ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

মেঘনার খোঁজে

ইশরাত তানিয়া

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৬:১৭ পূর্বাহ্ন

সচিত্রকরণ: মাসুক হেলাল

-বাদলমামা, কী বলেছ তুমি মাকে?
-বলেছি, পায়ের ওপর দিয়ে একটা তিরতিরে নদী চলে গেল।
-হুম ফিরোজা নীল ঢেউ... এমনই কিছু একটা শুনলাম।
-তোকে আবার বলতে গেল কেন?
-বলল কই? আঁচলে চোখ মুছল। টেনশান করছে খুব। চেপে ধরলাম। তখন বলে- বাদল।
-আরে এসব স্বপ্ন। তোর মা তো পাগল। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি, কিছু হলেই মনুর চোখ ভাসছে। কী না কী বলেছি... এত কিসের অস্থিরতা?
বাদল মামা মায়ের মামাতো ভাই। পিঠাপিঠি দুজনের খুব ভাব। একই স্কুলে পড়ত। এক ক্লাস ওপর নিচে। মায়ের একমাত্র বন্ধু বলা যায়। মেলবোর্নে সেটেলড বিশ বছর হলো। একটা পোলট্রি ফার্মের ম্যানেজার। একলা মানুষ। ঘুরতে চলে যায় পাহাড়ে সাগরে।
আমি জিভ দিয়ে টকাশ টকাশ বরইয়ের চাটনি খাচ্ছিলাম। হাতে খোলা রুশদেশের উপকথা। বিকেল হয়ে এলো প্রায়। অ্যাসাইনম্যান্ট টাইপ করবে রাজীব। আমার আপাতত হাত-পা ঝাড়া। লাল মলাটের হলদে হয়ে আসা বইটা এক সময়ে ছিল দিন-রাতের সঙ্গী। পুরনো বই নাড়া দিয়ে খুঁজে পেলাম। কত দিন পর ঝুপ করে কৈশোর নেমে এলো। বইটা অবশ্য মা’র। বাদল মামা দিয়েছিল মায়ের জন্মদিনে। শুভেচ্ছা  স্বরূপ লেখা- ভাগ্যিস, মনু জন্মে ছিলি!
অন্যদিন হলে মা ঠিক বলত- পড়া শেষ হলে জায়গা মতো রেখে দিও। তোমার তো ইস্টেশন নেই।
আজ মা খুব চিন্তিত। চোখ মুছে বলল- বাদলের কিছু হয়েছে। বলছে না।
-না বললে বুঝলে কিভাবে?
- ওর কাছে নদী এসেছিল। যখন নদী ছুটে আসে, বাদল খুব ছটফট করে।
-আচ্ছা, নদী...
-আমি তো জানি, কিছু গড়বড় হলেই নদী এসে সব ভাসিয়ে দেয়। নদী ওর খুব বন্ধু রে। খবর দিয়ে যায়। মামী চলে যাবার আগে নদী এসেছিল। বাড়িটা বেদখল হবার আগেও নদী এসেছিল। বাদলের সাইকেলটা যে রাতে চুরি হয়ে যায়, তার আগের রাতেও।
শেষের দিকে মা’র গলা ধরে এলো।
আমার আর ভালো লাগে না। ফ্যানের হাওয়ায় বইয়ের পাতা উল্টে যায়। ‘সিভকা বর্কা জাদু কা লাড়কা, চেকনাই ঘোড়া, সামনে এসে দাঁড়া’। নাহ, সত্যি ভাল্লাগছে না। বরইয়ের চাটনিটাও না। ভাইবারে কল করি মামাকে।
-বাদল মামা!
-কী বলবি বল।  
একটু সাহস করে আমি বলি- মেঘনা আন্টি?
-তাসমেনিয়া যাব আগামী মাসে। বুঝলি, দ্বীপরাজ্য! শিপে করে যেতে হয়।
-তোমরা বিয়ে করলে না কেন, বলতো?
-জানিস, প্রায় দশ হাজার বছর আগে তাসমেনিয়া অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
-আন্টি কিন্তু তোমাকে আজও মনে রেখেছে।
-হুঁ।
-হুঁ কী?
ফোনের ওপারে নৈঃশব্দ্য ঝরে। বাদল মামা চুপ করেই থাকে। বিয়ে করলে আমার বয়সী ছেলেমেয়ে থাকত মামার। এখনও এইটুকুন মেয়েই ভাবেন আমাকে। তাই হয়তো এসব ব্যাপারে কথা বলতে এত দ্বিধা। মামা অন্যরকম। প্রেমকাহিনী বলে বেড়ানোর লোক নয়। মা’র কাছ থেকেই অল্প কিছু শোনা। খুব ইচ্ছে ছিল মা’র, বাদল মামা আর মেঘনা আন্টির বিয়ে হোক। কেন যে বাদল মামা হঠাৎ দূরে সরে গেল। আজ অব্দি কেউ জানতে পারল না। এমন কি মা পর্যন্ত নয়!
মেঘনা আন্টি, নামের মতোই অনন্ত বইছে সে। অনেক বছর দেখা হয় না। আমরা ঢাকায়। আন্টি চট্টগ্রামে। বুটিক হাউজ আছে, একলা হাতেই সামলায়। আঙ্কেল চিটাগাং ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপক। মেঘনা আন্টি নিজেই এক শিল্পরূপ। চশমা চোখে, কপালে টিপ। কাঁধ পর্যন্ত ট্রিম করা খোলা চুল। লেবু চা খায়। আমি ভাবতাম বড় হলে মেঘনা আন্টির মতোই হবো।
সেই কবে গেছিলাম, এখনও মনে আছে! কি যেন বলে দুই বান্ধবী ছাড়া ছাড়া শব্দে। সেই পাঞ্জাবীর পকেটে... আধপাগলারে...ঝাঁকড়া চুল... লিফলেট ছিল...আজীবন এমন... ভাঙা ভাঙা শব্দাংশগুলো জুড়লে অবধারিতভাবে বাদল মামার মতো একটা আদল দেখতে পেতাম। তখন আমি আর রিংকি মনোপলি খেলছি।  রিংকি মেঘনা আন্টির মেয়ে। কথা বলার সময় হঠাৎ ওদের চোখ টলটল করে এলো। সেদিন আমি স্পষ্ট বুঝেছিলাম- বাদল মামা।
অ্যাসাইমেন্ট সাবমিটেড। ইনকোর্স পরীক্ষাও খুব ভালো হয়েছে। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। রাজীবসহ বাড়ি ফিরলাম। খাটের ওপর মা স্তব্ধ হয়ে বসে। কাছে যেতেই হাত ধরে বলল- মেঘনার ওভারিয়ান ক্যান্সার, অ্যাডভান্স স্টেজে। আর বড়জোর তিন মাস।

আজ পেরিয়ে কাল হয়, কাল যেতে যেতে পরশু... তিন মাস আর কিছু কাল।
বৃষ্টি ধোঁয়া সেদিন। সত্যিই ফিরোজা নীল ঢেউয়ের এক নদী এলো। নদীর পাড়ে বাদল মামা দাঁড়িয়ে। নৌকাতে মেঘনা আন্টি হাসছে। মামাকে ডাকছে হাতছানিতে। হাওয়ায় নদী উদ্দাম। মাঝি বৈঠা হাতে সামলে নিয়ে তীরের কাছা কাছিই। হঠাৎ বাদল মামা ঝাঁপ দিল নদীতে। সাঁতরে পৌঁছে গেল নৌকার কাছে। ভেজা গায়ে হাওয়া কাঁপুনি ধরায়। তখন মিহি বৃষ্টিকণায় ভর করে রঙ ছড়িয়ে পড়ছে রঙধনু থেকে। রঙের আভায় আরও উজ্জ্বল আন্টির মুখ।  আন্টির নামটাও কেন যে নদীর নামেই হলো! ঘাট থেকে ফিরে আসি।
পেছনে নদীটা এক ফালি সোনা রোদের আদরে ঝিলমিল। সামনে নরম কমলা আলোয় ভাসছে চারদিক। কোনো বিষাদ, কোনো ফুলস্টপ নেই কোত্থাও!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status