ঈদ আনন্দ ২০১৮

বিশেষ রচনা

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অধীনতা

সোহরাব হাসান

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৪:১২ পূর্বাহ্ন

যে দেশে মানুষের মতামত বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে কেমন করে?                                                                                                                                                                  -শেখ মুজিবুর রহমান
                                                                                                                                                    (কারাগারের রোজনামচা পৃষ্ঠা-৬২)

দাও আমাকে জ্ঞানের স্বাধীনতা দাও, কথা বলার স্বাধীনতা দাও, মুক্তভাবে বিতর্ক করার স্বাধীনতা দাও।                                                                                                                                                          -জন মিলটন
 
চলতি বছর মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘গণমাধ্যম, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন।’ অর্থাৎ আমাদের শুধু গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হলেই হবে না। সেই সঙ্গে ন্যায়বিচার ও সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা-এই দুটি অভিধার মধ্যে কোনো বিরোধ থাকার কথা নয়। গণতন্ত্রের বাইরে যেমন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চিন্তা করা যায় না, তেমনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়াও গণতন্ত্র হয় না।
কিন্তু বাংলাদেশের কূটাভাস বা প্যারাডক্সটি বেশ জটিল। এই মুহূর্তে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে কি না? সরকারি দলের নেতারা বলবেন, শত ভাগ স্বাধীনতা আছে। একই প্রশ্নের উত্তরে বিরোধী দলের নেতাদের জবাব হবে, কোনো স্বাধীনতা নেই। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে এ-ও লক্ষ করি যে বিরোধী দলে থাকলে রাজনীতিকেরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে অতিশয় সোচ্চার থাকেন, আর সরকারি দলে গেলে নানা রকম সবক দেন। সেই সবকটি অনেক সময় ধমক ও হুমকিতে রূপান্তরিত হতে দেখি।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আসে গণমাধ্যমের দায়িত্ব কী। গণমাধ্যমের প্রথম দায়িত্ব হলো জনগণের কাছে তথ্য বা সংবাদ পৌঁছে দেওয়া এবং সেই তথ্য সংগ্রহ, তৈরি ও পরিবেশনের কাজটি যদি সংবাদপ্রতিষ্ঠান ও কর্মীরা বিনা বাধায় করতে পারেন, সেটাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আজ নানাভাবে, নানা পক্ষ থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ১. প্রথমত এই বাধা আসে সরকারের পক্ষ থেকে- তারা এমন আইন করেন, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থি। দ্বিতীয় বাধা আসে সমাজের বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল থেকে, যারা মনে করেন গণমাধ্যমে তাদের তথ্য প্রকাশ পেলেই ক্ষতি। তৃতীয় বাধাটি আসে জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছ থেকে। এরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিংবা মানব সভ্যতা-কোনোটিতেই বিশ্বাস করে না; যাকেই তাদের মতের বিরোধী ভাবে, তাকেই হত্যার জন্য নিশানা করে। বাংলাদেশে  নিকট অতীতে বেশ কজন মুক্তমতের লেখক-প্রকাশক এদের হাতে খুন হয়েছেন। ভয়ে কেউ কেউ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।


আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে আছে:
    ১. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেওয়া হইল।
    ২. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা                                                আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ  সাপেক্ষে
    ক. প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং                                             
    খ. সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হইল।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ‘যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের’ সংজ্ঞাটি কে ঠিক করবেন? সরকার ঠিক করলে গণমাধ্যমের অংশীজনেরা গ্রহণ করবেন না। আর গণমাধ্যমের অংশীজনেরা নির্ধারণ করলে সরকারও হয়তো মানবে না। এই বিবেচনা থেকেই বিভিন্ন দেশে প্রেস কাউন্সিল গঠিত হয়। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে স্বাধীন প্রেস কাউন্সিলই গণমাধ্যম সংক্রান্ত সব বিরোধের ফয়সালা করে।
আমাদের দেশেও একটি প্রেস কাউন্সিল আছে। কিন্তু পূর্বাপর কোনো সরকারই প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করতে চায় না। এই কাউন্সিলের প্রধান পদে এমন ব্যক্তিকে বসানো হয়, যার সঙ্গে গণমাধ্যমের কোনো সম্পর্ক নেই। দ্বিতীয়ত যখন প্রেস কাউন্সিল হয়েছিল, তখন বেসরকারি খাতে কোনো টেলিভিশন বা বেতার ছিল না। এখন বেসরকারি খাতে অনেক বেতার-টিভি চলছে। অতএব, প্রেস কাউন্সিলের আইনি পরিসরও বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে।  
সরকার ও গণমাধ্যমের সম্পর্কটি কেমন হওয়া উচিত- এই প্রশ্ন প্রায়ই শোনা যায়। এ বিষয়ে আমি প্রবীণ সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক সাখাওয়াত আলী খানের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে সংবাদক্ষেত্রের ছোটখাটো খিটিমিটি অহরহ লেগেই থাকবে, এটা অনেক সময় গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য উপকারী হয়। সংবাদক্ষেত্রকে বলা হয় দ্য ফোর্থ এস্টেট, যদিও এ কথাটা আজকাল আর তেমন শোনা যায় না, কিন্তু সংবাদক্ষেত্রের এই ফোর্থ এস্টেটের ভূমিকা গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সংবাদক্ষেত্র ফোর্থ এস্টেটের ভূমিকায় যদি একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে স্থিত থাকে, তাহলে ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই তার মতপার্থক্য হতে পারে, এবং সেটা কোনোভাবেই খারাপ কিছু নয়, বরং গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য দরকারি।’
শুধু সরকার নয়, সমাজের অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গেও গণমাধ্যমের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, আছে। গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে সেটি নিরসনের উপায় হলো সঠিক তথ্য এবং যথাসম্ভব সবার তথ্য প্রকাশ করা। কিন্তু সমাজের বিভিন্ন অংশীজন চায় গণমাধ্যম শুধু তাদের খবরই প্রকাশ করুক। এ কারণেই গণমাধ্যমকে নৈতিক অবস্থানে অনড় থাকতে হবে। তথ্যটি কার পক্ষে বা বিপক্ষে গেল সেটি তার বিচারের বিষয় নয়, বিচার্য হলো তথ্যটি নির্ভুল কি না।


সাম্প্রতিককালে যেসব গণমাধ্যম সংক্রান্ত যেসব আইন নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। অতীতে বিশেষ ক্ষমতা আইন গণমাধ্যমসেবীদের জন্য একটি আতঙ্ক ছিল। এই আইন বলে সরকার চাইলেই যেকোনো পত্রিকার ডিক্লারেশন বা অনুমোদনপত্র বাতিল করতে পারত। এর বিরুদ্ধে সাংবাদিক ইউনিয়ন দীর্ঘ দিন আন্দোলন করেছে। তাদের যুক্তি, আজকের পত্রিকা ক্ষতিকর কোনো খবর প্রকাশ করলে সরকার বা আদালত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্তু আগামীকাল কী খবর প্রকাশ হবে সেটি অনুমান করে কোনো সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
২০০৬ সালে বিএনপি সরকার যখন তথ্যপ্রযুক্তি আইনটি পাস করে, তখন বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ এর কঠোর সমালোচনা করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সেই আইনটি শুধু অনুমোদনই করেনি এবং সংশোধনের নামে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। নাগরিকের অধিকার রক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে যে তথ্যপ্রযুক্তি আইন করা হয়েছে, সেটাই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সাংবাদিকের অধিকার হরণ ও হয়রানির কাজে। গত কয়েক বছরে বহু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হয়েছে। কেউ কেউ জেলে গিয়েছেন। এ ছাড়া মানহানির মামলায়ও অনেক সাংবাদিক-সম্পাদক নাজেহাল হয়েছেন। একটি ঘটনায় যদি কোনো সম্পাদকের বিরুদ্ধে সারা দেশে ৭০টিরও বেশি মামলা করা হয়, তাহলে সেটিকে আমরা নিশ্চয়ই আইনি প্রতিকার প্রার্থনা বলতে পারি না। এটি হলো ক্ষমতার দম্ভ এবং ভিন্নমত রুদ্ধ করার অপকৌশল। তবে এ ক্ষেত্রে এ কথাও স্বীকার করব। আগে মানহানির মামলায় অনেক সাংবাদিককে সরাসরি জেলে পাঠানো হতো। বর্তমান সরকার জামিনের বিধান চালু করে বিনা অপরাধে সেই জেলবাস থেকে রেহাই দিয়েছেন।  
সমালোচনার মুখে সরকারের একাধিক মন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে বাতিলেরও আশ্বাস দিলেও তা কার্যকর হয়নি। সম্প্রতি বিডিজবসের প্রধান নির্বাহীকে এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। পত্রিকার খবর অনুযায়ী ছাত্রলীগের কোনো এক নেতার সঙ্গে বিরোধের কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তিন ঘণ্টা পর অবশ্য তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তথ্যপ্রযুক্তির যে অপব্যবহার হচ্ছে, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষকে অসম্মানিত করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োজনীয়তা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবহার করা হবে?
কিন্তু মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত ও জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারা রাখা হয়েছে, তা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের চেয়েও মারাত্মক বলে মনে করেন সংবাদমাধ্যমের অংশীজনেরা।
 নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন-নোয়াব বলেছে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি প্রসঙ্গে অপরাধের ধরন ও শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে, তা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মুক্তচিন্তার জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এতে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি সংস্থার গোপনীয় তথ্য কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করলে তা হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি। এমনকি তথ্য সংগ্রহে যেসব কর্মকর্তা সহায়তা করবেন তাদেরও একই শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব হয়েছে। এই শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। কেউ এই অপরাধ দ্বিতীয় বা বারবার করলে শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। নোয়াব মনে করে, পুরোনো আইন বাতিল ও নতুন আইন প্রণয়নে অংশীজনদের চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এবং সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্টসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর মতো বিষয়গুলো ছিল, যেগুলোর অপপ্রয়োগ ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বাতিলের জোর দাবি ওঠে। এই চারটি বিষয়ই প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চারটি ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক অপরাধের জন্য আলাদা শাস্তি রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ওই সব অপরাধের বিষয়বস্তুগুলো প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ এবং ৩১ ধারায় কৌশলে রেখে দেওয়া হয়েছে।’  
সম্পাদক পরিষদও অবিলম্বে ৫৭ ধারাসহ আইসিটি আইনের বিতর্কিত সব ধারা বাতিল এবং প্রস্তাবিত নতুন আইনে যুক্ত ৩২ ধারাসহ বিতর্কিত ধারাসমূহ খসড়া থেকে বাদ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সম্পাদক পরিষদ মনে করে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি প্রসঙ্গে অপরাধের ধরন ও শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে, তা গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনা এবং বাকস্বাধীনতায় আঘাত করবে। একই সঙ্গে তা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩২ ধারা সংশোধনের দাবি জানানোর পাশাপাশি একটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। তারা বলেছে, আইনের কোনো ধারা প্রেস কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়া সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না।
একজন মানবাধিকার কর্মীর মূল্যায়ন হলো, ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীসহ মূলধারার গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে ইতিমধ্যেই একদিকে অভূতপূর্ব ভীতি ও অন্যদিকে ভীতি প্রসূত স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ চাপিয়ে দিয়েছে, যা বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীন দায়িত্ব পালনের প্রধান অন্তরায় বলে বিবেচিত হচ্ছে। আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৮ ধারাসমূহ প্রয়োজনীয় সংশোধন ছাড়া প্রণীত হলে সার্বিকভাবে দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।’ (ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ)
যে দেশে সরকার দুর্বল সে দেশে গণমাধ্যমের ওপর কঠোর আইন জারি করে থাকে, নানা রকম বিধিনিষেধ জারি করে। আর যে দেশে সরকার জনগণের শক্তিতে বলীয়ান সে দেশে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে কোনো আইনের প্রয়োজন হয় না। অনেক গণতান্ত্রিক দেশে পত্রিকা প্রকাশ করতে কিংবা টিভি চ্যানেল খুলতে একটি ট্রেড লাইসেন্সই যথেষ্ট। এমনকি সেই দেশের নাগরিক না হয়েও পত্রিকা বের করতে বা টিভি চ্যানেল চালাতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে নানা রকম শর্ত পূরণ করতে হয়। আর শর্ত মানেই দুর্নীতি।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে বলা হয়েছে: কংগ্রেস এমন কোনো আইন পাস করতে পারবে না যাতে মতপ্রকাশের বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হয়। আমাদের দেশেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য এ রকম সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রয়োজন বলে মনে করি।
 বাংলাদেশের সংবিধানের মৌল চরিত্রের বিরোধী কোনো আইন সংসদে পাস হলে সেটি আদালত দ্বারা বাতিল হওয়ার নজির যেমন আছে, তেমনি বাতিল না হওয়ার দৃষ্টান্তও আছে। হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ করে পাস করা সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর একাংশ সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম রয়েই গেছে। দুটোই যে সংবিধানের মৌল নীতির পরিপন্থী আশা করি মন্ত্রী মহোদয়ও স্বীকার করবেন।  


সম্প্রতি রিপোর্টার্স সানফ্রন্টিয়ারে (আরএসএফ) প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স বা সূচক প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬। অর্থাৎ নিচের দিক থেকে আমরা ওপরের সারিতে আছি। ২০১৬ সালে অবস্থান ছিল ১৪৪। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবার নিচে। ভুটান ৯৪, নেপাল ১০৬, শ্রীলঙ্কা ১৩১, ভারত ১৩৮ ও পাকিস্তান ১৩৯ অবস্থানে আছে। অর্থনীতি থেকে মানবসম্পদের সূচকে আমরা পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে থাকলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে কেন এগিয়ে থাকব? এটি কি বাংলাদেশের জন্য মোটেই গৌরবের নয়।
 অস্বীকার করা যাবে না যে বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বেড়েছে। গণমাধ্যম শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশে এখন কয়েক শ দৈনিক, সহস্রাধিক অনলাইন পোর্টাল, তিন ডজন টিভি চ্যানেল ও ডজন দুই এফএম রেডিও আছে। কিন্তু সংখ্যা বা প্রচারসংখ্যা সব সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে না। এই সংখ্যা বৃদ্ধি গণমাধ্যম কর্মীদের একধরনের ঝুঁকিতেও ফেলেছে। অনেক সময় দেখা যায় বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করা হলো, উচ্চ বেতনের কর্মীদের নিয়োগও দেওয়া হলো। কিছুদিন না যেতেই সংবাদকর্মীদের বেতন বাকি থাকতে শুরু করে এবং কর্মীরা ছাঁটাই হতে থাকেন। অনেক পত্রিকারও বেতন-ভাতাও নিয়মিত নয়। সংবাদকর্মীরা যখন আন্দোলন করে নবম বেতন বোর্ড আদায় করেছেন, তখন অনেক পত্রিকায় অষ্টম বেতন বোর্ড রোয়েদাদও বাস্তবায়ন করেনি। গণমাধ্যম আর্থিকভাবে সচ্ছল না হলে পেশাগত স্বাধীনতাও ভোগ করতে পারে না। গণমাধ্যমের প্রধান শক্তি পাঠক, দর্শক ও শ্রোতা। তাদের প্রতিই গণমাধ্যম দায়বদ্ধ।
আরএসএফ-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে ২৫টি শারীরিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমকাল প্রতিনিধি নিহত হন। এর আগে যেসব সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটেছে, দুই একটি ছাড়া কোনোটির বিচার হয়নি। সাগর-রুনি হত্যা রহস্যেরও কিনারা পাওয়া যায়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সাংবাদিকদের আরও ভঙ্গুর অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ২০১৭ সালের গণতন্ত্রের সূচকে ৮৪তম স্থান দিয়েছে। ১৬৭টি দেশের মধ্যে পরিচালিত এই জরিপে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বলা হয়েছে আংশিক স্বাধীন।  
গণমাধ্যম রাজনীতি বা সমাজ বদলাতে পারে না। পারলে আমরা অন্তত এর চেয়ে উন্নত রাজনীতি পেতাম। স্বৈরাচারী শাসনের কথা বাদ দিলেও নব্বই পরবর্তী রাজনীতিতে যে সহিষ্ণুতা ও বোঝাপড়া ছিল, সেটি এভাবে তিরোহিত হতো না। এখন একপক্ষ আরেক পক্ষের ধ্বংসের মধ্যদিয়ে নিজের বিজয় খোঁজে। কিন্তু গণতন্ত্রে তো সেটি হওয়ার কথা নয়। সেখানে নির্বাচনে এক দল জয়ী হয়ে দেশ শাসনের সুযোগ পাবে, আরেক দল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো ক্ষমতায় না থাকতে বা যেতে না পারলে কিছুই থাকবেন না। গণমাধ্যম রাজনীতি বদলাতে না পারলেও ভালো ও মন্দ রাজনীতির সীমারেখাটি অন্তত টানতে পেরেছে। তারা সাদাকে সাদা ও কালোকে কালোই বলতে চায়।
গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। অন্য তিনটি স্তম্ভ ঠিকমতো কাজ করলে গণমাধ্যমের কাজ কিছুটা কমে যায়। কিন্তু অন্য স্তম্ভগুলো ঠিকমতো কাজ করে না বলেই মানুষ গণমাধ্যমের কাছে বেশি আশা করে। কিন্তু গণমাধ্যমের তো অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তার হাতে রাষ্ট্র চালানোর অস্ত্র নেই, প্রশাসন নেই, থানা-পুলিশ নেই। গণমাধ্যম কেবল রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের চালক সরকারকে বলতে পারে ‘পথিক তুমি পথ হারাইছো।’
গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে যদি আমরা একটি গ্লাসের সঙ্গে তুলনা করি, কেউ বলবেন গ্লাসটি অর্ধেক পূর্ণ, কেউ বলবেন তিন চতুর্থাংশ খালি। কিন্তু আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার গ্লাসটি পুরোপুরি ভর্তি দেখতে চাই।



তবে আইন দিয়েও সব সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায় না। এটি একটি মানসিকতারও বিষয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
বাংলাদেশে বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার যেমন সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান তেমনি ভারতে দূরদর্শন ও আকাশবাণীও। বাংলাদেশে যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, দুটো প্রতিষ্ঠানকেই দলীয় মুখপত্র বানান। কিন্তু ভারতে গত ৭০ বছরে ডান বাম মধ্য-অনেক ধরনের সরকার এসেছে। কিন্তু সরকারি গণমাধ্যমকে কেউ দলীয় মুখপাত্র বানানোর চেষ্টা করেননি। এ কারণেই সরকারি ও বিরোধী দল-সবার খবর আকাশ বাণী ও দূরদর্শনে প্রচারিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগের খবর এবং আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির খবর নিষিদ্ধ থাকে। সরকারি বা বেসরকারি মালিকানা হোক গণমাধ্যমকে গণমাধ্যম হতে হবে। বিবিসি ব্রিটিশ সরকারের টাকায় পরিচালিত হয়।  
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে দেখেছেন মানুষের সার্বিক উন্নয়নের নিরিখে। তিনি বলেছেন, সংবাদমাধ্যমের ওপর লাগাম টানার ফলে যেসব তথ্য লুপ্ত হয়ে যায়, তা একনায়কতন্ত্রে সরকারকেই ভুল পথে চালিত করে।...প্রেসের ওপর সেন্সরশিপ কেবল নাগরিকদেরই অন্ধকারে রাখে, সরকারের কাছেও অতি জরুরি তথ্য পৌঁছাতে দেয় না। (স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম ও অর্থনীতির উন্নয়ন, ফার্স্ট বয়দের দেশ, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা ২০১৭)
 বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাস আছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা  আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন পেরিয়ে উনসত্তরে যে গণ-অভ্যুত্থান হলো তাতে গণমাধ্যম নিয়েছিল সাহসী ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগরে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। এমনকি বাংলাদেশ পর্বেও সামরিক স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও গণমাধ্যম গণতন্ত্রকামী রাজনীতিকদের সঙ্গে একযোগে কাজ করেছেন। আতাউস সামাদ, নির্মল সেনসহ অনেক সাংবাদিক জেল খেটেছেন। এই জাতীয় প্রেস ক্লাব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিকেরা জনগণের কাছে পরীক্ষা দেন পাঁচ বছর পর পর। আর গণমাধ্যমকে পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়, প্রতিদিন, প্রতি ঘণ্টায়, প্রতি মুহূর্তে।


গণমধ্যমে প্রকাশিত কোনো তথ্য জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী না অনুকূল এই বিচার কে করবে? সরকার নয়। আদালত। ১৯৭১ সালে মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক ড্যানিয়েল এলসবার্গ পেন্টাগনের অবমুক্ত না করা কিছু কপি নিউইয়র্ক টাইমসকে দেন এবং পত্রিকাটি তা প্রকাশও করে। পেন্টাগনের ওই দলিল অনুযায়ী হ্যারি ট্রু ম্যান, আইজেন হাওয়ার, জন এএফ কেনেডি ও লিন্ডন বি জনসন প্রশাসন ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে সংখ্যক মার্কিন সেনা মারা গেছে, তা অনেক কম করে দেখানো হয়েছে। মার্কিন সরকার জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে খবর প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দাবি করলে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সরকারের দাবি মঞ্জুর করেনি। অর্থাৎ গণমাধ্যমই জয়ী হয়েছে।
কেবল বাংলাদেশ বা উন্নয়নশীল দেশ নয়, বিশ্বব্যাপীই গণমাধ্যম কর্তৃত্ববাদী শাসকদের দ্বারা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। চীন, রাশিয়াসহ যেসব দেশ প্রথাগতভাবে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দ্বারা গণমাধ্যম নিগৃহীত সেসব দেশের কথা না হয় বাদই দিলাম গণতন্ত্রের ঝাণ্ডাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো পুরোনো গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণমাধ্যম আজ নানা চাপ ও হুমকির মুখে। আরএসএফ-এর সূচক অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত- দুটি দেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার আগের চেয়ে খর্ব হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাতে ‘আমাদের শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আরএসএফ যে তথ্যচিত্র দিয়েছে তাতে লেখা যায় বিশ্বের মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেন, আর মোটামুটি স্বাধীনতা ভোগ করেন সেই মানুষের সংখ্যা ১৭ শতাংশ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ এই তালিকায় নেই। ইকোনমিস্ট ইউনিটের মতে, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিম্নগামী গত ১০ বছরের তুলনায়। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। এসব দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও নেই।
মিসর, তুরস্ক ফিলিপাইন প্রভৃতি এশীয় দেশে যখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব হচ্ছে তখন আফ্রিকার অনেক দেশেই সূচকে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার হুমকি শুধু প্রশাসন ও আইন দ্বারাই আসে না; বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীও জঙ্গিবাদীদের কাছ থেকেও আসে। সরকার গণমাধ্যমের ওপর রুষ্ট হলে জেলে পাঠাবে, মামলা দিয়ে হয়রানি করবে; সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ আছে। কিন্তু জঙ্গি গোষ্ঠী যাকেই তাদের মতের বিরোধী ভাবেন, তাদেরই হত্যা করে। জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে প্রায় এক ডজন লেখক ও মুক্ত লেখক প্রকাশক জীবন দিয়েছেন, অনেকে ভয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
ক্ষমতার শীর্ষ মহল থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করে বলে দাবি করা হয়। তবে সব ক্ষেত্রে নয়, সরকার যেটুকু দেয়, সেটুকুই। আরেকটি প্রবণতা দেখা যায়, কোনো গণমাধ্যম ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করলে, সরকারের কাজের ভুলত্রুটির খবর প্রকাশ করলে তাকে দেশবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনেও বাধা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে অন্য গণমাধ্যমকেও এই বার্তা দেওয়া হয়ে যে তোমরা সরকারের সমালোচনা করলে একই পরিণতি হবে। ফলে পুরো গণমাধ্যমে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়, যা গণতন্ত্র কিংবা গণমাধ্যম কারও জন্যই সুখকর নয়।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা জরুরি বলে মনে করি। ইংরেজি সাপ্তাহিক হলি ডে-তে সোভিয়েতবিরোধী কোনো সংবাদ পরিবেশনের কারণে ঢাকায় অবস্থানরত তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেছিলেন, ‘দিস ইজ আওয়ার এনিমি পেপার’। কথাটি বঙ্গবন্ধুর কানে গেলে তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বলেছিলেন, ‘দিস ইজ মাই কান্ট্রি’স পেপার’।
 ইকোনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট বলেছে, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা আংশিক স্বাধীনতা ভোগ করছেন। এই আংশিক অর্ধেক, না তার চেয়ে কম তা তিনি খোলসা করেননি। তবে সাংবাদিকেরা এসব বাধা ও হুমকি মোকবিলায় অভ্যস্ত। সব সরকারের আমলেই তাদের এসব মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতা পেরিয়ে উঠতে না পারলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দূরের বাধা হয়েই থাকবে।
নিবন্ধটি শেষ করতে চাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার আরেক সাহসী যোদ্ধা, মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী কাল মার্কসের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। যদিও তার মতামত প্রতিষ্ঠার নামে বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। তিনি রাইন পত্রিকা ও নিউ রাইন পত্রিকা নামে দুটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রাইন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি লিখেছিলেন, জায়গা ছাড়ুন জনাব, একটি মুক্ত আত্মার ডানা মেলার জন্য। আগামী ৫ই জুলাই তার দ্বি-শততম জন্ম বার্ষিকী। আমরা যদি মুক্ত আত্মার ডানা মেলার পরিসরটি বিস্তৃত করতে পারি, সেটাই হবে এই মহান দার্শনিকের প্রতি উত্তম শ্রদ্ধা জানানো। মুক্ত রাষ্ট্র ও মুক্ত সমাজের জন্য চাই মুক্ত গণমাধ্যম।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status