ঈদ আনন্দ ২০১৮

বিশেষ রচনা

একজন হামিদার গল্প

আব্দুল হক প্রধান

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:০৫ পূর্বাহ্ন

হামিদা ছুটে চলেছেন। পেছনে বর্বর সেনাবাহিনীর লোক, গেরুয়াধারী স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। শোরগোল। আগুন জ্বলছে এখানে সেখানে। সঙ্গে স্বামী ও ৬ সন্তান। অন্তঃসত্ত্বা হামিদা ছুটেছেন প্রাণের ভয়ে। রাখাইনের মংডুর কাউডোং গ্রামের বাসিন্দা হামিদা। ২রা সেপ্টেম্বর ২০১৭। তিনি ঘরে ছিলেন। এমনি সময়ে বাইরে চিৎকার। প্রাণভয়ে পালাচ্ছে লোকজন। পেছনে ঘাতকের দল।
হামিদার সন্তান প্রসবের সময় আসন্ন। এই অবস্থায় তিনি পালাচ্ছেন স্বামী-সন্তানের সঙ্গে প্রাণভয়ে। তেড়ে আসছে হানাদার বাহিনী। কোনোমতে এক বনের ভেতরে নিজেদের লুকোলেন। শুরু হয় তার প্রসব বেদনা। ৪৮ ঘণ্টা এভাবে পেরিয়ে যায়। হামিদা বুঝতে পারেন সন্তান আসছে পৃথিবীতে। নেই বিছানাপত্র, নেই অন্য কোনো প্রস্তুতি। সন্তানদের সামনে বনের ভেতরে মাটিতে শুয়ে পড়েন। তিনঘণ্টা যন্ত্রণা শেষে আলোর মুখ দেখে তার ছেলে সন্তান। তখনো নাড়ি কাটা হয়নি। এরই মধ্যে বনের ভেতরে ঘাতক বাহিনী প্রবেশের শোরগোল। নাড়ি না কাটা ছেলেকে নিয়ে আবার পলায়ন। খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে একটু বিশ্রাম। এ সময় স্বামীর সাথে থাকা দা দিয়ে সন্তানকে আলাদা করা হয় মায়ের শরীর থেকে। কল্পনা বা সিনেমার গল্প কাহিনী হয়। মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের জীবন কথা। জীবনের এই গল্পটি লিখেছেন লন্ডনের অনলাইন দৈনিক ‘দ্য ডেইলি মেইলে’ সাংবাদিক ক্যাথলিন প্রিয়র। মিয়ানমার সেনাবাহিনী আর তাদের সহযোগীদের নৃশংসতার আর কোনো উদাহরণের প্রয়োজন আছে কী রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রমাণ স্বরূপ?
রোহিঙ্গা সংকট
রোহিঙ্গা সংকট প্রথম যখন আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিতে এসেছে তখন তা এমন গুরুত্ব পায়নি। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারি হয়। সামরিক অভ্যুত্থানের পরে সারা দুনিয়া এটিকে ‘সামরিক জান্তার শাসন’, ‘গণতন্ত্রহীনতা’ ইত্যাদি ব্যাখ্যা দিয়েছে। ১৯৮২ সাল থেকে শুরু। তখনই মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চুপিসারে রোহিঙ্গা নিধনের একটি আইন তৈরি করে। এই আইনের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে রাষ্ট্রহীন করার তৎপরতা শুরু করে। আজ প্রতিবাদ হচ্ছে- প্রতিবাদ হচ্ছে ২০১৭ সালে পৃথিবীব্যাপী। অথচ প্রতিবাদ হওয়ার কথা ছিল ১৯৮২ সালেই। তা হয়নি। পশ্চিম দুনিয়ার যে অবরোধ ছিল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তার কেন্দ্রে থাকা উচিত রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ। যুগযুগ ধরে একটি ভূখণ্ড বসবাসকারী একটি জাতিগোষ্ঠীকে  পরিচয়হীন, রাষ্ট্রহীন করার কোনো ইতিহাস বর্তমানে পৃথিবীর কোথাও কোনো উদাহরণ নেই। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কোনো দেশ এমন অন্যায় কাজটি করেনি মিয়ানমার যা করেছে। একটি জাতি নিধনের বিষয় হিসেবে না দেখে এটিকে শুধুমাত্র শরণার্থী সমস্যা হিসেবেই দেখা হয়েছে।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট ১৯৭৮ সাল থেকে। তখন সংকট এমন প্রকট ছিল না যেমন বর্তমানে হয়েছে। আগে থেকে প্রবেশ করেছে এমন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আর এখন পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ বহুমাত্রিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। আজকে কী কারো সন্দেহ আছে রোহিঙ্গা সংকট একটি মামুলি বিষয়? জাতিসংঘ বলছে এটি একটি জাতিকে ধ্বংস করার অপপ্রয়াস- তখন আর অন্য কারো বক্তব্য শোনার অবকাশ নেই।
ঘটনার শুরু
২৫শে আগস্ট ২০১৭। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (ARSA) নামের একটি উগ্রপন্থি গ্রুপ রাখাইনে একটি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এটাকে কেন্দ্র করে অভিযানের নামে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ফলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করে। বাংলাদেশে প্রবেশ করতে এসে নাফ নদে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অনাহার, রোগে ভুগে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে। এর সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন গত বছরের অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের উত্তর-পূর্ব রাখাইন রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সেনাবাহিনী নির্মম সহিংসতা চালাচ্ছে। তখনও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা
অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়ন অনেক আগে থেকে চলে আসছে।

নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার
প্রাণভয়ে পলায়নরত রোহিঙ্গাদের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করছে মিয়ানমার। পথে পথে পেতে রেখেছে স্থলবোমা। উদ্দেশ্য একটি রোহিঙ্গা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটি বলা হয়েছে। এর পরেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। ‘ল্যান্ডমাইন মনিটর’ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে অসংখ্য স্থানে প্রাণঘাতী স্থলবোমা অব্যাহতভাবে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের নিরাপত্তারক্ষীরা। অথচ ১৯৯৭ সালে স্থলবোমা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি মোতাবেক স্থলবোমা ব্যবহার নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ এই চুক্তিতে সই করেছে। মিয়ানমার সই করেনি। তাই তারা এই বেআইনি অস্ত্রটি ব্যবহার করছে।
মিয়ানমারের মশকরা
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন মিয়ানমার সেনাপ্রধান। রাষ্ট্রদূতকে তিনি বলেছেন- রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী নয়। দেশত্যাগী রোহিঙ্গার সংখ্যা কত তাও তিনি জানেন না। সেনাপ্রধান যুক্তি দিয়েছেন রোহিঙ্গারা প্রকৃতপক্ষে বাঙালি। তাই তাদেরকে নিজ দেশে ফেরত যেতে হবে। জোর করে তাদের ফেরত দেয়ার মধ্যে তাই কোনো অন্যায় নেই। অদ্ভুত যুক্তি। সত্যটি কী? মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে আধিপত্যবাদীদের অবস্থান শক্ত। দেশের সব সংখ্যালঘুদের সঙ্গে তারা সমস্যা বাঁধিয়ে রেখেছে। ইতিহাসস্বীকৃত, কোনো না কোনো সময় তারা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে সহায় সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তিন লাখ ভারতীয়কে বহিষ্কার করেছিল।
জাতিসংঘে মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেলরি ভ্যানথিও বলেছেন-কী কারণে এতো মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন তা পরিষ্কার নয়। আর এই মশকরাটা তিনি করলেন উপস্থিত বিশ্বনেতাদের সাথে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রধান মিন অং হিলাইং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন রোহিঙ্গাদের খতম করে। কী ভয়ঙ্কর চিন্তা-ভাবনা! মিয়ানমারের নেত্রী সুচি আরো একধাপ এগিয়ে গেলেন। সুচি বললেন- তিনি ভালো করে জানেন না রাখাইনে কী ঘটছে। সেখানকার মানুষেরা কী কারণে চলে যাচ্ছে তা তিনি বোঝার চেষ্টা করবেন। পরিহাস! পৃথিবীর কানা লোকটিও দেখেছে নির্মমভাবে রোহিঙ্গা বিতাড়ন ও নির্যাতনের ভয়ঙ্কর সব চিত্র। মিথ্যাচারে ভরা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির কথা। তাহলে কী সুচি বদলে গেছেন? ক্ষমতা কী তাকে অন্ধ করেছে? নাকি দীর্ঘদিন কারাভোগী, নির্যাতন বরণকারী সুচি ভয় পেয়েছেন? একাত্তরের বাংলাদেশে পাকিস্তানি পিশাচ জেনারেলরা মিথ্যাচারে ভরা বক্তব্য দিতো সর্বক্ষণ। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক। কাজেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেউ যেন নাক না গলায়। দম্ভ দেখিয়েছিল পাকিস্তান। পৃথিবীর মানুষ তা দেখেছিল। শেষতক তাদের করুণ পরাজয়ও দেখেছিল বিশ্ববাসী।
সেই সুচি এই সুচি
অক্সফোর্ডে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত সুচি। এক সময় গণতন্ত্রের জন্য নির্যাতন সয়েছেন। কারাবন্দি ছিলেন দীর্ঘদিন। সেনাবাহিনীর নির্যাতন উপেক্ষা করে অটল ছিলেন সিদ্ধান্তে। তার ত্যাগ তিতিক্ষা অনেক। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘নোবেল’ পেয়েছেন শান্তির জন্য। অক্সফোর্ড নগর কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড’ দিয়েছিল। ‘অনারারি ফ্রিডম অব দ্য সিটি অব লন্ডন অ্যাওয়ার্ড’সহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন সুচি।
সেই সুচি আজ কী ভূমিকা নিলেন তার নিজ দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে? তাহলে কি আজ একথা বলা খুব অযৌক্তিক হবে-ত্যাগী সুচি আজ ভোগী সুচিতে পরিণত হয়েছেন?
রোহিঙ্গা: ভারতীয় সাংবাদিকের কলমে
প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক মনোজ যোশী সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় লিখেছেন-১৯৭১ সালে এক কোটি বাঙালি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের পক্ষে তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার এটি একটি ছিল বড় ইস্যু। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চায় কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি যদি মোকাবিলা করা না যায় তাহলে সবকিছু উল্টে যেতে পারে যা ভারতের জন্য সুখকর হবে না। বিশ্ববাসীর কাছে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের দৃষ্টিভঙ্গি হলো রোহিঙ্গারা মুসলিম হওয়ার কারণে তারা সন্ত্রাসী। প্রশ্ন হলো রোহিঙ্গরা যাবে কোথায়? মিয়ানমার তো তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করে না। যোশী আরো লিখেছেন- ভারতের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে চারটি রাজ্যের। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত পাঁচটি রাজ্যের। কাজেই দুই প্রতিবেশীই ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কাছে বড় ধরনের বিনিয়োগকারী ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছে চীন। তাই চীন মানবাধিকার বিষয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয়। কাজেই ভারতের উচিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বলিষ্ঠ ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া, উচিত একীভূত আচরণ করা। যোশী এভাবে লেখা শেষ করেছেন-সাধারণ জ্ঞান বলে যে, যখন আপনার প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগবে, তখন আপনার নিজের স্বার্থেই তা নিভাতে এগিয়ে আসা উচিত।
গণআদালত
১৯৭৮ সালে রোমে এই আন্তর্জাতিক সংগঠন গঠিত হয়েছিল। ল্যাটিন আমেরিকার স্বৈরশাসকদের বিচারের জন্য যে ‘রাসেন ট্রাইব্যুনাল’ গঠিত হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত করা। গত ১৮ই সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ট্রাইব্যুনালের ৪৩তম অধিবেশন বসে। এই ট্রাইব্যুনালে রোহিঙ্গা এছাড়াও মিয়ানমারের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়।

রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রোহিঙ্গা নির্যাতনে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। বিশ্ব ব্যাংক মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পাদিত সকল ঋণ চুক্তি বাতিল করেছে। ইইউ মিয়ানমারের জেনারেলদের ইউরোপের দেশসমূহে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উদারভাবে আশ্রয় দিয়েছে।
শব্দটি ‘রোহিঙ্গা’
প্রাচীনকালে আরাকানিরা তাদের মাতৃভূমিকে ‘রখইঙ্গ’ নামে ডাকতো, যার মানে রাক্ষস বা দৈত্য দানব। জন্মভূমি তাদের কাছে ছিল ‘রক্ষইঙ্গতঙ্গী’। ‘রক্ষইঙ্গ’ শব্দটি পরবর্তীতে ‘আরখং’ বা ‘রাখাংগ’ রূপ ধারণ করে। কেউ বলছেন ইউরোপীয়দের দেয়া নাম ‘আরাকান’। ‘আরকং’ বা ‘রাখাংগ’ শব্দ থেকে শেষাবধি আরাকান।রোহিঙ্গা শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে আছে নানা মত। কারো মতে রাখাইন শব্দ থেকে রোহিঙ্গা। রোয়াং শব্দটি তিব্বতী, এর অর্থ আরাকান। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনো রোয়াং বা রোহিঙ্গা দ্বারা আরাকান রাজ্য এর অধিবাসীদের বোঝানো হয়।
অষ্টম শতাব্দীতে রাজা মহৎ-ইঙ্গ-চন্দ্রের রাজত্বকালে আরব থেকে আগত কয়েকটি মুসলিম বাণিজ্য জাহাজ রামব্রী দ্বীপের পাশে বিধ্বস্ত হয়। ঐ সময় জাহাজের আরোহীরা ‘রহম’, ‘রহম’ বলে চিৎকার করছিল বাঁচার আকুতি নিয়ে। এ সময় স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের উদ্ধার করে। আরবি ভাষায় অনভিজ্ঞ স্থানীয় লোকজন তাদের ‘রহম’ জাতির লোক ভেবে ‘রহম’ বলে ডাকতো। পরবর্তীকালে এই ‘রহম’ শব্দটি বিৃকত হয়ে রোহিঙ্গা রূপ ধারণ করে। ইতিহাস থেকে জানা যায় রোহিঙ্গারা আরাকানের আদিম জনগোষ্ঠী নয়।
কোনো এক সময় কামরাজগজি ও মারু বংশ আরাকান শাসন করতো। পরবর্তীতে মগধ থেকে আগত চন্দ্র সূর্য নামক এক সামন্ত সৈন্যবাহিনী চট্টগ্রাম ও আরাকানে বসবাসকারী আদিম জাহির সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে নতুন রাজ্যের গোড়াপত্তন করে। মগধ থেকে আসা হিন্দু ও বৌদ্ধ সৈন্যরা নতুন রাজ্যের আদিম অধিবাসীদের শিক্ষিত করে তোলে। ফলে পরবর্তীতে চট্টগ্রামে হিন্দু ধর্ম সংস্কৃতি ও আরাকানে বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কৃতির উদ্ভব হয়।
ইসলামের আবির্ভাবের ৫০ বছরের মধ্যেই আরাকান এলাকায় আরব থেকে মুসলমানদের আগমন শুরু হয়। এই সময় থেকেই মুসলমানরা আরাকান থেকে শুরু দক্ষিণ-পূর্ব চীনের ক্যান্টন বন্দর পর্যন্ত নৌবাণিজ্য বহর নিয়ে যাতায়াত করতো। চন্দ্র সূর্য বংশের প্রথম রাজা মহৎ ইঙ্গচন্দ্র ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে বৈশালীতে রাজধানী স্থাপন করেন। ঐ সময়ে আরবীয় বণিকরা ব্যাপকভাবে বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে ও ইসলাম প্রচারের মিশন পরিচালনা করে। পরবর্তীতে পিনসাবংশীয় রাজা পুন্যাখের রাজত্বকালে ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে পঁগা রাজবংশ আরাকান দখল করে কররাজ্যে পরিণত করে। এ সময়ে থেকে কিছু কিছু মুসলমান পঁগা রাজাদের সৈনিক, দেহরক্ষী, নাবিক ও বণিক হিসেবে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। দীর্ঘ সময় এখানে অবস্থানের কারণে স্ত্রী পরিবার তারা সঙ্গে আনতো না। ফলে স্থানীয় মেয়েদের তারা বিয়ে করতো। স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সময় বার্মার আইনের স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ফলে মুসলিম বণিকরা এখানে দ্বিতীয় বসতি স্থাপন করতো। কেউ কেউ স্থায়ী আবাস গড়ে তুলতো। ফলে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আরাকানের বিতাড়িত রাজা নরমিঘলা ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুরতান জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহর সহায়তায় হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। তিনি সিংহাসনে বসেন মুহাম্মদ সোলায়মান শাহ উপাধি নিয়ে। তিনি লেমব্রু নদীর তীরে ম্রোহং নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। এই ম্রোহং শব্দটি মুসলমানরা লিখতেন ‘রোসাংগ’। চট্টগ্রামে এই ‘রোসাংগৎ শব্দটি বিকৃত হয়ে রোহাংগ এবং শেষাবধি ‘রোহিঙ্গা’ পরিচিতি লাভ করে।
নরমিঘলার রাজত্বকালে ইসলাম প্রচার হওয়ার কারণে আরাকানের শাসকদের সাথে মুসলমানদের তেমন কোনো বিরোধ ছিল না। বৌদ্ধরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার চেয়ে সহযোগিতার মাধ্যমে স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করতো। ধীরে ধীরে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বৌদ্ধরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে। মুসলমানদের প্রতি রাজা সহানুভূতিশীল ছিলেন- এ ব্যাপারটাও বৌদ্ধরা পছন্দ করেনি। তারা নরমিঘলার মুসলিম প্রীতির জন্য তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়। কয়েকজন সামন্ত রাজা নরমিঘলার প্রতি আনুগত্যে অস্বীকৃতি জানায়। তারা আরাকানে বার্মার হস্তক্ষেপ কামনা করে। নরমিঘলার পরাজয়ের পর বর্মিরাজা তার জামাতা কামারুকে আরাকানের সিংহাসনে বসান। পরবর্তীতে নরমিঘলা বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহর সহযোগিতায় আরাকান আক্রমণ করে আবার সিংহাসনে বসেন। নরমিঘলার সঙ্গে দুইবারে আসা বাংলা সৈন্যরা আরাকানের স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে স্থায়ীভাবে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। চট্টগ্রাম থেকেও অনেক মুসলমান সেখানে গিয়ে স্থায়ী আবাস গড়েন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীও ছিল অনেক।
বাংলা থেকে যাওয়া মানুষের বসতি স্থাপনের শুরুটা এভাবেই। কিন্তু এরও আগে আরব থেকে আসা মুসলমানরা আরাকানে বসতি স্থাপন করেছিল। নরমিঘলার রাজবংশের শাসন আমলকে অনেকে ‘মুসলিম শাসনের যুগ’ বলতেন। এ সময়ে আরাকানে বাংলা ভাষায় অনেক সাহিত্য রচিত হয়। উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে ছিলেন দৌলত কাজী, আলাওল, মাগন ঠাকুর, আব্দুল করিম খোন্দকার।
এরপরের ইতিহাস মগ-ফিরিঙ্গিদের। তারা বাংলার উপকূল থেকে মানুষ ধরে নিয়ে আরাকানে বিক্রি করে দিতো। তারাই পরবর্তীতে আরাকানে স্থায়ীভাবে বসবাস স্থাপন করে। এরাও অন্তর্ভুক্ত হয় রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠির। এদের মধ্যে যেমন মুসলমান ছিল, তেমনি হিন্দুও ছিল।
সংকট জাতিগত, ধর্মীয় নয়
হাজার বছরের ব্যবধানে রোহিঙ্গা একটি জাতি। এখন যারা রোহিঙ্গা তাদের পূর্বপুরুষরা শুধু বাংলাদেশ থেকে যায়নি। রোহিঙ্গারা শুধু মুসলিম নয়, হিন্দুও আছে। রোহিঙ্গারা প্রথম আসে আরব থেকে, পরবর্তীতে যায় বাংলা থেকে। সুতরাং যারা রোহিঙ্গাদের একতরফাভাবে বাঙ্গালি বলে প্রচার করেন এবং শুধুমাত্র মুসলমান বলে চিহ্নিত করেন তারা এটা অজ্ঞতার কারণে করেন।
রোহিঙ্গা সংকট সম্পূর্ণ জাতিগত সংকট। তারা আরব কিংবা বাংলা যেখানে থেকেই আরাকানে থাকনা কেন হাজার বছরের অবস্থানের মধ্যদিয়ে তারা একটি স্বতন্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কাজেই আরাকান বা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সংকটকে জাতিগত সংকট হিসেবে নিয়ে তা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। কোনভাবেই ধর্মীয় সংকট হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
রোহিঙ্গা সমস্যা: ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ
রোহিঙ্গা নামের প্রাচীন জাতিগোষ্ঠির দশ লক্ষাধিক মানুষকে নির্মম নির্যাতনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও উগ্র রাখাইন সম্প্রদায়। অনিশ্চিত অবস্থা। কত সংখ্যক রোহিঙ্গা আসবে বাংলাদেশে? সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের সামনে আজ সমূহ বিপদের আশঙ্কা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির চাপে কক্সবাজার এলাকা পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এমনটি ধারণা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির। ইতোমধ্যে আনুমানিক দেড়শ’ কোটি টাকার বনজ সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। শুধু পরিবেশ নয় নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতাসহ সব ক্ষেত্রেই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশ। যে এলাকাসমূহে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে সে সকল এলাকার স্থায়ী অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা, আয়-ব্যয়ের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশের ভেতরে অন্যান্য অঞ্চলেও রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে এটিও একটি শঙ্কার কারণ। কক্সবাজারে দেশি বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা কম আসছে। ফলে পর্যটন শিল্পে আয় কমছে। বাংলাদেশের লক্ষ্য ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ। বিশ্বের কাছে আজ বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জিং। এই সম্ভাবনার একটি বিশাল প্রতিবন্ধকতা রোহিঙ্গা জনস্রোত। এই স্রোতে কতটুকু বাঁধাগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ সেই হিসাব সময়ের হাতে।
কাঁদে নাফ নদী
এপার ওপার। মাঝ দিয়ে বয়ে যায় নাফ নদী। নাফ নদীর জলে ভেবে যায় রোহিঙ্গার স্বজন, পুত্র পরিজন। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে রোহিঙ্গা পালায়। শুধু জীবনের জন্য। রোহিঙ্গার চোখে এখন মৃত অতীত আর ধূসর আগামী। মানুষ কাঁদে। রোহিঙ্গা কাঁদে। বাড়ে নাফ নদীর পানি। নাফ, তুমিও কি কাঁদো?
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status