ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

সরীসৃপ

আলী ইদ্‌রিস

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৪:২৭ পূর্বাহ্ন

সচিত্রকরণ: সুমন রহমান

এই যে জবা মা-মণি, চকলেট নেবে, আমার কোলে এসো, নিয়ে যাও। পাঁচ বছরের কচি মেয়ে অমনি বড় কাকার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চকলেটের মোড়ক খুলে নিজের মুখে দেবে, তার আগেই বড় কাকা খপ করে  হাত ধরে  বলে ‘উহু, আগে একটা কিসি দাও।’ অবুঝ মেয়ে শিখানো পদ্ধতিতে বড় কাকার ঠোঁটে চুমু দেয়। বড় কাকা সে সুযোগে জবাকে নিজের শরীরের সঙ্গে পিষে, দুই হাতে জাপটে ধরে মেয়েটির ঠোঁট দুটোতে চুমু দিতে থাকে। অস্বস্তিতে  মেয়েটা দু হাত দিয়ে বুড়ো মুখটা সরিয়ে দিয়ে চকলেট খায়।
ইতিমধ্যে ইসহাকের  যৌন উত্তেজনা জেগে যায়, আর কয়েক মুহূর্ত মেয়েটি কোলে থাকলে সে হয়তো খেলাচ্ছলে অন্যভাবে যৌন স্বাদ মিটিয়ে নিতো। ইতিপূর্বে বহুবার সে একই পদ্ধতিতে  যৌন স্বাদ মিটিয়েছে। মেয়েটি ভেবেছে এটা খেলা এবং চকলেটের লোভে বারবার শয়তানটার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ বয়সে এর অধিক কিছু কল্পনা করার  ক্ষমতা  নেই  জবার।
এই বড় কাকা মেয়েটির প্রতিবেশী। নাম  ইসহাক,  পেশায় কাঠমিস্ত্রি।  স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে সাজানো সংসার। মেয়ে দুটোর বয়স আট ও দশ বছর। নাম নিশাত ও বিপাশা। জবা বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়াতে নিঃসঙ্গ। তাই   নিশাত ও বিপাশার সঙ্গ নেয়ার জন্য এবং ওদের সঙ্গে খেলার জন্য সুযোগ পেলেই ইসহাকের বাসায় চলে আসে। তিন মেয়ে মিলে যখন লুকোচুরি খেলে শয়তান ইসহাক সুযোগটা কাজে লাগায়। সে জবাকে তার কোলে লুকোতে বলে চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলে। সে সুযোগে জবার নিষ্পাপ শরীর  দুই বাহুর বেষ্টনে  নিজের দেহের সঙ্গে লেপ্টে ধরে  উত্তেজিত হতে থাকে। এক সময় তার মুখ দিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস  বের হয়, তার উত্থিত যৌনাঙ্গ অবুঝ মেয়েটার দেহের সঙ্গে ঠেসে দিয়ে যৌন ক্ষুধা মিটায়। জবা এসব জঘন্য কাজের কিছুই বোঝে না, সে ব্যাপারটাকে খেলা মনে করে মেনে নেয়। কোমলমতি কচি মেয়ের আর কী করার থাকে। দিনের পর দিন  এভাবেই চলতে থাকে।
শয়তান ইসহাক নিকটতম প্রতিবেশী হওয়ার  সুযোগে জবাকে লোক দেখানো স্নেহের বর্ষণে প্লাবিত করে মা-মণি বলে ডাকে। বাইরে থেকে ফিরেই নিজের দুই মেয়েকে না ডেকে জবাকে প্রথম আহ্বান করে- কই রে আমার জবা মা-মণি। অতঃপর চকলেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোলে তুলে নেয়, দুই বাহুর বেষ্টনীতে বুকের সঙ্গে  লেপ্টে ধরে গালে, ঠোঁটে চুমোতে থাকে। জবার মা-বাবা দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়, ভাবে এমন স্নেহশীল মানুষও হয়! তাই লোকটাকে বড় কাকা বলে সম্বোধন করতে জবাকে শিখিয়ে  দেয়। এদিকে জবার জন্য এত স্নেহ, ভালোবাসা দেখে ইসহাকের নিজের স্ত্রীর চোখ টাটায়,  মেয়েরা অভিমান করে। কিন্তু ইসহাকের প্রবল বিকৃত দৈহিক লালসার কাছে স্ত্রীর শ্যেন দৃষ্টি আর মেয়েদের অভিমানের কোনো মূল্য নেই।  সে এসবের পরোয়া করে না।
পাঁচ বছরের একটি কচি মেয়ের ছোট  শরীরে কী আছে? ও তো অবুঝ, নিষ্পাপ, পবিত্র  শিশু। সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে শিশুটি একজন ফেরেস্তা বা দেব-দূত। মেয়ে বলেই কি ওর শরীরের প্রতি হায়েনা ইসহাকের লুলোপ দৃষ্টি?  ওর শরীরের অঙ্গগুলো এখনও গড়ে ওঠেনি। ওর ব্যথা বোঝার অনুভূতি ছাড়া আর কোনো বোধশক্তি এখনও জন্মায়নি, ওর জননেন্দ্রীয় অপরিপক্ব, অনুভূতিহীন। স্পষ্টভাবে এখনও সে কথা বলতে পারে না। কিন্তু কুকুরের যেমন হাড্ডি আর মাংসের প্রতি লোভ, দূর থেকে দেখলেও কুকুরের জিহবা থেকে ফোটায় ফোটায় জল পড়তে থাকে, ইসহাকেরও লোভ ছোট্ট মেয়েটার প্রতি। দেখলেই জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোট চাটতে থাকে। কোমলমতি জবার লোভ চকলেটের প্রতি, তাই সে লোকটার আহ্বানে সাড়া  দেয়। নিশাত ও বিপাশার সঙ্গে খেলার নেশাও আছে তার, তখন ইসহাকের ডাকে নয়, নিজে নিজেই এ বাসায় চলে আসে।
সৃষ্টিকর্তার খেয়াল বড় বিচিত্র। তিনি আকাশে ঝলমলে প্রখর সূর্যালোকের পরই কালো  মেঘের অমানিশা সৃষ্টি করেন। সবার সম্মুখে অভিনীত আচরণে ইসহাক জবার পিতৃসম বড় কাকা, কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে আছে রক্তনেশাগ্রস্ত এক হায়েনার ভয়ঙ্কর, কুৎসিৎ লালসা। জবাকে কামড়ে, ছিঁড়ে-খুড়ে খাওয়ার এক দুর্বার ক্ষুধা।  সেই লালসা চরিতার্থ করার জন্য সে দিনের পর দিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে সুযোগ এলো। সেদিন দুই মেয়েকে নিয়ে মিসেস ইসহাক মেয়েদের স্কুলে গিয়েছিলেন, সে ছাড়া পুরো বাসায় কেউ নেই। এ সময় জবা এসে উপস্থিত হলো। হয়তো সে নিশাত ও বিপাশার সঙ্গে খেলার লোভে চলে এসেছে। এসে হায়েনার খপ্পরে পড়ে গেল। পাপিষ্ঠ ইসহাক খালি বাসার দরজা-জানালা বন্ধ করে ক্ষুধার্ত বাঘের মতো শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।  ছোট্ট মেয়েটার নাক, মুখ, গাল, গলা, কপোল, উরু, বিন্দুর মতো উঁকি দেয়া স্তন, অপরিপক্ব নিম্নাঙ্গ কামড়ে রক্তাক্ত করল। অতঃপর তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাল। যেন এক হিংস্র হায়েনা, উচ্ছিষ্ট হাড্ডি-মাংস পেয়ে পাগলের মতো চিবিয়ে খাচ্ছে। তফাৎ হলো মানুষ হায়েনা একটি জীবন্ত মানব শিশুর  হামাংস ছিঁড়ে-খুড়ে খাচ্ছে। চল্লিশোর্ধ মানুষ পশুটার  ভয়ঙ্কর বিকৃত ক্ষুধা পাঁচ বছরের শিশুর দেহের ওপর আছড়ে পড়ছে।
পশুদের মধ্যেও এমন কোনো পূর্ণ বয়স্ক প্রাণি নেই যে, ছানার ওপর যৌন অত্যাচার চালায়। কিন্তু চল্লিশোর্ধ বিকৃত যৌন-ক্ষুধার্ত ইসহাক পাঁচ বছরের পবিত্র শিশুকেও ছাড়ল না। তার উম্মত্ত বিকৃত ক্ষুধা নিজের কন্যাদ্বয়ের চেয়েও বয়সে অর্ধেক একটি শিশুর দেহকে বিষাক্ত দাঁতের কামড়ে রক্তাক্ত, সংজ্ঞাহীন করে ফেলে। দু-পায়ী পশু ইসহাকের উপর্যুপরি পাশবিক অত্যাচারে জর্জরিত, দলিত, মথিত ফুল-শিশুটি সংজ্ঞা হারিয়ে কোন শব্দ করতে পারছিল না। আর মানুষ পশুটা নেশায়, উম্মাদনায় ভুলেই গিয়েছিল যে তার স্ত্রী, কন্যাদ্বয় কিংবা জবার মা-বাবা মেয়ের খোঁজে তার বদ্ধ দুয়ারে এসে হানা দিতে পারে। কিন্তু কাকতালীয় ঘটনা ঘটে গেল। ইসহাকের স্ত্রী-কন্যাদ্বয় স্কুল থেকে ফিরে বদ্ধ দরজায় টোকা দিতে না দিতেই জবার মা-বাবা মেয়ের খোঁজে ইসহাকের বাসায় চলে এল। জবার মা মেয়ের মরণাপন্ন অবস্থা দেখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, মহিলার উচ্চৈঃস্বরে কান্নার আওয়াজে আশপাশের লোকজন জড়ো হলো। বিপদ আঁচ করে দু-পায়ী পশুটা পালাতে চেষ্টা করলে উপস্থিত জনতা তাকে আটকে ফেলল এবং তার জঘন্য কুকর্মের  প্রমাণ পেয়ে পশুটাকে মাটিতে ফেলে চড়, থাপ্পড়, লাথি মারতে লাগল। কেউ কেউ বলল, ‘শালার চোখ দুটো উপড়ে ফেলা উচিত, তাহলে কুনজর দিতে পারবে না, কেউ কেউ বলল, ‘বেটাকে নেংটা করে ঠেলা গাড়ির পেছনে বেঁধে পাড়া ঘুরানো উচিত।’ কেউ বলল, ‘ওর যন্ত্রটাই কেটে ফেলা দরকার, তাহলে আর এগোবে না।‘ কয়েকজন বলল, ‘পশুটার তো শাস্তি হবে না, জামিন পেয়ে যাবে, এজন্য কুত্তার বাচ্চাকে জানে মেরা ফেলা উচিত।’ এসব মন্তব্যের ফাঁকে উত্তম-মধ্যম ঠিকই চলছিল।

নিরীহ, সরল  জবার মা ও বাবা মেয়ের করুণ দশা দেখে আত্মখেদে নিজেদেরকে চরম অপরাধী বলে মনে করতে লাগল। কী কুক্ষণেই না ওরা ওই কুত্তাটাকে বড় কাকু বলে সম্বোধন করতে  মেয়েকে শিখিয়েছিল! তাদের আক্কেল, জ্ঞান কী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল? জবার মার  অশ্রুপাত ও আহাজারিতে শহরতলীর খোলা হাওয়া যেন বিষাক্ত, ভারী হয়ে উঠল। আর  নিরীহ গো-বেচারা জবার বাবাও ক্রেধে, ক্ষোভে কুত্তাটার শরীরে দুই চার লাথি লাগালেন।
মানুষ হয়ে পশুর কাজ করলে তার আপনজনরাই বেশি আঘাত পায়, চোখের মণি তখন চক্ষুশূলে পরিণত হয়, কলজের টুকরা মাটির ঢেলায় রূপ নেয়। সবচেয়ে বিব্রত, মর্মাহত ও লজ্জিত ইসহাকের স্ত্রী ও দুই মেয়ে একটি কক্ষে কপাট লাগিয়ে সেই যে আত্মগোপন করেছিল সারা রাত, সারা দিন আর বের হয়নি। ওরা আর জন্তুটার চেহারা  দেখতে চায় না, এ রকম খাটাস জানোয়ার যে ওদেরই ঘরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল তা এরা জানতো না। জনগণ জানোয়ারটাকে পিটিয়ে মেরে ফেললে ওরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। পাড়ার কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি খবর শুনে মানুষরূপী পশুটাকে দেখতে এলেন। দেখে তাদের উপলব্ধি স্তব্ধ হয়ে  গেল। চল্লিশোর্ধ একটা জোয়ান, তাগড়া পুরুষ পাঁচ বছরের মেয়েকে উপর্যুপরি বলৎকার করেছে, এ যে বিশ্বাস করা ভার। প্রবীণতম সাত্তার সাব ইসহাকের নিতম্বে সর্বশক্তি দিয়ে ডান পায়ের একটা লাথি মেরে বললেন, “শালা, তুই তো কাঠমিস্ত্রি, কাঠ দিয়ে ওই মেয়ের সমান একটা কাঠের মেয়ে বানিয়ে একটি ছিদ্র গড়ে নিলি না কেন? ওই কচি মেয়ে আর কাঠের মেয়ের মধ্যে কি তফাৎ, ওর শরীরের অঙ্গগুলো এখনও গড়ে ওঠেনি। ওর ব্যথা বোঝার অনুভূতি ছাড়া কোনো বোধশক্তি নেই, স্পষ্টভাবে এখনও সে কথা বলতে পারে না। তুই শালা এত বিকৃত উম্মাদ কেন? বলেই তিনি আরও শক্তি দিয়ে পাছায় একটি লাথি মেরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন, একজন তাকে ধরে ফেলল। প্রাণে মারলে পাড়া-পড়শিকে থানা-পুলিশ-আদালত করতে হবে,  কে সে ঝামেলা কাঁধে নেবে, তাই বয়োজ্যষ্ঠগণ সিদ্ধান্ত নিলেন ইসহাককে থানায় সোপর্দ করা হবে। রাতে পশুটাকে একজন মুরুব্বীর বাসায় এক রুমে তালাবদ্ধ করে রাখা হলো। পরদিন দল বেঁধে পাড়ার ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে উল্লাস করে পশুটাকে কোরবানির গরুর মতো তাড়িয়ে থানায় নিয়ে গেলেন। ক্ষুধা তৃষ্ণায় দুর্বল মানুষরূপী পশুটা হাঁটতে পারছিল না, কিন্তু সেদিকে কারুর ভ্রূক্ষেপ ছিল না। সঙ্গে গেল জবার বাবা, তাকে থানায় মামলা করতে হলো।
থানাহাজতে আসামির জন্য খাবার, পানি, চাদর, বালিশ এসব নিয়ে স্বজনদের কেউ না কেউ পুলিশের দ্বারস্থ হয় এবং পৌঁছানোর জন্য পুলিশ দক্ষিণা পায়। কিন্তু ইসহাককে দেখতে কেউ এলো না। ফলে পুলিশের মেজাজ খারাপ, তদুপরি বেটা বারবার এসে খাবার চাচ্ছে। তাই পুলিশও বন্দুকের বাট দিয়ে কয়েক ঘা লাগাল। শৌচাগারের মলমূত্রের তীব্র দুর্গন্ধ, হাজতখানার রক্তখেকো মশার  কামড়, পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধায় ইসহাক ছটফট করছিল। দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে এক সময় প্রবেশদ্বারের আড়ালে মেঝেতে  নিরিবিলি একটি জায়গা পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অঘোর ঘুমে সে স্বপ্ন দেখল জনতা তাকে বেদম পিটাচ্ছে, মারের চোটে সে রাস্তায় নেতিয়ে পড়েছে।  সে মুহূর্তে জবা সেখানে উপস্থিত হয়ে সবাইকে বলছে “প্লিজ, আপনারা বড় কাকাকে মারবেন না, ও  তো আমাকে চকলেট দেয় আর অনেক আদর করে।” ইসহাকের অবচেতন মন জানে যে সে জবার ওপর নির্দয় অত্যাচার করেছে, তারপরও জবা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে, এ তো অভাবিত, কল্পনাতীত ব্যাপার। ইসহাকের ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখল পুলিশ তাকে রাইফেলের বাট দিয়ে গুঁতো দিচ্ছে আর বলছে, “ওই শালা, এটা কি শ্বশুর বাড়ি  পেয়েছিস, সরে যা, নিজের জায়গায় গিয়ে ঘুমা। প্রবেশ পথ ঘুমাবার  জায়গা নয়।” ইসহাক নিঃশব্দে, আস্তে নিজেকে সামলে নিজের জায়গায় সরে গেল।  সে রাতে  সে আর ঘুমোতে পারল না। স্বপ্নের দৃশ্যটি তার মন থেকে কোনোক্রমেই সরতে চাচ্ছে না। একটি অসহায় কচি মেয়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানোর জন্য এই প্রথমবার তার মনে অনুতাপ জাগলো।
আদালতে ইসহাক অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছিল। হাতেনাতে ধরা পড়ায় ঘটনার সাক্ষীরও অভাব হলো না। ডাক্তারি রিপোর্টেও অপরাধের সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। সবকিছু বিবেচনা করে বিজ্ঞ আদালত নিরপরাধ কচি মেয়ের ওপর মানুষরূপী পশুটার নির্মম নির্যাতনকে সমাজে মরণাত্মক বিষ বাষ্প হিসেবে গণ্য করলেন। রায়ে লিখলেন সমাজে এ ধরনের বিষধর সরীসৃপের অবাধ বিচরণ থাকলে আরও বহু নিরপরাধ, অসহায়, কচি মেয়ের সর্বনাশ এমনকি মৃত্যুও  হতে পারে। তাই ইসহাককে বিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে শোধরানোর সুযোগ দিলেন।
সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামিদের কারাগারের জীবন বড় কষ্টের। সারা দিন ইসহাককে দিয়ে মেহনতের কাজ করালেও  তার জন্য খাবারের বরাদ্দ থাকে বিনাশ্রম  কয়েদিদের মতো। ঘুম থেকে উঠেই ইসহাককে নির্দিষ্ট কাজে লেগে যেতে হয়, শৌচকর্ম,  গোসল, খাবার ও ঘুমানোর ছুটি ছাড়া আর কোনো বিরতি নেই, সারাক্ষণ কাজে লেগে থাকতে হয়। ইসহাকের বড় কষ্ট, এখানে থালা হাতে লঙ্গরখানার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় একথালা ভাত আর সামান্য তরকারি, ডালের জন্য। স্ত্রীর হাতের রান্না করা হরেক রকম মজাদার খাবার এখানে নেই, অথচ সারা দিন কাজ করতে হয়। কিন্তু মানুষ অভ্যাসের দাস, দু বছরের মধ্যে সব কষ্ট ইসহাকের গা-সহা হয়ে গেল, তার শরীর কৃশ হলো, দেহের শক্তি হ্রাস পেল। যে উম্মত্ত যৌন ক্ষুধায় সে একটি  অসহায় কচি শিশুর পবিত্র দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়েখুড়ে খেয়েছিল সেই ক্ষুধা আর নেই। ইসহাক আর একবার অনুতপ্ত হলো, সে অনুধাবন করল জবার প্রতি সে অন্যায় করেছে, তার কারাদণ্ডের প্রয়োজন ছিল, নতুবা হয়তো সে কখনও শোধরাতো না।
অনুতপ্ত ইসহাকের আচরণে, ভদ্রতার উপস্থিতি দেখে কারা কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সাধারণ কয়েদিদের থেকে পৃথক করে অন্য এক কোনে একটি বিছানায় স্থানান্তরিত করল। সেখানে একই অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত দুজন কয়েদি ছিল, একজন মুক্তি পেয়েছে।  সেই সিটটি ইসহাককে বরাদ্দ করা হলো। নির্বিঘ্নে ঘুমাবার জন্য বহু কয়েদির এজমালি বিছানা থেকে এটি নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক। প্রথম রাতে ইসহাক ভোরের ঘণ্টা বাজা পর্যন্ত লম্বা ঘুম দিল। এ রকম গভীর, নির্বিঘ্ন ঘুমের স্বাদ সে কারাগারে কোনো দিন পায়নি। দ্বিতীয় রাতে তার বিছানা সঙ্গী এগিয়ে এসে গল্প করতে লাগল। ঘন, কালো দাড়িভরা মুখ, লম্বা, সুঠাম, দেহের মানুষটা মহিষের মতো দেখতে। সে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুপার ছিল। একাধিক কিশোরের ওপর দিনের পর দিন বেবিচার করে অবশেষে ধরা পড়ে। বিজ্ঞ আদালত তাকে তিরিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড  দেন। মাত্র চার বছর পার হয়েছে। সে তার কৃত অপরাধের জন্য মোটেই অনুতপ্ত নয়, পালের ষাঁড়ের মতো সদর্পে ঘুরে বেড়ায় আর দুর্বল কয়েদিকে নিজের দেহের শক্তির ভয় দেখায়। ইসহাককে সে জিজ্ঞেস করল ‘ কি রে, কটা শিকার করেছিস?’ অনুতপ্ত, ইসহাক এসব আলোচনায় এগোতে নারাজ, সে বলল, ‘ভাই এ সব কথা বাদ দেন, আপনার কত বছরের সাজা হয়েছে, আমার হয়েছে বিশ বছরের।’ লোকটা এগিয়ে ইসহাকের কাঁধে হাত রেখে নিজের শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আদরের সুরে বলল, ‘আরে বল না দোস্ত, কাউকে জানাবো না, এখানে তো তুই আর আমিই।’ ইসহাক বলল, ‘একটা।’ উত্তর শুনে লোকটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, ‘মাত্র একটা, তুই তো শালা নবিস, আমার জানস্‌ কয়টা, ডজন ডজন। আমি তো কচি মাংসের ডিনার ছাড়া রাতে ঘুমাতেই পারি না ’। ইসহাক এসব আলোচনাতেই যেতে চায়না,  সে বলে ‘দেখেন ভাই, আমাদেরকে জেল দেয়া হয়েছে শোধরানোর জন্য, মন থেকে এসব পাপ চিন্তা দূর করেন।’ ক্রোধে লোকটা ইসহাককে ধাক্কা মারলো।
ভোর রাতে গভীর ঘুমে ইসহাক স্বপ্ন দেখল একটা ভারি মোটা সাপ তার হাত-পাসহ পুরো শরীর সাঁড়াশির মতো পেঁচিয়ে ধরেছে, সাপের মুখটা জবার মুখের আদলে গড়া। সমস্ত শক্তি দিয়েও সে সাপের বেড় থেকে ছুটতে পারছে না। ইসহাকের ঘুম ভেঙে গেলে পায়ূপথে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল। তখনই শরীরের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে নিজকে মুক্ত করল। এ মুহূর্তে মনে পড়ল ঠিক এভাবেই সে জবাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে সমস্ত শরীর কামড়ে, খামচে রক্তাক্ত করে উপর্যুপরি বলৎকার করছিল। তখনকার তার শ্বাস-প্রশ্বাস এবং আজকের মহিষের মতো লোকটার শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। নিঃশব্দ কামরায় দুটোই ফনা তোলা সরীসৃপের হিস হিস শব্দের মতো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status