ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

যৌবনের পরাজয়

ফখরুল করিম

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৭:১২ পূর্বাহ্ন

মাস্টার কই যাও? দূর থেকে জিজ্ঞাসা করে মজিদ মিয়া। উত্তরপাড়ায়। উত্তরটা এমনভাবে দেয় যেন আর কোন প্রশ্ন না জিগায়। বয়স হয়েছে মজিদ মিয়ার কিন্তু সব দিকে নজর। আমি কোথায় যায়, কী করি সব তথ্য সে রাখে। মাস্টার একটু দ্রুত পায়ে হাঁটা দেয়। এই বাড়ির আঙিনা পার হলেই সে বাঁচে। মাস্টারের সবচেয়ে বড় বাধা এই বাড়ির আঙিনা। যখনই যায় তখনই মজিদ মিয়া টের পায়, কী সকালে, কী দুপুরে, কী গভীর রাতে। মাস্টার এখন বিরক্ত। পারলে এই আঙিনার রাস্তা বাদ দেয়াই ভালো। উপায় নাই একটাই রাস্তা উত্তরপাড়ায় যাওয়ার। আর ও-পাড়ায় না গেলে মাস্টারের পেটের ভাত হজম হয় না। এ এমন এক নেশা, যা তার রক্তনালিতে ঢুকে গেছে। ফিরেও আসতে পারছে না। ছেড়েও দিতে পারছে না।
-কী ব্যাপার মাস্টার, মনটা বিষণ্ন কেন?
-তোমাকে না বলছি, আমাকে মাস্টার ডাকবা না। আমার নাম আছে, নাম ধরে ডাকবা। তাকায় মজিদ মিয়ার দিকে।
-তোমার নাম শাহজাদা। ওই নামটার সঙ্গে তোমার চরিত্র মিলাতে পারি না। তাই ডাকিও না।
-তুমি একটা নাম দিয়ে আমাকে ওই নামে ডাকিও, তবুও ওই মাস্টার মাস্টার বলে ডাকিও না। বুঝলা?
-হ, বুঝলাম, তা এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন? মনে মনে মজিদ মিয়া বলে, আমি এদিকে এলেই, শালার বুড়া ক্যামনে টের পায়! মনে হয় আমার অপেক্ষায় বসে থাকে। একটু উচ্চ স্বরে বলে, তোমার কোনো কাম নাই?
-তোমার জন্য অপেক্ষা করা ও কথা বলাও আমার একটা কাম! মজিদ মিয়া উত্তর দেয় তবে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে। আর কথা না বাড়িয়ে সে চলে গেল শমসের আলীর বাড়ির চৌহদ্দিতে।
-তুমি আস আর যাও। আমার বাড়িতে বসে আড্ডা মারো। বিড়ি খাও। ভাতও খাও। কোনো কোনো সময় রাতেও থাকো। সবাই জানে। তোমার এখানে আসার কারণ। শুধু আমি জানি না! তুমি না এলেই তো পারো? দেখা হওয়া মাত্রই পারুর বাবা শমসের আলী মাস্টারকে জিগায়।
-পারি, তয় তোমার মেয়ে যে আমাকে আসতে বলে!
মেয়ের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শমসের আলী আর কোনো কথা বলে না। সে নিশ্চুপ হয়ে যায়। মেয়েকে সে ভীষণ ভয় পায়। এ সংসারে মেয়েই তার একমাত্র ভরসা। যার জন্য সে এখনো বেঁচে আছে। মাস্টার মৃদু করে জিজ্ঞাসা করে,
-পারু ঘরে নাই?
-আছে, ওর জ্বর আর গা-টাও ব্যথা করছে।
-তাই নাকি? দাঁড়ানো অবস্থায়ই মাস্টার চমকে ওঠে। সে ধীরে ধীরে ঘরের দিকে যায়। ছনের বেড়া দেয়া ঘর। বাঁশের দরজা। ছাউনি হলো খড়ের। সে ঘরে ঢুকে পারুর পাশে বসে। সাহস করে ডাক দেয়। হাত দেয়ার সাহস পায় না।
-পারু, ও পারু? কেমন লাগতাছে? জ্বরটা কি বেশি? এই বলে হাতটা গায়ের দিকে এগিয়ে নেয়।
-হাত দেওনের দরকার নাই। দূর থাইক্যাই বইয়া দ্যাখেন। আমি ভালা আছি। আপনি বারবার আয়োন ক্যান? আর কয়বার না করবাম, আপনাকে। আমি বলছি তো, আমার পক্ষে সম্ভব না।
-এখন থাক, ওসব কথা। আগে তুমি ভালা হও। তোমার ভালা হওয়া জরুরি। তুমি ভালা থাকলে আমিও ভালা থাকমু।
-আমার ভালা হওয়ার দরকার নাই। আমি ভালা হতে চাই না। ক্যান যে মরণ আমারে নেয় না। ক্যান যে আমি বেঁচে আছি। এই বলে পারু অঝর ধারায় কাঁদতে থাকে। কান্নার শব্দ মৃদু থেকে উচ্চ হতে থাকে। এক সময় তা শমসের আলীর কানে পৌঁছে। বয়স্ক শমসের আলী কাশতে কাশতে ঘরে ঢুকে।
-মাস্টার শরীর কি বেশি খারাপ? আবারও মাস্টার বলায় সে কিছু মনে করছে না বা খেয়ালও করে নাই।
-মনে হয় ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবো! ওর শরীরের চেয়ে মনের অবস্থা খুবই খারাপ।
-আফনারে আমি না করতাছি, তার পরও বসে আছেন ক্যান? আফনি চইল্যা যান। আফনারা সবাই চইল্যা যান। আমি একা থাকুম। শরীফ চলে গেল আর আফনিও ওর মত চইল্যা যান। শরীফতো আফনার জন্যই চইল্যা গেল, ও কত বার মানা করছে। আফনি যেন এ বাড়িতে না আয়োন। আফনি ওর কথা হুনলাইন না। রাগ কইরা ও আমারে ফালাইয়া চইল্যা গেল। কোথায় গেল, কেউ বলতাছে না, কেউ তার খবর আইন্যা দেয় না। আমি তার লাইগ্যা বইয়া আছি, সে আসে না, আসে মাস্টার! আসে শাহজাদা! আসে হারামজাদা! যার জন্য আমার সোয়ামি চইল্যা গেল, সে বারবার আসে ক্যান-বাজান? তারে আমার সামনে থাইক্যা চইল্যা যাইতে কও। শমসের আলীকে চোখে ইশারা দিয়ে মাস্টার বাইরে যেতে বলে, সেও পেছনে পেছনে ঘরের বাইরে বের হয়ে আসে।
-শোন, মুরুব্বি! শমসের আলীকে মাস্টার কোনো কিছু সম্বোধন করে না। বরাবরই দেখা হলেই মুরুব্বি বলেই ডাকে। এ যেন চিত্তের বেদনা। সেও কিছু মনে করে না। বয়স হয়েছে, মনে করার মতো শক্তিও তার নেই। তাই ওতেই সে সন্তুষ্ট।
-একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবো। আমি সুধীর ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, মুরুব্বি তুমি ওর দিকে খেয়াল রাইখ্যো।
-ঠিক আছে, যাও।
দুইদিন হতে চলল উত্তরপাড়া থেকে কোনো খবর নাই। মাস্টারের মনটা আনচান করে। কী জন্য একটা ব্যথা অনুভব করে। কিসের ব্যথা সে ঠিকই বুঝতে পারে। প্রকাশ করতে পারে না। মাস্টারের অস্থিরতা দেখে ছন্দা ঠিকই বুঝতে পারে কিন্তু বলতে পারে না। বিয়ে হওয়ার পর থেকে সে মাস্টারের চরম অবহেলার পাত্র। ছয় বছর দাম্পত্য জীবনে সে এখনো মা হতে পারে নাই। কেউ কেউ তাকে বাঝা বলে। সে নাকি আর মা হতে পারবে না। এর জন্য দায়ী কে? ছন্দা না মাস্টার! তা পরীক্ষা করা হয় নাই। সমাজের বিধিবিধানের জাঁতাকলে বন্দি, তাই সে মাস্টারের সঙ্গে উচ্চবাক্য করে না। মাস্টার যা বলে তাই সে করে। একেবারে নিবেদিত স্ত্রী। মাস্টারের অস্থিরতা দেখে সে সহ্য করতে পারে না।
-অমুন অস্থির দেখাচ্ছেন যে?
-তোমার চিন্তায়! তুমি আমার মাথায় তেল দিতে চাও? দাও- আন আন জলদি আন, মাথায় তেল মাখাই। আমি অস্থির, তাতে তোমার কী? তোমার বাবার কী? যত সব ফালতু কথা। আমি একটু ভাবছি, কিভাবে দেশের উন্নয়ন করা যায়, আর উনি আমারে দেখলেন তেড়ছাভাবে। এই তোমার, তোমার জন্যই কিছু করতে পারলাম না।
-আর করণের দরকার নাই, যা করছেন তাতে মানুষ ছিঃ ছিঃ করতাছে।
-করবোই তো, এখনকার মানুষ কারো ভালা কেউ দেখতে পারে না। বাইরের কথা কী কব, ঘরের মানুষই আমার ভালা দেখতে পারতাছে না, অন্যের কথা কী কমু?
-যান যান, কোন দিকে যাবেন, যান আর কথা বাড়নের দরকার নাই, পেটের ভাততো হজম করা লাগবো। দুই দিন না যেতেই ঘর আওলা লাগতাছে।
মাস্টার আর কথা বাড়ায় না। সে মনে মনে বউয়ের ওপর খুশি হয়। যে বউ আগে কোথাও যেতে দিত না এখন সেই কি না বলে, বাইরে যেতে। আমি কোথায় যাই এবং কী করি হয়তো সে কারো কাছ থেকে জেনে থাকবে। তার পরও সে মুখে কিছু বলবে না। নারী খুবই দুর্বল, যে নারী বন্ধ্যা, সে তো আরো কাহিল। মানুষের জীবন বড়ই বিচিত্র। ও যদি আমাকে সন্তান দিতে পারতো, তাহলে তো সামনে দাঁড়ানোই যেত না। আমাকে পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়ের ওপর রাখতো। অবশ্য এখানে ওরও হাত নেই, আমারও হাত নেই। সবকিছুর মালিক একজনই। তিনি চাইলে ঘর ভরে দেন আবার কাউকে শূন্য রেখে ঈমানের পরীক্ষা করেন। কেউ পাস করে আবার কেউ করে ফেল- তার সৃষ্টির এক অভিনব কৌশল।
যত ভয়ই করুক না কেন! আজকে উত্তরপাড়ায় যেতেই হবে। মজিদ মিয়ার চোখকে আজ ফাঁকি দিতেই হবে। শালার বুড়া যদি একবার দেখে তো আর রক্ষা নেই। মনে হয় ওর খাবারে আমি ভাগ বসাচ্ছি। অবশ্য পারুর মা আর মজিদ মিয়া সম্পর্কে আমাদের গ্রামে একটা মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে। যদি গল্পটা সত্যি হয়, তাহলে আমাকে হিংসা করবে- এটাই স্বাভাবিক। একদিন নাকি মজিদ মিয়া পারুর মার ঘরে ধরা পড়েছিল। অনেক দিন থেকেই ধল্লা গ্রামের কিছু তরুণ মজিদ মিয়াকে সতর্ক করতেছিল। সে কথা কানেই তোলে নাই। তাকে বারবার নিষেধ করা হচ্ছিল যে উনি যেন পারুর মার কাছে আর না যান, এমনকি ওই বাড়িতেই যেন আর না যান। অনেকেই সন্দেহ করছিল যে পারুর মার সঙ্গে মজিদ মিয়ার একটা অনৈতিক সম্পর্ক চলছে, তাই গ্রামে এটা মেনে নেয়া যায় না। হয়ত শহর হলে সে বেঁচে যেত কিন্তু গ্রাম বলে আর শেষ রক্ষা পেল না। স্বয়ং মুরুব্বি পর্যন্ত উনাকে তার বাড়ির আঙিনায় আসতে নিষেধ করলেন, কথা শুনলেন না। যে নেশা তাদেরকে ধরেছে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউই থামেন নাই। এরই ফল হলো মজিদ মিয়ার একাকিত্ব আর পারুর মার নিরুদ্দেশ। কেউ তার আর সন্ধান করে নাই। শরীফ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। একদিন বিকালবেলায় মজিদ মিয়া পারুদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে, তখন পারুর বয়স পাঁচ কি ছয় হবে। গ্রামের তরুণরা আগে থেকেই ফন্দি করে রাখছে যে, উনি তো আমাদের কারোরই কথা শুনছেন না। এবার একটা শিক্ষা দিতে হবে। দূর থেকে তারা লক্ষ্য রাখছে তার গতিবিধির ওপর। সে কিন্তু তরুণদের পাত্তা দেই নাই বা বিষয়টি এতদূর নিয়ে যাবে তা ভাবতেও পারে নাই। কোনো রকম এদিক-ওদিক একটু তাকিয়ে সে ঘরে ঢুকল। দরজাটা খোলাই ছিল, সে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করল। ওই সময়ে পারু পাশের বাড়িতে খেলতেছিল আর মুরুব্বি ছিল বাজারে। এ যেন শিকারের উপযুক্ত সময়।
-ক্যাডা? পারুর মা বিকেলি ঘুমের ঘোরে জিজ্ঞেস করে।
-আমি, মজিদ। কেউ নেই মনে হয়?
-জানি না। বিরক্তির স্বরে জবাব দেয়।
-মন খারাপ?
-জানি না।
-কেন? আমি আইছি তুমি কি রাগ করতাছ? চইল্যা যাই?
-আইছো যহন, বস। আমি উঠতাছি। এই বলে পারুর মা বিছানা থেকে উঠতে যাবে ঠিক তখনই মজিদ মিয়া ওর পাশে গিয়ে দ্রুত বসে।
-ওঠা লাগবো না, তুমি শুইয়া থাকো। আমি তোমারে বইয়া বইয়া দেহি। তুমি কত সুন্দর-একবারে গোলাপের লাহান।
-অসময়ে এত পিরিতের কথা! মতলব কী?
-আমি পুরুষ মানুষ-আমার মতলব তুমি বুঝতে পারতাছো না-
-পারি, লজ্জা লাগে আর পাপ হবে! স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষ!
-এহনতো তুমি আমারে স্বামীই ভাবতে পারো। একটু ভাব-এই বলে সে পারুর মার পাশে শুয়ে পড়ে। এ যেন তার পরম আরামের বিছানা। যে বিছানা আজ তাকে স্বস্তি দেবে। পারুর মা আর না বলতে পারে না। অনেক দিনই বিভিন্ন মশকরা আর ইর্য়াকি ফাজলামো করে পারুর মাও মজিদের ওপর দুর্বল হয়ে পড়েছিল আজ যে সময় ও এসেছে তাতে দুজনার সময়ই অন্যরকম। মজিদ মিয়া পারুর মাকে আর কোনো সুযোগ দিল না। সে তার সঙ্গে কামলীলায় লিপ্ত হল। লজ্জা আর পাপকে কোনো সুযোগই দিল না কাছে আসতে। ওরা কাম শেষ করে পাশাপাশি শুয়ে ছিল। পারুর মা যেন পেল এক চিরসুখ আর মজিদ মিয়া পেল অপার আনন্দ। কেউ বাড়িতে আসতে পারে- এমন চিন্তা ওদের মাথায় ছিল না। বাড়ির আঙিনায় কাদের যেন ফিসফাঁস শব্দ শুনতে পেয়ে কাম শেষের নিদ্রা ভঙ্গ হলো। একটু সচেতন হলো। মজিদ মিয়া বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভয় পেতে লাগল। পারুর মা ওকে অভয় দিতে লাগল। পারুর মা ধীরে ধীরে দরজার দিকে এলো। বাইরে এলো।
-কী চাও, তোমরা? কাকে খুঁজতাছ?
তরুণরা কোনো জবাব দিল না। দলে ওরা পাঁচজন। একজন বলল,
-এই বাড়িতে কেউ নাই? বাড়ির মানুষরা কোথায়?
-এই যে আমি। আমারে কী মানুষ মনে অয় না?
-অয়! তবে অন্য মানুষরা থাকলে ভালা অইত। কোন সন্দেহ করতাম না।
-কিসের সন্দেহ? তোমরা কী কইতে চাও? পারুর মা বিধ্বস্ত অবস্থায় হুঙ্কার দিয়ে উঠল।
-আস্তে কথা কইন- জোরে কথা কইলেই বিপদ। গ্রামের হকলেই আইবো। এই বাড়িতে কী হয়- হকলেই জানতে পারবো। পারুর মা আর কোনো কথা বলে না।
-ঘরের মইধ্যে ক্যাডা? ওদের একজন জিজ্ঞাসা করে।
-কেউ না- যাও- তোমরা যাও- আমি এহন কামে যামু।
-কাম ঘরে অয় নাই? অন্য একজন ফুরুত কইরা কথা বলে।
-কী কস চ্যামরা! অ্যা অ্যা তোরা কী এই গ্রামের মাতবর হইয়া গেলি- আমার বাড়িতে আইস্যা আমার ঘরে ক্যাডা তা জানতে চাস! যা যা আমার বাড়ি থাইক্যা চইল্লা যা। আবারো জোরে জোরে চিল্লাইতে লাগল। মাতবর হইয়া- গেসস। সবাই মাতবর, আমরা কেউ না, আমরা হইলাম ফেলনা?
পারুর মার কথাকাটিতে একজন দুজন করে বেশ কয়েকজন জড়ো হয়ে গেল। কেউ কেউ বিষয়টা বুঝতে পারছে না। কেন রতন-ফিরোজ-কাঞ্চন-মনা আর জসিম পারুর মার বাড়িতে? ওদের মধ্যে কেউ কেউ বুঝতে পারছে কিন্তু কোনো প্রমাণ ছাড়া কথা বলা যায় না। এমন সময় হারু প্রশ্ন করে-
-কীরে রতন, তোরা এই বাড়িতে কী করিস? রতন আসল ঘটনা বলবে কি বলবে না, ঠিক বুঝতে পারছে না।
-কীরে ফিরোজ তোরা এখানে কেন? আর পারুর মা তোদের বকাবকি করছে কেন? আয়নাল জোরে জিজ্ঞাসা করে। সে বিলে মাছ ধরতে যাচ্ছিল, ছেলেদের জটলা দেখে এই বাড়িতে ঢুকে পড়ে। একে একে আরো বেশ কয়েকজন মধ্যবয়সী পুরুষ এই বাড়িতে চলে আসে।
ঘরের ভেতরে মজিদ মিয়া কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। ভয়ে আর লজ্জায় একদম কাঠ হয়ে গেছে। তার যেন গা ঘিনঘিন করছে। লুঙ্গিটাও পাল্টাতে পারছে না। ঘরে আর কোনো লুঙ্গি নাই। পারুর মা দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ছেলেদের সঙ্গে কথা বলছে। ভেতরেও আসছে না আবার অন্য কোনো দিকেও যাচ্ছে না। ছেলেদের সঙ্গে অন্যরা আসায় এবার সে নত হয়ে গেল। কী বলবে বা কী ঘটবে তা সে আন্দাজ করতে পারছে না। তবে ভয়ে এবার বুকের মধ্যে টন টন ব্যথা অনুভব করতে পারল।
-বল, ঘরের মইধ্যে ক্যাডা? কাঞ্চন জিগায়। পারুর মা কথা বলে না।
-তুমি দরজার সামনে থাইক্যা সর, আমরা দেখতাছি ক্যাডা তোমার ঘরে?
-আলা্লহর দোহাই, তোমরা ঘরে যাবা না, তোমরা ঘরে ঢুকবা না। আমি তোমাদের পায়ে পড়ি তোমরা চইল্লা যাও। কেউ কারো কথা শুনছে না। সবার মাঝে কৌতূহলের মাত্রা বেড়ে গেল। একরকম জোর করে পারুর মাকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিল- ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল। একসঙ্গে দুজন ঘরে ঢুকল। মজিদ মিয়া একটা ঢুলির আড়ালে লুকিয়েছিল কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারল না। ওদের চিরুনি অভিযানে সে ধরা পড়ল।
-তুমি এই ঘরে কী করো? কেউ বাড়ি নাই, তুমি কেন এই ঘরে? বুকে সাহস ফিরে পেল মজিদ মিয়া। যেভাবেই হোক মানসম্মান রক্ষা করতে হবে।
-আমি ক্ষেত দেখতে আইছিলাম-হঠাৎ হুনি পারুর মা কানতাছে, কান্নার শব্দ শুইন্যা আইয়া দেহি, তার পেট ব্যথা, কথা বন্ধ হইয়া যাইতাছে। আমারে কইল, মজিদ ভাই তুমি আমারে বাঁচাও, আমি মইরা যাইতাছি। আমিও ওর কথা শুইন্যা তারে সেবা যত্ন করতে লাগলাম- পানি খাওয়ালাম, ঘরে ওষুধ ছিল, ওটা খাওয়ালাম। আর তখনই শুনি পোলাপানের আওয়াজ। কী যে কই? আর মানসম্মান রইল না। পারুর মা কি কও? আমার কোন দোষ আছে, কও, বল হকলরে বল, আমার কোনো দোষ আছে? মজিদ মিয়া পারুর মার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কী জবাব আসে তার জন্য। জবাব এলো- মনার কাছ থেকে।
-সব ঠিক, আমরা সবাই তোমার কথা বিশ্বাস করলাম। আমরা এখানে আসছি, এইডাই আমাদের দোষ। ঠিক আছে সব ঠিক আছে। সব মানলাম। তবে একটা পরীক্ষা দিতে হবে?
-পরীক্ষা! একটা না, একশটা পরীক্ষা দিমু। মজিদ মিয়া উৎফুল্ল হয়ে কথা বলে। যেন পরীক্ষা কোনো ব্যাপারই না।
-আস- এইদিকে আস। জসিম ঘরে ঢুকে মজিদ মিয়াকে ডাকে। মজিদ মিয়াও ঘরে ঢুকে।
-পরীক্ষা কী ঘরে নিবা?
-হ, আস ভেতরে আস- এই তোরা সবাই আয়। তার দলের সবাই ঘরে ঢুকল। ছেলেরো কেউ ঘরে আবার কেউ কেউ বাইরে ঘোরাঘুরি করছে।
-তুমি কোনো কথা কবা না? ঠিক আছে?
-ঠিক আছে। মজিদ মিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। সবাই তাকে ঝাপটিয়ে শক্ত করে ধরে। সে কোনো নাড়াচাড়া করতে পারল না। একটানে মজিদ মিয়ার লুঙ্গিটা খোলে। উলঙ্গ হয়ে মজিদ মিয়া হা-হুতাশ করতে থাকে। ইস ইস করতে থাকে।
-তোমার এই জায়গা ভিজা কেন? লুঙ্গিতে এই জায়গায় কী মাখানো? কথা কও? বল? কোনো কথা কয় না মজিদ মিয়া।
-আপনারা সবাই আসেন, জলদি আসেন। দেখেন এরা কী কাম করছে? কীভাবে আমাদের গ্রামকে এরা দূষিত করছে? সবাই মজিদ মিয়াকে দেখে, দেখে মজিদ মিয়ার লুঙ্গী। এ যেন নতুন জাদুঘর। ছিঃ ছিঃ বলে আর কানাঘুষা করে সবাই যার যার দিকে চলে গেল। আগামীকাল তোমাদের বিচার হবে, চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবো তোমাদের। জসিম এই কথা বলে সবাইকে চলে যেতে বলল আর সবাই যেন সাক্ষী দেয় এই অনুরোধ করল। একে একে সবাই চলে গেল আবারও বাড়ি ফাঁকা তবে এ যেন শূন্য মরূদ্যান। পারুর মা ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে রইল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। মজিদ মিয়া মাটিতে ফেলে রাখা লুঙ্গি পরে নিয়ে মাথা নিচু করে বাড়ির দিকে রওনা দিল। পারুর মা ওইদিন সন্ধ্যার পর আর কোনোদিন এই গ্রামে দেখা দিল না। কেউ তার আর খোঁজ নিল না। পারু খেলা শেষে বাড়ি ফিরে আর মুরুব্বি বাজার থেকে ফিরে এসে ওকে পেল না। পরে লোকমুখে গল্প শুনে ওরাও আর কোনো খোঁজাখুজি করল না। এ যেন এক প্রাগৈতিহাসিক কালের গল্প।
মাস্টার এই মুখরোচক কাহিনীটা শুনেছে তবে বিশ্বাস করতে পারে নাই। আবার বিশ্বাস করে যখন মজিদ মিয়া সব সময় তাকে ফলো করে। মনে হয় এখনো নেশায় থাকে মজিদ মিয়া। এখনো মন টানে বা এখনো অপেক্ষায় আছে পারুর মার জন্য। আজ মাস্টার উত্তরপাড়ার দিকে রওনা হলো। বেশ ফুরফুরে মেজাজ। যাওয়ার পথেই মজিদ মিয়ার বাড়ি। কোনো রকম সন্তর্পণে যেতে পারলেই সে বাঁচে। আর কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায় না। সরাসরি যা বলার পারুকেই বলবে। বলবে, সে আর কোনোদিন এভাবে তার কাছে বা তার বাড়িতে আসবে না। সে শরীফকে খুঁজে বের করে, এখানে নিয়ে আসবে। তবে সে অপেক্ষায় থাকবে, যদি পারু কোনো দিন আমাকে ডাকে সেই দিনের অপেক্ষায়। ভাবতে ভাবতে মাস্টার হাঁটছে।
-কে যায়? বুড়ো মজিদ মিয়া জিগায় আর কাশতে থাকে।
মজিদ কোনো জবাব দেয় না। সে ঠিক বুঝতে পারছে না। জবাব দেবে কি না?
 -কে, মাস্টার না? এবার নিশ্চিত হয়েই জিগায়।
-জ্বি, কিছু কইবেন?
-না, কী আর কই? জ্বালা, বুঝলে মাস্টার, বড় জ্বালা। মাস্টার সায় দেয়।
- হয় জ্বালা।
-মাস্টার নেশা ছাড়ো, নইলে নেশায় তোমারে খাইবো। এ জীবনে কী পেলে আর কী হারালে তা কি ভাবছো? ভাব নাই। তাই নেশায় মজে থাকতে চাও। একবার ভাবলে আর নেশায় জড়াবে না। ঘরে যে বউ আছে তার কাছে যাও। ঐখানেই শান্তি, বাকি সব মিছা। সত্যের পেছনে যাও। মাস্টার কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সামনের দিকে না গিয়ে সে পেছনে ফিরতে লাগলো। উত্তরপাড়ায় না গিয়ে মাস্টারবাড়ির দিকে যেতে লাগলো। মজিদ মিয়া তৃপ্তির হাসি দিল। জীবনের কাছে যৌবনের পরাজয়। একগামীর কাছে বহুগামীর পরাজয়। অভিজ্ঞতার কাছে অনভিজ্ঞ মানুষের আত্মাহুতি। সমাজের শিকলে বাঁধা সমাজের চলন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status