বিশ্বজমিন

গোপন মার্কিন নথিতে তথ্য

১৯৭১: নিক্সনের রাজনৈতিক সমাধার চেষ্টা ব্যর্থ ভারতের কারণে

মানবজমিন ডেস্ক

২৫ জুন ২০১৮, সোমবার, ১১:১৯ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের বিরোধীতার বিষয়টি সুবিদিত। তবে কেন এই বিরোধীতা, তার একটি নতুন ব্যাখ্যা হাজির হয়েছে। সম্প্রতি অবমুক্ত হওয়া ওই সময়কার একটি গোপন মার্কিন নথির বরাতে ভারতের বার্তাসংস্থা পিটিআই লিখেছে, আমেরিকার বিরোধীতার কারণ ছিল ওই যুদ্ধের ফলে একটি ‘বাজে নজির’ সৃষ্টি হতে পারে। ছোট দেশগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে।
এতে বলা হয়, যুদ্ধের সময় একটি রাজনৈতিক সমাধানের ওপরও কাজ করছিল মার্কিন প্রশাসন। শরণার্থীদের প্রতি ত্রাণ সহায়তা ও পাকিস্তান যাতে একতরফা সৈন্য প্রত্যাহারে সম্মত হয়, সেটি নিশ্চিতের চেষ্টা করছিলেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। তবে ভারত নিজের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করায় তা সফল হয় নি।
যুদ্ধের অব্যবহিত কাল পরে যুক্তরাষ্ট্র সফররত জাপানি প্রধানমন্ত্রী এইসাকু সাতোর সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ায় হওয়া এক বৈঠকে এসব বলেন নিক্সন। তার প্রশাসনের বিরোধীতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘৬০ কোটি মানুষের একটি গণতান্ত্রিক দেশ ভারত ৬ কোটি জনসংখ্যার সামরিক শাসনাধীন দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। ভারত যত বড় বা গণতান্ত্রিকই হোক না কেন, দেশটি যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদে তার ছোট প্রতিবেশীকে গিলে ফেলে, তাহলে আশেপাশের অন্যান্য ছোট দেশের ভবিষ্যত হুমকিতে পড়বে।’
বৈঠকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি উল্লেখ করেন যে, সমসাময়িক অন্যান্য সংঘাত যেমন ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ভারত-পাকিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সম্পৃক্ততায় পার্থক্য ছিল। ইন্দো-পাক বিরোধে চীন-রাশিয়ার মতবিরোধ ছিল সবচেয়ে দৃষ্টিকটু। এই মতপার্থক্য কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মত দেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হবে বলে ধারণা করেন নিক্সন। তবে এটি বেশ দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। জাপান অবশ্য বাংলাদেশী শরণার্থীদেরকে মানবিক ত্রাণ প্রদানে সহায়তার ইচ্ছা প্রকাশ করে। নিক্সন মত দেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অবশ্য সময় প্রয়োজন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর মানবিক ত্রাণ সহায়তার প্রস্তাব সম্পর্কে ওই নথিতে বলা হয়, ‘এ বিষয়ে তার প্রশাসনের আগ্রহ থাকার বিষয়টি জানান প্রেসিডেন্ট। তবে তিনি এ-ও জানান, যুদ্ধ-সম্পৃক্ত কাজে ব্যবহার হতে পারে এমন ত্রাণ সহায়তা প্রদানের বিষয়ে কংগ্রেস রাজি নয়।’
জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত হয়ে নিক্সন বলেন, বাংলাদেশকে তৎক্ষণাৎ স্বীকৃতি দেওয়াটা পরিণত সিদ্ধান্ত হবে না। কারণ, বাংলাদেশ এমন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, যেটি টিকে থাকবে বলে নিশ্চয়তা দেওয়া যায়। পরিস্থিতি আরও খোলাসা না হলে আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না বলেও জানান নিক্সন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিরোধীতার কারণ ব্যাখ্যা করে নিক্সন বলেন, অ-কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের টিকে থাকার গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন। তবে একটি রাজনৈতিক মতপার্থক্য নিরসনে প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক পদক্ষেপের বিষয়টি তিনি সমর্থন করেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকারের দর্শন নিয়ে মতপার্থক্যগত কোনো কারণে নয়, বরং ভারতের এই পদক্ষেপ বাজে নজির স্থাপন করবে বলেই আমেরিকা এর বিরোধী।
তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে আরও বলেন, ‘আমরা এ কারণেই জাতিসংঘে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধীতা করেছিলাম।’ ভারতের তৎকালীন নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ‘নারী সরকার প্রধানরা সম্ভবত বিপজ্জনক হয়ে থাকেন। ভারত ও ইসরাইল দুই রাষ্ট্রই যুদ্ধে গেছে নারী সরকার প্রধানের নেতৃত্বে।’
জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার দেশ মনে করে ভারত যখন নিরপেক্ষ ছিল তখনই ভালো ছিল। এখন সোভিয়েত সমর্থন পেয়ে দেশটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিজেকে শক্তিশালী ভাবছে।
ওই বৈঠকে নিক্সন বলেন, সংঘাত নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের ওপর কাজ করেছিল মার্কিন প্রশাসন। এর মধ্যে শরণার্থীদের জন্য ৫০ কোটি ডলারের সাহায্য, একতরফা ভাবে যাতে পাকিস্তান সৈন্য প্রত্যাহার করে সেজন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে রাজি করানো অন্তর্ভূক্ত ছিল। তবে ভারত নিজের স্বার্থেই হস্তক্ষেপ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে বসে। একে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলা হয়। এ বিষয়ে নিক্সন বলেন, তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার একটি গবেষণা পর্যালোচনা করেছেন। এই গবেষণায় উঠে এসেছে ১৯৬৫ সালের পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে প্রায় ২০০ কোটি ডলার অর্থনৈতিক সাহায্য হিসেবে দিয়েছে। এই সময়ে ভারত প্রায় ৮০ কোটি ডলার দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সমরাস্ত্র কিনেছে। আর ১৭.৫ কোটি ডলারের সমরাস্ত্র নিজেরা প্রস্তুত করেছে।
নিক্সন বলেন, ‘এক হিসেবে, আমরাই ভারতের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে অর্থায়ন করেছি। অথচ, ওই সময়ে আমরা পাকিস্তানকে মাত্র ৫ কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছি। চীন থেকে দেশটি পেয়েছে ১০ কোটি ডলার। অর্থাৎ পাকিস্তানের অনুপাতে ভারতের সামরিক সামর্থ্য ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা ভীষণভাবে ভারতের পক্ষে গেছে।’
এ বিষয়টি তুলে ধরে নিক্সন আরও বলেন, ‘এ কারণে যখন এই অভিযোগ উঠে যে পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করেছে তা হাস্যকর ঠেকে। পাকিস্তান জানতো তারা হারবে। বাস্তবিক অর্থে সোভিয়েত সহায়তায় ভারতই পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ করেছে।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status