ঈদ আনন্দ ২০১৮

বিচিত্রিতা

তেল

সৈয়দ আবদুর রহমান

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:০১ পূর্বাহ্ন

প্রিয় পাঠক, যখন মানুষের মন ভালো থাকে, তখন মনোমুগ্ধকর গান, বক্তৃতা, পাঞ্চালী, রসিকতা, রমণ, হৃদয়তন্ত্রীর আকুলি-বিকুলি, এমনকি মধুর-যন্ত্রণার স্মৃতি রোমন্থন ও উপভোগ্য মনে হয়। নাহলে কি শেক্সপিয়ার লিখতেন- “Our Sweetest song are those, that tells of saddest thoughts”?

অর্থাৎ যখন আপনার মন ভালো থাকবে তখন সবই ভালো লাগবে। একটি অনুভূতি ভালো তো লাগবেই। এটা বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত। সেটা বলব? তাহলো- স্তূতি। এর গভীর স্তর হলো তোষামোদ, চাটুকারিতা, মুসাহেবি, খয়ের খাঁ গিরি যে নামেই একে অভিহিত করুন। এই স্বভাবটি বিশ্ব সাহিত্যেও স্থান পেয়েছে। নিগলিতার্থে সহজবোধ্য ভাষায় একে বলে ইংরেজিতে- ফ্ল্যাটারি, বাংলায় (আমার মতে সবচে’ মুখরোচক ভাবে বলতে গেলে) তৈল মর্দন। দাতা-গ্রহীতা উভয়ই প্রীত। যথা: বিম্বৌষ্ঠি ভার্য্যার বিম্বৌষ্ঠ্য পান। দিয়ে যেমনি, পেয়েও তেমনি। বরং ততোধিক। অবশ্য এই তৈল-মর্দনের ব্যাপারটি তখনই সার্থক হয় যখন উভয়পক্ষের সমান আগ্রহ থাকে। বৈশ্বিকভাবে এটা সমভাবে নন্দিত বা নিন্দিত হয়ে থাকে। গ্রহীতা যদি দাতার সমমনা হন, তাহলেই কেবল দাতার স্বার্থ সিদ্ধি ঘটে থাকে। এর প্রয়োগ মানব-সভ্যতার মধ্যযুগ হতেই ঘটে আসছে এবং তা চলবেই কেয়ামত তক। কারণ, তোষামোদি হচ্ছে ষড়রিপুর তৃতীয়, চতুর্থ এবং ষষ্ঠটিও। নৃপতিদের জন্য এটা অনিবার্য উপচার ছিল। ষোড়শ উপচারের মধ্যে মনোরঞ্জন একটি উপচার। আমার বক্ষ্যমান লেখাটিতে আমি এই স্বভাবটিকে “তৈল মর্দন”-ই বলব। “খাঁটি সরিষার তৈল” কথাটি এই স্বভাবটির বেলায়ই আমরা বলি, লিখি। এটা ঝাঁঝালো বলেই নাকি নিদ্রাকারক। এরই জন্য নাকি বলা হয় “নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো”। অর্থাৎ কিনা, আপনার নাক তেল পেলে আপনাকে সুপ্তি-মগ্ন করে। আর সুসুপ্তি? মানবমনের সর্বোচ্চ সুখের উপাদান তো এটাই! প্রাচীন-প্রাচীনা নৃপতি (স্ত্রীলিঙ্গে কি হবে না জানি না- তবে নৃপত্নী তো হবেই না। পাঠক, আমার শব্দকোষ-দারিদ্র্যকে ক্ষমা করতে নেক মর্জি হয়)। এই স্বভাবটিকে খুবই মূল্য নয়, তবে হাস্যবদনে প্রশ্রয় দিতেন। এর প্রমাণ স্বরূপ আপনাকে দু’টি ওয়াক্বিয়াহ বলছি। একটি এখন এবং অন্যটি বারদীগর। বারান্তরে। যখন মধুরেণ সমাপয়েৎ করব, তৎকালে।
মহারানী ভিক্টোরিয়া তখন ভারত-সম্রাজ্ঞী হয়েছিলেন কি জানি না। যাহোক, কোনো একটি স্থানে একটি অনুষ্ঠান উদ্বোধন-নিমিত্তে রাজকীয় অশ্ব-শকটারুঢ় হয়ে মঞ্চের সন্নিকটে অবতরণ করলেন। সহাস্য বদনের প্রতিযোগিতায় নেমে অপেক্ষমাণ ডিউক-ডাচেস, কাউন্ট-কাউন্টেস, আর্ল-আর্লেস, ভাইকাউন্ট-ভাইকাউন্টেস, নিম্নকক্ষ কমন্স সভার জাঁদরেল এমপি, প্রভাবশালী মন্ত্রী, চিহ্নিত চাটুকারবৃন্দ সসব্যস্ত হয়ে তাঁর চারপাশে বলয় হয়ে কৃপা-নেত্র লাভার্থে ঘিরে দাঁড়ালেন। তারপর নিল-ডাউন করলেন, নামাজে রুকু করার মত বাও করলেন, প্রশংসা তুবড়ি ছোটালেন কম-বেশি সবাই। ততক্ষণ অশ্ব শকটটি রাজকীয় আস্তাবলে ফিরে গেছে। তা গেছে তো গেছে-অশ্বগুলির যে, কোনো একটি স্ট্যালিওন বা মেয়ার বা জেলডিং যাই-ই হোক, যাবার আগে তার পেট খালি করে পুরীষ নির্গত করে গেল। কেউ তা দেখেনি। সবাই তখন সম্রাজ্ঞীর চার পাশে দুঁহু দুঁহু, কুঁহু কুঁহু অবস্থায়। সম্রাজ্ঞীর পুণ্যানন দর্শনপূর্বক পুণ্যার্জন করছিলেন- কারণ রাজদর্শনে নাকি পুণ্যার্জন হয়। যা হোক, স্তূতিপর্ব সমাপনান্তে প্রটোকল প্রধান ভিক্টোরিয়াকে বাও করে, ইস্তেকবাল করে পথ দেখিয়ে নিয়ে যখন মঞ্চ পানে নিয়ে যাবেন তখন সবাই অশ্বের সদ্য-প্রসবিত পুরীষস্তূপ সন্দর্শন করলেন। সম্রাজ্ঞীও দেখলেন! পুণ্যানন রক্তিম হলো ক্রোধে! অপমানে চোখের পাপড়ি কাঁপল বার কয়েক! ভ্রূ-কুঞ্চিত হল ততোধিক! প্রধানমন্ত্রীকে রোষকষায়িত লোচনের দৃষ্টিবাণ হানলেন। প্রধানমন্ত্রীর থরহরি-কম্প শুরু হল! চারপাশের মানব-মানবী ভয়ার্ত! হৃৎকম্পের ফলে সব্বাই তখন স্ট্যাচু! সমাধান কারুর মুখ থেকেই শব্দ বেরুচ্ছে না। শব্দ হচ্ছে না অসাড় রসনা থেকে। তখন হলো কি জানেন? সম্রাজ্ঞীর “নিকটতম প্রিয়ভাজন” একমন্ত্রী ওয়াল্টার র‌্যালি, যিনি উভয় কক্ষেই সুবিদিত ছিলেন চাটুকারিতার জন্য, তিনি সবচে ভয়ার্তের ভান ধরে এসে সম্রাজ্ঞীর ক্রুদ্ধ দৃষ্টির সামনে এসে কৃতার্থের হাসি হেসে মাটিতে গায়ের ওভারকোট খুলে ঐ অশ্বগোবরের উপর লম্বা করে বিছিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনি হলেন সেই সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী- যার নির্দেশ সমুদ্রের ঢেউ পর্যন্ত মেনে চলে। তাই আমার ওভার কোটটি আমার মত করে বিছিয়ে দিলাম। এতে আমি মনে করি আমার উপর দিয়ে হেটে গেলে আমি ধন্য হই।” সম্রাজ্ঞী তার পানে সস্নেহে মধুর হাসি দিয়ে অশ্ব-গোবর পার হয়ে গেলেন। মঞ্চারুঢ় হলেন। সংক্ষিপ্ত বচনামৃত বর্ষণ করলেন। আসনে আসীন হয়ে সম্রাজ্ঞী-সুলভ ছদ্ম-গাম্ভীর্য ধারণ কর্লেন। ফল কি হল জানেন? পরদিনই ওয়াল্টার র‌্যালি পেয়ে গেলেন নাইট হুড উপাধি। হয়ে গেলেন “রাইট অনারেবল স্যার ওয়াল্টার র‌্যালি।” বিশ্বসেরা স্তাবকদের মধ্যে তিনি একজন স্তাবক।
এই স্বভাবটি তা’ দোষ/গুণ যাইই হোক না কেন, সব ভাষাতেই এর একাধিক সমার্থক শব্দ আছে। বাংলায় ও এর নানান সমার্থক বিশেষণ আছে। পুনরুল্লেখ করা নিরর্থক। আপনারা মানুন বা নাই মানুন, আমি অধমজনা মনে করি স্বভাবটির পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায়- “তৈল-মর্দক” বিশেষণটিই হচ্ছে সর্বজন গ্রাহ্য উপাদেয় শব্দ। কারণ এতে আছে না গুণের স্বীকৃতি, না আছে তেমন বেশী ঘৃণা।
আসলে এই তৈল-মর্দন হল কাউকে অপ্রাপ্য প্রশংসা বর্ষণ বা প্রাপ্যের চেয়েও বেশি প্রশংসা বর্ষণ। তৈল দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে এইচসিএম (হাইয়েস্ট কমন ফ্যাক্টর) হল প্রশংসার মাত্রাবেগ। তবে প্রশংসা পেলে তৃপ্ত হয় না বিশ্বে এমন কেউ আছে কি? আমার প্রৌঢ়া-বিম্বোষ্ঠি যখন আমাকে বলে “আমাদের জন্য কষ্ট করছো। তবে আমি মরে গেলেও আমার স্থানটি কাউকে দেবে না। নৈলে ঘুমের মধ্যে এসে তোমার ঘাড় মটকে দেব”-তখন আমি কি আনন্দিত না হয়ে পারি? এটা তৈল মর্দন নয়। এটা প্রাপ্য স্বীকৃতি বা নীরেট প্রশংসাই। যে স্বীকৃতির কোনো বৈধ ভিত্তি নেই সেটাই হল তৈল মর্দন। এর নিম্নতম স্তর হল সাধারণ প্রশংসা। তবে যারা এটির গ্রহীতা-তারা এর মাত্রা বেশি হলে আত্মহারা হয়ত হয় না কেউ কেউ, তবে তাদের তৃপ্তির মাত্রাটি অর্ডিনাল সংখ্যার স্তরের ন্যায় অভ্রভেদী উল্লম্ফন তুল্য ও হতে পারে। স্মর্তব্য এই যে, এর গ্রহীতাবৃন্দ নর ও নারী উভয় প্রজাতীতেই আছে। পাঠককে চুপি চুপি কানে কানে বলছি-এইটির নারী গ্রহীতাদের মুগ্ধ কর্তে প্রধান দু’টি উপাদান হল সাধারণত রূপ ও রন্ধন। রূপবতী, গুণবতী এবং পুণ্যবতী যুগপৎভাবে হলে তার বেলায় সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে পুণ্যবতীর রক্ষণশীলতা, ধর্মচর্চা এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের অশুণ্ঠ প্রশংসা। অধার্মিকা নারীরা অধিকহারে স্তূতি মুগ্ধ হন সাধারণত: বিশ্বের তাবৎ নারীকুল একটি প্রশংসায় বশ হয়ে যান। আপনি যদি ভোজন পটু হন তবে যে কাজটি সুসম্পন্ন করলে আকণ্ঠভোজন সুবিধা পাবেন তাহল বয়স ও সম্পর্ক নির্বিশেষে আপনি ঐ নারীটিকে তাঁর রন্ধন-দক্ষতার প্রশংসায় ফুলিয়ে নিতে হবে। যার কাছে পেটপুরে খেতে চান তার কাছে রান্নার উচ্ছ্বসিত তারিফ করুন এবং তার জ্ঞাতসারে তাঁর রন্ধন-দক্ষতা অন্য নারীকে জোরালোকণ্ঠে শোনান। ব্যস, হয়ে গেল! যখনই তার সামনে পড়বেন, বেল্ট ও প্রথম বোতাম খুলে খেতে বসবার সুযোগ পেয়ে গেলেন।
দেখবেন আপনার পাতে তণ্ডুল পড়ছেই। পাতটি অন্ন-ঢিবি হয়ে গেছে। ঝোলে হ্রদ হয়ে গেছে। এবার চেটেপুটে খান! থালার খাদ্য ঢিবি যদি ন্যূনতম সময়ে উদরস্থিত করতে পারেন, তাহলে আপনার মতো বীরপুরুষ আর নাকি হয়ই না। ঐ নারীটিই মহিলা মহলে রটিয়ে দেবেন আপনি কৃতবিদ্য না হলেও পাহ্‌লোয়ান সম খেকো-বীর। প্রিয় পাঠক, কাউকে বলবেন না যেন- যৌবনে আমিও ভোজনপটু ছিলাম। এই নশ্বর পৃথিবীতে আমাদের মতো অধমজনাদের আর কি গুণ আছে ভোজন-বীর হওয়া ছাড়া? মহাপুরুষরা অমর হন, কীর্তিমান হন সুকীর্তির দ্বারা। আমরা কিছুকাল স্মরণসভায় আলোচিত হব ভোজন-বীর হবার জন্য। এই কর্মটিতে রাজা-প্রজা, জ্ঞানী-মূর্খ, সুশ্রী-বিশ্রী সবাই সমান। যাই হোক, যা বলছিলাম ঐ তৈল মর্দনটি হল অনায্য প্রশংসা বর্ষণ বা অতিরিক্ত প্রশংসা-বর্ষণ। ন্যায্যক্ষেত্রে প্রশংসা করাটাকে তোষামোদ বলা হয় না। সহানুভূতিকামীকে প্রশংসা করা তোষামোদ নয়। যথা: রোগাক্রান্তকে উন্নতি হচ্ছে বলাটা তৈল মর্দন নয়। এটা হচ্ছে তাকে মানসিকভাবে বলীয়ান করার জন্য সান্ত্বনা বাক্য।
সব তৈল মর্দন হচ্ছে নানা মাত্রার প্রশংসা, কিন্তু সব প্রশংসা তোষামোদ নয়। তাহলে তৈল-মর্দনের সংজ্ঞা কি? সংজ্ঞা হল- শ্রোতার প্রতি বক্তার ঐ সব উক্তি/দেহভঙ্গি ও যা গ্রহীতার প্রাপ্য নয়, অথবা সীমাতিরিক্ত গুণকীর্তন। যথা: অপরূপা/অসুন্দরী নির্বিশেষে তৈল-মর্দকের তোষণ-বাক্যালংকার তাদিগকে প্রাণের সুখে উচ্ছ্বলিত, হাস্যময়ী, লাস্যময়ী করে তুলে। কারণ, আমরা জানি যে সেইসব নারী যারা জানে যে, তারা অন্তত: কুচ্ছিত নয়-তারা নিজেদেরকে সর্বজনগ্রাহ্য সুন্দরী বলেই ভাবে। এদেরকে “সুন্দরী” বলে দেখুন- দেখবেন লাজুক হাসি। আনত নয়ন। মেয়েটি তখন নিজেকে হেলেন/পেনিলোপী/ভেনাস ভাবছে! এটাই স্বাভাবিক। নীরেট প্রশংসা হল কারুর বৈধ চিন্তা/বাক্য ও কর্মের স্বীকৃতি। তৈল-মর্দন হল ঐ বাক্য/কর্ম যা রানী প্রথম এলিজাবেথকে এডমন্ড স্পেন্সার তাঁর বই “দি ফেয়ারী কুইন” (পরীরানী)- এ যা বলেছেন, শেক্সপীয়ার রাজা ১ম জেমস্‌কে ম্যাকবেথ নাটকে যা বলেছেন; কিং লীয়ার নাটকে রাজার জ্যেষ্ঠ কন্যাদ্বয়- গনেরিল ও কর্ডেলিয়াকে দিয়ে যা বলিয়েছেন; নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী তাঁর বই “দি প্রিন্স” বইতে লরেনজো- “দ্যা মেডিসিনকে” দিয়ে তিনি যা বলিয়েছেন; জে.আর.আর তোলকিন তাঁর বই “দি লর্ড অফ দি রিংস” নামক বইতে ওয়ার্মটাংগকে দিয়ে যা বলিয়েছেন; সম্রাট আকবরের সভাষদ বীরবল যা বলতেন, এডোলফ হিটলারের পোষা মন্ত্রী হ্যারম্যান গোয়েবলস যা বলত; গোপাল-ভাঁড় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে যা বলত তার গোপালী ভাষায় (তবে গোপাল সমিতির মতো নয় যদিও, বালাইষাট! সে রকম হতে যাবে কেন? তারা গোপালী ভাঁড় তো নয়, তেনারা হলেন চাঁন-কপালী, তেনারা এক পুরুষ কামাবেন, আর তেনাদের তিন পুরুষ তক বসে বসে খেয়ে যাবেন)-এগুলি হল তৈল মর্দকের কথন-শৈলী বা মুক্তার মালা। মর্দকদের পরিণতি হয় শোচনীয়। ক্ষমতা হারালে, সূর্য্য পাটে গেলে, মুক্তার মালা ঘুঁটেমালা (শুষ্ক গো-ময় বা পুরীষ রাশি) বা পাদুকামালা হয়ে যেতে সময় লাগে না। পুষ্পাঘাত লোস্ট্রাঘাতে বদলে যেতে সময় লাগে না। এগুলি অফ দ্যা রেকর্ড বলছি।
উচ্চমাত্রায় তৈল মর্দনের ভাষা-শৈলী অসাধারণ হয় বলে নিম্নমার্গীয় তৈল গ্রহীতার অনুভবে আসে না। ফলে তারা হতাশ, গম্ভীর এবং বিরক্ত হয়ে যায় এবং গম্ভীর হয়ে যায়, বা বোঝার ভান করে। উভয় পক্ষই উচ্চমার্গীয় সমঝদার হলে এই গ্রহীতা শুধু মাথা নাড়েন বা দাস্যসুখে হাস্য করেন। তবে স্বীকার করি উচ্চমার্গীয় তৈল মর্দনের ভাষাকে হতে হয় সাহিত্য বা বিজ্ঞানের নিংড়ানো রস দিয়েই। কেবল প্রশংসা কিন্তু অন্তসার শূন্য মিছরীর কথামালা নয়। উচ্চমার্গীয় প্রশংসা হল সেই কথামালা যার ভিত্তি হলো ন্যায্যতা ও সত্যের উপর। যথা: ড. ইউনূস প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে অনুরোধ করে বিশ্বব্যাংকের স্থায়ী কর্মসূচিতে দারিদ্র্যবিমোচনে ক্ষুদ্র-ঋণ প্রকল্প নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করিয়েছেন এবং এর পরেই তারই কোনো এক বৈশ্বিক বক্তৃতায় তাঁর নিজ আত্মসম্মান বজায় রেখে বলেছিলেন, “বিশ্বময় দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য বিশ্বব্যাংক কর্তৃক গৃহীত ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প প্রণয়ন সম্ভব হয়েছে এক ব্যক্তির কারণে।”  তিনি প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের নাম বলেননি, তবে তাঁর দিকে চেয়ে কথাটি বলেছিলেন। এটা তোষামোদ নয়। এটা হল যথার্থ প্রশংসা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট না বললে বিশ্বব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি প্রকল্পটি তাদের এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করত না।
তবে এটাও সত্যি যে, খুব সূক্ষ্মভাবে প্রশংসা দিয়ে তোষামোদ করা যায়। তা হতে হবে উচ্চাঙ্গের। কথিত বাক্যটিকে হতে হবে দ্বিত্ববোধক, উভয়ার্থ বোধক। গ্রহীতা একে প্রশংসা ভাবলে প্রশংসা হবে, আবার তোষণ ভাবলে তোষণ ও হবে। ইংরেজিতে যুঁৎসইভাবে একে বলা হয় কমপ্লিমেন্টস। এ যেন উচ্চাংগের ছদ্ম-প্রশংসাটি আসলে তোষণ। এ যেন একটি দোলায়মান পেন্ডুলাম-দু’দিকেই হেলে। এ রকম কমপ্লিমেন্টসের অর্থ সমভাবে দুই রকমই হতে পারে। গ্রহীতা এটিকে যেভাবে ভেবে প্রীত হয়। এটা হল একটা অপূর্ব ধূর্ত-শৈলী। প্রশংসা পেলে কে না প্রীত হয়। সবাই হয়। আমি-আপনি-সে, সবাই প্রীত হয়। কোনো মুয়াজ্জিনকে বলুন সুবহে সাদিকের ওয়াক্তে তার সুরেলা আজান আপনাকে মুগ্ধ করে। চেহারায় থাউজেন্ড ভোল্টের মত আলোময় হয়ে যাবে তাঁর সহাস্য চেহারাখানি। ১০০% সৎ চাকুরেকে বলুন তিনি ঘুষ খান না বলে তাঁকে সম্মান করেন। তারপর দেখুন তাঁর আনন্দ উদ্ভাসিত গর্বিত চেহারাটা।
তোষামোদ ও একটা আর্টই বটে। একজন ধূর্ত তৈল মর্দক একজন ভালো মনোবিজ্ঞানীই বটে। সে তার টার্গেট ব্যক্তির মন ভালোভাবেই পড়ে ফেলতে পারে। সে অন্যের মন বুঝতে ঘাগু। কার বেলায় কি কি শব্দ ব্যবহার করতে হবে সে তা ভালই বোঝে। ডেল কার্নেগী বলছেন, “তোষামোদ তাই-ই যা যে ব্যক্তি নিজ সম্পর্কে যা ভাবে, তাকে তার বিশ্বাসগুলিকে সংক্ষেপে গুছিয়ে বলা।” এটা একটা শৈলী। এই শৈলী হল সংক্ষেপে নিম্নরূপ:
ক) কিছুটা উষ্ণ হৃদয় আন্তরিক প্রীতির ভাব নিয়ে মধুমাখা কণ্ঠে চমৎকার বাক্য দিয়ে মনোহারী কথা বলুন যাতে আপনার টার্গেট ব্যক্তির স্নায়ুতন্ত্রে শান্তভাবে অনুভূত হয়। একেই বলা হয়, আনন্দ যা তৈল গ্রহীতাকে দিতে হয়।
খ) প্রশংসা করতে মোটেই কার্পণ্য করা চলবে না। লঘু শব্দ বা মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করবেন না। কারণ মাত্রা লংঘিত হলে আপনাদের পারস্পরিক সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে। এই কাজে নিজ গাম্ভীর্য্য এবং তাঁর মনে আনন্দদানে ভারসাম্য রাখতে হবে।
গ) আপনার তৈল গ্রহীতাকে পর্যবেক্ষণ করুন এইভাবে যে, তাঁকে অধিকতর কর্মদক্ষ এবং সুশ্রী দেখাতে নিজের প্রতি বাড়তি পরিশ্রম কোথায় ও কিভাবে করেছেন, সেটার স্বীকৃতি দিন মোক্ষম ভাষায়।
ঘ) তাঁকে প্রশংসা করতে লম্বা লম্বা বাক্য শোনাবেন না। কারণ সময়ক্ষেপণ হেতু সময়ের অপব্যয় হলে তিনি আগ্রহ হারিয়ে কুপিত হতে পারেন। তাহলে সবই ভেস্তে গেল যে! কম শব্দ, ছোট ছোট বাক্য বললে তিনি আপনার কথা শুনতে মনোযোগী হবেন। ফলে আপনি কম সময়ে তাঁকে প্রভাবিত বেশী করতে পারবেন।
ঙ) ছদ্ম প্রশংসার ফলে তাঁর চেহারায় বিরক্তি প্রকাশ পেলে সংগে সংগেই ক্ষান্ত দিন।
সাফল্য পেতে তৈল মর্দন কি জরুরি? নিশ্চয়ই। আজকাল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীদের বেলায় এ ছাড়া উপায় নেই! গ্রহীতা নিজ প্রশংসা শুনতে ভালবাসলে, তবে তা করতে ই হবে। নৈলে পিছিয়ে পড়বেন। তবে সাবধানে। আগে তাঁর মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হোন। তিনি চাইলে আপনাকে তা দিতেই হবে। না দিলে- “তাহার মনের মধ্যে ব্ল্যাক-লিস্টেড হইবেন যে! তাহা আপনার মনে থাকিবে কি?”
ইউরোপে রেনেসাঁর যুগে ও সম্রাটরা তৈল মর্দনকে তাদের ন্যায্য পাওনা ভাবতেন। অধঃস্তনদের জন্য এটা সাফল্যের পরশপাথর হয়ে যেত। তা’ এই অতি প্রশংসার ফলাফল কি? ফলাফল হল এটা করলে প্রিয়ভাজন আস্থাভাজন হওয়া যায়। অসৎ ঊর্ধ্বতনের ডান হাত হওয়া যায়। তবে, অসৎ অধঃস্তনরাই অসৎ ঊর্ধ্বতনদের ডানহাত হয়ে যায়। তাদের পুরস্কার জুটে। বন্ধু জুটে। তবে অসৎ বসদেরকে অপ্রিয় সত্য বললে তিরস্কার জুটে। শত্রু জুটে। এই স্বভাবটি এর দাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে। তৈল-মর্দকরা কিন্তু ঊর্র্ধ্বতনদের বেলায় কেঁচোর মত নরম হয়ে যায়। তৈল গ্রহীতার নিকট এঁরাই নিজ দেহের কুণ্ডলী পাকানো দেহভঙ্গী ধারণ করে ঐ কুণ্ডলী পাকানো কেঁচোর মতই। অথচ এরাই তাদের অধঃস্তনদের প্রতি শুধু তৈল প্রত্যাশীই হয় না এরা কাঙ্ক্ষিত তোষামোদ না পেলে তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে যায়, বকা দেয়ার সীমা ছাড়িয়ে যায়, অনর্থক চাতুরীপূর্ণ শাস্তি দেয়, তাদের ন্যয্য ও বৈধ প্রাপ্তিতে বাধা দেয়, অসহযোগিতা করে। তা করতে পারলে নিজেদেরকে সম্রাট সূলভ ক্ষমতাবান বলে মনে করে। স্বার্থলাভে এরা চোখের পলকে এরা পাকা কথাকে ও বদলে ফেলে। উপার্জন জগতে তৈল-মর্দকরা নির্ভরযোগ্য তো নয়ই, বরং কূটচালক, বিপজ্জনক।
এদের বিচরণ শুধু কি অর্থজগতে? না-না! সর্বস্তরেই এরা সংকট সৃষ্টি কারক। সরকারী কর্মজগতে এরা খুবই সুবিধাভোগী শ্রেণি। ক্ষমতাবান। সবচেয়ে বেশি কোথায় এরা বিপজ্জনক তা জানেন? রাজনীতিতে। সরকারের শীর্ষের ও তার ঘনিষ্ঠ পদাধিকারীদের আশপাশেই এরা অবস্থান নেয়। ফলাফল? গৃহীত নীতিমালায় ক্ষতিকর ধ্বংসকারক সিদ্ধান্ত স্থান পেয়ে যায়। প্রমাণ চান? নিকটতম উদাহরণ হল স্বাধীন রাজ্য সিকিমের ভারতভুক্তি। কারণ, নীতিভ্রষ্ট চাটুকার ও ধান্ধাবাজ লেন্দুপ দর্জি। এরই কুচক্রের ফলে ভারতভুক্ত হয়ে যায় সিকিম। এই কিসিম লোকরাই হল জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, উমি চাঁদ, মীরজাফর প্রমুখ। মানবসভ্যতার মধ্যযুগ হতেই জ্ঞানীরা তৈল-মর্দকদের মনস্তত্ত্ব, বৈশিষ্ট্য, কৌশল প্রণালী, আচরণবিধি সম্পর্কে রচনামৃত রেখে গেছেন। শাসকবর্গ সতর্ক করেছেন বারংবার। রচনামৃত যে পান করেছে সে বেঁচেছে, যে করেনি, সে মরেছে। এদেরকে সর্বদাই ওয়াচে রাখতে হয়। নবী (দ.) কর্তৃক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা  ইলমে মারেফত বণ্টনের দায়িত্ব প্রাপ্ত, দার্শনিক, শ্রেষ্ঠ কবি, দুর্ধর্ষ মহাবীর হযরত আলী (রা: আ:) তাঁর “নাহজুল বালাগা” বইতে এদের সম্পর্কে জোরালোভাবে সাবধান করেছেন। ইবনে খালদুন তার বই “আল মুকাদ্দিমাহ” বইতে এদের বিবরণী ও প্রতিকার সম্পর্কে বিশদ বিবরণী ও সতর্কতার গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছেন। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলী তাঁর বই “দি প্রিন্স” বইতে চাটুকার সম্পর্কে বিশদ বিবরণী ও সতর্কতার গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছেন। বিশ্বের অন্যান্য গুণীজনরা ও লিখেছেন। এঁরা সবাই এদের সম্পর্কে সতর্ক ও জ্ঞাত থাকতে বলেছেন। কিভাবে এদেরকে চিনবেন? বলছি শুনুন-
ক) আপনি লক্ষ্য রাখবেন যে কে/কারা আপনি যাই-ই বলেন, যাই-ই করেন তারই প্রশংসা করে। প্রশংসার্হ কাজ আপনি না করলে ও প্রশংসা করে। আপনার বহু আগের প্রশংসার্হ কাজগুলি প্রশংসার চর্বিত-চর্বন আপনার সামনেই করে। এমনকি আপনার ভুল কাজটির ও ধূর্ত বাক্য শৈলী দিয়ে হালকাভাবে প্রশংসা করে।
খ) খেয়াল করবেন যে, কারা আপনাকে সদাই শাব্দিক লেহন করে বা চেষ্টা করে। এই কাজে পটুদের নিশ্চয়ই চিনবেন। নবাগত, আনাড়ীরা প্রথমবারেই আপনার কাছে চিহ্নিত হয়ে যাবে। শীর্ষ মর্দকরা কিন্তু চক্ষুলজ্জা ফেলে দিয়েছে। তারা আপনি সহ টার্গেট ব্যক্তিদেরকে সবার সামনেই হাসিমুখেই করে থাকে, তা’ এমন হাসি মুখে যার ফলে ঠোঁটের কোণা তার কানে গিয়ে ঠেক্তেমানে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি “আর কি। এতে সে মোটেই লজ্জিত হয় না। সে তো নির্লজ্জই। একে বলা যায় “খাল পড়া কুত্তা।”
গ) তার বাকপটু রসনাটি সুযোগ পেলেই আপনার জন্য ঝটিতি অতিরঞ্জিত প্রশংসা কর্তে থাকে স্থান-কাল-পাত্রের ধার না ধেরেই।
ঘ) তৈল মর্দকটি তার সহকর্মী, উপ-সহকারী, অধঃস্তনদের কখনই এরূপ মর্দন/লেহন করে না। বরং পারলে আরো করালমুখো হয়ে কম্বু কণ্ঠে কাল-কূট ঢালে তাদের কানে, যাতে তারা মর্মপীড়ায় ভোগে এবং তার বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক কিছু করতে ভয় পায়।
ঙ) মর্দকের অধ:স্তনরা আপনার কাছে নালিশ জানায় এবং আপনাকেই তাদের ত্রাণকর্তা ভাবে।
চ) যাদেরকে আপনি প্রশংসা করেন তাদের দক্ষতা এবং ব্যক্তিত্বের জন্য, তাদেরকে সে হিংসা করে। আপনার কাছে তাদের নতুন নতুন কৃতিত্বগুলিকে খাটো করে দেখাতে চায়। তাদের স্বাভাবিক ভুলগুলিকে আপনার কাছে তিলকে তালের মত বড় করে লাগায়। আপনার কানভারী করে অত্যন্ত চাতুর্য্যের সাথে যেন সহজে তাকে আপনি পাকড়াও করার সুযোগ না পান।
ছ) তারা অন্যের কৃতিত্বকে ছিনতাই করে নিজের কৃতিত্ব বলে আপনাকে ইমপ্রেস করতে চায়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যা সম্পর্কে সতর্ক থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। তাহল অফিস-রাজনীতিক। এরা বিশ্বের সব অফিসেই কমবেশী থাকে। দলীয় রাজনীতিকরা যেমন দুমুখো সাপ হয়ে থাকে, এরা ও তদ্রুপ। এদেরকে ও আপনাকে চিনতেই হবে। কিভাবে চিনবেন বলছি শুনুন-
গুজবশিকারী- এই প্রকার অফিস-রাজনীতিকরা সর্বদা গুজব-সন্ধানী এবং গুজব প্রচারক হয়। সমমনাদের নিয়ে এরা তৈল-মর্দকের গ্রুপে থাকে। গোপন বৈঠক ও করে। একাউন্টস, মানব সম্পদ ও প্রশাসন শাখার টেবিলে প্রায় এরা ঘুর ঘুর করে। এগুলির অফিসার ও স্টাফদের সঙ্গে শালা-দুলাভাইয়ের মত মশকরা আন্তরিকতার ভান ধরে। গুপ্ত তথ্য পাবার জন্য বানোয়াট তথ্য ছাড়ে শাখাগুলিতে। মর্দনের পর ও তথ্য না পেলে কুপিত আনন লুকিয়ে মহৎ ব্যক্তির জ্যোতির্ময় চেহারার ভান ধরে কষ্ট করে স্মিতহাস্য দিয়ে কেটে পড়ে।
কৃতিত্ব-তঞ্চক: এই প্রকারের অফিস-রাজনীতিকরা কর্মে মোটামুটি দক্ষ হয়ে থাকে। তবে এরা অসৎ। ঊর্ধ্বতন কর্তৃক আহূত পরামর্শ অন্যের কাছ থেকেই শুনেই চটজলদী তা’ নিজের উদ্ভাবিত পরামর্শ বলে আপনাকে বলবে আপনার কাছ থেকে প্রশংসা পাবার জন্য। অন্যের কৃতিত্ব ছিনিয়ে নিতে এরা মোটেই দেরি করে না। এদেরকে চিহ্নিত করতে হলে এককভাবে ডেকে ডেকে শুনুন এবং পরে মিটিং ডেকে সর্বসমক্ষেই পরামর্শ চান। যিনি যার পরামর্শকে হাইজ্যাক করে তার নিজস্ব কল্পিত বলে আপনাকে বলেছেন, তিনি আসল ব্যক্তির নিকট ধরা পড়বেন। আসল ব্যক্তির নিকট হতেই আপনি জানতে পারেন যে, পরামর্শটি কার মাথায় এসেছিল আগে। এরা ও তৈল মর্দক গ্রুপের সদস্য।
অন্তর্ঘাতক: এরা কেবল স্বীয় স্বার্থে তৎপর থাকে। অন্য সহকর্মীর ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিতে মোটেই দ্বিধা করেনা। নিজে লাভবান হতে অন্যের ক্ষতি করতে হলে তারা তা অনায়াসে করে। বিবেক দংশন অনুভব করে না। অথচ তাদের নিজের ভুল ত্রুটি মানতে বা স্বীকার করতে চায় না। এদেরকে নিয়ে কাজ করতে আপনাকে সতর্ক হওয়াটা খুব জরুরি। ভাগ্য ভাল থাকলে এদের সাথে পেরে উঠবেন। নৈলে এরা আপনারই বিরুদ্ধে আঞ্চলিক কর্তা/বিভাগীয় কর্তা/সদর দপ্তর প্রধান কর্মকর্তাকে আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ সহ বলে বলে কানভারী করবে। পারলে আপনাকে উঠিয়ে আপনারই চেয়ারে বসবে।
চাটুকার-এরা ডানে বামে সব্বাইকেই তোষণ করে। কাউকেই বাদ দেয় না। তাদের কোন প্রশংসাটা যথার্থ তা বোঝা মুশকিল হয়ে যায়।
লবিষ্ট: এরা ক্ষমতাবান/লড়াকু/নিজের পক্ষে অন্যদের মন্তব্য নিয়ে আসার দক্ষতা আছে এদের। আপনি যদি চান যে আপনার বক্তব্য সবাই শুনুক, তাহলে এটা জরুরী যে লবিষ্টের মতের সাথে সংঘর্ষিক মতামতকে পছন্দ করে না বলে তাদেরকে সরাসরি আপনার মতামত জানিয়ে দিলে তারা সরাসরি আপনাকে নিজেদের মতামত জানিয়ে দিতে পারে বা মেনে নিতে পারে।
উপদেষ্টা: ইনি সেই ব্যক্তি যাকে মালিকরা নিয়োগ দেন এবং বিশ্বাস করেন এবং তার কথায় চলেন। আপনি বুদ্ধিমান হলে তাকে বন্ধুহীন করে তুলুন, তাহলে আপনি অধঃস্তনদের সেরাটা পাবেন। যেহেতু তার মাধ্যমেই মালিকরা জেনে যাচ্ছে যে কি ঘটে চলেছে প্রতিষ্ঠানটিতে। উপদেষ্টা হলেন বাদুড়-সদৃশ। বাদুড় যেমন খেচর-কুলকে বলে আমি তোমাদের মতই উড়ি। তাই আমি তোমাদের। প্রাণীকূলকে বলে আমি তোমাদের। কারণ তোমাদের মতই স্তন্য দিই। উপদেষ্টা ও মালিকদের বলেন অফিসারদের নিকট তোমাদের পক্ষে বলি। অফিসারদের বলেন আমি ও অফিসার ছিলাম বলে মালিকদের নিকট তোমাদের পক্ষে বলি। এরা কেউ কেউ মুনাফিক হতে পারে বা মহাভারতের শকুনি চরিত্রের মত বা রামায়নের কৃতান্তের মত হতে পারে।
কিন্তু পাঠক! তাহলে বাঁচার উপায় কি? আছে কি উপায়? আছে-আছে, নিশ্চয়ই আছে। ম্যাকিয়াভেলীর মতে একটি উপায় হল প্রথমেই নিজেকে ঠকে যাওয়া থেকে বাঁচানো যাতে আর দুর্নীতি না হতে পারে। নৈলে দুর্নীতির মহামারী ঘটবে প্লেগ রোগের মত। অধঃস্তনদের নিকট হতে প্রাপ্ত সত্য নির্ভর পরামর্শ থেকে উপযুক্ত কর্মসূচী ঠিক করতে আপনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। সবার সবগুলি পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে গেলে আপনারই ব্যর্থতা ও দুর্নাম প্রকাশ পাবে। আপনাকে অসৎ তৈল মর্দক হতে বাঁচতে শৃগালের চেয়ে ও কৌশলি হতে হবে। এদের পাতা ফাঁদ চিনতে হবে। এদের পাতা ফাঁদ এড়াতে পারলে এদেরকে এড়াতে পারবেন। চিহ্নিত তৈল-মর্দকদের পরামর্শ মুতাবেক কখনোই কাজ করবেন না। তখন এরা নিজেরাই দমিত হয়ে পড়বে। মর্দকদের কথা বলতেই দেবেন না। তৈল-মর্দক নয় অথচ সৎ ও কর্মদক্ষদের পরামর্শ দিতে দেন আপনার নিকট। তা থেকে আপনার পছন্দসই সিদ্ধান্ত নিন। তাহলে বাঁচলেন। প্রতিষ্ঠানটি ও বাঁচল। মর্দকদের প্রশয় দিলে এক সময় আপনি ও একসময় মর্দন রীতিতে অভ্যস্থ হয়ে যাবেন। মর্দকরা আপনাকে সেই বক্তব্যই পেশ করবে যেটাতে আপনি তাদিগ কর্তৃক তৈল চর্চিত হবেন, খুশিতে ডগমগ হবেন। সুসুপ্তি মগ্ন হবেন। তাদের কথায় কাজ করবেন। তারা আপনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাবে। যেমন পোটেমকিন করেছিলেন। এই ঘটনাটি বলে বাখানটি শেষ করব।
রুশ সাম্রাজ্যর সম্রাজ্ঞী ক্যাথরীন দ্য গ্রেট ছিলেন প্রজা বৎসল নৃপতি। তার একাধিক ঋণাত্মক দোষের মধ্যে তোষণ-মর্দন খুবই পছন্দ করতেন। প্রশ্রয় ও দিতেন। তবে কর্মদক্ষদের মধ্যে যারা মোসাহেবী করত তাদেরকেই লাই দিতেন। তেমনই কর্মদক্ষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মর্দককে লাই দিতে দিতে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত টেনে তুলেন। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও রাখতেন। তবে তার ব্যক্তিগত সৎ, পটু কর্মীদের তিনি গুপ্তচর হিসেবে ও ব্যবহার করতেন যা সব নৃপতিরাই কর্তেন। এখন সরকার প্রধানরা ও নিজস্ব চরমণ্ডল পালেন। তো, সেই রকম তার চরমণ্ডল জানাল সাম্রাজ্যের সাইবেরিয়ার আগের একটি অঞ্চলে ফি বছর শস্যহানীর ফলে জনগণ অনাহারে মরছে। সরকারি কোনই উন্নয়ন কাণ্ড সেখানে হচ্ছে না। তাই সেই স্থানটি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী পোটেমকিনের কাছে জানতে চাইলেন। তিনি বললেন সম্রাজ্ঞীর দক্ষ শাসনের ফলে এবং কৃপাদৃষ্টির ফলে সেখানকার জনগণ সুখেই আছে। তারা সবাই স্বাস্থ্যবান, দর-দালানে জীবন যাপিত করছে। অনাহার ক্লিষ্ট, অস্থি চর্মসার, ভগ্নপ্রায় গৃহের কথা চেপে গেলেন। ক্যাথরীনের মনে বিশ্বাস জন্মালেন। কিন্তু, সম্রাজ্ঞীর নিজস্ব চর-মণ্ডল বল্ল পোটেমকিন সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছেন এবং তাকে সেখানে গিয়ে নিজ চোখে তদন্ত করার পরামর্শ দিল। সম্রাজ্ঞী পোটেমকিনকে সেই স্থান ভ্রমণের আয়োজনের হুকুম দিলেন। প্রধানমন্ত্রী তো প্রমাদ গুণলেন। পরের দিনই পোটেমকীন তাঁরও নিজস্ব বাহিনীকে ব্যাগভর্তি টাকা দিয়ে ঐ এলাকার শহরতলীতে বেশ কয়েকটা নতুন দালানের বাসযোগ্য সাইজের ইট, চুন, সুরকী দিয়ে মডেল, নতুন পাকা সাঁকো, স্কুলের নতুন দেয়াল, পুরাতন গীর্জার নতুন চুড়া বানাতে বল্লেন এবং সম্রাজ্ঞী যেদিন যাবেন সেদিন যেন অন্য এলাকা থেকে মোটাসোটা নর-নারী ধরে এনে মোতায়েন করা হয় রাস্তায় রাস্তায় যাতে সম্রাজ্ঞী সেই নর-নারী, দালান, স্কুল, গীর্জা ইত্যাদি দেখে যেন বিশ্বাস করেন সেটা উন্নত জনপদ, বুভুক্ষু বা অবহেলিত নয়। নির্ধারিত দিনে সম্রাজ্ঞী দেখলেন। প্রীত হলেন। পোটেমকিনকে ক্রেমলিনে পুরস্কৃত করলেন। নিজস্ব চরমণ্ডলকে তিরস্কৃত র্কলেন। তারাও তক্কে তক্কে রইল। পোটেমকিনের কোনো এক অন্যদেশে সফরের সময় তারা সম্রাজ্ঞীকে আবার সফর করতে বলল। তিনি করলেন। প্রকৃত অবস্থাটা স্ব-চক্ষে দেখলেন। বুঝলেন তিনি প্রতারিত হয়েছিলেন। তাহলে কি হল? তৈল-মর্দককে প্রশ্রয় দেওয়ায় জনগণের কাছে ঘৃণ্যপাত্রী হয়ে যান। এজন্য কে দায়ী? মর্দক, না মর্দিতা নিজে? গ্রহীতা চায় বলেই মর্দকরা মর্দনের সুযোগ পায়। পরিণতি তো মর্দিতদেরই হয়। মর্দকদের নয়। তারা তো বসন্তের কোকিল। শাসক শাসিকাদের মধ্যে যারা অসৎ, মর্দক, সর্বভূকদের প্রশ্রয় দেয় ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে তাদের পরিণতি এমন ধ্বংসময় হয় যে তারা চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। যেমন এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী “মোছলেম” লীগ হারিয়ে গেছে। চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

আমাদের অবশ্য তেমন কোনো রুশ জেরিনা ক্যাথরিন দি গ্রেট ও নেই, অস্তিত্ব হারাবার ও ভয় নেই।
- তামাম শুদ-  ত
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status