ঈদ আনন্দ ২০১৮

খেলাধুলা

ফুটবল জ্বরে কাঁপছে বিশ্ব

আনোয়ার হোসেন পিন্টু

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৪:৩৩ পূর্বাহ্ন

ফুটবল। চামড়ার এক গোলকের দুর্বার আকর্ষণে পুরো বিশ্বের নজর এখন একবিন্দুতে। কেন্দ্রস্থল রাশিয়া। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ- ফুটবল বিশ্বকাপ আসরের পর্দা উঠছে আগামী ১৪ই জুন। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে হবে আসরের উদ্বোধনী ও ফাইনাল খেলা। মাসব্যাপী এ আসরকে ঘিরে ফুটবল জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। বাদ নেই বাংলাদেশও। পছন্দের দলের পক্ষে চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন ফুটবলপ্রেমীরা। আবার সমর্থকদের কথার লড়াই জমেছে ফেসবুক, টু্‌ইটারের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। বিশ্বকাপের এটি ২১তম আসর। তবে পূর্ব ইউরোপে বিশ্বকাপ আসর বসছে প্রথমবার। বিশ্বকাপ ফুটবল প্রথমবার মঞ্চস্থ হয় ৮৮ বছর আগে। ১৯৩০-এ প্রথমবার উরুগুয়েতে আয়োজিত হয় ফুটবলের এ মহাযজ্ঞ। এবার রাশিয়ার ১১ শহরের ভিন্ন ১২টি ভেন্যুতে হবে বিশ্বকাপের খেলাগুলো। এতে মোট ম্যাচ ৬৪। দর্শকরা প্রথমবার টেলিভিশনে বিশ্বকাপের খেলা দেখার সুযোগ পান ১৯৫০’র আসরে। তবে কালক্রমে টিভিতে বিশ্বকাপের দর্শকপ্রিয়তা বেড়েছে ব্যাপকহারে। টেলিভিশনে এবারের বিশ্বকাপের খেলা উপভোগ করবে বিশ্বজুড়ে ৫০ কোটি দর্শক।
এবারের বিশ্বকাপেও খেলছে ৩২টি দেশ। ব্রাজিলের মাটিতে গত বিশ্বকাপে অংশ নেয়া ২০ দেশ খেলছে এবারো। ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার জন্য শুরুতে বিড করেছিল ৯টি দেশ। শেষ দিকে মেক্সিকো নাম প্রত্যাহার করে নেয় আর সঠিক সময়ে ফিফার কাছে নিজ দেশের সরকারের সমর্থন সূচক নথিপত্র জমা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ইন্দোনেশিয়ার বিড বাতিল করা হয়। শেষ মুহূর্তে বিড থেকে সরে দাঁড়ায় অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানও। এতে লড়াই হয় ইংল্যান্ড রাশিয়া ও দুই যৌথ বিডার নেদারল্যান্ডস-বেলজিয়াম, পর্তুগাল-স্পেনের। ২০১০’র ডিসেম্বরে জুরিখে ভোটাভুটিতে আয়োজকের মর্যাদা লাভ করে রাশিয়া। ভোটাভুটিতে ইংল্যান্ডের অবস্থান ছিল চতুর্থ। যদিও অভিযোগ ওঠে, ঘুষ দিয়ে আয়োজক দেশের মর্যাদা পেয়েছে রাশিয়া। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথমবার ফিফার ২০৯ দেশের আইনসিদ্ধ সবাই বাছাইপর্বে অংশ নেয়। বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচ মাঠে গড়ায় ২০১৫’র ১২ই মার্চ। সর্বোচ্চ ৩৬ বছরের বিরতিতে বিশ্বকাপে খেলছে লাতিন আমেরিকান দেশ পেরু। সর্বশেষ ১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপে খেলতে দেখা গিয়েছিল পেরুভিয়ানদের। ইতালিতে ১৯৯০’র আসরের পর প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলছে উত্তর আফ্রিকার দেশ মিশর। আর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের এক আসরে খেলতে দেখা যাচ্ছে ইউরোপের নরডিক অঞ্চলের তিন দেশকে (ডেনমার্ক, সুইডেন, আইসল্যান্ড)।

এবারের তারকা কথন

এবারের বিশ্বকাপেও স্বাভাবিকভাবেই দর্শকদের নজর থাকবে লিওনেল মেসি, নেইমার, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের ওপর। তবে এবার দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রে মোহাম্মদ সালাহ। সদ্য মৌসুমে ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলের জার্সি গায়ে ৪৫ ম্যাচে ৪৪ গোল পেয়েছেন এ মিশরীয় স্ট্রাইকার। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে সর্বোচ্চ ৩২ গোল নিয়ে গোল্ডেন বুট পুরস্কারজয়ী মোহাম্মদ সালাহ ভেঙে দিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো-লুইস সুয়ারেজের এক রেকর্ডও। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ৩১ গোলের রেকর্ড ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পর্তুগিজ স্ট্রাইকার রোনালদো, লিভারপুলের উরুগুইয়ান ফরোয়ার্ড সুয়ারেজ ও নিউক্যাসল ইউনাইটেডের ইংলিশ তারকা অ্যালান শিয়েরারের। আর বিশ্বকাপ শুরুর আগে ভিন্ন আলোচনার কেন্দ্রেও মোহাম্মদ সালাহ। এবারের ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ফাইনালে ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছাড়েন লিভারপুলের এ মিশরীয় স্ট্রাইকার। এতে শঙ্কা জাগে তার বিশ্বকাপে খেলা নিয়ে। যদিও মিশর ফুটবল ফেডারেশন জানিয়েছে, আসরের গ্রুপ পর্বেই দেখা যাবে সালাহকে। আরো একবার কঠিন সমীকরণের সামনে লিওনেল মেসি। বোদ্ধারা অনেকেই তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি দেন। তবে অনেকের মতে এমন স্বীকৃতি পেতে হলে বিশ্বকাপ জিততে হবে লিওনেল মেসিকে। গত আসরে শিরোপার একদম কাছে পৌঁছেও হতাশা নিয়ে ফিরতে হয় এ আর্জেন্টাইন সুপারস্টারকে। অতিরিক্ত সময়ের (১১৩ মিনিট) একমাত্র গোলে জার্মানির কাছে শিরোপা খোয়ায় অধিনায়ক মেসির আর্জেন্টিনা। এবার মৌসুম জুড়েই বল পায়ে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন মেসি। মৌসুমে ৫৪ ম্যাচে সর্বাধিক ৪৫ গোলের কৃতিত্ব মেসির। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে মেসি নিয়েছেন স্প্যানিশ লা লিগা ও কোপা দেল রে’ শিরোপার স্বাদও। লা লিগায় ৩৪ গোল নিয়ে কুড়িয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পিচিচি পুরস্কার। এতে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন সু পুরস্কারও জিতেছেন মেসি। আর জাতীয় দলের জার্সি গায়েও জারি রয়েছে ‘মেসি ঝলক’। লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের বাছাইপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে ৩-১ গোলে জয় নিয়ে রাশিয়ার টিকিট নিশ্চিত করে দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। বাঁচা-মরার ওই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন মেসি। রাশিয়ায় মূল লড়াইয়ে নামার আগে হাইতির বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচেও হ্যাটট্রিক নৈপুণ্য নিয়ে নিজের টাটকা ফর্মের জানান দেন মেসি। এবারও ফেভারিটের মর্যাদা নিয়েই বিশ্বকাপ মঞ্চে পা রেখেছে সর্বাধিক পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। বাছাইপর্বে সবার আগে টিকিট নিশ্চিত করে ব্রাজিল। আর বাছাইপর্বের খেলা শেষ করে তালিকার শীর্ষ স্থান নিয়েই। রাশিয়ায় ব্রাজিল সমর্থকদের আশা-ভরসার কেন্দ্রে নেইমার ডা সিলভা জুনিয়র। নিজ মাটিতে গত আসরে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ইনজুরি নিয়ে ছিটকে পড়েন নেইমার। আর সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে অবিশ্বাস্য ৭-১ গোলের হার নিয়ে শিরোপার স্বপ্ন ভাঙে নেইমারহীন ব্রাজিলের। এবার মৌসুমজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন নেইমার। মৌসুমের শুরুতে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ২২২ মিলিয়ন ইউরোর ট্রান্সফারে এফসি বার্সেলোনা থেকে ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইতে (পিএসনজি) পাড়ি দেন এ ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। সেখানে ৩০ ম্যাচে ২৮ গোল নিয়ে ফর্ম দেখান যথারীতি। তবে গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে খেলার মাঠে ইনজুরিতে পড়েন নেইমার। পায়ে অস্ত্রোপচার নিয়ে দীর্ঘ দিনের জন্য ছিটকে পড়েন তিনি। গত ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপার গৌরব কুড়ায় অধিনায়ক ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল। নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে ওটাই পর্তুগালের প্রথম বড় শিরোপা। এবার বিশ্বকাপের দিকে নজর পর্তুগিজদের। আর এতে ভক্ত-সমর্থদের প্রত্যাশার পালে হাওয়া দিচ্ছেন রোনালদোই। সদ্য মৌসুমে ৪৪ ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বাধিক ৪৪ গোলের কৃতিত্ব ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে তিনি নিয়েছেন সর্বশেষ ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ শিরোপার স্বাদও। মাদ্রিদে হ্যাটট্রিকসহ চারটি চ্যাম্পিয়ন লীগ শিরোপা জিতেছেন রোনালদো। আর চ্যাম্পিয়নস লীগের ইতিহাসে পাঁচ শিরোপাজ জয়ী একমাত্র ফুটবলার রোনালদোই। ২০০৮-এ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি গায়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ শিরোপার স্বাদ নেন রোনালদো। ফেভারিটের মর্যাদা নিয়েই রাশিয়ায় পা রেখেছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি। এবারো এককভাবে কোনো খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভরতা নেই কোচ জোয়াকিম লো’র দলের। এবার জার্মানি দলে নেই বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ফিলিপ লাম, স্ট্রাইকার মিরোস্লাভ ক্লোসা ও মিডফিল্ডার বাস্তিয়ান শোয়াইনস্টাইগারের মতো তারকারা। অবসর নিয়েছেন তিন জনই। অফ-ফর্মের কারণে দলে জায়গা পাননি ফাইনালের ‘নায়ক’ মারিও গোটসা। ব্রাজিলের মারাকানা মাঠে ফাইনালের ১১৩তম মিনিটে জার্মানিকে শিরোপা জয়সূচক গোলটি এনে দেন গোটসাই। ব্রাজিলে ২০১৪’র বিশ্বকাপে অন্যতম লজ্জার ঘটনাটি স্প্যানিয়ার্ডদের। গ্রুপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের কাছে ৫-১ গোলে বিধ্বস্ত হয় আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন স্পেন। ওই স্মৃতি তাজা স্প্যানিয়ার্ডদের। রাশিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে স্পেনের মিডফিল্ড তারকা আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা বলেন, ব্রাজিল বিশ্বকাপের শিক্ষা মনে রেখেছি আমরা। অর্থাৎ রাশিয়ার মাটিতেই পা থাকবে আমাদের। বাছাই পর্বে দাপুটে নৈপুণ্য নিয়েই রাশিয়ার টিকিট কাটে ইংলিশরা। বাছাইপর্বে ১০ ম্যাচের ৮টিতে জয় দেখে অপরাজিত ইংল্যান্ড। আর এবার ইংলিশদের আশা দেখাচ্ছেন তরুণ তারকারা। আন্তর্জাতিক বয়সভিত্তিক ফুটবলের তিন ক্যাটাগরির শেষ তিন বিশ্বকাপ শিরোপা উঠেছে ইংল্যান্ডের ঘরেই। ফর্মে রয়েছেন স্ট্রাইকার হ্যারি কেইন। এবারে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০ গোলের কৃতিত্ব তার। রাশিয়ায় ইংল্যান্ড দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ডও থাকছে কেইনের কাছে। ইংলিশ সমর্থকদের আশা দেখাচ্ছেন রাহিম স্টারলিং, ডেলে আলিরাও। এবারো প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিশ্বকাপ মঞ্চে পা রাখছে বেলিজয়াম। সর্বশেষ ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের তৃতীয় শীর্ষ দলটিকে আশা দেখাচ্ছেন তাদের সোনালী প্রজন্মের তারকা এডেন হ্যাজার্ড, রমেলু লুকাকু, ভিনসেন্ট কম্প্যানিরা।

‘ডাচ-আজ্জুরি’ দীর্ঘশ্বাস
এবারের বিশ্বকাপে অতৃপ্তি থাকবে ইতালিয়ান ও ডাচ ফুটবলের সমর্থকদের। টোটাল ফুটবলের জনক নেদারল্যান্ডস ও আজ্জুরি খ্যাত ইতালি এবারের বাছাই পর্বের গণ্ডি পার করতে ব্যর্থ হয়। আর ইতালিকে ছাড়া বিশ্বকাপ মঞ্চস্থ হচ্ছে দীর্ঘ ৬০ বছরে প্রথমবার। সর্বশেষ ১৯৫৮ বিশ্বকাপের বাইরে ছিল দ্বিতীয় সর্বাধিক চারবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি। এর পর প্রতিটি বিশ্বকাপেই বল পায়ে আলো ছড়িয়েছে ইতালিয়ানরা। তিনবারের রানার্সআপ নেদারল্যান্ডসকে এবার রাশিয়ার টিকিট এনে দিতে ব্যর্থ হন রবিন ভ্যান পার্সি-আরিয়েন রোবেনরা। গত টানা দুই বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলার কৃতিত্ব ডাচদের। ২০১০’র ফাইনালে একমাত্র গোলে স্পেনের কাছে হার নিয়ে শিরোপা স্বপ্ন ভাঙে নেদারল্যান্ডসের। আর গত আসরের সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে টাইব্রেকারে দুর্ভাগ্যজনক হার নিয়ে পরে স্বাগতিক ব্রাজিলকে পরিষ্কার ৩-০ গোলে হারিয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করে ডাচরা। এবারের বাছাইপর্বের প্লে-অফে খেলার সুযোগ পেয়েছিল ইতালি। প্লে-অফের প্রথম লেগে সুইডেনের মাঠে ১-০ গোলে হার দেখে অধিনায়ক জিয়ানলুইজি বুফনের ইতালি। আর নিজ মাটিতে ফিরতি লেগে গোলশূন্য ড্র নিয়ে খেলা শেষ করে দু’দল। এবারের বিশ্বকাপে দেখা যাবে না গত টানা দুই কোপা আমেরিকা ফুটবল আসরের চ্যাম্পিয়ন চিলিকে। টানা ছয় আসরের পর বিশ্বকাপের বাইরে কাটছে যুক্তরাষ্ট্রের। মূলপর্বের টিকিট পায়নি সর্বশেষ আফ্রিকান নেশনস কাপের চ্যাম্পিয়ন ক্যামেরুন। আর টানা তিন বিশ্বকাপে খেলার পর এবার বাইরে রয়েছে আফ্রিকার ফুটবলের দুই পাওয়ার হাউস ঘানা ও আইভরি কোস্ট।

সুরের মূর্ছনা ও আলো ঝলমলে উদ্বোধনী
স্বাগতিক রাশিয়া ও এশিয়ার ফুটবলের পাওয়ার হাউস সৌদি আরবের মধ্যে ম্যাচ দিয়ে মাঠে গড়াবে এবারের বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা। তার আগে দুই ঘণ্টাব্যাপী চলবে আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। আলোর ঝলকানি ও নাচেগানে মনোমুগ্ধকর এ উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন দর্শকরা। মস্কোর বিখ্যাত রেড স্কয়ারে আয়োজন হবে কনসার্টের। লুঝনিকি স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করবেন ৫০০ নৃত্যশিল্পী, জিমন্যাস্ট ও ট্রামপোলিনিস্ট। আর অনুষ্ঠানের শেষে থাকছে আলো ঝলমলে আতশবাজি। ব্রাজিলে ২০১৪ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফুটবলপ্রেমীদের সংগীতের মূর্ছনায় ভাসিয়েছিলেন প্রখ্যাত পপ শিল্পী জেনিফার লোপেজ ও ব্যান্ড পিটবল। আর রাশিয়ায় মঞ্চ মাতাবেন অপেরা গায়ক প্লাসিডো ডমিঙ্গো, লুসিয়ানো পাভারোত্তি ও হোসে কারেরাস। পারফর্ম করবেন পেরুভিয়ান সংগীত শিল্পী হুয়ান দিয়েগো ফ্লোরেজও। আয়োজকরা বলেন, ‘বৈশ্বিক আমেজের কথা মাথায় রেখে আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সাধারণত অপেরা গায়ক ও ধ্রুপদী শিল্পীদের পারফর্ম করতে দেখা যায়। এতে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশে সংগীতের ভাষাটা একাত্ম হয়ে যায়। রাশিয়ায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পারফম করবেন প্রখ্যাত পিয়ানো বাদক ডেনিস মাতসুয়েভ, অপেরা গায়ক আনা নেত্রেবকো, ইউসিফ ইভাজভ, ইলদার আবদ্রাজাকভ আইদা গারিফুলিয়ানার মতো রুশ শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে এবারের বিশ্বকাপের অফিসিয়াল থিম সং ‘লিভ ইট আপ’ পরিবেশন করবেন উইল স্মিথ, নিকি জ্যাম ও কসোভার-আলবেনিয়ান সংগীত শিল্পী ইরা ইসত্রাফি।


রেকর্ড ৪০০ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার
এবারের বিশ্বকাপে অর্থ পুরস্কারের অঙ্কটা বেড়েছে এক-অষ্টমাংশ। আসরের মোট প্রাইজমানি ৪০০ মিলিয়ন ডলার। যা গতবারের তুলনায় ৪২ মিলিয়ন ডলার বেশি। গতবারের তুলনায় এবার পুরস্কারের অঙ্কটা বেড়েছে ফাইনালের ক্ষেত্রেও। এবারের চ্যাম্পিয়ন দল পাবে ৩৮ মিলিয়ন ডলার এবং রানার্সআপ দল ২৮ মিলিয়ন। ব্রাজিলে গত বিশ্বকাপে শিরোপাজয়ী দল পেয়েছিল ৩৫ মিলিয়ন ডলার। রাশিয়ায় আসরের গ্রুপপর্ব পর্ব থেকে যারা বিদায় নেবে তারা প্রত্যেকেই ৮ মিলিয়ন ডলার পাবে। ব্রাজিলে ২০১৪’র বিশ্বকাপে মোট প্রাইজমানি ছিল ৩৫৮ মিলিয়ন ডলারের। চ্যাম্পিয়ন জার্মানি দলকে দেয়া হয় ৩৫ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার গ্রহণ করে রানার্সআপ আর্জেন্টিনা।

এক আসরে ৭ মুসলিম দেশ
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সর্বোচ্চ ৭টি মুসলিম দেশ অংশ নিচ্ছে বিশ্বকাপের এক আসরে। আর রাশিয়া বিশ্বকাপে আফ্রিকা অঞ্চল থেকে অংশ নেয়া সব ক’টি দেশই মুসলিম। এবারের বিশ্বকাপে অংশ নেয়া সাতটি মুসলিম দেশ হচ্ছে- সৌদি আরব, ইরান, মিশর, সেনেগাল, নাইজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কো। এর আগে সর্বোচ্চ চার মুসলিম দেশ অংশ নেয় ১৯৯৮’র ফ্রান্স বিশ্বকাপে। আসরে মুসলিম দেশ হিসেবে প্রথমবার অংশ নেয় আফ্রিকার দেশ মিশর। সেটা ১৯৩৪’র বিশ্বকাপে। পরে ৯টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলতে পারেনি কোনো মুসলিম দেশ। এর পরে ১৯৭০’র বিশ্বকাপে একমাত্র মুসলিম দেশ হিসেবে অংশ নেয় মরক্কো। এর পরে প্রত্যেকটি বিশ্বকাপে অংশ নেয় একাধিক মুসলিম দেশ। বিশ্বকাপের এক আসরে চার আরব দেশকে খেলতে দেখা যাচ্ছে এই প্রথমবার (মিশর, মরক্কো, সৌদি আরব, তিউনিশিয়া)।

পুঁচকে পানামার বিস্ময়
দেশটির ফুটবল খুব বেশি পরিচিত নয়। তাদের কোনো খেলোয়াড়কেও খুব চেনে না ফুটবলবিশ্ব। দেশটিকে সবাই চেনে এক পাশে আটলান্টিক আর অন্য পাশে প্রশান্ত মহাসাগর সংযোগকারী পানামা খালের কারণে। দক্ষিণ এবং উত্তর আমেরিকাকে সংযুক্ত করেছে দেশটি। কলা উৎপাদনে বিখ্যাত ৩০ লাখ জন্যসংখ্যার পুঁচকে দেশটি এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম বিস্ময়। বাছাইপর্বে যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়ান্টদের বিদায় করে বিশ্বকাপের টিকিট কাটে পানামা। নিজ মাঠে বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে কোস্টারিকার বিপক্ষে জয় নিয়ে রাশিয়ার টিকিট নিশ্চিত করে তারা। অন্য ম্যাচে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর কাছে ২-১ গোলে হেরে স্বপ্ন ভাঙে মার্কিনদের। বাছাইপর্বে পঞ্চমস্থান নিয়ে খেলা শেষ করে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের আয়োজকরা। পানামার চমকটা স্পষ্টই। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পানামা বিশ্বকাপের বাছাইপর্বই খেলতে পারেনি। ১৯৭৮’র বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে প্রথমবার খেলতে নামে তারা। যদিও ১৯৫১তে পানামা কুড়ায় সেন্ট্রাল আমেরিকা অ্যান্ড ক্যারিবিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। দুই দশক আগেও পানামার ফুটবল অবকাঠামো ছিল নিম্নমানের। তবে কলম্বিয়ান কোচ হোসে হারনানদেজের হাত ধরে আসে আমূূল পরিবর্তন। এই কোচের অধীনে ২০০৫’র মহাদেশীয় গোল্ডকাপ আসরের কোয়ার্টার ফাইনালের গৌরব কুড়ায় পানামা। আর কোচ হারনানদেজ দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও ২০০৭’র সেন্ট্রাল আমেরিকান ফুটবল আসরের ফাইনালে খেলে তারা। আর ২০০৯’র আসরে পানামা কুড়ায় শিরোপার গৌরব। আসরের সর্বশেষ সংস্করণে নিজেদের মাটিতে ফাইনালে খেলেছে তারা। যদিও ফাইনালে হন্ডুরাসের কাছে হার নিয়ে শিরোপার স্বপ্ন ভাঙে তাদের।

‘ছোট দেশের’ বড় চমক
ইউরোপের ছোট একটি দ্বীপ দেশ। মাত্রই ৩ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের বসবাস। আইসল্যান্ড। এর মধ্যে পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে পেশাদার ফুটবল খেলেন সাকুল্যে মাত্র ২০ হাজার। সেই ছোট দেশটিই নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের মূলপর্বে জায়গা করে নিয়েছে। এতে তারা গড়েছে অনন্য রেকর্ডও। জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বকাপের সবচেয়ে ছোট দেশ আইসল্যান্ড। আগের রেকর্ডটি ছিল ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর। এবারের বিশ্বকাপের ‘ডি’ গ্রুপে আইসল্যান্ডের প্রতিপক্ষ নাইজেরিয়া, দুই বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ও ১৯৯৮’র সেমিফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া। আগামী ১৬ই জুন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে এবারের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলবে আইসল্যান্ড। ডি’ গ্রুপে তাদের অপর দুই প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া ও নাইজেরিয়া। এবারের ইউরোপ অঞ্চলের বাছাইপর্বে ক্রোয়েশিয়া, ইউক্রেন তুরস্ককে পেছনে ফেলে গ্রুপসেরার মর্যাদা নিয়ে বিশ্বকাপের মূল পর্বের টিকিট কাটে আইসল্যান্ড। আগের ১২ বারের চেষ্টায় বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন অধরাই রয়ে গিয়েছিল আইসল্যান্ডের। ২০১৬’র ইউরোর কেয়ার্টার ফাইনালে খেলে তারা। আর এবারের বিশ্বকাপের মূলপর্বের টিকিট হাতে আইসল্যান্ড গড়ে ইতিহাস। জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বকাপের মূলপর্বের গৌরব কুড়ানো সবচেয়ে ছোট দেশ আইসল্যান্ড। ২০১৬ সালের শুমারি মোতাবেক দেশটির জনসংখ্যা ৩৩৪২৫২। আগের রেকর্ডটি ছিল ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর (১৩ লাখ)। ২০০৬’র জার্মানি বিশ্বকাপে পৌঁছে  নর্দান আয়ারল্যান্ডের (১৮.৫ লাখ) এমন রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল ক্যারিবীয় দ্বীপ ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো। এমন তালিকায় পরের দুই দেশ স্লোভেনিয়া (২০.৮ লাখ) ও জ্যামাইকা (২৮.৮ লাখ)। বাছাইপর্র্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে কসোভোকে ২-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ সেরার মর্যাদা নিয়েই বিশ্বকাপের টিকিট কাটে আইসল্যান্ড। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিজে এক গোল করেন এবং অপরটি সতীর্থ খেলোয়াড়কে দিয়ে করান আইসল্যান্ডের সেরা তারকা জিলফি সিগার্ডসন। গেল ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের কোয়ার্টার ফাইনালে আইসল্যান্ড ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিয়েছিল। ওই ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ গোলে জয় দেখে আইসল্যান্ড। ছোট হলেও দেশটির ফুটবল যে পিছিয়ে নেই সেটার প্রমাণ রয়েছে আরো। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশটিতে প্রতি ৫০০ জনের একজন উয়েফা মনোনীত কোচ। দেশটির ঘরোয়া ফুটবলের অবকাঠামোও মানসম্পন্ন।

গোলপটু নেকড়ে ‘জাবিভাকা’
রাশিয়া বিশ্বকাপের মাসকট হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে নেকড়ে ‘জাবিভাকা’কে। মাসব্যাপী অনলাইন ভোটিংয়ের মাধ্যমে মাসকট চূড়ান্ত করা হয়। এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অংশ নেয় এ ভোটিং প্রক্রিয়ায়। এতে ৫৩ শতাংশ ভোট পায় নেকড়ে ‘জাবিভাকা’। অন্যদিকে বাঘ পায় ২৭% এবং বিড়াল ২০% ভোট। রাশিয়ান ভাষায় ‘জাবিভাকা’ শব্দের অর্থ ‘যে গোল করতে পারে’। ‘জাবিভাকা’কে মনোহর, আত্মবিশ্বাসী ও সামাজিক অভিহিত করা হয়েছে। ব্রাজিলের সাবেক তারকা স্ট্রাইকার রোনালদো ডি লিমা বলেন, ‘আমার বিশ্বাস মাসকট ভালো কাজের জন্য ভালো দূত হিসেবে কাজ করে। এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপের মাসকট স্টেডিয়ামে অনেক আনন্দ বয়ে আনবে।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status