ঈদ আনন্দ ২০১৮
বিশেষ রচনা
তিস্তার বাঁচা-মরা
মু আ কুদ্দুস
২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৬:১৫ পূর্বাহ্ন
নদী মরে যায়। মরে গেছে খাল-বিল। মরে যাচ্ছে হাওর এবং বাঁওড়। লোকমুখে এখন শুধু শোনা যায় মরা নদীর গান। নদীতে মাছ ছিল। নদীতে সাঁতার কেটেছে পাড়ার ধিংগী মেয়েরা। আজ আর সেই গল্প নেই। বাংলাদেশের উত্তরে নদীহীন জনপদে ‘তিস্তা’ আশার আলো ছড়িয়েছিল। তিস্তাকে নিয়ে গড়ে তোলা হলো তিস্তা প্রকল্প। কিন্তু তারপর...
অত্যাধুনিক আদলে তিস্তাকে নদী থেকে অন্য পথে নীলফামারী জেলার ভেতর দিয়ে দিনাজপুর হয়ে বগুড়া পর্যন্ত প্রসারিত করা হলো। আশা ছিল তিস্তার পানি বৃহত্তর উত্তর জনপদের ক্ষেতের কাজে লাগবে। মরা মাটি প্রাণ পাবে। কিন্তু তিস্তা ব্যারেজ তৈরির কিছুদিন পর থেকে প্রকল্প হুমকির মুখে পড়ে। আজও চলছে তার লুকোচুরি খেলা। তিস্তা পাড়ের মানুষ এখন কাঁদে। কারণ একদিকে নদীর তীব্র ভাঙন। অন্যদিকে গ্রীষ্মে পানিহীন তিস্তা। হাজার হাজার মানুষ তিস্তার আগ্রাসনের শিকার। তারপরও আশায় বুক বাঁধে সুখের সন্ধানে। বহু নদীর মৃত্যু হয়েছে বলেই তিস্তার পাড়ে মানুষ সুখ খুঁজে। কিন্তু গত তিন দশকেও সুখপাখিকে দেখতে পায়নি উত্তরের মানুষ। ফলে বারে বারে এদেশের মানুষকে জানিয়ে দিতে হয় তিস্তার জন্ম আর আদিকথা।
তিস্তা। বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিস্তা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার প্রধান নদী। একে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের জীবনরেখাও বলা হয়। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। হিন্দু পুরাণ অনুসারে এটি দেবী পার্বতীর স্তন থেকে উৎপন্ন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নদীটির বাংলা নাম তিস্তা এসেছে ‘ত্রি-স্রোতা’ বা ‘তিন প্রবাহ’ থেকে। সিকিম হিমালয়ের ৭,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে এই নদীর সৃষ্টি। এটি দার্জিলিং-এ অবস্থিত শিভক গোলা নামে পরিচিত একটি গিরিসপথ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়ে তিস্তা একটি বন্য নদী এবং এর উপত্যকা ঘন বনে আচ্ছাদিত। পার্বত্য এলাকা থেকে প্রথমে প্রবাহটি দার্জিলিং সমভূমিতে নেমে আসে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) দুয়ার সমভূমিতে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অষ্টাদশ শতকের প্রায় শেষ সময় এই ধারাটি বিভিন্ন নদী প্রবাহের মাধ্যমে গঙ্গা নদীতে প্রবাহিত হতো। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের অতিবৃষ্টি একটি ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করেছিল এবং সেই সময় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কি.মি, তার মধ্যে ১১৫ কি.মি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। তিস্তা এক সময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং এর অংশবিশেষ এখনো বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত।
তিস্তা নদীর উৎস উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালার ৫,৩৩০ মি. (১৭,৪৮৭ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত সো লামো হ্রদে। হ্রদটি শেসচেনের কাছে ডোংখা গিরিপথের উত্তরে অবস্থিত।
তিস্তা নদী ছাঙ্গু, ইউমথাং ও ডোংকিয়া লা পর্বতশ্রেণি থেকে উৎপন্ন ছোট ছোট নদীর জলে পুষ্ট। সিকিমের রংপো ও পশ্চিমবঙ্গের তিস্তাবাজার শহরের মাঝের অংশে তিস্তাই উভয় রাজ্যের সীমানা নির্দেশ করছে। তিস্তা সেতুর (যে সেতুটি দার্জিলিং ও কালিম্পং শহরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে) ঠিক আগে তিস্তা তার প্রধান উপনদী রঙ্গিতের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এখান থেকে তিস্তার গতি দক্ষিণমুখী। শিলিগুড়ি শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে করোনেশন সেতু পেরিয়ে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। তারপর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা ও বাংলাদেশের রংপুর জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিস্তা মিশেছে ব্রহ্মপুত্রে।
তিস্তার সূচনা
১৫০০ সালের পর থেকে বাংলার অনেক নদীর নদীখাতই ভৌগোলিক কারণে পরিবর্তিত হয়েছে। তিস্তা নদীর তাদের মধ্যে একটি।
তিস্তা নদী আগে জলপাইগুড়ির দক্ষিণে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হতো। পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে পুনর্ভবা ও মধ্যে আত্রাই। সম্ভবত এই তিনটি ধারার অনুষঙ্গেই ত্রি-স্রোতা নামটি এসেছিল, যেটি কালক্রমে বিকৃত হয়ে দাঁড়ায় তিস্তা। তিনটি ধারার মধ্যে পুনর্ভবা মহানন্দায় মিশতো। আত্রাই চলন বিলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে করতোয়ায় মিশতো। তারপর আত্রাই-করতোয়ার যুগ্মধারাটি জাফরগঞ্জের কাছে মিশতো পদ্মায়। ১৭৮৭ সালের এক বিধ্বংসী বন্যার পর তিস্তা তার পুরনো খাত পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মেশে।
রেনেলের মানচিত্রে (১৭৬৪-১৭৭৭) দেখা যায় তিস্তা উত্তরবঙ্গের একাধিক শাখায় (পুনর্ভবা, আত্রাই, করতোয়া ইত্যাদি) প্রবাহিত হতো। সবকটি ধারা উত্তরবঙ্গের এখনকার পশ্চিমতম নদী মহানন্দায় মিশতো। তারপর হুরসাগর নাম নিয়ে অধুনা গোয়ালন্দের কাছে জাফরগঞ্জে পদ্মায় মিশতো। হুরসাগর নদীটি এখনো আছে। তবে, পদ্মার বদলে এটি এখন মিশে যমুনা নদীতে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে স্থির হয় যে, তিস্তা নদীর পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ পানি নদীটির সংরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু কীভাবে এই পানি ভাগাভাগি হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি যৌথ বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দু’দেশের সমান অংশে ভাগ করে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে প্রস্তাব দেয়। ভারত এই প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করে জানায় যে, বাংলাদেশ বাংলাদেশের সমান পানি পেতে পারে না। নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে ভারত জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিস্তা নদীর মূল পানিপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের তিস্তায় আসতে দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের শুষ্ক মৌসুমে ভারত কর্তৃক তিস্তার পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরে যেতে থাকে। পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুঁয়েমি, অনৈতিক ঢিলেমি ও হটকারীতায় তিস্তা তীরবর্তী ও আশেপাশের প্রকৃতি রুক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালি আর পলি পড়ে তিস্তার বুকে শুষ্ক মৌসুমে উত্তপ্ত বালুর স্তূপ। অন্যদিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলিয়ে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে আছরে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙনে ফি বছর ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে পথের ভিখেরি হয়। নদীর প্রবাহ পথে বিশাল চর ও উভয় তীরে ভাঙনের তাণ্ডবে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোনো কোনো জায়গায় ৫ কিলোমিটারেরও বেশি। কোনো জায়গায় ৫০০ মিটার।
তিস্তার জল দিয়ে ৯ লাখ হেক্টর জমিকে সেচসেবিত করে তুলতে চায় পশ্চিমবঙ্গ। আর বাংলাদেশ চায় সাত লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জল দিক তিস্তা। নদী-বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য নদীর জল দিতে গেলে শুকনো মওসুমে তিস্তায় প্রতি সেকেন্ডে ১৬০০ ঘন মিটার জল থাকা দরকার। অথচ এখন থাকে প্রতি সেকেন্ডে ১৫০-২০০ ঘন মিটার জল। সিকিমে তিস্তার উপরে তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ছাড়া জল পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা ব্যারাজ ধরে রাখতে পারে না।
তিস্তা নদী এলাকার বাসিন্দাদের কাছে জীবন রক্ষা বলা হয়। তিস্তার দু’পাড়ের উর্বরতা প্রধান সহায়ক তিস্তার পানি। এখানে রয়েছে সুস্বাদু মাছ। বর্ষায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তিস্তা। পথও পরিবর্তন করেছে বহুবার। এর ফলে অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। বহু লোকের জীবন কেড়ে নিয়েছে তিস্তা। এরপরও তিস্তার পানিকে কাজে লাগানোর জন্য শুরু হয় পরিকল্পনা। মহাপরিকল্পনা। কারণ তিস্তার পানি ধরে রাখতে পারলে ফসল উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা যেমন থাকবে তেমনি বন্যার হাত থেকে তিস্তা পাড়ের বাসিন্দাদের বাঁচানো যাবে। সারা বছর তিস্তা থাকবে বহমান। প্রয়োজন অনুযায়ী এর ব্যবহার হবে। এই আশাটুকু নিয়েই তৎকালীন সরকার তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়। ১৯৬০ সালে ব্যারেজ নির্মাণের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৯০ সালে ৬১৫ মিটার দৈর্ঘ্য তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। এতে ৪৪টি গেট রয়েছে। এরপর শুরু হয় মহা পরিকল্পনা। ব্যারেজের সাহায্যে বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার ৩৩টি থানার (উপজেলা) ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর উঁচু অনাবাদি জমি সেচ সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়। ১৯৭৯ সালের ১২ই ডিসেম্বর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৯০ সালের ৫ই আগস্ট তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন করেন। এ সময় একটি প্রধান খাল, ৩টি শাখা খাল ও অসংখ্য ছোট ছোট খাল নির্মাণ করা হয় পানি সংরক্ষণের জন্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষ করে ১৯৯৩ সালে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার তিস্তার কণ্ঠরোধকারী ৯২১.৫৩ মিটার ‘গজলডোবা ব্যারেজ’ নির্মাণ করে। এ বাঁধে এক তরফা পানি আটকিয়ে খালের সাহায্যে ভারত শুকনো মওসুমে ১ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে তিস্তার ভাটি অঞ্চলে শুধু পানি সংকটই নয়, দেখা দিয়েছে চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অন্যদিকে তিস্তায় পানির প্রভাব কমেছে। গতিপথ পরিবর্তন করার ফলে নদীটি সরু হয়ে আসছে। শুকনো মৌসুমে মানুষ হেঁটে পারাপার করছে। বিবিধ কারণে তিস্তা ব্যারেজ গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে।
তিস্তা ব্যারেজ
নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার সীমানা থেকে ১ কি.মি দূরে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানী নামক স্থানে তিস্তা নদীর উপর তিস্তা ব্যারেজ অবস্থিত। তিস্তা নদীতে ব্যারেজ নির্মাণপূর্বক অত্র অঞ্চলে গ্রাভিটি পদ্ধতিতে একটি সেচ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা বৃটিশ আমল হতেই অনুভূত হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সরকার তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মূল পরিকল্পনা গৃহীত হয় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ ১৯৭৯ সালে এবং ক্যানেল সিস্টেমের নির্মাণ কাজ ১৯৮৪-৮৫ সালে হাতে নেয়া হয়। ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ৬১৫ মিটার, গেট ৪৪টি। ক্যানেল হেড রেগুলেটর ১১০ মিটার দীর্ঘ, গেট ৮টি। সর্বমোট গেট ৫২টি। জুন ১৯৯৮ প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। মোট নির্মাণ ব্যয় ৯৬৯.৫৩ কোটি টাকা।
তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের কাজ ১৯৮৪ সালে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে সৌদি উন্নয়ন তহবিল ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং আবুধাবি উন্নয়ন তহবিলের প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা ব্যারেজসহ সেচ যোগ্য কৃষিজমি ও জলকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। উত্তর জনপদের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার আমন মৌসুমে (খরিপ জুলাই-অক্টোবর) সম্ভাব্য খরা পরিস্থিতি হতে আমন শস্যকে রক্ষা, শুষ্ক মৌসুমে রবি শস্যে সেচ সুবিধা প্রদান এবং বর্ষা মৌসুমে সেচ এলাকা হতে পানি নিষ্কাশন ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প (ফেজ-১) নীলফামারী জেলার পাঁচটি উপজেলা- সদর, জলঢাকা, সৈয়দপুর, কিশোরগঞ্জ, ডিমলা। রংপুর জেলার চারটি উপজেলা- সদর, গঙাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ। দিনাজপুর জেলার তিনটি উপজেলা- চিরির বন্দর, পার্বতীপুর, খানসামা উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত। প্রধান খাল ৩৩.৬৭ কিলোমিটার, মেজর সেকেন্ডারি খাল (দিনাজপুর, রংপুর, বগুডা) ৭৪.৪৩ কি.মি, শাখা খাল/সেকেন্ডারি খাল ২১৪.৭০ কিলোমিটার, উপ-শাখা খাল/টারশিয়ারি খাল ৩৮৭.৬৫ কি.মি, নিষ্কাশন খাল ৩৮০ কি.মি। প্রধান খালে পানি সরবরাহ ক্ষমতা ২৮৩ কিউসেক। প্রায় সব খাল নীলফামারী জেলার উপর দিয়ে রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় গেছে।
তিস্তা ব্যারেজের অতুলনীয় সৌন্দর্য্য এবং এর চতুর্দিকের সবুজ বেষ্টনী, ফুল, বাগান, নদীর পুরাতন গতিপথ, সিল্ট ট্রাপ ইত্যাদি পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে আকৃষ্ট করে থাকে। ব্যারেজের সম্মুখের বিশাল জলরাশি সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল হতে আগত অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রের সৃষ্টি করেছে। এখান থেকেই শরৎ-হেমন্তে বরফাচ্ছন্ন কাঞ্চনজংঘার পর্বত শৃঙ্গ দৃশ্যমান হয়।
তিস্তা ব্যারেজ ও সেচ প্রকল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে বিনোদন স্পট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর তিস্তা ব্যারেজের উজানে বাঁধ দিয়ে ঘেরা কৃত্রিম জলরাশি, সেচ বাইপাস খাল, বনায়ন আর পাথর দিয়ে বাঁধানো পাড় সব মিলে এক মনোরম পরিবেশ।
রংপুরের গঙাচড়ার হীরন্ময় ও কুড়িগ্রামের জাহানুরসহ রংপুর মেডিকেল মোড় থেকে সৈয়দপুর হয়ে দিনাজপুরের দশমাইল পর্যন্ত একটি জরিপ পরিচালনা করেন। এই মহাসড়কটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। এর উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে যতগুলো নদনদী ও খাল প্রবাহিত হয়েছে, সবই এই সড়ককে অতিক্রম করে গেছে। তাই সহজেই নদনদী ও খালের সংখ্যার ধারণা পেতে সক্ষম হই। ফলে ঘাঘট নদ থেকে শুরু করে বরাতি, যমুনেশ্বরী, ছোট যমুনা, করতোয়া, পুনর্ভবা, আত্রাইসহ মোট ৪১টি নদনদী, তাদের শাখা-প্রশাখা ও তিস্তা ব্যারেজের বিশাল ৬টি খাল আমরা অতিক্রম করি। এই বর্ষা মৌসুমে সব নদনদী ও তাদের শাখাগুলো পানিতে টইটুম্বুর থাকলেও বিশাল খাল ছয়টির মাত্র দুটিতে হাত দুয়েক করে পানি দেখেছি, বাকি চারটি খটখটে শুকনো। জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ে- ‘নদী কেন বেঁচে থাকে? -একদিন এই নদী-শব্দ করে হৃদয়ে বিস্ময়/ আনিতে পারে না আর; -মানুষের মন থেকে নদীরা হারায়-শেষ হয়।’ মন্তব্য নদী বিশেষজ্ঞ শফিউদ্দীন সরকারের। তিনি মন্তব্য করেন, আলো আর আকাশের থেকে নদী যতখানি আশা করে, আমরা নদীর সেই আশার সমাধি ঘটিয়ে বলি- গাছ, পাহাড়, রোদ, তারা, মেঘ ও আকাশ তোমার তরে নয়। বরং সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত শুষে নেওয়ার মতো করে খাল দিয়ে তোমার জলের গর্জন শুষে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি, উজানে সড়ক নির্মাণ ও উৎসমূলকে আটকে দিয়ে শাখা নদীগুলোকে হত্যা করার পথ চূড়ান্ত করেছি; তবুও নদীগুলো বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যায় জোয়ারের পানি ও বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। রংপুর থেকে দশমাইল পর্যন্ত ৪১টি নদনদী যেভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টায় আছে-গলিত স্থবির ব্যাঙ যেভাবে আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায়!
অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এত বিশাল বাজেটের আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার ফল এই শুকনো খাল? নদীর ভূমিকা যেমন সমস্ত গতিপথে ভূত্বকের চরিত্র বুঝে নিয়ে ও তার পানির উৎসকে পুনঃসঞ্চালিত করা এবং পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বৈরী প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত না করে উচ্চ বৃষ্টিপাত এলাকা থেকে পানি সরবরাহ করা। কিন্তু খালগুলোর বেলায় তা হয় না। উল্টো ৩০ ভাগ বাষ্পীভবনসহ ভূত্বকের পানি শুষে নেওয়ার কারণে সিংহভাগ পানি হারিয়ে যায়। প্রাকৃতিক গতিপথ থেকে পানির গতিপথ পরিবর্তনের ফলে ভাটি অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানি উৎসের পুনঃসঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয়। অথচ বড় বড় বাঁধ ও বৃহৎ সেচ প্রকল্পগুলো দাঁড়িয়ে আছে এই ধারণার ওপর যে, এতে পানির ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে এবং পানির চাহিদা স্বাভাবিক পানিচক্রের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না।
অন্য দিকে, হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে যে খালগুলো খনন করা হয়েছে, তা পতিত স্থাপত্যের নজির সৃষ্টি করেছে। উল্টো বর্ষা মৌসুমে ব্যারেজের ভাটিতে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি করেছে। হাতিবান্ধা ও ডিমলা এলাকার জনগণ শুকনো মৌসুমের চেয়ে বর্ষা মৌসুমে অধিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে নদীর প্রাণ যে পানিচক্রের সঙ্গে যুক্ত, তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে জলবিজ্ঞানচক্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রায় অর্ধ শতাধিক নদনদী ও তাদের শাখাগুলোর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে।
তিস্তা চুক্তি এখন একটি সময়ের দাবি। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজে চলছে জোর আলোচনা। সবাই চায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে একটা সুরাহা হোক।
তিস্তার পানি কতটা জরুরি তা সারা দেশবাসীর থেকে এর পারের বা কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষজনই উপলব্ধি করছে হাড়ে হাড়ে। আমি তিস্তা পারের মানুষ। এর উত্তাল তিস্তার রূপ আমি দেখেছি। তার স্বচ্ছ জলে সাঁতার কেটেছি। তার বুকের পানি ইরি ক্ষেতে কত সেচ দিয়েছি এই দু’হাতে, সেটা কেবল তিস্তাই জানে ও আমি জানি। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের পানি রংপুর অঞ্চলের মানুষের রুটি রুজির অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই নদীর পানি কতটুকু তার পারের লোকজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা দূরে থেকে উপলব্ধি করা যাবে না। এখানকার লোকজনের এখন ইরি চাষে অবর্ণনীয় কষ্ট। গভীর নলকূপ করে ও যান্ত্রিক পাম্পের দ্বারা সেচ দিয়ে যে চাষাবাদ হয় তা অনেকাংশে ব্যয়ের থেকে শস্যের পরিমাণ মূল্য কম হয়। তিস্তাতে পানি না থাকায় আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না। চলে না নৌকা। যার ফলে ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেকখানি ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের এ অঞ্চল এমনিতে উঁচু ও খরাপ্রবণ। অধিকন্তু মূল অববাহিকা তিস্তাতে পানিশূন্যতার কারণে পানির স্তর দিন দিন নিচে চলে যাচ্ছে।
সাগরপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২১ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত পূর্ব-মধ্য হিমালয়ের উত্তরে সিকিমের একটি বিশাল হিমবাহ থেকে নেমে আসা চো-লহমু হ্রদ (যেটি প্রায় ৫,৩৩০ মিটার বা ১৭,৫০০ ফুট) থেকে তিস্তা নদীর উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে এটি পুরো সিকিম রাজ্যের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, শুরু থেকেই নদীটি ফুলের রাজ্য সিকিম এবং পাহাড়ের রানী রূপসী দার্জিলিং এই দুই পার্বত্য জেলার সীমানা চিহ্নিত করে সৃষ্টি করেছে এক অপরূপ দৃশ্যের। এরপর পুরো তিস্তা দার্জিলিং জেলার সীমানায় প্রবেশপথে উত্তর-পশ্চিমের পার্বত্যভূমি থেকে নেমে আসা রাংগীত নামে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী এবং এর সংশ্লিষ্ট সকল উপনদীর পানি প্রবাহকে গ্রহণ করে এক ত্রিমোহনার সৃষ্টি করে আরো সমৃদ্ধ হয়ে পুরো তিস্তা দার্জিলিংয়ের বিশাল পার্বত্য অরণ্যপথ অতিক্রম করে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে সিভকের কাছে সমতল ভূমিতে নেমে এসে জলপাইগুড়ি জেলায় প্রবেশ করে। জলপাইগুড়ি শহর, ধানেশ, খরমপুর প্রভৃতি এলাকার ওপর দিয়ে নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার উত্তরে ডালিয়ার খড়িবাড়ী থেকে তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
১৯৮৭ সালের অক্টোবর মাসে রংপুর অঞ্চলে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ঘটে। এই বৃষ্টির পানি এবং সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পার্বত্য পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ বালি বহন করে নিয়ে আসে। এই বালি সঞ্চিত হয়ে আত্রাই নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তিস্তায় বন্যার পানি নিষ্কাশনের অন্তরায়ের কারণে অন্য কোনো পথ না পেয়ে ক্ষুদ্র নদী ঘাঘটের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে সমগ্র রংপুর অঞ্চলে মারাত্মক আকারের বন্যা দেখা দেয়।
এই তিস্তা চলার পথে বর্ষা মৌসুমে দুধ বা ঘোলা বর্ণের পানির সঙ্গে দীর্ঘ পার্বত্য পথ হতে প্রচুর ভাসমান কাঁকর, শিলা, পলি ও পলিজাত পদার্থ বহন করে এদেশের সমতলভূমিতে নিয়ে আসে। তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৪ কিলোমিটার বেগে পাহাড়ি পথ বেয়ে সমতলের দিকে নেমে আসে। রংপুর শহর তিস্তা এবং ঘাঘট নদীর তীরে অবস্থিত। বর্তমানে তিস্তা নদীর অবস্থা খুবই করুণ। নীলফামারী জেলা সীমানা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার উজানে ভারতীয় অংশের গজলডোবা হলো তিস্তা ব্যারেজের প্রধান বাঁধা।
এখন তিস্তায় পানি সংকটের কারণে নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা রেলসেতুর কাছ থেকে রাজারহাট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার বাঁধের রাস্তার দুই ধারে কয়েক হাজার মেহগনি, শিশু, রেইনট্রিসহ মূল্যবান গাছপালা মরে যাচ্ছে। তাহলে এখন অনুমেয় যে তিস্তা পারের বা এই ত্রি-স্রোতধারা বিধৌত এলাকার মানুষজনের আকুতি কতটুকু। আর এই তিস্তা যদি মরে যায় তাহলে পানি প্রবাহের সংকটে একসময় দেশের প্রধান নদী পদ্মাও হারিয়ে ফেলবে তার যৌবন। তখন দেশ প্রায় মরুময় হয়ে যাবে।
অনেকের ধারণা, হয়তো একদিন তিস্তাও হারিয়ে যাবে। নয়তো গজলডোবার বাধায় তিস্তা তার গতিপথ পরিবর্তন করে অন্যদিকে যাবে। অন্য নামে বইবে। তখন বৃহত্তর রংপুর বিভাগ উষ্ণ হয়ে উঠবে। মরুভূমিতে পরিণত হবে। কাজেই তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন এখনই। তা না হলে তিস্তাও মরবে মানুষও মরবে।
সূত্র : উইকিপিডিয়া
অত্যাধুনিক আদলে তিস্তাকে নদী থেকে অন্য পথে নীলফামারী জেলার ভেতর দিয়ে দিনাজপুর হয়ে বগুড়া পর্যন্ত প্রসারিত করা হলো। আশা ছিল তিস্তার পানি বৃহত্তর উত্তর জনপদের ক্ষেতের কাজে লাগবে। মরা মাটি প্রাণ পাবে। কিন্তু তিস্তা ব্যারেজ তৈরির কিছুদিন পর থেকে প্রকল্প হুমকির মুখে পড়ে। আজও চলছে তার লুকোচুরি খেলা। তিস্তা পাড়ের মানুষ এখন কাঁদে। কারণ একদিকে নদীর তীব্র ভাঙন। অন্যদিকে গ্রীষ্মে পানিহীন তিস্তা। হাজার হাজার মানুষ তিস্তার আগ্রাসনের শিকার। তারপরও আশায় বুক বাঁধে সুখের সন্ধানে। বহু নদীর মৃত্যু হয়েছে বলেই তিস্তার পাড়ে মানুষ সুখ খুঁজে। কিন্তু গত তিন দশকেও সুখপাখিকে দেখতে পায়নি উত্তরের মানুষ। ফলে বারে বারে এদেশের মানুষকে জানিয়ে দিতে হয় তিস্তার জন্ম আর আদিকথা।
তিস্তা। বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিস্তা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার প্রধান নদী। একে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের জীবনরেখাও বলা হয়। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। হিন্দু পুরাণ অনুসারে এটি দেবী পার্বতীর স্তন থেকে উৎপন্ন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নদীটির বাংলা নাম তিস্তা এসেছে ‘ত্রি-স্রোতা’ বা ‘তিন প্রবাহ’ থেকে। সিকিম হিমালয়ের ৭,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে এই নদীর সৃষ্টি। এটি দার্জিলিং-এ অবস্থিত শিভক গোলা নামে পরিচিত একটি গিরিসপথ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়ে তিস্তা একটি বন্য নদী এবং এর উপত্যকা ঘন বনে আচ্ছাদিত। পার্বত্য এলাকা থেকে প্রথমে প্রবাহটি দার্জিলিং সমভূমিতে নেমে আসে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) দুয়ার সমভূমিতে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অষ্টাদশ শতকের প্রায় শেষ সময় এই ধারাটি বিভিন্ন নদী প্রবাহের মাধ্যমে গঙ্গা নদীতে প্রবাহিত হতো। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের অতিবৃষ্টি একটি ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করেছিল এবং সেই সময় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কি.মি, তার মধ্যে ১১৫ কি.মি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। তিস্তা এক সময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং এর অংশবিশেষ এখনো বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত।
তিস্তা নদীর উৎস উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালার ৫,৩৩০ মি. (১৭,৪৮৭ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত সো লামো হ্রদে। হ্রদটি শেসচেনের কাছে ডোংখা গিরিপথের উত্তরে অবস্থিত।
তিস্তা নদী ছাঙ্গু, ইউমথাং ও ডোংকিয়া লা পর্বতশ্রেণি থেকে উৎপন্ন ছোট ছোট নদীর জলে পুষ্ট। সিকিমের রংপো ও পশ্চিমবঙ্গের তিস্তাবাজার শহরের মাঝের অংশে তিস্তাই উভয় রাজ্যের সীমানা নির্দেশ করছে। তিস্তা সেতুর (যে সেতুটি দার্জিলিং ও কালিম্পং শহরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে) ঠিক আগে তিস্তা তার প্রধান উপনদী রঙ্গিতের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এখান থেকে তিস্তার গতি দক্ষিণমুখী। শিলিগুড়ি শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে করোনেশন সেতু পেরিয়ে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। তারপর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা ও বাংলাদেশের রংপুর জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিস্তা মিশেছে ব্রহ্মপুত্রে।
তিস্তার সূচনা
১৫০০ সালের পর থেকে বাংলার অনেক নদীর নদীখাতই ভৌগোলিক কারণে পরিবর্তিত হয়েছে। তিস্তা নদীর তাদের মধ্যে একটি।
তিস্তা নদী আগে জলপাইগুড়ির দক্ষিণে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হতো। পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে পুনর্ভবা ও মধ্যে আত্রাই। সম্ভবত এই তিনটি ধারার অনুষঙ্গেই ত্রি-স্রোতা নামটি এসেছিল, যেটি কালক্রমে বিকৃত হয়ে দাঁড়ায় তিস্তা। তিনটি ধারার মধ্যে পুনর্ভবা মহানন্দায় মিশতো। আত্রাই চলন বিলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে করতোয়ায় মিশতো। তারপর আত্রাই-করতোয়ার যুগ্মধারাটি জাফরগঞ্জের কাছে মিশতো পদ্মায়। ১৭৮৭ সালের এক বিধ্বংসী বন্যার পর তিস্তা তার পুরনো খাত পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মেশে।
রেনেলের মানচিত্রে (১৭৬৪-১৭৭৭) দেখা যায় তিস্তা উত্তরবঙ্গের একাধিক শাখায় (পুনর্ভবা, আত্রাই, করতোয়া ইত্যাদি) প্রবাহিত হতো। সবকটি ধারা উত্তরবঙ্গের এখনকার পশ্চিমতম নদী মহানন্দায় মিশতো। তারপর হুরসাগর নাম নিয়ে অধুনা গোয়ালন্দের কাছে জাফরগঞ্জে পদ্মায় মিশতো। হুরসাগর নদীটি এখনো আছে। তবে, পদ্মার বদলে এটি এখন মিশে যমুনা নদীতে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে স্থির হয় যে, তিস্তা নদীর পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ পানি নদীটির সংরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু কীভাবে এই পানি ভাগাভাগি হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। ২০০৭ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি যৌথ বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দু’দেশের সমান অংশে ভাগ করে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে প্রস্তাব দেয়। ভারত এই প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করে জানায় যে, বাংলাদেশ বাংলাদেশের সমান পানি পেতে পারে না। নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে ভারত জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিস্তা নদীর মূল পানিপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের তিস্তায় আসতে দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের শুষ্ক মৌসুমে ভারত কর্তৃক তিস্তার পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরে যেতে থাকে। পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুঁয়েমি, অনৈতিক ঢিলেমি ও হটকারীতায় তিস্তা তীরবর্তী ও আশেপাশের প্রকৃতি রুক্ষ্ম হয়ে উঠেছে। তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালি আর পলি পড়ে তিস্তার বুকে শুষ্ক মৌসুমে উত্তপ্ত বালুর স্তূপ। অন্যদিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলিয়ে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে আছরে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙনে ফি বছর ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে পথের ভিখেরি হয়। নদীর প্রবাহ পথে বিশাল চর ও উভয় তীরে ভাঙনের তাণ্ডবে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোনো কোনো জায়গায় ৫ কিলোমিটারেরও বেশি। কোনো জায়গায় ৫০০ মিটার।
তিস্তার জল দিয়ে ৯ লাখ হেক্টর জমিকে সেচসেবিত করে তুলতে চায় পশ্চিমবঙ্গ। আর বাংলাদেশ চায় সাত লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জল দিক তিস্তা। নদী-বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ১৬ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য নদীর জল দিতে গেলে শুকনো মওসুমে তিস্তায় প্রতি সেকেন্ডে ১৬০০ ঘন মিটার জল থাকা দরকার। অথচ এখন থাকে প্রতি সেকেন্ডে ১৫০-২০০ ঘন মিটার জল। সিকিমে তিস্তার উপরে তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ছাড়া জল পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা ব্যারাজ ধরে রাখতে পারে না।
তিস্তা নদী এলাকার বাসিন্দাদের কাছে জীবন রক্ষা বলা হয়। তিস্তার দু’পাড়ের উর্বরতা প্রধান সহায়ক তিস্তার পানি। এখানে রয়েছে সুস্বাদু মাছ। বর্ষায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তিস্তা। পথও পরিবর্তন করেছে বহুবার। এর ফলে অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। বহু লোকের জীবন কেড়ে নিয়েছে তিস্তা। এরপরও তিস্তার পানিকে কাজে লাগানোর জন্য শুরু হয় পরিকল্পনা। মহাপরিকল্পনা। কারণ তিস্তার পানি ধরে রাখতে পারলে ফসল উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা যেমন থাকবে তেমনি বন্যার হাত থেকে তিস্তা পাড়ের বাসিন্দাদের বাঁচানো যাবে। সারা বছর তিস্তা থাকবে বহমান। প্রয়োজন অনুযায়ী এর ব্যবহার হবে। এই আশাটুকু নিয়েই তৎকালীন সরকার তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়। ১৯৬০ সালে ব্যারেজ নির্মাণের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৯০ সালে ৬১৫ মিটার দৈর্ঘ্য তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। এতে ৪৪টি গেট রয়েছে। এরপর শুরু হয় মহা পরিকল্পনা। ব্যারেজের সাহায্যে বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার ৩৩টি থানার (উপজেলা) ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর উঁচু অনাবাদি জমি সেচ সুবিধার আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়। ১৯৭৯ সালের ১২ই ডিসেম্বর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৯০ সালের ৫ই আগস্ট তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন করেন। এ সময় একটি প্রধান খাল, ৩টি শাখা খাল ও অসংখ্য ছোট ছোট খাল নির্মাণ করা হয় পানি সংরক্ষণের জন্য। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শেষ করে ১৯৯৩ সালে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার তিস্তার কণ্ঠরোধকারী ৯২১.৫৩ মিটার ‘গজলডোবা ব্যারেজ’ নির্মাণ করে। এ বাঁধে এক তরফা পানি আটকিয়ে খালের সাহায্যে ভারত শুকনো মওসুমে ১ হাজার ৫০০ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে তিস্তার ভাটি অঞ্চলে শুধু পানি সংকটই নয়, দেখা দিয়েছে চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অন্যদিকে তিস্তায় পানির প্রভাব কমেছে। গতিপথ পরিবর্তন করার ফলে নদীটি সরু হয়ে আসছে। শুকনো মৌসুমে মানুষ হেঁটে পারাপার করছে। বিবিধ কারণে তিস্তা ব্যারেজ গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে।
তিস্তা ব্যারেজ
নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার সীমানা থেকে ১ কি.মি দূরে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানী নামক স্থানে তিস্তা নদীর উপর তিস্তা ব্যারেজ অবস্থিত। তিস্তা নদীতে ব্যারেজ নির্মাণপূর্বক অত্র অঞ্চলে গ্রাভিটি পদ্ধতিতে একটি সেচ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা বৃটিশ আমল হতেই অনুভূত হয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সরকার তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মূল পরিকল্পনা গৃহীত হয় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ ১৯৭৯ সালে এবং ক্যানেল সিস্টেমের নির্মাণ কাজ ১৯৮৪-৮৫ সালে হাতে নেয়া হয়। ব্যারেজের দৈর্ঘ্য ৬১৫ মিটার, গেট ৪৪টি। ক্যানেল হেড রেগুলেটর ১১০ মিটার দীর্ঘ, গেট ৮টি। সর্বমোট গেট ৫২টি। জুন ১৯৯৮ প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। মোট নির্মাণ ব্যয় ৯৬৯.৫৩ কোটি টাকা।
তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের কাজ ১৯৮৪ সালে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে সৌদি উন্নয়ন তহবিল ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং আবুধাবি উন্নয়ন তহবিলের প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা ব্যারেজসহ সেচ যোগ্য কৃষিজমি ও জলকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। উত্তর জনপদের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার আমন মৌসুমে (খরিপ জুলাই-অক্টোবর) সম্ভাব্য খরা পরিস্থিতি হতে আমন শস্যকে রক্ষা, শুষ্ক মৌসুমে রবি শস্যে সেচ সুবিধা প্রদান এবং বর্ষা মৌসুমে সেচ এলাকা হতে পানি নিষ্কাশন ছিল এর প্রধান লক্ষ্য। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প (ফেজ-১) নীলফামারী জেলার পাঁচটি উপজেলা- সদর, জলঢাকা, সৈয়দপুর, কিশোরগঞ্জ, ডিমলা। রংপুর জেলার চারটি উপজেলা- সদর, গঙাচড়া, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ। দিনাজপুর জেলার তিনটি উপজেলা- চিরির বন্দর, পার্বতীপুর, খানসামা উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত। প্রধান খাল ৩৩.৬৭ কিলোমিটার, মেজর সেকেন্ডারি খাল (দিনাজপুর, রংপুর, বগুডা) ৭৪.৪৩ কি.মি, শাখা খাল/সেকেন্ডারি খাল ২১৪.৭০ কিলোমিটার, উপ-শাখা খাল/টারশিয়ারি খাল ৩৮৭.৬৫ কি.মি, নিষ্কাশন খাল ৩৮০ কি.মি। প্রধান খালে পানি সরবরাহ ক্ষমতা ২৮৩ কিউসেক। প্রায় সব খাল নীলফামারী জেলার উপর দিয়ে রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলায় গেছে।
তিস্তা ব্যারেজের অতুলনীয় সৌন্দর্য্য এবং এর চতুর্দিকের সবুজ বেষ্টনী, ফুল, বাগান, নদীর পুরাতন গতিপথ, সিল্ট ট্রাপ ইত্যাদি পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসু মানুষকে আকৃষ্ট করে থাকে। ব্যারেজের সম্মুখের বিশাল জলরাশি সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চল হতে আগত অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রের সৃষ্টি করেছে। এখান থেকেই শরৎ-হেমন্তে বরফাচ্ছন্ন কাঞ্চনজংঘার পর্বত শৃঙ্গ দৃশ্যমান হয়।
তিস্তা ব্যারেজ ও সেচ প্রকল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে বিনোদন স্পট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর তিস্তা ব্যারেজের উজানে বাঁধ দিয়ে ঘেরা কৃত্রিম জলরাশি, সেচ বাইপাস খাল, বনায়ন আর পাথর দিয়ে বাঁধানো পাড় সব মিলে এক মনোরম পরিবেশ।
রংপুরের গঙাচড়ার হীরন্ময় ও কুড়িগ্রামের জাহানুরসহ রংপুর মেডিকেল মোড় থেকে সৈয়দপুর হয়ে দিনাজপুরের দশমাইল পর্যন্ত একটি জরিপ পরিচালনা করেন। এই মহাসড়কটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। এর উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে যতগুলো নদনদী ও খাল প্রবাহিত হয়েছে, সবই এই সড়ককে অতিক্রম করে গেছে। তাই সহজেই নদনদী ও খালের সংখ্যার ধারণা পেতে সক্ষম হই। ফলে ঘাঘট নদ থেকে শুরু করে বরাতি, যমুনেশ্বরী, ছোট যমুনা, করতোয়া, পুনর্ভবা, আত্রাইসহ মোট ৪১টি নদনদী, তাদের শাখা-প্রশাখা ও তিস্তা ব্যারেজের বিশাল ৬টি খাল আমরা অতিক্রম করি। এই বর্ষা মৌসুমে সব নদনদী ও তাদের শাখাগুলো পানিতে টইটুম্বুর থাকলেও বিশাল খাল ছয়টির মাত্র দুটিতে হাত দুয়েক করে পানি দেখেছি, বাকি চারটি খটখটে শুকনো। জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ে- ‘নদী কেন বেঁচে থাকে? -একদিন এই নদী-শব্দ করে হৃদয়ে বিস্ময়/ আনিতে পারে না আর; -মানুষের মন থেকে নদীরা হারায়-শেষ হয়।’ মন্তব্য নদী বিশেষজ্ঞ শফিউদ্দীন সরকারের। তিনি মন্তব্য করেন, আলো আর আকাশের থেকে নদী যতখানি আশা করে, আমরা নদীর সেই আশার সমাধি ঘটিয়ে বলি- গাছ, পাহাড়, রোদ, তারা, মেঘ ও আকাশ তোমার তরে নয়। বরং সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত শুষে নেওয়ার মতো করে খাল দিয়ে তোমার জলের গর্জন শুষে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি, উজানে সড়ক নির্মাণ ও উৎসমূলকে আটকে দিয়ে শাখা নদীগুলোকে হত্যা করার পথ চূড়ান্ত করেছি; তবুও নদীগুলো বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যায় জোয়ারের পানি ও বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। রংপুর থেকে দশমাইল পর্যন্ত ৪১টি নদনদী যেভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টায় আছে-গলিত স্থবির ব্যাঙ যেভাবে আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায়!
অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এত বিশাল বাজেটের আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার ফল এই শুকনো খাল? নদীর ভূমিকা যেমন সমস্ত গতিপথে ভূত্বকের চরিত্র বুঝে নিয়ে ও তার পানির উৎসকে পুনঃসঞ্চালিত করা এবং পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বৈরী প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত না করে উচ্চ বৃষ্টিপাত এলাকা থেকে পানি সরবরাহ করা। কিন্তু খালগুলোর বেলায় তা হয় না। উল্টো ৩০ ভাগ বাষ্পীভবনসহ ভূত্বকের পানি শুষে নেওয়ার কারণে সিংহভাগ পানি হারিয়ে যায়। প্রাকৃতিক গতিপথ থেকে পানির গতিপথ পরিবর্তনের ফলে ভাটি অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানি উৎসের পুনঃসঞ্চালন বাধাপ্রাপ্ত হয়। অথচ বড় বড় বাঁধ ও বৃহৎ সেচ প্রকল্পগুলো দাঁড়িয়ে আছে এই ধারণার ওপর যে, এতে পানির ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে এবং পানির চাহিদা স্বাভাবিক পানিচক্রের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না।
অন্য দিকে, হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে যে খালগুলো খনন করা হয়েছে, তা পতিত স্থাপত্যের নজির সৃষ্টি করেছে। উল্টো বর্ষা মৌসুমে ব্যারেজের ভাটিতে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি করেছে। হাতিবান্ধা ও ডিমলা এলাকার জনগণ শুকনো মৌসুমের চেয়ে বর্ষা মৌসুমে অধিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে নদীর প্রাণ যে পানিচক্রের সঙ্গে যুক্ত, তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে জলবিজ্ঞানচক্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রায় অর্ধ শতাধিক নদনদী ও তাদের শাখাগুলোর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে।
তিস্তা চুক্তি এখন একটি সময়ের দাবি। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজে চলছে জোর আলোচনা। সবাই চায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে একটা সুরাহা হোক।
তিস্তার পানি কতটা জরুরি তা সারা দেশবাসীর থেকে এর পারের বা কাছাকাছি বসবাসকারী মানুষজনই উপলব্ধি করছে হাড়ে হাড়ে। আমি তিস্তা পারের মানুষ। এর উত্তাল তিস্তার রূপ আমি দেখেছি। তার স্বচ্ছ জলে সাঁতার কেটেছি। তার বুকের পানি ইরি ক্ষেতে কত সেচ দিয়েছি এই দু’হাতে, সেটা কেবল তিস্তাই জানে ও আমি জানি। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের পানি রংপুর অঞ্চলের মানুষের রুটি রুজির অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই নদীর পানি কতটুকু তার পারের লোকজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা দূরে থেকে উপলব্ধি করা যাবে না। এখানকার লোকজনের এখন ইরি চাষে অবর্ণনীয় কষ্ট। গভীর নলকূপ করে ও যান্ত্রিক পাম্পের দ্বারা সেচ দিয়ে যে চাষাবাদ হয় তা অনেকাংশে ব্যয়ের থেকে শস্যের পরিমাণ মূল্য কম হয়। তিস্তাতে পানি না থাকায় আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না। চলে না নৌকা। যার ফলে ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেকখানি ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের এ অঞ্চল এমনিতে উঁচু ও খরাপ্রবণ। অধিকন্তু মূল অববাহিকা তিস্তাতে পানিশূন্যতার কারণে পানির স্তর দিন দিন নিচে চলে যাচ্ছে।
সাগরপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২১ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত পূর্ব-মধ্য হিমালয়ের উত্তরে সিকিমের একটি বিশাল হিমবাহ থেকে নেমে আসা চো-লহমু হ্রদ (যেটি প্রায় ৫,৩৩০ মিটার বা ১৭,৫০০ ফুট) থেকে তিস্তা নদীর উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে এটি পুরো সিকিম রাজ্যের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, শুরু থেকেই নদীটি ফুলের রাজ্য সিকিম এবং পাহাড়ের রানী রূপসী দার্জিলিং এই দুই পার্বত্য জেলার সীমানা চিহ্নিত করে সৃষ্টি করেছে এক অপরূপ দৃশ্যের। এরপর পুরো তিস্তা দার্জিলিং জেলার সীমানায় প্রবেশপথে উত্তর-পশ্চিমের পার্বত্যভূমি থেকে নেমে আসা রাংগীত নামে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী এবং এর সংশ্লিষ্ট সকল উপনদীর পানি প্রবাহকে গ্রহণ করে এক ত্রিমোহনার সৃষ্টি করে আরো সমৃদ্ধ হয়ে পুরো তিস্তা দার্জিলিংয়ের বিশাল পার্বত্য অরণ্যপথ অতিক্রম করে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে সিভকের কাছে সমতল ভূমিতে নেমে এসে জলপাইগুড়ি জেলায় প্রবেশ করে। জলপাইগুড়ি শহর, ধানেশ, খরমপুর প্রভৃতি এলাকার ওপর দিয়ে নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার উত্তরে ডালিয়ার খড়িবাড়ী থেকে তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
১৯৮৭ সালের অক্টোবর মাসে রংপুর অঞ্চলে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ঘটে। এই বৃষ্টির পানি এবং সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পার্বত্য পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ বালি বহন করে নিয়ে আসে। এই বালি সঞ্চিত হয়ে আত্রাই নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তিস্তায় বন্যার পানি নিষ্কাশনের অন্তরায়ের কারণে অন্য কোনো পথ না পেয়ে ক্ষুদ্র নদী ঘাঘটের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে সমগ্র রংপুর অঞ্চলে মারাত্মক আকারের বন্যা দেখা দেয়।
এই তিস্তা চলার পথে বর্ষা মৌসুমে দুধ বা ঘোলা বর্ণের পানির সঙ্গে দীর্ঘ পার্বত্য পথ হতে প্রচুর ভাসমান কাঁকর, শিলা, পলি ও পলিজাত পদার্থ বহন করে এদেশের সমতলভূমিতে নিয়ে আসে। তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৪ কিলোমিটার বেগে পাহাড়ি পথ বেয়ে সমতলের দিকে নেমে আসে। রংপুর শহর তিস্তা এবং ঘাঘট নদীর তীরে অবস্থিত। বর্তমানে তিস্তা নদীর অবস্থা খুবই করুণ। নীলফামারী জেলা সীমানা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার উজানে ভারতীয় অংশের গজলডোবা হলো তিস্তা ব্যারেজের প্রধান বাঁধা।
এখন তিস্তায় পানি সংকটের কারণে নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা রেলসেতুর কাছ থেকে রাজারহাট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার বাঁধের রাস্তার দুই ধারে কয়েক হাজার মেহগনি, শিশু, রেইনট্রিসহ মূল্যবান গাছপালা মরে যাচ্ছে। তাহলে এখন অনুমেয় যে তিস্তা পারের বা এই ত্রি-স্রোতধারা বিধৌত এলাকার মানুষজনের আকুতি কতটুকু। আর এই তিস্তা যদি মরে যায় তাহলে পানি প্রবাহের সংকটে একসময় দেশের প্রধান নদী পদ্মাও হারিয়ে ফেলবে তার যৌবন। তখন দেশ প্রায় মরুময় হয়ে যাবে।
অনেকের ধারণা, হয়তো একদিন তিস্তাও হারিয়ে যাবে। নয়তো গজলডোবার বাধায় তিস্তা তার গতিপথ পরিবর্তন করে অন্যদিকে যাবে। অন্য নামে বইবে। তখন বৃহত্তর রংপুর বিভাগ উষ্ণ হয়ে উঠবে। মরুভূমিতে পরিণত হবে। কাজেই তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন এখনই। তা না হলে তিস্তাও মরবে মানুষও মরবে।
সূত্র : উইকিপিডিয়া