ঈদ আনন্দ ২০১৮
বিশেষ রচনা
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নূরে আলম সিদ্দিকী
২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৪:০৮ পূর্বাহ্ন
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন পূর্ব-বাংলা ও আসাম প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। তবে ১৯১১ সালে ১লা নভেম্বর দিল্লীর দরবারে ঘোষণার মাধ্যমে ১২ই ডিসেম্বর থেকে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করা হয়। ভারতীয় কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা প্রভৃতি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে, ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবটি বৃটিশ সরকার প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
তারই সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে তৎকালীন বৃটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। এর মাত্র তিনদিন পূর্বে ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এরপর ২৭শে মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আরও জোর দাবি জানান ব্যারিস্টার আর নাথান, ডি আর কুলচাঁদ।
বঙ্গভঙ্গের ফলশ্রুতিতে পূর্ব-বাংলার শিক্ষাঙ্গনে যে দিগন্ত-বিস্তৃত সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়, বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ফলে সেই সম্ভাবনা ঘনঘোর কালো মেঘে ঢেকে যায়। ১৯০৬ সালে জন্মপ্রাপ্ত মুসলিম লীগ শুরু থেকেই প্রাসাদ রাজনীতিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তবুও নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও জনাব এ কে ফজলুল হক ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার দাবিটি সোচ্চার করে তোলেন। তখনকার ভারতে বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ২১শে জানুয়ারি ঢাকা সফরে এসে ঘোষণা করেন, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ তিনি সরকারের কাছে পেশ করবেন। ফলে ওই বছরেরই মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির অধীনে ২৫টি সাব-কমিটির মাধ্যমে ভারত সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা তৈরি করে। ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির রিপোর্ট অনুমোদন দেন ভারত সচিব। কিন্তু বিধি বাম, এরই মধ্যে সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তখন বিশ্বের মোড়লী অনেকটাই ইংরেজদের হাতেই ছিল। সরাসরি তারা এই বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
জন্মলগ্ন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রতিকূলতা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে একটা দক্ষ যোদ্ধার মতোই সামনের দিকে এগোতে থাকে। যদিও ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটা বিরাট অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব-বাংলার মানুষ তাতে নিদারুণভাবে ভেঙে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাদের প্রত্যাশার সূর্য ঘনঘোর অন্ধকারের মাঝে নিপতিত হয়। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান।
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন মাইকেল স্যাগলারের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ১৩ টি সুপারিশ করেছিল, এর কিছু রদবদলসহ ১৯২০ সালে ভারতীয় আইনসভায় গৃহীত হয় এবং একই বছরের ২৩শে মার্চ তৎকালীন গভর্নর জেনারেল এই বিলে তার সদয় সম্মতি প্রদান করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পি জে হার্টগ ১৯২০ সালের ১লা ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অবশেষে অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রমের পর ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে পথ চলা শুরু করে। ওইদিন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন অনুষদেই কোন ছাত্রী ভর্তি হননি। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সবুজ চাদরে ঢাকা রমনা এলাকার ৬০০ একর জমি নিয়ে গঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম শিক্ষাবর্ষে ৮৭৭ জন ছাত্র এবং ৬০ জন শিক্ষককে নিয়ে এর সুদীর্ঘ পদচারণার শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুভ সূচনা-লগ্ন হতেই মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যরশ্মির মতো তার দ্যুতি ছড়াতে থাকে। তখনকার অবিভক্ত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা- সর্বত্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি এমন একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হয় যে, সত্যি বলতে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জীও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ৬০০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত হয়ে ওঠে। শুধু অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয়, বিভিন্ন দেশ, এমনকি খোদ গ্রেট বৃটেন থেকেও এখানে জ্ঞান আহরণের অন্বেষণে ছুটে আসেন অনেকে।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গাঢ় সবুজের মোড়কে আবৃত একটা প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি গৌরবান্বিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই শুধু নয়, বরং দিনে দিনে রাজনৈতিক সচেতনতার পীঠস্থান হিসেবে গড়ে ওঠে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাদপীঠ হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। এর সবচেয়ে বড় গৌরবের দিক হল- বিশ্ববিদ্যালয়টি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তিতে গঠিত হলেও পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয় চেতনার পীঠস্থান হিসেবে প্রতিস্থাপিত হতে পেরেছিল। বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, তার ব্যাপ্তি, বিকাশ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার চেতনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকা বাংলার ইতিহাসের লালিত সম্পদ। পাকিস্তানের সূচনালগ্নেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর দুঃস্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে যে অনির্বাণ চেতনা ও আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল- সেটিরও প্রসূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, শ্রী রাধাগোবিন্দ বসাক, এ এফ রহমান, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. জ্ঞানচন্দ্র, ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখের মতো একঝাঁক প্রতিভাপ্রদীপ্ত শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করা, আর অন্যদিকে গণতন্ত্রের শানিত চেতনায় উজ্জীবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিশ্বের এক বিস্ময়কর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে সফল নেতৃত্ব দিয়ে এভাবে সাফল্যের সোনালী সৈকতে পৌঁছে দিতে পেরেছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই।
কী অদ্ভুত- কী আশ্চর্যজনক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মধারা ! দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, জিন্নাহ মুসলিম লীগের মাধ্যমে জমিদারদের প্রাসাদে অবরুদ্ধ অভিজাত মুসলিম লীগের রুদ্ধদ্বার রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের দুয়ারে টেনে আনার মহান প্রচেষ্টার পেছনে অনুপ্রেরণার উৎস ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি জনাব মাইনউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক কওে ঢাকায় পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এখানে নতুন প্রজন্মকে জানানো প্রয়োজন, নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের উত্তরাধিকারই হল পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। আমার অনুভূতিতে একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগে, যে ছাত্রলীগ পাকিস্তান আনলো- সেই ছাত্রলীগই পাকিস্তান ভাঙলো। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট করে একটি কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলনে কারারুদ্ধ হওয়ার পর আমাদের মুজিব ভাই (তাঁকে আমি ‘বস’ বলে সম্বোধন করতাম) কারা-অভ্যন্তরে একদিন আমাকে খুবই আন্তরিকতার সাথে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন- আলম, পাকিস্তান ভাঙা তোদের পক্ষে যতখানি সহজ, আমার জন্য ততখানি নয়। কারণ, পাকিস্তান অর্জনে আমাকে অন্যদের সাথে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে, অনেক নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। তবুও আমার মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কোটারি স্বার্থের কুটিল রাজনীতির কারণে পাকিস্তান একদিন ভাঙবেই। বাঙালি জাতীয় চেতনা তো দূরে থাক, আমাদের ভাষার অধিকারটুকুও রক্তের বিনিময়ে কিনতে হয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তানকে তারা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ভাবে না, ভাবে শোষনের চারণক্ষেত্র হিসেবে।
৪৭ থেকে ৬৬ -এই ঊনিশটি বছর ক্রমাগত পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের কষাঘাতে শোষণের চারণক্ষেত্ররূপেই পরিণত হয় ১৪০০ মাইল দূরে অবস্থিত এই বঙ্গভূমি। স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকারের মোড়কে স্বাধীনতাকে সাফল্যের সৈকতে পৌঁছে দেয়ার মূল কারিগর ছিল ছাত্রলীগ। এই আন্দোলনের মূল স্থপতি পাকিস্তানের শোষনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রতিবাদকারী এবং রাজনীতির দিগন্তবিস্তৃত আকাশে বাঙালি জাতীয় চেতনার প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তারও পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতির যাত্রা শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন প্রদানের মধ্য দিয়ে। ৬ দফা কর্মসূচিটির গুরুত্ব প্রথমে আওয়ামী লীগ সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে না পারায় তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের কাছে মুজিব ভাই ৬ দফা কর্মসূচিটি প্রচণ্ড আবেগাপ্লুত হৃদয়ে তুলে দেন এবং তাঁরা উভয়েই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতেই ৬ দফার পক্ষে একটি সফল আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাই তো আমি বারংবার বলি, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্য হিসেবে আখ্যায়িত করলে তাকে বক্ষে ধারণ করা দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ হল ছাত্রলীগ। তাঁকে সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করা হলে তার উচ্ছ্বসিত ঊর্মিমালা হল ছাত্রলীগ। তাঁকে বটবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হলে তার মাটিতে প্রোথিত শিকড় হল ছাত্রলীগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দাঁড়িয়ে বাংলার চারণ কবির মতো আমার কণ্ঠে যখন এই পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারিত হতো, তখন সভায় উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চিত্ত তো উদ্বেলিত হতোই, তখন আমার কাছে মনে হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গাছের পত্র-পল্লব, প্রতিটি ইট-পাথরের কণায় কণায় অনবদ্যভাবে এই সুর ঝঙ্কারিত হতো। যেটা সমগ্র শ্রোতাকে এবং আমার বিমুগ্ধ চিত্তকে উদ্বেলিত করতো, উচ্ছ্বসিত করতো, একটি সম্মোহনী সুরের স্রোতধারায় আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। আজও আমার স্মৃতিতে বারবার ভেসে ওঠে বিশ্বকে অবাক করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইসব গৌরবদীপ্ত সোনাঝরা অজস্র স্মৃতিমালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদিকে জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটানোর স্রোতস্বিনী অনন্ত নদী। অন্যদিকে আন্দোলনের দাবানল বক্ষে লালন করা একটি জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস। যদিও তখনকার আন্দোলনের শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল জগন্নাথ কলেজ। জগন্নাথ কলেজ ও তখনকার কায়েদে আযম কলেজ (বর্তমান শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ) থেকে মিছিল না আসলে আমতলা অথবা বটতলা- কোন সভাই জমে উঠতো না। তবুও স্বীকার করতেই হয়, শুধু ছাত্রলীগই নয়, সকল ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান ছাত্ররা অত্যন্ত প্রত্যয়দৃঢ়ভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। ফলে আন্দোলনটি সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো বেগবান হয়। ১৯৪৬ সালের গণভোটে (যেটিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গণভোট হিসেবেও কেউ কেউ বর্ণনা করেন) মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। তখন অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ার ছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। খাজা নাজিমউদ্দিনও মুসলিম লীগ করতেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করে দলটির নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শেরে বাংলা লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক হওয়া সত্ত্বেও ৪৬-এর নির্বাচনে তিনি কৃষক প্রজা পার্টির তরফ থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। শেরে বাংলা যখন যেখান থেকেই নির্বাচন করেছেন, কেউ তাকে পরাজিত করতে পারেনি। ৪৬-এর প্রচণ্ড জনস্রোতে (মুসলিম লীগের পক্ষে) তিনি নির্বাচিত হলেও মুসলিম লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী দাঙ্গা-বিধ্বস্ত কোলকাতায় মুসলমানদেরকে অসহায় অবস্থায় রেখে ক্ষমতার আকর্ষণে তৎক্ষণাৎ ঢাকা আসতে রাজি হননি। নতুন প্রজন্মকে অবহিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন, তাঁর বিরুদ্ধে জোরালো ও সূক্ষ্ম অপপ্রচার করা হয় যে, তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতেন। কিন্তু মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং পরিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক মননশীলতার অধিকারী। কোলকাতায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে তাঁর ইতিহাস-স্বীকৃত অবদানে গান্ধীজী মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে কোলকাতায় প্রচণ্ডভাবে সাধুবাদ জানান এবং তাঁকে সাথে করে দাঙ্গা-কবলিত নোয়াখালী সফর করেন। ছাগদুগ্ধই মহাত্মা গান্ধীর প্রধান খাদ্য ছিল। বেরসিক নোয়াখালীবাসী গান্ধীজীর ছাগলটি চুরি করে খেয়ে ফেলে।
এখন আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে আসা যাক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রচারাভিযান শুরু করে। এ সমস্ত দাবির প্রতি কোন পরোয়া না করে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষার স্থান না হওয়ায় ১১ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পুলিশ বিক্ষোভে লাঠিচার্জ করে ও কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত নেতাদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সারাদেশে ছাত্রবিক্ষোভ শুরু হয়। শেষপর্যন্ত খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সাথে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এর ৪ দিন পর পাকিস্তানের জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ২১শে মার্চ ঢাকায় ঘোড়দৌড় (রেসকোর্স) ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা করেন এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্পষ্ট ঘোষণা দেন। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ্ সাহেব ভাষণ দেন। সেখানেও তিনি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দেন যে, ‘উর্দু এন্ড উর্দু এলোন শেল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’। সাথে সাথে ছাত্রদের পক্ষে থেকে তীব্র কণ্ঠে একটি ‘না’ উচ্চারণের মাধ্যমে এই ঘোষণার প্রতিবাদ জানানো হয়। মার্চের ২৪ তারিখে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল জনাব জিন্নাহ্র সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন সর্বজনাব শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, মোহাম্মদ তোহা, আজিজ আহমেদ, অলি আহাদ, নাঈমউদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম ও নজরুল ইসলাম।
১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও সরকারবিরোধী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। এটি মুসলিম লীগ সরকারের স্পষ্ট বিরোধী একটি সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৮ সালের ৭ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হলে লিয়াকত আলী খান নিশ্চুপ থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাঙালি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, মননশীলতা, মানসিকতা- সবকিছুর উন্মেষ বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ৩রা মার্চ থেকে যে ধর্মঘট শুরু হয়, সেই ধর্মঘটেও ছাত্রলীগকে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমাদের মুজিব ভাইকে শাস্তিস্বরূপ ১৫ টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি তা দিতে অস্বীকার করলে গ্রেফতার হন এবং ৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আন্দোলন চলার সময় কারাগারে থেকে অনশন ধর্মঘটের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সাথে সংহতি ও প্রতীতি ঘোষণা করেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি, মননশীলতা ও মানসিকতাকে পদদলিত করার কুটিল ষড়যন্ত্রে মানসিকতায় এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে শোষনের চারণক্ষেত্র বানানোর লক্ষ্যে এবং লিপ্সায় এই বাংলার মানুষের বুকের রক্ত জোঁকের মতো শুষে নিয়ে রক্তশূন্য করার লিপ্সায় তাদের নির্মম রাজনৈতিক নিপীড়ন ও নিগ্রহ চলতে থাকে। ভাষা আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হলে পুলিশ প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে এবং এক পর্যায়ে ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে সালাউদ্দিন, সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বার শহীদ হন। সমস্ত বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা ও দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। ৫৪-এর নির্বাচনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠনেও ছাত্রসমাজ তথা ছাত্রলীগের অবদান ছিল প্রণিধানযোগ্য। ইতোমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন। জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন এবং তারই প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রণোদনায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। জনাব মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং টাঙ্গাইলের জনাব শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, জনাব অলি আহাদকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও খন্দকার মোশ্তাক (ইতিহাসের নৃশংস খুনি) ও শেখ মুজিবুর রহমান- দু’জনকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এ কথাগুলো উল্লেখ করার প্রাসঙ্গিকতা হলো- তখনকার জাতীয় রাজনীতিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতাদেও গুরুত্ব ও অবদান তুলে করা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরে ৯২ (ক) ধারা জারি করে শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করা হয় ও শেরে বাংলাকে অন্তরীণ করা হয়। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ অগণিত নেতা-কর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার সকল নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের বাহ্যিক দাবি ছিলো হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত মূল সত্তাটি ছিলো আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা বাতিল করে সার্বজনীন ভোটাধিকার অর্জনে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মুক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনটি ব্যাপক সফলতা লাভ করে। যার ফলশ্রুতিতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায় এবং হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীও মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু নির্বাচনের প্রশ্নে মৌলিক গণতন্ত্রের পদ্ধতিটি বহাল থেকে যায়। এ প্রশ্নে আইয়ুব খান অনড় ছিলেন। ঐ সময়ের আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মৌলিক গণতন্ত্রের পন্থার বিপরীতে ইলেক্টোরাল কলেজ সিস্টেম মেনে নিতেও আন্দোলনরত ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্মত ছিলেন। কিন্তু আইয়ুব খান এ প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি হননি। মাদার-এ-মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহ্র সঙ্গে ১৯৬৪’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটিও মৌলিক গণতন্ত্রের পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে একমাত্র চালকের আসনে না থাকলেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এটা বলে রাখা অত্যাবশ্যক, প্রাচ্যের অক্সর্ফোড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞান-চর্চার প্রশ্নে নিঃসন্দেহে প্রাচ্যের শীর্ষস্থানে অবস্থানের ক্ষেত্রে কখনোই কোন হেরফের হয়নি। তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের তথা ভারতবর্ষের সর্বশীর্ষে অবস্থান করতো। বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের আগ্রহের প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল বলেও তখনকার ইতিহাস হতে জানা যায়। ৬০০ একর জমির উপর অবস্থিত পরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সবুজে ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, এএফ রহমান, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ফজলুল হালিম চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, ড. ললিত মোহন নাথ, গোলাম মোহাম্মদ ভূঁঞা, ড. হিরন্ময় সেনগুপ্ত প্রমুখ। প্রসিদ্ধ শিক্ষকমণ্ডলীর সমাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিকে সুউচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়। এর প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টগ, পরবর্তীতে মাহমুদ হাসান এদের সযত্ন লালিত্য ও প্রতিভাদীপ্ত চেতনায় উদ্ভাসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই উপমহাদেশে গৌরবমণ্ডিত এবং জ্ঞানে প্রদীপ্ত সূর্যের মতো বিকীর্ণ অগ্নিকণায় সত্যিকার অর্থে একটা জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের জ্ঞান পিপাসুদের নজর কাড়ে। আপন মহিমায় বিকশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের একটি অনন্যসাধারণ খ্যাতির সুউচ্চ গিরিশৃঙ্গমালায় অবস্থিত বিদ্যাপীঠ হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়। জ্ঞানপিপাসু শিক্ষক এবং ছাত্রদের সমাহারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এতই দেদীপ্যমান শিখার মতো প্রজ্ব্বলিত হয় যে, তখনকার এই উপমহাদেশের বহু প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নিষ্প্রভ ও ম্রিয়মান হয়ে ওঠে। এ বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিভিন্ন সময়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন এ পর্যন্ত ৫২ জন। পৃথিবীখ্যাত কীর্তিমানরা এই ডক্টরেট ডিগ্রির সম্মান অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এ কে ফজলুল হক, স্যার যদুনাথ সরকার, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, আব্দুস সালাম, চু এন লাই, ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ, বান কি মুন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অমর্ত্য সেন, প্রণব মুখার্জী প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। মর্যাদার দিক থেকে এই সম্মানসূচক ডিগ্রি নোবেল প্রাইজের পরেই অবস্থান করে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে তো বটেই সামগ্রিকভাবে শিক্ষাঙ্গন ও সুশীল সমাজে এভাবেই স্বীকৃত হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও মর্যাদার কারণে অনেক শিক্ষক বিশেষ করে অমুসলিম শিক্ষকরা কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর্ষণ পরিত্যাগ করে যাননি। শিক্ষক এবং ছাত্রদের কাছে তখনকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গৌরবদীপ্ত আদর্শের পীঠস্থান।
স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকারের উত্তরণের আন্দোলনে ছাত্রসমাজের তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের প্রসূতিকাগার বা পাদপীঠ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ছিল মূলত ছাত্রসমাজের সর্বদলীয়। সরকার সমর্থিত এসএফ-এর একটি বিরাট অংশ ৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এই এসএফ থেকেই একটি অংশ বেরিয়ে এসে আইয়ুব- মোনায়েমের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি লেজুড়বৃত্তিতে নিবিষ্ট হয়। যাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ঘৃণার চোখে দেখতো। কালে কালে স্কলারশিপ ও বিদেশযাত্রার অভিলাষে অনেক মেধাবী ছাত্রও এই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এনএসএফ-এ যোগ দিতে বাধ্য হয়। একমাত্র ফজলুল হক হল ও ইকবাল হল বাদে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ঢাকা হলে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে তারা ছাত্র সংসদ দখল করতে সক্ষম হয়। এনএসএফ’র দাপটে মূল সংগঠন এসএফ আস্তে আস্তে বিলুপ্তই হয়ে যায়।
আমাদের সময়ে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকারের মোড়কে স্বাধীনতার চেতনাটি তিলে তিলে বাস্তব রূপ নিতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। যদিও এনএসএফ’র দোর্দণ্ড প্রতাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থরথর করে কাঁপতো। যেকোন ছাত্র-ছাত্রীর জীবন তখন অনিশ্চিত ও আতঙ্কিত ছিল। পাঁচপাত্তু গলায় সাপ ঝুলিয়ে এবং কেউ কেউ কোমরে পিস্তল গুঁজে একটা বিভীষিকা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করতে চাইতো। তার বিপরীতে বাঙালি জাতীয় চেতনা-ভিত্তিক আন্দোলনে যে তীব্রতা সৃষ্টি করতে ছাত্রলীগ সক্ষম হয়, তার মাঝেও কখনো কখনো বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ তৈরি হলেও আন্দোলনের তীব্রতায় ক্রমে ক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এনএসএফ’র বিভীষিকা স্তিমিত হতে হতে নিঃশেষিত হয়ে যায়।
৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর শাজাহান সিরাজ যখন সাধারণ সম্পাদক ও আমি সভাপতি নির্বাচিত হই, তখন ক্রমান্বয়ে গোটা বিস্তীর্ণ বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও ছাত্রলীগের পরিপূর্ণ করায়ত্তে চলে আসে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনে ছাত্রলীগের প্রায় সকল সভা কানায় কানায় ছাত্র-ছাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সরাসরি ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ যে অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করে, তখনকার সর্বজনপঠিত বাঙালির চিন্তার দর্পণ ইত্তেফাক আট কলাম কাঠের শিরোনাম করেছিল- “এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবি কী দিয়া? বালির বাঁধ?” ওই নির্বাচনের পর ছাত্র-ছাত্রীরা তো বটেই, সমগ্র শিক্ষকসমাজ ছাত্রলীগের প্রতি প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট ও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের আবেগাপ্লুত হৃদয়ের প্রত্যক্ষ সমর্থন দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের দোতলার বারান্দায় অসংখ্য চেয়ার পেতে সকল বিভাগ ও অনুষদের শিক্ষকরা আমাদের বক্তৃতা শুনতে আসতেন। অর্থাৎ, তাঁদের হৃদয়ের সমর্থন প্রকাশ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা নয়, সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দিগন্তবিস্তৃত আলোকরশ্মিতে উদ্ভাসিত করে উপাচার্য হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী এসেও যখন শিক্ষকদের সঙ্গে বারান্দায় বসতেন, তখন সবার মধ্যে যে আবেগ ও উন্মাদনা সৃষ্টি হতো, তা অবর্ণনীয়। আমি অজানা এক বিস্ময়কর উন্মাদনায় উদ্ভাসিত হয়ে পাগলপ্রায় উত্তেজনায় বক্তৃতা করতাম। ছাত্রসভার কলেবর তো বটেই, শিক্ষকবৃন্দ- বিশেষ করে আবু সাঈদ চৌধুরীর উপস্থিতি সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো আমার হৃদয়কে উদ্বেলিত করতো।
তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তাল তরঙ্গমালা সারা বাংলাদেশের প্রান্তিক জনতার হৃদয়কে এমনভাবে আপ্লুত করে যে দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই চেতনার সাথে একান্তভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। জীবনের সব নদী সমুদ্রের মোহনায় এসে অভূতপূর্বভাবে একই স্রোতধারায় মিলিত হয়ে যায়।
টিএসসি’র একটি ছাত্রসভায় উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর উদ্বেলিত হৃদয়ের আবেগ এবং নির্মল উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়ে এক বক্তৃতায় বললেন- আমার সামনে যখন সুখের দিন আসে, কোন অভাবনীয় আনন্দে আমার হৃদয় যখন আপ্লুত হয়ে ওঠে- তখন নানা সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষীর স্মৃতি আমাকে বিমোহিত করে, বিমুগ্ধ করে। কিন্তু আমার জীবনে যখন কোন দুঃসময় আসে, দুঃখ-বেদনা-দ্বিধা-সংশয়, দুঃসময়ের কালো মেঘ যখন আমার হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতিকে ঢেকে ফেলতে চায় তখন আমার শ্রান্ত ক্লান্ত অনুভূতির মানসপটে দু’টি মুখ ভেসে ওঠে। একটি মুখ আমার পিতা আব্দুল হামিদ চৌধুরীর, অন্য মুখটি আমার সন্তানপ্রতিম নূরে আলম সিদ্দিকীর। সমগ্র টিএসসি এবং তার চতুষ্পার্শ্ব তখন উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের গর্জনের মতো করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে কেন্দ্র করে যে শব্দটি উচ্চারণ করেন, তার গভীরে ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় প্রতীতির অভিব্যক্তি। যে চেতনাটিকে ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে আমি হয়তো বারবার স্পর্শ করতে পেরেছিলাম।
সেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর পেছনের অভিসন্ধিটা শুধুমাত্র ভাষাকেন্দ্রিক ছিলো না। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের চারণক্ষেত্র বানিয়ে বাঙালি জাতিকেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার দুরভিসন্ধি ছিলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই, ৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের (টু নেশন থিওরি) ভিত্তিতে যে দেশটির জন্ম হলো এবং ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এদেশের মানুষ বুক উজাড় করে পাকিস্তানের স্বপক্ষে মুসলিম লীগকে ভোট প্রদান কারণ, তারাই ৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর উক্তির শুধু প্রতিবাদই করলো না ৫৪’র নির্বাচনে শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয়ের মাধ্যমে গঠিত প্রাদেশিক পরিষদে সর্বসম্মতভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস সৃষ্টি করে। যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এই সফল আন্দোলনের উদ্ভব, বিস্তৃতি ও সফলতা সবটুকুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং এর সাফল্যের পেছনে পরিচালিত আন্দোলন সবটুকুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক। তারই রেশ ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ও সফলতার পাদপীঠ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা যায়। আমতলা ও বটতলা এই দু’টিই ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার হতে ৬ দফা ভিত্তিক স্বাধীনতার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এর উন্মেষ, বিকাশ, ব্যপ্তি ও সফলতার পাদপীঠ হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও মধুর ক্যান্টিনের কর্মীসভা, বটতলা ও আমতলার ছাত্রসভায় জগন্নাথ কলেজের জাগ্রত মিছিলই প্রাণ সঞ্চার করতো; তবুও ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থানেরও লীলাক্ষেত্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় দাঁড়িয়ে আমি প্রায়শই আমার বক্তৃতায় উদ্ধৃত করতাম- “গোকলে বলতেন- what Bengal thinks today, the whole India thinks it tomorrow এর সূত্র ধরে আমি বলতাম- what we think today, the rest of politicians think it tomorrow.
এরই ধারাবাহিতায় ডাকসু’র নির্বাচনে ছাত্রলীগের একক বিজয়ের গৌরব অর্জন এবং ৭০’র নির্বাচন ও ডাকসু’র নির্বাচনে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভে মারাত্মকভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। এদেশের যেকোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়ে এবং ৭১’র মার্চে ঐতিহাসিক গণজাগরণ তৈরি ও তাকে লালন করে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার সফলতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভূতপূর্ব প্রভাবকে অবারিত চিত্তে স্বীকৃতি দিতেই হয়। পৃথিবীর কোন জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনে এমনকি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনেও ছাত্রদের এমন ব্যাপক ও অগ্রণী ভূমিকা কোনদিনই ছিল না। ভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে অবশ্যই বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু সমগ্র আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি। তবুও বলি, এই আন্দোলনের মূল কারিগর হলো ছাত্রলীগ।
এই নিরিখে নিশ্চিতভাবে উপসংহার টানা যায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশ যে একটি সমুদ্রের মোহনায় একীভূত চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের অভিপ্রায়ে সকল মানুষ উদ্বেলিত চিত্তে এক ও অভিন্ন সত্তায় বিলীন হয়ে যায়, সেখানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব ছিল অভাবনীয়।
তারই সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে তৎকালীন বৃটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। এর মাত্র তিনদিন পূর্বে ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এরপর ২৭শে মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আরও জোর দাবি জানান ব্যারিস্টার আর নাথান, ডি আর কুলচাঁদ।
বঙ্গভঙ্গের ফলশ্রুতিতে পূর্ব-বাংলার শিক্ষাঙ্গনে যে দিগন্ত-বিস্তৃত সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়, বঙ্গভঙ্গ বাতিলের ফলে সেই সম্ভাবনা ঘনঘোর কালো মেঘে ঢেকে যায়। ১৯০৬ সালে জন্মপ্রাপ্ত মুসলিম লীগ শুরু থেকেই প্রাসাদ রাজনীতিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তবুও নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ও জনাব এ কে ফজলুল হক ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার দাবিটি সোচ্চার করে তোলেন। তখনকার ভারতে বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ২১শে জানুয়ারি ঢাকা সফরে এসে ঘোষণা করেন, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ তিনি সরকারের কাছে পেশ করবেন। ফলে ওই বছরেরই মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির অধীনে ২৫টি সাব-কমিটির মাধ্যমে ভারত সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা তৈরি করে। ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির রিপোর্ট অনুমোদন দেন ভারত সচিব। কিন্তু বিধি বাম, এরই মধ্যে সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তখন বিশ্বের মোড়লী অনেকটাই ইংরেজদের হাতেই ছিল। সরাসরি তারা এই বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
জন্মলগ্ন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রতিকূলতা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে একটা দক্ষ যোদ্ধার মতোই সামনের দিকে এগোতে থাকে। যদিও ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটা বিরাট অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব-বাংলার মানুষ তাতে নিদারুণভাবে ভেঙে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাদের প্রত্যাশার সূর্য ঘনঘোর অন্ধকারের মাঝে নিপতিত হয়। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান।
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন মাইকেল স্যাগলারের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ১৩ টি সুপারিশ করেছিল, এর কিছু রদবদলসহ ১৯২০ সালে ভারতীয় আইনসভায় গৃহীত হয় এবং একই বছরের ২৩শে মার্চ তৎকালীন গভর্নর জেনারেল এই বিলে তার সদয় সম্মতি প্রদান করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পি জে হার্টগ ১৯২০ সালের ১লা ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। অবশেষে অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রমের পর ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে পথ চলা শুরু করে। ওইদিন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন অনুষদেই কোন ছাত্রী ভর্তি হননি। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সবুজ চাদরে ঢাকা রমনা এলাকার ৬০০ একর জমি নিয়ে গঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম শিক্ষাবর্ষে ৮৭৭ জন ছাত্র এবং ৬০ জন শিক্ষককে নিয়ে এর সুদীর্ঘ পদচারণার শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুভ সূচনা-লগ্ন হতেই মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যরশ্মির মতো তার দ্যুতি ছড়াতে থাকে। তখনকার অবিভক্ত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা- সর্বত্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি এমন একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হয় যে, সত্যি বলতে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জীও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ৬০০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত হয়ে ওঠে। শুধু অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নয়, বিভিন্ন দেশ, এমনকি খোদ গ্রেট বৃটেন থেকেও এখানে জ্ঞান আহরণের অন্বেষণে ছুটে আসেন অনেকে।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গাঢ় সবুজের মোড়কে আবৃত একটা প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি গৌরবান্বিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই শুধু নয়, বরং দিনে দিনে রাজনৈতিক সচেতনতার পীঠস্থান হিসেবে গড়ে ওঠে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাদপীঠ হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। এর সবচেয়ে বড় গৌরবের দিক হল- বিশ্ববিদ্যালয়টি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তিতে গঠিত হলেও পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয় চেতনার পীঠস্থান হিসেবে প্রতিস্থাপিত হতে পেরেছিল। বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, তার ব্যাপ্তি, বিকাশ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার চেতনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকা বাংলার ইতিহাসের লালিত সম্পদ। পাকিস্তানের সূচনালগ্নেই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর দুঃস্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে যে অনির্বাণ চেতনা ও আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল- সেটিরও প্রসূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, শ্রী রাধাগোবিন্দ বসাক, এ এফ রহমান, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. জ্ঞানচন্দ্র, ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখের মতো একঝাঁক প্রতিভাপ্রদীপ্ত শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করা, আর অন্যদিকে গণতন্ত্রের শানিত চেতনায় উজ্জীবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিশ্বের এক বিস্ময়কর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর আর কোন বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে সফল নেতৃত্ব দিয়ে এভাবে সাফল্যের সোনালী সৈকতে পৌঁছে দিতে পেরেছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই।
কী অদ্ভুত- কী আশ্চর্যজনক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মধারা ! দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, জিন্নাহ মুসলিম লীগের মাধ্যমে জমিদারদের প্রাসাদে অবরুদ্ধ অভিজাত মুসলিম লীগের রুদ্ধদ্বার রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের দুয়ারে টেনে আনার মহান প্রচেষ্টার পেছনে অনুপ্রেরণার উৎস ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি জনাব মাইনউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক কওে ঢাকায় পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এখানে নতুন প্রজন্মকে জানানো প্রয়োজন, নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের উত্তরাধিকারই হল পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। আমার অনুভূতিতে একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগে, যে ছাত্রলীগ পাকিস্তান আনলো- সেই ছাত্রলীগই পাকিস্তান ভাঙলো। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট করে একটি কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলনে কারারুদ্ধ হওয়ার পর আমাদের মুজিব ভাই (তাঁকে আমি ‘বস’ বলে সম্বোধন করতাম) কারা-অভ্যন্তরে একদিন আমাকে খুবই আন্তরিকতার সাথে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেছিলেন- আলম, পাকিস্তান ভাঙা তোদের পক্ষে যতখানি সহজ, আমার জন্য ততখানি নয়। কারণ, পাকিস্তান অর্জনে আমাকে অন্যদের সাথে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে, অনেক নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। তবুও আমার মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কোটারি স্বার্থের কুটিল রাজনীতির কারণে পাকিস্তান একদিন ভাঙবেই। বাঙালি জাতীয় চেতনা তো দূরে থাক, আমাদের ভাষার অধিকারটুকুও রক্তের বিনিময়ে কিনতে হয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তানকে তারা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ভাবে না, ভাবে শোষনের চারণক্ষেত্র হিসেবে।
৪৭ থেকে ৬৬ -এই ঊনিশটি বছর ক্রমাগত পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের কষাঘাতে শোষণের চারণক্ষেত্ররূপেই পরিণত হয় ১৪০০ মাইল দূরে অবস্থিত এই বঙ্গভূমি। স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকারের মোড়কে স্বাধীনতাকে সাফল্যের সৈকতে পৌঁছে দেয়ার মূল কারিগর ছিল ছাত্রলীগ। এই আন্দোলনের মূল স্থপতি পাকিস্তানের শোষনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রতিবাদকারী এবং রাজনীতির দিগন্তবিস্তৃত আকাশে বাঙালি জাতীয় চেতনার প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তারও পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতির যাত্রা শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন প্রদানের মধ্য দিয়ে। ৬ দফা কর্মসূচিটির গুরুত্ব প্রথমে আওয়ামী লীগ সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে না পারায় তখনকার ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের কাছে মুজিব ভাই ৬ দফা কর্মসূচিটি প্রচণ্ড আবেগাপ্লুত হৃদয়ে তুলে দেন এবং তাঁরা উভয়েই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতেই ৬ দফার পক্ষে একটি সফল আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাই তো আমি বারংবার বলি, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্য হিসেবে আখ্যায়িত করলে তাকে বক্ষে ধারণ করা দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ হল ছাত্রলীগ। তাঁকে সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করা হলে তার উচ্ছ্বসিত ঊর্মিমালা হল ছাত্রলীগ। তাঁকে বটবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা হলে তার মাটিতে প্রোথিত শিকড় হল ছাত্রলীগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দাঁড়িয়ে বাংলার চারণ কবির মতো আমার কণ্ঠে যখন এই পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারিত হতো, তখন সভায় উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চিত্ত তো উদ্বেলিত হতোই, তখন আমার কাছে মনে হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গাছের পত্র-পল্লব, প্রতিটি ইট-পাথরের কণায় কণায় অনবদ্যভাবে এই সুর ঝঙ্কারিত হতো। যেটা সমগ্র শ্রোতাকে এবং আমার বিমুগ্ধ চিত্তকে উদ্বেলিত করতো, উচ্ছ্বসিত করতো, একটি সম্মোহনী সুরের স্রোতধারায় আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। আজও আমার স্মৃতিতে বারবার ভেসে ওঠে বিশ্বকে অবাক করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইসব গৌরবদীপ্ত সোনাঝরা অজস্র স্মৃতিমালা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদিকে জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটানোর স্রোতস্বিনী অনন্ত নদী। অন্যদিকে আন্দোলনের দাবানল বক্ষে লালন করা একটি জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস। যদিও তখনকার আন্দোলনের শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল জগন্নাথ কলেজ। জগন্নাথ কলেজ ও তখনকার কায়েদে আযম কলেজ (বর্তমান শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ) থেকে মিছিল না আসলে আমতলা অথবা বটতলা- কোন সভাই জমে উঠতো না। তবুও স্বীকার করতেই হয়, শুধু ছাত্রলীগই নয়, সকল ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান ছাত্ররা অত্যন্ত প্রত্যয়দৃঢ়ভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। ফলে আন্দোলনটি সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো বেগবান হয়। ১৯৪৬ সালের গণভোটে (যেটিকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গণভোট হিসেবেও কেউ কেউ বর্ণনা করেন) মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। তখন অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ার ছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। খাজা নাজিমউদ্দিনও মুসলিম লীগ করতেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করে দলটির নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শেরে বাংলা লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক হওয়া সত্ত্বেও ৪৬-এর নির্বাচনে তিনি কৃষক প্রজা পার্টির তরফ থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। শেরে বাংলা যখন যেখান থেকেই নির্বাচন করেছেন, কেউ তাকে পরাজিত করতে পারেনি। ৪৬-এর প্রচণ্ড জনস্রোতে (মুসলিম লীগের পক্ষে) তিনি নির্বাচিত হলেও মুসলিম লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী দাঙ্গা-বিধ্বস্ত কোলকাতায় মুসলমানদেরকে অসহায় অবস্থায় রেখে ক্ষমতার আকর্ষণে তৎক্ষণাৎ ঢাকা আসতে রাজি হননি। নতুন প্রজন্মকে অবহিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন, তাঁর বিরুদ্ধে জোরালো ও সূক্ষ্ম অপপ্রচার করা হয় যে, তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতেন। কিন্তু মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং পরিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক মননশীলতার অধিকারী। কোলকাতায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে তাঁর ইতিহাস-স্বীকৃত অবদানে গান্ধীজী মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে কোলকাতায় প্রচণ্ডভাবে সাধুবাদ জানান এবং তাঁকে সাথে করে দাঙ্গা-কবলিত নোয়াখালী সফর করেন। ছাগদুগ্ধই মহাত্মা গান্ধীর প্রধান খাদ্য ছিল। বেরসিক নোয়াখালীবাসী গান্ধীজীর ছাগলটি চুরি করে খেয়ে ফেলে।
এখন আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে আসা যাক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জোরালো প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রচারাভিযান শুরু করে। এ সমস্ত দাবির প্রতি কোন পরোয়া না করে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে বাংলা ভাষার স্থান না হওয়ায় ১১ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পুলিশ বিক্ষোভে লাঠিচার্জ করে ও কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত নেতাদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সারাদেশে ছাত্রবিক্ষোভ শুরু হয়। শেষপর্যন্ত খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সাথে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এর ৪ দিন পর পাকিস্তানের জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ২১শে মার্চ ঢাকায় ঘোড়দৌড় (রেসকোর্স) ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা করেন এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্পষ্ট ঘোষণা দেন। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ্ সাহেব ভাষণ দেন। সেখানেও তিনি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দেন যে, ‘উর্দু এন্ড উর্দু এলোন শেল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’। সাথে সাথে ছাত্রদের পক্ষে থেকে তীব্র কণ্ঠে একটি ‘না’ উচ্চারণের মাধ্যমে এই ঘোষণার প্রতিবাদ জানানো হয়। মার্চের ২৪ তারিখে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল জনাব জিন্নাহ্র সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন সর্বজনাব শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, মোহাম্মদ তোহা, আজিজ আহমেদ, অলি আহাদ, নাঈমউদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম ও নজরুল ইসলাম।
১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও সরকারবিরোধী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হয়। এটি মুসলিম লীগ সরকারের স্পষ্ট বিরোধী একটি সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৮ সালের ৭ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হলে লিয়াকত আলী খান নিশ্চুপ থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাঙালি জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, মননশীলতা, মানসিকতা- সবকিছুর উন্মেষ বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ৩রা মার্চ থেকে যে ধর্মঘট শুরু হয়, সেই ধর্মঘটেও ছাত্রলীগকে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমাদের মুজিব ভাইকে শাস্তিস্বরূপ ১৫ টাকা জরিমানা করা হয়। তিনি তা দিতে অস্বীকার করলে গ্রেফতার হন এবং ৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আন্দোলন চলার সময় কারাগারে থেকে অনশন ধর্মঘটের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সাথে সংহতি ও প্রতীতি ঘোষণা করেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাংলার ভাষা, সংস্কৃতি, মননশীলতা ও মানসিকতাকে পদদলিত করার কুটিল ষড়যন্ত্রে মানসিকতায় এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে শোষনের চারণক্ষেত্র বানানোর লক্ষ্যে এবং লিপ্সায় এই বাংলার মানুষের বুকের রক্ত জোঁকের মতো শুষে নিয়ে রক্তশূন্য করার লিপ্সায় তাদের নির্মম রাজনৈতিক নিপীড়ন ও নিগ্রহ চলতে থাকে। ভাষা আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হলে পুলিশ প্রথমে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে এবং এক পর্যায়ে ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে সালাউদ্দিন, সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বার শহীদ হন। সমস্ত বাংলাদেশ আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা ও দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। ৫৪-এর নির্বাচনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠনেও ছাত্রসমাজ তথা ছাত্রলীগের অবদান ছিল প্রণিধানযোগ্য। ইতোমধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন। জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন এবং তারই প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রণোদনায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। জনাব মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং টাঙ্গাইলের জনাব শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, জনাব অলি আহাদকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও খন্দকার মোশ্তাক (ইতিহাসের নৃশংস খুনি) ও শেখ মুজিবুর রহমান- দু’জনকে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এ কথাগুলো উল্লেখ করার প্রাসঙ্গিকতা হলো- তখনকার জাতীয় রাজনীতিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতাদেও গুরুত্ব ও অবদান তুলে করা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরে ৯২ (ক) ধারা জারি করে শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করা হয় ও শেরে বাংলাকে অন্তরীণ করা হয়। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ অগণিত নেতা-কর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার সকল নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের বাহ্যিক দাবি ছিলো হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত মূল সত্তাটি ছিলো আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা বাতিল করে সার্বজনীন ভোটাধিকার অর্জনে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মুক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনটি ব্যাপক সফলতা লাভ করে। যার ফলশ্রুতিতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায় এবং হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীও মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু নির্বাচনের প্রশ্নে মৌলিক গণতন্ত্রের পদ্ধতিটি বহাল থেকে যায়। এ প্রশ্নে আইয়ুব খান অনড় ছিলেন। ঐ সময়ের আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মৌলিক গণতন্ত্রের পন্থার বিপরীতে ইলেক্টোরাল কলেজ সিস্টেম মেনে নিতেও আন্দোলনরত ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্মত ছিলেন। কিন্তু আইয়ুব খান এ প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি হননি। মাদার-এ-মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহ্র সঙ্গে ১৯৬৪’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটিও মৌলিক গণতন্ত্রের পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে একমাত্র চালকের আসনে না থাকলেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এটা বলে রাখা অত্যাবশ্যক, প্রাচ্যের অক্সর্ফোড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও শিক্ষা-দীক্ষা এবং জ্ঞান-চর্চার প্রশ্নে নিঃসন্দেহে প্রাচ্যের শীর্ষস্থানে অবস্থানের ক্ষেত্রে কখনোই কোন হেরফের হয়নি। তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের তথা ভারতবর্ষের সর্বশীর্ষে অবস্থান করতো। বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের আগ্রহের প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল বলেও তখনকার ইতিহাস হতে জানা যায়। ৬০০ একর জমির উপর অবস্থিত পরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সবুজে ঘেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য শিক্ষকমণ্ডলীর মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, এএফ রহমান, সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মুনীর চৌধুরী, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ফজলুল হালিম চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, ড. ললিত মোহন নাথ, গোলাম মোহাম্মদ ভূঁঞা, ড. হিরন্ময় সেনগুপ্ত প্রমুখ। প্রসিদ্ধ শিক্ষকমণ্ডলীর সমাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিকে সুউচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়। এর প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টগ, পরবর্তীতে মাহমুদ হাসান এদের সযত্ন লালিত্য ও প্রতিভাদীপ্ত চেতনায় উদ্ভাসিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই উপমহাদেশে গৌরবমণ্ডিত এবং জ্ঞানে প্রদীপ্ত সূর্যের মতো বিকীর্ণ অগ্নিকণায় সত্যিকার অর্থে একটা জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের জ্ঞান পিপাসুদের নজর কাড়ে। আপন মহিমায় বিকশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের একটি অনন্যসাধারণ খ্যাতির সুউচ্চ গিরিশৃঙ্গমালায় অবস্থিত বিদ্যাপীঠ হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়। জ্ঞানপিপাসু শিক্ষক এবং ছাত্রদের সমাহারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এতই দেদীপ্যমান শিখার মতো প্রজ্ব্বলিত হয় যে, তখনকার এই উপমহাদেশের বহু প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নিষ্প্রভ ও ম্রিয়মান হয়ে ওঠে। এ বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিভিন্ন সময়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন এ পর্যন্ত ৫২ জন। পৃথিবীখ্যাত কীর্তিমানরা এই ডক্টরেট ডিগ্রির সম্মান অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এ কে ফজলুল হক, স্যার যদুনাথ সরকার, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, আব্দুস সালাম, চু এন লাই, ড. মাহাথির বিন মোহাম্মদ, বান কি মুন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অমর্ত্য সেন, প্রণব মুখার্জী প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। মর্যাদার দিক থেকে এই সম্মানসূচক ডিগ্রি নোবেল প্রাইজের পরেই অবস্থান করে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে তো বটেই সামগ্রিকভাবে শিক্ষাঙ্গন ও সুশীল সমাজে এভাবেই স্বীকৃত হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও মর্যাদার কারণে অনেক শিক্ষক বিশেষ করে অমুসলিম শিক্ষকরা কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আমন্ত্রণ পাওয়া সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর্ষণ পরিত্যাগ করে যাননি। শিক্ষক এবং ছাত্রদের কাছে তখনকার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গৌরবদীপ্ত আদর্শের পীঠস্থান।
স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকারের উত্তরণের আন্দোলনে ছাত্রসমাজের তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের প্রসূতিকাগার বা পাদপীঠ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন ছিল মূলত ছাত্রসমাজের সর্বদলীয়। সরকার সমর্থিত এসএফ-এর একটি বিরাট অংশ ৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এই এসএফ থেকেই একটি অংশ বেরিয়ে এসে আইয়ুব- মোনায়েমের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি লেজুড়বৃত্তিতে নিবিষ্ট হয়। যাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ঘৃণার চোখে দেখতো। কালে কালে স্কলারশিপ ও বিদেশযাত্রার অভিলাষে অনেক মেধাবী ছাত্রও এই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এনএসএফ-এ যোগ দিতে বাধ্য হয়। একমাত্র ফজলুল হক হল ও ইকবাল হল বাদে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ঢাকা হলে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে তারা ছাত্র সংসদ দখল করতে সক্ষম হয়। এনএসএফ’র দাপটে মূল সংগঠন এসএফ আস্তে আস্তে বিলুপ্তই হয়ে যায়।
আমাদের সময়ে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকারের মোড়কে স্বাধীনতার চেতনাটি তিলে তিলে বাস্তব রূপ নিতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে। যদিও এনএসএফ’র দোর্দণ্ড প্রতাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থরথর করে কাঁপতো। যেকোন ছাত্র-ছাত্রীর জীবন তখন অনিশ্চিত ও আতঙ্কিত ছিল। পাঁচপাত্তু গলায় সাপ ঝুলিয়ে এবং কেউ কেউ কোমরে পিস্তল গুঁজে একটা বিভীষিকা ও আতঙ্কের সৃষ্টি করতে চাইতো। তার বিপরীতে বাঙালি জাতীয় চেতনা-ভিত্তিক আন্দোলনে যে তীব্রতা সৃষ্টি করতে ছাত্রলীগ সক্ষম হয়, তার মাঝেও কখনো কখনো বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ তৈরি হলেও আন্দোলনের তীব্রতায় ক্রমে ক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এনএসএফ’র বিভীষিকা স্তিমিত হতে হতে নিঃশেষিত হয়ে যায়।
৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর শাজাহান সিরাজ যখন সাধারণ সম্পাদক ও আমি সভাপতি নির্বাচিত হই, তখন ক্রমান্বয়ে গোটা বিস্তীর্ণ বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও ছাত্রলীগের পরিপূর্ণ করায়ত্তে চলে আসে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনে ছাত্রলীগের প্রায় সকল সভা কানায় কানায় ছাত্র-ছাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সরাসরি ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ যে অবিস্মরণীয় বিজয় অর্জন করে, তখনকার সর্বজনপঠিত বাঙালির চিন্তার দর্পণ ইত্তেফাক আট কলাম কাঠের শিরোনাম করেছিল- “এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবি কী দিয়া? বালির বাঁধ?” ওই নির্বাচনের পর ছাত্র-ছাত্রীরা তো বটেই, সমগ্র শিক্ষকসমাজ ছাত্রলীগের প্রতি প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট ও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের আবেগাপ্লুত হৃদয়ের প্রত্যক্ষ সমর্থন দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলাভবনের দোতলার বারান্দায় অসংখ্য চেয়ার পেতে সকল বিভাগ ও অনুষদের শিক্ষকরা আমাদের বক্তৃতা শুনতে আসতেন। অর্থাৎ, তাঁদের হৃদয়ের সমর্থন প্রকাশ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা নয়, সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দিগন্তবিস্তৃত আলোকরশ্মিতে উদ্ভাসিত করে উপাচার্য হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরী এসেও যখন শিক্ষকদের সঙ্গে বারান্দায় বসতেন, তখন সবার মধ্যে যে আবেগ ও উন্মাদনা সৃষ্টি হতো, তা অবর্ণনীয়। আমি অজানা এক বিস্ময়কর উন্মাদনায় উদ্ভাসিত হয়ে পাগলপ্রায় উত্তেজনায় বক্তৃতা করতাম। ছাত্রসভার কলেবর তো বটেই, শিক্ষকবৃন্দ- বিশেষ করে আবু সাঈদ চৌধুরীর উপস্থিতি সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো আমার হৃদয়কে উদ্বেলিত করতো।
তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তাল তরঙ্গমালা সারা বাংলাদেশের প্রান্তিক জনতার হৃদয়কে এমনভাবে আপ্লুত করে যে দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষক-শিক্ষিকারা এই চেতনার সাথে একান্তভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। জীবনের সব নদী সমুদ্রের মোহনায় এসে অভূতপূর্বভাবে একই স্রোতধারায় মিলিত হয়ে যায়।
টিএসসি’র একটি ছাত্রসভায় উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর উদ্বেলিত হৃদয়ের আবেগ এবং নির্মল উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়ে এক বক্তৃতায় বললেন- আমার সামনে যখন সুখের দিন আসে, কোন অভাবনীয় আনন্দে আমার হৃদয় যখন আপ্লুত হয়ে ওঠে- তখন নানা সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষীর স্মৃতি আমাকে বিমোহিত করে, বিমুগ্ধ করে। কিন্তু আমার জীবনে যখন কোন দুঃসময় আসে, দুঃখ-বেদনা-দ্বিধা-সংশয়, দুঃসময়ের কালো মেঘ যখন আমার হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতিকে ঢেকে ফেলতে চায় তখন আমার শ্রান্ত ক্লান্ত অনুভূতির মানসপটে দু’টি মুখ ভেসে ওঠে। একটি মুখ আমার পিতা আব্দুল হামিদ চৌধুরীর, অন্য মুখটি আমার সন্তানপ্রতিম নূরে আলম সিদ্দিকীর। সমগ্র টিএসসি এবং তার চতুষ্পার্শ্ব তখন উচ্ছ্বসিত সমুদ্রের গর্জনের মতো করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে কেন্দ্র করে যে শব্দটি উচ্চারণ করেন, তার গভীরে ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় প্রতীতির অভিব্যক্তি। যে চেতনাটিকে ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে আমি হয়তো বারবার স্পর্শ করতে পেরেছিলাম।
সেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর পেছনের অভিসন্ধিটা শুধুমাত্র ভাষাকেন্দ্রিক ছিলো না। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের চারণক্ষেত্র বানিয়ে বাঙালি জাতিকেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার দুরভিসন্ধি ছিলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই, ৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের (টু নেশন থিওরি) ভিত্তিতে যে দেশটির জন্ম হলো এবং ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এদেশের মানুষ বুক উজাড় করে পাকিস্তানের স্বপক্ষে মুসলিম লীগকে ভোট প্রদান কারণ, তারাই ৪৮ সালে পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর উক্তির শুধু প্রতিবাদই করলো না ৫৪’র নির্বাচনে শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয়ের মাধ্যমে গঠিত প্রাদেশিক পরিষদে সর্বসম্মতভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস সৃষ্টি করে। যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এই সফল আন্দোলনের উদ্ভব, বিস্তৃতি ও সফলতা সবটুকুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং এর সাফল্যের পেছনে পরিচালিত আন্দোলন সবটুকুই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক। তারই রেশ ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ও সফলতার পাদপীঠ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিহিত করা যায়। আমতলা ও বটতলা এই দু’টিই ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার হতে ৬ দফা ভিত্তিক স্বাধীনতার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এর উন্মেষ, বিকাশ, ব্যপ্তি ও সফলতার পাদপীঠ হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও মধুর ক্যান্টিনের কর্মীসভা, বটতলা ও আমতলার ছাত্রসভায় জগন্নাথ কলেজের জাগ্রত মিছিলই প্রাণ সঞ্চার করতো; তবুও ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থানেরও লীলাক্ষেত্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় দাঁড়িয়ে আমি প্রায়শই আমার বক্তৃতায় উদ্ধৃত করতাম- “গোকলে বলতেন- what Bengal thinks today, the whole India thinks it tomorrow এর সূত্র ধরে আমি বলতাম- what we think today, the rest of politicians think it tomorrow.
এরই ধারাবাহিতায় ডাকসু’র নির্বাচনে ছাত্রলীগের একক বিজয়ের গৌরব অর্জন এবং ৭০’র নির্বাচন ও ডাকসু’র নির্বাচনে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভে মারাত্মকভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। এদেশের যেকোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয়ে এবং ৭১’র মার্চে ঐতিহাসিক গণজাগরণ তৈরি ও তাকে লালন করে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার সফলতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভূতপূর্ব প্রভাবকে অবারিত চিত্তে স্বীকৃতি দিতেই হয়। পৃথিবীর কোন জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনে এমনকি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনেও ছাত্রদের এমন ব্যাপক ও অগ্রণী ভূমিকা কোনদিনই ছিল না। ভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে অবশ্যই বলতে হয়, বঙ্গবন্ধু সমগ্র আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি। তবুও বলি, এই আন্দোলনের মূল কারিগর হলো ছাত্রলীগ।
এই নিরিখে নিশ্চিতভাবে উপসংহার টানা যায়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশ যে একটি সমুদ্রের মোহনায় একীভূত চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের অভিপ্রায়ে সকল মানুষ উদ্বেলিত চিত্তে এক ও অভিন্ন সত্তায় বিলীন হয়ে যায়, সেখানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব ছিল অভাবনীয়।