ঈদ আনন্দ ২০১৮

গল্প

গ্রেপ্তার

কারু তিতাস

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৪:২৪ পূর্বাহ্ন

সচিত্রকরণ: কাদিমুল ইসলাম যাদু

ফরিদপুর শহরে সবচেয়ে বড় যৌনপল্লী দৌলতদিয়ার রথখোলা। সারি সারি ছোট ছোট স্যাঁতসেঁতে ঘর। গোটা পল্লীজুড়ে দেশি মদের উৎকট গন্ধে গা ঘিনঘিন করে। নানা মাদকের জমজমাট ব্যবসা এখানে। ঠোটে কড়া গোলাপি লিপস্টিক মেখে ঘরে ঘরে দাঁড়িয়ে থাকে মাজেদা, কবিতা, শেলী, শেফালী, জুলেখারা। এমন এক কুৎসিত অন্ধকারে বিপু কীভাবে যেন জন্ম নেয়। এখানে জন্ম নেয়া সন্তানের বাবা থাকে না।
বিপু এখন বারো পেরিয়ে তেরো বছরের কিশোর। মায়ের মতো গায়ের রং মায়ের মতই দেখতে ভারি মিষ্টি এক কিশোর। বিপু তার অন্য বন্ধুদের মতো চঞ্চল হাসিখুশি না। কেমন যেন একটু চুপচাপ। সারাক্ষণ মায়ের আঁচলে থাকতে চায়। কিন্তু মায়ের আঁচলে তেমন থাকা হয় না বিপুর। মায়ের পেশা আজ বিপু বুঝতে পারে। খদ্দের এলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। বেশি দূরে যায় না, ঘরের দরজার সামনে বসে থাকে। বিপু স্কুলে যায়। লেখাপড়া করতে চায়। জুলেখাও চায় ছেলে একটু লেখাপড়া করুক। স্কুলের সময়টা ছাড়া বিপু বেশির ভাগ সময় দরজার সামনে বই-খাতা নিয়ে বসে থাকে। এলাকার মাস্তান কাল্লু বিপুকে দেখে একদিন বলে, বেশ্যার ছেলের আবার লেখাপড়া, শালা! বিপু হিংস্র বাঘের মতো কাল্লুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বলে, শালা খবরদার আমার মাকে বেশ্যা বলবি না। ছেলের চিৎকার শুনে জুলেখা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কাল্লুর পায়ে ধরে বলে, ভাই এবারের মতো মাফ করে দে, আজ আয়, তোরে টাকা দিতে হবে না। বিপু তখন রক্তাক্ত। বিপুর সঙ্গে এমন প্রায়ই হয় পল্লীতে।
কেরামত ফরিদপুরের বিশিষ্ট সোনার ব্যবসায়ী। জুলেখার বান্ধা কাস্টমার। প্রতি রাতে লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরে চলে আসে জুলেখার ঘরে। জুলেখার ইচ্ছে না থাকলেও উপায় নেই। কেরামতের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিয়েছে জুলেখা। হাজারে একশ টাকা। প্রতি মাসে টাকা দিচ্ছে শরীর দিচ্ছে! তাও টাকা শোধ হয় না।
আজ জুলেখার একশ তিন ডিগ্রি জ্বর। বিপু পানি ঢালছে মাথায়। রাত তখন দশটা বাজেনি, শীতের রাত, মনে হয় অনেক রাত। এমন সময় কেরামত দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। দেশি মদের গন্ধে বিপুর বমি ঠেলে আসে। বলে, আজ মার খুব জ্বর, আজ আমি মার কাছে থাকবো। কেরামত ধাক্কা দিয়ে বিপুকে বের করে দেয়।
বিপু দরজার ওপারে বসে সারা রাত মায়ের আকুতি শোনে। আজকের মতো আমাকে মাফ করো কেরামত, তোমার পায়ে পড়ি, আজ আমারে ছাড়ো! আজ আমি পারবো না, আমি মরে যাবো...! চোপ... বিচ্ছিরি খিস্তি দিয়ে ওঠে কেরামত। বিপুর মায়ের কান্না আর আর্তনাদ শোনে সারা রাত।
শেষ রাতের দিকে বিপুর যেন কেমন হয়ে ওঠে। বিপুর চোখে পানি টলটল করে। মায়ের কান্না বিপু আর সহ্য করতে পারছে না। শীতের রাত পল্লী তখন কিছুটা শান্ত। বিপু বাইরে বেরিয়ে আসে। কুকুরগুলো নিশি পাওয়া ঘুমে, ঘন কুয়াশায়ও দূরের
চায়ের দোকানে কারা যেন চা খাচ্ছে। বিপু ঘরের পেছন থেকে মাটিতে ডেবে থাকা একখানা আস্ত ইট তুলে আনে।
ফজরের আজান শেষ হলো এক্ষুণি। জুলেখার ঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। বিপু অপেক্ষা করে হালকা অন্ধকারে। কেরামত দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। কেরামত একটা চিৎকার দিয়ে বাইরের অন্ধকারে লুটিয়ে পড়ে। জুলেখা কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসে। বিপুর হাতে রক্তাক্ত ইট। মায়ের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে বিপু!!! জুলেখা দ্রুত ঘর থেকে ছুরি নিয়ে আসে। কেরামতের রক্তাক্ত থেঁতলানো মাথা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে অন্ধকার। জুলেখা সজোরে ছুরি বসিয়ে দেয় কেরামতের বুকে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে জুলেখা। বলে, তুই কোনো কথা বলবি না।
কুয়াশা না কাটলেও সকাল হয়। কেরামতের ডেডবডি আগেই নিয়ে গেছে পুলিশ। এখন জুলেখাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দূরের বড় রাস্তায় পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে। পুরো পল্লী কেমন যেন স্তম্ভিত! হাতকড়ার দড়ি পুলিশের হাতে, বিপু দুই হাতে শক্ত ধরে আছে মায়ের আঁচল। বিপু মায়ের পিছে পিছে হাঁটছে।
জুলেখা এখন পুলিশ ভ্যানে। পুলিশ ভ্যান চলতে শুরু করে। বিপুর হাত থেকে মায়ের আঁচল ছুটে যায়। ধীরে ধীরে পুলিশ ভ্যান এখন অনেক দূরে। বিপু আর দেখতে পাচ্ছে না জুলেখাকে। তাও বিপু দৌড়াচ্ছে পিছে পিছে। চারদিকে ঘন কুয়াশা। বিপু যেন নিজেকেও আর দেখতে পাচ্ছে না। আসলে এমন কুয়াশায় কিছুই দেখা যায় না। 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status