শেষের পাতা

ভিক্ষাবৃত্তিতেও প্রতারণা

মহিউদ্দিন অদুল

২৫ জুন ২০১৮, সোমবার, ১০:০১ পূর্বাহ্ন

পায়ের সঙ্গে পা পেঁচানো। পায়ের পাতা ও আঙুল অদ্ভুতভাবে বাঁকানো। কোনোটা টান টান করে রাখা। হাতের আঙুলগুলো এলোমেলোভাবে বাঁকানো। হামাগুড়ি দিয়ে চলছে। কখনো দুই হাতে ভর করে অচল নিম্নাঙ্গ চালিয়ে নিয়ে হাত পাতছে পথচারী কিংবা যাত্রীদের সামনে। প্রথম দেখাতেই দয়ায় মন গলছে সবার। দুই-পাঁচ-দশ-বিশ টাকা ছুঁড়ে দিচ্ছে। তা পকেটে নিতেও অক্ষমতার ভান। কিন্তু এসবই তার ছদ্মবেশ। এমন অচল ভিক্ষুকের ছদ্মবেশ নিয়ে হৃদয়গ্রাহী সুর ও বিলাপে রাজধানীর রাস্তায় ভিক্ষা করছে এক প্রতারক। প্রতারণার টাকায় চলছে নেশা। সম্পদ গড়া। মানবজমিনের অনুসন্ধানে জানা গেল ওই যুবকের নাম কাজল। চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন এমন প্রতারণার পর এখন রাজধানী ঢাকায় মেতেছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। ব্যস্ততম সড়ক ও মোড়ে প্রতিদিন এমন ছদ্মবেশী প্রতিবন্ধীর কসরত ও অভিনয় করে পকেট কাটছে এক সময় যাত্রাপালার সদস্য এই যুবক।
গত ৭ই মে দুপুর। বাংলা মোটর মোড়। যাত্রীতে ঠাঁসা একটি বাস আটকা পড়ে যানজটে। হাতে ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে ওই বাসে ওঠে কাজল। এরপর টানা সুর করে ভিক্ষা চাওয়া। যাত্রীদের দানের টাকা নিতে নিতে বাসের ভেতরের দিকে এগুতে থাকে। তাকে দেখেই যাত্রীরা টাকা দিতে থাকে। তার হাত-পা অতিরিক্ত বাঁকানো থাকায় অনেকের কাছে অস্বাভাবিক লাগে। এক যাত্রী তাকে চ্যালেঞ্জ করতেই চমকে ওঠে। ‘তুমি তো প্রতিবন্ধী না, অভিনয় করছো,’ এমন কথা বলতেই সে ক্ষেপে যায়। এরপর একনাগাড়ে গালি দিতে দিতে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। নামতেই বেরিয়ে আসে তার ছদ্মবেশ। শরীর পেঁচিয়ে বসে নেই। সোজা দাঁড়িয়ে। যাত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে ‘তুকে মেরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিব’। নাম গাড়ি থেকে। কাইট্টা টুকরা টুকরা করমু।’ ততক্ষণে যানজট কমে গেলে গাড়িও চলা শুরু করে।
২৩শে মে রাত। রাজধানীর ফার্মগেট মোড়। একইভাবে প্রতিবন্ধীর ভান করে অপর একটি বাসে উঠে। তার ভিক্ষা চাওয়ার সুরেলা আওয়াজ কানে আসতেই মোবাইলের ক্যামেরা অন করা হয়। ভিডিও অন করার দৃশ্য চোখে পড়তেই সে থমকে যায়। থামে বুকের হামাগুড়ি। দ্রুত ফিরে যেতে উদ্বত হয়। গাড়ি থেকে নামতে শুরু করে। তাকে থামতে বললেই সে উল্টো হুমকি দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে বলে।
সর্বশেষ গত ২রা জুন। দুপুর। ফার্মগেট সংলগ্ন পার্ক। পার্কে ঢুকতে তার সঙ্গে দেখা। সঙ্গে আরো ৭ ঘনিষ্ঠজন। আড্ডায় মাতোয়ারা। কিন্তু পেঁচানো-বাঁকানো নয়। চাটাইয়ে বসা। কাছে এগুতেই তারা মারমুখো। দিনদুপুরে মোবাইল কেড়ে নেয়ার জন্য তেড়ে আসে। পরে বোঝা গেলো সে চিনতে পারেনি। মনে নেই আগের দু’ঘটনা। কাছে গিয়ে একথা সেকথা বলে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি। এক ফাঁকে টিপ্পনি কেটে প্রতিবন্ধী কিনা জানতে চাইলে সে হাসিতে ফেটে পড়ে। বলে ‘কিসের প্রতিবন্ধী’। দাঁড়াতে পারেন কিনা জানতে চাইলে বলে ‘এই লোক কয় কী?’ হাঁটতে পারেন কিনা জানতে চাইলে বলে, ‘দৌড়ে আমার সঙ্গে পারবেন?’ এ কথা সে কথায় তাকে প্ররোচিত করলে সে যে প্রতিবন্ধী নয় তা প্রমাণ করতে এক পর্যায়ে দেয় দৌড়।’ এক দৌড়ে পার্কের বেশ কিছু অংশ ঘুরে আসে। ওই সুযোগে ছবি ও ভিডিও চিত্র ধারণ করা হয়। সঙ্গে থাকা আরো ৭ যুবক তার মতো এত তুখোড় নয়। নয় ছদ্মবেশী প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকও। তবে মাদকসেবনের সহযোগী। তাদের মাদকের টাকা যোগাতে উদার দেখা গেছে। রোজা হলেও তারা মাদক সেবনে ব্যস্ত। নিজেকে ইমন পরিচয় দিয়ে ওই দলের এক কিশোর তার সম্পর্কে দু-একটা কথা বলে। এতে উৎসাহিত হয় সে নিজেও। বলে তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ। দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে কাটিয়েছে। কালুরঘাটের ওয়ারলেস এলাকায় সে একইভাবে লোক ঠকিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি চালায়। দু-একটি কথা বললেও নিজের কুকর্ম লুকাতে ব্যস্ত। ইমন জানায়, তার নাম কাজল। সে ও তার স্ত্রী চাচার দলে যাত্রাপালা করতো। সেখানে এক দুর্ঘটনায় তার বাম পায়ে আঘাত পায়। সেই থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হয়। তবে হাঁটাচলা বা দৌড়ঝাঁপ করতে পারে। কিন্তু সেই দুর্ঘটনার আঘাতকে পুঁজি করেই সে এখন রাজধানীতে লোক ঠকিয়ে প্রতারণার ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status