ঈদ আনন্দ ২০১৮

এক জীবন্ত কিংবদন্তি

মোশাররফ রুমী

২৮ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৩:৩১ পূর্বাহ্ন

তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তি। অনন্য প্রতিভায় উজ্জ্বল। সে ঔজ্জ্বল্যে দারুণভাবে আলোকিত করেছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের চৌহদ্দিকে। তিনি শাবানা। চলচ্চিত্রের অসাধারণ অভিনেত্রী। পর্দায় যার মোহিনী হাসি কোটি মানুষের চিত্তে জাগাতো চাঞ্চল্য।  আর কান্না অশ্রুসিক্ত করে তুলতো  যে কাউকেই। সিনেমায় তার অভিনীত কোনো চরিত্র যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতো তখন দর্শকরাও ন্যায়ের পক্ষে প্রজ্বলিত হতো দারুণ আবেগে। দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেছেন অভিনয় জগতে।
এ সময়ের মধ্যে তিনি ২৯৯টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ষাট থেকে নব্বই দশকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন এ অভিনেত্রী। ১৯৯৭ সালে হঠাৎই তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকে বিদায় নেয়ার ঘোষণা দেন। ২০০০ সাল থেকে তিনি স্বামী-সন্তানসহ যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। হজ সম্পন্ন করার পর থেকে তিনি ইসলামী রীতি-অনুশাসন মেনে চলেন। বর্তমানে তিনি নাতি-নাতনী, ছেলেমেয়েদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। পর্দার অন্তরালে এই জীবন্ত কিংবদন্তির ব্যক্তিজীবন খুব শান্তিতেই কাটছে বলে জানা গেছে তার নিকটজনদের কাছ থেকে। একজন অভিনেত্রী হিসেবে শাবানা লাস্যময়ী নায়িকা, সোহাগিনী ভাবী আর মমতাময়ী মায়ের ইমেজসম্পন্ন। তেমনই ব্যক্তিজীবনে তিনি দারুণ মিশুক, বিনয়ী এবং কোমলতায় পূর্ণ। চলচ্চিত্রে চলার পথে এর প্রমাণ তিনি বরাবরই দিয়ে গেছেন। আর সর্বশেষ দিয়েছেন গেল বছর দেশে এসে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা নেয়ার সময়। সেখানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমন সব কথা তিনি বলেছেন যা শুনে অনুষ্ঠানস্থল জুড়ে নেমে এসেছিল গভীর নিস্তব্ধতা। আর অতিথিরা হয়ে উঠেছিলেন খুব আবেগময় এবং অশ্রসিক্ত। শাবানার প্রকৃত নাম আফরোজা সুলতানা রতœা। ১৯৫৩ সালে চট্টগ্রামের রাউজানের ডাবুয়া এলাকায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। বাবা ফয়েজ চৌধুরী পেশায় ছিলেন টাইপিস্ট। অভাব-অনটনের সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনার জন্য পরবর্তীতে তিনি টাইপিস্টের পেশা ছেড়ে সিনেমা জগতে নাম লেখান। লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ায় এবং আর্থিক দুরবস্থার কারণে শাবানা ৯ বছর বয়সেই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলেন। বাবা ফয়েজ চৌধুরী মেয়েকে নিয়ে এফডিসিতে প্রায়ই আসতেন। ১৯৬২ সালে প্রথমবারের মতো তিনি শিশু শিল্পী হিসেবে ‘নতুন সুর’ সিনেমায় অভিনয় করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তালাশ’ সিনেমায় নৃত্যশিল্পী হিসেবে একটি দৃশ্যে তাকে দেখা যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ‘আবার বনবাসে রূপবান’ ও ‘ডাকবাবু’ নামে দুটি চলচ্চিত্রে পার্শ্ব নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। তার বাবা ফয়েজ চৌধুরীর খালাতো ভাই ছিলেন তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক আবু নূর মোহাম্মাদ এহতেশামুল হক। ১৯৬৭ সালে চাচা এহতেশাম পরিচালিত উর্দু ভাষায় নির্মিত ‘চকোরী’ সিনেমায় প্রথমবারের মতো তিনি নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ সিনেমায় তার বিপরীতে ছিলেন পাকিস্তানি অভিনেতা নাদিম। এই সিনেমার মধ্য দিয়েই তিনি তার রতœা নামের পরিবর্তন করে শাবানা নামে আত্মপ্রকাশ করেন। নামটি দিয়েছিলেন এহতেশাম। সিনেমাটি সেই সময়কার দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং ৬টি ক্যাটাগরিতে নিগার পুরস্কার লাভ করে। টানা ৮১ সপ্তাহ ধরে চলা এ সিনেমার পর আর কখনো শাবানাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এ সময় তিনি অসংখ্য উর্দু সিনেমায় অভিনয় করেন। নায়ক নাদিম ও তাকে নিয়ে তৎকালীন মিডিয়া পাড়ায় গুঞ্জন শুরু হলেও পরবর্তীতে তিনি তা সামলে উঠেন। বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালে তিনি নায়করাজ রাজ্জাকের বিপরীতে ‘ছদ্মবেশী’ ও ‘মধুমিলন’ সিনেমায় অভিনয় করেন। ঐ বছরই তিনি উর্দু ভাষায় ‘পায়েল’ সিনেমাতেও রাজ্জাকের বিপরীতে অভিনয় করেন। এ গুণী শিল্পী ১৯৭৩ সালে যশোরের  কেশবপুর নিবাসী সরকারি কর্মকর্তা ওয়াহিদ সাদিকের সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরে সুমী ও ঊর্মি নামের দুটি কন্যাসন্তান ও নাহিন নামের এক পুত্রসন্তান রয়েছে। ১৯৭৯ সালে তিনি স্বামী ওয়াহিদ সাদিকের সঙ্গে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এসএস প্রোডাকশনস  তৈরি করেন। চাচা আজিজুর রহমানের পরিচালনায় তিনি ও তার স্বামীর গড়া এসএস প্রোডাকশনসের ব্যানারে রাজ্জাকের বিপরীতে তিনি অভিনয় করেন ‘মাটির ঘর’ সিনেমায়। যা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় সিনেমা হয়ে আছে। পরবর্তীতে তিনি অসংখ্য চলচ্চিত্র এ  প্রোডাকশন হাউজের ব্যানারে প্রযোজনা করেন। তিনি তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তার সময়কার সব নায়কের বিপরীতেই অভিনয় করেছেন। তাদের মধ্যে নাদিম, রাজ্জাক, আলমগীর, বুলবুল আহমেদ, ইলিয়াস কাঞ্চন, জসীম, ওয়াসীম অন্যতম। নায়ক আলমগীরের সঙ্গে শাবানার জুটি ছিল অনবদ্য। তাদের জুটি হওয়া প্রায় সব সিনেমাই ছিল ব্যাপকভাবে ব্যবসাসফল। শাবানার ক্যারিয়ারের ১৩০টি সিনেমাই আলমগীরের বিপরীতে করা। এ জুটির জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘ভাত  দে’, ‘মরণের পরে’, ‘গরীবের বউ’, ‘রজনীগন্ধা’, ‘ব্যথার দান’, ‘সত্য মিথ্যা’, ‘অস্বীকার’, ‘ঘরের বউ’, ‘আশার আলো’, ‘রাঙা ভাবী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। রাজ্জাকের সঙ্গে শাবানার সাবলীল অভিনয় ছিল বহুল জনপ্রিয় ও প্রশংসিত। এ জুটির অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘মধুমিলন’,  ‘সখী তুমি কার, ‘অভিমান’,   ‘স্বাধীন’, ‘অংশীদার’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি নায়ক জসিমের বিপরীতে অভিনয় করেছেন অসংখ্য সিনেমায়। তাদের জুটির অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘স্বামী কেন আসামী’, ‘কাজের বেটি রহিমা’, ‘কালিয়া’, ‘মাস্তান রাজা’, ‘জিদ্দি’ সহ আরো অনেক সিনেমা সুপারহিট হয়েছে। শাবানা তার ক্যারিয়ারে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সর্বমোট ৯ বার পেয়েছেন অভিনেত্রী হিসেবে, একবার প্রযোজনার জন্য ও একবার আজীবন সম্মাননা। এসবের মধ্যে ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া সিরাজুল ইসলাম পরিচালিত সিনেমা ‘জননী’তে তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্র ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হয়ে পুরস্কার জিতে  নেন।  ১৯৮০ সালে আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সখী তুমি কার’ সিনেমায় রাজ্জাক-শাবানা-ফারুক ত্রয়ীর ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী পর্দায় ফুটে উঠে অসাধারণভাবে। এ সিনেমার জন্য তিনি  সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নেন। এরপর ১৯৮২ সালে রাজ্জাকের বিপরীতে ‘দুই পয়সার আলতা’ সিনেমায় অভিনয় করে দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলেন ছবির কুসুম চরিত্রটি। ১৯৮৩ সালে ‘ভাত  দে’ সিনেমায় নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করে কাঁদিয়েছিলেন সব দর্শককে। এত সাবলীল অভিনয় আর হৃদয়বিদারক সমাপ্তি বাংলা সিনেমার জগতে যোগ করেছিলো এক নতুন মাত্রা। সিনেমাটিতে তার বিপরীতে ছিলেন নায়ক আলমগীর। এই দুটি সিনেমাই পরিচালনা করেন আমজাদ  হোসেন। এরপর ১৯৮৭ সালে দীলিপ বিশ্বাসের ‘অপেক্ষা’ ও ১৯৮৯ সালে মতিন রহমানের ‘রাঙা ভাবী’ সিনেমা দুটির জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নেন। এ দুটি সিনেমাতেই তিনি অভিনয় করেন আলমগীরের বিপরীতে। ১৯৯০ সালে তিনি প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে পুরস্কার পান ‘গরীবের বউ’ সিনেমার জন্য। সে বছরই আজহারুল ইসলামের ‘মরণের পরে’ সিনেমায় অনবদ্য অভিনয় সুবাদে জয় করে নেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও। ১৯৯১ সালে শিবলী সাদিকের পরিচালনায় ‘অচেনা’ সিনেমায় তার ক্যারিয়ারের শেষ বারের মতো সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার  জেতেন। ১৯৯৭ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে সর্বশেষ তিনি রূপালী পর্দায় আসেন। গেল বছর বাংলাদেশ সরকার তাকে চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status