ঈদ আনন্দ ২০১৮

বিচিত্রিতা

সাঁওতালদের ‘বাপলা’

সালেক খোকন

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৬:৪১ পূর্বাহ্ন

সাঁওতাল বিয়েতে সিঁদুর দান পর্ব

শীতকাল তখন। দিনকয়েক প্রচণ্ড শীত। ঘন কুয়াশা ঢেকে রেখেছে দিনাজপুর শহরের চারপাশ। আমাদের গন্তব্য একবারপুর। হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকের রাস্তাটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে সেদিকে। প্রত্যন্ত এই গ্রামেই পাড়া করে বসবাস করছে সাতটি সাঁওতাল পরিবার। আশপাশের গ্রামেও বসবাস করছে সাঁওতালসহ অন্য আদিবাসীরা। তবে তাদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করছেন। কিন্তু এ গ্রামের সাত পরিবার এখনও আগলে রেখেছেন পূর্বপুরুষদের সনাতন ধর্ম বিশ্বাসকে।
এ আদিবাসী গ্রামটিতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান আজ। ফিলিপ টুডু ও রান্দন হাজদার মেয়ের বিয়ে। কনের নাম ফুল মনি টুডু। বিয়ে হচ্ছে বীরগঞ্জ দক্ষিণ সুজালপুর গ্রামের সকাল সরেন এর সঙ্গে। সাঁওতালদের সনাতন বিয়ের খবর পেয়েই আমরা পা রাখি ফিলিপ টুডুর বাড়িতে।
ফুল মনি টুডুর বিয়ের নানা আদি আচার চলে সকাল হতে রাত অবধি। খুব কাছ থেকে দেখি বিয়ের আদি রেওয়াজগুলো। সময় সময় ছবি তোলা আর বয়োবৃদ্ধ সাঁওতালদের মুখে শুনি সাঁওতাল বিয়ের আদি রীতি ও বিয়ে নিয়ে বিশ্বাসের মিথগুলো।
বিয়ে বাড়ি দূর থেকে চিহ্নিত করার সুবিধার্থে সাঁওতালরা বাড়ির ভেতর উঁচু বাঁশ গেড়ে দিয়ে বাঁশের মাথায় খেড় দিয়ে তৈরি করা বানরাকৃতি ঝুলিয়ে রাখে। এটা দেখেই গ্রামবাসী বিয়ের সংবাদটি জেনে যায়। একইভাবে বিয়ে বাড়ির সীমানার শুরুতেও বেঁধে দেয়া হওয়া বিশেষ গাছের লতা। তা দেখে সবার মতো আমরাও খুঁজে নিই সাঁওতাল বিয়ের বাড়িটিকে।
সাঁওতালরা বিয়েকে বলে ‘বাপলা’। এ আদিবাসী সমাজে মোট বারটি গোত্র রয়েছে। যেমন- হাঁসদা, মুরমু, সরেন, হেমব্রম, টুডু, বাস্কে, কিস্কু, বেদেয়া, মাণ্ডি, বেসড়া, চঁড়ে, পাঁউরিয়া। সাঁওতাল সমাজে একই গোত্রে বিয়ে নিষিদ্ধ। এছাড়া বেসড়ার সঙ্গে টুডু এবং মাণ্ডিদের সঙ্গে কিস্কুদের বিয়ে হয় না।
সাঁওতাল সমাজে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয় মেয়ের বাড়িতে। এ সময় শালপাতার বাটি ব্যবহার করা হয়। বাটিতে ফেলে রাখা হয় কয়েকটি ধাতব মুদ্রা। বিয়ের আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বাটিটি জগমাঝির কাছেই থাকে। সাঁওতাল সমাজে কনে পণ দেয়ার রীতি চালু আছে। তবে সেটি খুবই সামান্য। তবে বিয়েতে কনের মা, মাসী ও পিসিদের জন্য পাঁচ থেকে সাতটি শাড়ি প্রদান করতে হয়।
সাঁওতাল আদিবাসী বিয়ে সাধারণত তিন প্রকারের। যেমন- ‘আস্‌লি’ অথবা ‘দুয়ার ইতুত’, ‘সিঁদুর বাপলা’, ‘রাজাবাজি’ এবং ‘হুরকাটারা’ বা ‘ইতুত’। এছাড়াও ‘নিরবোলক’, ‘টুংকি’, ‘দিলিপ’ এবং ‘সেতা বাপলা’ ইত্যাদি ধরনের বিয়ের প্রচলন রয়েছে। তবে এদেশে বসবাসরত সাঁওতালদের এ বিয়েগুলো খুব কমই দেখা যায়। একসময় রাক্ষস বিয়ের প্রচলন থাকলেও এখন তা একেবারেই নেই। ‘আসলি’ বিয়ে সাধারণত সম্ভ্রান্ত সাঁওতাল পরিবার ও শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে ‘রাজাবাজি’ বিয়েই সাধারণত সাঁওতাল সমাজে বেশি হয়ে থাকে। সাঁওতাল সমাজে বাল্যবিয়ে নেই বললেই চলে।
আবার রাজাবাজি বিয়ের নিয়মানুসারে সাঁওতালরা হাট-বাজার বা মেলার দিনে মেয়ে-ছেলে উভয়েই সেখানে যায়। উদ্দেশ্য অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে সেখান থেকে তাদের নিজ নিজ প্রিয়জন খুঁজে নিবে। সাঁওতাল মেয়েরা যখন হাটে বা মেলায় আসে তখন তাদের সঙ্গে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিও থাকেন। সাঁওতালী ভাষায় তাকে ‘জগমাঝি’ বলা হয়। যদি কোনো সাঁওতাল মেয়ে মেলায় এসে কোনো যুবককে পছন্দ করে ফেলে এবং তাকে জীবনসাথী করতে চায় তবে সেটি সে অকপটে বলে জগমাঝিকে। তিনি তখন ওই যুবকটির খোঁজে বেরিয়ে পড়েন এবং তার কাছে সবকিছু খুলে বলেন। এ সময় মেয়েটির নানা গুনাগুনও তার কাছে তুলে ধরা হয়। এতে যুবকটি সায় দিলে তার অভিভাবক ও মেয়ের অভিভাবককে বিয়ের কথা জানানো হয়। অভিভাবকদের এতে কোনো আপত্তি না থাকলে নির্দিষ্ট দিনে গ্রামের প্রধানদের ডেকে বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত করা হয়।
ওই দিন বরপক্ষ কনেপক্ষকে মুড়ি কিংবা মুড়ির মোয়া উপহার দিয়ে থাকে। এছাড়া বরপক্ষ কনেপক্ষকে বিয়ের পণ হিসেবে দিতে হয় ছয় টাকা থেকে চল্লিশ-বিয়াল্লিশ টাকা। তবে ওইদিনই বিয়ে সমাধা হয় না। বরং দিনক্ষণ চিন্তা করে পরের কোনও নির্দিষ্ট দিনে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়। তারিখ ঠিক হলেই সকলের সামনে একটি দড়ি বা সুতো এনে যতদিন পর বিয়ে হবে তাতে ততটা গিঁটবাঁধা হয়। অতঃপর প্রত্যেক দিন একটা করে গিঁট খুলতে খুলতে যখন নির্দিষ্ট দিনটি আসে তখন বরের অভিভাবকরা তাকে হলুদরঙের কাপড় পরার কথা বলেন এবং বাড়িতে তখন থেকেই বিয়ের বাজনা বাজতে থাকে।
এ বিয়ের দিন বরের সঙ্গে তার মা-মাসী কিংবা পিসিও যেতে পারে। বরপক্ষ একটি ঝুড়িতে কাপড়-চোপড় ও বিয়ের অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে ঢাক-ঢোল-কাড়া-নাকাড়ার ধ্বনি দিয়ে সদলবলে কনের বাড়িতে যায়। ওই বাড়িতেই বিয়ে ও কনে বিদায় পর্ব সম্পন্ন হয়। অতঃপর বরপক্ষ মহাধুমধামের সঙ্গে কনেকে নিয়ে নিজ ঘরে ফিরে। এ ভাবে সাঁওতালদের রাজাবাজি বিয়ে শেষ হয়।
আবার সাঁওতাল সমাজে কোনও যুবক যদি কোনো যুবতীর প্রেমে মজে যায়। অথচ যুবতী তাকে মোটেই পছন্দ না করে, তবে সেক্ষেত্রে যুবক তাকে পাবার জন্য জবরদস্তির আশ্রয় নেয়। তখন যুবক আগে থেকেই হাটে বা মেলায় যায় এবং যুবতীটির খোঁজ করতে থাকে। অতঃপর তার দেখা পেলে সুযোগ বুঝে সে তার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস অবিবাহিতা মেয়ের কপালে সিঁদুর দিলেই তাকে আর অন্যত্র পাত্রস্থ করা যায় না। মেয়েটি তখন অকপটে ব্যাপারটি তার পিতামাতা ও মুরুব্বিদের কাছে খুলে বলে। তারা তখন পরবর্তী হাটের দিন একটি ভাঙা শাখা নিয়ে হাটে গিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতঃপর সকলের সহযোগিতায় মেয়ের বাবা সেই যুবককে পঞ্চায়েতের নিকট হাজির করায় এবং তার বিচার হয়। সাধারণত বিচারে যুবককে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং তা আদায় হয়ে গেলেই তার কাছে মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়। যুবকটি যদি জরিমানা দিতে অস্বীকার করে তবে সেক্ষেত্রে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়। এটিকেই সাঁওতালরা হুরকাটার বা ইতুত বিয়ে বলে থাকে।
তবে এদের ‘বিরবোলক’ বিয়ে একেবারেই অন্যরকম। কোনো সাঁওতাল যুবতী কোন যুবকের প্রেমে আত্মহারা হলে তখন সে বিচিত্র নকশা-আঁকা একটি মাটির হাঁড়িতে মদ নিয়ে ছেলের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। যুবতীকে দেখামাত্রই যুবকের মা কিংবা মাতৃস্থানীয়রা ব্যাপারটি বুঝতে পারে। তখন তারা তাকে তাড়াবার জন্য নানা ধরনের পন্থা অবলম্বন করে। যেমন-খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ মিশিয়ে দেয়া যাতে সে সংসারকে তিক্ত মনে করে চলে যায়, এক সঙ্গে অনেকগুলো শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে ধুঁয়ো দিয়ে তাকে তাড়াবার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি। কিন্তু যুবতী নাছোড়বান্দা। যতই লাঞ্ছনা হোক সে থাকে অনড়। তখন মুরুব্বিরা তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তবে এ ধরনের বিয়ে বাংলাদেশে বসবাসরত সাঁওতাল সমাজে বর্তমানে খুব কমই দেখা যায়।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করে বাল্যকালে যদি কোন ছেলে বা মেয়ের ওপরের মাড়িতে প্রথম দাঁত উঠে তবে সে দেবতার কোপানলে পড়েছে। তারা বয়োপ্রাপ্ত হলে তাদের বিয়ে অসবর্ণপদ্ধতিতে সমাধা করা হয়। দেবতার অভিশাপ থেকে রক্ষার জন্য ছেলে বা মেয়েকে প্রথমে একটি কুকুর কিংবা শেওড়াগাছ অথবা মহুয়াগাছকে বিয়ে করতে হয়। কুকুর বিয়ে করলে তা ‘শেতা বাপলা’, শেওড়াগাছ বিয়ে করলে ‘দাইবান বাপলা’, অথবা মহুয়াগাছ বিয়ে করলে তাকে ‘মাতকোম বাপলা’ বলা হয়। এসব বিয়েতে বিশেষ আনন্দ ও নাচ-গানের মাধ্যমে বর ও কনেকে কুকুর/শেওড়াগাছ/মহুয়াগাছ-এর নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। আগে থেকেই তাদেরকে নতুন সাজে সাজানো হয়। বর অথবা কনেকে প্রথমে তাদের যে কোন একটিকে বিয়ে করে অতঃপর বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরের দিন বর ও কনে স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করবার অধিকার পায়।
সাঁওতাল বিয়ের তিনদিন আগে বর বা কনের বাড়ির উঠানের চারপাশে চারটি খুঁটি পুঁতে তার উপর শাল বা আম বা নিম ডাল দিয়ে তৈরি করা হয় ছামডা। এছাড়া বিয়ের তিনদিন বা পাঁচদিন আগে কোনো কোনো জায়গায় আগের দিন বা বিয়ের দিন জগমাঝির মাধ্যমে মারোয়া সাজানো হয় বিশেষ পূজার মাধ্যমে। এ পূজায় তিনটি মুরগি লাগে। মুরগিগুলো বলি দেওয়া হয় জাহের এরার থান ও অন্য ঠাকুরের থানে যথাক্রমে জাহের এরা ও মড়েকো তুরুইকোদ এবং মারাঙবুরুর নামে।
প্রথমে জগমাঝি গ্রামের যুবকদের মারোয়ার মধ্যে একটি মহুয়া গাছের ডাল পোঁতার নির্দেশ দেন। যেখানে ডাল পোঁতা হলে তার ভেতরেই তিনটি কাঁচা হলুদ, পাঁচটি ফুটো কড়ি ও তিনটি দুর্বাঘাসের ডগ এবং বাটা হলুদের সঙ্গে তিনটি আতপ চাল মিশিয়ে এক জায়গায় বেঁধে দেয়া হয়। মহুয়া ডাল পোঁতার পর সে জায়গায়টি মাটি দিয়ে ভরাট করে গোবর দিয়ে নিকিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর আঁকা হয় রঙবেরঙের আলপনা। মারোয়ার দু’পাশে থাকে দুটো জলে ভরা কলসী। সাঁওতালদের কাছে এ কলসী মঙ্গল বা কল্যাণকর। বিয়ের যেকোন অনুষ্ঠানই মারোয়ার সামনে অনুষ্ঠিত হয়। তাই অঞ্চলভেদে মারোয়া তৈরির ভিন্নতা থাকলেও এটি তৈরি করা সাঁওতাল আদিবাসী সমাজে অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
সাঁওতালরা বিয়ের আগে ‘দা বাপলা’ বা গ্রামপূজার আয়োজন করে তাকে। একটি মাঠের মধ্যে ছোট্ট একটি চারকোণা গর্ত করে তার তিন দিকে তিনটি ধনুক দাঁড় করিয়ে সিঁদুর দিয়ে এ পূজা শেষ করতে হয়। গর্তের মধ্যে দিতে হয় ‘সিটাকা (এক টাকার কয়েন, চাউলি (চাল), হানডি (হাড়িয়া ও জল)। পূজা শেষে গর্তের কিছু পানি একটি কাঁসার ঘটিতে করে নেয়া হয় কনের সুদ্ধির জন্য স্নানের সময় ব্যবহার করা হয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস এ পানি মিশিয়ে স্নান করলে কনে অপদেবতাদের কুদৃষ্টি থেকে মুক্তি পাবে।
এ আদিবাসী বিয়ের আগের দিন বর ও কনে উভয়ের বাড়িতে ‘তেলাইদান’ নামক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘তেলাইদানের’ পূর্বে কমপক্ষে তিনজন সধবা মেয়ে পুকুর থেকে কলস ভর্তি জল এনে বরকে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করায়। একই নিয়ম মেনে কনের বাড়িতে কনেকেও স্নান করানো হয়। স্নানের জল আনারও বিশেষ নিয়ম থাকে। যেমন- বিধবা বা অবিবাহিতা মেয়েরা জল আনতে পারে না, কলসীর সামান্য অংশ খালিও রাখা যায় না, আবার জল আনার সময় পেছন থেকে ডাকা একেবারেই নিষেধ থাকে।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করে স্নানের মাধ্যমে শরীরকে পবিত্র করা হয় যাতে অপদেবতার কোনো ‘কু-দৃষ্টি’ না পড়ে। জল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করার মধ্যেও একই বিশ্বাস রয়েছে। অতঃপর বর ও কনেকে যার যার বাড়িতে নতুন কাপড়, রূপার অলঙ্কার পরানো হয়। ওইদিন থেকেই শুরু হয় নাচ-গান আর ফুর্তি।

সাঁওতালরা বিয়ের দিন একই নিয়মে বর ও কনেকে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করায়। বিয়েতে তেল হলুদ মাখানোর সময় এরা গান গায়:
সুনুম সাসাং অজঃ মড়ে দিন পাহিল খন
দং বুন এনেচ আঃ ঝামর ঝামর।
সুনুম সাসাং পে অজঃ কেদিঞ।
ভিতির বলন পে মানা কেদিঞ।
ডুলৗ পাড়ন রিঞ ফাঁসি গজুঃ

ভাবার্থ :
গায়ের তেল হলুদ পাঁচ দিন আগে থেকে
দং নাচ হবে ঝামর ঝামর করে।
তেল হলুদ মাখাল।
ভিতরে ঢুকতে মানা করলো।
দে মা এক টুকরো দড়ি।
পিঁড়িতে ঠেস দিয়ে ফাঁসি দিয়ে মরি।

স্নানের পর বর-কনের হাতে আম পাতায় বাধা একটি পোঁটলা বেঁধে দেয়া হয়। পোঁটলায় থাকে কমপক্ষে তিনটি দূর্বাঘাস, নখে খুঁটে সাতটি আতপ চাউল এবং তিন টুকরো কাঁচা হলুদ। অতঃপর বরপক্ষ কনের বাড়িতে যাত্রা শুরু করে।
এ সময় কনের বাড়িতে বর-কে নিয়ে নানারকম কৌতূহলদীপ্ত গান গাওয়া হয়। তেমনি একটি গান-
নাইন্‌ নূতুম দো বাবা বারঘরে মাছ ওয়া-এ পে
গুরিচ মন্দরে খুনতি বিদ মে,
নাইন্‌ নুতুম বারিয়াদ কো
হোর রে গে দরম কোপে
নাইন্‌ রেঁ জুরি দো নাতো রে গে।

ভাবার্থ:
বাবা, মাঠের মধ্যে সামিয়ানা টানাও,
সে সামিয়ানা যেন থাকে বাড়ির খুব কাছে,
এবং সে সামিয়ানার খুঁটি পুঁতে দিও গোবরের ঢিবিতে,
বরযাত্রী যখন আসবে তখন তাদের বাধা দিও,
বাবা, আমার হৃদয় রয়েছে তোমাদের কাছে।

সাঁওতালদের যেদিক দিয়ে বরপক্ষ কনের গ্রামে প্রবেশ করবে সে দিকে কনে বাড়ির একজন মুরব্বি আগে থেকেই জলভর্তি একটি কলস নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। বরপক্ষ আদি নিয়ম মেনে ওই কলসে একটি ছোট্ট লাঠি দিয়ে আঘাত করে গ্রামে প্রবেশের ইঙ্গিত দেয়। অতঃপর তাদের কনের বাড়ি থেকে একটু দূরে কোন গাছের নিচে বসানো হয়। এই সময় তাদের কনের বাড়িতে প্রবেশ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিধ থাকে। গাছের নিচে বরপক্ষকে কোনো কোনো সময় একদিনের বেশি সময়ও থাকতে হতো। এখানে থাকাকালীন তাদের খাওয়া-দাওয়ার যাবতীয় খরচ নিজেদেরই বহন করতে হয়।
গ্রামে বর পৌঁছানোর খবর পেয়েই কনে বাড়িতে প্রথম কনেকে স্নান করানোর ধুম পড়ে যায়। এ সময় একদল কুমারী মেয়ে আঁচলে মুড়ি বেঁধে বাজনা ও নৃত্যের তালে তালে পুকুর ঘাটে যায় এবং কলস ভর্তি জল এনে কনেকে মই পেতে গোয়াল ঘরে বসিয়ে স্নান করায়। কোনো কোনো অঞ্চলে কেবল মই-এর উপর বসিয়েই স্নান করানো হয়ে থাকে।
সন্ধ্যার দিকে বাড়ির সেই মুরব্বি এক ঘটি জল নিয়ে বর ও বরপক্ষকে বাড়ি আসার আমন্ত্রণ জানাতে রওনা হয়। এ সময় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একটি দল বাজনা নিয়ে বর বরণের অপেক্ষায় থাকে বাড়ির বাইরে। এই দলে দুটি কলস ভর্তি পানি নিয়ে দু’জন মহিলা এবং কনের মার হাতে থাকে গুড় ও মিষ্টির একটি থালা। বর এসে প্রথম কনের মা, বাবা ও মুরব্বিদের প্রণাম করে। কনের মা তখন জল নিয়ে নতুন জামাতার পা ধুইয়ে দেয় এবং কোলে বসিয়ে মুখে গুড় তুলে খাওয়ায়।
যখনই বরপক্ষ বাড়ির ভেতর দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখনই কনে পক্ষেও নাচের দল বরপক্ষের সঙ্গে আসা নাচের দলকে ভেতরে আসতে বাধা দেয়। এই বাধা চলে নাচ ও ধাঁধার মাধ্যমে। যতক্ষণ নাচ ও ধাঁধা চলতে থাকে ততক্ষণ বর গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে জল, গুড় ও মিষ্টি খেতে থাকে। বাঁধা ডিঙ্গিয়ে না আসা পর্যন্ত বরপক্ষের কেউই কনের বাড়িতে ঢোকার অধিকার পায় না।
সাঁওতাল বিয়েতে বরপক্ষ বাড়ির ভেতর পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে বরের বাবা কিছু চাল, মুড়ি ও পয়সা প্রদান করেন। এরপর কনের বড়বোন বরকে নতুন কাপড় পরানোর জন্য এগিয়ে আসে। এ সময় বরকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয়। একইভাবে কনের ভাই অপেক্ষায় থাকে বরপক্ষের কাছ থেকে কনের নতুন কাপড় নিতে। অনেক সময় বর নিজ হাতেই এ কাপড় প্রদান করে। বর নতুন কাপড় কনের ভাইয়ের হাতে তুলে দেয়ার সময় উভয়ে কিছু আতপ চাউল বদল করে পরস্পরের মুখে তুলে দেয়। কনের নতুন কাপড়ের সঙ্গে কনের মায়ের জন্য একজোড়া শাড়িও থাকে। সাঁওতালরা একে ‘মারাংবুড়ো’ শাড়ি বলে থাকে।
সিন্দুর ঘানডি বা সাঁওতাল বিয়ের কাপড় থাকে হলুদ রঙের। কাপড়ি তৈরি করা হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। বাজার থেকে কিনে আনা বার হাত সাদা কাপড় কিনে সেটিকে কাঁচা হলুদে ডুবিয়ে এবং পরে তা শুকিয়ে তৈরি করতে হয় বিয়ের কাপড়।
নতুন কাপড় দেয়ার পর কনের বাবা বরের বড় ভাই বা ভাই সম্পর্কের পাঁচজন লোককে ঘরে আসার অনুরোধ জানায়। তবে এদের প্রত্যেককেই বর থেকে বয়সে বড় হতে হয়। অতঃপর গ্রামের মাতব্বর বা মুরব্বিরা বিয়ের নতুন কাপড় পরীক্ষা করে। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে কাপড় নেড়ে চেড়ে দোষ না ধরলে সংস্কার অনুযায়ী বিয়ে শুভ হয় না। কাপড়ে দোষ পেলে বর পক্ষকে জরিমানা বা দোষযুক্ত কাপড় অনেক সময় পাল্টেও দিতে হয়।
বিয়ের কাপড় চূড়ান্ত হলে মেয়ের মা নতুন কাপড় নিজে এবং মেয়েকে পরিয়ে দেয়। এরপর মা মেয়ের পা ধুইয়ে দেয়। পা ধুইয়ে দিলেই আগে থেকে রাখা বাঁশের ঝুড়িকে মেয়ে এসে ভক্তি দেয় এবং মেয়েকে ওই ঝুড়িতে বসিয়ে দেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে বরের ওই পাঁচজন বড় ভাই এসে ঝুড়ি সমেত মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কনে পক্ষ সহজেই নিতে দেয় না। শুরু হয় ধাঁধার বাঁধা। এ বাঁধার সময় ঝুড়ি মাটিতেও পড়তে পারবে না আবার দরজার সঙ্গে স্পর্শও করানো যায় না। অন্যথায় বরপক্ষকে জরিমানা দিতে হয় যা কনে পক্ষের মেয়েরা আনন্দ করে ভাগ করে নেয়। এভাবে কনেকে ঝুড়িতে করে বিয়েস্থলে আনা হয়।
পাঁচজন বড় ভাই অথবা কনের ভাসুর যখন ঝুড়ি উঁচু করে মাড়োয়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন বরের ভগ্নিপতিরা বরকে কাঁধে নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায়। ঠিক সেই মুহূর্তে বর হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও কনিষ্ঠাঙ্গুলি একত্র করে কৌটা থেকে তিনবার সিঁদুর তুলে মাটিতে ফেলে দেয় এবং কনের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সিঁদুর-দান অনুষ্ঠান হয়ে গেলেই ধরে নিতে হয় তারা স্বামী-স্ত্রী। উপস্থিত সকলেই তখন উলুধ্বনি দিয়ে আশীর্বাদ জানায়।
এ সময়ে শুরু হয় কনের মা ও কনের মধ্যকার বিশেষ একটি আচার। মেয়ের মা সিঁদুর, তেল, হলুদ, চাউলের গুড়ো মেয়ের মুখমণ্ডল, কপাল ইত্যাদিতে মাখিয়ে দেয় এবং মেয়েও তার মাকে মাখিয়ে দেয়। তখন মেয়ের বড় বোন একটা লাঠির মাথায় পাতায় করে বেঁধে আগুন এনে মায়ের হাতে দেয়। মা সেই লাঠি একবার বাম হাতে নিয়ে ডান হাত আকাশের দিকে তুলে। একইভাবে ডান হাতে নিয়ে বাম হাত আকাশের দিকে তুলে ধরে। এভাবেই এ পর্বটি শেষ হয়। অতঃপর বড় বোন এসে জল ঢেলে ওই আগুন নিভিয়ে দেয় এবং মা-কনে ও জামাতাকে মিষ্টি ও জল খাইয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে আসে।
সাঁওতাল সমাজে কনে বিদায়ের আগে বরপক্ষের কিছু লোক এবং কনে পক্ষের কিছু লোকসহ কনের বাবা মিষ্টি ও জল নিয়ে ‘জাহের খান’ অথবা ‘বুড়াবুড়ি খান’- এ যায়। তাদের সঙ্গে থাকে গ্রাম্য মোড়লও। সবার মধ্যে তখন মিষ্টি ও জল খাবারের পালা চলে। কনেপক্ষ তখন বরপক্ষকে তাদের মেয়েকে আদর যত্নে রাখার অনুরোধ জানায়। অতঃপর উভয়পক্ষ নব দম্পতির সুখময় জীবনের জন্য ‘মারাং বুড়ো’র কাছে প্রার্থনা করে। এর পরই শুরু হয় কনে বিদায়ের অনুষ্ঠানটি।
কনে বিদায়ের সময় সাঁওতালরা অনেকগুলো গান গায়। গানগুলো:
১.     আতো গাতি কুড়ি কোড়া
মায়া জালাং ছাড়া ফিঁদেই
ইনদ ভেদ কান বোঙ্গা দেউড়ে
ঈং রেনাং মায়া জালা মিনা
    আনাং মেন খান।
কাদাম বাতে চাপা দিন পে
ত্রিয়ে ডুচিয়ে তে গেদু জিন পে
দেউড়ে চিতাং কুলি শহর নূর।
ভাবার্থ:
গ্রামের যতো যুবক যুবতী আছে
মায়ার জালে আটকা তাদের কাছে
ছিলাম আমি। এখন বোঙ্গার জালা
ছিঁড়লো মায়া, আমার যাওয়ার পালা
কদম ফুলে ইশারায় দিস্‌ ডাক
আসবো আমি, মিথ্যে নয় এ হাঁক।

২.     রাসি আতো রেন কুড়ি কানাম
রে রঁমি আতোরে পাড়া গুনা।
রঁনি আতো নালম দিশে গাঁতি
    মিআ ছাড়াও মে,
হড়ম আলম তিলে দায়াম
    এঁড়ে আ।।
ভাবার্থ:
বড়ো গাঁয়ের মেয়ে ছিলি তুই
এখন তুই ছোট গাঁয়ে গেলি।
ভুলে যা তুই বড়ো গাঁয়ের কথা
ছোট গাঁ-ই এখন আপন তোর।
সোনার তনু করিস না কো কালো
সোনার তনু বড়ো আপন তোর।

৩।    গাতে গাতে লাং তাহে কানা
অভিগাতে লাং তাহে কানা
মেৎ ঞেপেলহ আরশী মেলা
আলাং ঞেপেলহ বানু আঃ।
ভাবার্থ:
আমরা দীর্ঘদিন একত্র ছিলাম।
তোমাকে নিজের চেয়েও ভালবাসতাম,
আমাদের মুখ দেখার আয়না আছে,
হায়! তোমাকে দেখার আর কোন উপায় নেই।

৪।    বেকের বেকের য়্যামগিম জনম লি দিন,
কোনর কোনর য়্যাগমগিম হর লি দিন,
বাতি রে বাসাঁ ডাক মলি রে সুনুম
কোতু জোতুঞেতে য়্যামগিম হর লি দিন।
বম দয়ালে নায়ো বাম্যা আ লেঞে
তালা লিঞদা মিনহুন মেরোম
লেকা য়্যামগির ছুটি কি দিন।

ভাবার্থ:
তোমার জন্যেই এ পৃথিবীতে আমার আবির্ভাব,
তুমিই আমাকে কোলে-কাঁখে করে মানুষ করেছো,
তোমার কলসীতে ছিল খাবার পানি, হাঁড়িতে ছিল তেল,
তুমি সব কিছু দিয়ে আমাকে বড়ো করেছো,
মা, আজকে তোমার স্নেহ-প্রীতি কোথায় গেলো,
তুমি মাঝরাতে আমাকে বিদায় দিচ্ছো
যেমন বাথান থেকে গরু-ছাগল বিদায় দেওয়ানা হয়।

৫।    হপন হপন গিদ্‌রা কুড়ি
সিতুন লুলু দিন রে পে ইদি একানতিঞ
ই হো চান্দো বোঙ্গা!
জিপির জিপির দগ মে, পূর্ব রিমিল হো-এ মে
রে আরে লিংগ মে হো চান্দো বোঙ্গা।
ভাবার্থ:
আমার মেয়েটি খুব ছোটো,
তোমরা তাকে খর-রৌদ্রে নিয়ে যাচ্ছে;
হে ঈশ্বর, তুমি বৃষ্টি দাও, পানি দাও,
হে পুরের হাওয়া, তুমি ধীরে বও;
আমার মেয়ের যাত্রাপথ যেন শান্তি হয়।

সাঁওতাল বিয়েতে কনে নিয়ে বর গ্রামে এলে প্রতি বাড়ি বাড়ি চলে বর ও বধূকে মিষ্টি খাওয়ানোর পালা। এ সময় ধান, দূর্বা, চাউল, সিঁদুর দিয়ে নব-দম্পতিকে বরণ করা হয়। অতঃপর দু’জনকে একত্রে বসিয়ে যে ঝুড়িতে কনেকে আনা হয়েছে সেই ঝুড়ি দু’জনের ওপরে সাতবার ঘোরানো হয় এবং আগুনের তাপ দিয়ে হালকা সেঁক দেয়া হয় দু’জনের গাল ও মুখে। এভাবেই বিয়েতে বরের বাড়িতে বর-কনেকে বরণ করে নেয়া হয়।
সাঁওতাল সমাজে কনে দেখা থেকে শুরু করে বিয়ের শেষ পর্ব পর্যন্ত হাড়িয়া (প্রিয় পানীয়) ব্যবহার করতে হয়। হাড়িয়া ছাড়া এ আদিবাসীদের কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় না। কনের বাড়িতে বরপক্ষকে হাড়িয়া দিয়ে বরণ না করলে তা অপমানের সমতুল্য হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এছাড়া এদের বিয়েতে শুকর বা ছাগলের মাংস, গুড়-ভাত, আম, কলা প্রভৃতি খাবার খাওয়ানো হয়ে থাকে।
আবার বিয়ে বাড়িতে সাঁওতালরা ধামসা, মাদল, বাঁশি, বানাম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। অনেক অঞ্চলে এদের কাঁসার থালাকেও বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। বিয়েতে ছেলেরা বাদ্য বাজায় আর মেয়েরা অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে মাদলের ছন্দে ছন্দে নাচতে থাকে। একের বাহুতে এরা বেঁধে নেয় অন্যের বাহু। এরা একে দোন বা ঝিকা নৃত্য বলে।
সাঁওতালরা মনে করে সিঁদুর দান থেকেই একটি সুখী পরিবার তৈরি হয়। বাঙালি হিন্দু সমাজে সিঁদুরের ব্যবহারটি এসেছে মূলত আদিবাসী সমাজ থেকেই। হিন্দুদের শাস্ত্রীয় গ্রন্থ পুরাণ, ভবিষ্যৎ পুরাণ প্রভৃতিতে ঘট স্থাপনের কথা বলা হলেও কোথাও সিঁদুরের উল্লেখ নেই। বাংলার ভট্টভবদেব এবং পশুপতি পণ্ডিতসহ অনেকেই সিঁদুর দানের বিষয়ে পৌরাণিক কোনো শাস্ত্র খুঁজে পাননি। ফলে সর্বপ্রথম ভট্টভবদেব এবং পশুপতি ভদ্র হিন্দুসমাজে প্রচলিত প্রথানুসারে শিষ্ট সমাচারাৎ মারফত সিঁদুর দানের স্বীকৃতি দেয়। অথচ তারও বহু আগে থেকে স্বীকৃতি ছাড়াই আদিবাসী সমাজে সিঁদুর জনপ্রিয় ছিল।

সাঁওতাল সমাজে স্বামীকে দেবতা তুল্য হিসেবে মনে করা হয়। সাঁওতাল গানেই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে:
নিঞগাঁ নাপুন সারি কান্দো বড়বারী
গতেঞ তালুক তুকু-এ বরোবারিক;
জিয়ী বো গে বারিক গাতিং গে নাতাঁ
জিয়ী বোগে বারিক গোতিং তিঙগুন
নিনান জিয়ী দোরো গতেন তাই রে।
ভাবার্থ:
পিতা আর মাতা দেবতা সদৃশ;
কিন্তু স্বামীর সমকক্ষ কে আছে?
জীবনের সকল সুখ এবং দুঃখ
একমাত্র স্বামীই ভাগ করে নিতে পারে;
একমাত্র স্বামীই বিপদ রুখে দাঁড়াতে পারে।
আমার গোটা জীবন স্বামীর হাতেই নির্ভরশীল।

এরা বিশ্বাস করে জলের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই। যে অর্থে জলের অপর নাম জীবন সে অর্থে জলে রয়েছে অতিমাত্রায় জীবনসার। সাঁওতালরা মনে করে জীবনসার দিয়েই জীবনকে দীর্ঘায়ু করা যায়। এ কারণেই বিয়ের আচারে জলের ব্যবহার বেশি। বিবাহ-অনুষ্ঠানে কুলোতে ধান-দূর্বা, আতপ চাউল, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে বরণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। এরা মনে করে কুলো লক্ষ্মীর শূর্প অর্থাৎ যাতে সৌভাগ্য আসে। ধান-দূর্বা দীর্ঘায়ু ও নব-দম্পতির সুখী জীবনের চিহ্ন বহন করে। আবার আতপ চাউল, মিষ্টি ইত্যাদি অপদেবতাদের খাবার। সাঁওতাল বিয়েতে কনের আঁচলে যে ধান ও আতপ চাউল গচ্ছিত রাখা হয় তা পরে ঘরের চালে ছিটিয়ে দেয়া হয়। অপদেবতার খোরাক হিসেবেই তাদের কোপানল থেকে বাঁচতেই এমন আচার পালন করে এরা।
সাঁওতালদের বিয়েতে সিঁদুরদান উৎসবের পর বর ও কনে একত্র বসে খায় এবং একজনের মুখের খাবার মুখ থেকে বের করে আর একজনকেও খাওয়ানো হয়। এরা বিশ্বাস করে এতে দুই জনের আত্মা এক হয়ে যায়। তবে তাদের সমাজে স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসে খাওয়া সেটিই প্রথম এবং শেষ। কেননা সাঁওতাল সমাজে নারী-পুরুষ একসঙ্গে খেতে পারে না। এমনকি নারী জাতি কখনোই পুরুষের আগে খায় না। এছাড়া সিঁদুরদান উৎসবে রব ও কনে পরস্পরের কনিষ্ঠ আঙুল থেকে রক্ত বের করে সিঁদুরের সঙ্গে মিশিয়ে কিছুটা জিহ্বায় দেয় এবং বাকি অংশ কনের কপালে পরিয়ে দেয়। এদের কাছে সিঁদুর যৌন ও বিজয়ের চিহ্ন।
এছাড়া এরা বিয়ের নির্ধারিত দিনে যদি জ্বালানি কাঠ ভর্তি গাড়ি কিংবা কোনো শিয়ালকে ডানদিক থেকে বামদিক যেতে দেখে- তবে সেদিনের জন্য যাত্রা স্থগিত রাখে। আবার কোনো গাভীর মৃতদেহ দেখলেও তারা আর যাত্রা করে না। তবে কোনো লোকের মৃত্যুসংবাদ শুনলে কিংবা ভরা কলসী দেখলে এরা বিয়েযাত্রা শুভ বলে মনে করে।
নবদম্পতির দাম্পত্য জীবন সুখের এবং পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে সাঁওতালরা পালন করে এক ধরনের রীতি। বিয়ের পর কনে যখন শ্বশুরবাড়ি রওনা হয় তার আগে তাদের যেতে হয় পার্শ্ববর্তী নদী বা পুকুরে স্নান করতে। কনে যাবে আগে এবং বর তার পেছনে পেছনে। বরের হাতে থাকবে তীর ধনুক। নববধূ স্নান সেরে কলসি ভর্তি পানি নিয়ে ডাঙায় উঠে এবং বর তার কাঁধে আস্তে করে হাত রেখে তীর ছুঁড়বে সামনের দিকে। অতঃপর দু’জন হাঁটতে হাঁটতে আসে তীরের কাছে। কনে পায়ের আঙুল দিয়ে তুলে সে তীর দেয় স্বামীর হাতে। পানি ভর্তি কলস তখনও থাকে কনের মাথার উপরে। এই নিয়মের মধ্যে দুটো বিশ্বাস রয়েছে। প্রথমত; তীর ছুঁড়ে অপদেবতার চক্ষু নষ্ট করে দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত; নববধূ যে স্বামীকে হাত, পা এবং মাথার সাহায্যে আজীবন সহায়তা করবে তার প্রমাণ মাথায় কলস ভরা জল, হাত দিয়ে কলস ধরে রাখা এবং পা দিয়ে স্বামীকে তীর তুলে দেয়া।
সাঁওতাল আদিবাসী বিশ্বাসে বাল্যকালে কোনো ছেলে বা মেয়ের ওপরের মাড়িতে যদি প্রথম দাঁত ওঠে তবে তার ওপর দেবতার কুনজর থাকে। আর এই কুনজর থেকে রক্ষা পেতে তাকে প্রথমে কুকুর বা শেওড়া গাছ বা মহুয়া গাছের সঙ্গে বিয়ে দিতে হয়। এ ধরনের বিয়েকে সাঁওতালি ভাষায় যথাক্রমে শেতা বাপলা, দাইবান বাপলা, মাতকোম বাপলা বলে। তবে বর্তমানে এ ধরনের বিয়ের প্রচলন নেই বললেই চলে।
সাঁওতালদের বিয়েতে নবদম্পতির ভবিষ্যৎ জীবন কিরূপ হবে- সে পরীক্ষা রীতিও চালু আছে এ আদিবাসী সমাজে। বিয়ের পরের দিন বাড়ির আঙিনায় ছোট একটি পুকুর কাটা হয়। অতঃপর তাতে জলভর্তি করে বর ও কনেকে সে পুকুরে পয়সা লুকোচুরি খেলায় নামতে হয়। প্রথমে বর একটি পয়সা লুকিয়ে রাখে এবং স্ত্রী তা বের করে। পরে স্ত্রী তা লুকিয়ে রাখে এবং বর বের করে। যদি উভয়ই সফল হয় তবে তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ জীবনে দ্বন্দকলহের সম্ভাবনা থাকে না বলে ভেবে নেয়া হয়।
এদের সমাজে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ব্যক্তিগত কারণে বিবাদ তৈরি হলে তালাক প্রথা চালু রয়েছে। স্ত্রীকে স্বামী তালাক দিতে চাইলে তাকে কুড়ি টাকা জরিমানা প্রদানসহ বিশেষ আচারের মাধ্যমে তালাক দিতে হয়। পাঁচজন গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে স্বামী-স্ত্রী উপস্থিত হয়ে স্বামী তালাক ঘোষণা করেন এবং শালপাতা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে একটি পানিভর্তি কলসি উপুড় করে ফেলে দেন। শালপাতা ছিঁড়ে ও পানি ফেলে দিয়ে মূলত প্রতীকী অর্থে সম্পর্কচ্যুতি ঘটেছে বলে সাঁওতালরা ভেবে নেয়।
একইভাবে যদি স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করতে চায় তবে গোত্র প্রধান ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তির সম্মুখে তাকে পণের সমস্ত টাকা ফেরত দিয়ে একই রীতিতে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটানো হয়। য
দি স্বামী জরিমানার টাকা কিংবা স্ত্রী পণের টাকা পরিশোধ করতে না পারে সেক্ষেত্রে কারও তালাকই সম্পন্ন হয় না।
সাঁওতাল আদিবাসী সমাজে বিধবা নারী ও তালাকপ্রাপ্তাদের দ্বিতীয়বার বিয়ের ব্যবস্থা প্রচলন রয়েছে। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীকে ছোট ভাই বিয়ে করতে পারে। আবার অবিবাহিত যুবক যদি বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্তা নারীকে বিয়ে করতে চায় তবে তাকে প্রথমে একটি ফুলকে বিয়ে করতে হয়। অতঃপর সে ফুলটি সিঁদুররাঙা করে মহিলাকে দিতে হয়। এভাবেই তারা স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করতে পারে।
বিয়ের ঘটক নিয়ে সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত একটি কাহিনী। বিয়ের ঘটককে কেন বাঘে খায় না? এ নিয়ে সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত একটি কাহিনী শুনি রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার ছাতনি পাড়ায় বসবাসরত সাঁওতালদের মুখে।
কাহিনীটির ভাবার্থ: ‘বিয়ের ঘটক থাকে দুজন। একজন কনেপক্ষের, অন্যজন বরপক্ষের। একবার এক বিয়ের প্রস্তাবে কনের বাড়ি ছিল ধাড় দেশে। আর বরের শিলদাতে। বড় একটি জঙ্গলের পাশেই একত্রে এসে মিশেছে ধাড় দেশের নদী ও শিলদার নদীটি। কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র পথটি ছিল সে জঙ্গলের ভিতর দিয়েই। সে জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব হতো প্রায়ই। জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেছে আরেকটি ছোট্ট নদী।
একবার কনেপক্ষের ঘটক, বরের বাড়িতে যাচ্ছিল সে নদীর ধার দিয়ে। দূর থেকে ঘটককে যেতে দেখেই একটি বাঘিনী হুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়লো তার সামনে। হঠাৎ বাঘিনীকে দেখে ঘটকের প্রাণ যায় যায়। বাঘিনী প্রথমে ঘটককে দুই থাবার মধ্যে নিয়ে খেলা করতে লাগলো। এটাই বাঘদের নিয়ম। শিকারকে সঙ্গে সঙ্গে খায় না তারা।
সে সময় বাঘিনী ঘটককে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওহে, তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?’
বাঘিনীর কথায় ঘটক একটু সাহস পেলো। সে ভয়ে ভয়ে বললো, ‘মহারানী, আমি ধর্মের কাজে যাচ্ছিলাম, আমাকে তুমি মেরো না।’
ঘটকের উত্তরে বাঘিনীর বেশ কৌতূহল হল। সে বলল, ‘কেমন, ধর্মের কাজ হে?’
ঘটক বলল, ‘আমি দুটি পরিবারকে একত্রিত করি। দুজন আলাদা লোককে একজনে পরিণত করি।’
বাঘিনী বলে, ‘কেমন করে?’
ঘটক উত্তরে বলে, ‘যার বউ নেই তাকে বউ জোগাড় করে দিই আর যার স্বামী নেই তার জন্য স্বামী জোগাড় করে দিই।’
ঘটকের উত্তর শুনে বাঘিনীর নিজের কথা মনে হয়। সে বলে, ‘যদি তাই হয়, আমার জন্যও স্বামী জোগাড় করে দাও।’
সে দুঃখ করে বলে, ‘বারোবছর আগে আমার স্বামীকে দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলেছে। সে থেকেই আমি একা।’
সুযোগ বুঝে ঘটক বাঘিনীর কথায় রাজি হলো। সে বলল, ‘তাহলে তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিতে হবে, মহারানী।’ ঘটককে বিশ্বাস করে বাঘিনী তাকে ছেড়ে দিলো।
ছাড়া পেয়ে ঘটকমশাই গেল সেই গ্রামে। অনেক খুঁজে গ্রামের ভেতর পেল একটা দোকান। দোকান থেকে সে দুটো নতুন বস্তা কিনে নিলো। তা সেলাই করার জন্য কিনলো একটি সুচ ও সুতলি দড়িও। ওই গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়িতে থাকতো দুজন  বুড়ো ও বুড়ি। গ্রামের যে কোনো বিয়েতে তারাই হলুদ ও পাতা বাছাই করে দিতো।
ঘটক তাদের বাড়িতে গিয়ে খুশি মনে বলল, ‘যাও, একটু হলুদ বেটে এবং পাতা বেছে পরগাছার সরু কাঠি দিয়ে শালপাতার চার কোণের খালা তৈরি কর। সেই খালায় দিয়ে দাও বাটা হলুদ ও তেলটুকু।’ বুড়ো-বুড়ি তাই করলো।
ঘটক এবার নতুন বস্তা, সুচ, শনের দড়ি ও তেল-হলুদ নিয়ে ফিরে গেল বাঘিনীর কাছে।
বাঘিনীকে সে বলল, ‘মহারানী, তোমার জন্য পাত্রের সন্ধান পেয়েছি।’
শুনে বাঘিনী তো মহাখুশি।
ঘটক বলল, ‘যদি আমাকে বিশ্বাস কর এবং বিয়ে করতে চাও তবে তুমি এই বস্তার ভিতর ঢুকে পড়ো।’
বিয়ের আনন্দে বাঘিনী ঘটকের কথা মতো বস্তার ভেতর প্রবেশ করলো। ঘটক তখন সেই তেল-হলুদের খালাটি বাঘিনীর হাতে দিয়ে ভালো করে ধরে থাকতে বলল। সরল বিশ্বাসে বাঘিনী তাই করলো।
ঘটক এবার সেই শনের দড়ি দিয়ে ঐ বস্তাটিকে ভালো করে সেলাই করলো। অতঃপর বাঘিনীকে বলল, ‘মহারানী, নড়াচড়া করো না। তোমাকে এই নদীর জলে নামিয়ে দিচ্ছি। এই জলের নিচেই তোমার স্বামী তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে যখন তোমাকে নদীর জল থেকে তুলে নেবে তুমি তখন হাতে থাকা তেল-হলুদ তার মুখে মাখিয়ে দিও।’ এ কথা বলেই ঘটক বস্তাটিকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিলো।
সে দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ফলে নদীতে বান দেখা দিয়েছিল। অন্য একটি গ্রামে ছিল একটি বাঘ। তার স্ত্রীকেও মানুষেরা মেরে ফেলেছে বারো বছর আগে। সেই বাঘটি প্রতিদিন বান দেখতে নদীর ধারে এসে বসে থাকতো। মাঝে মাঝে বানের জলে গরু, ছাগল, মহিষ ভেসে আসলেই নদী থেকে সে তা তুলে এনে খেতো। সেদিনও সে নদীর ধারে বসেছিল। একটি বস্তা ভেসে আসতে দেখেই সে জলে নেমে সেটাকে উপরে তুলে আনলো। দাঁত দিয়ে বস্তাটি ছিঁড়তে যাবে অমনি বস্তার ভিতর থেকে বাঘিনীর  গর্জন।
বাঘ তাড়াতাড়ি বস্তাটি ছিঁড়ে ফেললো। ঠিক তখনই বাঘিনী মনের আনন্দে আস্তে আস্তে বস্তা থেকে বেরিয়ে এলো। সে হাতের তেল-হলুদ বাটা ভালো করে মাখিয়ে দিলো ওই পুরুষ বাঘটির মুখে এবং তাকে চুমু খেতে থাকলো। অতঃপর তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সুখে- শান্তিতে কাটতে থাকলো বাঘ-বাঘিনীর জীবন।
বারো বছর যাবৎ পুরুষ বাঘটি একাকী ছিল। আর স্ত্রী বাঘটিও স্বামী হারিয়ে ছিল একাকী। ঘটক লোকটিই তাদের বিয়ে করিয়ে দিলো। তাই বাঘেরা ঘটকদের উপর খুব খুশি। এরপর থেকে ঘটকালীর কাজ করতে যাবার সময় রাস্তায় বা জঙ্গলে রাত-বিরাতে আসা যাওয়ার সময় বাঘরা কখনো ঘটকদের ধরতো না।’
সাঁওতাল আদিবাসীদের অধিকাংশই এখন খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলে ধর্মান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিয়ে কেন্দ্রিক উৎসবের আচার ও বিশ্বাসগুলো আজ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ধর্মান্তরিত সাঁওতালদের কাছে সাঁওতাল বিয়ের আদি রীতিগুলো আজ কুসংস্কার মাত্র। কিন্তু আদি ধর্ম আঁকড়ে থাকা সাঁওতালদের কাছে তাদের বিয়ের আদি রূপটিই তাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status