ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

মানুষ, মাকড়, আরশোলা

রিয়াজ মোবারক

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৭:১৮ পূর্বাহ্ন

সচিত্রকরণ: সুমন রহমান

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই আবেদিন অনুভব করল সকালটা ভিন্ন। পুব দিকের মাটিছোঁয়া কার্টেনটা সরাতেই ধোঁয়াটে মেঘের শাড়ি পরা আকাশটা বেরিয়ে এলো। কেমন একটা বিষণ্নতার জাল বুনেছে কেউ। পুরো সপ্তাহটাই তার কেটেছে মালবো, কোপেনহেগেন আর অসলোতে। দাঁত মাজতে মাজতে সে অনুভব করলো ঘরটা অনেকদিন গুছানো হয়নি। ধুলোর আস্তর পড়েছে অনেক জায়গায়। সপ্তাহ একটি দিন অন্তত সে ঘরদোর পয়পরিষ্কার করে। কিন্তু গেল সপ্তাহে তার সেই সুযোগটি হয়নি।
বাথরুমে ঢুকে টুথব্রাশটা ধোয়ার জন্য বেসিনের কলটা খুলতেই কোত্থেকে দুটো জ্যান্ত আরশোলা বেরিয়ে এলো। জলপতনের শব্দে তেলতেলে প্রাণীযুগলের নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে হয়তো, দুটি অতিকায় কৃষ্ণমাকড় সিলিং বেয়ে পঁই পঁই করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। স্রষ্টার কী অপূর্ব তৈরি! মানুষ, মাকড়শা আর আরশোলা। আবেদিন হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। বাসন-কোসন, হাঁড়ি-পাতিল সবই অগোছাল, হাত পড়েনি অনেক দিন। ঘর-পরিষ্কারের বুয়াকে এখনও খবর দেয়া হয়নি, সে ফিরে এসেছে। ফ্রিজ থেকে অর্ধেক হয়ে যাওয়া ব্রাউন রুটির প্যাকেটটা বের করে। এক্সপাইরি ডেটটা পরখ করে নেয়। গতকালই শেষ হয়েছে, নো-প্রবলেম। দু টুকরা ব্রেড টোস্টারে ঢোকায় আবেদিন। সকেটে প্লাগ ঢুকতেই লাল হয়ে আসে টোস্টারের ভেতরটা। আগেই সুইচটা অন করা ছিল। ফ্রিজ থেকে, ডিম, বাটারের প্যাকেট আর জ্যামের কৌটো বের করে। চুলোটাকে জ্বালিয়ে ডিম পোচ করতে লেগে যায় আবেদিন। রুটি টোস্ট হয়ে গেছে, টোস্টারের লাল বোতাম চাপ দিতেই তরাক করে লালচে রুটির টুকরোগুলো মাথা উঁচিয়ে ওঠে। জ্যামের বইআম আর বাটারের প্যাকেট ডাইনিং টেবিলের ওপর অপেক্ষায় নিরুত্তাপ। আবেদিনের নিঃসঙ্গ এই জীবনের সঙ্গে যেন সবগুলো অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। মাঝে মধ্যেই উদ্ভট সব চিন্তা তার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নিজেকে মনে হয় অব্যবহৃত ঔই জ্যাম-জেলির ডিব্বা কিংবা ফ্রিজে অনেকদিন জমে থাকা বাটারের প্যাকেট।
ওভেনের ওপরটা একটু পরিষ্কার করে নেয় আবেদিন। ধুলোর আস্তর জমেছে। ইলেকট্রিক কেটলির শিষ তাকে টেনে নেয় ডাইনিং টেবিলের কোনায়। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে কয়েক প্যাকেট পোর-ওভার কফি নিয়ে এসেছিল সে। কলম্বিয়ান কফি কিংবা কফি-অ্যারাবিকার চাইতে কম কি? পার্বত্য চট্টগ্রামেও আজকাল ভাল কফি হচ্ছে।
পোর-ওভার কফি তৈরি, কফির গন্ধে সারা ঘর ম-ম। একসময় এই বাড়িটিতে মৌর ভালবাসার সুবাসে ম-ম করতো। আজ মৌ-অনেক দূরে। ভালবাসাও দূর-বহুদূর। ওর হাতের ছোঁয়া ঘর-বাড়িতে, আসবাবে।
করাৎ! করাৎ! করে সেল ফোনটা বেজে উঠলো। মিহি গানের সুরের চাইতে এইটেই ভাল। ফোনটা কানে লাগাতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল মোহিনীর কণ্ঠ। মোহিনী এমন কোন মোহিনী নয় যে মোহিত হতে হবে। মোহিনী রায় আবেদিনের সঙ্গে একসময় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করতো। সত্তর পেরিয়ে গেছে তার বয়স। কিন্তু এখনও জোয়ান, তরতাজা।
লাল্টু বাবু কেমন আছ?
ভাল, তুমি?
বেশি ভাল নেই।
কেন কী হল?
ফেসবুকের নতুন বন্ধুটির কাছে ধরা খেয়ে গেছি আমি।
মানে?
মানে আর কী? কুড়ি বছরের ছেলেটি আমার প্রেমে একেবার গদগদ করছিল আর কী? মোহিনীর গলা থেকে রস বেরিয়ে এলো। বুড়ো হলেও কণ্ঠটা বুড়ো হয়নি।
হোঁ হোঁ?
তোমার বিশ্ব-প্রেমাভিযান এগিয়ে বলছে দুর্দম গতিতে।
বল দেখি লাল্টু বাবু, আমার বয়সটা নয় একটু বেশি। সাধ-আল্লাদ নেই বুঝি?
আছ বটে! চালিয়ে যাও, ধরা খেওনা। মনে রেখ চোরের সাত দিন, গেরস্তের একদিন।
বল দেখি সবার কপালে কি ভগবান বিয়ে লিখে রাখে, সবার কি সংসারধর্ম হয়? আর ভালবাসা তো দুর্লভ!
কেন বিয়ে করলেই তো পারতে?
পারতুম বটে, কিন্তু এক ছ্যাঁকা এমনই হলো আমার হৃদয়টাকে একেবারে ভস্ম করে দিলো।
ভুল করেছে মোহিনী।
না মোটেই না। তোমার জীবনটা কী হলো আবেদিন?
এক যুগ প্রেমের পর বিয়ে। ফুটফুটে একটি মেয়ে হলো। মেয়েটি বড় হতে না হতেই ফুরুৎ, উড়াল দিলো।
ও মৌর কথা বলছ বুঝি?
তা নয়ত কী? মনে হল মৌকে তুমি বেমালুম ভলে গেছ?
না ভুলব কেন? মৌ আমার পারমিতার জন্মদাত্রী।
কিন্তু তুমি বিয়ে করলে না কেন?
তুমি তো জান পারমিতা অন্য কেউকে মা হিসেবে দেখতে চায় নি। এই টপিক্‌টা বাদ দাও, তা তোমার শরীরটা কেমন?
আমি ভাল থাকলেই কী, না থাকলেই বা কি? কারো কোন এসে যায় না।
আচ্ছা আমার একটা রিপোর্ট শেষ করতে হবে। আজ তাহলে রাখি। নিজের শরীরের দিকে নজর রেখ।
রাখবো আবেদিন, তোমাকেও একই কথা বলি। বেশি মদ খেওনা।
ফোনটা কফি টেবিলের পাশে রেখে আবেদিন রিডিং রুমের দিকে এগিয়ে যায়। রিডিং রুমের চারদিকে কেবল বই আর বই, বইয়ের কাবার্ড মোড়া দেয়ালগুলোকে মনে হয় একটি ছোটখাট কারাগার। ফোনটা খুলে রেখেছিল পারমিতার ফোনের অপেক্ষায়। পারমিতা যুক্তরাষ্ট্রের মিডওয়েস্টে একটি লিবারেল আর্ট কলেজের ছাত্রী। মেয়েটি মায়ের মতই মুক্তমনা। কথা কম বলে, নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা একটি মানুষ। ফোন আসলেই আবেদিনের মনে হয় পারমিতা। ডিপ্লম্যাটিকলী পারমিতা মা আর বাবা দুজনকেই খুশি করে চলেছে। ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে, বার্থ ডে, ম্যারিয়েজ ডে সবই মনে থাকে তার। উইশ করতে ভুল হয় না। কিন্তু তারপরও মনে হয় পারমিতার, ওর মায়ের প্রতিই বেশি টান। টান থাকলেই বা কী? হিংসে হয়?
কম্পিউটারের রিপোর্টটা শেষ দফা রিভিশন দিচ্ছে আবেদীন। জমা দেয়ার ডেডলাইন এখনও এক হপ্তা। এই সব কাজ করতে তার সময় লাগেনা বেশি। তাড়াতাড়ি রিপোর্ট জমা দিলে, তাড়াতাড়ি বিলটা মিলবে। হালকা করে গানের ডেক্‌টা অন করে দিল আবেদিন।
রাতের বেলা মালকোষ শুনতে ভাল লাগে। সুভায়ু অর্থাৎ সুভায়ু সেন মজুমদার আমাদের ছোট ভাই বন্ধু অসাধারণ এসরাজ বাজায়। হাজার হোক রক্তে তো এসরাজ। ওর জ্যাঠা শৈলজারঞ্জন মজুমদার। এসরাজে মালকোষের মিহি সুর বাজছে।
রিপোর্টটা রিভিশন দিতে গিয়ে মেজাজটা বিগড়ে গেল আবেদিনের, অজস্র ভুল ভ্রান্তি। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো কেমন জানি আন্তরিকতাহীন। কাজের মন নেই। আলমিরা থেকে সিভাস রিগালের ৩-৪ হওয়া বোতলটা টেনে নিল আবেদিন। ফ্রিজ থেকে আইসকিউবের একটি ট্রে বের করলো। হুইস্কি অন্‌ দা রক্স। গলা দিয়ে শীতল পানীয় সারা শরীর মনকে কেমন স্ফুর্ত করে তোলে। মনে হয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অর্থ আছে। হঠাৎ কেন জানি আবার আরশোলা আর মাকড়টার চেহারা ভেসে উঠল আবেদিনের চোখের সামনে। ব্রাশ করতে গিয়ে ওদের মুখোমুখি হয়েছিল সে। আরশোলা, মাকড় কী বিচিত্র প্রাণী! আর মানুষ আরো বিচিত্র, স্বার্থের জন্য তার সঙ্গীকে ত্যাগ করতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করে না। আরশোলা, মাকড়রাও তো একসঙ্গে থাকে। এডিট করে চলল আবেদিন রিপোর্টটা। এর চেয়ে নতুন করে কিছু লিখলে হয়ত ভাল হতো। জীবনটাকেও যদি এভাবে এডিট করা যেত? কেটে চিরে নতুন একটা জীবন বানানো যেত, যেখানে মৌ এর স্বার্থপরতা নেই, পারমিতার হিপোক্রেসি নেই।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল আবেদিন টের পায়নি। রাতে সিভাস রিগালের বোতলটার অবশিষ্টাংশের অনেকখানিই শেষ করেছে। অনেকদিন পর মনে হলো পাকা ঘুম হয়েছে। মানুষের জীবনে ঘুমের খুউব প্রয়োজন। অন্যান্য প্রানীদেরও ঘুম দরকার হয়, কিন্তু মানুষের ঘুমের চাহিদা না মিটলে মানুষ ধরা খেয়ে যায়। তার চেহারায় নিদ্রাহীনতার ছাপ পড়ে? প্রাণীদের কীট-পতঙ্গের আদলে ধরা পড়ে কিনা জানা নেই তার। সেল ফোনের করাৎ করাৎ শব্দ হতে থাকে। অনেকবার বাজে তবুও আবেদিনের ঘুম ভাঙ্গেনা, যদিও কানের কাছেই রাখা সেল ফোনটা। পারমিতার ফোনের জন্যে সে ফোন সেট্‌টা বালিশের ওপরে রেখেছিল। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গে তার আরশোলা আর মাকড়শার সুরসুরিতে। কী অদ্ভুতভাবে একটি আরশোলা আর একটি মাকড় তার চোখমুখের উপর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। হুইস্কির গন্ধে ঘর ভরপুর। ওরাও কী নেশার টানে ছুটে এসেছে আবেদিনের অবয়বের উপর। ধড়মরিয়ে ওঠে আবেদিন চোখ মুখ থেকে ঝেরে ছুঁড়ে দেয়ে তেলাপোকা আর মাকড়, ওরা ওকে কামড়াচ্ছিল কিনা ঠাওর করা গেলনা। কিছুটা বিরক্তি আর ভীতি নিয়ে উঠে বসে আবেদিন। তেলাপোকা আর মাকড়সারা তখন উধাও। সারা ঘর স্তব্ধ। ইয়ালো লাইটটা নেভাতে মনে নেই, ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজের অজান্তে। ঘরে কেবল দেয়াল ঘড়ির টিকটিক্‌ শব্দ। আবারো সেলফোনের করাৎ করাৎ শব্দ। আবেদিন উদগ্র হয়ে আছে। নিশ্চই পারমিতা। প্রায় একুশ দিন তোমার কণ্ঠ শুনিনা। আমার জীবনের একমাত্র সৃষ্টি, একমাত্র ভালবাসা, বেঁচে থাকার প্রেরণা। পারমিতা। তড়িৎ গতিতে ফোনটা খপ করে হাতে নেয় আবেদিন। কিন্তু ধরতে না ধরতেই বন্ধ হয়ে যায়। অচেনা একটা নম্বর সেল ফোনের মিস্‌ড্‌ কলের লিস্টে। পারমিতা কি অন্য কোনো নম্বর থেকে ফোন করল? কিন্তু না, পারমিতার নাম্বারটা আনরিচেবল্‌ । মেসেঞ্জার, ভাইবার, ইমো সবকিছুই ইনঅ্যাকটিভ।
দেয়াল ঘড়িটায় সময়টা দেখে নেয় আবেদিন। সকাল ৫টা। ভোর হয়ে গেছে। এই অন্ধকার জীবনে আরেকটি সকাল। মৌ, পারমিতাবিহীন আরেকটি দিন। আবেদিন বেডরুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে হেঁটে যায়। বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। হুইস্কি খেলে গলা শুকিয়ে যায়, শরীরের কোষগুলো শুকনো হয়ে যায়। ডাক্তার না হলেও এইটুকু ডাক্তারীবিজ্ঞান আবেদিনের জানা। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতলটা বের করে ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা গেলে আবেদিন। দূর থেকে কোন একটি সিকউরিটি গার্ডের বাঁশির হুইসেল বেজে ওঠে। ডিওএইচএস এলাকার সিকিউরিটি পাকাপোক্ত। এবার সেল ফোনটা আবার বেজে ওঠে। অচেনা নম্বরটা ফোনের পর্দা-প্যানেলে দুলতে থাকে। হয়তবা রং নম্বর। একটি বিরক্তিকর মহিলা হয়তবা তার নিকটাত্মীয়ের নাম ধরে সম্বোধন করবে- বজলু না, বালা। এক সিলেটি মহিলা কয়েক সপ্তাহ আগে তার মেজাজটা বিগড়ে দিয়েছিল।

ফোনটা কানে ধরতেই অপরপান্ত থেকে ভারী কণ্ঠস্বর- মি. আবেদিন?

-    হ্যাঁ কে বলছেন?
-    সাব-ইন্সপেক্টর মুরতজা। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ।
-    বলুন।
-    মোহিনী রায় আপনার সঙ্গেই শেষ কথা বলেছেন। তার ফোনের ব্যালেন্স নেই। নয়তো তার ফোন থেকেই ফোন করতাম।
-    শেষ কথা বলেছেন মানে?
-    মানে মেহিনী রায় মারা গেছেন। আমি তার এফ আইআর করতে এসেছি।
-    জলজ্যান্ত একটি মানুষ মারা গেছেন? কাল রাতেই তো তার সঙ্গে আমার কথা হলো।
-    হ্যাঁ, সেই সূত্র ধরেই তো আপনাকে ফোন। দারোয়ান বলল ওনার আত্মীয়স্বজন নাকি এদেশে খুব কমই আছেন। কেউ কেউ আছেন চটগ্রামে।
-    হ্যাঁ, আমিও তো তাই জানি। তিনি তো বিয়ে-থা করেননি। যারা নিকটাত্মীয় তারা কোলকাতায়।
-    আপিনি কি তাদের ঠিকানা কিংবা ফোন নম্বর জানেন?
-    হ্যাঁ ওনার ভাগ্নের ফোন নম্বর ও ঠিকানা আমার জানা। উল্টোডাঙ্গায় থাকেন। আমি পুনে যাওয়ার পথে একরাত ওনার বাসায় কাটিয়ে ছিলাম। ভদ্রলোকের নাম সুজন রায়। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।
-    আপনার কাছ থেকে কি আমরা কিছু সহযোগিতা পেতে পারি?
-    অবশ্যই ইন্সপেক্টর সাহেব।
-    আমি ইন্সপেকটর নই। এসএই মুরতজা। আপনার বাড়ির ঠিকানাটা বলবেন। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।
-    তার প্রয়োজন নেই। আমি অলরেডি রওয়ানা দিয়ে দিয়েছি।

মোহিনীর মৃত্যু, হঠাৎ করেই। মানুষের মৃত্যু বুঝি এতই সোজা? যে মানুষটি কাল রাতেও জলজ্যান্ত, রসে ভরপুর গলার আওয়াজ, সে আজ নেই।
-    মোহিনীর বাড়ির ফটকে পৌঁছুতেই একজন পুলিশ কনস্টেবল এসে জিজ্ঞাসা করল, কে আমি। আমি বললাম আপনাদের এসআই মুরতজা সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমি জয়নুল আবেদিন, মোহিনী রায়ের বন্ধু। গাড়িটা পার্ক করতেই একজন সাদা পোশাক পরা লোক এগিয়ে এল। কোমরে রিভলবারের বাটটা বেরিয়ে আছে।
-    আমি এসআই মুরতজা।
-    আমি আবেদিন। জয়নুল আবেদিন।
-    আপনার কাছ থেকে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। আপনি বুঝতে পারছেন, ভিকটিম শেষ কথা আপনার সঙ্গেই বলেছেন।
-    হ্যাঁ বলেছেন। তাতে প্রবলেম কী?
-    প্রবলেম নেই আবার প্রবলেম অনেক কিছুই তো হতে পারে? আমরা ছুটা-বুয়াটাকে আটক করেছি, দারোয়ানকে আটক করেছি জিজ্ঞাসাবাদ করতে।
-    আমাকেও কি আটক করবেন নাকি?
-    বুঝেনই তো স্যার, প্রয়োজন হলে করতেও হতে পারে।
-    তবে করুন। একটু ক্ষীপ্ত হয়েই আবেদিন কথা বল্ল।
-    পুলিশ কিন্তু সে ক্ষমতা রাখে।
-    পুলিশ মানুষকে বিনা দোষে হ্যারাস করার ক্ষমতা রাখে না। আগে ওপরে চলুন। মোহিনী আমার বন্ধু, এক্স কলিগ, ওকে দেখতে হবে। আপনারা যদি ভাবেন অস্বাভাবিক মৃত্যু সেটার কারণ অবশ্যই বের করতে হবে।
- সেই ধরনের চিন্তাভাবনাই আমাদের। কারণ ভদ্রমহিলার অফুরন্ত সম্পত্তি। এই এক বিঘার ধানমন্ডির বাড়িটার কথাই ভাবুন না। শত কোটির নিচে তো হবে না। আর উত্তরাধিকার সূত্রে নাকি চিটিগাংয়ে তার অনেক সম্পত্তি পাওনা।
-    এত অল্প সময়ে এত কিছু জানলেন কি করে?
-    দারোয়ান আর ছুটা বুয়ার কাছে থেকে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দারোয়ান আলি আর ছুটা বুয়া জুলেখা হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
-    আমরা কিছু জানিনা স্যার। ম্যাডামরে আইয়া দেহি দরজা খুলে না, তাই পুলিশরে খবর দিই।
-    কিন্তু মোহিনীর সঙ্গে চিটাগাং থেকে তার এক আত্মীয়, দূর সম্পর্কের বোন না থাকত?
- সে তো সাতদিন আগে চইল্যা গেছে। চিটাগাংয়ের সব সম্পত্তি সে দেবোত্তর সম্পত্তি করছে কিনা তাই। ঐ সম্পত্তি কেউ নাকি ভোগ করতে পারবে না। কেবল হাসপাতাল, এতিমখানা ইত্যাদি করা যাবে।
-    তুমি এত সব জান কি করে জুলেখা?
-    ম্যাডামের সঙ্গে ঝগড়া ঔইতো নিত্য এই কি জানি সঞ্চারী দির, তারে কোন সম্পত্তি দেয় নাই তাই। আমি ঘর ঝাড় দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে শুনতাম।
-    এস আই সাহেব সঞ্চারীর খোঁজ নিয়েছেন আপনি?
-    নিয়েছি। চিটাগাং পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করেছে। মোহিনীর বেডরুমে ঢুকতেই এসআই সাহেবের সতর্কীকরণ
- কোন কিছু টাচ্‌ করবেন না কিন্তু।
-    ও কে। মোহিনী শুয়ে আছে বিছানায়। চোখ দুটো আধ্‌বোজা। মনে হয় একটু পরেই চিৎকার করে উঠবে- লাল্টু বাবু তুমি এস্‌ছ? আজ দিনটা আমার ভালই যাবে। এই বুড়ির তার প্রতি কি একটা টান জন্মেছিল। আবেদিন কে সে লাল্টু বাবু বলেই ডাকত।
-    এস আই মুরতজা সাহেব আপনার সঙ্গে বোধ হয় আমার ভালো করে পরিচয় হয়নি। আমি  FAO অর্থাৎFood and Agriculture Organization এর  Consultant  ইকোনমিস্ট। আপনাদের বড় কর্তাকে একটু লাগান, বলেন FAO থেকে জয়নাল আবেদিন সাহেব কথা বলবেন।
-    বড়কর্তা মানে? ঠিক বুঝলাম না।
-    বড়কর্তা মানে ডিসি ডিবি। নামটা বলতে হবে? না বরং আমি করি।
-    না না আমিই করছি। সেল ফোনে নাম্বার টিপ্‌ল এসআই মুরতজা। অপর প্রান্ত থেকে ফোনটা সঙ্গে সঙ্গেই ধরল। সম্ভবত অন্য কেউ। একজন মহিলার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে হালকাভাবে।
-    সটান হয়ে সালাম দিল এসআই মুরতজা। মনে হলো তার সামনেই ডিসি সাহেব বসে। স্যার মোহিনী রায় কেসটার জন্য আমি তার বাসায়। মহিলাকে বিছানায় মৃত পাওয়া গেছে। দারোয়ান ও ছুটা বুয়াকে আটক করেছি। সঞ্চারী নামে এক মহিলাকে চিটাগাং পুলিশ আটক করেছে, তার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। স্যার আপনার সঙ্গে ভিকটিমের এক বন্ধু কথা বলতে চান। ফোনটা এগিয়ে দিল এসআই মুরতজা। আবেদিন ফোনটা কানে ধরল।
-    আবেদিন বলছি। জয়নাল আবেদিন।
-    তুই এখানে কি করিস? অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে।
-    মোহিনী রায় আমার এক্স কলিগ, আমার বন্ধু। আর কাল রাতে আমার সঙ্গেই সম্ভবত তার শেষ কথা হয়।
-    তাহলে তো তোর কাছ থেকে আমাদের কিছু তথ্য নিতে হবে। কেসটা সহজ নাও হতে পারে। মার্ডারও হতে পারে।
-    কিন্তু মোহিনী রায়কে কে খুন করবে?
-     সেটিই তো বের করতে হবে। আচ্ছা, এসআই মুরতজা কে ফোনটা দে দেখি। আবেদিন ফোনটা ফিরিয়ে দিল মুরতজাকে।
-    স্যার, আপনার ছেলে বেলার বন্ধু। নিশ্চই স্যার। বড় অর্থনীতিবিদ। কোনরকম অসম্মান হবেনা স্যার। সেল ফোনটা কান থেকে নামিয়ে আবেদিনের উদ্দেশ্য একটা স্যালুট দিল মুরতজা। স্যার বলেছেন আপনি তার ছেলেবেলার বন্ধু। আপনি সম্মানী লোক। আমিও স্যার অর্থনীতিতে অনার্স করেছি। বিসিএস হয়নি বলেই এস আই স্যার।
-    তা মুরতজা সাহেব আপনার কি মনে হয় মোহিনী রায় মার্ডার হয়েছে?
-    দু’দিনের মধ্যেই খবর পেয়ে যাব স্যার। আর এই সময়টুকু আপনার বাসায় থাকতে হবে স্যার। আমাদের যেকোনো সময় আপনাকে দরকার হতে পারে। দারোয়ান আর ছুটা বুয়া আমাদের হেফাজতে থাকবে। এ বাড়িটি পুলিশ পাহারা দেবে। আপনার সঙ্গে স্যার কথা বলবেন।
-    কিন্তু আমার তো বান্দরবান যাওয়ার কথা একটা Project  Profile  তৈরির জন্য।
-    আপাতত সেই পরিকল্পনা পিছাতে হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অ্যাম্বুল্যান্স এসে মোহিনীর মৃত দেহটাকে তুলে নিল। মিশনের লোকজনও ছিল অ্যাম্বুলেন্সে। পোস্টমর্টেম হবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে।
-    মিশনের লোকজনকে আপনি ডেকে এনেছেন বুঝি? মুরতজাকে প্রশ্ন করল আবেদিন।
-    না গতকাল মোহিনী রায় মিশনের লোকের সঙ্গে কথা বলেছে। তার সব সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি করে গেছেন। এই নিয়েই তার সঞ্চারী দেবীর সঙ্গে বাকবিতন্ডা হয়েছিল। তার কোলকাতার বোনপোর সঙ্গেও তার এই নিয়ে মনমালিন্য।
-    কিন্তু এত কিছু তো আমি জানতাম না। তা মুরতজা সাহেব আমি কি এখন বাড়ি ফিরতে পারি? নাকি আমাকেও অ্যারেস্ট করবেন?
-    কি যে বলেন স্যার। আপনি বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে গেলেই হবে।
মুরতজাকে বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে গাড়িতে উঠল আবেদিন। মাথাটা কেন ঝ্‌িম ঝ্‌িম করছে? মোহিনী রায় তাকে লাল্টু বাবু বলে ডাকত। সাদা মনের মানুষ মোহিনী। সংসার করল না। এভাবেই জীবনটা তার শেষ হয়ে গেল।
দুদিন পরেই পোস্টমর্টেম রিপোট বের হলো। অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি সেবনেই মোহিনী মারা গেছেন। কোনরকম হোমিসাইডের এভিডেন্স নেই। মিশনের লোকজন মোহিনীর মরদেহের যথাযথ সৎকার করেছেন। এই পৃথিবীর সব অশান্তি আবর্জনা থেকে মোহিনীর মুক্তি মিলেছে। মরণ-রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান। আজ সকালে একবার পারিমিতার সঙ্গেঁ আবেদিনের কথা হয়েছে। আগেই টের পেয়েছিল আবেদিন পারমিতার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। পারমিতা আর সেই ছোট্ট পারমিতাটি নেই। অনেক কানাঘুষা শুনছিল আবেদিন। কিন্তু পারমিতা যে সরাসরি মুখ খুলবে ভাবেনি সে। কিন্তু আজকের এই আধুনিক পৃথিবীতে আবেদিনের এই নিয়ে বিষন্ন হওয়ার তো কোন কারণ নেই। পারমিতার মুখেই সে শুনল আমেরিকার এক বান্ধবীকেই সে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছে। লিসবিয়ান আর গে-রাইট নিয়ে সারা পৃথিবী যখন সোচ্চার তখন অনাধুনিক সেকেলেভাবে মুখ বেজার করার তো অজুহাত নেই।
সিভাস রিগালের অবশিষ্টাংশ শেষ। নতুন একটা হুইস্কির বোতলের মুখ খুলল সে। জেম্‌সন। অনেকদিন আগের কেনা একটা মলটেড হুইস্কি পড়েছিল বাসায়। সেইটিই চলুক। মোহিনী তার লাল্টু বাবুকে বেশি মদ্যপান না করেছিল। কেমন একটা অধিকারবোধ মোহিনীর তার ওপর। কিন্তু মোহিনী দিদি? তুমি তোমার ছোট ব্রাদারকে স্ট্রেস দুর করার আর কোন সহজ পদ্ধতি দেখিয়ে যাওনি। আজ রাতটা আবেদিনের জন্য অন্যরকম। পারমিতার স্বীকারোক্তি। মোহিনীর মৃত্যু। দু’টো ভিন্ন জিনিস তাকে জীবন নিয়ে অন্য ভাবনার স্রোতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মোহিনীর জীবনটাও কী হঠাৎ করে অন্য বাঁকে প্রবাহিত হতে চলছিল। মৌ তার জীবন থেকে অনেক দূর। এখন মৌ-র চেহারাটা আবছা হয়ে আসে। মনে হয় আলো-আঁধারিতে ঘেরা অচেনা একটা মুখ। আর আজ থেকে মনে হচ্ছে পারমিতা ভিন্নগ্রহের মানুষ, এলিয়েন।
জেমসনের বোতলটাও অর্ধেক শেষ। আবেদিন কেমন একটা প্রশান্তি অনুভব করছে। মনে হচ্ছে অঙ্কের অনেকগুলো ধাপ শেষে সলিউশনে পৌঁছে গেছে। বাথরুমে দরজাটা খুলে কিছুটা বেসামাল গতিতে বাথরুমে ঢোকে আবেদিন। বাথরুমের দেয়াল ঘড়িটা আবছা মনে হয়। ক’টা বাজে ঠাওর করতে পারে না। প্রয়োজন নেই। সময় দেখার প্রয়োজন আছে কী? বাতি জ্বালাতে একটু কষ্ট হয়, কারণ আবেদিনের দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে। মাটিতে চোখ পড়তেই আরশোলা আর মাকড়জুটিদের চোখ পড়ল। কিন্তু আগের মত ট্যাপকল খুলতেই যেমন নড়ে উঠেছিল, তেমনি ওরা নড়েচড়ে উঠল না। ওরা প্রাণহীন, নিথর, মৃত ঠিক মোহিনীর মতো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status