ঈদ আনন্দ ২০১৮

স্মৃতিকথা

স্মৃতিগদ্যে দুই বন্ধু

আমীরুল ইসলাম

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৬:২৪ পূর্বাহ্ন

আহমাদ মাযহার ও আসলাম সানীর সঙ্গে আমীরুল ইসলাম

আহমাদ মাযহার ও আসলাম সানী। আমার সাহিত্যজীবনে বন্ধু ও ভাই হিসেবে পাওয়া সেরা দুই ব্যক্তিত্ব। তাদের দুজনের সঙ্গে চলাফেরা, আড্ডা আর সাহিত্য সাধনার কিছু স্মৃতি কিছু ভালো লাগা আজ আমি এখানে আনপাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চাই...

প্রাণের সখা আহমাদ মাযহার
সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে আহমাদ মাযহারকে নিয়ে কিছু লেখা। কিছুতেই এই লেখাটা গুছিয়ে তোলা যায়নি। ’৭৯ সাল থেকে বন্ধুত্ব। একদিনের জন্যও ছেদ পড়েনি। প্রায় চল্লিশ বছর। মাযহারই আমার একমাত্র সাহিত্যিক বন্ধু। পারিবারিক বন্ধু।
আমার সাহিত্য বিষয়ের ভাবনা চিন্তা ও আমার নিরীক্ষাধর্মী লেখার উৎসাহী পাঠক হচ্ছে মাযহার। আমার ক্ষ্যাপাটে ও উদ্ভট আচরণ সবচেয়ে বেশি সহ্য করেছে মাযহার। আমার নানা কীর্তি কাহিনির বিভিন্ন স্থানে মাযহার বহুবার অপদস্থ হয়েছে। হজম করেছে সেসব। লোকে আমাকে না পেয়ে আমার গালাগাল মাযহারকে শুনিয়েছে। মাযহার তার অপরিসীম ধৈর্য শক্তির পরিচয় দিয়ে গালি শুনেছে। আমার বহু অক্ষমতার দায় মাযহার পালন করেছে। অনেক বই আমি আর মাযহার ভাগাভাগি করে পড়েছি।
মাযহার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ করেছে। মাযহার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রথম দিককার পাঠাগার স্থাপন করেছে। মাযহার সামান্য বেতনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে চাকরি করেছে। চাকরি নয়, সায়ীদ স্যারের সাহচার্যের জন্যে লেগে থেকেছে। সায়ীদ স্যারের চরম দীক্ষাগুরু মাযহার। মাযহার সাহিত্যের রস আস্বাদন করেছে সায়ীদ স্যারের হাত ধরে। ক্লাসে ছন্দ শিখেছে সায়ীদ স্যারের কাছে। আমরাও সায়ীদ স্যারের সান্নিধ্যে সহজেই পৌঁছেছি মাযহারের কারণে।
মাযহারের শুরু হলো শিশুসাহিত্যের হাতেখড়ি দিয়ে। কিশোর বাংলায় মাযহার অনেক লিখতো। পরে বাংলা অনার্স পড়া শুরু করেও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনেক পাঠকচক্রে অংশ নিয়ে ভারি ভারি প্রবন্ধ লেখা শুরু। মাযহারের চিন্তার জগৎ পরিবর্তিত হতে লাগলো। যেকোনো বিষয়কে সাহিত্য ও দর্শনের আলোকে বিচার করার সহজাত ক্ষমতা তার তৈরি হলো। তবে, আনন্দের কথা শিশুসাহিত্যের সংশ্রব মাযহার ত্যাগ করেনি। শিশুসাহিত্য বিষয়ে দুই বাংলায় মাযহারই সবচেয়ে বেশি প্রবন্ধ লিখেছে। এর মূল্য মাযহারের অবশ্যই প্রাপ্য। ওপার বাংলাতেও প্রাবন্ধিক হিসেবে মাযহার ব্যাপক প্রশংসিত।
মাযহার দুর্দান্ত নিষ্ঠাবান। একটা কাজ শুরু করলে সে কঠিন কামড় দিয়ে কাজটা শেষ করবে।
মাযহারের বন্ধু ও সহধর্মিণী শিরীন বকুল। নিজেও লেখক এবং বিখ্যাত নাট্যশিল্পী। বকুলকে নিয়ে আলাদা লিখতে হবে। তবে, প্রসঙ্গক্রমে বলি- বকুল মাযহারের ছায়াসঙ্গী। মাযহারকে আগলে রেখে সংসার যাত্রার দীর্ঘপথ সে পাড়ি দিয়েছে। তাদের একমাত্র সন্তান সুদীপ্ত প্রিয়দর্শন। আমি, অমি, আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য। দেশ বিদেশে কত ঘুরেছি! প্রিয় বলে থাকেন- তার সবচেয়ে প্রিয় মামা হচ্ছে আমীরুল ইসলাম। প্রিয় এখন আমেরিকাতে লেখাপড়া করে। বছরে একবার আমেরিকা যাই। অমির সাথে প্রিয় তখন আমরা নিত্যসঙ্গী। বকুলও বাংলায় দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছে। বাংলা ভাষা-সাহিত্যে এমএ। বকুল খুব মেধাবি। রুচিবান ও উন্নত সাংস্কৃতিক বলয় থেকে ওর আগমন। বকুলের কাছ থেকেও আমরা অনেক সমৃদ্ধ হয়েছি। অনেক শিখেছি।
যাহোক মাযহারের কথা লিখছিলাম। মাযহার সাহিত্যের পেছনে নিরন্তর শ্রম দিয়ে আজ উচ্চ আসনে পৌঁছে গেছে। বাংলা সাহিত্যের গত একশো বছরের যে তথ্য উপাত্ত মাযহারের কাছে সুসংরক্ষিত। শুধু বই নয়- বিগত শতাব্দীর পত্রিকাসমূহ সম্পর্কেও মাযহারের ব্যাপক আগ্রহ। ঢাকা, কলকাতা ঘুরে ঘুরে, লাইব্রেরি বা কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ ব্যবহার করে ব্যাপক সমৃদ্ধ হয়েছে।
মাযহারের আগ্রহ শিশুসাহিত্য ও বাংলা ভাষায় লিখিত যেকোনো প্রবন্ধ বা প্রাবন্ধিক। নিরন্তর অধ্যয়ন মাযহারকে রবীন্দ্র বা নজরুল বিশ্লেষকেও রূপান্তর করেছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে কামরুদ্দীন আহমদ কিংবা আবদুল হক সম্পাদিত। মাযহারের সুচারু গবেষণা সকল মহলেই আলোচিত।
প্রাবন্ধিক মাযহারকে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও রচনা নিয়ে কাজ করা উচিত। সময় ও সুযোগ পেলে সেটা হবে।
তবে, আহমাদ মাযহারের অন্য বিষয় নিয়ে কিছু বলি। মাযহার খেতে খুব ভালোবাসে। আমার রান্না মাযহারের খুব প্রিয়। আমার সবচেয়ে বাজে রান্নাও মাযহারের প্রশংসায় উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে। মাযহার সবকিছুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। কারো কোনো ক্ষতি মাযহার কখনো করেনি। পরগাছার মতো আচরণও নেই তার। মাযহার কূটচাল স্বভাবের নয়। কারও বিরুদ্ধে সে কখনো উচ্চকণ্ঠ নয়। অসাধারণ ব্যক্তিক ক্ষমতা আছে মাযহারের। মিথ্যা অপবাদ দেয় না কাউকে। আর মানবিকতায় হৃদয় পূর্ণ তার। টাকার পেছনে কখনো সে দৌড়ায়নি। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য নিজেকে বিক্রি করেনি।
মাযহার অনেক উন্নত
রুচি মনের মানুষ। অসম্ভব সৎ। তাই খুব দৃঢ়। তার প্রতিবাদের ভাষাও তীব্র। তার ভালোবাসার ক্ষমতাও তীব্র। আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি মতামত ব্যক্ত করেছি মাযহারের কাছে। সাহিত্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা বলেছি মাযহারের সাথে। সবচেয়ে বেশি তর্ক-কুতর্ক করেছি মাযহারের সাথে।
আমাদের ঘনিষ্ঠজনেরা বহুবার সাক্ষী থেকেছেন মাযহার আর আমার ঝগড়ায়। আমি উচ্চকণ্ঠে ঝগড়া করি। মাযহার নিচুকণ্ঠে। বকুল হয়তো স্বামীর পক্ষ না নিয়ে বন্ধুর পক্ষ নিয়ে নিলো। তুষের আগুন জ্বলে উঠলো তর্কে-বিতর্কে। পানাহারের সময় এই তর্ক বিতর্ক বেশি হয়। মাযহার এবং আমি- সামান্য পরিমাণ সোমরস গলাধঃকরণ করি। খুব ভালোবাসি সোনালি তরল। একটু নিয়মিত খেতাম। আমার মদ্যপানের সবচেয়ে দীর্ঘতম সঙ্গী মাযহার। মদ খাওয়ার পর নেশা চড়ে উঠলে কত যে ঝগড়া হয়েছে। আমাদের এই ঝগড়া দেখতে দেখতেই বড় হয়েছে অমি আর প্রিয়। ওদের মুখে থাকে লজ্জার হাসি।
ভ্রমণেও আমরা কূটতর্কে পারঙ্গম। মনে পড়ে গোয়াতে অমির বকা খেয়ে ঝগড়া থামালাম। দার্জিলিঙে প্রিয় বকা দিলো। অমি-প্রিয় বড় হয়েছে। আমরা একসাথেই মদ্যপান করি। এসব নিয়ে মাযহার-আমার কোনো সংস্কার নেই। চয়ন ইসলাম ও লিলি ইসলামও সংস্কারের বাইরে। চয়নদা’র বাসায় কত পার্টি হয়েছে আমি রান্না করি। হুইস্কি পান চলতে থাকে। আমাদের পরবর্তী জেনারেশন অমি, প্রিয়, ঋষভ আমরা একসাথে হইচই করি। পার্টি করি। খাইদাই। অবসরে ঘুরে বেড়াই।
আমাদের জীবনটার পেছন পানে তাকালে আনন্দে মন ভরে ওঠে। আমরা যা চেয়েছি তা পেয়েছি। মাযহারেরও কোনো আক্ষেপ নেই। এখন সে নিউইয়র্কবাসী। মিউজিয়াম আর লাইব্রেরি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই তো চেয়েছিলাম মাযহার। দেশে বিদেশে যেখানে থাকুক না কেন- বই পড়তে চেয়েছে মাযহার।
ঢাকায় যখনই থাকে সব ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। গানের অনুষ্ঠান, মঞ্চ নাটক, নৃত্যানুষ্ঠান, আলোচনা অনুষ্ঠান, বই প্রকাশনা, সাহিত্য সভা- সুযোগ পেলেই মাযহার ছুটে চলে যাবে। পুরো অনুষ্ঠান মাযহার উপভোগ করবে।
মাযহার অসম্ভব ধৈর্যশীল। ধীরস্থির মাযহারের এই মানবিক ও ধৈর্যশীলতাকে আমি শ্রদ্ধা করি। মাযহারের নিষ্ঠার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। আমাদের সময়কালে মাযহারের মতো অকুণ্ঠ নিষ্ঠার সাথে কেউ কাজ করেনি। মাযহারের প্রবন্ধ মৌলিক প্রতীম। আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো অসাধারণ প্রতিভাও এখন মাযহারের কল্যাণে জীবন্ত হয়ে আছে।
মাযহার যা বিশ্বাস করে তা অকপটে বলে। দ্বিধাহীনভাবে বলে দেয়। মাযহারকে প্ররোচিত করে কিছু লুকানো যায় না। হৃদয় থেকে মাযহার লিখে থাকে। তাই অনুরোধ-উপরোধ তাকে প্রভাবিত করে না।
অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত জীবনের জন্য যা প্রয়োজন মাযহার সবই অর্জন করেছে। আমরা অতি দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছি। সংস্কার, গ্লানি, আত্মসম্মানবোধ সব কষ্ট করে অর্জন করেছি। মাযহারেরও পারিবারিক জীবন শৈশব-কৈশোরে আমাদের মতোই ছিল। তাই আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে সময় লাগেনি। আমরা দারিদ্র্যের সমস্ত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেছি। এ আমাদের জীবনের বড় অর্জন। এসব অমি বা প্রিয় বুঝবে না। কারণ ওরা স্বচ্ছলতার মধ্যে বেড়ে উঠেছে।
কোনো বিষয়ে জয়ী হতে চাইনি আমরা। আমরা আনন্দের মধ্যে দিন কাটাতে চেয়েছি। দুঃশ্চিন্তাহীন জীবন। বন্ধুবান্ধবদের সাথে হইচই হাসি আনন্দ গানে আমরা বুড়ো হয়ে গেলাম।
ঢাকায় থাকার সময় আমাদের প্রতিদিন দেখা হতো। সুদূর নিউইয়র্কে প্রতিদিন কোনো এক বেলা মাযহারের সাথে কথা হয়। ভাবের আদান প্রদান হয়।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে আমি মাযহার দুজনেই পিতার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা করি। ভালোবাসি। একদা হাতিরপুলে মাযহারের বাসায় কত আড্ডাই না আমরা দিয়েছি। ইদানিং আমার মোহাম্মদপুরের ফ্ল্যাটে। আড্ডায় নিত্যসঙ্গী সায়ীদ স্যার, লুৎফর রহমান রিটন, আসলাম সানী, আহমাদ মাযহার, আমি। সে সব আড্ডায় মধ্যরাত পর্যন্ত চলেছে। খাওয়া দাওয়া তর্ক আর পানাহার।
চয়নদার বাসাতেও আরেক রকম আড্ডা। গান। পান।
এখন যেন এসব স্মৃতি হয়ে গেছে! আবার সবাই কি এক হতে পারব? প্রাণের সখা আয় আয়। মিলনের ছন্দে আনন্দে আবার কি বাঁশি বাজবে?
সাহিত্য নিয়ে মাযহারের অনেক স্বপ্ন। বিশেষ করে বই ও বই সংক্রান্ত বিষয়ে ওর খুব আগ্রহ। বুক রিভিউ নিয়ে ‘বইয়ের জগৎ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনও দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছে। আশ্চর্য রকমের ক্রিয়েটিভ পত্রিকা ছিল সেটা। ছোটদের জন্য একটা লিটল ম্যাগাজিনের আমৃত্যু স্বপ্ন মাযহারের।
মাযহার এখন উন্নত বিশ্বে উন্নত সংস্কৃতি চেতনায় উন্নত স্বপ্ন দেখছে!
এবারও বইমেলায় মাযহার এক মাসের জন্য এলো। বইমেলা সরাসরি উপস্থাপনা করলো। কিছু আড্ডা, কিছু কথকতা- সময় যেন উড়ে চলে গেল।
মাযহার ক্রিকেট পাগল। মাযহার বিশ্ব ফুটবল দেখার পোকা। মাযহার ব্রাজিলের ঘোরতর সাপোর্টার। মাযহার রবীন্দ্র সংগীত ভালোবাসে। মাযহার চিত্রকলার সমজদার। ইম্প্রেশনিস্ট পেইন্টাররা মাযহারের খুব প্রিয়। সমা ও টেট গ্যালারিতে সে সব প্রত্যক্ষ করেছে মাযহার।
মাযহারের সুস্থতা কামনা করি সবসময়। কারণ মাযহারই আমাদের বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে। আমাদের নিয়ে মাযহার প্রবন্ধ লিখবে। সেই প্রবন্ধের মধ্যে যৎকিঞ্চিৎ সাহিত্য সাধনা যদি মূল্য পায় সেও কম কি!

সানী ভাই : একক ও অদ্বিতীয়
সানী ভাইকে নিয়ে কি লিখব। একহাজার পৃষ্ঠা লিখলেও লেখা শেষ হবে না। এক পাতা লিখলে হয়তো সমাপ্ত হয়ে যাবে সানী ভাইয়ের কীর্তিকাহিনি।
সানী ভাইয়ের বহু পরিচয়। তিনি কবি। তিনি রাজনীতিবিদ। তিনি সাংস্কৃতিক কর্মী। তিনি ছড়াকার। তিনি ঢাকাইয়া সমাজের প্রতিনিধি। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত। তিনি বঙ্গবন্ধু-সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিষয়ে আপোষহীন।
এ রকম অনেক পরিচয়ে তাকে মহিমান্বিত করা যায়। তিনি সকলের প্রিয় সদাহাস্য সদারসিক কবি আসলাম সানী। সানী ভাইয়ের মুখে সবসময় রঙিন হাসি। সবাইকে প্রাণখুলে হাসাচ্ছেন। মন খুলে কথা বলছেন।
যেন উচ্ছ্বসিত ঝর্ণাধারা। যেখানে সানী ভাই সেখানেই আনন্দের উৎস। তার সামনে কেউ গোমড়ামুখো থাকতে পারবে না। হাসতে হবেই তাকে। শ্লীল-অশ্লীল, ছোট বড় কোনো ভেদাভেদ নেই। ছেলেমেয়েদের সামনে শ্রাব্য-অশ্রাব্য বাণী ছুড়ে দিচ্ছেন অসঙ্কোচে। গালি তার মুখে মধুর হয়ে ওঠে। চুদির ভাই, চোদনা- এসব তার মুখে সহজাত বুলি। নাতি-নাতনির সঙ্গেও তার একই রকম ব্যবহার। গালি দিয়ে তাদের সম্বোধন করবেন। আর সবসময় রসিকতা করবেন।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সানী ভাই আমার বড় ভাই। কবে কখন প্রথম দেখা সে সব মনে নাই। তবে আমরা ছোট হলেও তিনি আমাদের সঙ্গে কোনোদিন ছোটোর মতো আচরণ করেননি। সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন। সানী ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকা শহরের এ মাথা ও মাথা ঘুরে বেড়িয়েছি দিনের পর দিন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। উদ্দেশ্যহীন অকারণ। সেই সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন কথাসাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন, ঢাকা বিশেষজ্ঞ আনিস আহামেদ, চলচ্চিত্রকার জাহিদ হোসেন মনজু, আমি- আমরা সবাই লালবাগ, আমলিগোলা পট্টি। একসাথে শৈশব-কৈশোর পার করেছি। সানী ভাইয়ের সঙ্গে এখনও আমার নিয়মিত সম্পর্ক রক্ষিত আছে। যোগাযোগ আছে।
সানী ভাই আমার অভিভাবক, আমার পিতৃতুল্য। আমার সুখ দুঃখের একান্ত সহচর। আমার সামান্য লোক হয়ে ওঠার পেছনে সানী ভাইয়ের প্রত্যক্ষ অবদান আছে। আমাকে সকল বাঁধা বিঘ্ন থেকে তিনি পিতার মতো রক্ষা করে থাকেন। আমার বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার উৎসাহদাতা সানী ভাই।
১৯৭৯ সাল। ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগ থেকে সংসদ নির্বাচন করেছিলাম। বাসা থেকে নিষেধ ছিল। শুধু সানী ভাইয়ের আগ্রহেই নির্বাচন করি এবং কামরুল-হাবিব পরিষদ থেকে বৈতরণী পার হই। ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনেও সাহিত্য সম্পাদক পদপ্রার্থী হতে পারি সানী ভাইয়ের কল্যাণেই। পরাজিত হই তৎকালীন পরিবেশে। আমাদের আরেক সহযাত্রী ড. শাহাদৎ হোসেন নিপু। শেখ সাহেববাজার বাসী।
জীবনটা কত দ্রুতই না আমাদের ফুরিয়ে গেল। এই লেখা লিখতে গিয়ে কত স্মৃতিই না মনে পড়ছে। সানী ভাই ঘরে যেমন বাইরেও তেমন। ভাবির সঙ্গে সবসময় ঠাট্টা-মশকরা করছেন। দুষ্টুমি করছেন।
মনে পড়ে ভাবি বললেন,
যাও সানী- বাজার করো
সানী ভাই হাসতে হাসতে বললো
চলো তো টুলু- চলো, জলদি যাই। এগো লগে থাকলে আর লেখক হইতে পারুম না। যা দিন সব হান্দাইয়া ফালাইবো। এগো খিদা শেষ হইব না।
ভাবিও হাসছেন। সানী ভাইয়ের এই রসিক চরিত্র তারচেয়ে বেশি কে জানে! ভাবি পুরনো ঢাকার বনেদী পরিবারের সন্তান। তাদের বিশাল আত্মীয়-গোষ্ঠী। সানী ভাইয়ের সকল অত্যাচার তিনি সমগ্র জীবন ধরে হাসিমুখে সহ্য করে গেলেন। কোনোদিন প্রতিবাদ করেননি। সংসারের হাল ধরে সানী ভাইয়ের লেখালেখি করার জন্য সহায়তা করেছেন। তিন মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। মানুষ করেছেন। রুম্পা, শম্পা, ঝুম্পা। বড় দুজনের বিয়ে হয়েছে। ঝুম্পা এখন সানী ভাইয়ের সকল কাজের সহকারী। ছোট্ট একটা স্কুটি আছে ঝুম্পার। বাবাকে একটানে কোথাও নামিয়ে দিয়ে আসছে। আবার বাসা ফেরার সময় সানী ভাইকে স্কুটির পেছনে বসিয়ে ঝুম্পা ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছে।
অসম্ভব জীবনরসিক মানুষ আসলাম সানী। তার খাই খাই স্বভাব নাই। বেশি উচ্চাশা করেন না। পৈতৃক সম্পত্তি পেয়েছেন। সুখের সংসার। টাকার জন্য সানী ভাই কোনোদিন কাজ করেননি। ভালোবাসার টানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছেন। টিএসসি, শাহবাগ, পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি- এসব স্থানেই নানা কাজে কর্মে সানী ভাইকে পাওয়া যাবে। সবার প্রিয় মানুষ। সবার হৃদয়েও তার ভালোবাসার আসন।
কেউ কখনো সানী ভাইকে কোনো কাজ না করেন না। সানী ভাই অন্যের জন্যও সারাক্ষণ ছুটে বেড়াচ্ছেন।
খুব পরোপকারী ও সমাজসেবক ধরনের ব্যক্তি তিনি। কোনো রোগী মানুষ যদি সানী ভাই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তবে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হবেই। প্রয়োজনে কারো চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন। কারো চাকরি প্রয়োজন, কেউ জমি কিনতে চায়, কারো বিদেশ যাত্রা, কারো সন্তানের বিয়ে- সবার প্রতি সানী ভাইয়ের উদার দুই হস্ত প্রসারিত। এক আশ্চর্য মানুষ তিনি।
দুই
জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি গালি খেয়েছি সানী ভাইয়ের কাছে। আমাকে খুঁজে না পেলেই আমি ফোন ধরতে না পারলে কোনো নির্ধারিত অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত না হলেই শুরু হবে সানী ভাইয়ের গালিবর্ষণ।
আমীরুল হালায় মানুষের বাচ্চা না। অর কথা আর কইবা না আমারে। চোদনা ধান্দাবাজ হইয়া গেছে। কথা দিয়া কথা রাখব না। চর্বি জইমা গেছে।
আমীরুল- হালার লগে আর কথা নাই। অর ফোন আর ধরুম না।
দু’একদিন হয়তো এই গোস্বা থাকবে। তারপর আবার সানী ভাই সহজ ও স্বাভাবিক। আবার আমাদের কার্যক্রম চলতে থাকবে।
আর গালি গালাজ তো লিখিত হবে না। সানী ভাইয়ের গালির ধ্বনি ঝংকার শুনতেই ভালো লাগবে। সেসব কাগজে লেখা সম্ভব নয়।

আমার অনেক বই সানী ভাই প্রকাশ করে দিয়েছেন। শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের অবদান সানী ভাইয়ের। তার কল্যাণেই আমার অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। সানী ভাইয়ের কল্যাণে আমার বড় ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্র অমির জন্যে ঢাকার আশপাশে জমি কেনা হয়েছে।
সানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো স্বার্থের সম্পর্ক নয়। ভালোবাসা শ্রদ্ধার সম্পর্ক। সানী ভাই যদি কিছু বলেন বা আদেশ দেন সেটা পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আমি কিছু বললে সানী ভাই সেটা সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে সমাধা করে দেন।
সানী ভাইকে আমি বেশ কয়েকটা বই উৎসর্গ করেছি। সানী ভাইও আমাকে অনেকগুলো বই উৎসর্গ করেছেন।
বইমেলা ২০১৮তে সানী ভাই অপরিসীম আবেগে আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। ‘আমীরুলনামা’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ ছড়ার বই প্রকাশ করেছেন সানী ভাই। বইটির প্রকাশক বাদল চৌধুরী। আমাদের আরেক স্নেহভাজন। বইটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে মেলা মাঠে।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বললেন, শাবাশ সানী। দুর্দান্ত কাজ করেছ। বাংলাভাষায় জীবিত কোনো অগ্রজ কোনো অনুজপ্রতি এরকম ছড়ার বই প্রকাশ করেনি।
তোমাকে অভিবাদন সানী।
সানী ভাই হাসতে হাসতে বললেন, সব হালায় এই বই দেইখা হিংসায় জ্বলতাছে। সবার খবর হয়্যা গেছে।
আমি বললাম,
কামটা ভালো হয়নি উস্তাদ।
সানী ভাই, হিংসা বাড়ায়া লাভ কি?
সানী ভাই অবশ্য কাউকে পরোয়া করেন না। যত বড় ব্যক্তি হউক না কেন- অসংগতি দেখলে তার সমালোচনা করে যাবে, কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই সানী ভাইয়ের। মন্ত্রী, এমপি, সচিব- সবার সঙ্গেই সদ্ভাব তার। স্বনামে সবাই তাকে স্নেহ করেন। ভালোবাসেন।
সানী ভাই কখনো সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অকারণ সুবিধা নেয়নি। কোনো রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে তিনি দূরে থাকেন।
সানী ভাই সকল সংগঠনের প্রাণপুরুষ। সবার সঙ্গে তিনি মিলেমিশে থাকেন। মজাটা হচ্ছে সানী ভাই আর আমি এমনই মানিকজোড় যে সানী ভাইয়ের প্রিয়জনেরা আমার প্রিয়জন। আমার ঘনিষ্ঠজনেরা সানী ভাইয়েরও ঘনিষ্ঠ।
একটা কথা বলা হয়নি। আমাকে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত করে থাকেন তিনি আসলাম সানী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে থাকেন : আমীরুল আমার চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু জ্ঞানে মেধায় আমীরুল আমার চেয়ে অনেক বড়।
আমীরুল আমার গুরু।
আমীরুলের কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আছে।
যারা আমীরুলের মূল্য দিতে জানে না তাদের দিয়ে কিছু হবে না। আমীরুলকে ভ্যালু দিতে হবে।
আমি সামনে হয়তো দর্শক আসনে বসে আছি। সানী ভাই মাইক্রোফোনে অনর্গল বলে যাচ্ছেন-
আমীরুল অনেক লাজুক। নিজের আত্মপ্রচার করতে পছন্দ করে না। আরেকজন আছে ধ্রুব এষ। খামোখা এরা ছোটাছুটি করে না।
বক্তৃতার মধ্যে বলতে থাকলেন, শুধু বাংলা নয়, বিশ্ব শিশুসাহিত্যেই আমীরুল তার সৃজনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আছে। আমি লজ্জায় মাথা নত হয়ে বসে থাকি।
ঢাকা, কলকাতা, চট্টগ্রাম, সিলেট যেখানেই হোক না কেন সাহিত্য অনুষ্ঠান সানী ভাই থাকলেই আমাকে গাছে তুলে ছাড়বে। আমি নামব কিভাবে সে উপায় থাকবে না।
সানী ভাইয়ের সাথে বিদেশ ভ্রমণ অতি আনন্দের। কলকাতায় আমরা বহুবার গেছি। একসাথে একই হোটেলে থেকেছি। ভ্রমণে সানী ভাই অসম্ভব সাহায্যকারী ব্যক্তি। আমি হার্টের রোগী। আমাকে কোনো ব্যাগ-লাগেজ বহন করতে দেবেন না তিনি। আমার প্রথম কলকাতা ভ্রমণও সানী ভাইয়ের হাত ধরে।
সানী ভাইয়ের বৃত্তান্ত বলে শেষ হবে না। পুরো একটা বই লেখার ইচ্ছা রইলো আমার।
সানী ভাই সম্পর্কে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, নাট্যজন মামুনুর রশীদ কিংবা আমাদের উভয়ের অতি কাছের বন্ধু আহমাদ মাযহার সবসময় বলে থাকেন- আসলাম সানীর মতো চরিত্র আমাদের দেশে নাই। একেবারে বিরল চরিত্র। কোনো তুলনা নাই।
সানী ভাই একক ও অদ্বিতীয়। সানী ভাইয়ের মুখের হাসি যেন কোনোদিন মলিন না হয়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status