দেশ বিদেশ

আদালতে দুই শিশু সন্তান থাকতে চায় মা-বাবার সান্নিধ্যে

স্টাফ রিপোর্টার

২৬ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০১ পূর্বাহ্ন

মা-বাবার বিচ্ছেদ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না দুই শিশু সন্তান ধ্রুব (১২) ও রুদ্র (৯)। মা ও বাবা চান দুই শিশু সন্তানকে নিজ নিজ হেফাজতে নিতে। কিন্তু দুই সন্তানের আবদার তারা থাকতে চায় বাবা ও মায়ের কাছেই, থাকতে চায় তাদের সান্নিধ্যে। উচ্চ আদালতেও এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে দুই সন্তান। মা বাবার মিলন চায় তারা। আর তাদের এ আকুতি ছুঁয়ে গেছে আদালতে উপস্থিত বিচারক, আইনজীবী, গণমাধ্যম কর্মীসহ সকলকে। গতকাল এমনই এক ঘটনায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে সৃষ্টি হয় আবেগঘন পরিবেশ।
দুই সন্তানকে নিজ হেফাজতে নিতে মা কামরুন্নাহার মল্লিকার করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৯শে মে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই দুই শিশুসহ বাবা মেহেদী হাসানকে ২৫শে জুন (গতকাল) আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। এরই প্রেক্ষিতে গতকাল বাবা মেহেদী হাসান, মা মল্লিকা ও তাদের কয়েকজন স্বজন হাজির হন। সঙ্গে দুই সন্তান ধ্রুব ও রুদ্রকেও নিয়ে আসা হয়। শুনানি নিয়ে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এক আদেশে দুই শিশুকে আগামী ৪ঠা জুলাই পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে পরবর্তী আদেশের জন্য ওই দিন আবারো সকলকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়। আদালতে ওই শিশু দুটির বাবা মেহেদী হাসানের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী তাপস বল। মা কামরুন্নাহার মল্লিকার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল। তার সঙ্গে ছিলেন একে এম রিয়াদ সলিমুল্লাহ।
আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, মাগুরার মহম্মদপুরের মেহেদী হাসান ও রাজশাহীর কামরুন্নাহার মল্লিকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হয় ২০০২ সালে। রাজধানীতেই বসবাস করতে থাকেন দুজন। মেহেদী হাসান একটি বেসরকারি ব্যাংকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করতেন। কামরুন্নাহার রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করেন। এরই মধ্যে দুজনের ঘর আলোকিত করে রাখে দুই ফুটফুটে সন্তান ধ্রুব ও রুদ্র। একটু বড় হলে দুজনকেই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে বিভিন্ন কারণে মেহেদী হাসান ও কামরুন্নাহার মল্লিকার মধ্যে দেখা দেয় মনোমালিন্য। পরে ২০১৭ সালের ১২ই মে দুজনের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। স্বামী মেহেদী হাসান স্ত্রীকে তালাক দেয়ার এক সপ্তাহ আগে দুই সন্তানকে তার গ্রামের বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর পাঠিয়ে দেন। সেখানে তার বোনের তত্ত্বাবধানে মাগুরার জেলা শহরের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় দুই ছেলেকে। মেহেদী হাসান থাকতেন ঢাকার উত্তরাতে।
তবে, এই একবছর মা কামরুন্নাহার মল্লিকা দুই সন্তানের দেখা পাননি। তার অভিযোগ, মেহেদী হাসানের বোনের কারণেই সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি। একপর্যায়ে সন্তানদের নিজের হেফাজতে নিতে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন তিনি। গত ২৯শে মে হাইকোর্ট এক আদেশে মেহেদী হাসানকে দুই শিশু সন্তানসহ ২৫শে জুন (গতকাল) আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। এ ছাড়া দুই শিশু সন্তানকে কেন মায়ের হেফাজতে দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক মাগুরার মহম্মদপুর থানা পুলিশ শিশু দুটিকে গতকাল আদালতে আনে। এ ছাড়া শিশু দুটির মা কামরুন্নাহার মল্লিকাসহ মামা, নানী ও ফুফুসহ আত্মীয়স্বজনরাও আদালতে হাজির হন। সকালে এ সংক্রান্তে শুনানি শুরু হয়। শুনানির একপর্যায়ে আদালত ওই দুই শিশুর বক্তব্য শুনতে চান। সালিম সাদমান ধ্রুব আদালতকে বলেন, আমরা আর কিছু চাই না, বাবা-মাকে একত্রে দেখতে চাই। তাদের সঙ্গে থাকতে চাই। শিশু দুটির বক্তব্য শুনে আদালত ফের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনেন। এ সময় কামরুন্নাহার মল্লিকার আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল সন্তানদের সঙ্গে মায়ের কথা বলার সুযোগ চান। পরে আদালতের অনুমতি পেয়ে মা কামরুন্নাহার দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। দুই সন্তানও দীর্ঘ দিন পর মাকে সামনে পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে বড় ছেলে ধ্রুব হাত বাড়িয়ে বাবাকেও কাছে ডেকে বলতে থাকে, বাবা তুমিও এসো। আমাদের কাছে এসো। আম্মুকে সরি বল। এ সময় বাবা মেহেদী হাসানও এগিয়ে যান তাদের কাছে। জড়িয়ে ধরেন তাদের। এ সময় তাদের কান্নায় আদালতের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। বাবা-মা এবং তাদের সন্তানদের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার এই দৃশ্য দেখে তখন আদালতে উপস্থিত সকলের চোখও জলে ভিজে ওঠে।
একপর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আবারো ওই শিশুদের সামনে ডেকে নেন। সঙ্গে বাবা মাকেও কাছে ডাকেন। দুজনকেই বলেন, সন্তানদের জন্য নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করতে। এ সময় আদালতে উপস্থিত উভয়পক্ষের আইনজীবীসহ শতাধিক আইনজীবী দাঁড়িয়ে সমস্বরে সন্তানদের বিষয়টি বাবা মাকে বিবেচনা করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে সন্তানদের চাওয়া অনুযায়ী তাদের দাম্পত্য জীবন যাতে বজায় থাকে এরকম একটি আদেশ দিতে আদালতের কাছে আর্জি জানান আইনজীবীরা। পরে আদালত ওই দুই শিশুর বাবা-মা এবং শিশু দুটির নানী ও ফুফুকে আদালতের কাছে ডেকে নেন। একে একে প্রত্যেকের বক্তব্য শুনেন আদালত। মধ্যাহ্ন বিরতির পর বিচারপতিরা তাদের খাস কামরায় ডেকে নিয়ে মেহেদী হাসান ও কামরুন্নাহার মল্লিকার বক্তব্য শুনেন। তাদের বক্তব্য শুনে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আদেশ দেন আদালত। আদেশে আদালত জানান, আগামী ৪ঠা জুলাই পর্যন্ত দুই শিশু সন্তান তাদের মা কামরুন্নাহার মল্লিকার হেফাজতে থাকবে। তবে, এই সময়ে বাবা শিশু দুটির দেখাশোনা করার অবারিত সুযোগ পাবে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ৪ঠা জুলাই দিন ধার্য করেন আদালত।
ওই দুই শিশু সন্তানের বাবা মেহেদী হাসানের আইনজীবী তাপস বল বলেন, ‘বাচ্চা দুটি বাবা মায়ের কাছে থাকতে চায় বলে আদালতকে যেভাবে জানিয়েছে তাতে আদালতে আজ (গতকাল) আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের কথা শুনে এবং তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে আদালত মনে করেছেন যে বাচ্চাদের সর্বোচ্চ স্বার্থ ও কল্যাণের কথা ভেবে বাবা মা আবারো একত্র হতে পারেন।’ কামরুন্নাহার মল্লিকার আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘বাচ্চা দুটি আদালতে বলেছে তারা বাবা মা কাউকে ছাড়তে চায় না। তাদের কাছেই থাকতে চায়। আদালত তাদের কথা শুনে এবং পুরো ব্যাপারটি বিবেচনা করে আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমরা বলেছি আদালত যেটি ভালো মনে করেন সেটিই করবেন।’ তিনি বলেন, আদালত আগামী ৪ঠা জুলাই পর্যন্ত বাচ্চা দুটিকে মায়ের কাছে রাখার আদেশ দিয়েছেন। তবে, এই সময়ে বাবাও তাদের দেখাশুনা করতে পারবেন। ওই দিন আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবেন।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status