ঈদ আনন্দ ২০১৮

ভ্রমণ

ইউননানের পথে-প্রান্তরে

মিশকাত শরীফ

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৭:৪২ পূর্বাহ্ন

যদি বলি মেঘের দেশ, যদি বলি ফুলের রাজধানী যদি বলি চিরবসন্তের নগরী তুমি কি তবে একটি দেশ, একটি রাজধানী আর একটি নগরীর নাম বলতে চাইবে? হয়তোবা। তবে আমি তোমাকে শুধু একটি নাম বলবো যা মেঘ, ফুল আর বসন্তের নগরীর গল্প শোনাবে তোমায়। যদি বলো কোথায়, কতদূর? আমি বলবো তোমার খুব কাছেই। বাংলাদেশ থেকে মাত্র দু’ঘণ্টার বিমানে যাত্রাপথ। তুমি ঢাকায় দুপুরে বিমানে চেপে বস পাইলট তেমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে ২০০০ মিটার উপরে। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখ তুমি আকাশের অনেক অনেক উপরে উড়ে বেড়াচ্ছ।
বিমান মেঘের স্তর পার হয়ে আরো উপরে উঠার সময় পাইলট তোমায় অভয় বাণী শোনাবেন, বলবেন প্রিয় যাত্রী আমরা এখন মেঘের স্তর অতিক্রম করতে যাচ্ছি, বিমান বাফারিং করতে পারে আপনি ভয় পাবেন না। তুমি অনুভব করবে বিমান থরথর করে কাঁপছে। তুমি কি ভয় পেয়েছিলে? হয়তবা! তুমি তখন জানালা দিয়ে তাকাও দেখতে পাবে বিমান ঘন মেঘের স্তর নিজের শক্তি নিয়ে ভেদ করে যাচ্ছে। তুমি এবার বিমানকে পাবে শান্ত-স্থির। জানালার বাইরে তাকাও দেখবে চারদিকে মেঘের সমুদ্র। যতদূর চোখ যায় শুধুই মেঘ আর আর মেঘ। আমি জানি তুমি মনে মনে বলবে আরে এতো মেঘের সমুদ্র আর আমরা হাওয়াই জাহাজে সমুদ্র অতিক্রম করছি। তুমি দেখতে পাবে ইয়া বড় বড় মেঘের পাহাড়। ভয় পেয়ো না পাইলট ভুল করে সেই পাহাড়ের চূড়ায় হাওয়াই জাহাজ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে না যেটা টাইটানিকের জাহাজ আটলান্টিকের বরফ খণ্ডে করেছিল।
তুমি বলবে আহ! কি অপরুপ দৃশ্য। মনে মনে কামনা করবে ইশ! যদি আমার বাড়ি এই মেঘেদের দেশে হতো! তোমার কল্পনা মাঝে এবার বাগরা বাজাবে এক সুন্দরী কোন রমণী। তোমাকে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলবে, জনাব আপনি কি খাবেন, কি পান করতে পছন্দ করেন? বিরক্তি বোধ করেছিলে কিনা জানা নাই তবে সুন্দরী বিমানবালার হাসিমাখা মুখ তোমার বিরক্তি লুকিয়ে রাখতে বাধ্য করবে। খেতে ইতস্তত না করে তৃপ্তি সহকারে খেও কারন সুন্দরী বিমানবালা তোমাকে হালাল খাবার সরবরাহ করবে। খাবার শেষে তুমি পানিও হিসেবে আপেল, কমলা অথবা আমের জুস নিতে পারো। ওহ ভুলে গেছি চাইলে কোকোও পান করতে পারো। খাবার শেষে পাইলট এবার তোমাকে বলবে প্রিয় যাত্রী আমরা আর আধা ঘণ্টার মধ্যেই খুনমিং ছাংশুয়েই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছি, দয়া করে আপনি আপনার সিটবেল্ট বেঁধে নিন। তুমি মনে মনে বলবে ধুর সব চিটারি বাটপারি, না চড়তেই বিমান থেকে নামায়ে দেয়ার ধান্দাবাজি!!! পাইলট তোমাকে আবারো আগের ন্যায় অভয়বাণী শোনাবেন তবে এবার তোমার মন উদাস হয়ে আছে বাইরে মেঘের সমুদ্রজলের ঝাপটায়। আগের মতো তুমি আবারো ঘন মেঘের স্তর পার হবে থরথর কাঁপুনি নিয়ে।
তুমি কোন মাসে যাত্রা করবে আমার জানা নেই তবে এটা আমার জানা আছে যে তুমি যে মাসেই যাত্রা কর না কেন এবার পাইলট তোমাকে একটা কথা অবশ্যই শোনাবেন ‘প্রিয় যাত্রী, আমরা এখন ইউননান প্রদেশের রাজধানী খুনমিংয়ের আকাশে, স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা বেজে ৩০ মিনিট, এখন বাইরে ১৬ ডিগ্রি। হ্যাঁ, তুমি সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে গেছ। তুমি ভেবো না পাইলট তোমাকে নিয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা আকাশে উড়ে বেড়িয়েছে, কারণ ঢাকায় তোমাকে নিয়ে আকাশে উড়ার সময় সে তোমাকে বলেছিল ‘এখন সময় দুপুর ২টা। সে তোমাকে নিয়ে মাত্র দেড় ঘণ্টা উড়ার পর চীনের আকাশ সীমায় পৌঁছেছে তবে খুনমিংয়ের স্থানীয় সময় ঢাকার সময় থেকে ২ ঘণ্টা এগিয়ে। আর ঢাকায় তুমি হয়তো গরমে ঘেমে অস্থির হয়ে উঠছিলে অথবা গরমে বিরক্তি প্রকাশ করছিলে। তুমি ঢাকা থেকে যে আবহাওয়া ত্যাগ করে আসনা কেন এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে স্নিগ্ধ শীতলতা। আবহাওয়া সবসময় গড়ে ১৬.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। সুতরাং, তুমি যদি ঢাকায় গরমে ঘেমে ভিজে যাচ্ছিলে তবে বিমান থেকে নামার আগেই তুমি শীতলায় মনের অজান্তেই গায়ে হালকা গরম কিছু জড়িয়ে নেবে। আর যদি ঢাকায় শীতের রুক্ষতা তোমায় আহত করে তবে খুনমিংয়ের আবহাওয়া তোমায় করবে আনন্দিত। সময় আর আবহাওয়ার রহস্যে তুমি যখন বিভোর ঠিক তখনি তুমি হয়তো জানালা দিয়ে তাকিয়ে ভয়ে বিহ্বল হতে পারো! তুমি বলবে আরে আরে পাইলট করছে কি, মেঘের পাহাড় চূড়ায় আছড়ে পরলো না সে এখন দেখি মাটির পাহাড় চূড়ায় আছড়ে পড়তে যাচ্ছে। আরো কাছে এলে মনে হবে পাইলট বেটা এবার শীতলতায় বিমান নিয়ে ইয়া বড় এক ঈগল ডানার নিচে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছে। ভয় পেয়ো না পাইলট কোনো ভুল করছে না, এটাই খুনমিং ছাংশুয়েই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তুমি ভুল দেখনি এটা পাহাড় চূড়ায় নির্মিত আর দেখতে এক বড় ঈগলের মতো যে কিনা তার দু ডানা মেলে ধরে আছে। আর তার পালকের মতোই বিমানবন্দর সোনালি রঙে বর্ণিল। তুমি হেটে অগ্রসর হয়ো না কারণ তুমি হাঁটতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। তুমি চলমান এক্সক্লাভেটর-এ দাঁড়িয়ে পড় সে তোমাকে সামনে নিয়ে যাবে। এটা অনেক বড় বিমানবন্দর যা চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম। ৭৮টা গেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তেমার অপেক্ষায়। তুমি তোমার পোটলা-পুঁটলি সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে পড়। কাস্টম কর্মকর্তাদের জানান দাও তুমি এখন মেঘের দেশ, ফুলের শহর, চির বসন্তের নগরীতে পৌঁছে গেছ। তুমি এবার এক্সিট গেট দিয়ে বেরিয়ে চোখ তুলে তাকাও। তুমি কি এবার কিছু দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ, তুমি দেখতে পাবে বড় অক্ষরে লেখা “Welcome To The Capital Of Flower, The City of Eternal Spring”
তুমি ইতোমধ্যেই পৌঁছে গেছ মেঘের দেশ, ফুলের রাজধানী, চির বসন্তের নগরী খুনমিংয়ে।



ইউননান। সে এক বিস্ময়। চীনের পর্যটন স্বর্গরাজ্য বলা হয় ইউননানকে। স্বর্গে স্বর্গবাসীগণ পবিত্র সুরা পান করবেন। তারা সেথায় মাতাল হবেন কিনা আমার জানা নেই তবে এখানে প্রকৃতি তোমায় ক্ষণে ক্ষণে মাতাল করতে তোমার পিছু লেগে থাকবে। তুমি শুনতে চাইবে না কেন? সে উত্তর না হয় তুমি মাতাল হয়েই খুঁজে নিও।
ইউননানে রয়েছে চীনা দুটি শব্দ। ইউন আর অপরটি নান। ইউন মানে মেঘ আর নান মানে দক্ষিণ। তার মানে তুমি চীনের সর্বদক্ষিণ এ মেঘের কোলে অবস্থান করছো। বেই মানে উত্তর আর জিং মানে বড় শহর। তার মানে বেইজিং চীনের সর্বউত্তরের বড় শহর যাকে লোকে রাজধানী বলে ডাকে। ইউননানকে চীনারা মেঘের দেশ বলে ডেকে থাকে। ইউননান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯০০ মিটার উপরে। তোমার কি মনে পড়ে ঢাকা ছেড়ে আসার সময় তোমাকে নিয়ে পাইলট ২০০০ মিটার উপরে আকাশে উড়াল দিয়েছিল। তোমাকে নিয়ে সে পৌঁছে গিয়েছিল মেঘের কোলে। পাইলট সেই যে উড়ে এসে তোমায় মেঘের কোল থেকে নামিয়ে দিল মেঘের দেশ ইউননানে।
খুনমিং। একইসঙ্গে ফুলের রাজধানী, বসন্তের নগরী আর মেঘের দেশে ইউননানের রাজধানী। খুনমিং পৃথিবী বিখ্যাত শহর তার আবহাওয়ার কারণে। একটা কথা বলা হয় “ Spring all year round”  যা আমার ভাষায় ব্যক্ত করলে ‘চির বসন্ত’ তুমি যখন খুনমিং-এ প্রথম পদার্পণ করবে, এখানকার বাতাস আর মিষ্টি রোদের অলৌকিকতা তোমায় বিস্ময়াভিভূত করবে। স্বচ্ছ নীল আকাশ চীনে শুধু খুনমিংয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখানকার আকাশ তোমায় দেবে শৈল্পিক কল্পনা জগৎ। তার নীল আকাশ সে ক্ষণে ক্ষণে সাজিয়ে তোলে বহুরূপী সব মেঘের আকৃতি দিয়ে। তুমি কখনো মেঘেদের পাবে একাকি উদাস পথিকের বেশে কখনো দল বেঁধে সূর্যের সাথে লড়াইয়ে কখনো বিভিন্ন জীবজন্তর আকৃতিতে। সে কখনো কালো কখনো তোমার তরে মিষ্টি আলো। আসলে খুনমিংয়ের আকাশ আর নারীর মন দুটোই সমার্থক। সে কখনযে তোমার দিকে কামুক দৃষ্টিতে মিষ্টি হাসি দেবে কখন অভিমানে মুখ গোমরা করে কালো হয়ে উঠবে আবার কখন যে সে প্রচণ্ড আবেগে কেঁদে দেবে তা খুনমিংয়ের আকাশই জানে। সারা দিন কেমন যাবে তা নাকি সকালের সূর্য দেখে বোঝা যায় এই কথা তোমায় ভুলে যেতে বাধ্য করবে খুনমিং। খুনমিংয়ের আকাশ-বাতাস এক সুঁতোয় বাঁধা।তুমি সকালে আকাশকে দেখেছ মিষ্টি হাসি দিতে ভাবলে সারা দিন হয়তো এমনটাই যাবে। তুমি হয়তো হালকা কাপড় পরে বেরিয়েছ। তবে প্রতারিত করবে বাতাস। তোমার দেখা নীলাকাশকে মুহূর্তেই কালো আকাশে বানিয়ে দিবে খুনমিংয়ের মৃদুমন্দ বাতাস। আর মুহূর্তেই মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে তেমার উপর। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা হয়তো নেমে যাবে ৭-৮ ডিগ্রিতে। তুমি তখন কিছুটা ঠাণ্ডা অনুভব করবে। খুনমিংয়ের আকাশ তোমার ডান হাতে মিষ্টি রোদ ছড়াবে বাতাস তোমার বাম হাতে বৃষ্টি হয়ে পড়বে। এখানে তুমি ষড়ঋতু পাবে না, ৪ ঋতুর এখানে আবর্তন তবে সবার নামই এখানে বসন্তের নামে। কারন এখানে ৮ মাস বসন্তের আধিপত্য। দুই মাস শীত তবে এখানকার শীতের সকাল আর গভীর রাতই শুধু শীতের শীতলতা আর দিনের বেলা বসন্তের আধিপত্য। কারণ সকালে হয়তো ১-২ ডিগ্রি দিনের বেলায় ৮-১০ ডিগ্রি। তবে যখন খুনমিং-এর শীতলায় লোকেরা গায়ে মিষ্টি রোদ মেখে বেড়ায় তখন হয়তো বেইজিং মাইনাস তাপমাত্রায় চীনকে জানান দিচ্ছে শীতের তীব্রতা। দুই মাস নাকি গরম এখানে তবে তুমি অবশ্যই বলবে ২০-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এতো আমার দেশের বসন্তী হাওয়া। এখানে তুমি এক পোশাকে লোকেদের সারাবছর। কারন আমার দেশের মতো এখানে গরম বা ঠান্ডার জন্য আলাদা পোশাকের প্রয়োজন নেই যখন গড় তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এখানে তুমি সর্বদাই বিভ্রান্ত হবে হঠাৎ ঠান্ডা হঠাৎ গরমে আবার বোকা বনে যেতে পার হঠাৎ বৃষ্টি হঠাৎ রোদে। তাই তুমি এখানে ছাতা আর গরম কাপড় সঙ্গী করতে বাধ্য।
খুনমিং তোমায় দেবে প্রাণ খুলে শ্বাস নেবার সুযোগ। এখানকার বায়ুতে পাবেনা তুমি কোন মল তাই তা নির্মল। খুনমিং তিন দিক থেকে উঁচু পাহাড়ে ঘোড়া আর একদিকে উন্মুক্ত। উন্মুক্ত বললে ভুল হবে কারন একদিক তিয়েনসি লেকের জলে সিক্ত। তিয়েনসি চীনের অন্যতম স্বচ্ছ বড় লেকের মধ্যে একটি। তিয়েনসিকে বলা হয় ‘ঙীুমবহ ইধৎ’। তিন দিক পাহাড় এক দিক স্বচ্ছ পানির লেক খুনমিংকে সর্বদাই রাখে পরিশুদ্ধ।
খুনমিং-এর লোকেরা গর্ব করে বলে ‘থিয়েন থিয়েন শি ছুন থিয়েন, ওয়োমেন পুইয়োং খোংথিয়াও’ প্রতিদিনই তো বসন্ত। তাই আমরা এসি ব্যবহার করি না। অবাক হবার কিছু নেই খুনমিং-এর বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালতে কোথাও পর্যন্ত পাবে না। প্রতিদিন যদি হয় বসন্তের দিন তবে ফ্যান-এসি তো সেথায় প্রয়োজনহীন।
ফুলের রাজধানী খুনমিং। এর আকাশে মেঘের ঘনঘটা যেন খুনমিংয়ের ঘোমটা। নিচে সারা বছর বিভিন্ন ফুলের সমারোহ যেন তান দেহের অলংকার। আবহাওয়া যেন নারীর মন। আসলেই খুনমিং এক যৌবনা নারী। খুনমিংয়ের সড়ক সারা বছর বিভন্ন ফুলে ফুলে সজ্জিত। তুমি যখন খুনমিংয়ে নতুন তখন হয়তো ভাববে কি সব পাতা বিহীন হাড্ডিসার গাছে মাইলের পর মাইল ভরিয়েছে যেমনটি আমি ভেবেছিলাম। তবে ঐ পাতাবিহীন গাছই যে ফুলে ফুলে বর্ণিল হবে তা এখানে তা অকল্পণীয়। খুনমিংয়ের সড়কে কোন ফলের গাছ পাবে না। তুমি যদি কোন সড়কে হলুদ কোন ফুল দেখ তার ধারাবাহিকতা পাবে কয়েক মাইল পর্যন্ত এরূপ সব ফুলের ক্ষেত্রে। সড়কের ধারে বড় গাছ নাই বললেই চলে। যা দেখবে সব বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ। আর ফুলে ফুলে পুরো খুনমিং যেন কোন ফুলের বাগান। বিশেষত বসন্তের দিনগুলা খুনমিংকে দেয় নববধূর সাজ। তুমি খুনমিং নিত্যদিন নিজেকে ফুলে ফুলে সজ্জিত করতে বদ্ধপরিকর। এখানে তুমি একই ফুল দেখতে দেখতে কখনোই একঘেয়ে বোধ করবে না কারন এখানে কোন ফুল হয়তো এক সপ্তাহ তার রূপ প্রদর্শন করবে তেমায় অতঃপর সে ঝরে পড়বে। আবার অন্য প্রজাতির ফুল তোমায় দেখা দেবে। এ যেন পুরাতনের স্বেচ্ছায় অবসর আর নতুনকে সুযোগ করে দেয়া। তুমি চেরী ফুলের পাবে বিভিন্ন রং। গাঁদা ফুল যেন তার রঙের চেয়ে তার মিষ্টি গন্ধে তোমায় মাতাল করতে প্রস্তুত। খুনমিং ফুলকে শুধু পথিকের আনন্দের খোরাক দেয়নি দিয়েছে বিশ্ব দরবারে অন্যতম বড় ফুল শিল্পের অবস্থানও। খুনমিং ও ইউননানের বিভিন্ন অঞ্চলে লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে সহস্রাধিক প্রজাতির ফুলের চাষ। খুনমিং-এ গড়ে উঠেছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ ফুলের বাজার। এখান থেকে প্রতিদিন ফুল ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। তৌনানে এই ফুল বাজারের অবস্থান।
লাল গোলাপ, তা তোমার হাতে দিবো দিবো করেও সাহস হয়নি। সময় ফুরিয়ে গেছে গোলাপের পাপড়িও সব ঝরে গেছে এখন মনের বাগানে আর গোলাপ ফোটেনা। গোলাপ গাছগুলো আজ সব কাঁটাগাছে রূপ নিয়েছে। ভালবাসার বসন্ত হাওয়া আর মনকে ছুঁয়ে দেয় না এখন মনে শুধুই লু হাওয়া বয়ে যায়। তবে স্রষ্টা আমাকে চির বসন্তের নগরীতে এনেছেন গায়ে বসন্ত হাওয়া লাগাতে। কেউ আমার মন না বুঝলেও তিনি বুঝতে পেরেই এ নগরীর বাসিন্দা করেছেন তার নিজ কৃপায়। এখানে ভালবাসাকে মেঘেরা পূজা করে। এই রাজ্যের লোকেরা ভালবাসার প্রতীক লাল গোলাপকে মাটিতে ঝরে পরতে দেয় না। তারা গোলাপকে ভক্ষণ করে। গোলাপের পাপড়ি দিয়ে তৈরি করে মুন কেক। আর এই ভালবাসার পাপড়ি দিয়ে বানানো কেক ছড়িয়ে পরে চীনের আনাচে-কানাচে। সকলেই মেঘের রাজ্যের ভালবাসার গোলাপ একে অপরকে উপহার হিসেবে দেয়। জানান দেয় তার মনের ভালবাসার ঘ্রাণ। প্রতিটি কামড়েই ভালবাসার অনুভব। চীনারা প্রযুক্তিতে এগিয়েছে তবে খুনমিংয়ের এই বিশেষ কেক অন্য কোথাও তৈরির সাহস করেনি। এটা যেন তার নিজস্বতা। মেঘের রাজ্যে এক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছে নাম তার ইউনতা যাকে আমরা ইউননান বিশ্ববিদ্যালয় বলে জানি। তবে চীনারা তাকে ইউনতা বলেই ডাকে। তুমি কি জানো কেন? ‘ইউন’ মানে মেঘ আর ‘তা’ মানে বিশ্ববিদ্যালয়, মানে মেঘের কোলে বিশ্ববিদ্যালয়। মেঘ ছুঁই ছুঁই পাহাড় চূড়ায় তার রয়েছে লাল গোলাপ বাগান। প্রভাতে আর বিকালে মেঘের কোলের শিক্ষার্থীরা গোলাপ বাগানে গিয়ে স্নিগ্ধতা উপভোগ করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বাগানের গোলাপ কলি সব ফুটে তাই তার পাপড়ি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংগ্রহ করে নিয়ে আসা হয় রান্নাঘরে। সেখানে রয়েছে দক্ষ ও পেশাদার গোলাপ রাঁধুনি। কেএফসির চিকেন ফ্রাই বিখ্যাত হতে পারে তবে ইউনতার গোলাপ পাপড়ি ফ্রাই চীনে বিখ্যাত। ইউননান বিশ্ববিদ্যালয় তার গোলাপ পাপড়ি ফ্রাইয়ের জন্য অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রতিদিনের খাবার মেন্যুতে মিলে এই লাল গোলাপকে। প্রতিটি কামড়েই তুমি পাবে ভালবাসা। মনে হবে ভালবাসার প্রতীক লাল গোলাপকে তুমি হজম করছো যেন তুমি নিজেই ভালবাসার প্রতীক হয়ে উঠছো। তোমার রক্তের প্রতিটি কণাই যেন ভালবাসা। তোমার মুখ নিসৃত বায়ু যেন ভালোবাসা মিশ্রিত বায়ু। তুমিই যেন ভালবাসা আর লাল গোলাপ যেন তেমারই প্রতীক।


ইউননান মেঘ-পাহাড়-ঝর্ণা আর লেকের এক রসায়ন। মেঘ আর পাহাড়ের মাঝে রয়েছে লড়াই। কোথাও মেঘের দল এ লড়াইয়ে জয়ী হয়ে পাহাড়কে মেঘে ঢেকে ফেলেছে সদলবলে আবার কোথাও পাহাড় মেঘের উপর বিজয়ী হয়ে মেঘেদের পদদলিত করে বুক টান করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন পাহাড় চূড়ায় তাকালে তুমি তার বিরোচিত মুখ দেখতে পাবে না কারণ সে মেঘ ভেদ করে স্বর্গমুখী। সে তোমাকে জানান দেবে সে যুদ্ধজয় করে মাথা উঁচিয়ে মুখিয়ে আছে স্বর্গের আরোহীর অপেক্ষায়। সে তোমাকে প্রলুব্ধ করছে তোমার দুঃসাহসিক অভিযাত্রী মন নিয়ে তার চূড়ায় আরোহন করতে। তুমি তার চূড়ায় পৌঁছলে সে তোমাকে মেঘের সমুদ্র তরঙ্গমালা দেখাবে শোনাবে তোমায় স্বর্গের ধ্বনি যেমনটি নবী মূসা পাহাড় চূড়ায় গিয়ে স্রষ্টার দর্শন পেয়েছিলেন আর নবী মুহাম্মদ পাহাড়ের গুহায় পেয়েছিলেন ফেরেশতা জিবরাইলের সাক্ষাৎ। তুমি ইউননান এর পাহাড় চূড়ায় স্রষ্টার সাক্ষাৎ পাবে না হয়তো তবে অনুভব করবে স্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য আর তার মহত্ত্ব। স্রষ্টার মহত্ত্ব অনুভব করা স্রষ্টার সাক্ষাত পাওয়া নয় কি?
ইউননানের আয়তন ৩ লাখ ৯৪ হাজার বর্গ কি. মি যা বাংলাদেশের প্রায় ৩ গুণ। তবে ইউননান প্রায় ৮০ ভাগ পাহাড় বেষ্টিত অঞ্চল। তার আকাশ ভেদ করা পাহাড় চীনকে লাওস, ভিয়েতনাম মায়ানমার আর কম্বোডিয়ার সীমান্তে দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে দিয়েছে তাই বুঝি চীনারা দক্ষিণে মহাপ্রাচীর না করে উত্তরে করেছে। এখানে চারিদিকে পাহাড়ের উঁকিঝুকি আর নিচেই স্বচ্ছ জলের লেক। মেঘেদের দলেরা কখনো এসে সবুজ পাহাড়কে সাদা মেঘে ঢেকে দেয় আবার কখনো তার চূড়ায় পরিয়ে দেয় মেঘের ঘোমটা। কোনো কোনো পাহাড়ের মেঘেদের সঙ্গে এই মধুর লড়াই কখন যে প্রেমের সম্পর্ক করে দিয়েছে তা তাদেরও জানা নাই। মেঘ আর পাহাড়ের এই প্রেম লীলার বীর্যপাত যেন পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া চলমান ঝর্ণাধারা। যে থেকে সৃষ্টি সমুদ্রাকৃতির বড় বড় সব স্বচ্ছ জলের লেক। এ রূপ যেন কোনো উদভ্রান্ত কামুক নারীর নিজের উন্মুক্ত সৌন্দর্য প্রদর্শন।
সেই নারী তোমার অপেক্ষায় নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে খুনমিংয়ে। খুনমিংয়ের তিয়েন সি লেকের ধারেই সেই চিরযৌবনা যুবতীর অবস্থান। খুনমিং সিটি সেন্টার থেকে ১০ কিমি পশ্চিমে শুয়ে আছে শিশান (ওয়েষ্ট মাউন্টেইন)। তাকে চীনারা ঘুমন্ত নারী (স্লিপিং গার্ল) বলে ডাকে। শিশান খুনমিংয়ের সর্বোচ্চ উঁচু পাহাড়। এর আকৃতি হুবহু এক নারীর ন্যায় যে কিনা তার লম্বা চুল পেছনে ছেড়ে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার কপাল বেশ প্রসস্থ, নাক সাধারণ চীনাদের মতো থেবড়া নয় বরং খাড়া আর লম্বা। টানটান উন্নত বক্ষ যেন তার কামুকতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। হাত দুটো সে তার পেটের উপর গুটিয়ে রেখেছে। আর দীর্ঘ পা যুগল সামনে সোজা করে ছড়িয়ে দিয়ে গভীর ঘুমে নিমগ্ন। তার দেহের পাশেই স্বচ্ছ জলের লেক ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠছে। প্রথম দেখাতে তুমি কি তিয়েনসি কে লেক বলবে নাকি সমুদ্র বলবে তা আমার জানা নেই। কারণ তার বিশালতা আরা উত্তাল তরঙ্গমালা তোমার ধাঁধায় ফেলতেই পারে। আর যখন দেখবে সেখানে ভ্রমণ পিপাসিরা সেই জাহাজে চড়ে শিশানের দেহের ধারে মাতালের মতো ছুটে চলছে। শুধুই কি তারাই তার দেহের সৌন্দর্যে মাতাল? না সূর্য তো জাপানে উঠে অপেক্ষায় থাকে কত দ্রুত মহাচীনের পথ-ঘাট পেরিয়ে মেঘের দেশে উপনীত হওয়া যায়। সূর্য সারা দিন যখন তার প্রখরতায় সব ঝলসে দেয় তখন সে তার প্রেমিকা শিশানের পেছনে এসে নিভু নিভু আলো নিয়ে ডুবে যায়। কত প্রেমিকই তো শিশানের ঘুম ভাঙানোর অবিরাম চেষ্টায় লিপ্ত। তবে তারা কেউই জানেনা যে তার জাগ্রত না হবার কারণ যে ঐ সূর্য। সূর্যের উদয় যেখানে জাগরণের প্রতীক সেখানে সূর্য নিজেই যখন শিশানের কোলে এসে ঘুমিয়ে পড়ে তখন কি শিশানের ঘুমের হবে কখনো জাগরণ? বরং শিশান যেন সমগ্র চীনের দীর্ঘ ক্লান্তির অবসান, বিশ্রামের প্রতীক। তাইতো সে আজো ঘুমিয়ে আছে। তোমার প্রেম কি পারবে তাকে জাগ্রত করতে? চেষ্টায় দোষ কি। তবে শিশান কি তোমার কথায় কর্ণপাত করবে, মনে হয়না। সেতো চিৎ হয়ে শুয়ে আছে স্বর্গমুখী হয়ে। সেতো তাকিয়ে আছে স্বর্গবাসীর দিকে। তোমার মুখের বাণী কি তার ভালোলাগবে? তবুও শিশান চায় যে, প্রমিকেরা তার ঘুমন্ত শরীরে আসুক জাগরণের বাণী শোনাতে। আর তাইতো কোন চীনা সেখানে তার প্রেমিকা নিয়ে যায় না। চীনাদের মাঝে বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, প্রেমিক-প্রমিকা শিশান পাহাড়ে ঘুরতে গেলে পাহাড় থেকে নিচে নামার পর তাদের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যায়। হওয়ারই তো কথা শিশান তে কেবলই তার উন্মুক্ত সৌন্দর্য নিয়ে ঘুমিয়ে আছে তেমার প্রেমের প্রতীক্ষায় সেখানে তুমি যদি তোমার প্রেমিকা নিয়ে যাও তবে কি তার সৌন্দর্যের অবমূল্যায়ন হলো না? আর তুমি যখন তোমার প্রমিকাকে পাশে রেখে শিশানের সৌন্দর্য অবলোকন করবে তখন কি তোমার প্রেমিকার সৌন্দর্যের অবমূল্যায়ন হয় না?
তবে তুমি যদি তোমার প্রেয়সী নিয়ে তার সৌন্দর্য অবলোকন করতেই চাও তবে শিশানের পায়ের কাছে চলে যাও। তার পায়ের গোড়ালি তিয়েনসির জলে ডুবানো। তুমি সেই তিয়েনসির উত্তাল জলের বাঁধে দাড়িয়ে তার সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারো। তুমি কামনা করো তোমাদের প্রেম যেন শিশানের ঘুমের মতোই চিরস্থায়ী হয়। তুমি সেথায় পাবে অসংখ্য গাংচিল যারা এসেছে সুদূর রাশিয়া থেকে। তুমি হাত বাড়ালে হয়তো গাংচিলের দলেরা তেমার হাতে এসে বসবে। তুমি তাদের তোমাদের প্রেমের কথা খুলে বলতে পারো যেন তারা তোমাদের প্রেমের জন্য প্রার্থনা করে। তুমি যদি প্রেমিকাহীন একক প্রেমিক হয়ে থাকো তবে গাংচিলের দলেদের কাছে তুমি তোমার অব্যক্ত প্রেম আমানত রাখতে পারো। সন্ধ্যায় তুমি সেথায় দাঁড়িয়ে অবলোকন করতে পারো সূর্য-শিশানের একে অপরের মাঝে বিলীন হওয়ার দৃশ্য।
তুমি না হয় শিশানের ঘুম ভাঙাতে ব্যর্থ তবে কি তোমার প্রেমের বাণী বৃথা যাবে? অসম্ভব। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে আরহাই লেক। তুমি কি জানো আরহাই মানে কি? তোমাকে যে জানতেই হবে কারণ রহস্য যে তার নামেই নিহিত। আর মানে কান, হাই মানে সাগর। মানে কর্ণাকৃতির সাগর। তুমি কি চমকে গেলে? হ্যাঁ, এটাই সত্যি এই লেকের আকৃতি হুবহু মানুষের কানের মতো আর বিশালতায় সাগরের মতোই। তবে মতো বললে ভুল হবে। কারণ তার গর্জন সাগর থেকে ধার করা। তুমি কি একাকী তার ধারে গেলে ভয়ে পালাবে? আমি তো প্রথম যেদিন আর হাইয়ের পথ ধরে তার ধারে পৌঁছেছিলাম তার উত্তাল ভয়ানক গর্জন শুনে ভয়ে দৌড় দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম জল থেকে ভয়ানক কিছু একটা আমার দিকে ধেয়ে আসছে। কিছু দূর গিয়ে পেছন ফিরে দেখি আদৌ ভয়ানক কিছু ছিল না, ছিল আরহাইয়ের পক্ষ থেকে আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা তবে আমি তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি।
হয়তো তুমি হিমালয়ের সম্মুখ দেখেছ, দেখেছ তার চূড়ায় থাকা বরফ গলে চলমান নদীর উৎপত্তি। তবে কি তুমি হিমালয়ের পশ্চাৎ দেখেছ, দেখেছ কি পশ্চাৎ চূড়ায় জমে থাকা বরফ থেকে কিসের উৎপত্তি? হ্যাঁ, হিমালয়ের সর্বশেষ অংশ হচ্ছে চাংশান মাউন্টেন। যার রয়েছে ১৯টা চূড়া আর ১৮টা ঝর্ণা। সেই ১৮ ঝর্না প্রবাহিত হয়ে কোনো প্রবহমান নদীর উৎপত্তি করেনি করেছে বিশালাকৃতির সমুদ্র তরঙ্গমালা যাকে আরহাই লেক নামে ডাকা হয়। এই কর্ণাকৃতির লেক যেন হাজার মাইল দুরের বেইজিংয়ের কোলে চীন সাগরের কান। তুমি চাইলেই এখান থেকে পৌঁছে দিতে পার সুদূর চীন সাগরের পাড়ে অপেক্ষারত তোমার প্রেয়সীর কাছে তোমার প্রেমের বাণী। আরহাই কি শুধুই চীন সাগরের কান? না। সে মহাবিশ্বের সকল মহাসাগরের কান। সে কান পেতে রয় তোমার প্রেমের বাণী শ্রবণে। তোমার প্রেয়সীর কাছে সে তোমার বাণী পৌঁছতে কখনো কার্পণ্য করবে না সে যেথায় থাকুক না কেন। সে কি শুধুই ডাক পিয়নের কাজ করে? না। সার্থক প্রেমকে সে তার বক্ষে আলিঙ্গন করে। সে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তার বক্ষে আকাশের চাঁদ নিয়ে। হ্যাঁ, সে আকাশের চাঁদ নামিয়ে নিয়ে আসবে তার বক্ষে শুধুই তোমার জন্য। কারণ তুমি তো এসেছ ‘সিটি অব রোমান্স’ তালি শহরে। তুমি নৌকা নিয়ে রাত কাটিয়ে দাও আরহাই এর কোলে। উপভোগ কর আকাশের পূর্ণ চাঁদ আকাশে তাকিয়ে নয় বরং আরহাইয়ের পানে তাকিয়ে। চাঁদের আলো আরহাই এ প্রতিফলিত হয়ে তোমায় রাত জেগে পাহারা দেবে। জানান দেবে আজ তোমার মধুচন্দ্রিমা। আর তাই তো আরহাই এর অপর নাম মুন লেক। আরহাই প্রেমিকের কাছে বহুরূপী। সে তার বক্ষে দিনে চাংশান পাহাড়কে ধারন করে, রাতে সে আকাশের চাঁদকে। বলা হয়ে থাকে আরহাই বাতাস, ফুল, বরফ আর চাঁদ এই চার দৃশ্যের প্রতিফলন ঘটায় তার স্বচ্ছ পানির আয়নায়।
তালি ইউননানের পুরাতন রাজধানী। এটা যেন মেঘের চাদরে ঢাকা কোনো নগরী। মেঘেরা তো থাকে ঐ আকাশে তবে এটা মেঘের দেশ, মেঘেরাই এখানে করে রাজত্ব। তারা এই শহরে পথে প্রান্তরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এখানে মেঘেরদের রয়েছে নানান রুপ। সূর্য যেন তাদের কাছে অসহায়। কখন যে তাকে মেঘেদের দল ঢেকে ফেলবে তা শুধুই মেঘেরাই ভালো জানে। এখানে মেঘেদের রয়েছে উদ্ধত আচরণ। তুমি চলছো মেঘ হঠাৎ এসে তোমাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। তুমি কি হবাক হচ্ছ? অবাক হবার কিছু নাই। তুমি গাড়ি করে তালি শহরে যাচ্ছ মেঘেদের দল পথে এসে তোমাকে প্রথমে স্বাগত জানাবে। চলতে থাক দেখবে তুমি পৌঁছে গেছ পাহাড়ের উপড় মেঘের কোলে। তুমি পাবে বিমানের অনুভূতি। মেঘেরা এবার তোমার বাহনের নিচে নিজের ডানা মেলে ধরবে। তুমি সেখানে মেহমান তাই সব মেঘ তোমার নিচে ভেসে বেড়াচ্ছে। তুমি নিজে গাড়ি চালালে সাবধানে থেকো কারণ হয়তো তারা তোমায় হঠাৎ চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে পারে অথবা ভুল করে নিজেকে বিমানের পাইলট ভেবে তাদের উপর উড়ে যেতে চাইতেও পারো। তবে তাদের খামখেয়ালিপনা যেন তোমাকে মাটির সড়ক থেকে বিচ্যুত না করে। পথে পুরুষের কুনজর থেকে নারী যেমন নিজেকে বোরখাবৃত করে পথ চলে এখানে তুমি রেইনকোটে নিজেকে আচ্ছাদিত করতে বাধ্য। নতুবা পথ চলতে গিয়ে অনুভব করবে তোমার আশপাশ কুয়াশাচ্ছন্ন। ঘোর কেটে গেলে উপলব্ধি করবে আদৌ তা কুয়াশা ছিল না তারা ছিল ভবঘুরে মেঘেদের দল যারা তোমায় ভিজিয়ে দিয়ে পালিয়েছে। তুমি বাড়ির ছাদে উঠে তাদের সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হতে পার। নবী মূসার কাছে তার ইহুদি সমপ্রদায় খোদার পক্ষ থেকে খাবার দাবি করেছিল। আল্লাহ তাদের দাবি মোতাবেক বেহেশতী খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তারা প্রতিদিন সকালে উঠে মান্না-সালওয়া নামক এক প্রকার খাবার পেতেন যা মাটিতে ঘাসের ওপর শিশির বিন্দুর ন্যায় জমে থাকতো। তালিবাসী কোন নবীর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে স্বর্গীয় পানির ব্যবস্থার জন্য দাবি করেছিল আমার জানা নাই। এখানে মান্না-সালওয়ার ন্যায় রাতে মেঘেরা বাড়ির ছাদে পানির পাত্রে এসে অবস্থান নেয় আর সকালে তারা পানি হয়ে তালিবাসীর কাছে প্রবাহিত হয়। তুমি কি কল্পনা করতে পারো, তালি বাসী মেঘের পানি পান করছে। হ্যাঁ, এখানে এটাই স্বাভাবিক কারণ তারা মেঘের রাজ্যের বাসিন্দা। এই রাজ্যের বসতি, বাসিন্দা আর মেঘেদের পার্থক্য করা অসম্ভব কারণ তাদের বাড়িঘর পোশাক-পরিচ্ছদ সবই মেঘেদের ন্যায় শুভ্র। আর চাংশান যেন এই ভেবে নিজেকেও শুভ্র বরফ কখনো শুভ্র মেঘের আবরণে জড়িয়ে রাখে।


তুমি হয়তো ভাবছো মেঘের দেশে মেঘের শীতলতার কথা। তুমি কি শীতলতার হাত থেকে রক্ষা পেতে গরম পানির কথা ভেবে দুশ্চিন্তিত? তুমি নিশ্চিত থাক। এটা ইউনান। প্রকৃতি তোমার জন্য প্রস্তুত শুধু তোমার জন্য। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে পাওশান। তুমি যদি পাওশানের পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হও তবে তুমি পাওশানের অলৌকিকতা তোমার অজানাই থেকে যাবে। এখানে রয়েছে ২৪০ টারও বেশি প্রাকৃতিক গরম পানির ঝরনা। একেকটা ঝরণা হতে প্রবহমান একেক ধরনের প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান। কোনটা হতে কার্বোনেট, কোনটা হতে সালফার, কোনটা হতে সেলেনিয়াম। একেকটা ঝরনা মানব দেহের স্বাস্থ্যের জন্য একেক ধরনের উপকারিতা বহন করছে। তাই পাওশানকে বলা হয় “World Hot Spring Museum”
শুধুই কি গরম পানির ঝরণা, এছাড়াও সেখানে পাবে গরম পানির সমুদ্র!!! হ্যাঁ, থেংছোং হট সী কে বলা হয় সবচয়ে বিখ্যাত গরম পানির স্পা যার অবস্থান এই ইউননানের পাওশান শহরে। এটি প্রায় নয় বর্গকিমি আয়তনের। এর আরো মজার বিষয় হলো রয়েছে ৮০টির অধিক গরম পানির উন্মুক্ত কূপ যা থেকে অবিরাম হরম পানির বুঁদ বুঁদ বের হচ্ছে। সেখানে রয়েছে ১০টা ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কূপ। শুধু পাওশান নয় সমগ্র ইউনানেই রয়েছে এমন অনেক গরম পানির কূপ। এর মাঝে আননিং এ রয়েছে উষ্ণ গরম পানির লেক যেখানে তুমি চাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে ভেসে থাকতে। ইউননানে সমুদ্র নেই তবে প্রকৃতি এখানে নিজেকে সাজাতে কার্পণ্য করেনি। ওয়েনশান সেক্ষেত্রে অপরূপ রূপের অধিকারী। সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে নতুন বিস্ময় নিয়ে। সেখানে মাটির নিচে রয়েছে ঝর্ণা। সেখানেও রয়েছে লেক তবে তা তোমার প্রচলিত ধারণার বাইরে। লেকের মাঝে মাঝে রয়েছে পাহাড়ের টিলা। মনে হবে যেন পানিতে জলহস্তীর দল মাথা বের করে তোমার দিকে ঢের তাকিয়ে আছে। সেথায় বিস্তীর্ণ জলাশয় যেন পদ্ম বন।
তুমি এখন চীনের পর্যটন স্বর্গরাজ্য ইউননানে। প্রতিটি মুহূর্তেই তোমাকে প্রকৃতি বিস্ময়াভিভূত করতে প্রস্তুত। তেমন এক প্রকৃতির আশ্চর্যজনক বনের অবস্থান খুনমিংয়ে। যার নাম ঝঃড়হব ঋড়ৎবংঃ বা পাথরের বন। চীনারা একে শিলিন বলে ডাকে। শি মানে পাথর আর লিন মানে বন। সেখানে তুমি পাবে বিভিন্ন আকৃতির পাথরের আকৃতি। হাতি, বিড়াল ইঁদুর আরো কত কি। তবে তোমাকে অবশ্যই শিল্পীর দৃষ্টিতে তাকাতে হবে। শিশান যেমন অঘোর ঘুমে নিমগ্ন তেমনি এই বনে আশিমা তার প্রমিকের অপেক্ষা আজো দাঁড়িয়ে আছে। আশিমা এক নারীর প্রতিমূর্তি, যে তার পিঠে ঝুড়ি নিয়ে আজো পথ চেয়ে আছে। এই বন প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠেছে আর বনের পাথরের আকৃতিও প্রকৃতির দান।
তুমি হয়তো জানো পৃথিবীতে চায়ের আবিষ্কার চীনে তবে তোমার কি এটা জানা আছে তুমি এখন চায়ের জন্মভূমি ইউননানেই অবস্থান করছো। এখান থেকেই চায়ের জন্ম। তুমি হয়তো পৃথিবী বিখ্যাত ফুআর চায়ের কথা শুনেছ। ফুআর ইউননানের একটা অঞ্চল যেখানকার মাটি আর মানুষ যেন চায়ের স্রষ্টা।


স্বর্গ সে তো কোনো শ্রেণি বিশেষের একক আবাস্থল নয়। সেথায় তুমি সকল শ্রেণির লোকের দেখা পাবে। ইউননান সে তো চীনের প্রাকৃতিক স্বর্গরাজ্য আর স্বভাবতই তুমি সেথায় পাবে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর বসবাস। চীনে ৫৬টি জাতি গোষ্ঠীর বসবাস তার মাঝে খোদ ইউননানেই বসবাস ২৬টি জাতিগোষ্ঠীর। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্বতা। তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, পেশাক-পরিচ্ছদ খাদ্যাভ্যাস, সমাজব্যবস্থায় রয়েছে নিজস্বতা। আর তাই ইউননানের সংস্কৃতিতে তুমি পাবে বৈচিত্র্যময় আমেজ। প্রকৃতিতে যেমন তুমি বিস্ময় পাবে, ঠিক তেমনি ইউননানের জনগোষ্ঠীর আচার তোমাকে আশ্চর্য করবে। তুমি হয়তো কোন সুন্দরী যুবতী সাক্ষাৎ পেয়েছ, তোর জমকালো ঐতিহ্যবাহী পোশাকে তুমি মুগ্ধ। সে হয়তো মাথায় গোল মুকুট পরে আছে। সাবধান থেক তার ঐ মুকুট স্পর্শ করা থেকে। যদি কোন ঈ সমপ্রদায়ের অবিবাহিত নারী এরূপ মুকুট পরিহিত থাকে আর কোনো পুরুষ যদি তা স্পর্শ করে তবে ঐ পুরুষকে অবশ্যই ঐ নারীকে বিয়ে করতে হবে এবং তাকে ঐ নারীর পরিবারের জন্য টানা দুই বছর বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিতে হবে। তুমি হয়তো মাতৃপ্রধান পরিবার বা জাতিগোষ্ঠীর কথা শুনেছ তবে পুরুষহীন নারী প্রধান রাজ্যের কথা জানা আছে কি? তার অবস্থান এই ইউননানেই। ইউননানের লিচিয়াংয়ে এই রাজ্যের অবস্থান। এটি লুকু লেক ও শিয়াংশুয়েই নদী দ্বারা অন্যান্য স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন। এই রাজ্যে একমাত্র প্রবেশদ্বার হচ্ছে লম্বা একটা কাঠের ব্রিজ। এই রাজ্য সম্পূর্ণরূপে পুরুষমুক্ত রাজ্য। এই রাজ্যে মোছু জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের সামাজিক রীতিনীতি চীনের অন্যদের থেকে একদম ভিন্ন। তাদের মাঝে প্রচলিত কোনো বিবাহের প্রথা নেই। এখানে নারীরাই সকল ক্ষমতার অধিকারী। তাদের মাঝে বিবাহ হয় এক রাতের জন্য। প্রতিটি ঘরের পেছনে রয়েছে ছোট জানালা। রাতের বেলা পুরুষেরা ঐ কাঠের ব্রিজ অতিক্রম করে বাড়ির পেছনের জানালায় কড়া নাড়ে। একে নারী যদি খোলে তবে তাদের মাঝে বিবাহ হলো এবং পুরুষকে জানালা টপকিয়ে নারীর ঘরে প্রবেশ করতে হবে। পুরুষ ঐ নারীর ঘরে রাত কাটিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই ঐ কাঠের ব্রিজ অতিক্রম করে নারীর রাজ্য ত্যাগ করতে হবে। দ্বিতীয়বার নারীর জানালায় পুরুষ কড়া নাড়লো তবে নারী যদি জানালা না খোলে তবে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ। এটা নারীর রাজ্য। নারীর ইচ্ছাই এখানে শেষ কথা। যৌন মিলনেও নারীর ইচ্ছা ও আবেগ প্রাধান্য পায়।
তোমার কি মনে পড়ে সেই ছোটবেলায় পড়েছিলাম লিলিপুটের দেশে। ছোট ছোট মানুষ, তাদের ঘরবাড়িগুলো ছোট ছোট। মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় এই লিলিপুটের কার্টুন ছবি দেখেছিলাম। তখন খুব অবাক হয়েছিলাম। ভাবতাম এমন কোন দেশের অস্তিত্ব আদৌ আছে কি?
হ্যাঁ আছে। চির বসন্তের নগরী খুনমিং-এ তা রয়েছে। ঐ দেশের নাম ‘শিয়াও রেন চিয়া’ যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ছোট মানুষের দেশ। যা আমার ছোটবেলায় দেখা লিলিপুটের দেশ। এখানকার সকল মানুষ এক থেকে দেড় মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট। তাদের ঘরবাড়িও সব দুই মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট। সেখানে গেলে তুমি কি থমকে যাবে না? তুমি কি বিস্ময়াভিভূত হবেনা?
এবার যে যাবার সময় হলো। ফিরতে হবে যে ঢাকায়। খুনমিং ছাংশুয়েই বিমানবন্দরে ঢাকাগামী বিমানে তুমি পূর্বের ন্যায় আসন গ্রহণ করো। পাইলট তোমাকে নিয়ে আকাশে উড্ডয়নের সময় তোমাকে আগের ন্যায় শোনাবে, প্রিয় যাত্রি এখন স্থানীয় সময় দুপুর ২টা। তুমি এবার আর আকাশে উড়ার সময় জানালার বাইরের দৃশ্য তোমাকে আর আগের ন্যায় টানবে না। তোমার মন পড়ে রয়েছে মেঘের দেশের কোনো পথে প্রান্তরে। তোমার চোখের সামনে ভাসছে অপরূপ ইউননানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় কোনো দৃশ্য। তোমার মন যখন ভারি আর স্থির তখন তো বিমান স্থির নয়। বিমান তার নিজ গতিতে দু ঘণ্টা উড়ে এসে ঢাকায় অবতরণ করলো। তুমি তোমায় শোনাবে, প্রিয় যাত্রী আমরা এখন ঢাকার আকাশে। স্থানীয় সময় দুটো, আমরা আর অল্প কিছুক্ষেণের মধ্যেই অবতরণ করতে যাচ্ছি। প্রথমে আনমনা থাকায় তুমি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলে পাইলট আসলে কি বললো!!! তুমি যখন কান পেতে তার কথা শুনলে তখন তোমার শরীরের লোম সব খাড়া হয়ে গেছে। তুমি তখন মনে মনে ভাবছো, খুনমিং থেকে তো দুপুর দুইটায় উড্ডয়ন করলাম আবার ঢাকায় সেই দুপুর দুইটায় অবতরণ করলাম। তবে কি সময় থমকে ছিল? নাকি আমি স্বপ্নের ভিতর ছিলাম। তবে কি পাইলট যখন ঢাকায় আমাকে নিয়ে খুনমিংয়ের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করেছিল সে কি কোনো স্বপ্নের দেশে পৌঁছেছিল যেখানে আমি এতদিন স্বপ্নের মাঝে অতিবাহিত করেছি? সেখানে কি সময় থমকে ছিল। যেমনটি হয়েছিল নবী মুহম্মদ (স.)-এর মিরাজে গমন করে। নাকি তুমি মাতাল ছিলে? 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status