায়ও নামেন কানন দেবী, গঠন করেন শ্রীমতী পিকচার্স। প্রথম ছবি ‘অনন্যা’। তারপর একের পর এক শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’, দর্পচূর্ণ’, নববিধান’, ‘দেবত্র’, ‘অন্নদা দিদি, ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্ত’ প্রভৃতি, প্রযোজনা কানন দেবীর শ্রীমতী পিকচার্স আর পরিচালনায় স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্য। অন্নদা দিদির ভূমিকায় অভিনয়ের পর কানন আর কোনো ছায়াছবিতে অভিনয় করেননি। অভিনয় করেননি, কিন্তু সিনেমা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন আমৃত্যু। উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালের ১৭ই জুলাই কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৩
অনন্য কণ্ঠশিল্পী, অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক এই শিল্পী বিভিন্ন নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন: কানন দাস, কাননবালা, কাননবালা দেবী। তবে সংক্ষেপে কানন দেবী কিংবা তিনি সাধারণে ‘কাননবালা’ নামেই সুপরিচিত ছিলেন। অভিনেত্রী, কণ্ঠশিল্পী কাননবালা দেবী পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রতন চন্দ্র দাস এবং মায়ের নাম রাজবালা দেবী। তবে জানা যায়, রাজবালা ছিলেন রতন চন্দ্র দাসের রক্ষিতা, বিবাহিত পত্নী নন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় কাননবালা দেবীর বহুল পঠিত ও জনপ্রিয় আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’। জীবনী থেকেই জানা যায় তার জীবনের কঠোর পরিশ্রম, একনিষ্ঠ সাধনা, একাগ্রতার কথা, স্বপ্ন আর প্রবল আশাবাদী সংগ্রামী যোদ্ধার কাহিনী। জানা যায়, ছবি করা ছেড়ে দিলেও দুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত? অভিনেত্রীদের জন্যে আমৃত্যু তার চিন্তাভাবনা কখনও থামেনি।? তৈরি করেছিলেন ‘?মহিলা শিল্পী মহল’?। সাহায্য করেছেন বহু শিল্পীকে। একসময় নিজে কষ্ট করে বড় হয়েছেন তাই অন্যের কষ্ট দেখলে পাশে দাঁড়াতেন সঙ্গে সঙ্গে। তবে, এসব কথা ঘটা করে বলেননি কখনও। কিন্তু নিজের যাত্রাপথের সত্যকে গোপন করেননি তাঁর আত্মকথা ‘সবারে আমি নমি’?তে। এমন এক মহৎ জীবনকে আমাদের সামনে আনার জন্যে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ এই বইয়ের অনুলেখিকা সন্ধ্যা সেনের কাছে। আরেকটি জীবনীগ্রন্থের কথাও উল্লেখ না করলেই নয়। মেখলা সেনগুপ্তার . KANAN DEVI: THE FIRST SUPERSTAR OF INDIAN CINEMA, । এক সময় সারা ভারতবর্ষ জুড়ে দুর্বার আকর্ষণ ছিল বঙ্গললনা কাননবালার প্রতি! আর তাই কাননবালার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে, কোন এক বিশেষ আকর্ষণে বিশ্বখ্যাত ‘লন্ডন বিজনেস স্কুল’-এর গ্রাজুয়েট মেখলা সেনগুপ্তা জার্মান ব্যাংকের লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে কাননবালার জীবনী লিখতে উদ্বুদ্ধ হন। গ্রন্তুটির লেখিকা মেখলা সেনগুপ্তা প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এই মহানায়িকার জীবন সংগ্রামের অনেক অজানা কাহিনী।
৪
রূপোলি জগতের বাইরে একটু নজর দিলে দেখতে পাবো সেকালে যার সূক্ষ্ম রুচিবোধকে যামিনী রায় থেকে বিষ্ণু দে সম্মান করে চলতেন সেই ডাকসাইটে আইসিএস অফিসার অশোক মিত্র স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ১৯৪১ সালে তিনি যখন কৃষ্ণনগরে, স্বামীর সঙ্গে তখন কানন এলেন শ্বশুরালয়ে। কেবল তার অপরূপ রূপ বা কোকিলবিনিন্দিত সুর নয়, তার কথা-বলা হাঁটাচলার মধ্যে অপূর্ব রুচিবোধের হদিস পেয়েছিলেন অশোক মিত্র। তিনি প্রশ্ন করেছেন, উত্তরও খুঁজেছেন- কোত্থেকে পেলেন কানন এই রুচিবোধ? এ-ও পরিশীলন, তার সুর ও অভিনয়ের মতো। আর জনপ্রিয়তার কথা? ‘চলো, তোমাকে আমার কলেজ দেখিয়ে আনি’, বলে বিলেত ভ্রমণকালে কাননের ননদাই বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ তাকে ক্যাম্ব্রিজে নিয়ে গেছেন। সেদিন বোধহয় ক্যাম্ব্রিজের সব ক্লাসই মুলতবি হয়ে গেল, ভারতীয় ছাত্রেরা ভিড় করে কাননবালাকে দেখতে এসেছে বলে। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে। মেট্রো গোল্ডুইন-মেয়ার স্টুডিও দেখে বেরিয়েছেন, লস এঞ্জেলসের কাগজ হেডিং করলো, ‘ভারতের গ্ল্যামার কুইনকে এসকর্ট করে নিয়ে এসেছেন এক স্টাটিস্টিশিয়ন!’ হ্যাঁ, এ রকম সব নানা রকমের ‘ছুট্কাহানী’ (anecdote)-তে ভরা মেখলা সেনগুপ্তার বইখানি। তিনি উল্লেখ করেছেন- ব্রাহ্মসমাজ ও শান্তিনিকেতনের গণ্ডী ছাড়িয়ে রবীন্দ্রসংগীতকে আমবাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ায় কাননের কৃতিত্ব পঙ্কজকুমার মল্লিকের সমতুল্য। বইটিতে অবধারিত এসেছেন তার সহানুভূতিশীল (দ্বিতীয়) স্বামী নেভি-অফিসার হরিদাস ভট্টাচার্যের কথা, সফল ফিল্ম-প্রযোজনা ব্যবসায়, কাননের অগাধ দানের প্রসঙ্গ, তার আধ্যাত্মিক জীবন। ১০০ বছর আগের এক নারী, যার প্রসঙ্গে সেই সময়ের নবীন-প্রবীণেরা একই সুরে গাইতেন, ‘আমি বনফুল গো...’ যেন চোখের সামনে কাননবালা মূর্ত হয়ে ওঠেন এই বই পড়তে পড়তে। আজকের বাঙালি প্রজন্মের জন্যে ইংরেজিতে লেখা বইটি পড়ে নানান তথ্য জানতে পেরে শ্রদ্ধা বেড়ে যায় কারণ ভারতের শ্রেষ্ঠ মহানায়িকা ছিলেন এই বাংলারই, কলকাতার, আদতে এক ঘরহীনা কুলহীনা ধনহীনা নারী, যাকে কাননবালা থেকে কাননদেবী-তে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিলেন তার অগণ্য ভক্তকুলই, যাদের উদ্দেশ্যে সেই মহীয়সীর আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’।
৫
‘কে বাবা কে মা দিয়ে কী হবে! আমার কাননবালা পরিচয়ই যথেষ্ট’। এক সময় স’ান ছিল নিষিদ্ধ পাড়ায়, পরিচারিকার কাজও করেছেন জীবনে। তাঁর বাবার প্রকৃত পরিচয় জানেন না কেউ! কাননদেবীর শতবর্ষ স্মরণে সেই শিল্পীকে নিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য যথার্থই লিখছেন, ‘কাননদেবীকে সুচিত্রা সেনের আগের জমানার ‘সুচিত্রা সেন’ বললে খুব একটা ভুল হয় না। সেই অপরূপ মুখশ্রী! মুহূর্তের পর মুহূর্ত আলো নেওয়া আর ক্যামেরার লেন্সে উদ্ভাসিত হয়ে থাকার ক্ষমতা! পরের পর ছবি হিট করানো, রুপোলি পর্দা ও পর্দার বাইরেও সমানভাবে নায়িকা থাকা, ইন্ডাস্ট্রির মাথাদের কব্জায় আনা, নিজেকে প্রায় একটা ব্র্যান্ডে গড়ে নেওয়া! এবং সর্বোপরি, কয়েক প্রজন্মের পুরুষের স্বপনচারিণী হয়ে ভেসে থাকা সুচিত্রার কেরিয়ারের নীল নকশাই যেন তৈরি করে গেছিলেন কানন দেবী। চাইলে সুচিত্রাকেও পরের যুগের কানন বললে সিনেমার মানহানি হয় না।’
৬
বাংলা চলচ্চিত্রের এক মর্যাদাময় ব্যক্তিত্ব কানন দেবী। কাননবালা থেকে কাননদেবী। তখন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নিতান্তই শৈশব। কাননের জন্মের তিন বছর আগে সবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথচলা শুরু হয়েছে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃত দাদা সাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’-এর মুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯১৩ সালে। কলকাতায় পার্শি ব্যবসায়ী জে.এফ. ম্যাডান গঠন করেছেন চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক প্রদর্শনের পথিকৃত প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাডান থিয়েটার’। এক সহৃদয় ব্যক্তির হাত ধরে ১০ বছরের কিশোরী কানন পা রাখলেন ম্যাডান থিয়েটারের স্টুডিওতে, সংস্পর্শে এলেন পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেটা ১৯২৬ সালের কথা, তখনো চলচ্চিত্র শব্দহীন, নির্বাক যুগ চলছে। দশ বছরের কিশোরী কাননের প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’ এ ‘রাধা’ চরিত্রে। পারিশ্রমিক পেলেন পাঁচ টাকা। চলচ্চিত্রজীবনে কাননের প্রথম উপার্জন। এর পর ‘শঙ্করাচার্য’তে অভিনয় করলেন কানন, সেটিও নির্বাক ছবি। ১৯৩১ সালে বাংলা ছায়াছবি কথা বলতে শুরু করলো, ১৯৩১ সালের ১১ই এপ্রিল সবাক কাহিনিচিত্র অমর চৌধুরী পরিচালিত ‘জামাই ষষ্টি’ মুক্তি পেল। ঐ বছরেই কাননের প্রথম সবাক চিত্রে অভিনয় ম্যাডান থিয়েটারের ‘জোর বরাত’ ছবির নায়িকা চরিত্রে। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩১ সালের ২৭শে জুন। এরপর ১৯৩৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শ্রী গৌরাঙ্গ’ চলচ্চিত্রে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ চরিত্রে অভিনয় ও গানে কানন শিল্পীর সম্মান ও প্রতিষ্ঠা পেলেন। ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ মুক্তি পাওয়ার পর কাননের গানের খ্যাতিও বিস্তৃত হলো, ডাক পেলেন গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে। কাননদেবী তার আত্মকথায় লিখেছেন ‘এই সময় স্টুডিও থেকে ক্রমশ গ্রামোফোন কোম্পানি অবধি কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হোল...গান এসে আমার অভিনয়ের পাশে দাঁড়াতেই মনে হলো আমার জীবনের এক পরম পাওয়ার সঙ্গে শুভদৃষ্টি ঘটল। ... নিজেকে যেন নতুন করে চিনলাম” (‘সবারে আমি নমি’)। তারপর কত ছবি, কত গান- কানন হয়ে উঠলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার, ‘মহা নায়িকা’। চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের বাইরে গ্রামোফোন রেকর্ডে কানন দেবীর কণ্ঠের কিছু গান তো ‘লিজেন্ড’ হয়ে আছে শ্রোতাদের কাছে। ‘আমি বনফুল গো, ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে...’, ‘সাপুড়ে’ ছবিতে নজরুল ইসলামের সুরে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ’, ‘সাথী’ ছবিতে সায়গলের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ‘বাবুল মোরা নৈহর ছুটল যায়’ এখনও তন্ময় সংগীতপ্রেমীদের মুগ্ধ করে। কাননের আরো একটি গান ‘লিজেন্ডে’র মর্যাদা পেয়েছে। ১৯৪৭ সালের অগস্ট মাসে লন্ডনের ‘ইন্ডিয়া হাউস’-এ তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে। ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন তখন লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার। সেখানে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে কানন গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু, এখন ওগো কর্ণধার তোমারে করি নমস্কার’ গানটি।
৭
১৯৩৬ সালে রবীন্দ্র-কাহিনী নয় এমন চলচ্চিত্রে রবীন্দ্র সংগীতের প্রয়োগ করলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন নিয়ে কানন দেবী গাইলেন ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’ এবং ‘আজ বিদায় বেলার মালাখানি’। এই সুবাদে কানন হয়ে গেলেন শান্তিনিকেতন ঘরানার বাইরে রবীন্দ্র-গানের প্রথম মহিলা-কণ্ঠ। তারপর অজস্র ছায়াছবি ও গ্রামফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন কানন। সেকালে রবীন্দ্রনাথের গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে পঙ্কজকুমার মল্লিকের মত কানন দেবীরও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। সংগীতপ্রধান ছবি ‘বিদ্যাপতি’ (১৯৩৮)তে অভিনয় ও গায়িকা রূপে কানন খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেছিলেন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কানন না সংগীত শিল্পী কানন- কে বড় সে প্রশ্নের মীমাংসা হবার নয়। কাননের নিজের কথায় “আজ আমার অভিনেত্রী পরিচয়টাই সকলের কাছে বড়। কি আমার নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি দামি আমার গানের মহল ...” (‘সবারে আমি নমি’)। পণ্ডিত আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন। গান শিখেছেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, নজরুল ইসলাম ও পঙ্কজকুমার মল্লিকের কাছে। সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, ‘কানন কিন্তু একাই এক নিখুঁত, অতুলনীয় প্যাকেজ। আর গান বলে গান! কার নয়? আর হায়, কী গান! কী বাংলায়, কী হিন্দিতে। রবীন্দ্রনাথ সিনেমায় তার গানের চিত্ররূপ অনুমোদন করলে সেই প্রথম গানটি ছিল কাননের ‘আজ সবার রঙে রং মেশাতে হবে’। গান নিয়ে করা প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ ছবি দুরন্ত হিট হওয়ার পর হিন্দুস্তান রেকর্ডজে কবিকে প্রথম দেখা কাননের। প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ আলাপ করাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এ হল কানন, তারকা অভিনেত্রী।’’ কানন প্রণাম করতে রবীন্দ্রনাথ ওঁর ঠোঁট ছুয়ে বলেছিলেন, ‘‘কী সুন্দর মুখ তোমার! গান করো?’’ এ ঘটনা ‘বিদ্যাপতি’ ছবির সময়কার। কবির মনে ছিল না এই মেয়েটিই ‘মুক্তি’-তে ওঁর গান গেয়েছে। প্রশান্তচন্দ্র তখন যোগ করলেন, ‘‘ও তো আপনার গান গেয়েই বিখ্যাত।’’ রবীন্দ্রনাথ তখন বলেছিলেন, ‘‘তাই? তা হলে একবার শান্তিনিকেতনে এসে গান শুনিয়ো আমাকে।’’ সেই সৌভাগ্য কাননের আর হয়নি।’ ১৯৩৮ সালে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর করা একখানি ছবি উপহার পান কানন দেবী। এ সংবাদটি কেমন করে যেন পৌঁছেছিল কলকাতার উঁচু মহলে। এ প্রসঙ্গে কানন দেবী বলেছিলেন ‘ কি যেন একজন ফোনে জানাল অভিনেত্রীর কবির নাম স্বাক্ষরিত ছবি রাখার অধিকার নেই।’
৮
অথচ মাত্র নয় বছর বয়সে তার পিতা মারা যায়। অসহায় মাতা দুই কন্যাকে নিয়ে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িত আশ্রয় নিয়ে ঝিয়ের কাজ করেন। সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর মা-মেয়েতে মিলে ঝিয়ের কাজ করেন। তার আত্মজীবনী ‘সবারে আমি নমি’ গ্রন্তেু তাঁর বড় হয়ে ওঠার এসব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ছোটবেলায় পরের বাড়িতে লাথি-ঝাঁটা খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে হয়েছে। খাবার জুটত না দু’বেলা। বাবা রতনচন্দ্র দাস মার্চেন্ট অফিসে কাজ করতেন। একটা ছোটখাটো সোনা-রূপার দোকানও ছিল। কিন্তু নানান কুঅভ্যাসের জন্যে আয়ের চেয়ে ব্যয়ই ছিল বেশি। ফলে, প্রচুর ধারদেনা রেখে যখন অকালে মারা গেলেন রতনচন্দ্র, তখন সেই ঋণ শোধ করতে ছোট্ট কাননের মাকে সর্বস্ব বিক্রি করে পথে নামতে হলো। সেই কাননই পরবর্তীকালের বাংলা সিনেমা ও গানের কাননবালা থেকে অদ্বিতীয়া কানন দেবী হয়ে ওঠেন। জীবনের এইসব অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করেননি কানন দেবী। বরং সেই কঠিন অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে আরও বেশি খাঁটি, আরও বেশি মানুষ হয়ে উঠেছেন তিনি। তবে, সেইসব কথা স্বীকার করার মতো তেজ ও সততা তার ছিল। তাই, এমন কথাও তিনি স্বীকার করেছেন, বড় হয়ে তিনি কারও কারও কাছে শুনেছেন, বাবার বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন না তার মা। এর উল্টো কথাও শুনেছেন। কিন্তু, নিজের আত্মকথায় তিনি বলেছেন, ‘এ নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমি ‘মানুষ’, সেই পরিচয়টাই আমার কাছে যথেষ্ট। শুধু দেখেছি, বাবার প্রতি তার আনুগত্য ও ভালবাসা কোনও বিবাহিত পত্নীর চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। হয়তোবা সেই ভালবাসা-জাত কর্তব্যবোধের দায়িত্বেই বাবার সমস্ত ঋণভার অম্লানবদনে মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। তাই দরিদ্রের সংসারের যা কিছু সোনা-দানা ও বিনিময়ে অর্থ পাওয়ার মতো জিনিসপত্র ছিল, সব বিক্রি করে বাবার ঋণ শোধ করলেন।’ ‘এরপরই শুরু হল চরম দুরবস’া। একবেলা আহার সব দিন জুটত না। জীর্ণতম বস্ত্র মায়ের অঙ্গে, আমার অবস’াও একইরকম।’ এই সবই কানন দেবীর নিজের কথা।
৯
তারপর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে কাকুতি-মিনতি করে আশ্রয় জোটানো। কিন্তু, কানন আর তার মা আশ্রয় নেওয়ার পর সেই আশ্রয়দাতা বাড়ির ঝি, রাঁধুনি দুই ছাড়িয়ে ছিলেন। এই সব কাজ করতে হতো কানন আর তার মা-কে। এবং প্রতি মুহূর্তে অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা শুনতে হতো তাঁদের। একদিন মায়ের হাত থেকে চায়ের প্লেট পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল। তখন বাড়িসুদ্ধ সবাই তেড়ে মারতে গেল মা-কে। দশ বছরের কানন মায়ের হাত ধরে সেদিন আবার রাস্তায় নেমে আসে। এর চেয়ে উপোস করে মরাও ভালো, এটাই মা-কে বলেছিল সেই ১০ বছরের মেয়েটা। এরপর বারো ঘর এক উঠোনের এক বাড়িতে ঠাঁই। তখনই পরিচিত এক ভদ্রলোক তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা। তাকে কাকাবাবু বলত ছোট্ট কানন। কাননের মিষ্টি মুখ, মায়াবী চোখ দেখে ছবিতে কাজ করার জন্যে তিনি নিয়ে যান বিখ্যাত পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বাংলা চলচ্চিত্রের তখন শৈশব অবস’া। বুলি ফোটেনি। নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’-এ সুযোগ হলো রাধার চরিত্রে অভিনয় করার। ম্যাডান থিয়েটার্স লিমিটেডের সেই ছবিতেই প্রথম ফুল ফুটল কাননের অভিনয়ের। সেটা ১৯২৬ সাল। এই ছবির পর চার বছর ছিল কাননের প্রস’তি পর্ব। ম্যাডান কোম্পানির ব্যানারেই তৈরি হলো বাংলার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র ‘ঋষির প্রেম’। এই ছবিতে উৎপলার ভূমিকায় অভিনয় করলেন, গানও গাইলেন কাননদেবী। সেটা ১৯৩১ সাল। ওই বছরেই ছোট ছবি ‘জোর বরাত’-এ তিনি নায়িকা এবং ‘প্রহ্লাদ’ ছবিতে তিনি নারদের ভূমিকায়।
১০
অভিনয় ছাড়াও দশকের পর দশক তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও বাংলা সংগীতজগতে অসাধারণ অবদান রাখেন। সুকণ্ঠের জন্য তিনি শৈশব থেকেই সুনাম পেয়ে এসেছেন। কিন্তু আর্থিক দুরবস’ার জন্য তার মা তাকে ভালো শিক্ষকের কাছে গান শেখানোর ব্যবস’া করতে পারেননি। তার সহজাত সংগীত প্রতিভার বদলে তিনি ছবিতে কণ্ঠদান করতে‘ পেরেছিলেন। পরে অবশ্য কাননদেবী ওস্তাদ আল্লা রাখার কাছে তালিম নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত এবং আধুনিক বাংলা গানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সেকালের বিখ্যাত গায়ক, সুরকার এবং সংগীত শিক্ষক রাইচাঁদ বড়াল, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, পঙ্কজ মল্লিক, অনাদিকুমার দস্তিদার, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র প্রমুখের কাছে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে গান শিখেছিলেন। তার গাওয়া নজরুলসংগীত ‘আমি বনফুল গো’ এক সময়ে যেমন অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, আজো রসিক শ্রোতার মনে সমান দোলা দেয়। তার গাওয়া জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে’, ‘তার বিদায় বেলার মালা খানি’, ‘আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে’, ‘তোমার সুরের ধারা’ আমার বেলা যে যায়’, ‘বারে বারে চেয়েছি, পেয়েছি যে তারে’, ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’, ‘সেই ভালো সেই ভালো’, ’একদিন চিনে নেবে তারে’, ‘কাছে যবে ছিল হলোনা যাওয়া’, ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’, ‘এত দিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে’।
১১
কানন দেবী অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। কাননদেবী যখন চলচ্চিত্রে আসেন, তখন অভিজাত ঘরের মেয়েরা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আসতেন না। এমনিতে কাননবালা ছিলে অভাবী ঘরের, অন্য দিকে ছিলেন রক্ষিতার কন্যা। এই কারণে, তাঁর সামাজিক মূল্য ছিল অতি নিম্ন। চলচ্চিত্রে আসার পর, তার এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। পরিচালকরা তাঁকে দিয়ে প্রায় নগ্নদশায় পর্দায় উপস্থিত করার চেষ্টা করেন। তার পুরোমাত্রার অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। তার প্রথম সবাকচিত্র ‘জোর বরাত’ (১৯৩১)। রাধা ফিল্মসের সবাক ছবি ‘জোরবরাত’-এ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই ছবির পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে নায়ক জোর করে তাকে চুম্বন করেন। এই আচরণে তিনি ক্ষুব্ধ হলেও, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, তাঁর বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। এরপর তিনি অভিনয় করেন ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’, ‘শঙ্করাচার্য’, ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’, মা ছবিতে। ১৯৩৫ সালে সতীশ দাস গুপ্তের ‘বাসবদত্তা’ ছবিতে তিনি প্রায় নগ্ন হয়ে অভিনয় করতে বাধ্য হন। অথচ শোনা যায়, ছবি নির্মাতারা তাকে অভিনয়ের সম্মানীও ঠিকমতো দেন না।
১২
১৯৩৫ সালে জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতে অভিনয় করে সুখ্যাতি লাভ করেন। এই ছবিতে তিনি নিজের কণ্ঠে গীত গানের সাথে ঠোঁট মেলান। এ সময়েই তিনি কাননবালা থেকে কানন দেবীতে পরিণত হন। অপরূপা কানন এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন যে, রাস্তার ধারে তার আলোকচিত্র বিক্রি হতে শুরু করে এবং তার পোশাক, অলঙ্কার, চলাফেরা ইত্যাদি নারীদের জন্যে ফ্যাশনে পরিণত হয়। ১৯৩৬ সালে দেবকী বসুর ‘বিদ্যাপতি’ তাকে অসাধারণ জনপ্রিয়তা দেয়। আর, প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’ তো বাংলা ছবির ইতিহাসেই অবিস্মরণীয় সংযোজন। মুক্তি-র সংগীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। এ ছবিতে কানন দেবীর অভিনয়ও যেমন, তার গলার রবীন্দ্রসংগীতও বিদগ্ধ দর্শক, শ্রোতাদের কানন-অনুরাগী করে তোলে। কাননদেবীর কণ্ঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে’ শুধু মুক্তি-র রবীন্দ্রসংগীত হয়ে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। তবে, তার কণ্ঠে দ্বিভাষিক ‘শেষ উত্তর’ বা ‘জবাব’ ছবির ‘তুফান মেল’ গান মাতিয়েছিল সারা ভারতের মানুষকে। ‘শেষ উত্তর’-এর ‘আমি বনফুল গো’ গানটাও বাঙালি কোনওদিন ভুলবে না। ভোলা যাবে কানন দেবীর গাওয়া ‘যদি ভালো না লাগে তো দিয়ো না মন’? না, ভোলা তো যাবেই না, সেই চল্লিশের দশকে সুশীল মজুমদারের ‘যোগাযোগ’-এ তার কণ্ঠে এ গান শুনে আপামর বাঙালি মন দিয়েছিল তাকে।
১৩
আগেই জেনেছি, দেবকী বসু পরিচালিত ‘বিদ্যাপতি’ ছবিতে অভিনয় করে কাননবালা খ্যতির শীর্ষে উঠে আসেন। এই বছরেই মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মুক্তি’ ছবির মাধ্যমে তিনি প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সেকালের প্রখ্যাত নায়ক প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে ‘মুক্তি’ এবং আরও কয়েকটি ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন। এই বছর থেকে দরিদ্র সস্তা অভিনেত্রী ‘কাননবালা’ থেকে তিনি সম্ভ্রান্ত ‘কাননদেবী’ হয়ে উঠেন। আর্থিক দুরবস্থার কারণে, এই সময়ে বাছবিচার ছাড়া তিনি বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৩৬ সালে ‘কৃষ্ণ সুদামা’, ‘কণ্ঠহার’, ‘বিষবৃক্ষ’ খুনি কৌন (হিন্দি) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। এই বছরে তিনি নিউ থিয়েটার্স-এ যোগদান করেন। ১৯৪১ সালে কানদেবী নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে নিজের পছন্দমতো বইয়ে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৪২ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত ‘শেষ উত্তর’ ও তার হিন্দি ‘জবাব’ ছবিতে তিনি বিশেষ সাফল্য পান। বিশেষ করে তার ‘তুফান মেল’ গানটি তাকে অভিনেত্রীর পাশাপাশি গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত হিন্দি বাংলা মিলিয়ে বেছে বেছে অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেন। তার জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে আছে বিদ্যাপতি, সাথী, পরিচয়, শেষ উত্তর, এবং মেজদিদি। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের ভিতরে তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো ছিল ‘স্ট্রিট সিংগার সাথী (১৯৩৮), সাপুড়ে (১৯৩৯), জওয়ানি কি রাত (১৯৩৯), পরাজয় (১৯৪০) ইত্যাদি অন্যতম। ১৯৪৮ সালে তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা শুরু করেন, প্রতিষ্ঠা করেন ‘শ্রীমতী পিকচার্স’ এবং এই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনার দিকে মন দেন। এই সময় তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরিতে মনোযোগী হন। ১৯৫৯ সালে তিনি শেষবারের মতো অভিনয় করেন ‘ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্ত ও অন্নদা দিদি’। তিনি এ সময় পর্যন্ত বিশেষত মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন।
১৪
তেইশের তরুণী কানন চেয়েছিলেন জীবনকে শুদ্ধ, সুন্দর করে গড়ে তুলতে। তখনকার সমাজ নিদারুণ আঘাত করেছিল কাননের প্রথম প্রেমকে। সেই পরম পাওয়ার আনন্দসুধা অঞ্জলি ভরে পান করতে পারেননি তিনি। ১৯৩৯ সালে তেইশ বছরের তরুণী কানন বিবাহ করেন প্রখ্যাত ব্রাহ্মসমাজী শিক্ষাবিদ হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের পুত্র অশোক মৈত্রকে। ভিক্টোরীয় শুচিতার প্রতীক হেরম্ব মৈত্রের পুত্রের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে সখেদে কানন লিখেছেন ‘সমাজ আমাদের মিলনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সম্ভ্রমের বরণডালা দিয়ে বরণ করেনি। ... আমাদের দুঃসাহসের সাক্ষী হয়েছে, কিন্তু উৎসবের আলো জ্বালিয়ে একে অভিনন্দিত করেনি ...। আজও মনে পড়ে, বারান্দায় দাঁড়াতে সাহস করতাম না, পাছে কারো কোন বিরূপ মন্তব্য কানে আসে। নানান কুরুচিপূর্ণ কদর্য ভাষার প্যামফ্লেট ছাপিয়ে উঁচু স্বরে হেঁকে বিক্রি হ’ত আমারই বাড়ির সামনে ...। নিঃসম্বল অসহায় একটা মেয়ে। কত ঝড় তুফান পেরিয়ে ছুটছে আর ছুটছে। কিন্তু তার সেই বিরামহীন চলা, গ্রন্থিহীন তপস্যার এতটুকু মূল্য কেউ কোনদিন দেয়নি। চেয়েছে তাকে ব্যর্থতার সমাধিতে নিশ্চিহ্ন করে দিতে” (‘সবারে আমি নমি’)। সে বিবাহ স্থায়ী হয়নি, বেশিদিন টেকেনি। সেকালীন রক্ষণশীল সমাজ প্রবল নিন্দাবাদ করেছিল বংশগৌরবহীন একজন চিত্রাভিনেত্রীর সঙ্গে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিবাহে। জানা যায়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি তাদের বিবাহে আশীর্বাণী ও প্রীতি উপহারস্বরূপ একটি ছবি পাঠিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। এক চিত্রভিনেত্রী রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর করা ছবি পাবে কেন! বিয়ের সময় কাননের কাছে শর্ত ছিল বিবাহের পর চিত্রাভিনয় ত্যাগ করতে হবে। ব্যক্তিত্বময়ী কানন সম্মত হননি। ১৯৪৫ সালে কানন তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ নেন। বিবাহ-বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সত্ত্বেও প্রথম স্বামীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন, অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা তাঁকে প্রথম সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য। পরবর্তীকালে, অশোকের দিদি রানী মহলানবিশ, তার স্বামী প্রখ্যাত পরিসংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ কিংবা অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গে কাননের অন্তরঙ্গতা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিন্দুমাত্র ঘাটতি ছিল না ।
১৫
কানন দেবীর জীবন সংগ্রাম, প্রেম ও বিবাহিত জীবন নিয়ে অনেক কাহিনি জানতে পারা যায় শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের রচনায়। তিনি লিখছেন, ‘কানন দেবী তাঁর আত্মজীবনীতে একটি নাম উচ্চারণই করলেন না। তার প্রথম স্বামী অশোক মৈত্রের! এক অতীব অকিঞ্চিৎকর পরিস্থিতি থেকে এই বিয়ে হয়েছিল আভিজাত্যে ওঠার এক স্বর্গীয় সিঁড়ি। কারণ শ্বশুরবাড়ি মৈত্র পরিবার ছিল বাঙালি সমাজের ক্রেম দ্য ল্য ক্রেম। মান্যতার ফিরিস্তিটা একবার শুনুন।’... তার স্বামী অশোক অক্সফোর্ড ফেরত। দেশে ফিরে কবির বিশ্বভারতীতে পড়ানো শুরু করেছেন। ওঁর পাশাপাশি তখন ওখানে পড়াচ্ছেন বলরাজ সাহনি। অশোকের বোন রানীর বিয়ে হয়েছিল সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সঙ্গে। আর বাবা? এই এক মহৎ পরিচয় ও বৃহৎ সমস্যা। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ও সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। হেরম্বচন্দ্র সম্পর্কে চমৎকার গল্প আছে শিক্ষিত মহলে। তার একটা হল তিনি শ্যামবাজারের রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। এক ছোকরা ওঁকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, স্টার থিয়েটারটা কোন দিকে?’’ থিয়েটার হলের খোঁজ চাওয়ায় রাগে গরগর হেরম্বচন্দ্র বললেন, ‘জানি না!’ বলেই হেঁটে চললেন। খানিক গিয়েই দোটানায় পড়লেন নীতিবাদী অধ্যাপক। সে কী, একটা নির্দেশ দেবেন না বলে মিথ্যে বললেন! সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ফিরে ছোকরাকে গিয়ে ধরলেন আর বললেন, সেই নীতিবাদী টোনে, ‘‘জানি, কিন্তু বলব না!’’ হেরম্বচন্দ্রের অন্য গল্পটাও অদ্ভুত। কলেজে অপূর্ব নিষ্ঠা ও আবেগে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা পড়ান অধ্যাপক। হঠাৎ এক দিন কবির জীবনীতে হোঁচট খেলেন একটি তথ্যে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার সৎবোন অগাস্টার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে ছিলেন! ব্যস, সে দিন থেকে তার প্রিয় কবির কবিতা পড়ানো বন্ধ করে দিলেন।
১৬
বলা বাহুল্য, জীবনের শেষ দিন অবধি কাননের সঙ্গে পুত্রের বিবাহ মেনে নেননি হেরম্বচন্দ্র। তাই ওঁর জীবিতকালে অশোক, কাননের সম্পর্ক থাকলেও বিয়ে হয়নি। অশোক ও কাননের প্রথম আলাপও যেন বায়োস্কোপ থেকে তোলা। অশোক শান্তিনিকেতনে পড়ান। আর ফুরসত হলেই কলকাতা চলে আসেন ফুর্তির খোঁজে। সাহেবি আমলের কলকাতা বলে কথা! অশোক রাইফেল হাতে পাকা শিকারি। এক সময় ওঁর মন গেল প্রণয়ের শিকারে। ওঁ কল্পনা ও আবেগ জুডাত তখন একটাই মুখ, একটাই মানুষ। কাননবালা! তো এক বার কলকাতা সফরে অঢেল পান হল্লার পর নেশায় চুর অশোক বলেই দিলেন, ‘‘এখন এই সন্ধ্যায় চাওয়া-পাওয়ার কী-ই বা বাকি রইল, শুধু কাননকে পাশে পাওয়া ছাড়া।’’ সঙ্গীসাথীরা বন্ধুর এই বাসনাটুকুও বাকি রাখতে চায়নি। তাই ওঁকে প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় বৌবাজার পল্লীর কাপালিতলা লেনে কাননের বাড়ির দোরগোড়ায় ফেলে চম্পট দেয়। সেই সুদর্শন, সুবেশ, নিদ্রিত পুরুষটিকে বাড়ির বাইরে ভোরবেলা আবিষ্কার করেন কাননই। ওঁর মাথাটা তুলে নিয়েছিলেন নিজের কোলে। আধো ঘুম ও খোঁয়ারির মধ্যে চোখ মেলে নায়িকাকে দেখে অশোকের মনে হয়েছিল স্বপ্নেই আছেন। কানন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আপনি কে? কেমন করে এখানে আসা হলো?’’ অশোক তখন নাকি চোখ মুদে বলেছিলেন, ‘‘চলে যান, স্বপ্ন ভাঙবেন না। আমি এখন কানন বালার সঙ্গে আছি।’’ বলা বাহুল্য, এর পর অশোক-কাননের প্রেম দানা বাঁধতে সময়ে নেয়নি। কিন্তু বিয়ে করা যাচ্ছে না, চিনের প্রাচীরের মতো সম্মুখে হেরম্বচন্দ্র। ওঁরা রাজভবনে হাতার মধ্যে এজরা ম্যানসনে মিলিত হতে লাগলেন। এ ছাড়া সিনেমা দেখা ছিল। আর সময় হলেই গাড়ি হাঁকিয়ে লং ড্রাইভ। কত যে ট্রিপ হয়েছে এ ভাবে! শুধুই ফলতা বন্দর! যাওয়া হয়েছে কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ। হাঁটা হয়েছে নিজামত ইমামবাড়াচত্বরে। কানন দেবী লিখেছেন, ‘‘আমি সামাজিক স্বীকৃতিকেই আমার প্রেমের মুকুট করতে চেয়েছিলাম। সেটা পেলামও। কারণ ও-ও বিয়ে চেয়েছিল।’’ কাননকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন অশোকের মা কুসুমকুমারী দেবী। সুন্দর সম্পর্ক হয়েছিল রানী ও প্রশান্তচন্দ্রের সঙ্গে, তবু অপেক্ষা করতে হয়েছিল হেরম্বচন্দ্রের মৃত্যু অবধি। সে-বিয়ে হলো ১৯৪০- সালের ডিসেম্বরে। অশোকের বয়স যখন ছত্রিশ, কাননের পঁচিশ। অনুরাগীদের আশঙ্কা ছিল ১৯৩৯-এ গায়িকা-নায়িকা উমাশশী যেমন বিয়ে করে গান ও অভিনয় ছেড়েছেন কাননও হয়তো তাই করবেন। আর কানন সেটা করলেন না বলেই কালো মেঘ জমল সম্পর্কের আকাশে। কানন দেবী স্বীকার করে গেছেন, যে-অশোককে তিনি দেবতার মতো পুজো করেছেন, ওঁর সংস্পর্শে এসে জীবনের রূপরসগন্ধের স্পর্শ পেয়েছেন, পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গে দীক্ষা পেয়েছেন, জেনেছেন ভালবাসা কারে কয়, সেই ঘরের মানুষটিই বিবাগী হয়ে গেল স্ত্রী যে কাজটা ভালোবাসে সেটাই করে বলে! তখনকার অভিনেত্রীদের বিবাহিত জীবনে অবিরত যেটা হতো, তাই হলো কাননের জীবনে। পাঁচ বছরের মধ্যে বিয়ে ভাঙল। অশোকের বরাবর ধারণা ছিল, কানন যে শেষ অবধি ডিভোর্স ফাইল করেছিলেন, সেটা রানী ও প্রশান্তচন্দ্রের পরামর্শে। অশোক মামলা কন্টেন্ট করেননি। এত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যে অশোক মৈত্রর প্রতি, তাঁর নামই কেন করলেন না কানন দেবী তাঁর জীবনীতে? বলা মুশকিল এবং উত্তরও নেই।’
১৭
কানন দেবীর সাথে ১৯৪৯ সালে পশ্চিবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপালের সঙ্গে আলাপের সূত্রে পরিচয় হয় রাজ্যপালের নেভাল এ.ডি.সি হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রণয় এবং বিবাহ ঐ বছরেই। ‘দ্বিতীয় বিয়ে হতেই কেচ্ছা শুরু’ শিরোনামে কানন দেবীর আরেক জীবন নিয়ে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘আমরা কানন দেবীর যে অতি রূপবান, ভারী ভদ্র, উচ্চমনা ও রসময় স্বামীটিকে দেখেছি, তিনি হরিদাস ভট্টাচার্য। সত্তর দশকের শেষ দু’বছর এবং আশির দশকের শুরুর বছর খানেক ওঁকে কয়েক বার দেখেছিলাম আনন্দবাজারের অপিসঘরে। স্নিগ্ধ, সুপুরুষ প্রৌঢ় এসে বসতেন গৌরকিশোর ঘোষের টেবিলে। আমারও একটা জায়গা ছিল সে-ঘরে তখন। প্রথম দিন গৌরদা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী রে, চিনিস এঁকে?’’ বললাম, ‘‘আলাপ হয়নি। তবে চিনি।’’ সঙ্গে সঙ্গে হরিদাসবাবু পিছনে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী করে চিনলেন?’’ বলেছিলাম, ‘‘আপনার করা ছবি দেখে।’’ বাড়াবাড়ি করছি না, কিন্তু সে দিন ওই কথায় ওঁর সোনালি ফ্রেমের চশমা ও কাাঁপাকা চুলের (বেশিটাই পাকা) সুন্দর মুখে যে ভাললাগার ছোঁওয়া দেখেছি, তা ভোলার নয়। গৌরদাও পরে বলেছিলেন, ‘‘তুই যে শুধু কানন দেবীর বর বলে ওঁকে চিনিস না, সেটা ওঁর ভাল লেগেছে।’’ ১৯৪৯-এ কানন দেবীর বর হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু হরিদাস ভট্টাচার্য কেউকেটা। যখন বিয়ে হচ্ছে, তখন তিনি ক্যাপ্টেন হরিদাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ড. কৈলাসনাথ কাটজুর এডিসি। কলকাতার মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলারদের এক। মেয়েরা ওঁকে বর আর তাদের মায়েরা ওঁকে জামাই করতে চায়। কিন্তু হঠাৎ একদিন এই যুবকের চোখ পড়ল কাননবালার ওপর।’
১৮
আর হরিদাস ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘‘এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ড. কাটজুর সঙ্গে। সেখানেই দেখা কানন বালার সঙ্গে। প্রায় বাধ্য হয়েই সেখানে এসেছিল ও। সারাক্ষণ মঞ্চে থেকেও একটি কথাও বলেনি।’’ এরপর তাদের দ্বিতীয় দেখা রাজভবনে গান গাইতে এলেন যখন কানন। সেই আমন্ত্রণও হরিদাসই জানিয়েছিলেন। এর পর ফের সাক্ষাৎ যখন নায়িকার ছবির শ্যুটিঙের পারমিশন জোগাড় করে দিলেন রাজ্যপালের এডিসি। কারণ লোকেশন হল সরকারি ঘেরাটোপের ফলতা। কাননের প্রেমের সঙ্গে আবার জুড়ে গেল ফলতা। কানন দেবী বলেছেন, একজন জীবনসঙ্গীর কাছে যা কিছু তার চাওয়ার ছিল, সবই পেয়েছিলেন হরিদাসের কাছে। সব চেয়ে বড় পাওয়া হরিদাসের মনের জোর। কাননের অতীত নিয়ে কোনওই প্রশ্ন বা কৌতূহল ছিল না ওঁর। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে যা চর্চা লেগে গেল এবং কাগজপত্রে যা লেখালেখি শুরু হলো তাতে বিয়ে টেকানো তো তিন দিনের প্র্যাকটিসে ট্র্যাপিজের খেলায় নামার সামিল। কাননের বুকটা দমে যেত হরিদাসের কথা ভেবে। কিন্তু হরিদাসকে টলায় কে! তোয়াক্কাই করলেন না এসব কেচ্ছার কেত্তনের। বর-বৌয়ের সব ব্যাপারেই যে মতের মিল একই রকম। হরগৌরী যোগ, তাও নয়। কিন্তু ওঁদের সুন্দর ভাবে বেঁধে রাখল তিনটে জিনিস- ভেতরের টান, বাগানের নেশা আর সিনেমার প্রেম।
১৯
কানন ও হরিদাসকে নিয়েই একটা স্বতন্ত্র বৃত্তান্ত হয়, এবং সে-জন্য কানাঘুষোর ওপর নির্ভর করতে হয় না। ওঁদের দ্বৈত পরিচালনার শ্রীমতী পিকচার্সের ছবি তো বাংলা সিনেমার ইতিহাসে জায়গা নিয়েছে। প্রযোজিকা হিসেবে কানন দেবী এবং পরিচালক হিসেবে হরিদাস ভট্টাচার্য এক দুরন্ত হিট জুটি। শ্রীমতী পিকচার্সের প্রথম হিট ‘মেজদিদি’-তে হরিদাসসহ পরিচালক। তিনি স্বাধীনভাবে পরিচালনায় এলেন ‘নববিধান’ ও ‘দেবত্র’-য়। ‘দেবত্র’-য় একবারই মাত্র কানন দেবী, উত্তম ও সুচিত্রা ত্রয়ী একসঙ্গে পর্দায় এলেন। তবে হরিদাস ভট্টাচার্যকে আমরা ভুলিনি, ভুলব না, ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদি’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ এবং থ্রিলার ছবি ‘শেষ অঙ্ক’-র জন্য। আর কানন দেবীকে তো বাঙালি প্রেমে পড়ে, নিন্দে করে, ভালোবেসে, গাল পেড়ে, তারপর বুকে ধরে কাটিয়ে দিয়েছে যুগের পর যুগের পর যুগ। ‘আমি বনফুল’ গেয়ে বাঙালিকে এক কালে মাতিয়েছিলেন যে-নায়িকা তাকে আর প্রশ্ন করার ছিল না ‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা’? শেষ দিন অবধি অবশ্য হরিদাস ও কানন একসঙ্গে থাকতে পারেননি। ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। যদিও তার মাত্র ক’বছর আগে কানন দেবী আত্মকথায় লিখছেন, ‘‘যখন হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ে করি তখন লোকের ধারণা ছিল এ বিয়ে পনেরো দিন টিকবে হয়। সেই বিয়েই তো চব্বিশ বছর টিকে গেল।’’ ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে হরিদাস ও কাননবালা গিয়েছিলেন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে। কানন দেবী সে দিন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিলেন। আর ১৯৮৯ সালের এক দিন ওঁর টাকা-পয়সা, কাগজপত্র, শখের পিস্তল ও রিভলভার গুছিয়ে হরিদাস ওঁদের ১নং রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। কিছু দিনের মধ্যে কানন দেবীও ১৭ই জুলাই, ১৯৯২-এ বেল ভিউ ক্লিনিকের এক নির্জন কেবিনে প্রায় চুপি চুপি সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। সেই কেবিনের আশেপাশের কোনও একটিতে বছর কুড়ি বাদে জীবন শেষ করলেন সুচিত্রা সেনও। ওপর তলায় বসে এ সব স্ক্রিপ্ট কে লেখে কে জানে!যত দোষ বাংলা বায়োস্কাপের!
২০
জীবনে সম্মান, মর্যাদা কেউ কারো হাতে তুলে দেয় না। অতি সহজ বস্তুও পাবার পথে বহু বিঘ্নতায় ভরা। অনেক পোড় খেয়ে, অনেক বেদনা বয়ে, অনেক রক্ত ঝরা অন্তর্দ্বন্দ্বের বন্ধুর পথে চলে কাননবালা দেবীর মতোন মানুষেরা বোঝেন পৃথিবীটা মোটেই সরল নয়। কঠিন পর্বতের মতো এবড়োখেবড়ো। গাঁইতি দিয়ে কেটে কেটে তাকে সমতল করে নিজের চলার পথ নিজে তৈরি করে নিতে হয়। এই পথের বিবরণ জানাবার তাগিদ পাওয়া যায় তার আত্মজীবনীতে। জীবনে কোনো কাজের সাফল্য লাভই যে কঠিন নয়, সেটা সুষ্পষ্ট হয় তার স্মৃতিচারণ পাঠে। পথের মেয়ে থেকে তিনি জেদ, সংগ্রাম এবং আত্মবিশ্বাসে হয়ে উঠলেন বাংলা ছবির সম্রাজ্ঞী। সত্যিই এমন একটা মহৎ জীবন আমাদের বহু কিছু শিক্ষা দেয় আজও। বাংলা ছবির হার্টথ্রব নায়িকা-গায়িকা, উনিশ শতকের প্রথম মহা তারকা কানন দেবীর স্মৃতির প্রতি অবিরল জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(তথ্যসূত্র: অনুশীলন, বাংলাপিডিয়া: গোলাম মুরশিদ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক আজকাল, ইন্টারনেট)
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ভাসানটেক সরকারী কলেজ, ঢাকা