ঈদ আনন্দ ২০১৮

বিশেষ রচনা

সব দিকই ঘিরে ফেলা

অধীর বিশ্বাস

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৪:২১ পূর্বাহ্ন

বৌমাকে কেমন লাগছে যেন! আজ যেন বিধবার গড়ন নিয়ে এসেছে। বিয়েতে-পাওয়া দুল ছিল না? দেখছি, কান খালি। শাদাটে শাড়ি। কেমনই লাগছে। এক সময় হঠাৎ করেই বৌমা বলল, কাকিমা, আপনি রান্নার মেয়েকে কত দেন?
যেন কথার কথা। বাড়ির লোক জানতে চাইছে। খুকু টাকার অঙ্ক বলল।
পরে কী ভেবে আবার বলল, ও কাকিমা, একটা কথা বলব?
‘বল!’
যদি সাইকেলে এসে আমিই রান্নাটা করে দিই!
নাতি-নাতনি মেঝের ওপর দুষ্টুমি করছে। নাতির পাঁচ। বয়স বেড়েছে। মানসিক মান খুব দুর্বল। ওর বলা কথা ঠিক বোঝা যায় না। মেয়ের তিন বছর। ওদের বাবা, মানে, আমার ভাইপো কলকাতার বড় খবরের কাগজে কাজ করত। তেরো বছর পর ছাঁটাই হলো। মা নিয়ে পাঁচ জন। কাজ চলে যাওয়ার পর বৌমা ব্লাউজ সেলাই করে। সেলাই মানে, হেম-করা হুক-লাগানো। জামাকাপড় বিক্রি করে ভাইপো। ঘুরে ঘুরে। বইয়ের দোকানে কাজ করে বিকেলবেলা।
কথাগুলো বলে ঠিক হয়নি বোধহয়। না হলে কেন এমন চোখমুখ হবে? সে জন্যেই কি মিটিমিটি হাসিতে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, কিছু মনে করলেন, কাকিমা!
খুকু, মানে আমার বউ, উত্তর দেয়নি। এড়িয়ে গিয়ে অন্য কথায় চলে গেল সে। অনেক কথা। নাতিপুতিদের সঙ্গেই সময় কাটাই আমি। কিন্তু কথাটা এড়ায়নি।
এমনিই বুঝি বেড়াতে আসা ওদের। দাদুভাইয়ের পোশাক এমন কেন? পুরনো জামাপ্যান্ট দিয়েছে কেউ? তাই ঢোলঢোলা?
নাতনি মুখে আঙুল দিয়ে বার বার মায়ের কাছে যাচ্ছিল। বৌমা বলে, দাদু ডাকছে তো- যাও!
অনেক কিছু মনে আসে। বলতে পারি না। কী বলতে কী বলি, এই ভয়। পরে খুকুই ধরবে। ভুলের জন্য কথা শুনতে হয় যদি! তাই ওদের সঙ্গেই-। ‘বৌমা, শিঙাড়া খাবে?’
‘থাক, আনতে হবে না, কাকা!’
কেন বলল? অভাব কখনও কি পক্ষ নিয়ে ফেলে? চাইতে মানা করে? হোক না কাছের! নিয়তি যখন নিজের। এই ভোগ দু:খ পরিবার নিয়েই করে যেতে চায়- তেমন কিছু? তার জন্য ‘না’?
এ বার যাওয়ার পালা। বেরিয়েও গেল গেট খুলে। দাঁড়িয়ে থাকি। বললাম, টা টা!
রাতের আলোয় গাছ আর বাড়ির ছায়া ওদের গায়ে। যেন দুটো খেতে এসেছিল। ছেলেমেয়ে নিয়ে। নিজেরও হবে তাতে। খুকু কিছু বলল না। কেন বলল না? বিস্কুট নাতিছেলে খেতে চাইল না। বিস্কুট পড়েই থাকে। আর কিছু চাইতে পারেনি। ওই যে, রাস্তায় উঠে দাদুভাই মায়ের কাপড় ধরে কিছু বলছে হয়তো। বার বার। হঠাৎ ঠাস শব্দ! মারল?
গেট পেরিয়ে যাব, খুকু বলল, থাক। ঘরে এসো বলছি।
ওরা বোধহয় গলি পেরিয়ে চার রাস্তার মোড়ে। ছায়া-অন্ধকারের গেটে দাঁড়িয়ে খুকু বাড়ির কথা, বৌমা কেন এসেছে, এ সবই বলছিল।
‘একটু আসছি।’
 ‘কোথায় যাচ্ছ? ওদের বাড়ি?’
‘না। হেঁটে আসি।’ যেখানে দাদুভাই ঠাস-শব্দে চড় খেয়েছিল, সেই বাপিদের বাড়িটা পার করে ফেলি। পাঁচিলঘেরার আমের ডাল রাস্তায় এসে আরও অন্ধকার করে ফেলেছে। দাঁড়িয়ে থাকি একটুক্ষণ। থাকতে ভাল লাগছে। জন-পরিজন ছেড়ে আরাম একটু। পা চলল ফের। যেতে চাইছি কোথাও? বৌমারা কি পৌঁছল?



এক এক করে পার করে দিচ্ছে বাবা। মাগুরা টাউনের দোকানটায় হ্যাজাক জ্বলে যখন, দূর থেকে চকচক করে। বড়দার দোকানদারি, দাদাভাই বিস্কুটের বয়াম। কাগজে বানানো সূর্যমুখী ফুলটাকেও ঝুলতে দেখি।
কিন্তু না। এমন বেশি দিন আর দেখিনি। বাকি পড়ে পড়ে সেই দোকান চলল না। মাল কেনার টাকা নেই। হ্যাজাকের তেল খরচও বেশি। দোকানে টুমটুমি চোদ্দ-লাইট। এসব দেখতে মন চাইত না। বাবা বলল, কালিদাস, ইন্ডিয়া যাবি?
বড়দাও এমন কিছু চাইছিল বোধহয়। তারপর সত্যি একদিন পালিয়ে গেল। পাড়ার লোকে খোঁজ করে। বাবা বলে, ও দৌলতপুর কাপড়ের মিলে কাজ করে। দৌলতপুর কোন জেলা যেন? হঠাৎ একদিন সকাল থেকে মেজদাও নেই। বাবা শিখিয়ে দেয়, বললে বলবি, দাদা ঢাকায় কাজ পেয়েছে।
এমন করেই দেশছাড়া আমাদের। ছোট বলে সব কিছু জানাত না। আমিও এক দিন এ ভাবেই চলে যাব।
তাই হল। ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেণ্ট। আকাশে হেলিকপ্টার। সেই সময়ের একদিন ভোরবেলা সেজদা নিয়ে চলল। ইন্ডিয়া যাচ্ছি। যদি কেউ দেখে ফেলে, যদি বলে ফেলি সত্যি কথাটা! পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।
শুধু দুই ভাইপো। কানাই প্রশান্ত। আর রইল বৌদি আর বাবা। তারাও এসে গেল কলকাতা। যে ভাইপোর চাকরি গেল, যে বৌমা এসেছিল সে দিন, সে প্রশান্তরই বৌ। ওর বাবা, মানে, আমার বড়দা গলায় দড়ি দিল। পুলিশ খোঁজ করল। পাড়ার লোক জানায়, অন্য কিছু না। খুব অভাব ছিল এদের। এতগুলো মানুষ, খাওয়া জোটে না, তাই্ত। পুলিশ চলে গেল।
এই তো কিছু দিন আগে কথার মধ্যে কথা এনে প্রশান্ত বলল, কাকা, দেশের বাড়ি দাদুদের কেউ আছে?
‘কেন?’
‘এমনি!’
‘এমনি না, কিছু ভেবেই বলছিস!’
মিটি দিয়ে হাসে ও। বলে, আমরা যদি বাংলাদেশে যাই, যাওয়া যাবে? দেশের বাড়ির মাগুরার হাটে একটা দোকান দেওয়া যাবে?
ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারি না। শুধু বলি, ভুলভাল কী বলছিস!
আর কিছু বলে না প্রশান্ত।
আমারও কিন্তু মনে হয় এমন। ভাইপোর কথা শুনে কেমন হয়ে আছি কদিন। সেই সাতষট্টির মতো হাউড়-জঙ্গল পার হয়ে যাচ্ছি যেন। আবার ফিরে যাচ্ছি আমাদের গ্রামে। শুনেছি, দু-দেশের সীমানা দিয়ে নাকি কাঁটাতার বেড়া। কিন্তু সব দিকটাই ঘিরে ফেলা হয়েছে?

‘মাটির বাড়ি’
ওঙ্কার পার্ক ডাক ঘোলাবাজার
কলকাতা ৭০০ ১১১
[email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status