খেলা

গ্রাম থেকে শহর ফুটবল আবেগ সর্বত্র

মরিয়ম চম্পা

২৫ জুন ২০১৮, সোমবার, ১০:০৩ পূর্বাহ্ন

গ্রামের নাম কাজীর চর। ইউনিয়নটিতে প্রায় ৫ হাজার মানুষের বসবাস। এটাকে অনেকটা মডেল গ্রামও বলা চলে। ঢাকা থেকে বরিশাল তথা কাজীর চরের দূরত্ব ৩১২ কিলোমিটার। মাদকের করাল ছোবল থেকে গ্রামের যুবসমাজকে বাঁচাতে সম্প্রতি এলাকার তরুণ যুব সংঘ মিলে মেইন রাস্তা থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলোর ব্যবস্থা করেছে। ফলে এলাকায় চুরি ডাকাতির মতো ঘটনা যেমন হ্রাস পেয়েছে, একই সঙ্গে মাদকমুক্ত হয়েছে গোটা এলাকা। সভ্যতার আধুনিক ছোঁয়া থেকে পিছিয়ে নেই গ্রামটি। বরিশাল জেলার মুলাদী থানার কাজীর চর ইউনিয়নটি আর দশটি গ্রাম বাংলারই প্রতিচ্ছবি। এখানে ঘরে ঘরে শিক্ষার হার যেমন আশানুরূপ তেমনি স্যাটেলাইট থেকে শুরু করে ইন্টারনেট সংযোগ সবই এখন হাতের মুঠোয়। বাদ পড়েনি বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার উন্মাদনা থেকেও। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে নেই। তার পরও ফুটবল বিশ্বকাপের জ্বরে কাঁপছে গোটা বাংলাদেশ তথা কাজীর চর গ্রামবাসী। মুলাদী থানার সর্বত্রই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর জার্মানির পতাকায় ছেয়ে গেছে। উপজেলার কিছু কিছু বাড়িও রঙিন হয়েছে প্রিয় দলের পতাকার রঙে। সংঘর্ষ ও হাতাহাতির ঘটনা থেকেও পিছিয়ে নেই গ্রামটির ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। কাজীর চরের অধিকাংশ তরুণ আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। আবার একইভাবে পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ১

বিপুলসংখ্যক প্রবীণ ব্রাজিলের সাপোর্টারও রয়েছেন। মজার বিষয় হচ্ছে, রাঘুয়াকান্দির শেষ মাথায় একটি পরিবারের বাবা-মা আর্জেন্টিনা আর ছেলে-মেয়ে ব্রাজিলের সাপোর্টার। তবে এটা নিয়ে তাদের মাঝে কোনো মনোমালিন্য দেখা যায়নি। অনেকটা আপসের ঢং-এ তারা আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল দুটো পতাকাই টাঙিয়ে রেখেছে। এ বছর ঈদের আনন্দেও যেন রীতিমতো ভাগ বসিয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল। মুলাদী প্রপারের রারী বাড়িতে সদ্য জন্ম নেয়া টুইন (জমজ) বাচ্চা রাওনাফ-রাফা। আট মাস বয়সী এই জমজ ভাইবোনকে তাদের মেজো চাচা সাখাওয়াত হোসেন সোহেল আর্জেন্টিনার ঈদ জার্সি কিনে দিতে মোটেও ভুলেননি। রীতিমতো আর্জেন্টিনার জার্সি পরেই ওরা দুই ভাইবোন বাবা-কাকার সঙ্গে ঈদ গায়ে ও নানুবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। নিজের
মাকে ব্রাজিলের জার্সির সঙ্গে মিল রেখে ঈদের শাড়ি ব্লাউজ কিনে দিতে ভুলেননি একমাত্র ছেলে সোহাগ।
এদিকে বিশ্বকাপ ফুটবল এবং একই সঙ্গে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের উৎসবে মেতেছে বরিশালবাসী। সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের শুভেচ্ছা পোস্টারের সঙ্গে বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের পতাকায় ছেয়ে গেছে গোটা বরিশাল নগরী। দিনে কৌশলী নির্বাচনী প্রচারণা আর রাতে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা উপভোগের উৎসবে মেতেছে বরিশাল নগরীর পাড়া-মহল্লার বিভিন্ন বয়সের মানুষ। বড় পর্দায় খেলা দেখার সঙ্গে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা।
বিভিন্ন ওয়ার্ডের সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের পক্ষে সমর্থন বাড়াতে পাড়া-মহল্লায় বড় পর্দায় বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা উপভোগের জন্য কিনে দিচ্ছেন দামি প্রজেক্টর। নগরীর ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মেহেদী হাসান খান আবির। গত পাঁচ বছর ধরে সাধ্যমতো ওয়ার্ডবাসীর সেবা করেও আবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য এলাকার তরুণ ক্রীড়াপ্রেমীদের আবদার রক্ষায় প্রজেক্টর কেনার অনুদান দিয়েছেন তিনি। তবে এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। শুধু আবির একা নন, প্রজেক্টরের মাধ্যমে নগরীর কলেজ এভিনিউ এলাকায় বড় পর্দায় বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখার ব্যবস্থা করেছেন নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এস এম জাকির হোসেনসহ অনেকেই। বিশ্বকাপ ফুটবলের শুভেচ্ছা জানাতে ভুলেননি সহ-সম্পাদক বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের মিজানুর রহমান হাওলাদারও। এমনকি অনেক নতুন মুখের কাছ থেকে পাড়া-মহল্লার তরুণ ক্রীড়াপ্রেমীরা বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান নিয়েছেন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখার আয়োজন করার জন্য। পাড়া-মহল্লার ক্রীড়াপ্রেমীদের আবদার সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করেছেন সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
এটা তো গেল বরিশাল ও মুলাদী থানার ছোট্ট একটি গ্রাম কাজীর চর ইউনিয়নের গল্প। ঈদের দুই দিন পর কর্মস্থলে ফেরার পথে বরিশাল থেকে ঈগল পরিবহনে ঢাকাগামী কোচের টিকিট কিনতে গিয়ে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ দেখা গেছে। এক যাত্রী কাউন্টারে গিয়ে টিকিট চাইলে কাউন্টারের সুপারভাইজারের সাফ কথা যদি ব্রাজিলের সাপোর্টার হন তাহলে ভালো সিট তো পাবেনই সঙ্গে একশ টাকা ডিসকাউন্ট। আর আর্জেন্টিনার সাপোর্টার হলে কোনো টিকিটই দেয়া যাবে না। এটা নিয়ে কাউন্টারের ক্যাশিয়ার আর সুপারভাইজারের সঙ্গে যাত্রীদের হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। শেষে অবশ্য আর্জেন্টিনার সাপোর্টার যাত্রীকে টিকিট দেয়া হয় কোনো প্রকার ডিসকাউন্ট ছাড়াই। বাসে নববিবাহিত দম্পত্তির হাতে মেহেদির রং সেখানেও স্থান পেয়েছে স্বয়ং ফিফা বিশ্বকাপ। আরিচা ফেরি থেকে বাস নামার সময় একটি চায়ের দোকানে ব্রাজিলের পোস্টার ছিঁড়ে রামছাগলকে খাওয়ার ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে ভুলেননি অনেক আর্জেন্টিনার সমর্থক। রাত সাড়ে আটটার সময় সাভারের বিশমাইল গেটে নেমে দেখা গেল একই চিত্র। অটোরিকশায় উঠতে গিয়ে ব্রাজিলের পতাকা পত্‌্‌পত্‌ করে উড়তে দেখা গেছে মেইন গেটে। যাওয়ার পথে বিশমাইলের স্টাফ কোয়ার্টারের ছাদগুলোতে অন্ধকারের মধ্যেও শোভা পেতে দেখা গেছে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা। অটোরিকশা থেকে নেমে পানধোয়া বাজার অতিক্রম করতেই দেখা গেলো ব্রাজিল সমর্থক তরুণদের আনন্দ মিছিল। যেন এক টুকরো ব্রাজিল এসে নেমেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী মফস্বল শহর পানধোয়া বাজারে। আধো আলো আধো ছায়ায় ব্রাজিলের জার্সির হলুদ আলোর আভায় মুখরিত হয়েছে চার পাশ। মাত্র ২০ গজ পার হয়ে বাসায় ঢুকতেই দেখা গেল ছোট্ট টুটুল তার প্রিয় দল আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে খেলা দেখছে। বাসায় ঢুকতেই জানতে চাইলো কোন দলের সাপোর্টার। ছোট্ট টুটুলকে খুশি করতে বলা হলো আমি তোমার দলের সাপোর্টার। এটা শুনে টুটুলের আনন্দ যেন উপচে পড়ছিল। এদিকে বিপত্তিরও যেন কমতি ছিল না। বড় ভাই বাবলু আবার ব্রাজিলের সাপোর্টার হওয়ায় টুটুলের সমর্থনটা যেন ঠিক মেনে নিতে পারেনি।
রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর জার্মানির পতাকায় ছেয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, রাস্তার মোড়, বাড়ির ছাদ, বাসার ব্যালকনি, যানবাহন কিংবা অফিসে জনপ্রিয় ফুটবল দেশের পতাকা ওড়ানো দেখেই সেই উন্মাদনা আঁচ করা যায়। শহরের অধিকাংশ মোড়ে বাসাবাড়িতে, রিকশায়, বাসে কিংবা মোটরসাইকেলে পত্‌্‌পত্‌্‌ করে উড়ছে বিভিন্ন দেশের পতাকা। মিরপুরের কাজীপাড়ার ৬ নম্বর রোডের একটি বাড়ির ছাদে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকা ওড়ানোকে কেন্দ্র করে গত বুধবার দুই সমর্থকের মধ্যে বাধে বিপত্তি। আর্জেন্টিনার সমর্থক মো. দিদার আহম্মদ বাড়ির ছাদের পানির ট্যাংকির ওপরে বাঁশের সঙ্গে পতাকা উড়িয়েছিলেন। একই ছাদে ব্রাজিলের পতাকা টাঙানো ছিল ওই পতাকার নিচে। আর্জেন্টিনার পতাকা ওপরে দেখে ব্রাজিলের সমর্থক মোখলেসুর রহমান বৃহস্পতিবার ট্যাংকির ওপরে আবারও উঁচু করে পতাকা টাঙান। পাল্টাপাল্টি পতাকা টাঙানো নিয়ে তাদের দুজনের ভেতরে কথাকাটাকাটি হয়। পরে দুটি পতাকাই নামিয়ে দেন বাড়ির মালিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল, টিএসসি, হাকিম চত্বরসহ প্রতিটি আড্ডার পয়েন্টে একটাই আলোচনা কে হচ্ছে চ্যাম্পিয়ন! নিজ দলের সমর্থনে তাদের বাকবিতণ্ডার শেষ নেই।
এবার বিশ্বকাপ উপলক্ষে পতাকা বিক্রি করে ঈদের খরচ তুলে ফেলেছেন অনেক পতাকা বিক্রেতা ও হকার। সবচেয়ে বেশি পতাকা বিক্রি হয়েছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর জার্মানির। এছাড়া চাহিদা রয়েছে বিশ্বকাপ খেলুড়ে অন্যান্য কয়েকটি দেশের পতাকারও। পতাকার মতো জার্সিও বিক্রি হয়েছে প্রচুর। ঢাকা শহরে এবার ঈদের কেনাকাটার চেয়ে বিশ্বকাপে বিভিন্ন দেশের পতাকা আর জার্সি কেনায়ই তরুণরা বেশি আগ্রহী ছিলেন। গুলিস্তান, সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জে ছোট ছোট কারখানায় রাত-দিন ব্যস্ত জার্সি আর পতাকা বানাতে। এদিকে কেউ কেউ তাদের বাড়িটিই পছন্দের দলের পতাকার রঙয়ে রাঙিয়েছেন। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের ‘ব্রাজিল বাড়ি’ বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান করে নিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার লালপুর এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন ওরফে টুটুল তার প্রিয় দলের প্রতি ভালোবাসার নজির সৃষ্টি করতে নিজের ছয়তলা বাড়িটি ব্রাজিলের পতাকার রঙে রাঙিয়েছেন। শুধু বাড়িকে ব্রাজিলের পতাকায় সাজানোই নয়, বাড়ির নাম ফলকেও এই বাড়ির পরিচিতি এখন ‘ব্রাজিল বাড়ি’। তিনি এ বছর রাশিয়া গেছেন ব্রাজিলের খেলা দেখতে। ঢাকাতে আর্জেন্টিনার সমর্থকরাও কম যান না। নারায়ণগঞ্জেরই গলাচিপা এলাকায় মো. আউয়াল মিয়া তার নিজের বাড়ির রঙ করেছেন আজেন্টিনার পতাকার আদলে। এমনকি বাড়ির গাছেও আর্জেন্টিনার পতাকার রঙ মেখেছেন। বাড়িটি দেখতে প্রতিদিন আজেন্টিনাভক্ত সমর্থকরা বাড়ির সামনে ভিড় জামাচ্ছেন। এদিকে ঢাকার অদূরের কাঁচপুর ব্রিজ এলাকায় গাছের প্রিয় কাঁঠালেও আর্জেন্টিনার রং করতে যেন ভুলে যাননি সাপোর্টার আবু বকর ছিদ্দিক। দীর্ঘ পতাকা বানানোরও প্রতিযোগিতা চলছে। তবে সবচেয়ে বড় পতাকা বানানো হয়েছে জার্মানির। মাগুরার কৃষক আমজাদ হোসেন এবার সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ জার্মানির পতাকা বানিয়েছেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি এই পতাকা বানিয়ে আসছেন জার্মানিকে ভালোবেসে।
এদিকে বাংলাদেশে বিশ্বকাপের সময় প্রিয় বিদেশি ফুটবল দলের পতাকা টানানোর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিটও হয়েছে। রিটকারী মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ নুরুল আমিন আবেদনে বলেন, ‘ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের বাংলাদেশি সমর্থকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদেশি পতাকা উত্তোলন করেন। বিশেষত আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, জার্মানি ইত্যাদি দেশের বড় বড় পতাকায় সারা বাংলাদেশ ছেয়ে যায়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা বিধিমালা, ১৯৭২-এর বিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনৈতিক মিশনগুলো ছাড়া অন্য কোনো স্থানে অন্য রাষ্ট্রের পতাকা উত্তোলন করতে হলে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। সেই বিধান লঙ্ঘন করে ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালে নির্বিচারে দেশব্যাপী বিদেশি পতাকা উত্তোলন করা হয়। আশি-নব্বইয়ের দশকে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ছিলেন ব্রাজিলের পেলে। ব্রাজিলের ‘কালো মানিক’ তখন থেকেই এ দেশে পরিচিত নাম। এতে ব্রাজিলের প্রতি সমর্থনও বেড়ে যায়। আর আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয় ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মধ্যদিয়ে। দিয়েগো মারাদোনার জাদুতে ভুলে গিয়ে এক টুকরো আর্জেন্টিনার জন্ম নেয় বাংলাদেশের বুকে। ঠিক তখন থেকেই এ দেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল অভিজ্ঞরা। রাশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল মঞ্চের পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে শুরু হয়ে গেছে ফুটবল উন্মাদনা। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম সর্বত্রই ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বকাপ জ্বরের উত্তাপ। দেশের কোটি কোটি ফুটবল ভক্ত নাচছেন উন্মাদনায়। খেলছে ৩২টি দল। সারা দেশের ফুটবলপ্রেমীরা পছন্দের দলের সমর্থনে গাছের ডালে ঘরের ছাদে পতাকা উড়িয়েছেন।
‘ক্রিকেটে’ সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও ফুটবলে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। বিশ্ব ফুটবলে পেছনের সারিতে থাকলেও ‘সমজদার দর্শক’ হিসেবে বাংলাদেশিদের অবস্থান সামনের কাতারে। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর তুলনায় তৃতীয় বিশ্বের এই বাংলাদেশে বিশ্বকাপ উত্তেজনা বেশি। জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগালের হাজারো সমর্থক থাকলেও কালো মানিকখ্যাত পেলের দেশ ব্রাজিল এবং দিয়াগো ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে চলছে অন্যরকম উত্তেজনা। আপনি, তুমি, তুই! ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা এই প্রশ্ন এখন সর্বত্রই। বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সহকর্মী, সহশিক্ষার্থী, পরিচিত-অপরিচিত যাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করছেন আপনি ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা? নিজের সমর্থনের সঙ্গে মিলে গেলে পাওয়া যায় বাড়তি আদর-আপ্যায়ন। খেলা শুরুর আগ থেকেই খেলা নিয়ে শুরু হয়েছে যুক্তি-তর্ক-বিতর্ক আর গল্প? কে সেরা? আর্জেন্টিনা, না কি ব্রাজিল? স্পেন না জার্মানি? পর্তুগাল না স্বাগতিক রাশিয়া? মেসি, রোনালদো, নেইমারের ছবিসংলিত গেঞ্জি গায়ে মিটিং মিছিল ও শো-ডাউন হচ্ছে। অবাক বিষ্ময়ে কেউ উচ্চারণ করছেন ‘আহা এবার ইতালি নেই!’ জমে উঠেছে যুক্তি-তর্ক আর গল্প? এরশাদের শাসনামলে মূলত ঢাকার ক্লাব মহামেডান ও আবাহনী দেশের দর্শকদের কাছে ফুটবল জনপ্রিয় করে তোলে। সে সময় বিদেশ থেকে খেলোয়াড় এনে দেশের দুই বড় ক্লাব হৈচৈ পড়ে যেত। দুই ক্লাবের খেলা মানে বাড়তি উত্তেজনা; দেশের দর্শকরা আবাহনী আর মহামেডান দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। সে সময় ১৯৮৬ সালে প্রথম বিটিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা সরাসরি প্রচার করা হয়। জার্মানি, স্পেন ও ফ্রান্স, ইতালি তখনো ভালো খেললেও ওই সব দেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো ‘তারকা’ খেলোয়াড় ছিল না। মূলত ছিয়াশি ও নব্বইয়ের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার ‘ফুটবল জাদু’ বাংলাদেশের দর্শকদের আর্জেন্টিনার সমর্থনে উদ্বুদ্ধ করে। তখন থেকে ম্যারাডোনার সমর্থকরাই ‘আর্জেন্টিনা’কে সমর্থন দিয়ে আসছে। এরপরে বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিলের রাজত্ব।
দেশটি ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ বিজয়ী হয় শক্তিশালী ইটালিকে পরাজিত করে। ১৯৯৮ সালে ফাইনালে উঠে স্বাগতিক ফ্রান্সের কাছে হেরে গেলেও ২০০২ সালে আবারো বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল। বিটিভিতে সরাসরি বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা প্রচারের পর থেকে টানা ৫টি বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ‘দাপুটে খেলা’ দুই দলের পক্ষ্যে বাংলাদেশে তৈরি হয় সমর্থক গোষ্ঠী। বাংলাদেশে ব্রাজিল সমর্থকদের ফুটবল উন্মাদনা দেখতে এসেছেন দেশটির তিন সাংবাদিক। তারা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন শহর-জেলায়। সফরের মাঝপথে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তারা বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে। এক সংবাদ সম্মেলনে ব্রাজিলের জাতীয় টিভি গ্লোবো’র ওই তিন সাংবাদিক বলেন- আমরা পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি। কিন্তু ব্রাজিলের এত বিপুল সমর্থন আর কোথাও দেখিনি। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্রাজিলের প্রতি মানুষের এত সমর্থন আর উন্মাদনা দেখে মনেই হয়নি আমরা ভিন দেশে আছি। সংবাদ সম্মেলনে ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জানান, বিশ্বকাপের পরপরই তার দেশের কিংবদন্তি ফুটবলার জিকো বাংলাদেশ সফরে আসবেন। বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নে ব্রাজিল কী সহযোগিতা দিতে পারে- তা নিয়ে ওই সফরে আলোচনা হবে। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলছে না। তার পরও কেন এই উন্মাদনা? র‌্যাকিংয়ে বিশ্বের ২১১টি দেশের মধ্যে ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯৪। তাই বিশ্বের যেখানেই ফুটবল খেলা হোক, তা নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাকে। আমরা স্বপ্ন দেখি, একদিন বাংলাদেশও বিশ্বকাপে খেলবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status