ঈদ আনন্দ ২০১৮

ভ্রমণ

বিশ্বের অবাক বিস্ময় ঊনকোটির প্রস্তর ভাস্কর্য

পরিতোষ পাল

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৪:১৮ পূর্বাহ্ন

উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরা। বাংলাদেশ দিয়ে ঘেরা তিন দিক। ত্রিপুরা অর্থ তিন শহর। গ্রিক শব্দ ত্রিপোলিসের মতো। অনেকের মতে, ‘ত্রিপুরি’ থেকেই হয়েছে ত্রিপুরার নামকরণ। আবার ত্রিপুরেশ্বরী দেবীর নাম থেকে এসেছে বলেও মনে করা হয়। তবে ত্রিপুরার প্রাচীন নাম ছিল কিরাট। মহাভারতেও এই কিরাট রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। দীর্ঘ সময় ত্রিপুরা ছিল রাজশাসনে। ত্রিপুরার রাজারা ছিলেন ত্রিপুরি উপজাতির মানুষ। এদের ভাষা হলো কগবরক। কগবরক ভাষায় ত্রিপুরা পরিচিত টুইপ্রা নামে। অর্থাৎ টুই মানে জল, আর প্রা মানে কাছাকাছি। ত্রিপুরা নামের সঠিক ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে। হিল টিপ্পেরা নামে এটি বৃটিশ আমলে স্বাধীন  হিসেবে পরিচিত ছিল।
ত্রিপুরার আধুনিক রাজারা ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমঝদার। ফলে বাংলার সঙ্গে ছিল গভীর যোগাযোগ। রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার সেখানে গিয়ে ত্রিপুরার রাজাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। রাজাদের উদার মানসিকতার কারণেই বাংলাভাষা ত্রিপুরায় বহুদিন আগেই রাজভাষার মর্যাদায় অভিষিক্ত।
পঞ্চদশ শতকে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের যে কুলপঞ্জি রচনা করা হয়েছিল সেই ‘রাজমালা’য় বংশপরম্পরায় ১৭৯ জন রাজার উল্লেখ করা হলেও নাম পাওয়া গিয়েছে মাত্র ৩৩ জন রাজার। প্রথম রাজা ছিলেন রত্নমাণিক্য। ১৪৬৪ থেকে ১৪৮৩ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছিলেন। সেই সময় ত্রিপুরার রাজধানী ছিল উদয়পুরে। ১৮৮০ সালে মহারাজা বীরমাণিক্য রাজধানীকে নিয়ে আসেন আগরতলায়। ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরার মহারানি কাঞ্চনপ্রভা দেবী ত্রিপুরাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। প্রথমে স্বাধীন ভারতে এটি ছিল কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। পরে ১৯৭২ সালে এটিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়।
ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরা পাহাড় জঙ্গল আর সমতলের সমন্বয়ে ভারতের এক কোনে নির্জনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাঁচটি পাহাড় শ্রেণি রযেছে ত্রিপুরায়। পাহাড় ও টিলার আধিক্য থাকলেও ত্রিপুরার চারদিকে সবুজের ঢল। প্রকৃতি সবুজ চাদর বিছিয়ে রেখেছে পাহাড়ের কোলেও। ত্রিপুরায় অনেক কটি নদীও রয়েছে। খোয়াই, ধলাই, মনু, জুরি, লোঙ্গাই নদী বয়ে গেছে উত্তর দিকে। আর গোমতী গেছে পশ্চিম দিকে। অন্যদিকে মহুরি আর ফেনী বয়ে গিয়েছে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে। সব কটি নদীই চলে গিয়েছে প্রতিবেশি বাংলাদেশে।
ত্রিপুরা ভারতের তৃতীয় ছোট রাজ্য। অন্য দুটি ছোট রাজ্য হল গোয়া ও সিকিম। ত্রিপুরার আয়তন মাত্র ১০৪৯১ বর্গ কিলোমিটার। এই রাজ্য সফরে যাবার কথা মনে উঁকি দেয়া মাত্রই প্রস্তুতি সেরে ফেলেছিলাম। তবে সেই প্রস্তুতিতে কেউই জানান নি যে, ত্রিপুরার বুকে রয়েছে এক অবাক করা বিস্ময়। আমরা আমাদের সফরের মাঝপথে এসে দাঁড়িয়েছিলাম সেই অবাক বিস্ময়ের মুখোমুখি। আমরা আসার আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। ফলে চারিদিকে সবুজের মাখামাখি আরও বর্ণময় হয়ে উঠেছিল। আর সেই বৃষ্টিভেজা পাহাড়ে ঊনকোটির সেই অপরূপ প্রস্তর ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে ভেবে চলেছি, কীভাবে তৈরি হয়েছিল এগুলি, অসামান্য প্রতিভার অধিকারী কোন শিল্পীরাই বা তৈরি করেছিল পাহাড়ের দেয়ালে মূর্ত করে তোলা ভাস্কর্য। ভারতের সবচেয়ে বৃহৎ প্রস্তর ভাস্কর্য হিসেবে পরিচিত ঊনকোটির এই ভাস্কর্য্য।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ১৭৮ কিলোমিটার দূরে এবং উত্তর ত্রিপুরার প্রধান শহর কৈলাশহর থেকে আট কিলোমিটার দুরে জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ে মুখ লুকিয়ে রেখেছে ঊনকোটি। আর এই ঊনকোটির পাহাড়কে বলা যায় অনুপম শিল্প শৈলির ভান্ডার। শিল্পের ভাষায় এগুলিকে বলা হয়, বাস রিলিফ স্কাল্পচারস। বেশ খানিকটা দূর থেকেই নজরে পড়ে এই শিল্প সম্ভারের। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে এবং পাথর কেটে গড়ে তোলা হয়েছে হিন্দু দেবদেবীর অসংখ্য মূর্তি ও ভাস্কর্য। গোটা পাহাড়টিকে ক্যানভাস করে এক অজানা শিল্পীর দল সৃষ্টির গভীর মগ্নতায় রূপ দিয়েছেন। পাহাড়ের গায়ে সাজানো দেবদেবীর মূর্তির মাঝখানে অধিষ্ঠান শিবের। তিরিশ ফুট উচ্চতার এই শিবের মূর্তির (এটিকে ঊনকোটিশ্বর কাল ভৈরবও বলা হয়) মাথায় রয়েছে ১০ ফুট উচ্চতার উষ্ণিষ। আর শিবের মাথার এক পাশে রয়েছে সিংহবাহিনী দুর্গা, অন্য পাশে মকরে উপবিষ্ট গঙ্গা দেবী। এছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাহাড় গাত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আরও অনেক দেবদেবী, হনুমান, নন্দীর ষাড়, রাবণ প্রভৃতিকে।
এই সব প্রস্তর ভাস্কর্যের এক পাশ থেকে নেমে এসেছে জলের ধারা। এই ঝরণাধারা এসে পড়েছে একটি কুন্ডে। নাম অষ্টমী কুন্ড। এই কুন্ড থেকেই যাত্রা শুরু করেছে ত্রিপুরার দীর্ঘতম নদী মনু।
পাহাড়ের এক জায়গায় পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে সুবিশাল গণেশ মুর্তি। পাশে আরও কয়েকটি গনেশ মূর্তি রয়েছে। এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ গণেশ মুর্তি এটি। পাহাড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আরও অনেক শিল্পকীর্তি।
সাধারণ মানুষের দেখার সুবিধার জন্য তৈরি সিঁড়ি ধরে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম দুই পাহাড়ে ছড়িয়ে থাকা এই সব সৃষ্টিকে। আর ভাবছিলাম এক সময় হয়তো এখানে ঘণ্টা বাজত, ধুপের গন্ধে চারদিক মোহিত হয়ে থাকত। দুই পাহাড়ের সংযোগকারী সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ভাস্কর্যগুলোকে দেখতে দেখতে এক অন্য রাজ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম। মনের গহনে একটিই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এত উচ্চতার শিল্প সৃষ্টির পিছনে যে দক্ষতা কাজ করেছে তারা কোথা থেকে এসেছিল।

স্থানীয় মানুষ জানিয়েছেন, আরও অনেক মূর্তি ও ভাস্কর্য সময়ের আবহে পাহাড়ে মাটির নিচে চাপা পড়ে রয়েছে। ধ্বংস হয়ে গিয়েছে মন্দিরও। সামান্যই উৎখনন করা হয়েছে। ঊনকোটির পাহাড়ের সাজানো ভাস্কর্য পেরিয়ে কয়েকশ’ ফুট উপরে উঠে এই রকমই ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি মন্দিরের মেঝে দেখেছি। সেখানে এখন একটি পুজো অর্চনার ব্যবস্থা করে তৈরি হয়েছে ঘর। দুজন সাধুও রয়েছেন সেখানে। শোনা যায়, এরা ছিলেন দুর্ধর্ষ ডাকাত। এখন সাধু হয়ে ঊনকোটিতেই অবস্থান।
ইতিহাসবিদদের মতে, দীর্ঘদিনের অবহেলা ও মনোযোগের অভাবের ফলে নষ্ট হয়ে গেছে অনেক সৃষ্টি। তবে এখনও মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে অনেক অজানা সৃষ্টি। তবে হেরিটেজ হিসেবে এটিকে দেখভালের দায়িত্ব ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হাতে তুলে দেওয়ার পর অবস্থার খানিকটা উন্নতি হয়েছে। তবে নতুন করে উৎখননের কোনও কাজ হয়নি। ভারত সরকার কিছুদিন আগে ইউনেস্কোর কাছে এটিকে ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আরজি জানিয়েছে।
ঊনকোটি মানে এক কম এক কোটি। এই নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা লোককথা। স্থানীয় আদিবাসীরা মনে করেন, কাল্লু কুমার নামে এক মৃৎশিল্পী ও ভাস্কর এসব ভাস্কর্যের রূপকার। আর তাই অনেকে এটিকে কাল্লুর ঊনকোটিও বলে থাকেন। এই নামে একটি বইও রয়েছে। প্রচলিত লোককাহিনীটি হলো- পার্বতীর একনিষ্ঠ ভক্ত কাল্লু শিব ও পার্বতীর সঙ্গে তাদের বাসস্থান কৈলাশ পর্বতে যাওয়ার জন্য পার্বতীকে অনুরোধ করেন। পার্বতী শিবকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করেন এক শর্তে। কাল্লুকে এক রাতের মধ্যে শিবের এক কোটি ভাস্কর্য করতে হবে। কাল্লু কাজ শুরু করেন। পরদিন ভোরে দেখা যায় একটি কম এক কোটি ভাস্কর্য হয়েছে। এল ফলে শিব রুষ্ট হয়ে কাল্লুকে ও তার ভাস্কর্যকে ঊনকোটিতে রেখেই কৈলাশে চলে যান। আবার আরেকটি কাহিনী মতে, কাল্লু শেষ যে ভাস্কর্যটি করেছিল সেটি সে নিজের রূপ অনুযায়ী করেছিল। কাল্লুর অহঙ্কার ও গর্বের কারণেই তার কৈলাশ যাওয়া আর হয়নি।
নামকরণ নিয়ে আরেকটি কিম্বদন্তী হল, শিব উনকোটি দেবতাকে নিয়ে কাশি যাওয়ার পথে এই পর্বতে অবস্থান করেছিলেন এক রাতের জন্য। তিনি সকলকে বলেছিলেন যে, সূর্য ওঠার আগেই যাত্রা শুরু করবেন। কিন্তু শিব সকালে উঠে দেখেন তিনি ছাড়া আর কেউ ওঠেননি। ফলে শিব ঊনকোটি দেবতাকে অভিশাপ দিয়ে মর্ত্যে রেখে চলে যান।
নামকরণের পেছনে যে কিংবদন্তি বা লোককাহিনীই থাক না কেন, ঊনকোটির শিল্প ভাস্কর্য দেখে মনে হয়েছে, অদিবাসী শিল্পীরাই উনকোটির অনুপম শিল্প সম্ভারের সৃষ্টি কর্তা। আদিবাসীদের নিজস্বতা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রতিটি শিল্পকর্মে। প্রতিটি শিল্পকর্মের উচ্চতা ৩০-৪০ ফুট। এই উচ্চতার শিল্প সৃষ্টি কীভাবে হয়েছিল সেটাই রহস্যের। সপ্তম শতকে বা তার কাছাকাছি সময়ে এগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে এটি শৈবতীর্থ হিসেবে বর্তমানে মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। অশোকাষ্টমী উৎসব উপলক্ষে  শ্রাবণ মাসে হাজার হাজার মানুষ এখানে আসেন পুজো দিতে।  
ঊনকোটির বিস্ময় নিয়েই রাতের জন্য জায়গা নিয়েছিলাম কৈলাশহরের সরকারি লজে। সেখানেও এক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। আমাদের লজের পাশের কাঁটাতারের বেড়া দেখে চমকে উঠেছিলাম। লজের ম্যানেজার বললেন, এটার ওপারেই বাংলাদেশ। আমি ও পুত্র বেরিয়ে পড়েছিলাম কাঁটাতারের পাশ দিয়ে এই সীমান্ত শহরের কিছুটা অংশ হেঁটে দেখতে। শহর হলেও গ্রামের ছোঁয়া সর্বত্র।
একইভাবে কাঁটাতারের বেড়ায় দুভাগ হওয়া কসবায় হাজির হয়েও অবাক হয়েছিলাম। এখানে টিলার উপরে কসবা কালীবাড়ি। শান্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাজানো গোছানো কালীবাড়িতে কালীর মূর্তিটিও অভিনব। দশ হাত, সিংহবাহিনী দেবীর পায়ের কাছে ছিন্ন মস্তক অসুর। এখানেই কালী মূর্তির পাশে রয়েছে মা আনন্দময়ীর ছবি। তিনিও পূজিতা হন। মন্দিরের পূজারি জানালেন, এখানেই মা আনন্দময়ী সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
দেশভাগের সময় কালীবাড়িটি এপারে পড়েছে। পাশ দিয়েই গিয়েছে কাঁটাতার। আর মন্দিরে দাঁড়িয়েই দেখেছিলাম ওপারে কসবা রেল স্টেশন। কসবায় রয়েছে কমলাসাগর নামে একটি সুবিশাল দীঘি। মহারাজা ধনমাণিক্য রাণী কমলাদেবীর ইচ্ছানুসারে এই দীঘিটি খনন করিয়েছিলেন।
সেখান থেকে গিয়েছিলাম মেলাঘরে। কি সুন্দর এর নাম। তবে নামের সৃষ্টি যেভাবেই হোক না কেন, এই মেলাঘরে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত এক জলাশয়। নাম রুদ্রসাগর। আর এই রুদ্রসাগরে ভেসে রয়েছে অপূর্ব শ্বেতশুভ্র এক প্রাসাদ, নাম নীরমহল। এটি ছিল ত্রিপুরার রাজাদের গ্রীষ্মাবাস। এটি তৈরি করেছিলেন মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য। এটির নির্মাণকাজ শুরু হযেছিল ১৯৩০ সালে, শেষ হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। মহারাজার ভাবনা অনুযায়ী হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল সাতমহলা এই প্রাসাদ। প্রাসাদটি তৈরি করেছিল মার্টিন এন্ড বার্ণ কোম্পানি। তখন সেটি ছিল বৃটিশ কোম্পানি।
নৌকায় করে আমরা পৌঁছেছিলাম প্রাসাদে। রাজারাও এই ভাবেই নৌকা করেই পৌঁছাতেন নীর মহলে। প্রাসাদে দুটি সিঁড়ি নিচে জলের কাছে আসার। রাজপরিবারের সকলে ব্যবহার করতেন ভিতর দিকের সিঁড়ি, সেখান দিয়ে তারা নৌকা করে ঘাটে এসে নামতেন বা যেতেন।  

নীরমহলে পা দিয়েই রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। কী অপূর্ব এর পরিবেশ। চারদিকে জলরাশি। তরঙ্গ না থাকলেও জলে ভেজা বাতাস যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে স্নিগ্ধতা। দুটিভাগে ভাগ করা প্রাসাদটি। পশ্চিম দিকের অংশটি অন্দর মহল হিসেবে পরিচিত। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম প্রতিটি ঘর। কোনটি শোবার ঘর, কোনটি খাবার ঘর, কোনটি আবার বসার ঘর। মোট ২৪টি ঘর রয়েছে এই প্রাসাদে। কোনো মহলে থাকতেন রাজা। কোনো মহলে রানি। আবার কোনো মহলে মন্ত্রিপারিষদ। অন্য অংশে ছিল নাটক, থিয়েটার, গান-বাজনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের খোলা জায়গা। সিপাহি-সান্ত্রী এবং রান্না ও কাজের লোকজনের জন্য ছিল আলাদা ব্যবস্থা। সন্ধ্যার সুর্যাস্ত মায়াময় করে তুলেছিল গোটা পরিবেশকে। ফিরে মেলাঘরে এসে নীরমহলের দিতে তাকিয়ে দেখি রঙিন আলোতে আরেক রূপে সেজে উঠেছে নীরমহল।
বর্তমানে এই নীরমহল ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। রাতের বেলায় প্রাসাদে যাওয়া মানা। আমরা যখন মেলাঘরে তখন সেখানে চলছিল নীরমহল পর্যটন উৎসব। প্রতিবছরই এই উৎসব উপলক্ষ্যে বাইচ প্রতিযোগিতা ও বৈঠা নাচ হয়ে থাকে। আয়োজকরা আমাদের নিযে বসালেন অনুষ্ঠান স্থলে। তার আগে দেখলাম রুদ্র সাগরের বুক চিরে ছুটে যাওয়া বাইচের প্রতিযোগিতা। অনুষ্ঠান স্থলেই দেখি এক অভিনব নাচ। বাইচের প্রতিযোগীরা সকলে বৈঠা হাতে ছন্দোময়  নৃত্যে সামিল। ফেরার সময় বারে-বারে দেখছিলাম অককারের বুকে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নীরমহলকে।
কলকাতা থেকে বিমানে আগরতলা নেমে খানিকটা চমকেই গিয়েছিলাম। এত ছোট এয়ারপোর্ট আগে কখনো দেখিনি। বিমানবন্দরে পর্যটন দপ্তরে যোগাযোগ করা মাত্র এক জন চালক কাম গাইড এসে হাজির। জানালেন আগামী ছয় দিন তার বাহন এবং তিনি আমাদের সঙ্গী। গাড়িতে করে সরকারি লজে। সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম আগরতলা ঘুরে দেখতে। প্রথমেই গেলাম উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদে। রাজার এই প্রাসাদ এখন মিউজিয়াম। মহারাজা বীর মাণিক্যের আমলেই এটি তৈরি হয়েছিল। অনেকগুলো ঘর এই প্রাসাদে। কোনটিতে রাজা-রানিদের তৈলচিত্র, কোনটিতে ছবি ও পুতুলসহ উপজাতিদের জীবন বর্ণনা। আবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাজপরিবারের সখ্যের নানা ছবি রয়েছে। আর রয়েছে বিদ্যোৎসাহী রাজপরিবারের বিশাল পুস্তক ও পুঁথির ভাণ্ডার। সেখান থেকে একেবারে সীমান্তে। আখাউড়া সীমান্তে অতিথি আসনে বসেম দেখলাম দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর রিট্রিট সিরিমনি। কোথাও কোনও উগ্রতা নেই, বরং মিত্রতারই রেশ ছড়িয়ে ছিল সর্বত্র। নো- ম্যানসল্যান্ডের ওপার থেকে কয়েকজন বাংলাদেশিকে দেখলাম এপারে থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে সুখ-দঃখের দিনযাপনের তথ্য বিনিময় করতে।
পরদিন দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পৌঁছেছিলাম জাম্পুই পাহাড়ে। ত্রিপুরার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, সমুদ্র পৃষ্ট থেকে তিন হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।  এই পথে আসতে আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে বড়মুড়া ও আধারমুড়া পর্বতশ্রেণি। অবশ্য আগরতলা শহরের বাইরে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে দেখেছিলাম চতুর্দশ দেবতার মন্দির। আহামরি কিছু নয়, তবে এই মন্দির ত্রিপুরার ধর্মীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
জাম্পুই আসলে পর্বত শ্রেণি। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। আর পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচুতে  ভেঙ্গামুন গ্রামের কাছে বেটালিং চিপে সরকারি টুরিস্ট লজ। সেখানেই আমাদের দুদিনের রাত্রিবাস। আসার পথে দু’চারটি জনপদও পেরিয়েছি। আর পাহাড়ের পাদদেশে লুসাই উপজাতিদের গ্রাম ফুলডুংসাই আমাদের স্বাগত জানিয়েছিল। পাহাড়ের বুকে অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে লজ থেকে চারিদিকের প্রেক্ষাপট আলোর মালা পড়ে হাজির। দূরে মণিপুরের গ্রামের টিমটিম আলো এক মনমোহিনী দৃশ্য ধারণ করেছিল। পরের দিন মেঘের খেয়ায় আমরা ভেসে ছিলাম বেশ কয়েক ঘন্টা সময়।
জাম্পুই পাহাড়ে দেখলাম কমলা লেবুর বাগান। কফির বাগানও চোখে পড়েছে। নানা ধরনের মশলার গাছও পথের পাশে উঁকি দিচ্ছে। অর্কিডের রঙ্গিন শোভা মুগ্ধতারই আবেশ ছড়িয়ে দিয়েছে।
জাম্পুই পাহাড়ে আসার পথে দূর থেকে ঘণ্টা ধ্বনির আওয়াজ পেয়ে সচকিত হয়ে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম, পাহাড়ের কোনও মন্দির থেকে হয়তো ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। গোটা পথে এই ঘন্টাধ্বনি আমাদের সঙ্গী হয়েই ছিল। কিন্তু মন্দির কোথায়? ভুল ভাঙালেন আমাদের গাড়ির চালক কাম গাইড। তিনিই জানালেন, এখানে কোনো মন্দির নেই। এটি আসলে ঘন্টা পোকার শব্দ। ঘণ্টার সঙ্গে ঘণ্টা পোকার তৈরি শব্দের এত মিল দেখে আমরা অবাকই হয়েছি। তবে আড়াল থেকে বার করে এনে এই পোকাকে দেখার ইচ্ছেটা মনের কোণে রয়েই গেল।
এবার যাত্রা  ত্রিপুরার প্রথম রাজধানী গোমতীর তীরে মন্দির শহর উদয়পুরে। এই উদয়পুরে আসার পথে আমরা মাতাবাড়িতে গিয়েছিলাম ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির দেখতে। সুন্দর সাজানো গোছানো মন্দির। শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশ। এটিকে সতীর একান্নপিঠের একপিঠ বলা হয়। পাশেই কল্যানসাগর দীঘি। সেখানে বিশাল বিশাল মাছেরা মানুষের দেওয়া খাবারের আশায় ঘাটের সিঁড়ির কাছে ভিড় করেছে।

আমাদের কাছে উদয়পুরের আকর্ষণই ছিল আলাদা। এই উদয়পুরের ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পটভূমিতেই রবীন্দ্রনাথ ‘রাজর্র্ষি’ উপন্যাস লিখেছিলেন। পরে সেটিকে নাট্যরূপ দিয়ে লিখেছিলেন ‘বিসর্জন’। চারচালা ও স্তূপশীর্ষ রীতিতে তৈরি ভুবনেশ্বরী মন্দিরটি একটি উঁঁচু চাতালের ওপর অবস্থিত। ১৬৬০ সালে মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। মন্দিরে একসময় নরবলি হওয়ার কথা চালু থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এই মন্দিরের গর্ভগৃহে কোনো মূর্তিই নেই। গোমতীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল মূর্তিকে। মন্দিরের নির্মাণ শৈলি সাধারণ হলেও মুগ্ধতায় ভরিয়ে রাখে। আর সেইসঙ্গে মনের গভীরে তোলপাড় করে জীবন্ত হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট চরিত্রেরা। এই উদয়পুরেই রয়েছে টেরাকোটার তৈরি গুণবতী মন্দির। আর যে রাজপ্রাসাদের কৌলিন্য সকলকে চমকিত করত সেই রাজপ্রাসাদের ভগ্নদশা দেখে বিমর্ষই হতে হয়েছে। কোনো রকম সংস্কারের দেখা নেই, অবহেলায় আরও বিলীন হয়ে যেতে বসেছে। উদয়পুরকে বিদায় জানানোর সঙ্গে সঙ্গে মনও ভারি হয়ে উঠেছিল। আমাদের চলে আসতে হবে ত্রিপুরার সৌন্দর্যের স্মৃতিকে ধারণ করে। ত্রিপুরা সফরে আমরা বেশ কয়েকটি ইকোপার্ক দেখেছি। প্রকৃতি সংরক্ষণের অনবদ্য দৃষ্টান্ত এসব ইকো পার্ক। বড়মুরা ও তেপানিয়া ইকোপার্কে অযত্নের ছাপ থাকলেও খুমুলং ইকোপার্কটি সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো। মন ভরে যায়। আসার পথে আগরতলা
রেল স্টেশনটি দূর থেকে দেখে মুগ্ধই হয়েছি। সুবিশাল এই রেল স্টেশনটি থেকে এখন সরাসরি ট্রেন যাচ্ছে ভারতের নানা শহরে। অগম্য ত্রিপুরার দুর্গতি সরিয়ে রেখে গোটা রাজ্য এখন জেগে উঠেছে।
লেখক : দৈনিক মানবজমিন, কলকাতা প্রতিনিধি
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status