ঈদ আনন্দ ২০১৮

বিশেষ রচনা

বোকা-বকুনি

পবিত্র সরকার

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৪:০৩ পূর্বাহ্ন

এ লেখাটার শুরু করব ভেবেছিলাম জীবননানন্দ থেকে টুকলিফাই-কাম-প্যারডি করে- ‘সকলেই বোকা নয়, কেউ কেউ বোকা’ -কিন্তু এক লহমাতেই বুঝে গেলাম তা যদি লিখি সে হবে কী প্রাণঘাতী মিথ্যাচার। আসলে কথাটা ঠিক উলটো। সকলেই বোকা। একটানা নিরবচ্ছিন্নভাবে বোকা না হলেও কখনও-কখনও বোকা, কোনও-কোনও মুহূর্তে, দিনে বা বয়সে বা পর্যায়ে, প্রায়ই, মাঝে মধ্যে বা কদাচিৎ বোকা। জন্ম থেকে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত অব্যাহতভাবে নিখুঁত ও নিশ্ছিদ্র বোকা কেউ আছে কি না আমি জানি না, কিন্তু আজীবন, অনাহত, অব্যাহত, অবিক্ষিপ্ত, অভিনন্দিত চালাকও কেউ নেই। কথায় বোকা, কাজে
আর আচরণে বোকা। স্বরচিত বোকা, বানানো বোকা। আমি অবশ্য এই বিবেচনা থেকে মেয়েদের বাদ দিচ্ছি।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বয়ঃসন্ধির আগে পর্যন্ত মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি চালাক থাকে, তারপর পুরুষ-প্রধান সমাজ তাদের জন্যে একটা ‘বোকায়ন’-এর প্রোগ্রাম শুরু করে। পুরুষের সমাজভাবে, ‘রসিকতা নাকি? বললেই হলো, মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে চালাক হবে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা!’ কোন্‌ গোঁফদাড়িওয়ালা লাঙ্গুলহীন সমাজ এটা প্রাণে ধরে মেনে নেবে-নানা রকম খাপ পঞ্চায়েত তো হরিয়ানার বাইরেও সারা পৃথিবীতেই এখানে-ওখানে ঘাপটি মেরে বসে আছে! কাজেই মেয়েদের ‘সাইজ’ করো, পুরুষের তুলনায় যাতে ওরা কিছুতেই বেশি চালাক থাকতে না পারে তার জন্যে হাজারো ফ্যান্তাফ্যাচাং করো। মেয়েরা সেই অ্যাসেম্বলি লাইনে পড়ে ঢিট হয়ে যায়। প্রকৃতির পক্ষপাতের চিকিৎসা মানুষই করে। কাজেই আমার এ লেখার একমাত্র ও মহৎ বিষয় হলো বোকা পুং, আমিও যার মধ্যে পড়ি। তবে আমার সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে আপনাদের কাছে ক্যারদানি দেখানোর জন্যে শেকস্‌পিয়ারের প্রাতঃস্মরণীয় fool-দের নিয়েও আমি কথা বলবো না। তারা শুনেছি যতটা বোকা তার চেয়ে বেশি দার্শনিক, কাজেই ওখানে খাপ খোলবার ক্ষমতা আমার নেই। ওটা নিয়ে ইংরেজিনবিশেরা লিখুক। আমি লিখব পৃথিবীর চেনাশোনা বোকাদের নিয়ে।
এই বোকাদের নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনে হলো, বোকারা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। আর আমি এই মাত্র উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক সেমিনারে প্রচুর গবেষণা প্রবন্ধ শুনে এসেছি, কাজেই এ লেখায় যদি গবেষণার জ্বরোত্তাপ খানিকটা লেগে থাকে পাঠকেরা আমাকে ক্ষমতা করবেন।
বিচারক হাবিবুর রহমানের ‘যথা শব্দ’ বা বন্ধুবর অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘সমার্থশব্দকোষ’ আমি হাতের কাছে পাচ্ছি না, কিন্তু বাঙালির মধ্যে যে অভিধান আছে তা বোকার অনেক প্রতিশব্দ বেশ আনন্দিত চিত্তে সাজিয়ে রাখে- ‘নির্বোধ’, ‘বুদ্ধিহীন’, ‘মূর্খ’, গণ্ডমূর্খ, ‘মূঢ়’, ‘বুদ্ধিহীন’, ‘অল্পবুদ্ধি’, ‘অবরোধ’, ‘অঘা’, ‘উজবুক’, ‘গবাকান্ত’, ‘গবেন্দ্র’, ‘গবেশ’, (গোবরগণেশ’, ‘গোলা’, ‘বুদ্ধু’ (আদরে ‘বুদ্ধুরাম’), ‘বোকচন্দর’, ‘বোকাহাবা’, ‘বোকাহাঁদা’, ‘বোকাপাঁঠা’, ‘বুজভোম্বল’, হিন্দি থেকে নেওয়া ‘বুরবাক’, ‘ভোঁদা’ (আদরে ‘ভোঁদু), ‘ভ্যাড়া’, ‘গান্ডু’, ‘ভ্যাবা’, ‘ভ্যাবলা’, ‘মাথামোটা’, হাঁদা, ‘হোঁদল’, ‘হাবা’, ‘হাবাগোবা’, ‘ল্যাবদা’ আদরে ‘লেবদু’, ‘মাথায় গোবর-পোরা’, ‘ঘাস-খাওয়া বুদ্ধি’ ইত্যাদি আর রূপকে ‘গোরু’, ‘গাধা’, ‘পাঁঠা’, ‘বোকাপাঁঠা’, ‘টিউবলাইট’ (যে দেরিতে রসিকতা বোঝে), ইংরেজি থেকে নেওয়া ‘ইডিয়ট’, ‘স্টুপিড’, ‘মোরন’, ‘ক্রেটিন’ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এর কয়েকটা শব্দ নিছক বর্ণনা, আবার কিছু শব্দ প্রয়োগ আবেগ-মাখানো। পৃথিবীর বোকাবৈচিত্র্য অঢেল, বোকাদের সংখ্যাও অন্তহীন। সকল ধরনের বোকার কথা বলা বাল্মীকি-ব্যাসদেব-হোমার-একত্রে এই তিনজনের পক্ষেও সম্ভব নয়।


কিন্তু ওই যে বলছিলাম। সকলেই বোকা- কোথাও কোথাও, কখনও কখনও। মানুষ-বোকাদের নিয়েই আগে শুরু করি। দেখুন, গল্পে রূপকথায় যে সব বোকাদের কথা আমরা শুনি তারাও কেউ আদ্যন্ত, চিরস্থায়ী বোকা নয়। এমন যে কালিদাস, যে যে-ডালে বসেছিল সেই ডালের গোড়াই কাটছিল, অর্থাৎ একেবারে অজবোকার যে লক্ষণ- কার্যকারণ না বোঝা-সেও একসময়ে মহাকবি কালিদাস হয়ে উঠেছিল (‘উঠেছিলেন’ বললেই বোধ হয় দেশদ্রোহী ভাষাপ্রয়োগ হতো না)। বা সেই চালাক ভাই আর বোকা ভাইয়ের সম্পত্তি ভাগ-গোরুর মুখের দিকটা, নারকেল গাছের গোড়া আর দিনে ব্যবহারের জন্যে কাঁথা যে সম্পত্তির ভাগ হিসেবে মেনে নিয়েছিল, সেও এক সময় বুদ্ধি ধার করে দাদাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছিল। কিংবা আমার নাতি ঘঞ্চু, উনুনে প্রেশার কুকারের সিটি বাজলে যে হাউমাউ করে এক সময় এসে মাকে জড়িয়ে ধরত, তাকে এক মামা শিখিয়ে দিল যে সিটি বাজলেই দু-কানে হাত চাপা দেবে- তাই সে এখন সেই সিটিকে আর মোটেই ভয় পায় না। কিংবা সেই যে সর্দারজি, কলকাতায় যার মেসের বাঙালি বন্ধুরা বলেছিল, রোজ একটা করে কাতলামাছ কিনে আমাদের খাওয়াও, মাথাটা তুমি খাও, কাতলামাছের মাথা খেলে খুব বুদ্ধি বাড়ে। সর্দারজি কিছুদিন চলার পর বুঝল কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে, মাছের আসল অংশটা সে পাচ্ছে না। সে তখন বাঙালি বন্ধুদের বলল, ‘আরে ভাই, আমার পয়সার মাছ খাচ্ছ, তা মাছ ভি তো আমাকে একটু দেবে?’ তখন বাঙালিরা বলল, ‘এই দ্যাখো, মাথার ঘিলু খেয়ে এর মধ্যেই তোমার বুদ্ধি কেমন বেড়ে গেছে, তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গেছ!’ এই ethnic joke গুলো সমন্ধে পরে আমরা আরও বলবো।

আর-এক ধরনের বোকা হলো যার উপস্থিতের বাইরে আর কিছু দেখতে পায় না, অদূরদর্শী। সলিল চৌধুরীর একটা গানে ছিল, ‘আমার বাবা বোকা ছিল, আমি তো তার ছেলে।’ এই লাইনটা আমার জীবনেও নির্ভুল হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার বাবা, ১৯৪৮ সালে, দেশভাগের পর পশ্চিমবাংলায় এসে একটা বাসস্থান করার জমি খুঁজছিলেন। কারও কাছে খোঁজ পেয়ে তিনি যাদবপুর স্টেশনের পশ্চিমদিকে জমি দেখতে এলেন। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখলেন, সেখানে সর্বব্যাপী বেতের জঙ্গল। তিনি নাক সিঁটকে বললেন, ‘দূর! এইখানে মানুষ থাকে!’ এই বলে পাঁচশো টাকা কাঠার সেই জমিকে নস্যাৎ করে চলে গেলেন।
কিন্তু আমাদের মাড়োয়ারি ভাইদের দেখুন। তাঁদের চোখে আছে স্থানের শুধু নয়, কালের দূরবীন। পঞ্চাশ বছর পরে একটা জমি কোন্‌ স্বর্গে পৌঁছে যাবে তা দেখতে পান। সেই জমিতে তাঁদের হাতে আক্ষরিক অর্থে সোনা অথবা হাইরাইজ বড়ির আকাশছোঁয়া ফসল ফলে। বোকারা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত বা সাঁটে কথা যে বুঝতে পারে না, তাও তো আপনারা জানেন। আমেরিকায় আপনি যদি কারও বাড়িতে বিকেল বেলায় যান, কথাবার্তা বলতে বলতে বাড়ির লোক এক সময় ভাবতে থাকে এবার এরা গেলেই বাঁচি, ডিনারে বসব আমরা। তখন তাঁরা বলেন, ‘এতক্ষণ যখন রইলেন, আজ আমাদের সঙ্গে ডিনার খেয়ে যান!’ এটা হল পরিষ্কার ইঙ্গিত যে, ‘ভাই, এবার তোমরা কেটে পড়ো, আমরা ডিনারে বসব।’ যারা সেটা ধরতে পারে না, ‘না-না-না-না’ করেও শেষে ‘অনেক ধন্যবাদ’ বলে টেবিলে বসে যায়, গেরস্থটা দাঁত কিড়মিড় করে তাদের মুন্ডুপাত করতে থাকে। বোকারা প্রেমিকার চোখের বা শরীরের ভাষা পড়তে পারে না, আসলে নোটবইয়ে লেখার বাইরে তারা যেতেই পারে না। আর তাদের নোটবইয়ে কখনওই লেখা থাকে না যে ‘পাগলা ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন করে ঠেকাব তায়’।
বোকারা বস্তাপচা রসিকতা করতে অভ্যস্ত। এ রকম রসিকতা আমি বাজারে রোজ শুনি। ঢ্যাঁড়শটা কচি হবে কি না, বাজারের তরকারিওয়ালা লিয়াকতকে এক বাহাত্তর বছরের চিমসে-মতন বৃদ্ধ যখনই জিজ্ঞেস করেন, তখন তিনি সব সময় ‘আমার মতো’ কথাটা যোগ করে দেন। এ রকম রসিকতা লিয়াকত সম্ভবত ৮৬৩৯১৪৬৭ বার শুনেছে, কিন্তু সেটা শুনে লিয়াকতকে হাসতে হবে, নইলে তিনি ‘আমার মতো’ কথাটার প্রতি বারবার লিয়াকতের নজর টানবেন, লিয়াকত না হাসলে খুশি হবেন না। আবার বোকারা রসিকতা না বুঝতে বা দেরিতে বুঝতে অভ্যস্ত। আমার মনে আছে, হোস্টেলে এক বন্ধু সিগারেট ধরাবেন বলে দেশলাই চাইছেন, তখন এক অতিশয় স্মার্ট বন্ধু একটা বেশ বোকা রসিকতা করল, আরে, এই তো বালব জ্বলেছে, সিগারেটটা ঠেকিয়ে ধরিয়ে নে না! বোকা বন্ধু দাঁতালো হাসি হেসে বললে, ‘কাচ রইয়েসে যে!’ যে বোকা দেরিতে রসিকতা বা অর্থ বোঝে তাকে যে ‘টিউব লাইট’ বলে তা তো আপনারা জানেনও। মদ্যপানের ফলে বোকা, অর্থাৎ মাতাল বোকাদের গল্পও অঢেল। এক মাতাল তার বন্ধু মাতালকে বলছে- ‘এই, পাগলা, আমি টর্চটা ওপরের দিকে জ্বালিয়ে ধরছি, তুই এই আলোটা বেয়ে ওপরে উঠে যেতে পারবি?’ অন্য মাতাল বলল, ‘ফুঃ, ওটা আবার একটা কাজ নাকি, খুব পারব! কিন্তু হুঁ বাবা, তোমার চালাকি আমি বুঝেছি। আমি ওপরে উঠলাম আর তুমি ফুট করে টর্চটা নিবিয়ে দিলে, আমি ধপাস করে মাটিতে পড়ে মরি আর কী!’
বোকারা ঝোঁকের মাথায় কাজ করে অনুশোচনা করে অর্থাৎ হঠকারিতা বোকাদের স্ত্রী বা প্রেমিকার নাম (দুই এক না আলাদা সে তর্কে আমি এখন যাব না)। এই হঠকারিতা প্রায়ই ঘটে লোকের কথায় গ্যাস খেয়ে। যেমন আমার দাদা লোকের কথায় খেপে উঠে একবার একশো চোদ্দটা দারুণ ঝাল কাঁচালঙ্কা খেয়েছিলেন চিবিয়ে। তার পর তিনদিন তাঁকে মগ এবং বাথরুম থেকে দূরে রাখা যায়নি, বাথরুমের পাশেই তার খাট পেতে দেওয়া হয়েছিল। বোকারা বেশি রাগ করে হঠাৎ বালতিতে বা খাটের পায়ায় লাথি মেরে ‘উ হুঁ হুঁ হুঁ গেলাম গেলাম!’ করে ওঠে। বোকারা ভূয়োদর্শী নয়, অর্থাৎ তারা কোনও জিনিসের সবদিক খতিয়ে দেখে না। অনেকদিন আগে বিলেতের এক বোকা জামাইয়ের কথা পড়েছিলাম। আপনারা জানেন, বিলেতে শাশুড়িদের জামাইরা পছন্দ করে না। কাজেই শাশুড়ির মৃত্যুর খবরে এক জামাই খুব ফুর্তিতে ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকেরা এসে বলল যে, শাশুড়ির কেউ নেই, কাজেই তার কবরের খচর জামাইকেই দিতে হবে। সে এক বিশাল খরচ। তখন জামাইয়ের উক্তি, ‘এখন বুঝতে পারছি যে সব ভালো জিনিসেরই একটা খারাপ দিক থাকে।’


পৃথিবীতে কেন জানি না, কোনও কোনও গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে সর্বাংশে বোকা বলে চিহ্নিত করা হয়। তাদের নিয়ে প্রচুর রসিকতা জমে ওঠে, সেগুলোকে বলে ethnic joke । আমেরিকায় নিজেদের নিয়ে রসিকতা আছে টেক্সাসের বড়লোকদের সম্বন্ধে, আবার বহিরাগত পোল্যান্ড থেকে আসা পোলিশদের সম্বন্ধে। আমাদের দেশে সর্দারজি বা কাবুলিওয়ালাদের, বা এককালে বিহারি বা ওড়িয়াদের নিয়ে। সেটা কি ঈর্ষা থেকে? ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় ‘বাঙালদের’ যাদের মধ্যে আবার ঢাকার বাঙালরা নাকি ছিল শিরোপাধারী, তাই নিয়ে রজনীকান্তের গানের প্যারোডি আছে- ‘বাঙাল বলিয়া করিয়ো না হেলা আমি ঢাকার বাঙ্গাল নহি গো’। ভাষা না বোঝার জন্যে বোকার একটা গল্প বলি শুনুন। আমেরিকায় আসা এক নতুন পোলিশ যুবক, ভালো ইংরেজি জানতো না, তা সত্ত্বেও একটি আমেরিকান মেয়ে তাকে বিয়ে করে সুখে দিন কাটাতে থাকে। হঠাৎ একদিন পোলিশ যুবকটি উকিলের কাছে ছুটে যায় ডিভোর্স চাইতে। কী সমস্যা? না, আর সব ঠিক আছে, কিন্তু তার মনে হচ্ছে তার বউ তাকে খুন করতে চাইছে। সে ওষুধের দোকান থেকে একটা শিশি কিনেছে, বাথরুমের তাকে রেখেছে, তাতে লে
খা আছে ‘Polish Remover’, সেটা যে আসলে নখের পালিশ মোছবার লোশন তা স্বামীকে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি।
টেক্সাসের বড়লোকদের নিয়েও অনেক গল্প আছে, যে গল্প আরবের শেখদের সম্বন্ধেও শুনেছি। দুই শেখ এসেছে নিউ ইয়র্কে বেড়াতে, স্যাভয় না কোন হোটেলে উঠেছে। সকালে রেস্টুরেন্টে কফি খেয়েছে, দুজনেই পকেটে হাত ঢুকিয়েছে, কিন্তু একজন অন্যের হাত টেনে ধরে বলেছে, ‘কফির দামটা আমি দেব।’-The coffee is on me.  তা তুমি দাম দেবে তা ঠিকই আছে, অন্যজন আর জোর করেনি। এর পরে তারা গেছে গাড়ি কিনতে, দুজনেই একখানা করে ‘গোল্ড ক্যাডিলাক’ গাড়ি কিনেছে, দশ লাখ ডলার এক-একটার দাম হবে। এবার কফির দাম যে দিয়েছিল সে তার পার্স বার করতে গেছে তো আর একজন হাঁ হাঁ করে বলেছে, ‘আরে কী করছ ভাই, Cadillacs are on me . ‘ক্যাডিলাকের দামটা আমার দেওয়ার পালা। তুমি তো কফির দাম দিয়েইছ।’ এ কি বোকামি, না আর কিছু?
এবার সর্দারজিরা। নেহরু মন্ত্রিসভার মন্ত্রী বলবীর সিং সম্বন্ধে অনেক গল্প আছে, সে আপনারা জানেন নিশ্চয়ই। এক রেস্তোরাঁতে বলবীর সিং-এর এক বন্ধু একটা মুরগির ঠ্যাং-এর হাড় নিয়ে তাকে একদিক ধরে টানতে বলে, টানার ফলে হাড়টা দু খণ্ড হয়ে যায়। তাতে কী হলো, না হলো bone apart . সিংজি বললেন সে আবার কী? বন্ধু বলল, তাও জান না, ওটা একদিকে হলো ‘হাড় ভেঙে আলাদা’ আর একদিকে হলো, ‘বোনাপার্ট’, সম্রাট নেপোলিয়নের পদবি। সিংজি ভাবলেন, বাঃ। এটা দেশে গিয়ে করে দেখাতে হবে। দেশে এসে এক রেস্তোরাঁয় সিংজি তার এক বন্ধুকে একই খেলায় ডাকে, হাড় ভেঙে আলাদা হয়ে গেলে বন্ধু বলে, কী হলো ব্যাপারটা? সিংজি বললেন, তাও বুঝলে না? হলো, (বিজয়ীর কণ্ঠে)- নেপোলিয়ন! বা সেই সর্দারজির কথা আপনারা জানেন, যিনি নিজে লিখতে পড়তে জানতেন না, কিন্তু তাঁর স্ত্রী জানতেন। মিলিটারি ক্যাম্পে স্ত্রীর চিঠি এলে তিনি কাউকে দিয়ে পড়িয়ে নিতেন। সেই ব্যক্তি চিত হয়ে শুয়ে চিঠি পড়তো, আর সর্দারজি তার বুকের ওপর বসে দুহাত দিয়ে লোকটিরই দুই কান চেপে বন্ধ করে রাখতেন।
আমাদের বাঙালদের (লেখক জন্মসূত্রেও তাই) নিয়ে বোকামির গল্প কম নেই। দীনবন্ধু মিত্র (‘সধবার একাদশী’), গিরিশচন্দ্র (‘বেল্লিক বাজার’), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (‘প্রায়শ্চিত্ত’) নাটকে তা অমর করে রেখে গেছেন। কিন্তু ঢাকাই কুট্টিদের গল্পে প্রচুর বোকার গল্প আছে, আছে বোকা বানানোর গল্প। এক তো আচরণে বোকা বানানো বা বোকা বনা। এক ঢাকার লোক স্টিমারে এক ফরিদপুরের লোকের সঙ্গে জগড়া বাধিয়ে দুখানা ঘুষি খায়। তখন সে চটে উঠে বলেছে, ‘কই আমার বউরে মার্‌ দেহি!’ ফরিদপুরিয়া তাও সম্পন্ন করায় ঢাকার লোক আবার বলে, ‘আমার পোলামাইয়ারে পারবি?’ দেখা গেল তাতেও ফরিদপুরের লোক পিছপা হয়নি। তখন ঢাকার লোক বলে, ‘এই বার কেউ বাইরতে (বাড়িতে) গিয়া কইতে পারব না যে আমারে একাই মারসস!’ কথা দিয়ে বোকা বানানোর গল্প একটা বলি, হয়তো আপনারা জানেন। চায়ের দোকানে চায়ে মাছি পড়েছে বলে খদ্দের চটে গিয়ে কৈফিয়ত চেয়েছে, ‘এই হারামজাদা, চায়ে মাছি পড়ছে ক্যান?’ চাওয়ালা বলেছে, ‘খাইবেন তো দুই পসার চা। তা চায়ে মাছি পড়বো না কি এরোপ্লেন উইড়া আইসা পড়বো?’
লোকশ্রুতিতে অবশ্য কোনও কোনও লোকও বোকা বলে চিহ্নিত হয় এবং প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে যায়। লোকগল্পে উপন্যাসে তাদের কথা প্রচুর পাবেন। কোনও কোনও রাজার সম্বন্ধেও ‘বোকা’ কথাটা ইতিহাসে ব্যবহৃত হয়েছে, প্রজারা তাকে সেই উপাধি দিয়েছে। কিন্তু আমি জানি না, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জনসন সম্বন্ধে কেন এই কথাটা চালু হয়েছিল যে, লোকটা এতই মাথামোটা যে, একসঙ্গে দুটো কাজ করতেই পারে না। চকোলেট মুখে নিয়ে রাস্তা পেরোতে পারে না। হয় এপাশে দাঁড়িয়ে চকোলেট চিবিয়ে শেষ করবে, নয়তো ওপারে পৌঁছে চকোলেট চিবোনো শুরু করবে। আমার এক বন্ধু ওয়াটসঅ্যাপে জনৈক কাল্পনিক ভেঙ্কটের কিছু কথাবার্তা আমাকে পাঠিয়েছেন- তার কিছু নমুনা দেখুন-শিক্ষক: কৃষ্ণ, জিশু, রাম, বুদ্ধ, গান্ধী- এদের মধ্যে মিল কোথায়? ভেঙ্কট: এঁরা সবাই সরকারি ছুটির দিনে জন্মেছিলেন। আর-একটা হলো, ভেঙ্কটের স্ত্রী যমজ সন্তান হওয়ায় দ্বিতীয় সন্তানটির পিতা কে এই নিয়ে ভেঙ্কটের সারা রাত ঘুম হয়নি। তৃতীয় এবং শেষ: ভেঙ্কট এই প্রাচীন আর কঠিন প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে বার করেছিল-মুরগি আগে না ডিম আগে। সে বলেছিল, ‘সে একটা সমস্যা নাকি? রেস্টুরেন্টে বসে তুমি যেটা আগে অর্ডার দেবে সেটাই আগে আসবে!’


শুধু কি মানুষ মানুষকে বোকা বানায়? মানুষ দেশকে বোকা বানায়, যেমন বিজয় মালিয়া না নীরব মোদি ভাইয়েরা করেছেন। প্রাণী প্রাণীকে বোকা বানায় কত-শেয়াল পণ্ডিত আর কুমির, শেয়াল পণ্ডিত আর বাঘমামা, শেয়াল আর সন্দেশমুখে কাকের গল্প আপনারা সবই জানেন-! খরগোশ কী করে সিংহকে কুয়োয় ফেলেছিল-! আবার আর এক খরগোশ কী করে নিজেই কচ্ছপের কাছে বোকা বনেছিল-সে সবও আপনাদের অজানা নয়। পশুদের গল্পে চালাক পশুদের কথা আছে-! বোকা পশুদের কথাও আছে। আমেরিকার আদিবাসীদের কাছে কয়োটে নামে নেকড়ে জাতীয় পশু বোকাদের প্রতীক।
পশুরা কখনও কখনও মানুষদেরও বোকা বানায়-! তারও গল্প আছে-! প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে। কাক আপনার ধোপদুরন্ত। জামায়। বিচ্ছিরি কান্ড! করল!! বেড়ালে আপনার দুধ বা মাছ খেয়ে নিল-! আপনার বাড়ির বা গ্যারেজের দরজার সামনে যদি পাড়ার কুকুর! ইয়ে! করে দিয়ে গেল-! তবে কি নিজেকে বোকা বলে মনে হয় না।
শুধু পশু কেন জড়বস্তুও আপনাকে বোকা বানাতে পারে। পচা গোবরে আপনার পা বসে যেতে পারে-! ফুটপাথের আলগা পাথরে পা বসে নিচের পচাজল ছিটকে আপনার সাদা পাঞ্জাবি রাঙিয়ে দিতে পারে-! পৌঁছাবার আগে ট্রেন ছেড়ে যেতে পারে-! এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর আগে প্লেন-সারা পৃথিবী আপনাকে বোকা বানানোর জন্যে তৈরি। জন্মগত বোকা-! আজন্ম! বোকা হয়তো কেউ নেই-! কিন্তু কর্মফলে বোকা, পাকচক্রে বোকা আমরা সকলেই, সকলেরই মাথায় কখনও না কখনও ওঠে Fool’s cop ,  এপ্রিল ফুল হোক আর নাই হোক।
তাই আমি বলি-! বোকারা এমন কিছু দুর্লভ জীব নয়-! তাদের খুঁজতে গেলে আকাশ পাতাল তন্নতন্ন ছত্রখান করে-!! হাঁসফাঁস হয়ে খুঁজতে হয় না।!! আপনি ভাতঘুম দিয়ে-! বিশ্রাম, টিশ্রাম নিয়ে-! দাঁত মেজে-! চুল আঁচড়ে-! গায়ে পাউডার দিয়ে (এগুলো সবই ঐচ্ছিক বিকল্প-চাইলে নাও করতে পারেন) আপনার ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়ান-! একজন বিশিষ্ট-! সম্ভ্রান্ত ও অভিনন্দনযোগ্য বোকার দেখা পাবেন। আপনার তাকে খুব খারাপ নাও লাগতে পারে। আমিও শেষ অংশটা-আয়নার সামনে দাঁড়ানো-রোজ করি-! এক বিশ্ববোকাকে দর্শন করি, আর তার পর নিশ্চিন্ত হয়ে মানবসমাজে মিশে যাই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status