ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

ঝরাপাতায় বিষণ্ন বাতাস

শাহীন রেজা

২৯ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৪:০৯ পূর্বাহ্ন

সচিত্রকরণ: সুমন রহমান

চোখ বন্ধ করে ফিসফিস স্বরে ডাকছে ঋতু, ‘জান এসো, জান এসো, জান...।’ ঝরা পাতায় উত্তরা বাতাসের শব্দ উঠে আবার মিলিয়ে যায়। কিন্তু জান আসে না। চোখ খোলে ঋতু। ধু-ধু রোদে প্রথমে একটা ধাক্কা লাগে তারপর আস্তে আস্তে দেখতে পায় সেই আঁকাবাঁকা পথ, বাঁশ গাছ, হলুদ শালিক, গাদা ফুলের ঝোঁপ, লাল পিঁপড়ের সারি, সব...। সব একই রকম, ঠিকঠাক। শুধু জান নেই। মিজান।
‘মি’ টাকে ছেঁটে শুধু জান বলে ডাকা শুরু করেছে পরিচয়ের দুই মাস যেতে না যেতেই। আবার ঝরা পাতায় বাতাসের শব্দ ওঠে, একটা কাঠঠোকড়া ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক শব্দে আম গাছের শরীরে কারুকাজ তুলতে ব্যস্ত হয়। ঋতু আবার চোখ বন্ধ করে ফিস ফিস শব্দে ডাকতে থাকে
: এসো, জান এসো। দু’ঘণ্টা। দু’ঘণ্টা সময় চলে গেছে। চারটায় ফিরতে হলে হাতে থাকবে আর মাত্র আড়াই। এটুকু সময় কথা বলতে না বলতেই শেষ হয়ে যাবে শীতের বেলার মতো। তুমি তাড়াতাড়ি চলো এসো জান খুব তাড়াতাড়ি। প্রতীক্ষার বোঝা আর আমি বইতে পারছি না একা। চলে এসো জান, এসো....।’
কাঠঠোকরার শব্দটা হঠাৎ থেমে যায়। ঘাসের উপর দিয়ে সরসর শব্দে কী যেন একটা দৌড়ে পালায় আর সেই প্রিয় পদশব্দটা কানে বাজে ঋতুর। আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করে তার। চোখ না খুলেই বসে থাকে। পায়ের শব্দ একদম কাছে এসে থেমে যায়। যুবকের ভরাট কণ্ঠে কেঁপে ওঠে শরীরটা,
: এ্যাই সোনা, চোখ বন্ধ করে বসে আছো কেনো?
শ্রবণেন্দ্রীয় জুড়ে একঝাঁক প্রজাপতির স্পর্শ অনুভব করে ঋতু। বহু কষ্টে চোখের পাতা খুলতেই সামনে সেই প্রিয় অতিপ্রিয় হাসিমাখা মুখ। আচ্ছা, জান কি হাসি ছাড়া থাকতে পারে না? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে। এতো বছরের সম্পর্কে কখনও দুঃখ কিংবা বিষাদের ছায়া দেখেনি সে জানের মুখে। তারুণ্যে উদ্দীপ্ত যুবকের মুখে শুধু হাসি আর হাসি। একটা কবিতা মনে পড়ে যায় ঋতুর- ‘হাসলেই সুন্দর রমণীরা কেমন আরো অনিন্দ্য হয়ে যায়।’
নাহ্‌ জান তো রমণী নয়। তারচে’ বলা যায়, ‘হাসলে জানের মতো পুরুষ কত সহজেই আরো সুপুরুষ হয়ে যায়।’
এবার মিলেছে, হাসি ফুটে ওঠে ঋতুর মুখে।
: এই হাসছো কেনো? কি ভাবছো।
মিজানের প্রশ্নে সচকিত হয়ে ওঠে ঋতু
: না গো সোনা, কিচ্ছু ভাবছি না।
: তাহলে হাসলে যে...
: তোমাকে ভেবে।
: অদ্ভুত মেয়ে, দেরি দেখে আমি ভয়ে অস্থির। কোথায় বকা খাবো, তার বদলে কি-না হাসি, সত্যি ঋতু তোমাকে বুঝে ওঠা দায়।
: নাও আর বুঝতে হবে না। এবার পাশে এসে বসে পড়ো তো লক্ষ্মী ছেলের মতো।
মিজান পাশে বসতেই ঋতু আলতো করে তার একটা হাত টেনে নেয়। এটা ওর পুরনো অভ্যেস। হাত না ধরে বসতে পারে না। যতক্ষণ কাছে থাকে হাতটা ধরেই থাকে। মিজান ভাবে বোধহয় ওকে হারাবার ভয়ে এমনটি করে ঋতু এবং সে ভাবনাটা শুধু ওর অন্তরেই লুকিয়ে ডালপালা মেলে। কখনো এ ব্যাপারে ঋতুর কাছ থেকে ওর কিছু জানা হয়নি। আর জানার প্রয়োজনটাই বা কী।
বাম হাতে মিজানকে ধরে রেখে ডান হাতে টিফিন বক্স খুলতে থাকে ঋতু। বক্সটা খুলতেই কাবারের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আজও সে কাবাব পরোটা এনেছে। শাম্মি কাবাব মিজানের ভীষণ প্রিয়। সেই সঙ্গে ঘিয়ে ভাজা টানা পরোটা। প্রায় দুপুরেই এটা নিজ হাতে বানিয়ে আনে ঋতু। খাবারের গন্ধে ভিতরে জমাট বাধা ক্ষুধাটা চনমন করে ওঠে দু’জনেরই। হাত দিয়ে পরোটা ছিঁড়ে মিজানের মুখে তুলে দিতে দিতে প্রশ্ন করে ঋতু-
: এতো দেরি করলে, একটুও ক্ষুধা লাগেনি বুঝি।
খাবার চিবোতে চিবোতে উত্তর দেয় মিজান,
: ক্ষুধা তো লাগবেই, কিন্তু ভার্সিটি থেকে বোটানিক্যাল- এতো পথ আসতে কতো সময় লাগে জানো তুমি? রাস্তায় শুধু জ্যাম আর জ্যাম। শাহবাগ থেকে গাড়ি ধরতেই পঁয়তাল্লিশ মিনিট। তারপর এক নাম্বার আসতে পাক্কা এক ঘণ্টা দশ। এরপর এ পর্যন্ত ছুটতে ছুটতে আরো বিশ। এবার গুণে নাও কতক্ষণ লাগলো...
কথা শেষ করার আগেই আরেক টুকরো কাবাব পরোটা মিজানের মুখে তুলে দেয় ঋতু এবং তারপরে তুলে নেয় নিজের মুখে।
খাওয়া শেষে ঋতুর কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে মিজান।
একটা ঘাস ছিঁড়ে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে দূরে দৃষ্টি ছুড়ে দেয় ঋতু। আস্তে আস্তে ক’দিনেই কী ভীষণ পরিচিত হয়ে গেছে জায়গাটা। উই ঢিবিটায় মাটি আরো বেড়েছে। সেদিনের ছোট্ট কাঁঠাল চারাটা কেমন মাথা বাড়িয়ে ছুঁতে চাচ্ছে আকাশটা। বাঁশঝাড়গুলো যেন আরো ঘন হয়েছে, মমতায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে আরো নিবিড়ভাবে। হলুদ শালিকটার সঙ্গে ক’দিন ধরে জুটি বেঁধেছে আরো একটা, দুটোতে মানিয়েছে বেশ। লাল পিঁপড়ের সারিগুলো একই পথে প্রতিদিন বয়ে যায়- যেতেই থাকে, যেন ওদের পথ চলা অনন্তের, কোনদিন শেষ হবে না। গাঁদা ফুলের ঝাড়ে শেষ শীতের আমেজ, কলি থেকে বড়ো হওয়া ফুলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, দু’চারটা নতুন কলি ফুটি ফুটি করলেও তাদের শরীরে যৌবনের রোশনাই নেই। ...কতো পরিচিত দৃশ্য। চারদিকে দৃশ্য দেখতে দেখতে সময়গুলো চড়ুইয়ের মতো ফুড়ুৎ করে কখন উড়ে যায় টেরই পায় না। জানের জন্য প্রতীক্ষার দীর্ঘ মুহূর্তগুলো এভাবেই চারপাশ দেখতে দেখতে কাটিয়ে দেয় ঋতু। এই পরিবেশটা তাই ওর অনেক প্রিয়, অনেক আপন।
: কি ভাবছো সোনা?
মিজানের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পায় ঋতু। লম্বা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তর দেয়,
: নাহ তেমন কিছু না। ভাবছি এখানে আসতে আসতে আশপাশের জিনিসগুলো কতো পরিচিত, কতো আপন হয়ে গেছে।
: আমার চেয়েও বেশি?
: নাহ্‌ তোমার চেয়ে বেশি হবে কেনো। প্রকৃতি এবং পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে কি তোমার তুলনা চলে? তুমি আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো, সব থেকে আপন।
: তাই বুঝি।
গাঢ় মমতায় ঋতুর মাথাটা কাছে টেনে রক্তিম ঠোঁটের চূড়ায় একটা ভালোলাগার ছাপ এঁকে দেয় মিজান। তারপর আবার সব চুপচাপ। আশপাশ দেখতে থাকে ঋতু। মিজান চোখ বুঝে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে।
: সোনা,
এক সময় মিজানই নীরবতা ভাঙে।
: উম্‌।
: আচ্ছা, তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাসো?
: হঠাৎ এ প্রশ্ন কেনো জান?
: নাহ্‌ এমনিই।
: এমনি নয়, স্পষ্ট করে বলো। আমি তোমাকে চিনি, এতদিন পর হঠাৎ এমন কথা কারণ ছাড়া তুমি কখনো বলতে পারো না।
: সত্যি বলছি, কোনো কারণ নেই।
: নাহ্‌ জান, সত্যি নয় বলো তুমি।
ঋতুর জোরাজুরিতে বিমর্ষ হয়ে যায় মিজান। আকাশের গাঢ় নীলের মাঝে উড়ে চলা একটা চিল দেখতে দেখতে বলে উঠে সে,
: সোনা, আমার অক্সফোর্ডের স্কলারশিপটা হয়ে গেছে। ষোল তারিখে ফ্লাইট। একদিকে ক্যারিয়ার, আর একদিকে তুমি। কি করি বলো তো?
মিজানের কথায় চারদিকের সব সুর, সব ছন্দ যেন থেমে যায়। ঋতুর চোখ দুটো ভিজে আসে। কুয়াশা জড়ানো কণ্ঠে সে উত্তর দেয়,
: ভালোই তো।
: বেশ বলেছ। এটা কেমন ভালো হলো। তোমাকে রেখে কীভাবে একটা বছর আমি ওখানে কাটাবো বলতো পারো?
চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে মিজানের মুখের উপর পড়তে যাচ্ছিল- হঠাৎ তা সামলে নেয় ঋতু।
অন্যদিকে ফিরে বিকৃত কণ্ঠে বলে,
: একটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে দেখো।
অবুঝ শিশুর মতো মিজান তারপরেও গো ধরে
: নাহ্‌ কাটবে না, কাটতে পারে না।
: কাটবে জান, কাটবে। তুমি বড়ো ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরবে। বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করবে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। আমি যে সেটাই প্রার্থনা করি। এতেই যে আমার সুখ।
কান্না চেপে কোনমতে উত্তর দেয় ঋতু।
ঠিক এ সময়েই আছরের আজানের শব্দ ভেসে আসে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে মিজান-
: যাহ্‌ সোয়া চারটা। এখুনি যে উঠতে হয়।
: এখুনি উঠবে। ঠিক আছে চলো।
নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে বলে ঋতু।
: কাল কি আসবে?
: কাল কিভাবে আসি বলো? কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করতে হবে। সন্ধ্যার লঞ্চেই যেতে হবে বাড়ি। আজ তেরো, পনেরো’র মধ্যেই সবাইকে বলে সবকিছু গুছিয়ে ফিরতে হবে।
ঋতুর হাত-পা অবশ হয়ে আসে। কণ্ঠের জোর ক্রমশ ক্ষীণতর হয়।
: তাহলে এখানে আর আমাদের দেখা হচ্ছে না?
: এখানে আর কী প্রয়োজন। বাড়ি থেকে এসে তোমাকে নিয়ে কেনাকাটা করবো। একসঙ্গে খাবো, তারপর এয়ারপোর্টে তুলে দিতে যাবে তুমি। বাবা মা আসবেন। তাদের সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এনগেজমেন্টের আংটিরও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সময় থাকলে কাজীর ব্যাপারটাও। এতো কিছুর মধ্যে এখানে আসার সময় হবে কখন?
মিজানের এতো কথার কোনটাই কানে ঢুকছিল না ঋতুর। ওর চোখ তখন লাল পিঁপড়ের সারিতে। পিঁপড়েগুলো এতোদিন পর পথ পাল্টেছে। গাঁদা ফুলের ঝোঁপের পাশ দিয়ে পশ্চিমে ঘাসের মধ্যে নতুন পথ বেছে নিয়েছে ওরা। আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা এতক্ষণ পর বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে ঋতুর। হঠাৎ চোখ পড়ে হলুদ শালিকটার দিকে। এতোদিন পর ও জোড়া বেধেছে। বেশ সুখেই আছে ওরা। কিন্তু ওটা একা কেনো? ওর সাথীটা কোথায়? চারদিকে চোখ বুলিয়ে কোথাও সাথীটাকে খুঁজে পায় না ঋতু। দমকা বাতাসে একটা ইউক্যালিপটাস পাতা উড়ে এসে মাথার চুলে জড়িয়ে যায় ওর। হাত বাড়িয়ে পাতাটা ছুঁতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। এতো জল। অবাক চোখে ঋতুর কান্না দেখতে দেখতে একসময় নিজেও কেঁদে ফেলে মিজান। ওদের দু’জনার অশ্রু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status