প্রথম পাতা

গাজীপুরে নতুন অঙ্ক

স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা ও গাজীপুর

২৬ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:৩১ পূর্বাহ্ন

সংশয়, শঙ্কা আর গুজবে ভারি হাওয়া। নানা হিসাব, অঙ্ক। গুমোট পরিবেশ। এমন অবস্থায় আজ ভোটগ্রহণ হচ্ছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর এ সিটির নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি দেশবাসীর। কেমন হবে ভোট? খুলনা মডেলের ভোট হবে নাকি নতুন কোনো মডেল দেখা যাবে ভাওয়াল গড়ে? এমন নানা প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে সরগরম ছিল নির্বাচনী এলাকা। নির্বাচন কমিশন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু  ভোট করতে নানা উদ্যোগের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত প্রার্থীরা কমিশনের ওপর আস্থা স্থাপন করতে পারেননি। তারা বলছেন, ভোটের দিনের পরিস্থিতিই সব বলে দেবে। খুলনার ভোট নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল নির্বাচন কমিশন। দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ ভোটে কারচুপির নানা অভিযোগ তুলেছিল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। পরে অবশ্য নির্বাচন কমিশনের তদন্তেও তা ধরা পড়ে।

ওই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিয়ে গাজীপুরে আরো কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা জানিয়েছে ইসি। তবে কমিশন কতটা কঠোর হতে পারবে তা আজকের পরিবেশই বলে দেবে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুরের ভোট ইসির সামনে বড় এক চ্যলেঞ্জ। প্রধান বিরোধী জোট ২০ দলের অন্যতম বিএনপি বলছে তফসিল ঘোষিত তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে গাজীপুরের নির্বাচন দেখে। গাজীপুরে মেয়র পদে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। লড়াই হবে নৌকা ও ধানের শীষে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকার দুই জনই জয়ের ব্যাপারে আশার কথা জানিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী ফুরফুরে মেজাজে প্রচারণা শেষ করলেও বিএনপি প্রার্থী রয়েছেন নানা শঙ্কা আর আতঙ্কের মধ্যে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার নেতাকর্মীদের ক্রমাগত হয়রানি করে আসছে বলেও অভিযোগ তার। গত কয়েকদিনে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের অভিযোগ রয়েছে বিএনপি প্রার্থীর। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে তিনি দফায় দফায় অভিযোগ দিলেও কমিশন শেষ মুহূর্তে গতকাল জেলা পুলিশ সুপারকে একটি লিখিত নির্দেশনা দিয়ে পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশনা দিয়েছে। এদিকে বিএনপির হাতে থাকা গাজীপুর সিটির মেয়র পদ নিজেদের করে নিতে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখবে দলীয় ঐক্য।

দৃশ্যত দুই দলেই নেতাদের ঐক্য দেখা গেলেও আদতে তা কতটা মিটেছে তার ওপর নির্ভর করবে ফল। এদিকে এ সিটিতে ভোট গ্রহণের সব প্রস্তুতি গত রাতের মধ্যেই শেষ হয়েছে। আয়তনে দেশের বৃহত্তম এই নগরীর ৪২৫ কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়া হয় ব্যালট পেপার, বাক্স, সিলসহ নির্বাচনের সরঞ্জাম। ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণে প্রস্তুত ৬ কেন্দ্র। আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোট গ্রহণ হবে। নির্বাচন কমিশনের মতে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বা ঝুঁকিপূর্ণ ৩৩৭ কেন্দ্রে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ নিয়েও প্রার্থীদের মধ্যে দুশ্চিন্তা রয়েছে।

নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের শিবিরে স্বস্তি থাকলেও অনিশ্চয়তায় বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার। ভোটের আগের দিনও বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের অভিযোগ করেছেন তিনি। অন্যদিকে ভোটের আগের দিন গতকাল এক মেয়র প্রার্থীসহ বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে টাকায় ভোট কেনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এত কিছুর পরেও শেষ পর্যন্ত একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশায় রয়েছেন গাজীপুরের ভোটাররা। তবে এবার ভোটে আগ্রহ কমায় ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ ভোটারের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কেন্দ্রে না যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন প্রার্থীরা। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে ৭ মেয়র প্রার্থীসহ ২৫৪ কাউন্সিলর প্রার্থীর সিংহভাগ সন্দিহান থাকলেও নিরপেক্ষ নির্বাচন চান অধিকাংশ প্রার্থী।

গতকাল সকাল থেকে রত্ন এলাকায় বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে স্থাপিত রিটার্নিং অফিসারের অস্থায়ী কার্যালয় থেকে নির্বাচন সামগ্রী বিতরণ করা হয়। সেখান থেকে তা নেয়া হয় আরো চারটি বিতরণ কেন্দ্রে। পাঁচ বিতরণ কেন্দ্র থেকে গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন কেন্দ্রের দায়িত্ব পাওয়া প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে ব্যালট পেপার, বাক্স, সিল ইত্যাদি বুঝিয়ে দেয়া হয়। তা গ্রহণের পর পুলিশ ও আনসার সদস্যদের পাহারায় নিজ নিজ কেন্দ্রে নিয়ে যান তারা। গতকাল বেলা দু’টার দিকে গাজীপুর সদরের রানী বিলাশ মনি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে প্রিজাইডিং অফিসার ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারবৃন্দ ইভিএম স্থাপন করেন। তাদেরকে যান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে দেখা গেছে।

কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার এম হাসান চৌধুরী বলেন, ইভিএমে ভোট দেয়া-নেয়া নিয়ে আমাদেরকে আগে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আজ (সোমবার) স্থানীয়দেরকেও ইভিএমে কীভাবে ভোট দিতে হবে তা দেখিয়েছি। আমরা ইভিএমে ভোট গ্রহণে প্রস্তুত। এদিকে অন্যান্য কেন্দ্রেও সরজ্ঞাম নিয়ে পৌঁছার পর প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারবৃন্দকে নির্বাচনী বুথ তৈরিসহ প্রাসঙ্গিক কাজ করতে দেখা যায়। আগের দিন গত সোমবার থেকে গাজীপুরের মোতায়েন রয়েছে ২৯ প্লাটুন বিজিবিসহ ব্যাপক সংখ্যাক পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা। গতকাল গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের টহল চোখে পড়ে।

এদিকে নির্বাচনের আগের দিন প্রার্থীরাও কেন্দ্র এবং বুথের জন্য পোলিং ও সহকারী পোলিং এজেন্ট নির্বাচনে সময় কাটান। অধিকাংশ প্রার্থীই তাদের এজেন্টের তালিকা রিটার্নিং, সহকারী রিটার্নিং ও কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে পৌঁছে দেন। তবে শেষ মুহূর্তেও নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন ৭ মেয়র প্রার্থীর ৬ জন।

বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, নির্বাচন কমিশন তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। আমাদের কোনো অভিযোগের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখনও গণগ্রেপ্তার চলছে। সকল ভয়-ভীতি-বাধা এবং ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার জন্য ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কাস্তে প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মেয়র প্রার্থী কাজী মো. রুহুল আমিন বলেন, জনগণ শঙ্কিত, নিরুৎসাহিত। এমন পরিস্থিতিতে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। ইসলামী ঐক্যজোট প্রার্থী (মিনার প্রতীক) ফজলুর রহমান বলেন, জনগণের মধ্যে উৎকণ্ঠা আছে। এ ছাড়া বৃষ্টি হলে ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে। আমরা চেষ্টা কববো কীভাবে ভোটারদের উপস্থিত করা যায়। তবে ভোটের আগের দিন বিনা উস্কানিতে বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার নির্বাচনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী মো. জালাল উদ্দিন বলেন, আতঙ্ক থাকায় আমরা আমাদের ভোটারদের মধ্যে সকাল থেকে ১০ বা ১১টার মধ্যে ভোট দিয়ে যেতে বলেছি। কারণ ১২টার পর কী হবে তা আমরা বলতে পারছি না। বাতাসে গুজব ভাসছে। ভোট ইঞ্জিনিয়ারিং হতে পারে।

তাছাড়া বৃষ্টি হলে তাতে অনেক কেন্দ্রে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নির্বাচনে তিনি সম্মানজনক ভোট পাবেন বলেও আশা ব্যক্ত করেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মো. নাসির উদ্দিন বলেন, একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তো আছে। আশা করি নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ২২৫ কেন্দ্রের ২ হাজার ৭৬১ বুথের জন্য আগেই পোলিং ও সহকারী পোলিং এজেন্টের তালিকা চূড়ান্ত করেন। তবে গতকাল বিকাল পর্যন্ত অপর চার দলের ৪ প্রার্থী ২০০ থেকে ৫০০ জনমত এজেন্ট প্রস্তুতে সক্ষম হন। তবে আওয়ামী লীগকে ভোটের দিন সুবিধা দেয়ার জন্য প্রার্থিতা করছেন বলে কথিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমদ ২২৫ কেন্দ্রের জন্য ২ হাজার ৭৬১ পোলিং ও সহকারী পোলিং এজেন্টের তালিকা রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দিয়েছেন বলে জানান।

তিনি মানবজমিনকে বলেন, গত দু’একদিন ধরে হঠাৎ পরিস্থিতি গুমট বেঁধে আছে। ভোটারদের মধ্যে মোটামোটিভাবে শঙ্কা আছে। ভোটের আগের দিন বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তারটা ঠিক হচ্ছে না। আপনার যত এজেন্ট ততটা ভোট যদি না পান তাহলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সুবিধা দেয়ার জন্য প্রার্থিতা করার বিষয়টি প্রমাণ হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ তা হবে। পরে আবার বলেন, তাহলে ধরে নিতে হবে এজেন্টরা আমার সঙ্গে বেঈমানি করেছে।

শুধু প্রার্থীরা নন। গতকালও প্রার্থীদের মধ্যে শঙ্কা দেখা গেছে। গাজীপুর চৌরাস্তার মোড়ে অনুপম সুপার মার্কেটের কাপড়ের ব্যবসায়ী সাতাত্তর বছর বয়সী আশরাফ আলী ২১ নম্বর ও মধ্য বয়সী ঘড়ি ও ছাতা বিক্রেতা মো. সেলিম অন্য ওয়ার্ডের ভোটার। আশরাফ বলেন, ভোটারদের চাওয়া-পাওয়ায় তো নির্বাচন হচ্ছে না। আমরা ভোট দেব। সরকার বা প্রশাসন যাকে চায় তিনিই বিজয়ী হবেন। সেলিম বলেন, এখন কী আর আগের মতো ভোট আছে। বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে কেন্দ্র থেকে চলে আসবো।

গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে শিববাড়ী আসার পথে কথা হয় ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার পান বিক্রেতা আব্দুর রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু ভোট হবে কী করে। আজ (গতকাল) ভোরে সালনা পোড়াবাড়ির বাজারে আমার বাসার কাছ থেকে পুলিশ বিএনপি কর্মী হারিছ ও বাকীকে ধরে নিয়ে গেছে।

শেষ মুহূর্তেও গ্রেপ্তার: রোববার দিবাগত রাতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্তত ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে হুমকি দেয়ার অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এমনকি মারধরে নেতাকর্মীদের অনেকেই আহত হয়েছেন। কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা গতকালও সরব ছিলেন। নৌকা প্রতীকের ব্যাজ লাগিয়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করতে দেখা গেছে তাদের। বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলেই জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের  নেতা-কর্মীরা। এদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মারধর করে আহত করা হয়েছে টঙ্গী পুবাইল রোডের শওকত আলীকে।

গতকাল শওকত আলীর বাড়িতে গেলে ডান হাতে, কোমরে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে তিনি জানান, তিনি ব্যবসায়ী। রাজনীতি করেন না। তার বড় ভাই মো. আবদুল আলী বিএনপি’র ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের  সাংগঠনিক সম্পাদক। রোববার রাত ১১ টার দিকে সাত-আটজনের একটি দল বাড়ির গেইটের সামনে তাকে পেয়ে তার বড় ভাইয়ের খোঁজ করে। ভাইয়ের খোঁজ না দেয়ার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে শওকতের ওপর চড়াও হন তারা। শওকতকে বেদম  পেটানো হয়। তাকে সঙ্গে নিয়ে আবদুল আলীর বাসা তল্লাশি করা হয়। শওকত জানান, ‘তারা বলেছে পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাজীপুর ছাড়বি। নির্বাচনের দিন যেন  কোনোভাবেই ভোটকেন্দ্রে না দেখি। নইলে জানে মেরে ফেলবো।’

হুমকি-ধমকিতে বাড়ি ছেড়েছেন নোয়াগাঁও এমএ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বিএনপি’র নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক জসিম উদ্দিন। আমতলী  কেরানীরটেক এলাকার বাসিন্দা জসিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে ঘরে ঝুলছে তালা। ফোনে যোগাযোগ করা হলে জসিম জানান, রোববার রাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কয়েকজন তার বাসায় যায়। এ সময় তারা জসিমের খোঁজ করে। তরা জসিমের স্ত্রীকে হুমকি দিয়ে বলেছে, জসিমকে পেলে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দেবো। এ সময় জসিমের স্ত্রীকে তারা এক্ষণি বাড়ি ছাড়তে বলে। তারা বলেছে, নির্বাচনের পরে গাজীপুর আসবি। এ সময় জসিমের স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। একপর্যায়ে তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয় সাদা পোশাকধারীরা। একইভাবে ওই এলাকার সুলতান, আসাদুল, নুরুল ইসলামের ঘরে তল্লাশি করেছে তারা। এসব বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার রকিব উদ্দিন মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

টঙ্গীসহ গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নৌকার ব্যাজ পরে বিভিন্নস্থানে অবস্থান করছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের কর্মী-সমর্থকরা। বিকালে জাহাঙ্গীরের ছয়দানা এলাকার বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, চারতলা বাড়ির নিচতলায় জড়ো হয়েছেন সহস্রাধিক নেতাকর্মী। জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠজন আশরাফুল আলম বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই গাজীপুরের মানুষের জন্য কাজ করছেন জাহাঙ্গীর। এলাকার যানজট নিরসের জন্য প্রায় সাড়ে তিন শ’ ট্রাফিক সহযোগী রয়েছে তার। এরমধ্যে বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ৭২ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। মানুষের কল্যাণের কাজ করার কারণেই জাহাঙ্গীর জয়ী হবেন বলে মনে করেন তিনি। জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে জনগণের রায় প্রতিফলিত হবে। কোথাও কোনো হুমকি-ধমকির ঘটনা ঘটেনি বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, কারচুপি করে নির্বাচনে জেতার অভ্যাস আওয়ামী লীগের নেই।

অন্যদিকে, গাজীপুরে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এমন কোনো ওয়ার্ড নেই যেখানে আমাদের নেতাকর্মীদের হুমকি-ধমকি দেয়া হয়নি। অনেকে আমাকে জানিয়েছেন পুলিশের পোশাক পরে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেমে গেছে। তারা নেতাকর্মীদের মারধরও করছে। আওয়ামী লীগ ফেয়ার নির্বাচনের কথা বলছে, ফেয়ার নির্বাচনটা আসলে কী? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, তবে গাজীপুরে তারা শিক্ষা পেয়ে যেতে পারে যদি মানুষ জেগে ওঠে। শেষ পর্যন্ত নিবাচনী মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, আমি নিরাশ না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনীতিবিদ। আমি মাঠে থাকবো। গতকাল সকালে হাসান উদ্দিন সরকারের টঙ্গীর আউচপাড়া বাসায় তিনি এসব কথা বলেন। গাজীপুরের পুলিশের সিনিয়র এএসপি  রাসেল শেখ জানান, ইতিমধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় সাত শ’ বিজিবি সদস্য, ছয় শ’ র‌্যাব সদস্য ও সাত হাজার পুলিশ ও সাত হাজার আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও আজ  ভোটগ্রহণ চলাকালে সিটি করপোরেশনের ৫৭ টি ওয়ার্ডে ৫৭ জন ম্যাজিস্ট্রট দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানান তিনি।

 ৮০ ভাগ কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ: মেয়র পদ ছাড়াও দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচনে রয়েছে ৫৭ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ১৯ জন সংরক্ষিত (নারী) ওয়ার্ড কাউন্সিলার পদ। এতে ৭ জন মেয়র, ২৫৪ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৮৪ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একজন কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় তিনটি পদে সব মিলে প্রার্থী রয়েছেন ৩৪৫ জন। এ নির্বাচনে এবার মোট ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭শ‘ ৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩৫ এবং নারী ভোটার ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮০১।  ভোট কেন্দ্রগুলোর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ।

রংপুর ও খুলনার পর এবার এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৬টি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনে সাতজন মেয়র প্রার্থী হলেন- আওয়ামী লীগ মনোনীত মো. জাহাঙ্গীর আলম (নৌকা), বিএনপি মনোনীত হাসান উদ্দিন সরকার (ধানের শীষ), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি’র কাজী মো. রুহুল আমিন (কাস্তে), ইসলামী ঐক্য জোটের ফজলুর রহমান (মিনার), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. নাসির উদ্দিন (হাতপাখা), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মো. জালাল উদ্দিন (মোমবাতি) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ আহমদ (টেবিল ঘড়ি) প্রতীক। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম কানাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ও বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার টঙ্গীর আউচপাড়া এলাকার বসির উদ্দিন উদয়ন একাডেমি কেন্দ্রে ভোট দেবেন।

যেসব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহারে প্রস্তাব করা হয়েছে সেই কেন্দ্রগুলো হলো- চাপুলিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (ভোটার সংখ্যা-২৪৮০), চাপুলিয়া মফিজউদ্দিন খান উচ্চ বিদ্যালয় (ভোটার সংখ্যা-২৫৫২), পশ্চিম জয়দেবপুরের মারিয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে-১ (ভোটার সংখ্যা-২৫৬২), মারিয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে-২ (ভোটার সংখ্যা-২৮২৭), রানী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে-১ (ভোটার সংখ্যা-১৯২৭) ও রানী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে-২ (ভোটার সংখ্যা-২০৭৭)।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩৩৭টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও প্রশাসনিক ভাষায় এসব কেন্দ্রকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ উল্লেখ করা হয়েছে। সেই হিসাবে গাজীপুরে মোট ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ৭৯ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোটকেন্দ্র।

এই নির্বাচনে ভোট গ্রহণের জন্য মোট ১০ হাজার ২৪ জন আনসার ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে থেকে শুরু করে আগে ও পরে ৪ দিনে ৫৭ জন (প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। আরও ১০ জন অতিরিক্ত হিসেবে মোট ৬৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া গড়ে তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে মোট ১৯ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ২৮ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের বাইরে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি’র টহল বেশি থাকবে। নগরের ৫৭টি ওয়ার্ডে পুলিশ ও এপিবিএন ও ব্যাটালিয়ন আনসারের ৫৭টি মোবাইল ও ২০টি স্ট্রাইকিং ফোর্স, র‌্যাব’র ৫৮টি টিম ও ২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েনের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী কাজে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ৫৭টি ওয়ার্ডে র‌্যাব’র ৫৭টি টহল দল মোতায়েন করা হয়েছে। মোট ৬০০ জন র‌্যাব সদস্য নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। নির্বাচনে নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি র‌্যাব-১ মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। মোট ৫৭টি ওয়ার্ডের প্রতিটি ওয়ার্ডে ১টি করে মোট ৫৭টি টহল দল মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতি টহলে আটজন করে জনবল থাকবে। প্রতি ৪ ওয়ার্ডে একজন করে মোট ১৪ জন অফিসার নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন। সার্বক্ষণিক তদারকি কাজে নিয়োজিত থাকবেন র‌্যাব-১ উত্তরার অধিনায়ক মো. সারওয়ার-বিন-কাশেম।

প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র পাহারায় পুলিশ ও আনসারের ২৪ জন সদস্য মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মধ্যে ১২ জন অস্ত্রধারী ও বাকি ১২ জন লাঠিসহ অবস্থান করবেন। অপরদিকে সাধারণ ভোটকেন্দ্রে (ঝুঁকিমুক্ত) ২২ জন করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থাকবেন, যাদের মধ্যে রয়েছে ১০ জন অস্ত্রধারী। এছাড়া প্রতিটি সাধারণ ওয়ার্ডে ১০ জনের একটি টিম এবং ১০ জনের একটি রিজার্ভ টিম মোতায়েন থাকবে। ৫৮০ জন র‌্যাব সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রে ৪২৫ জন প্রিজাইডিং ও ২ হাজার ৭৬১ জন সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, ৫ হাজার ৫২২ জন পোলিং অফিসারসহ মোট ৮ হাজার ৭০৮ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ ছাড়াও ৮৭১ জন রিজার্ভ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

গাজীপুরে সরজমিন অবস্থান করে প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন স্টাফ রিপোর্টার মহিউদ্দিন অদুল, রুদ্র মিজান, ইকবাল আহমদ সরকার ও এমএ হায়দার সরকার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status