ঈদ আনন্দ ২০১৮
গল্প
সহমরণ ভাবনা
রানা জামান
২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৬:৫১ পূর্বাহ্ন
ছেলে সায়মনের ঘরে উঁকি দিয়ে ঠোঁট উল্টে ফিরে চললেন হোসনা কাদরি। পাশেই মেয়ে পুষ্পিতার কক্ষ। ও ঘরে উঁকি দিয়ে একই অবস্থা দেখে মনটা খুব খারাপ হলো হোসনার। ফিরে চললেন নিজের শয্যাকক্ষের দিকে। হোসনা জানেন, স্বামীকেও একই অবস্থায় দেখবেন। বাপ-ছেলেমেয়ে একই কাজ করছে। ভাবা যায়?
নিজের কক্ষেই ঢুকলেন হোসনা কাদরি। নিজের শয্যাকক্ষই আপন মনে হয় তার। ছেলেমেয়ের কক্ষ দুটো মনে হয় হোটেল।
জামাল কাদরি স্ত্রীকে দেখে এক ফালি মুচকি হেসে ফের নজর দিলেন মোবাইলফোনে। হোসনা কাদরি মনে মনে বললেন: দাঁড়াও! আমিও তোমাদের মতো আত্মমগ্ন হয়ে যাবো! তিনি ড্রেসিংটেবিল থেকে নিজের মোবাইলফোনটা নিয়ে বিছানায় স্বামীর পাশে বসলেন। উঁকি দিলেন স্বামীর হাতের মোবাইলফোনে। কী করছেন স্বামীটি বুঝতে পারছেন না। জিজ্ঞেস করলেন, কী করছো তুমি মোবাইলফোনে?
জামাল কাদরি মোবাইলফোনের পর্দা থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বললেন, ও তুমি বুঝবে না।
আমি বুঝতে চাই।
কী করবে বুঝে?
তোমরা মোবাইলফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকো। বাসাভর্তি লোক থেকেও আমি একা। আমার মোবাইলফোনে দেখিয়ে দাও, আমিও তোমাদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
অশেষ বিরক্তি নিয়ে জামাল কাদরি স্ত্রীর মোবাইলফোনটা দেখে বললেন, ঐসব এনালগ ফোন দিয়ে এসব হবে না! এনড্রয়েড ফোন লাগবে, এনড্রয়েড! টাচস্ক্রিন!
হোসনা কাদরি স্বামীর গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন, ওকে! আমাকে আজই একটা টাচস্ক্রিন ফোন কিনে দাও। নাকি?
ওকে ডার্লিং! আজই কিনে দেবো।
বুড়ো বয়সে ডার্লিং! শখ কত!
বাহ! তুমি আমার স্ত্রী, আমি তোমার স্বামী। আমরা দুজন সবসময় একে অপরের ডার্লিং। নাকি?
স্বামীর এমন কথায় হোসনা কাদরির চোখে অশ্রু চলে এলো। তিনি স্বামীর আরেকটু গাঘেঁষে বললেন, আমরা সারাজীবন এমন থাকবো তো?
জামাল কাদরি বিস্মিত হয়ে বললেন, সেকি! আধা জীবন পার হয়ে গেল এভাবে। বাকি আধা জীবনও পার হয়ে যাবে এভাবে, ইনশাআল্লাহ।
আমার মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় গো।
কিসের ভয়?
তোমার আমার মাঝে বয়সের এতো ফারাক। আমার আগে তুমি যাবেই। তখন আমার কী হবে? একা একা বাকি জীবন কীভাবে পার করবো? শেষের দিকে গলাটা ভিজে গেল হোসনা কাদরির।
একটা বিয়ে করে ফেললেই আমার মতো সঙ্গী পেয়ে যাবে!
তুমি কি তাই করবে গো?
হয়তোবা।
তুমি এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে যেতে পারবে? আমি পারবো না।
পার্থিব বিবেচনায় নিষ্ঠুরের মতো মনে হচ্ছে আমার কথাগুলো; কিন্তু পরকালে তো মানুষ আরো নিষ্ঠুর হবে।
মানে?
ওখানে কেউ কাউকে চিনবে না। যত মায়া আর ভালোবাসা সব পৃথিবীতে। পৃথিবীতে একমাত্র স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটা আইনি ও আনুষ্ঠানিকতার বন্ধনে আবদ্ধ। তারপরও পরকালে মিলনের সম্ভাবনা খুব কম।
বুঝলাম না।
স্ত্রী মারা গেলে স্বামী আবার বিয়ে করতে পারে; একইভাবে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারে। তাহলে পরকালে কে কাকে কাছে টেনে নেবে?
বড্ড জটিল কথাবার্তা বললে। আমি এইটুকুই বুঝি যে তোমার আগে মরতে চাই। তুমি আগে মারা গেলে আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
জামাল কাদরি স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি আমাকে ইমোশনাল করে ফেলছো। মৃত্যু নিয়ে ভাবা ভালো; তবে এভাবে ভেবো না। কে আগে মারা যাবে, আর কে পরে, তা মহান আল্লাহ তায়ালা আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন।
বিকেলে সবাই মিলে চলে গেল বসুন্ধরা সিটিতে। ছেলের পছন্দমতো কেনা হলো একটি এন্ড্রয়েড মোবাইলফোন। হোসনা কাদরি লম্বা নিঃশ্বাসে নতুন মোবাইলফোনের ঘ্রাণ নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন। সায়মন মায়ের হাত থেকে মোবাইলফোনটা নিয়ে বললো যে ফুলচার্জ দেবার পর কাস্টোমাইজ করলে এটা ব্যবহারের উপযোগী হবে। নতুন কোনো কিছু কেনার পর রিচ ফুড খাওয়াটা রেওয়াজ হয়ে গেছে এই পরিবারের। তো চলে গেল ওরা ফুড কর্ণারে। হৈ-হুল্লোড় করে যার যার ইচ্ছেমতো খাবার খেয়ে চলে এলো বাসায়। হোসনা কাদরির দৃষ্টি পড়ে রইলো সারারাত ছেলের হাতে। একরকম নির্ঘুম রাত কাটলো হোসনা কাদরির। স্বামী যাতে টের না পায় এমন নিঃশব্দে হোসনা কাদরি তিনবার ছেলের কক্ষে উঁকি মেরে গেছেন। ছেলেমেয়ে দুটোই গভীর রাত পর্যন্ত কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে।
জামাল কাদরি প্রতিবার স্ত্রীর বিছানা ত্যাগে টের পেয়েছেন; কিন্তু বুঝতে দেননি-এতোদিনের স্ত্রীর গায়ের গন্ধ আত্মায় মিশে আছে; দূরে গেলেই টের পেয়ে যান। চতুর্থ বার উঠে যেতে চাইলে স্ত্রীর হাত ধরে উঠে বসলেন। বললেন, এবার আমিও তোমার সাথে যাবো।
হোসনা কাদরি অপ্রস্তুত হাসলেন। জামাল কাদরি আলগোছে স্ত্রীর হাত ধরে খাট থেকে নামলেন। ছেলের কক্ষে যাবার পথে নিঃশব্দে উঁকি দিলেন মেয়ের কক্ষে। পুষ্পিতা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় নিবিষ্ট মনে মোবাইলফোনের পর্দায় আঙ্গুল নাড়াচ্ছে।
সরে এসে জামাল কাদরি স্ত্রীর কানে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, এমন এটেন্টেভলি পড়া করলে রেজাল্ট আরো ব্রাইট হতো।
স্বামী-স্ত্রী দুজন সায়মনের কক্ষে ঢুকলো। সায়মন ফিরেও তাকালো না মা-বাবার দিকে-ল্যাপটপে গেম খেলছে; দুটো হাত দ্রুত নড়ছে কি-বোর্ডে। দুজন ছেলের পেছনে দাঁড়ালেন।
দেয়াল ঘড়িটা একবার দেখে জামাল কাদরি বললেন, রাত আড়াইটা বাজে। প্রত্যেক দিন এতো রাত জেগে একই গেম খেলিস। বিরক্ত লাগে না?
ল্যাপটপের পর্দায় তাকিয়ে থেকে সায়মন বললো, লাইভ খেলছি বাবা।
লাইভ খেলছিস? ওদিকে কে?
আমেরিকার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড।
তোর মার ঘুম হচ্ছে না মোবাইলফোনের জন্য। বারবার উঠে আসছেন। আমারও ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছে।
সায়মন চকিতে মাকে একবার দেখে ল্যাপটপে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললো, মা! তুমি বাচ্চার মতো বিহেভ করছো! মোবাইলফোন এখন চার্জে দিয়েছি। সকালে আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবো মা। তুমি এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাও মা।
নিজেদের শয্যাকক্ষে ঢুকে দরজা আটকে স্ত্রীর হাত ধরে বিছানায় মুখোমুখি বসে জামাল কাদরি বললেন, যেদিন প্রথম আমাকে দেখেছিলে, সেদিনও তুমি এমন অস্থির হয়ে উঠেছিলে। মনে আছে?
হোসনা কাদরির মুখমণ্ডল লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো। তিনি একবার স্বামীকে দেখে মাথা নত করে নিলেন।
জামাল কাদরি স্ত্রীর আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বললেন, আমিও কি কম ছিলাম নাকি! আজকেও আমার সেরকম ফিলিংস হচ্ছে।
জামাল কাদরি স্ত্রীর আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলেন। নিঃশ্বাস উভয়ের নাক-মুখে লাগছে। বেশ উষ্ণ। এবার হোসনা কাদরি স্বামীর আরো কাছে এলেন। পরস্পর পরস্পরের কাছে আসতে থাকলেন। আরো... আরো...। এরপর পৃথিবীর দ্বার বন্ধ হয়ে যায়।
একসময় হোসনা কাদরি স্বামীকে বললেন, প্রাচীনকালে ভারত উপমহাদেশে সহমরণ প্রথা ছিলো।
জামাল কাদরি বললেন, ওটা সনাতন ধর্মাবম্বীদের মধ্যে ছিলো। স্বামীর চিতায় স্ত্রীকে জ্যান্ত সহমরণে বাধ্য করা হতো।
আমার সহমরণ হতে ইচ্ছে করছে। তোমার সাথে বাঁচতে চাই, তোমার সাথেই মরতে চাই।
অমনটা ভাবাও পাপ। তবে আল্লাহর কাছে আমাদের দুজনকে যাতে একসাথে মৃত্যু দেন সে প্রার্থনা করতে পারো।
পরদিন থেকে হোসনা কাদরি আর একা রইলেন না। একই বাড়িতে চারটি প্রাণী নিজ নিজ ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে নিজ জগতে ভরাডুবি। খাওয়ার সময়টাও পাল্টে যেতে থাকলো চারজনের। ডাইনিংটেবিল হয়ে গেলো একা। জামাল কাদরি ও হোসনা কাদরি বিছানায় পাশাপাশি বসে থেকেও যেনো দুই ভিন্নজগতে বাস করছেন।
একদিন বাথরুম থেকে স্ত্রীর ‘উফ’ ধ্বনি শুনে জামাল কাদরি সজাগ হলেন। তিনি মোবাইলফোনটা বিছানায় ফেলে দ্রুত বাথরুমের দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো গো? পা পিছলে পড়ে গেলে নাকি? ক’দিন ধরে আমারও মনে হচ্ছিলো যে বাথরুমের ফ্লোরটা স্লিপারি হয়ে গেছে।
বাথরুমের ভেতর থেকে হোসনা কাদরি বললেন, তেমন কিছু না।
উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জামাল কাদরি বললেন, তবুও দরজা খোল।
হোসনা কাদরি দরজা খুললেন। তাঁর বাম হাতটা পেছনে লুকানো।
জামাল কাদরি জিজ্ঞেস করলেন, বাম হাত পেছনে লুকানো কেনো? কী হয়েছে বাম হাতে? দেখি!
হোসনা কাদরি বাম হাত সামনে আনতে না চাইলে জামাল কাদরি একরকম জোর করেই সামনে এনে হয়ে গেলেন হতবাক। ব্লেড দিয়ে হাতে একটি তিমির অবয়ব বানানো হয়েছে। রক্তে হাত সয়লাব।
জামাল কাদরি রাগ করবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। স্বাভাবিক কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলেন, হাতে এটা করেছো কেনো?
এবার হোসনা কাদরি বললেন, আমি নেটে ব্লু হোয়েল গেম খেলছি। হাত কেটে নীল তিমি আঁকা খেলার একটা স্টেজ। আজ আমি সেই স্টেজ অতিক্রম করেছি।
নিজের কক্ষেই ঢুকলেন হোসনা কাদরি। নিজের শয্যাকক্ষই আপন মনে হয় তার। ছেলেমেয়ের কক্ষ দুটো মনে হয় হোটেল।
জামাল কাদরি স্ত্রীকে দেখে এক ফালি মুচকি হেসে ফের নজর দিলেন মোবাইলফোনে। হোসনা কাদরি মনে মনে বললেন: দাঁড়াও! আমিও তোমাদের মতো আত্মমগ্ন হয়ে যাবো! তিনি ড্রেসিংটেবিল থেকে নিজের মোবাইলফোনটা নিয়ে বিছানায় স্বামীর পাশে বসলেন। উঁকি দিলেন স্বামীর হাতের মোবাইলফোনে। কী করছেন স্বামীটি বুঝতে পারছেন না। জিজ্ঞেস করলেন, কী করছো তুমি মোবাইলফোনে?
জামাল কাদরি মোবাইলফোনের পর্দা থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে বললেন, ও তুমি বুঝবে না।
আমি বুঝতে চাই।
কী করবে বুঝে?
তোমরা মোবাইলফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকো। বাসাভর্তি লোক থেকেও আমি একা। আমার মোবাইলফোনে দেখিয়ে দাও, আমিও তোমাদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
অশেষ বিরক্তি নিয়ে জামাল কাদরি স্ত্রীর মোবাইলফোনটা দেখে বললেন, ঐসব এনালগ ফোন দিয়ে এসব হবে না! এনড্রয়েড ফোন লাগবে, এনড্রয়েড! টাচস্ক্রিন!
হোসনা কাদরি স্বামীর গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন, ওকে! আমাকে আজই একটা টাচস্ক্রিন ফোন কিনে দাও। নাকি?
ওকে ডার্লিং! আজই কিনে দেবো।
বুড়ো বয়সে ডার্লিং! শখ কত!
বাহ! তুমি আমার স্ত্রী, আমি তোমার স্বামী। আমরা দুজন সবসময় একে অপরের ডার্লিং। নাকি?
স্বামীর এমন কথায় হোসনা কাদরির চোখে অশ্রু চলে এলো। তিনি স্বামীর আরেকটু গাঘেঁষে বললেন, আমরা সারাজীবন এমন থাকবো তো?
জামাল কাদরি বিস্মিত হয়ে বললেন, সেকি! আধা জীবন পার হয়ে গেল এভাবে। বাকি আধা জীবনও পার হয়ে যাবে এভাবে, ইনশাআল্লাহ।
আমার মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় গো।
কিসের ভয়?
তোমার আমার মাঝে বয়সের এতো ফারাক। আমার আগে তুমি যাবেই। তখন আমার কী হবে? একা একা বাকি জীবন কীভাবে পার করবো? শেষের দিকে গলাটা ভিজে গেল হোসনা কাদরির।
একটা বিয়ে করে ফেললেই আমার মতো সঙ্গী পেয়ে যাবে!
তুমি কি তাই করবে গো?
হয়তোবা।
তুমি এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে যেতে পারবে? আমি পারবো না।
পার্থিব বিবেচনায় নিষ্ঠুরের মতো মনে হচ্ছে আমার কথাগুলো; কিন্তু পরকালে তো মানুষ আরো নিষ্ঠুর হবে।
মানে?
ওখানে কেউ কাউকে চিনবে না। যত মায়া আর ভালোবাসা সব পৃথিবীতে। পৃথিবীতে একমাত্র স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটা আইনি ও আনুষ্ঠানিকতার বন্ধনে আবদ্ধ। তারপরও পরকালে মিলনের সম্ভাবনা খুব কম।
বুঝলাম না।
স্ত্রী মারা গেলে স্বামী আবার বিয়ে করতে পারে; একইভাবে স্বামী মারা গেলে স্ত্রী আবার বিয়ে করতে পারে। তাহলে পরকালে কে কাকে কাছে টেনে নেবে?
বড্ড জটিল কথাবার্তা বললে। আমি এইটুকুই বুঝি যে তোমার আগে মরতে চাই। তুমি আগে মারা গেলে আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
জামাল কাদরি স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি আমাকে ইমোশনাল করে ফেলছো। মৃত্যু নিয়ে ভাবা ভালো; তবে এভাবে ভেবো না। কে আগে মারা যাবে, আর কে পরে, তা মহান আল্লাহ তায়ালা আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন।
বিকেলে সবাই মিলে চলে গেল বসুন্ধরা সিটিতে। ছেলের পছন্দমতো কেনা হলো একটি এন্ড্রয়েড মোবাইলফোন। হোসনা কাদরি লম্বা নিঃশ্বাসে নতুন মোবাইলফোনের ঘ্রাণ নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন। সায়মন মায়ের হাত থেকে মোবাইলফোনটা নিয়ে বললো যে ফুলচার্জ দেবার পর কাস্টোমাইজ করলে এটা ব্যবহারের উপযোগী হবে। নতুন কোনো কিছু কেনার পর রিচ ফুড খাওয়াটা রেওয়াজ হয়ে গেছে এই পরিবারের। তো চলে গেল ওরা ফুড কর্ণারে। হৈ-হুল্লোড় করে যার যার ইচ্ছেমতো খাবার খেয়ে চলে এলো বাসায়। হোসনা কাদরির দৃষ্টি পড়ে রইলো সারারাত ছেলের হাতে। একরকম নির্ঘুম রাত কাটলো হোসনা কাদরির। স্বামী যাতে টের না পায় এমন নিঃশব্দে হোসনা কাদরি তিনবার ছেলের কক্ষে উঁকি মেরে গেছেন। ছেলেমেয়ে দুটোই গভীর রাত পর্যন্ত কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে।
জামাল কাদরি প্রতিবার স্ত্রীর বিছানা ত্যাগে টের পেয়েছেন; কিন্তু বুঝতে দেননি-এতোদিনের স্ত্রীর গায়ের গন্ধ আত্মায় মিশে আছে; দূরে গেলেই টের পেয়ে যান। চতুর্থ বার উঠে যেতে চাইলে স্ত্রীর হাত ধরে উঠে বসলেন। বললেন, এবার আমিও তোমার সাথে যাবো।
হোসনা কাদরি অপ্রস্তুত হাসলেন। জামাল কাদরি আলগোছে স্ত্রীর হাত ধরে খাট থেকে নামলেন। ছেলের কক্ষে যাবার পথে নিঃশব্দে উঁকি দিলেন মেয়ের কক্ষে। পুষ্পিতা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় নিবিষ্ট মনে মোবাইলফোনের পর্দায় আঙ্গুল নাড়াচ্ছে।
সরে এসে জামাল কাদরি স্ত্রীর কানে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, এমন এটেন্টেভলি পড়া করলে রেজাল্ট আরো ব্রাইট হতো।
স্বামী-স্ত্রী দুজন সায়মনের কক্ষে ঢুকলো। সায়মন ফিরেও তাকালো না মা-বাবার দিকে-ল্যাপটপে গেম খেলছে; দুটো হাত দ্রুত নড়ছে কি-বোর্ডে। দুজন ছেলের পেছনে দাঁড়ালেন।
দেয়াল ঘড়িটা একবার দেখে জামাল কাদরি বললেন, রাত আড়াইটা বাজে। প্রত্যেক দিন এতো রাত জেগে একই গেম খেলিস। বিরক্ত লাগে না?
ল্যাপটপের পর্দায় তাকিয়ে থেকে সায়মন বললো, লাইভ খেলছি বাবা।
লাইভ খেলছিস? ওদিকে কে?
আমেরিকার এক ফেসবুক ফ্রেন্ড।
তোর মার ঘুম হচ্ছে না মোবাইলফোনের জন্য। বারবার উঠে আসছেন। আমারও ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছে।
সায়মন চকিতে মাকে একবার দেখে ল্যাপটপে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললো, মা! তুমি বাচ্চার মতো বিহেভ করছো! মোবাইলফোন এখন চার্জে দিয়েছি। সকালে আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবো মা। তুমি এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাও মা।
নিজেদের শয্যাকক্ষে ঢুকে দরজা আটকে স্ত্রীর হাত ধরে বিছানায় মুখোমুখি বসে জামাল কাদরি বললেন, যেদিন প্রথম আমাকে দেখেছিলে, সেদিনও তুমি এমন অস্থির হয়ে উঠেছিলে। মনে আছে?
হোসনা কাদরির মুখমণ্ডল লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো। তিনি একবার স্বামীকে দেখে মাথা নত করে নিলেন।
জামাল কাদরি স্ত্রীর আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বললেন, আমিও কি কম ছিলাম নাকি! আজকেও আমার সেরকম ফিলিংস হচ্ছে।
জামাল কাদরি স্ত্রীর আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলেন। নিঃশ্বাস উভয়ের নাক-মুখে লাগছে। বেশ উষ্ণ। এবার হোসনা কাদরি স্বামীর আরো কাছে এলেন। পরস্পর পরস্পরের কাছে আসতে থাকলেন। আরো... আরো...। এরপর পৃথিবীর দ্বার বন্ধ হয়ে যায়।
একসময় হোসনা কাদরি স্বামীকে বললেন, প্রাচীনকালে ভারত উপমহাদেশে সহমরণ প্রথা ছিলো।
জামাল কাদরি বললেন, ওটা সনাতন ধর্মাবম্বীদের মধ্যে ছিলো। স্বামীর চিতায় স্ত্রীকে জ্যান্ত সহমরণে বাধ্য করা হতো।
আমার সহমরণ হতে ইচ্ছে করছে। তোমার সাথে বাঁচতে চাই, তোমার সাথেই মরতে চাই।
অমনটা ভাবাও পাপ। তবে আল্লাহর কাছে আমাদের দুজনকে যাতে একসাথে মৃত্যু দেন সে প্রার্থনা করতে পারো।
পরদিন থেকে হোসনা কাদরি আর একা রইলেন না। একই বাড়িতে চারটি প্রাণী নিজ নিজ ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে নিজ জগতে ভরাডুবি। খাওয়ার সময়টাও পাল্টে যেতে থাকলো চারজনের। ডাইনিংটেবিল হয়ে গেলো একা। জামাল কাদরি ও হোসনা কাদরি বিছানায় পাশাপাশি বসে থেকেও যেনো দুই ভিন্নজগতে বাস করছেন।
একদিন বাথরুম থেকে স্ত্রীর ‘উফ’ ধ্বনি শুনে জামাল কাদরি সজাগ হলেন। তিনি মোবাইলফোনটা বিছানায় ফেলে দ্রুত বাথরুমের দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো গো? পা পিছলে পড়ে গেলে নাকি? ক’দিন ধরে আমারও মনে হচ্ছিলো যে বাথরুমের ফ্লোরটা স্লিপারি হয়ে গেছে।
বাথরুমের ভেতর থেকে হোসনা কাদরি বললেন, তেমন কিছু না।
উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জামাল কাদরি বললেন, তবুও দরজা খোল।
হোসনা কাদরি দরজা খুললেন। তাঁর বাম হাতটা পেছনে লুকানো।
জামাল কাদরি জিজ্ঞেস করলেন, বাম হাত পেছনে লুকানো কেনো? কী হয়েছে বাম হাতে? দেখি!
হোসনা কাদরি বাম হাত সামনে আনতে না চাইলে জামাল কাদরি একরকম জোর করেই সামনে এনে হয়ে গেলেন হতবাক। ব্লেড দিয়ে হাতে একটি তিমির অবয়ব বানানো হয়েছে। রক্তে হাত সয়লাব।
জামাল কাদরি রাগ করবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। স্বাভাবিক কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলেন, হাতে এটা করেছো কেনো?
এবার হোসনা কাদরি বললেন, আমি নেটে ব্লু হোয়েল গেম খেলছি। হাত কেটে নীল তিমি আঁকা খেলার একটা স্টেজ। আজ আমি সেই স্টেজ অতিক্রম করেছি।