ঈদ আনন্দ ২০১৮

স্মৃ তি ক থা

আর্তস্বর

নীলাচার্য

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৩:৪৯ পূর্বাহ্ন

পদ্মার পাড়ে নিজ ভিটেমাটি দেখতে লেখক

উপমহাদেশ খণ্ডিত হবার পরের বছর, ১৯৪৮ সালের দুর্গা পূজার পর, জন্মভিটে ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসতে হয়েছিল। ক্ষতি-কষ্টের পরিমাপ করা সম্ভব ছিল না, ঐ বয়সে। কিন্তু সে বয়সের অনুভূতির সঙ্গে জীবন-শেষ-লগ্নের অনুভূতির পার্থক্য যে সীমাহীন, গভীর মননে আজ টের পাচ্ছি।
ডাকঘর নাটকে মধাব দত্তের উক্তি-‘ মুশকিলে পড়ে গেছি। যখন ও ছিল না তখন ছিলই না-কোন ভাবনাই ছিল না। এখন ও কোথা থেকে এসে আমার ঘরজুড়ে বসল; ও চলে গেলে আমার এ ঘর যেন আর ঘরই থাকবে না’, আজ বোরবার হৃদয়ের অন্তস্তলে আর্ত-আঘাত হানছে।
বাংলাদেশে ২০০৮ সালে আমন্ত্রিত হয়ে আসার আগে শৈশব-কৈশোরের নিভে যাওয়া অনুভূতি বা ফিরে আসার পর নব পরিচিত ভাইবোনের সঙ্গে আত্মীয়তার অনুভূতি আজকের মতো এতটা হৃদয়-গ্রন্থিত নিশ্চয়ই ছিল না। বিগত দশ বছরে সতের বার কেন বাংলাদেশে গিয়েছি বা আসতে হয়েছে, প্রশ্নের উত্তরে কি শুধুমাত্র ‘আবেগ’ শব্দটাই যথেষ্ট হবে? বোধহয় না, একদমই না। প্রতিটি দিনের দিনপঞ্জি স্মরণে আনতে পারলে দেখা যাবে যে এমন কোন দিন যায় না, শনিবার ‘মৌণী দিবস’ বাদ দিয়ে, যেদিন বাংলাদেশের একাধিক ভাইবোনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হয় না। এটা নিশ্চয়ই নিজেকে জাহির করার প্রচেষ্টা নয়; প্রাণের টানে, প্রাণের আকুতিতে, প্রাণের অপ্রতিরোধ্য তাগিদে দৈনন্দিন এই সংযোগ।
বাংলাদেশের মানুষজনের যে আবেগ দেখেছি, নিজের জন্মভিটের বর্তমান আবাসিকদের মানসিকতায় তা কি পাওয়া যায়? খেমত আলি ছৈয়ালের বড় পুত্রবধূ ষাট বছর পরে জন্মভিটায় আমার প্রথম পদার্পণে যে কথাটা তার শাশুড়িকে সর্বসমক্ষে বলেছিল- ‘দালানের আসল মালিক আইছে’, তার মর্যাদা কি সত্যি দিতে পেরেছে! দেওয়ানজী বাড়ির (ভূইয়াবাড়ি) মালিক চিন্তাহরণ ভট্টাচার্য তাঁর সম্পত্তি দেখভাল করার জন্য খেমত আলি ছৈয়ালকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলেন। তদবধি সম্পত্তির সবটুকু তার পরিবারই ভোগ করে চলেছে। যদিও দালানের এতটুকু সংস্কারের প্রয়োজন মনে করেনি, আজ তা অতিশয় জীর্ণ-ভগ্নদশাগ্রস্ত। একমাত্র তার ছোট ছেলে মুশারব প্রতিবারই শুধু এই-দাদাকে নয়, তার সকল সঙ্গীসাথিকে সাদরে গ্রহণ করে এবং আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখে না।
কবি-সাহিত্যিক-প্রবন্ধক-সংগঠক সায্‌যাাদ কাদির, যে মানুষটির সূচনায় বাংলাদেশে আজ আমার এত সংযোগ, তিনি আজ বেহস্তে। তাঁর সংগঠন ‘বাংলাভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্রে’-র আমন্ত্রণে ২০০৮ ফেব্রুয়ারি সম্মাননা গ্রহণের জন্য প্রথম বাংলাদেশে যাওয়া এবং অনেক ভাইবোনকে আন্তরিকভাবে পাওয়া। পরে সময়ের আর্তিতে স্বাভাবিক ভাবেই অনেকে সংযোজিত হয়েছেন।
‘সম্মাননা গ্রহণ’ বা ‘সংবর্ধিত হওয়া’ শব্দ দুটির মূল্যায়ন যদি প্রকৃত অর্থে অন্তরে ধারণ করা যায়, তা আমার কাছে অপরিসীম। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের পরিচিত মানুষের কাছ থেকে যে অকৃত্তিম শ্রদ্ধা ভালোবাসা পেয়েছি বা আজও পেয়ে চলেছি, তার মধ্যে এতটুকু খাদ পাইনি, হয়তো খোঁজার চেষ্টাও করিনি। অন্তরে বিশুদ্ধ-পরিমণ্ডল স্থাপনা, গ্রহণযোগ্যতা অর্জন, মনে করি জরুরি। প্রতিটি যাত্রায়-সফরে বাংলাদেশের পরিচিত ভাইবোনের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে সংবর্ধিত এবং সম্মাননা-গ্রহীতা বলে মনে হয়, বাহ্যিক আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরের প্রয়োজন হয় না। এটা আমার প্রত্যয়।

যতদিন পুর্ব পাকিস্তান কিংবা পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে আসা হয়নি, অনেক ‘শঙ্কা’-‘কিন্তু’ তাড়া করে ফিরেছে। জন্মভিটের কথা স্মরণের বালুকা বেলায় থাকলেও, হয়তো দেখতে আসার জন্য সেভাবে মনে তাগাদা দিতে পারেনি। কবি-সাহিত্যিক সায্‌যাদ কাদির আমার জীবনে একটা নতুন অধ্যায় প্রথিত করে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করে গেছেন।
শৈশব-কৈশোরে দেখা বিক্রমপুরের আন্তরিকতা-আতিথেয়তার রেশ দাদুমনি চিন্তহিরণ ভট্টাচার্যের আমলে আমাদের কলকাতার বাসায়ও বহাল ছিল। যদিও কলকাতাতে আমাদের দীর্ঘদিনের ভাড়াবাড়ি ছিল, তবু ভিটেমাটি ছেড়ে আসতে বাধ্য হওয়ায়, বৈভবে টান পড়েছে। বিশেষ করে দেশের আত্মীয়স্বজন উদ্বাস্তু-নিঃসম্বল হয়ে চলে আসতে বাধ্য হওয়ায়, দাদুমণির স্মরণাপন্ন হতে হয়, তাঁর দায়িত্বের বোঝা ভারি হয়ে যায়। ফলে অর্থনৈতিক ভাঁটা এড়ানো সম্ভব হয় না। ধীরে ধীরে তিনি শারীরিক-মানসিক-আর্থিক ভাবে কাবু হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দীর্ঘদিন বিছানার আশ্রয় নিতে হয় সেদিনের প্রচণ্ড প্রতাপশালী ভূঁইয়াকে।
প্রথমবার বাংলাদেশে আসার পর ঐসব শঙ্কা-শঙ্কোচ-কিন্তু-কে হার মানিয়ে দেয় সদ্য গ্রন্থিত ভাইবোনেরা, তাদের আন্তরিক আতিথেয়তা দিয়ে। ঢাকার পোলার, বিক্রমপুর ঢাকার এক পরগনা ছিল এক সময়, গ্রন্থিত ভাইবোনের সাথে একাত্ম হতে এতটুকু সময় লাগেনি বা শঙ্কোচ হয়নি। রাজনীতির ক্ষমতা-লোভ, লিপ্সা-লালসামত্ততা, সাম্প্রদায়িক বিভাজনে দেশকে দুভাগ করেছিল। ক্ষতি হয়েছে, সর্বনাশ হয়েছে, প্রাণ গিয়েছে আমাদের মতো উলুখাগড়াদের। পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ হয়তো বেশি করে অনুধাবন করতে পেরেছে ভাষা আন্দোলনের সময় বা মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে। এই বিভাজনের দায় কোনমতেই সাধারণ নাগরিকের উপর বর্তায় না।
‘গত দশ বছরে সতেরবার কেন বাংলাদেশ আসতে হয়েছে, প্রশ্নের উত্তরে কি শুধুমাত্র ‘আবেগ’ শব্দটাই যথেষ্ট হবে? বোধহয় না।’ উল্লিখিত আখরগুলো অনুধাবন করার জন্য গভীর মনোসংযোজনের প্রয়োজন। যতো সহজ এবং সরল ভাষায় কথাগুলো বলা হলো, সত্যি কি সেটা ততো সহজ-সরল? এই দশ বছরের সতেরবারের মধ্যে অন্তত প্রথম ছ’সাত বছর ফিরে আসার সময় প্রতিটি চোখে পানি ঝরতে দেখছি। নিজের চোখও বাদ থাকেনি।
এই প্রসঙ্গে পীরগঞ্জের মানুষের আন্তরিকতার কথা না বললে অত্যন্ত গর্হিত কাজ হবে। সেখানকার প্রায় প্রতিটি উপস্থিত মানুষকে প্রতিবার ফেরার সময় অঝোরে কাঁদতে দেখেছি। মন চাইলেও ঢাকা থেকে তিনশ’ কিলোমিটার যাওয়া, তিনশ কিলোমিটার ফেরা, ছ’শ’ কিলোমিটার যাতায়াতের ধকল নেবার মতো বয়স বা সাধ্য কোনটাই আর নেই। ইচ্ছে থাকলেও শরীরে কুলোচ্ছে না, যেতে পারি না। তাদের শ্রদ্ধা আজও একইভাবে অনুভব করি।
এয়ার পোর্টে পৌঁছে দিয়ে ঢাকার কবি আবদুল মজিদ, পীরগঞ্জের সুলতান আহমেদ সোনার ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্নার কি কোন প্রতিদান হতে পারে? না কোন মূল্যায়ন হতে পারে ঐ দীর্ঘ-বলিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান ফরিদ জাকির খান-এর বিদায় বেলায় প্রণাম করার সময় নিজেকে স্থির রাখতে না পারাটা! ঐ ভাইটার শ্রদ্ধার কোন তুলনা নেই। আজ তাঁকে হারিয়ে অনেকটাই শোকতপ্ত-দিশাহারা-ক্ষতিগ্রস্ত আমি।
চিত্রকরা জন্মভিটে দেখে ফেরার পথে বাংলদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. এমএমআর সিদ্দিকীর আগ্রহেই লেখা হয়েছিল জন্মভিটের উপর কবিতা- ‘জন্মেছিলেম হেথা আমি.........’। আজও খুবই শ্রদ্ধা করেন এই মানুষটি।
বাংলাদেশের ভাইবোনেরা নীলাচার্যের আশিতম জন্মদিন ঢাকায় পালন করে। শাহবাগ আন্দোলনের উত্তাল জনসমুদ্রের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে আলাপ হয় ‘কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র’-এর কর্ণধার ড. ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এই সংস্থাও একই উপলক্ষে নীলাচার্যকে সংবর্ধিত করেছে। সংস্থার সকলেই পরিচিত শুধু নয়, সাজু-দীনা তো নীলদার হলদিরাম-রাজকচৌরী-সাথী হয়ে গেছে। আর ভাস্বরের পুরো পরিবার হয়ে গেছে অতি আপনজন।
ঢাকার বোনদের কথা বলতে গেলে অনেকের নামই বাদ চলে যাবার সম্ভাবনা। কেউ কি সজল চোখ ছাড়া, কান্না ছাড়া, না এ দেশে এসে না ওদেশে, তাদের নীলদাকে বিদায় জানাতে পেরেছে! এই দাদা তাদের সকলের আপন-একান্ত দাদা হয়ে গেছে। সুফিয়াবোন সর্বসমক্ষে বলেছিল- ‘নীলদা যে আমার আপন মায়ের পেটের ভাই না, কেউ কইতে পারবো না।’ দুই নাহার বোন, সিদ্দিকী আর ফরিদ খান! কতো বলবো! অনিরুদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে সেই নাহার সিদ্দিকী বোনের শ্রমজীবী গোরস্থানে অঝোরে অশ্রু ঝরাতে হয়েছে এই বৃদ্ধকে।
আরেক বোন কবি-সাহিত্যিক-প্রকাশিকা পপি চৌধুরী, বোন-কন্যা মিলিয়ে বোন্ন্যা। শুধু তার নয়, পুরো পরিবারের আপন হয়ে আছি। আমেরিকাবাসী হয়ে দাদাকে কি ভুলতে পেরেছে?
ভাঙা-পা অপারেশন করার পর তিন মাস বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল। কবি-সাহিত্যিক তাহমিনা কোরাইশী তার স্বামী জনাব ওমর এ আর কোরাইশীকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে দুর্ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে গেছে। তার ঢাকার বাড়িতেও এলাহি খাবারের মধ্যে অতবড় সাইজের চিংড়ি, খাওয়া দূরে থাক, দেখতে পাওয়া দুর্লভ।
তাহমিনার বোন কবি-সাহিত্যিক সাহানা খানম সিমু আর এক গভীর ভালোবাসার মানুষ। প্রায় প্রতিবারই দুইবোন দাদার সঙ্গে দেখা করতে আসার সময় দাদার জন্য কিছু না কিছু জামাকাপড় নিয়ে আসে। এই জামাকাপড় দেওয়ার পর্ব প্রায় সব বোনের মধ্যেই রয়েছে। বাদ দেয় না কবি মো. আবদুল মজিদের মতো ভাইরাও। কী প্রচণ্ড শ্রদ্ধা-ভালোবাসার জোয়ার !
ছড়াকার অভিমানী রিফাত নিগার শাপলা একাধিকবার বিরাট আয়োজন করে তাদের বাসায় দাওয়াত দিয়েছ্‌ে নীলদাকে। স্বামী মুক্তিযুগ্ধ ইতিহাস গবেষক-লেখক মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া তার লেখা প্রতিটি বই সাদরে নীলদার হাতে তুলে দিয়েছেন। এতটুকু কমতি নেই শ্রদ্ধা-ভালোবাসায়।
লেখিকা মীনা মাশরফি (পিঙি নাজনিন), শুধু নিজেই দাদাকে শ্রদ্ধা করে না, তার নিকট আত্মীয় ‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’র স্রষ্টা আব্বাসউদ্দিন আহমেদ সাহেব-কন্যা বিখ্যাত গায়িকা ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেন। আন্তরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসার অগুণিত ভাইবোন ছড়িয়ে আছে সারা বাংলাদেশে। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব, কাকে বাদ দেব! তবে স্মৃতি বিভ্রমে অনিচ্ছাকৃত ভাবে অনেকেই হয়তো বাদ পড়ে যাবেন।
সুফিয়া বোন, বাড়িতে বিক্রমপুরিয়া রান্নার বিভিন্ন পদ খাওয়ানো, ফরিদপুরের পাটালি গুড় এনে দেওয়া ছাড়াও, বন্ধু জাহানারাকে জুটিয়ে দেন। সহজ সরলমনের জাহানারার মাধ্যমে পাই তার দাদা এসপি মাহমুদ সাহেবের স্ত্রী নূপুরকে। আর এক সুন্দরমনের জন। কলকাতায় বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, আমাদের বাসায় এসেছেনও। নিজের দুটো গাড়িতে আমাদের নিয়ে গেছেন ঢাকা থেকে চিত্রকরা, সঙ্গী ভাগনে-ডোডোবাবু (সেই সময় ঢাকায় পোস্টিং ছিল) এবং অনিরুদ্ধ, খাইয়েছেন তাদের টঙ্গিবাড়ি খামার বাড়িতে। নিজের পুকুরের মাছ, বাগানের ডাটা দিয়ে প্রায় মশলাছাড়া চিংড়ি কি মাছের অপূর্ব রান্না! হারিয়ে যাওয়া জাকির ভাইও সেদিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ভুলিনি কিছুই নূপুর।
বিক্রমপুর যাদুঘরের কিউরেটর অধ্যাপক শাহজাহন মিয়ার সঙ্গে আলাপ হয় কলকাতায়। বিক্রমপুর বিষয়ক কোন সংস্থার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। ওখানে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন ‘বিক্রমপুর ইতিহাস এবং ব্যক্তিত্ব’ গ্রন্থের গবেষক-রচয়িতা ঢাকানিবাসী মো. অজহারুল ইসলাম। তিনি মাত্র অল্প কিছুদিন পূর্বে বইটির চতুর্থখণ্ড প্রকাশ করেন। বিক্রমপুরজাতক নীলাচার্যের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি জগত সম্পর্কে কিছুটা অবগত হওয়ায়, বেশ কয়েক লাইন সংযোজন করেন ঐ গ্রন্থে। সেই পরিসরে তার সঙ্গে আলাপ।
অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া নীলদার সঙ্গে তার সম্পর্কের গণ্ডিটা প্রায় অসীমে নিয়ে গেছেন। বড়ভাই হিসেবে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন তার সমগ্র পরিবারও। এমন কি তার ছোটভাই আমেরিকানিবাসী ডাক্তার-ঔপন্যাসিক সাহাব ইয়ুনুস পর্যন্ত এই সম্পর্কের কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে রাশিয়ান সস্ত্রীক নীলদার নরেন্দ্রপুরের ফ্ল্যাটে হাজির হন। জম্পেশ সান্ধ্য আড্ডা হয় সেদিন।
মিয়ার গণ্ডিতে-আবদ্ধ-বন্ধু ‘ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’, সংক্ষেপে ঢাকা কেন্দ্র-এর কর্ণধার-কর্ণেও নবপরিচিত-উপাখ্যান প্রবেশ করান হয়, ফলে ঢাকা কেন্দ্রের তরফ থেকে নীলাচার্যকে সংবর্ধনা প্রদান। ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক যুবক আমাকে বলেন- ‘আমি নীলাচার্যের লেখার সাথে পরিচিত’। তার সম্পাদনায় ‘স্মৃতির ঢাকা’ বইটিতে মানবজমিন ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত আমার একটা লেখা সংযোজিত হয়েছে। এক কপি উপহারও দিলেন। পরে জানলাম তিনি একজন সাংবাদিক। নাম তার কাজল ঘোষ। পেলাম আর একজন সুজন।
কাজল পরবর্তী সময় সস্ত্রীক কলকাতায় এলে। একসঙ্গে অনেকটা সময় অতিবাহিত করাও হয়। অতি শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট তাদের ছাওয়াল, আমার নাতি, শিশুটিকে নিয়ে দুজনই নাজেহাল। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আর হাল্কাচালে রইলো না। অন্যান্য বাংলাদেশি ভাইবোনের মতোই মাখোমাখো হয়ে গেছে।
পরবর্তীকালে ঐ ঢাকা কেন্দ্র ‘নীলাচার্যের অগ্রন্থিত রচনা সমগ্র’ তাদের প্রকাশনায় বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হায়াত মামুদের মোড়ক উন্মোচনে আড়ম্বরে প্রকাশ করে। কেন্দ্রের চেয়াম্যান মো: আজিম বক্‌সও ক্রমশ নীলদার নীলসাগরে ভাসমান পরিলক্ষিত হয়। তিনি বিক্রমপুরের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে চোরমর্দন গ্রামে একটা বড় বাড়ি কিনে সংস্কার করেই চলেছেন। কবে যে সংস্কার শেষ হবে, তিনি নিজেও বোধ হয় জানেন না।
ঐ শাহজাহন মিয়ার দৌলতে বিক্রমপুরের প্রায় প্রতিটি কোণ আজ নীলাচার্যের সমকোণ হয়ে গেছে। তার শিক্ষক-বন্ধু নাসিরুল হক একবার আমাদের বিক্রমপুর সফরের সঙ্গী ছিলেন এবং তার আরিয়ল দ্বীপ-বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজের এলাহিকাণ্ড করে বসেছিলেন।
ভাগ্যকুল, শ্রীনগর, পাশিয়া, ফুরসাইল, মাওয়া, লৌহজং, বালিগাও-আইড়ল, টঙ্গিবাড়ি, মুন্সিগঞ্জ সদর এলাকাগুলোর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান বেশ কয়েকবার দেখা হয়ে যায় এর মধ্যে ঐ মিয়ার দৌলতে। বাদ যায় না অগ্রসর বিক্রমপুরের যাদুঘর, জগদীশ বসুর পৈত্রিক ভিটা, অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান বজ্রযোগীনি, রাজা শ্রীনাথের বাড়ি, বাবা আদমের মসজিদ, সোনারং জোড়া মন্দির, শ্যামসিদ্ধির মঠ, বৌদ্ধ বিহার প্রত্নসম্পদ ও ঐতিহাসিক নিদর্শন খনন কার্য্য, কনকসার, বেতকা, মালখানগর ইত্যাদি ইত্যাদি। বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কারের ফলে বিক্রমপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিশ্বের দরবারে আরো এগিয়ে যাবে, আশা করা যায়।
শুধু তাই নয়, নীলাচার্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মাননা অগ্রসর বিক্রমপুরের তরফ থেকে ‘বিক্রমপুরের কৃতি সন্তান’, স্বীকৃতি লাভ।
২০১৭ মে মাসে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। জন্মভিটে-এলাকার স্থানীয় অধিবাসী ‘টঙ্গিবাড়ি থানা জন কল্যাণ সংঘ’ পাঠাগার-মাধ্যমে কবি নীলাচার্যকে সংবর্ধিত করে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপ্যাল অধাপক সুখেন ব্যানার্জি, অধ্যাপক শাহজাহন মিয়া, ঢাকাকেন্দ্রের প্রাণপুরুষ মো. আজিম বক্‌স, কলকাতার সহযাত্রী ড. অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী সহ আরো অনেকে। পাঁচগাও-এ নতুন ভাতৃত্ব বোধে পেলাম স্থানীয় শিক্ষক বিমল পাল এবং কল্যাণ সংঘের চেয়ারম্যান সোহেল মোল্লাকে। গ্রামে নরাদার পোলা লক্ষ্মী তো প্রথম সফর থেকেই সঙ্গে রয়েছে।
ঐ সংঘের প্রায় প্রতিটি সেবক-সভ্য উৎসুক হয়ে কবি নীলাচার্যের জন্মভিটে দেখতে আমাদের সঙ্গেই চিত্রকরা ভুঁইয়া-ভগ্নপ্রায়-বাড়ি চলে আসে। ছবি তুলেছে দোতলার বারান্দায় দাঁড় করিয়ে, তাদের ভাষায় বর্তমান প্রজন্মের ভূঁইয়াকে নিয়ে। ওদের আলোচনার বিষয় এবং বিস্ময় ছিল- এ তো কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি, সঙ্গী অনিরুদ্ধের দৃষ্টি এড়ায়নি সে আলোচনা! যাউগ গিয়া সে কথা। ওরা তো বাড়ির অংশটুকুই শুধু দেখেছে !
অধাপক সুখেন ব্যানাজির সঙ্গে অগ্রসর বিক্রমপুরের সম্মাননা অনুষ্ঠানে শুধু আলাপই হয়নি, পাঁচগাও-এর দীনেশ ব্যানার্জি-জ্যাঠুর পুত্র-সূত্রে আত্মীয়তায় আবদ্ধ হয়ে আমি তারও নীলদা হয়ে যাই। সৌভাগ্য কাকে বলে! অসুস্থ সুখেন কেবল মাত্র নীলদার জন্য এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে সম্মত হন এবং তার গ্রামের বাড়িতে পাটপাতার বড়া, ইলিশ মাঝের ঝোল সহ বিক্রমপুরের বিভিন্ন পদ খাওয়ার সৌভাগ্য-সুযোগ করে দেন। কিছুদিন পর খবর পাই নতুন করে পাওয়া ভাইটা হারিয়ে গেছে। এই সৌভাগ্য দুঃখজনকভাবে অত্যন্ত স্বল্পকালের, ক্ষণস্থায়ীই বলা যায়।
বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ-এর কর্ণধার বিখাত কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক কামরুল ইসলামের সঙ্গে হঠাৎই সখ্যতা হয়ে যায়। আলাপ হয়েছিল জাকিরভাই-নাহারবোনের বাড়িতে প্রতিসফরের মতো নীলদার সব ভাইবোনদের আমন্ত্রণ করে সাহিত্য আলোচনা-আড্ডা-চর্বচোষ্য আহার-অনুষ্ঠানে। ‘নীল দিগন্তে’ (নীলাচার্য কাব্য সংকলিতা) বইটি কামরুল ইসলামকে উপহার দেওয়া হয়েছিল।
সাম্প্রতিক আধুনিক কবিতা প্রসঙ্গে কামরুল ইসলামের একটি প্রবন্ধ ইন্টারনেটে দেখা যায়। তাতে শুধুমাত্র ঐ বইটির ওপর নির্ভর করে প্রবন্ধের এক জায়গায় তার মন্তব্যের ক’টি লাইন-‘ চল্লিশের দশক থেকে বর্তমান অবধি কবিতার উন্মত্ততার শৌর্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র, অজিত দত্ত, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সমর সেন, আহসান হাবীব, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, শঙ্খ ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, অমিতাভ দাশগুপ্ত, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, মোহম্মদ রফিক, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন কবির, অসীম সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা, রূদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, হাবীবুল্লা সিরাজী, বিমল গুহ, মতিন বৈরাগী, নীলাচার্য, মৃণাল বসু চৌধুরী প্রমুখের কবিতা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।’ স্বীকৃতির জন্য ধন্যবাদ।
কিছুদিন আগে নীলাচার্যের তিনটি বই- “নীল দিগন্তে” (ড. অরুণ বসু দ্বারা নীলাচার্য কাব্য সংকলিতা); “গল্প কথা : রম্যতা” (রম্য গল্প) এবং “বিস্মৃতির অতল থেকে” (জীবন প্রবাহ) গ্রহণ করেছে বলে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ চিঠিতে জানিয়েছে। অতীব সম্মানীয় সংবাদ।
বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ, পারস্পরিক সমপ্রীতি, মৈত্রী ও ঐক্য, বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকার বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিক সেতুবন্ধন হেতু সর্ববঙ্গীয় লেখক-শিল্পী সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানায়। জানুয়ারিতে আমরা তিনজন- ড. কল্যাণ সেন, ড. অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী এবং আমি, ঢাকা যাই। ভাবনায়-রথ দেখা কলা বেচা। হয়েছিলও ঠিক তাই।
একটা পুরনো ঘটনার কথা এই বেলা বলে নেওয়া দরকার। ২০০৮ সালে প্রথমবার আমন্ত্রিত হয়ে সম্মাননা গ্রহণের দিন বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক উপস্থিত ছিলেন। আলাপ হয়েছিল সুইডেন নিবাসী সাহিত্যিক মোয়াজ্জেম হোসেন আলমগীরের সঙ্গে। পরে আরো কয়েকবার দেখা হয়েছে, কিন্তু আলাপ খুব বেশি অন্তরঙ্গতায়-প্রলাপে ছিল না। এবার কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলার আগে হঠাৎ আলমগীর সাহেবের কাছ থেকে আমার ফোন নম্বর জানাবার অনুরোধ পাই, ফেসবুকে। তিনি কলকাতায় আসছেন এবং দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। জানালাম। আসার পর কয়েকটা দিন বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াই। অতি আন্তরিক এবং সজ্জন মানুষটিকে নতুন করে জানার এবং পাবার সুযোগ হলো। অল্পদিনে আপন হয়ে গেলেন তিনিও।
জানুয়ারি মাসে ঢাকা যাবার আমন্ত্রণ শুনে নিজেই বললেন-‘দাদা, আপনি ঢাকা গেলে ওখানে আমার গাড়ি আর ড্রাইভার-হামিদ আছে। আপনি যতদিন বাংলাদেশে থাকবেন ঐ গাড়ি আপনার সঙ্গে থাকবে। হামিদ গাড়ি তো চালাবেই, সঙ্গে ভাটিয়ালি গানও শোনাবে।” সত্যি যতদিন বেঁচে থাকব, সম্বল হয়ে থাকবে সেই সফর। তবে তিনি একটা কঠিন শর্ত দিয়েছিলেন- ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলার সময় তিনি ঢাকায় যখন আসবেন, কয়েকদিনের জন্য আমার সঙ্গ চাই। সে শর্তও পূরণ করা হয়েছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
একটা কথা না উল্লেখ করলে বিবেকের কাছে ছোট হয়ে যাব। ৫ নভেম্বর ২০১৭, আমার এবং আমার স্ত্রীর কন্যাসম নিকটজন-বন্ধু অলোকানন্দা মুখোপাধ্যায় ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে ঘুমের মধ্যে অকস্মাৎ আমাদের ছেড়ে চলে যান। তার উজার করা স্নেহ- নিবিড় ভালোবাসা-সম্পর্ক, হৃদয়-নিংড়ানো বন্ধুত্ব, জাগতিক জীবনের এই নির্মম পরিণতি একেবারেই মেনে নিতে পারছিলাম না। একযুগ সাধনার ব্যর্থতা পাগল-প্রায় অবস্থায় এনে ফেলেছিল। ২০০৮ নভেম্বরে আমার বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গে তাকেও বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছিলাম। মাত্র ক’দিনের মধ্যে আমার প্রতিটি নিকটজনের প্রিয়পাত্রী হয়ে যান তিনি। বিশেষ করে তার শিস্‌-সঙ্গীত ভীষণভাবে সমাদৃত হয় ঐ দেশে। তাই এই আমন্ত্রণের অজুহাতে ঢাকা যাওয়ার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল- বাংলাদেশের বোনদের কাঁধে কাঁধ রেখে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি ঝরিয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করা।
শাহজাহানের সহায়তায় আর আলমগীরের বদান্যতায় ড. কল্যাণ সেনকে নীলদার জন্মভিটে, নাটেশ্বরে বিক্রমপুরের প্রত্নসম্পদ ও ঐতিহাসিক নিদর্শন খনন কার্য, জগদীশ বসুর পৈত্রিক ভিটা, অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান বজ্রযোগিনী, রাজা শ্রীনাথের বাড়ি, বাবা আদমের মসজিদ, সোনারং জোড়া মন্দির, শ্যামসিদ্ধির মঠসহ প্রায় সমগ্র বিক্রমপুর দেখানো হয়ে যায়। অনিরুদ্ধ বেশ কয়েকবার নীলদার জন্মভিটেতে গেছেন। তার কাছে নতুন শুধু কল্যাণের সঙ্গ পাওয়া। কনকসারের অতিথি গৃহ এবারও আশ্রয় দেয়।
স্পীড বোডে পদ্মা পার হওয়া এই যাত্রার সবচেয়ে আকর্ষক-উত্তেজক ঘটনা। বিক্রমপুরের মাওয়া ঘাট থেকে নদী পেরিয়ে শরীয়তপুর জেলায়। কাওড়াকান্দি নদীঘাটে টাটকা পদ্মার ইলিশ ভাজা, ভাজা তেল দিয়ে ভাত খাওয়া। ঘটি, বল্লাল সেনের ষোড়শতম বংশধর-কল্যাণ সেন মহাশয় তো বটেই, বিক্রমপুইর‌্যা আমি আর বরিশাইল্যা অনিরুদ্ধও কম রোমাঞ্চিত হইনি। পথ প্রদর্শক শাহজাহান মিয়া তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছে আমাদের এই ছেলেমানুষি উন্মাদনা।
ঔপন্যাসিক আনোয়ারা আজাদ আগে থেকেই নীলদার পরিচিত ভাইবোনের গণ্ডিতে আবদ্ধ। তিনি তার বন্ধু ড. খালেদা ইসলাম (অরুণা)-কে নীলদার বেলেঘাটা বাড়িতে নিয়ে আসেন। ঢ়ষবধংরহম ঢ়বৎংড়হধষরঃু শব্দটা বোধ হয় অরুণার জন্যই তৈরি হয়েছিল। একদিনের আলাপে নীলদাকে কিভাবে আপন করে নিয়েছে, কল্পনা করা কঠিন। জানুয়ারি মাসে ঢাকা ভ্রমণকালে ইউনিভার্সিটি কামাই করে শুধু নীলদাকে নয়, তার দুই সঙ্গী ড. কল্যাণ সেন এবং ড. অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীকে, ডক্টর স্বামী-স্ত্রী যেভাবে আপ্যায়ণ করেছেন, বলে শেষ করা যাবে না। তিনি নিজে একজন কোয়ালিফাইড ডাক্তার, নিউট্রিসন নিয়ে গবেষণালব্ধ ডক্টরেট এবং বর্তমানে নিউট্রিসন এন্ড ফুড সাইন্স ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
সর্ববঙ্গীয় লেখক-শিল্পী সম্মেলনে ধুমধাম করে হলেও আমার নিশানা অর্জুনের মতো স্থির ছিল; বাংলাদেশে আমার আত্মার আত্মীয় ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা হওয়া আর পদ্মার পানি-বাতাস সারা অঙ্গে-নিভৃত হৃদে ধারণ করে প্রাণ জুড়োনো। আশা নিশ্চয়ই পরিপূর্ণ হয়নি। একমাত্র নাহারবোন ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। কেউ ছিলেন বিদেশে, কেউ বা পিত্রালয় ফরিদপুরে, কেউ যষ্টিনির্ভর হয়ে গৃহবন্দি। যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি বলাই ভালো। তবে তার ঝাল মিটিয়েছে বেশ কয়েকজন ভাইবোন ফেস বুকে। নতুনের মোহে প্ররোচিত হয়ে আদি অকৃত্তিম ভাইবোনদের না কি ভুলে গিয়েছি। কী সাংঘাতিক অনুযোগ!!! এতদিনের ‘কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা’র পর চির জীবন গানের ডালা না বইয়ে, একেবারে পরিত্যাগ!! সে সব দিনগুলো ফরবফ রহ ঃযব ভরবষফ, মাঠে মারা গেছে! কি আর করা! অপরাধী না হইয়াও তাহাদের সহস্র-অনুযোগ-অভিযোগ নত মস্তকে অভিমানীদের মান ভাঙাতে স্বীকার করিয়া লইতে হইয়াছিল। ফেসবুক তাহার সাক্ষ্যও দিবে।
মোয়াজ্জেম হোসেন আলমগীরের শর্ত পালনে ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলার ঢাকায় তাকে সঙ্গ দিতে কয়েকদিনের জন্য যেতেই হলো। দুই ডক্টরেটকে নিয়ে একই টিম। ঢাকা এয়ারপোর্ট গেট থেকে সংবর্ধনার বহর শুরু। ফুলে ফুলে ঢাকা অবস্থায় ঢাকার বিখ্যাত রাস্তা জ্যাম-এর স্বাদ পেলেন দুই ডক্টরেট। আট কিলোমিটায় যেতে সময় লাগলো মাত্র দেড় ঘণ্টা। অভিজ্ঞতা আমার আগেই হয়েছে। সুতরাং মা ভৈঃ।
আলমগীরের ধানমন্ডির পৈত্রিক সাততলা লিফ্‌ট বিহীন বাড়িতে গেলাম আমরা। চারতলার একটা ঘরে কফি-বিশ্রাম। কিছুটা নয়, অনেকটাই বাঁচোয়া। তারপর ছ তলা এবং সাত তলায় ঘর নির্বাচন। উত্তেজনায় ভুলে গিয়েছিলাম বুকে একটা হৃদয় সঞ্চালক যন্ত্র বসানো রয়েছে। এতবার উঁচু নীচু করার ধকল ঐ যন্ত্রনাও সহ্য করতে পারে। তবে আলমগীর ভরষা দিয়েছিলেন যে একজন ইঞ্জিনিয়র, একজন প্রশাসনিক আধিকারিক ছাড়াও দুজন ডাক্তার ভাড়া থাকেন এ বাড়িতে। শুনে অনেকটাই ভরসা হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম একজন যোগব্যায়াম-চিকিৎসক। একজন পশু-চিকিৎসক। ঐ চিকিৎসা-ভরষার ব্যাপারে বাক্য-ব্যারামে আর সাহস হয়নি অগ্রসর হতে। আলোচনায় বিরাম দেওয়া শ্রেয় মনে হয়। পরদিন সারাদিন বিশ্রামহীন-ক্লান্তির পরও অন্যত্র বাসস্থান নির্বাচন জরুরী হয়ে পরে। অবশ্যই আলমগীরের অনুমতি এবং সহায়তায়।
ঐ সারাদিন বিশ্রামহীন-ক্লান্তির পর্বে আসতে হচ্ছে। সকালে আমাদের অভিযানের পূর্বনির্বাচিত সদস্য অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া এসে হাজির। অল্প বয়সী যোগব্যায়াম মিশুকে- চিকিৎসক-আশীস-পরিবারের সাদর-নাস্তা পর্ব শেষে সুশ্রী-দাড়িতে-আলোকিত-কবি আব্দুল খালেক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক হাফিজ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে সদা হাস্যময় সারথি-হামিদের জিম্মায় পথ চলা শুরু। শুনে অবাক হলাম, আমরা মুন্সিগঞ্জ জেলাতেই যাব, অথচ সে জায়গার নাম আগে কখনো শুনিনি। আমারই অজ্ঞতা। মুন্সিগঞ্জ জেলায় হলেও, এটা বিক্রমপুর অঞ্চল নয়, বুঝলাম। বিক্রমপুইর‌্যা তো !
ঢাকা থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ হাইওয়ে ধরে কাপ্তানবাজর, ওয়ারী, ফতুল্লা, চাষারা, নারায়ণগঞ্জ শহর পাশ কাটিয়ে, মেঘনা পেরিয়ে গজারিয়া উপজেলার বালুয়াকান্দি ইউনিয়নের, প্রথমে ডা. আবদুল গফফার উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরে কলেজে সংবর্ধিত হতে যাওয়া হলো। হাফিজ আহমেদ সাহেব ঐ অঞ্চলকে শিক্ষার জগতে আলোকিত করার জন্য অনেক স্কুল, কলেজ স্থাপনা করেছেন। তার নামে ঐ অঞ্চলে একটা রাস্তাও রয়েছে। তিনিই আমাদের অভিযান-নির্দেশক।
ওখান থেকে আমাদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। সর্বত্রই আন্তরিক সংবর্ধনা এবং চা-কফিসহ বিশদ-জলযোগের আয়োজন। যে সব স্কুল কলেজে যাওয়া হয়েছে, সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের অনুবর্তিতা ও আন্তরিকতা লক্ষণীয় এবং প্রশংসনীয়।
স্থানীয় এক নার্সারি-কর্তা-আয়োজিত বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হল। ভবেরচরের প্রাচীন, প্রায় আমারই বয়সি, ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত, ওয়াজীর আলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে পৌঁছতে অনেকটাই বিলম্ব হয়ে যায়। তবু স্কুল প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখানো হয়।
আদর্শগত ভাবে ভবেরচরের সর্বসম্প্রদায়ের মানুষ-হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ মিলে ২০১০ সালে শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। গজারিয়ার এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন জনাব রেফায়েত উল্লাহ্‌ খাঁন তোতা। মন্দির প্রাঙ্গণে প্রায় সব দেবতার সার্বজনীন পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং ধর্ম নির্বিশেষে স্থানীয় মানুষ অংশ গ্রহণ করে। জানা গেল এটা গজারিয়ার ঐতিহ্য। এই প্রকল্প গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে মন্দির ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় দ্বারা উদ্দীপিত।
এবার গেলাম আলমগীর সাহেবের জন্মভিটা-গ্রামে। গ্রামের নাম হোগলাকান্দি, তাদের সিকদার বাড়ি। গ্রামে স্কুল-মসজিদ-মাদ্রাসা-খেলার মাঠ ইত্যাদি রয়েছে। ইউনিয়ন কাউন্সিল অধিকারি অফিসও এখানে। সিকদার পরিবার সামাজিক কাজের জন্য প্রভূত জমি, প্রায় দশ বিঘা, দান করেছে। এই গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় চার হাজার, তার মধ্যে সিকদার পরিবারেরই প্রায় পাঁচশত জন। এই পরিবারের ইউনুস সিকদার অঞ্চলের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ছিলেন, দশ বছর ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও। সিকদারদের নিজস্ব মসজিদ, পারিবারিক গোরস্থান সবই দেখালেন আলমগীর সাহেব।
দেখলাম মেঘনা নদীর নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে-‘মেঘনা ভিলেজ’। ‘মেঘনা ভিলেজ হাইওয়ে ক্যাফে’ এখানকার সবচেয়ে বড় হোটেল-রেস্টুরেন্ট। সুন্দর মধ্যাহ্ন ভোজের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। মধ্যাহ্নভোজ না বলে অপরাহ্ন ভোজ বলাই ভাল, ভোজ শেষে নির্মীয়মাণ দ্বিতীয় মেঘনা সেতু পেরিয়ে গেলাম সোনারগাঁও পানামা নগর।
হাজার বছরের পুরনো সুবর্ণগ্রামই সম্ভবত আজকের সোনারগাঁও। মুসলিম শাসনে আসার আগে এটি হিন্দু রাজ্য ছিল। হিন্দু ধনী বণিকরা এই পানামা নগরের গোড়াপত্তন করে। প্রায় দুহাজার ফুট লম্বা সতের ফুট চওড়া রাস্তার দুই ধারে ইয়ুরোপীয়-মোঘল স্থাপত্বশৈলী-মিশ্রণে তৈরি বাহান্নটি অট্টালিকা নিয়ে এই পানামা নগর। এই নগরের সাথে বার ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর যোগ, ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায়।
এবার আমরা এলাম অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। ঝিঙ্গে ফুল, বর্ষা দুপুর, বিকাশ, নবরাগ, রিদম, বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থাসহ অনেক প্রকাশক মোয়াজ্জেম হোসেন আলমগীরের গল্প-উপন্যাস এই বইমেলায় প্রকাশ করেছে। কিছু বই সংগ্রহ করা হলো। ফিরতে বেশ একটু রাত হলেও আলমগীরের বাড়িতে, সামাদ-বিবির মূলো দিয়ে লোভনীয় শোলমাছ রান্নাসহ রতের খাওয়া শেষ করে আস্তানা খোঁজা শুরু হয় প্রিয় সারথির সহায়তায়। অবশেষে অধিষ্ঠান হলো গ্রীন রোডের সিলকম হোটেলে।

পরদিন হোটেল-ব্রেকফাস্ট-প্যাক সঙ্গে নিয়ে ঢাকা-পাটুরিয়া (আরিচা) হাইওয়ে ধরে শিলাইদহ উদ্দেশে প্রত্যুষেই বেরিয়ে পড়া গেল। ডাব খাবার লোভ কোনদিনই সংবরণ করতে পারা যায়নি। মানিকগঞ্জে হাইওয়ের পাশে এক ডাবের দোকানে সবাই হৈচৈ করে ডাব খাওয়া হলো। ওখান থেকে আরিচা হয়ে পদ্মা- যমুনা (ব্রহ্মপুত্র) নদী সংযোগ স্থল পাটুরিয়া-ফেরিঘাটে গাড়ি সহিত বাহিত হতে হয়েছে ওপারের দৌলতদিয়া ফেরিঘাট টারমিনাল যেতে। সেদিনের উত্তাল পদ্মার পাড়ভাঙা ঢেউয়ের উন্মাত্ততার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সকলের সঙ্গে ভাগ করার মধ্যে যে উন্মাদনা ছিল, তা এ প্রজন্মেন পক্ষে বিস্ময়কর। একমাত্র বরিশালজাত অনিরুদ্ধ কিছুটা অভিজ্ঞতালব্ধ এই ব্যাপারে।
বর্তমান- পদ্মা হারিয়ে ফেলেছে তার অতীত-উত্তালতা-উন্মত্ততা। শান্ত-প্রায় নিরীহ পদ্মার বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো ঢাকা-ফরিদপুর হাইওয়ে ধরে গোয়ালয়ন্দ ঘাট-নির্দেশক-প্রস্থরখন্ডের কাছাকাছি হতে। ট্রেন থেকে নেমে এই ঘাটেই তো স্টিমার ধরতে হতো সেদিন! কোথায় সেই ঘাট, কোথায় আমার পদ্মা? বিস্তীর্ণ বালুচরে গড়ে উঠেছে গ্রাম, মাইলের পর মাইল জুড়ে। কোথাও কোথাও জলাশয় রয়েছে-নেই আমার কৈশোর-দৃষ্টিতে ভেসে আসা, স্মৃতিতে যত্নে লালিত, সেই সাগরব্যাপ্ত-কুল হারানো-পদ্মা।
রাজবাড়ি, বোয়ালিয়া, পাংশা, খোকশা, কুষ্টিয়া হয়ে কুমারখালী-শিলাইদহ রোড ধরা হলো। কসবা জামে মসজিদ পেরিয়ে কুঠিবাড়ি রোড। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, পৌঁছলাম কুমারখালী উপজেলার রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি। কতদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো! ভাবতে পারিনি এ জীবনে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি দেখা হয়ে যাবে। এ সৌভাগ্যলাভ একমাত্র স্বল্প সময়ে অতি-আপনজন হয়ে যাওয়া, মোয়াজ্জেম হোসেন আলমগীরের বদান্যতায় হয়েছে। অকুন্ঠচিত্তে তার লেখনি সঞ্চালনা সহ, সর্বকর্মে সাফল্য এবং মঙ্গল কামনা করি।
কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে বার মাইল দূরে অবস্থিত, চারদিক বিভিন্ন ফল-ফুল-গাছপালা শোভিত, প্রায় এগার একর এলাকা নিয়ে বাগান বেষ্টিত এই লালরং-এর পিরামিড আকৃতি তিনতলা কুঠিবাড়ি। অবিভক্ত বাংলায় কুষ্টিয়া নদীয়া জেলার অংশ ছিল। জমিদারি দেখভাল করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রায়ই এসে থাকতে হতো শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে। এই নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে দিন অতিবাহিত করার সময় তিনি এখানে অথবা পদ্মা নদীতে বজরায় বসে প্রচুর কবিতা-গান-উপন্যাস লিখেছেন। একসময় ১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সাল, এগার বছর একনাগারে এখানে ছিলেন। বাড়িটিকে সুরুচিপূর্ণ-সুরম্য, সপরিবার-গৃহস্থালী করার মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিলেন।
ঐ সময় নৈবেদ্য এবং খেয়ার কবিতা, গীতাঞ্জলি এবং গীতিমাল্যর গান সৃষ্ট হয়েছে। সোনার তরী, চিত্রা, কথা ও কাহিনী, চৈতালী, ক্ষণিকার মতো বিখ্যাত গ্রন্থ বা কবিতার জন্ম এখানে হয়। শিলাইদহ বসে তিনি পাঁচটি নাটক, চারটি উপন্যাস ও অজস্র কবিতা-গান লিখেছেন। গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ এখানেই লেখা শুরু করেন ১৯১২ সালে এবং নোবেল পুরষ্কার পান ১৯১৩ সালে।
ছিন্ন পত্রাবলীতে তিনি তাঁর শিলাইদহ এবং পদ্মানদী প্রীতি লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর উক্তি “The holy place of my literary pursuits during my youth and middle age was the village of  Shilaidaha kissed by the waves of Padma”, বিশেষ ভাবে প্রনিধানযোগ্য।
১৮০৮ সালে উত্তরাধিকার সুত্রে এই জমিদারির মালিক হন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার জন্য প্রথম আসেন। বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, নাট্যকার ডি এল রায়, সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর মতো সেদিনের অনেক দিকপাল শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে এসেছেন কবির আমন্ত্রণে।
রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত লেখার টেবিল, চেয়ার, শোবার খাট, পদ্মায় বেড়াবার নৌকো, পাল্কী, পোষাক, আলনা,এমন কি তাঁর প্রিয় পদ্মা নামক বজরার রেপ্লিকাও সযত্নে রাখা অছে। বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে তাঁর ছবি ছাড়াও অন্যান্য ছবি টানানো আছে ঘর-বারান্দা-সিড়ি জুড়ে।
আরেক রবির অস্তাচলে যাবার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। যেতে হবে সাঁই লালন ফকিরের সমাধি প্রাঙ্গনে। পথে দেখা গেল সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা। তারপরই লালন ফকিরের পূণ্য সমাধি স্থল। লালন সাঁইকে বাঙালির ঐতিহ্যের লালন, ইতিহাসের লালন, সংস্কৃতির লালনও বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে। বাউল সাধকদের কাছে তিনি ধর্মগুরু। তাঁর সমাধিস্থল তাদের কাছে তীর্থভূমি। তাঁর বীজমন্ত্র-‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, সর্ব সাধন সিদ্ধি হয় তার’।
কুষ্টিয়া শহরতলি কালিগঙ্গা নদীতীরে ছেঁউরিয়া গ্রামে তাঁর চারণভূমি ও সমাধিস্থল। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের দোল পূর্নিমার দিন এখানে তার অনুগামী, অনুরাগী, অগনিত সাধুদের মিলন মেলা হয়। তারা আত্মার তৃষ্ণা মেটাতে উদাত্ত কন্ঠে লালন-গীতি গেয়ে থাকেন। আমরা যেদিন গেলাম সেদিনও লালন-গীতি চলছিল।
সাঁই-এর নির্দেশ অনুসারে ছেঁউরিয়া আখরার একটি ঘরে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। পরে সেই ঘরে তাঁর স্ত্রীও সমাধিস্থ হন।
আমাদের সঙ্গী অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া নিজে একজন লালন-সাঁই অনুগামী-অনুসারি মনের ফকির। চোরমর্দন গ্রামের নিজের বাড়িতে বারামখানা বানিয়েছেন। বেশ কিছু শিষ্য-ছাত্র বছরে একদিন জাহন ফকিরের বারামখানাকে সাধনস্থল বানায়। বাউলের বিশ্বাসে ঈশ্বর বাস করেন মানব দেহে। সাধুর বারামখানা (নিরিবিলিতে বিশ্রাম-সাধন স্থল) শুনে প্রাণ অনুভূতি-সঙ্গমে ভূজঙ্গনা হয়ে চমকে ওঠে।
ফেরার যাত্রা শুরু। দৌলতদিয়া ফেরিঘাট টার্মিনাল থেকে ফেরিবাহনে যখন উঠলাম, রাত বেশ অনেকটা। রাতের খাওয়া ফেরিবাহনেই হলো। গ্রীন রোডের হোটেলে ফিরতে রাত প্রায় তিনটে।
পরদিন সারাটা দিন হোটেলেই কাটল। অরুণার ‘ইউনিভার্সিটি কামাই করে’-র বদলে বাড়ি থেকে আমাদের মধ্যাহ্ন-ভোজনের খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে। খাদ্য-বাহীর কাছ থেকে জানতে পারলাম সে অসুস্থ এবং বিছানায়। ফোনে বকাবকি করার চেষ্টা করলাম। কোন লাভ হয়েছে বলে মনে হলো না, দাদার এমনই বোন যে!
সুপ্রিমকোর্টের বিচারের রায়ে গন্ডগোলের সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায়, বিশেষ নিরপত্তার চাদরে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল ঢাকা শহর। তবু সন্ধ্যাবেলা আমাদের শহর দেখতে নিয়ে গেলেন আলমগীর সাহেব। নিয়ে গেলেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। বল্লাল সেনের ষোড়শতম বংশধর আমাদের সঙ্গে থাকায় বেশ কিছুটা খাতিরদারি হলো। তাছাড়া আলমগীর বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিচিত ব্যক্তি।
এবার ফেরার দিন এসে গেছে। আলমগীর, দলবল নিয়ে, আমাদের বিমানেই কলকাতা যাবেন। বিকেলের ফ্লাইট। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ দেখার বন্দোবস্ত করেছে আলমগীর। কন্যা-বয়সী লাবণ্য আহমেদ জাতীয় সংসদের জনসংযোগ বিভাগের অধিকর্তা, আলমগীরের বন্ধুও। খুবই যত্ন-আপ্যায়ণ করে সংসদ সদন ঘুরে ঘুরে দেখালেন। এ-ও এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। আগের দিন যাবার কথা থাকায় লাবণ্য আহমেদ স্পিকারকে বলে রেখেছিলেন আমাদের যাবার কথা। সম্মানীয় অভ্যর্থনার অয়োজন ছিল। মন্দভাগ্য, হলো না। লাবণ্যকে কন্যার সম্মান দিয়ে ফিরে এলাম।
আবার সেই পুত্রসম সাংবাদিক কাজল ঘোষ ও তার জীবনসঙ্গী পুষ্পিতা সহাস্যে জামদানী শাড়ি ক্রয়ে কল্যাণ-কল্যাণার্থে এলিফ্যান্ট রোড মার্কেটে নিয়ে যায়। আমরা শ্রোতা-দর্শক। ক্রয় সারা হলে ঐ রাস্তার ওপর বিখ্যাত দীপন পুর বই-এর দোকান সংলগ্ন ক্যাফে-সপে কফি সহযোগে আপ্যায়ন করেন পুত্রসম সেই সাংবাদিক।
জাগৃতি প্রকাশনীর অসাম্প্রদায়িক-মনোভাবাপন্ন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে মৌলবাদিরা তার শাহবাগ আজিজ মার্কেট অফিসে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাই এই দীপন পুর বই-এর দোকান তার স্মৃতি বিজড়িত।
মধাব দত্তের উক্তি দিয়ে শুরু করেছিলাম। প্রশ্ন আসবেই কেন আমার মনে কথাটা এলো? যতদিন ‘ও’ আসেনি কোন ভাবনাই আসেনি। ‘ও’ কোথা থেকে এসে তার ঘর জুড়ে বসেছিল। একই কথা আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ‘ও’ এখানে প্রতীকী-আমার বাংলাদেশের আত্মার-আত্মীয়দের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার গভীরতা-অসীমতা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status