এক্সক্লুসিভ

আর্জেন্টিনার হার, ঢাকায় হতাশা, কান্না

মারুফ কিবরিয়া, মরিয়ম চম্পা ও পিয়াস সরকার

২৩ জুন ২০১৮, শনিবার, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

রাত জেগে বড় পর্দায় বিশ্বকাপ উপভোগ করছেন ফুটবলপ্রেমীরা। ছবিটি পুরান ঢাকা থেকে তোলা -ছবি: নাসির উদ্দিন

হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব। গভীর রাত। তবুও জেগে ছিল বাংলাদেশ। আশায় বুক বেঁধে ছিলেন আর্জেন্টিনার লাখ লাখ সমর্থক। আরো একবার তাদের হৃদয় ভেঙেছে। প্রিয় তারকাদের ব্যর্থতায় ভেঙে পড়েছেন তারাও। আর্জেন্টিনার বাংলাদেশি সমর্থকদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেছেন হতাশা আর ক্ষোভের কথা। ফার্মগেটের নিবেদিকা ছাত্রী হোস্টেলের বাসিন্দা মৌরি, তানিয়া, সানজিদা, নেহা, তামান্না ও রেখা বলেন, আর্জেন্টিনার গতকালের খেলা কোনো খেলাই ছিল না। ভাবতে লজ্জা হয়, প্রিয় মেসির এই পতন তথা গোটা আর্জেন্টিনার পতন দেখার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। মৌরিতো গতকাল রাত থেকে কিছুই খায়নি। তানিয়া আর সানজিদা দ্বিতীয় গোল হওয়ার পরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওদের সামাল দিতে গিয়ে নিজেও নার্ভাস হয়ে পড়েছেন বলে জানায় নেহা। রেখা বলেন, গতকালকের খেলায় শুরু থেকেই দলের ছন্দপতন, মেসিসহ গোটা দলের প্লেয়ারদের নার্ভাসনেস, গোলকিপারের অদক্ষতাই মূলত মেসি তথা আর্জেন্টিনাকে আজ খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করেছে। অনেক আশা ছিল পরবর্তী বিশ্বকাপে মেসি অংশ নিতে না পারলেও এই বিশ্বকাপে মেসি তার কারিশমা দেখাবে। কিন্তু হায় এ-কি কারশিমা দেখালো মেসি। তুমি ভাই ভালোয় ভালোয় অবসরে চলে যাও।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুসফিক শুভ, রনি, সানি, সোনি, আরিয়ান, তানহা, সামিয়া বলেন, আমরা এখনো বলছি আর্জেন্টিনাই শ্রেষ্ঠ দল। মেসির তুলনা কেবলই মেসি। জয় পরাজয় খেলার মাঠেই হয়, অন্দরমহলে নয়। তাই বলে অযাচিত কোনো দলের সঙ্গে আর্জেন্টিনাকে তুলনা করা যাবে না। হাতি মরলেও লাখ টাকা বাঁচলেও লাখ টাকা। ব্রাজিলের মতো দেশ গত বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে যেখানে ৭টা গোল খেয়েছিল সেখানে ক্রোশিয়ার কাছে আর্জেন্টিনার মাত্র তিনটা গোল কোনো ব্যাপারই নয়। জয়তু আর্জেন্টিনা-জয়তু মেসি। হারলেও মেসি-জিতলেও মেসি। তানহা একটু বেসুরোভাবে বললেন, আমি কোনোভাবেই গতকালের ম্যাচে মেসিদের এভাবে হেরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছি না। তবে এ বিষয়টাও আমাদের মনে রাখা উচিত মেসির একার পক্ষে গোটা দলকে সামলানো সম্ভব ছিল না। দলের স্ট্রাইকার হিসেবে মেসিকে বল পাস করার মতো যোগ্য কোনো খেলোয়াড় গতকাল চোখে পরেনি। আর নির্বোধ গোলকিপারের কথা না হয় বাদই দিলাম। তানহাকে থামিয়ে দিয়ে আরিয়ান বললো, আরে গতকালতো ক্রোয়শিয়াকে একেবারে মুখে তুলে গোল দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে আর্জেন্টিনা। সামিয়া বলেন, মেসিকে মাঠ থেকে মাথা নিচু করে একবুক হতাশা নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা এখনো ভুলতে পারছি না। ইস ওদের দলগত বন্ডিং আর খেলোয়াড়দের সমতা যদি ঠিক থাকতো তাহলে এই ভরাডুবিটা দেখতে হতো না।
সংবাদকর্মী এমএ রাশেদ তালুকদার বলেন, প্রচণ্ড গরমের তাপদাহেও আর্জেন্টিনার এই ঐতিহাসিক পরাজয়ে গোটা ঢাকা শহর ঠাণ্ডা এবং সেই সঙ্গে যেন বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাও ঠাণ্ডায় জমে গেছে। হায় লিও মেসি কি খেল দেখালে তোমরা! আলি ইব্রাহিম বলেন, আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র, ক্রোশিয়ার সঙ্গে তিন গোলে হার। এর পরেও কি বলা যায় এরা আর্জেন্টিনা। তবুও বলছি কারণ ওদের বাপ চাচারা ভালো খেলেছিল। এরপর যদি এরা পরের রাউন্ডে যায় তবে বিশ্ব কাপের মজাই নষ্ট হয়ে যাবে। রাশিয়া বিশ্বকাপ যারা ভালো খেলবে তারাই জিতবে। এখনো বার্সা-রিয়ালের মতো দামিদের খাওন নাই। বাবারা বাড়ি যাও। নাকে তেল দিয়া ঘুমাও। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত হও। মিরপুরের খাদিজা ফাল্গুনি বলেন, আর্জেন্টিনা দলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় তিন ক্যারেক্টার। আমি বংশ পরম্পরায় ব্রাজিলের সাপোর্টার। তবুও মেসির জন্য ভালোবাসা। আর্জেন্টিনার কোনো যোগ্যতাই নেই তারে খেলানোর। খামোখা ডেকে এনে প্রতিবার একটা বেইজ্জতির মাঝে ফেলে। কোনো মানে হয়? নাট্য নির্মাতা জামিল আসরাফ খান নয়ন বলেন, এইবার মেসি যে ভেলকি দেখাইলো তাতে চট্টগ্রামে নেমেই একটা ব্রাজিলের জার্সি গায়ে দিয়ে শহরে ঢুকতে হবে। আর্জেন্টিনা আর মানইজ্জত বলে কিছু রাখলো না। এমন ক্ষণস্থায়ী ফ্যানদের জন্য ব্রাজিলের দরজা সবসময় খোলা। আসেন আসেন বইসা যান!
লেখক ও নির্মাতা রেজা ঘটক বলেন, আর্জেন্টিনার সমর্থকদের আগামী এক সপ্তাহ ঘর থেকে বের হওয়া ঠিক হবে না। বলাতো যায় না, কে কখন পঁচা ডিম ফিকা মারে। বেসরকারি চাকরিজীবী ডি রফিক ঢালি বলেন, ভুয়া ওরা ভুয়া। আর্জেন্টিনা হারার কারণে আমরা ব্রাজিলের সমর্থকরা মর্মাহত ও তিন দিনের শোক পালন করার ঘোষণা দিয়েছি। এরকম করুণ হার আমরা কখনোও আশা করিনি। তাই সব আর্জেন্টাইন সাপোর্টারকে বলছি শোককে শক্তিতে রূপান্তর করো বন্ধু। রাজাবাজার চায়ের আড্ডায় মহিন, মিজান, রাশেদ, জামাল, তুহিন, মুহিন, দোকানদার সাইফুল সবাই আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। মিজান বলেন, এই বিশ্বকাপে আমার অবজারভেশন বেশিরভাগই ভালো খেলছে। আর্জেন্টিনা সাপোর্টের শুরুটার মুল কারণও আমার জানামতে তাই ছিল। অন্য দলগুলো এখন ভালো করা সত্ত্বেও জাতি ব্রাজিল আর্জেন্টিনা যেমনটা আওয়ামী লীগ বিএনপির বাইরে যেতে পারছে না কেন? এখানে কি জন্মসূত্রে পছন্দ করার জিনগত কোনো ব্যাপার কাজ করছে। যদি তাই হয় তা হলে দলের ভালোতে যেমন সাপোর্ট করা উচিত আবার দুর্দিনেও পাশে থাকাটাই একজন বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে। জামাল ও তুহিন বলেন, ডান-বাম দুটোই যদি সমানে সমান হয় তাহলে সহাবস্থান কেমনে হবে। মুহিন বলেন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি বিশ্বসেরা এই তিন ফুটবল পরাশক্তির একটা দলও কী এবার তাদের সেরা খেলাটা দিতে পেরেছে? বিশ্বব্যাপী তাদের যত ভক্ত আছে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী? পারেনি। বরং প্রথমবারের মতো খেলতে আসা অনেক দলও দারুণ খেলছে। কাজেই বড় দলগুলোর উচিত তাদের কাছে শিক্ষা নেয়া। বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফয়সাল ইসলাম বলেন, মেসির ভক্তরা এখন কই গেছে? আহাম্মকের দল মেসিরে এমন করার লাইগা উইঠ্যা পইরা লাগছিল। রিতিমত কান্নাকাটি করছিল। এবারো না খেললেই ভালো হতো। অপমান খালি মেসির। আর বাকিরা গ্যালারি আর টেলিভিশনের পর্দায় গলা ফাটিয়েই দায় শেষ।
স্ট্যামফোর্ডের সাবেক শিক্ষার্থী কাজী বাধন বলেন, সমাজে কয়েকজন ভদ্র ব্রাজিল সাপোর্টারের জন্য একজন আর্জেন্টাইন সাপোর্টারই যথেষ্ট। জোর করে সেভেন আপ খাইয়া ঝগড়া করে জিতে কী লাভ? বেসরকারি চাকরিজীবী পায়েল আলম বলেন, আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ নিবে তাই না? এর বদলে বিশ্বপিরিচ নিয়ে থ্রিপিছ পরে আগেই বিদায় নিল যে,,, এখনতো ৩২ থেকে ৩৬ এ পা দিলো। আর কতো মামা। কমরেড সুদেভ চক্রবর্তী বলেন, আর্জেন্টিনার কল্যাণে বাপের জন্মে সেরা বাজে ফুটবল খেলা দেখার দুর্ভাগ্য হলো গতকাল। এদিকে সেনাপতি মেসি বলই পায় না। ডিফেন্ডাররা প্রমাণ করলো বিশ্বের মধ্যে তারা সর্বনিম্ন। আর গোলকিপার সম্ভবত গাঁজা খেয়ে মাঠে নেমেছিল। কোচ সাম্পাওলি মারিয়া প্রমাণ করলেন তিনি অযোগ্য কোচ ছাড়া আর কিছুই না। আর্জেন্টিনা এবার ফেবারিট ছিল না। এটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে ওরা যে খেলতেই পারে না সেটা কি করে মানবো। হা হা, আর্জেন্টাইন সাপোর্টারদের অনেক কিছুই মানতে হয়। ক্রিস্টোপার লেভি বলেন, জীবনে প্রথম প্রেম করা আর আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করা একই কথা। দুটাতেই না পাওয়ার বেদনা আর আফসোস থেকে যায়। যাই হোক আর্জেন্টিনার জন্য শুভকামনা।
এ্যালিফ্যান্ট রোডে ডিউটিরত পুলিশ কর্মকর্তা ওবায়দুর বলেন, কালকের খেলার কথা আর কি বলবো। মনটা ভীষণ খারাপ। কালকের ওইটারে খেলা বলে। কালকে ওটা কোনো খেলা ছিল না। আর্জেন্টিনা বিশেষ করে মেসির পারফরমেন্স মেনে নেয়ার মতো নয়। পাশেই ফুটপাতের ফলের দোকানদার মোখলেস বলেন, আরে দেশে কোনো আর্জেন্টিনা বলে কথা নাই। কিসের আর্জেন্টিনা। সবাই একসময় ব্রাজিল হয়ে যাবে। আমিতো গতকাল রাতেই আর্জেন্টিনাকে তালাক দিয়েছি। বিটিভির সিনিয়র সাংবাদিক আফরিন জাহান বলেন, এটা শুধু মেসির একার ভুল ছিল না। একটা দলে ১১ জন প্লেয়ার থাকে। যখন আমরা শুধু একজনের উপর পুরো এক্সপেক্টেশনটা চাপিয়ে দেই তখন তার উপর আলাদা একটা প্রেশার পরে। এই প্রেশারের কারণে অনেক সময় প্লেয়ার বা স্ট্রাইকার ঠিক আউটপুট দিতে পারে না। এর আগের ওয়ার্ল্ড কাপে আর্জেন্টিনা দলে সবসময় মিনিমাম ৫-৬ জন কোয়ালিফাইড প্লেয়ার থাকতে দেখেছি। কিন্তু এই টিমটাতে আসলে মেসিই একা স্টার। দলে অন্য কোনো স্টার নাই যে মেসিকে সাপোর্ট দিবে। অন্য সব দলে ডিফেন্ডারের সংখ্যা বেশি থাকে যেটা স্ট্রাইকারকে বল পাস বা গোল দিতে হেল্প করে এক্ষেত্রে মেসিকে বাদ দিলে তেমন কোনো উল্লেখ্যযোগ্য প্লেয়ারই দেখছি না। ফলে যে চাপটা সৃষ্টি হয়েছে সেটা সামলাতে না পেরেই আর্জেন্টিনা শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছে। প্রতি চার বছর পর পর যেহেতু খেলা হয় সেক্ষেত্রে ব্রাজিল যেমন খুব ভালো প্লেয়ার বেছে নিয়ে আসে একইভাবে জার্মানিও। এই বিষয়টা আর্জেন্টিনাকেও ফলো করতে হবে। তাহলে তারা ভবিষ্যতে আরো ভালো করবে।
হোম ইকোনোমিক্সের শিক্ষার্থী মোহনা, সালমা, জাহনারা, প্রিতি, আশা, মহুয়া বলেন, আমাদের কাছে শুরু থেকেই পুরো সিস্টেমটাই মনে হয়েছে এলোমেলো। খেলার যে একটা ব্যাপার আছে অর্থাৎ গুছিয়ে খেলা, প্ল্যানিং করে খেলা এগুলোর অভাব ছিল। আর মেসিতো শুরু থেকেই নার্ভাস ছিল। প্রথম গোলটাও কিন্তু নার্ভাসনেসের মধ্যে দিয়ে হয়েছে। পরবর্তীতে তারা আর নিজেদেরকে প্রটেক্ট করতে পারেনি। ফলে একের পর এক গোল করেছে ক্রোশিয়া। একসময় খেলার প্রতি মেসির যে একট উত্তাপ ছিল সেটা গতকাল চোখে পড়েনি। গতকাল আমরা ভিন্ন এক মেসিকে দেখেছি। যার চোখে, মুখে, পায়ে সর্বত্রই ভয় দেখা গেছে। আমাকে বা আমার দলকে জেতাতে হবে এমনটা মেসির ভেতর দেখা যায়নি। আর গোলকিপারতো নিঃসন্দেহে খুবই বাজে ছিল। যার ফলে প্রতিপক্ষ ক্রোশিয়া ইজিলি একের পর এক গোল দিচ্ছিল। কেননা গোলকিপার চাইলেই গোলগুলোকে ইজিলিই ঠেকাতে পারতো।
ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী পপি রায়, মেহরুণ, শাকিলা, স্বর্ণা, সোফিয়া, আঞ্জুম, আখিমনি ও সাথি বলেন, আর্জেন্টিনাকে ভালোবাসি মেসির জন্য। গতকাল মেসির পারফরমেন্স আমাদের একদমই ভালোলাগেনি। মেসিদের এভাবে হেরে যাওয়াটা মেনে নেয়া যায় না। পরের রাউন্ডে নাইজেরিয়ার সঙ্গে ম্যাচে কতটা ওভারকাম করতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। মেসি আরো ভালো খেলতে পারতো। ও একাই হয়তো পুরো দলকে এগিয়ে নিতে পারে কিন্তু একা মেসির উপর নির্ভর না করে সমগ্র দলকে ভালোভাবে ট্রেনআপ করে সবাইকে যোগ্য করে তুলতে পারলে আর্জেন্টিনা হয়তো তাদের স্বরূপে ফিরে যেতে পারবে। পপি রায় বলেন, এক্ষেত্রে দলের ভেতর কৌশলটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্ট্রাইকারকে বল পাস করতে না পারলে পরাজয় অনেকাংশে নিশ্চিত হয়ে যায়। একা একা কেউ ভালো করতে পারে না-দলের ১১ জনকেই প্রশিক্ষিত হতে হবে। ইডেনের হাসনা হেনা হোস্টেলের সিকিউরিটি গার্ড মুজিবুর রহমান বলেন, এমনিতেই খুব মন খারাপ লাগছে। তার উপর চিন্তা হচ্ছে সামনে নাইজেরিয়ার সঙ্গে মেসি কেমন খেলবে এটা ভেবে। গতকাল খেলার প্রতি মেসির মনোযোগটা কম দেখা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী চয়ন রায়, অমিত হোসেন, তাপস পাল, রায়হান, শ্যামল, বুলবুল, মুসফিকুর রহমান বলেন, গত পাঁচ ম্যাচ ধরেই আর্জেন্টিনার গোলকিপার খুবই খারাপ খেলছে। তাছাড়া মেসি গতকালকের খেলায় ভালোভাবে ক্লিক বা নক করতে পারেনি। এছাড়া দলের রক্ষণভাগটা একটু দুর্বল ছিল। খেলার মধ্যে সমন্বয়ের ব্যাপারটা ছিল না। ডিফেন্স তিন জনের জায়গায় আরো ভালো ও যোগ্য ডিফেন্স বারানো গেলে তাহলেই তাদের ওভারকাম করা সম্ভব। ১১ জন খেলোয়াড় সবাই যদি ব্যালেন্স করে ভালো না খেলে তাহলে একা মেসি বা তারকা স্ট্রাইকারের পক্ষে দলকে সামনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জগন্নাথ হলের গার্ড কার্তিক সাহা বলেন, দলের প্রথম পাসটাই ভুল ছিল। একটা ভুল পাসের জন্য প্রথম গোলটা হয় এবং ক্রমান্বয়ে ভুলের কারণে বাকি গোলগুলো হজম করতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। কাজেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে আগাতে হবে। তবে মেসির জন্য কষ্ট হয়। কারণ আগামী ওয়ার্ল্ড কাপে হয়তো মেসিকে আর নাও পেতে পারি। নীলখেতের মায়ের বাধন তেহারি ঘরের স্টাফ খালেদ বলেন, মেসি জিতলেও আছি, হারলেও আছি। গতকাল আমার দল হারলেও ভালো লেগেছে। কোনো হাতাশা নেই সামনে ওরা ভালো করবে এটাই প্রত্যাশা। টিএসটিতে পান বিক্রেতা সঞ্চিত কুমার দে বলেন, মারাডোনার সময় থেকে আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করি। কোচের সিদ্ধান্তের কারণে খেলায় মেসিদের হারতে হয়েছে। ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্তে খেললে এটা হতো না। তারপরেও বলব প্রাণের দল আর্জেন্টিনা ভবিষ্যতে ৪-৫ বার হারলেও এই টিমকেই সাপোর্ট করবো।
খেলা শেষ হওয়ার পর পর রাতভর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে হৈচৈ পড়ে। বিশেষ করে ফেসবুকে প্রিয় দল হেরে যাওয়ায় কষ্টের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেছেন অনেক আর্জেন্টাইন ভক্ত। এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। টিভি সেটের সামনে বসে দেখা অনেক দর্শকের ঘুমও হয়নি সারারাত। কেউ কেউ কষ্টে চোখের জলে ভাসিয়েছেন। আবার কেউ মেসিদের জাদুকরী পারফরম্যান্স না দেখতে পেয়ে পাথর হয়ে গেছেন। এমন ভক্তের সংখ্যাও কম নয়। খেলা শেষে রাত ২টার দিকে উত্তর বাড্ডার তেঁতুলতলা রোডে বসেছিলেন তিন বন্ধু সীমান্ত, আসিফ ও ফয়সাল। তিনজনই পড়াশোনা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের আয়োজনেই আর্জেন্টিনার খেলা দেখার জন্য প্রজেক্টরের মাধ্যমে বড় পর্দার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু প্রিয় দলের হতাশা যেন ওই সময়টিতে কিছুতেই মানতে পারছিলেন না তারা। সীমান্ত জানান, এ বছর সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা ছিল আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দেখবো বলে। কিন্তু সেই দল প্রথম ম্যাচের চেয়েও জঘন্য পারফরম করলো! এই বিশ্বকাপের জন্য কত কি না করেছি আমরা। বড় পতাকার ব্যবস্থা করেছি। প্রজেক্টর দিয়ে এলাকাবাসীর জন্য খেলা দেখার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু কিছুই হলো না। সব আশা শেষ। খেলায় মেসির পারফরম নিয়ে বেশি হতাশ তার আরেক বন্ধু আসিফ। আর্জেন্টিনা দলের চেয়েও বেশি পছন্দ করেন মেসিকে। কিন্তু সেই মেসির কোনো অবদান না দেখতে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই যুবক। একপর্যায়ে তিনি বলেন, মেসিকে আমি এত বেশি পছন্দ করি যা বলে বোঝানো সম্ভব না। কিন্তু সবশেষ দুই ম্যাচে সে মেসি) কী দেখালো আমাদের? একটি গোল আমাদের উপহার দিতে পারেনি। ভেবেছিলাম দ্বিতীয় রাউন্ডে হলেও যাবে আর্জেন্টিনা। কিন্তু এভাবে হতাশ হতে হবে ভাবতেই পারিনি। ফয়সাল ফুটবলের পোকা। দেখার পাশাপাশি প্রায় খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাড্ডা জাগরণী ক্লাবের হয়ে একসময় খেলতেনও তিনি। প্রিয় দল আর্জেন্টিনার হেরে যাওয়াটা যেন স্বাভাবিকভাবে নিতেই পারছেন না। ফয়সাল বলেন, বিশ্বের শক্তিশালী দলগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনার অবস্থান রয়েছে। ভেবেছিলাম বিশ্বকাপটা এবার আমার প্রিয় দলেরই হবে। কিন্তু সব আশা শেষ। এই হেরে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। তাও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আমরা হেরে যাবো! আজ যদি ফ্রান্স, জার্মান হতো তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু এই দলের সঙ্গে কীভাবে তিন গোল খায়! মধ্য বাড্ডা ওভারব্রিজের নিচে একটি চায়ের দোকানি শাহাব উদ্দিনও আর্জেন্টিনার খেলা দেখে হতাশ। খুব কষ্ট পেয়েছেন। দোকানের পাশে অন্য দোকানিরা মিলে বিশ্বকাপ উপলক্ষে একটি বড় পতাকা ঝুলিয়েছেন শাহাব। তিনি বলেন, কি কমু! যা খেলছে! সব শ্যাষ কইরা দিছে। আর এক ম্যাচ আছে। কিন্তু আর আশা নাই। তার পাশেই আরেক কাপড়ের দোকানি শফিক জানালেন, খেলার জন্য ৫০০ পিস আর্জেন্টিনার জার্সি আনছিলাম। ৩০০ বিক্রি হইসে ঈদের আগে। কালকে (২১শে জুন) বিক্রি হইসে ৩০টা। এখন যেগুলা আছে আর বিক্রি হইবো না। আমার লস। কিন্তু আর্জেন্টিনার কাছে এমন খেলা দেখতে অইবো চিন্তা করি নাই। শাহাবের দোকানে চা পান করতে আসা ব্যাংকার ইরফান আহমেদ বলেন, এই খেলায় হারবো এটা মানতে পারা যায় না। প্রথম গোলটাই তো অস্বাভাবিক। এভাবে কেউ গোল খায়! কিছু বলার নেই। ওই দোকানেই বসা আরেক শিক্ষার্থী ফারুক বলেন, আমি ব্রাজিল সমর্থক। কিন্তু আর্জেন্টিনার এমন পারফরম্যান্সে কষ্ট হইসে অনেক। আর্জেন্টিনার খেলা দেখে হতাশ বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত আফরিন আক্তার। তিনি জানান, এক গোল হারলে এত কষ্ট লাগতো না। কিন্তু তিন গোল! এটা কিভাবে সম্ভব? গত ২০ বছর ধরে আর্জেন্টিনার খেলা দেখছি। এভাবে কিন্তু একটা পরিণত দলের কাছে এভাবে হারবে ভাবনার বাইরে ছিল। আমি সত্যিই হতাশ। আফরিনেরই আরেক সহকর্মী জালাল উদ্দিন বলেন, আমি জার্মানির সমর্থক। তবে এ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কাছে অনেক প্রত্যাশা ছিল। ভেবেছিলাম অন্তত কোয়ার্টার ফাইনাল খেলবে। কিন্তু প্রথম রাউন্ডেই এই অবস্থা! আশা করা যায় না। আর্জেন্টিনা তিন গোলে হারবে এমন প্রত্যাশা কেউ করেন না। তাদের ভক্তরা তো হারের কথা চিন্তাই করেন না। তেমনই আরেক ভক্ত মাহফুজ জানান, বিশ্বকাপটাই যেন আর্জেন্টিনার জন্য। কিন্তু তারা হতাশ করলো। বেশি কিছু বলার নেই। গুলশান-১ নম্বর ডিসিসি পাকা মার্কেটের নিচের চায়ের দোকানি ফরহাদ। খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন খেলার আগে। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে আর্জেন্টিনার হারার পর চা বিক্রি ছাড়া একটি বাড়তি কথাও কারো সঙ্গে বলছেন না। তিনি বলেন, মামা মনডা খুব খারাপ। আর্জেন্টিনা হাইরা গেলে এত খারাপ লাগে! আমি কত আশা কইরা খেলা দেখতে বইছিলাম। কিন্তু একটা গোলও দিতে পারলো না। খুব কষ্ট পাইসি। ফারহাদের চায়ের দোকানে বসা ইশতিয়াক নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আর্জেন্টিনা না থাকলে খেলা দেখার মজাই শেষ। এই দল যদি বিদায় নেয় তাইলে ক্যামনে কী! ফরহাদের পাশেই এক সবুজ নামের এক ফুল বিক্রেতা বলেন, আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ নেবে -এটাই ভাবসিলাম। কিন্তু ভালো খেলাটাও খেলতে পারেনি। মেসির ওপর খুব রাগ লাগছে। গুলশান চলতি পথে রিকশা থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বাজারে যাচ্ছিলেন নাভেদ নামের এক চাকরিজীবী। আর্জেন্টিনার খেলার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাইয়া নো কমেন্টস। আমার দেখা সবচেয়ে বাজে পারফরম্যান্স এবারের বিশ্বকাপে। আর কিছু বলতে গেলে বেশি রাগ হবে। থ্যাঙ্ক ইউ। শিহাব নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গুলশান ডিসিসি মার্কেটে এসেছিলেন। খেলা নিয়ে তিনি বলেন, এই আর্জেন্টিনা সেই আর্জেন্টিনা নেই। মেসি ছাড়া এই দলে কেউ নেই। একজন দিয়ে কী খেলা হয়! হারার কথা ছিল হেরেছে। আমি যদিও ব্রাজিল সমর্থক। ডেসকোতে কর্মরত আফরোজা সুলতানা কলি বলেন, বেশি কিছু বলার নেই। আর্জেন্টিনা ভালো দল নিঃসন্দেহে। কিন্তু এবার যে কি হলো। আমি সত্যিই আপসেট। মাল্টিন্যাশনাল একটি কোম্পানিতে কর্মরত আবু সালেহ মুন্না বলেন, এভাবে খেললে তো হারবেই। ক্রোয়েশিয়া কেন, যেকোনো দুর্বল টিমের সঙ্গেও হারার কথা তাদের। ভাগ্য ভালো আর্জেন্টিনা ৩টার বেশি গোল খায়নি। মগবাজারের মিডিয়া গলিতে আড্ডায়রত কয়েকজন মিডিয়াকর্মীর সঙ্গে কথা হলেও আর্জেন্টিনার খেলা নিয়ে তাদের মাঝেও হতাশার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তাদের মধ্যে বদিউল আলম নামের একজন জানান, মেসি থাকতে আর্জেন্টিনা হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেবে এটা মানা অসম্ভব। আমি জাস্ট মানতে পারলাম না। মিনহাজ নামের এক নাট্যনির্মাতা বলেন, এই আর্জেন্টিনার কাছে আমরা প্রতিবারই একটু বেশি আশা করি। কিন্তু কী হয়! তারা আমাদের হতাশায় ডোবায়। এবার সেটার মাত্রা একটু বেশি বলতে পারেন। মিনহাজের সঙ্গেই আরেক সহকারী পরিচালক মাহমুদ বলেন, তিনটা গোল বেশি হয়ে গেছে। আর্জেন্টিনার মতো দল ক্রোয়েশিয়ার কাছে এভাবে হারবে বিশ্বাস হচ্ছে না। খুব খারাপ লাগছে। গতকাল রাত থেকে ঘুমাতে পারিনি। শাহিন নামের এক ভিডিও এডিটর জানান, খেলা শুরুর আগে থেকে কত আয়োজন করেছি। বন্ধুরা সবাই মিলে খিঁচুড়ি রান্না করেছিলাম। ভেবেছি আর্জেন্টিনা জিতে গেলে সেটা খেয়ে উদযাপন করবো। কিন্তু কীভাবে কী হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে একটা স্বপ্নের মধ্যে বাস করেছি নব্বইটা মিনিট। বাংলামোটর এলাকার একটি চায়ের আড্ডায় গিয়েও দেখা মিললো আর্জেন্টিনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। সোহান নামের এক চাকরিজীবী বলেন, আমরা আর্জেন্টিনা নিয়ে বেশি আশা করি বলেই এ অবস্থা। আরিফ নামের একজন জানান, এটা সত্যিই আমাদের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য হতাশা। এভাবে হতাশ করবে জানলে খেলাই দেখতাম না। সাইফুল হক এক শিক্ষার্থী বলেন, আর কখনো খেলা দেখবো না। অন্যদের কাছ থেকে রেজাল্ট জানবো। বাংলামোটরেরই এক চায়ের আসলাম নামের এক চা দোকানি বলেন, আমার কাছে মনে হয় আর্জেন্টিনা এবার বিশ্বকাপ খেলতে আসে নাই। গোল দেয়ার কোনো ইচ্ছা দেখি নাই তাদের। বেলা গড়াতেই তার দোকানে ক্রেতাদের ভিড় জমে। একে একে সাত আটজন বসেন চা পান করতে। এসময় সুমন নামের এক আর্জেন্টিনার ভক্ত বলেন, আমি রাতে খাইনি। সকাল থেকে চা-এর ওপর আছি। আর্জেন্টিনার খেলা শেষে খাবো বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু খাওয়া আর হলো না। জানি না এ শোক কীভাবে কাটাবো। ফজলু নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আর্জেন্টিনা এবার সবচেয়ে বাজে দল নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে আসছে। মেসি ছাড়া দলের কেউ ছিল না। কিন্তু একজন দিয়ে কি বিশ্বকাপ জিতা যায়? বসুন্ধরা সিটিতে কাপড়ের ব্যবসা করেন মাহবুব। চা পান করতে এসে তিনি বলেন, শেষ! আমার ব্যবসা শেষ। এবার আর্জেন্টিনার জার্সিগুলো নেবে কে? যা খেলছে। এইডা খেলা! আমাগো গ্রামের পোলাপাইনও এর চেয়ে ভালো খেলে। চা পান করতে করতে শফিউল নামের এক চিকিৎসক বলেন, এরা তো জেতার জন্য খেলে নাই। কোনো ইচ্ছাই ছিল না। শুধু সবাই মিলে মাঠের মধ্যে দৌড়েছে। ধানমন্ডি শংকর প্লাজার সামনে কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিলেন। কাছে গিয়ে শোনা গেল আর্জেন্টিনা নিয়ে গল্প হচ্ছে তাদের মাঝে। জানতে চাইলে তাদেরই মাসুম নামের একজন জানান, এই হারের পর আর খেলা দেখার কোনো ইচ্ছা নাই। সব স্বপ্ন শেষ করে দিল মেসিরা। শোভা নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এত ভালোবাসা তাদের জন্য। অথচ এই প্রতিদান দিলো। কোনো চেষ্টাই করতে দেখলাম না। ওই আড্ডাস্থলে সীমা নামের আরেক তরুণী জানান, মিথ্যা স্বপ্ন দেখেছি। আর্জেন্টিনা হারবে- এটা কল্পনাও করতে পারিনি। মেনে নেয়াটা খুব কষ্টের। ব্রাজিল সমর্থক হয়েও আর্জেন্টিনার জয়ে আশা করেছিলেন শিক্ষার্থী তৌফিকা খানম ইপু। তিনি বলেন, আমি ব্রাজিল সমর্থক। কিন্তু চেয়েছি যেন আর্জেন্টিনা জেতে। কিছুই হলো না। দেখা যাক ব্রাজিল কী করে। শরীফ নামের আরেক ব্রাজিল সমর্থক বলেন, আমরা এই আর্জেন্টিনাকে দেখতে চাইনি। জাস্ট হতাশ করলো। ঢাকা মামার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন শিমুল। তিনি আর্জেন্টিনার অন্ধভক্ত। এই তরুণ বলেন, আর্জেন্টিনার প্রতি ভালোবাসা আগে যেমন ছিল এখনো আছে। কিন্তু গতকালকের ম্যাচ নিয়ে কোনো কথা বলতে গেলেই চোখের পানি আসে। সহ্য করতে পারি না। রামপুরা থেকে বাংলাদেশ মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন মনিরা নামের এক শিক্ষিকা। আর্জেন্টিনা হেরে যাওয়ার পর কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। মনিরা জানান, আমি প্রতি মাসেই এখানে আসি চেক-আপ করাতে। গতকাল রাতে খেলা দেখে একটু অসুস্থ হয়ে পড়ি। মানতে পারছিলাম না এই হারের কথা। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও আর্জেন্টিনার খেলার নিয়ে উত্তেজনা কম ছিল না। তাদের অনেকের বিশ্বাস এই বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার হাতেই উঠবে। কিন্তু সব আশা যে শেষ। প্রতিক্রিয়া জানাতে সানাউল্লাহ নামের এক আম ব্যবসায়ী বলেন, এখন আর কথা বলে কি হইবো। হাইরাই তো গেলাম। আরেক আম ব্যবসায়ী তুহিন বলেন, এত আশা কইরা খেলা দেখসি হাইরা যাওনের লাইগা! সবজি বিক্রি করতে করতে সোহাগ বলেন, আর্জেন্টিনার কথা বইলা আর কষ্ট বাড়াইয়েন না। ভালো লাগতেছে না কিছু। ফার্মগেটে সংবাদপত্রের দোকানে দাঁড়িয়ে সংবাদপত্র কিনছিলেন মাসুদ নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এইটা খেলা! এর চেয়ে ভালো তো আমিও খেলতে পারি। আর্জেন্টিনার কাছে এটা আশা করি নাই। তার পাশেই শাওন বলেন, রাত জাগাটাই বৃথা গেছে। কোনো লাভ হলো না। আর্জেন্টিনা তো শেষ। আমার বিশ্বকাপ খেলা দেখাও শেষ। সংবাদপত্রের দোকানের পাশেই মহিম নামের এক খাবারের ব্যবসায়ী বলেন, আর্জেন্টিনাকে হারতে দেখছি। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে হারবে- এটা ভাবতে পারিনি।
ভোর ছয়টা, চলছে আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল ম্যাচ। ধানমন্ডি লেকে এই খেলায় ১-০ গোলে জয় পায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু তাদের এই জয়কেও নীল বিষে পরিণত করেছে বৃহস্পতিবার রাতের ৩-০ গোলের হার। মাঠের খেলায় আর্জেন্টিনা জয়ী হলেও তর্কের খেলায় এগিয়ে ব্রাজিল সমর্থকরা। খেলা শেষে আড্ডায় কিছুটা নীরব ভূমিকা পালন করে মেসি-বাহিনীর সমর্থকরা। আর্জেন্টাইন সমর্থক ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আফসান রহমান বলেন, আরে এই হারের মাঝেও সম্মান আছে। সেভেন আপতো আর খাই নাই। তার বন্ধু একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনার চৌধুরী বলেন, হ্যাঁ এবার থেকে সেভেন আপ তিন বেলা করে খাব। লজ্জা করে না এই কথা বলতে আমরা চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানির কাছে হারছি আর তোরা ক্রোয়েশিয়ার মতো দলের কাছে হারিস। তাদের আরেক বন্ধু বলেন, তোদের দল পাঁচবার বিশ্বকাপ ঘরে তুলে তোরা সাতটা খাস ছিঃ ছিঃ ছিঃ। আরেকজন মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, বিশ্বকাপের মর্ম তোরা কি বুঝবি, ভাগ্যে তো সেই কত বছর আগে জুটছে দুইটা বিশ্বকাপ। ফ্যামিলি প্লানিংয়ের মতো ব্যাপার দুইটার বেশি না। তর্কে কিছুটা পরাজয় মেনে নিয়ে তাদের বন্ধু থমাস বলে, এত লাফাইস না, দেখা যাবে আজকের (গতকালের খেলা ব্রাজিল বনাম কোস্টারিকা) খেলায় ব্রাজিল কয়টা খায়। মিঠুন বলেন, পলিও রোগী নেইমার আর কই খেলবে সেটা অনুমান করাই যায়। আবার তার মাথায় দেখি কেকাপ্পা নুডুলস কাট। বুলেট মাহমুদ বলেন, দেখছি তো তোদের সুপার স্টার মেসি কেমন খেলছে। আর আগের খেলায় নেইমারকে ১০ বার ফাউল করলে খেলবে কেমন করে। এভাবে চলতেই থাকে তাদের তর্ক-বিতর্ক কখনো সেটার মাঝে থাকে যুক্তি তবে অধিকাংশ সময়ই তা হয়ে যায় অযৌক্তিক।
চলছে গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ রাশিয়া বিশ্বকাপ ২০১৮। গোটা বিশ্বের নজর যেখানে রাশিয়ার ময়দানে আবার সেই সঙ্গে বাংলাদেশে চলছে তর্কের ঝড়। বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকরা দুই ভাগে বিভক্ত আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। এছাড়াও সমর্থক রয়েছে জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন আবার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শোনা যায় সৌদি আরবকে সমর্থন করতে। ধানমন্ডি লেকে মর্নিংওয়াক করতে আসা সবারই আলোচনার একমাত্র টপিক আর্জেন্টিনার পরাজয়। দীর্ঘ সময় হাঁটার পর লেকে বজরায় আড্ডা জমিয়েছেন আটজন ব্যক্তি (বয়স আনুমানিক ৬০-৭০ বছর)। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী আমিনুর রহমান বলেন, বয়স হয়েছে রাত জাগতে পারি না। তাও কাল রাতে (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত) কষ্ট করে খেলা দেখলাম নিরাস করল আর্জেন্টিনা। বাজে ডিফেন্স আর সমন্বয়হীনতার কারণেই নির্মম পরাজয় তাদের। আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা লতিফ খন্দকার তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, আরে ভাই না ঘুমিয়ে আর্জেন্টিনার খেলা দেখলে কষ্ট পেতেই হবে। বাংলাদেশের মানুষ অযথা তাদের সমর্থন করে। ম্যারাডোনা একজন বিতর্কিত খেলোয়াড় আর আর্জেন্টিনার সমর্থকরা হুজুগে বাঙালি। বাংলাদেশে এত আর্জেন্টাইন সমর্থক কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যখন টেলিভিশন আসা শুরু করল বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে তখন আর্জেন্টিনা দুইটা কাপ জয় করে আর ম্যারাডোনার তখন তারকা সেই কারণেই তাদের এত সমর্থক। তাদের প্রভাবেই নতুন প্রজন্মের মাঝে আর্জেন্টিনা-প্রীতি চলে আসছে। আর ব্রাজিলের যারা সমর্থক তারা খেলা বোঝে এজন্যই ব্রাজিলকে সমর্থন করে। তবে হ্যাঁ মেসি ভালো খেলোয়াড় কিন্তু এটা বুঝতে হবে বার্সেলোনার খেলা চলছে না, এটা দেশের হয়ে খেলা। আর মেসি ভালো খেলবে কেন সে তো নামেই আর্জেন্টাইন; আসলে তার বেড়ে ওঠা, মাটির স্বাদ সব স্পেন। ব্রাজিলে জন্ম দিয়েছে পেলে, রোনাল্ডো, রোনালদিনহো, নেইমারের মতো খেলোয়াড় আর আর্জেন্টিনার শুধুই ম্যারাডোনা, মেসি।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে স্কয়ার হাসপাতালের সামনে টেলিভিশনের পর্দায় একসঙ্গে দেখেছেন প্রায় ১০০-১৫০ জন দর্শক। খেলায় দুইভাগে বিভক্ত ছিল আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের সমর্থকরা সমর্থন যুগিয়েছে ক্রোয়েশিয়াকে। প্রথমার্ধ পর্যন্ত নীল সাদা শিবিরের আওয়াজ শোনা গেলেও গোল হওয়ার পর থেকেই তা রূপ নেয় একপক্ষের সমর্থনে। লুকা রদ্রিচ যখন মেসি বাহিনীর জালে দ্বিতীয়বার বল জড়ালেন ধীরে ধীরে কমতে থাকে আর্জেন্টাইনদের ভিড়। এক সমর্থকের শরীরে ছিল নীল-সাদা জার্সি। খেলা শেষে তাকে দেখা যায় জার্সি খুলে শুধু ভেতরের গেঞ্জি পরে বাড়ি ফিরতে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে চলছে আর্জেন্টিনা এবং আর্জেন্টিনা সমর্থকদের নিয়ে নানান ট্রল ও বিরূপ স্ট্যাটাস। ব্রাজিল সমর্থকরা যেমন দিচ্ছেন স্ট্যাটাস আবার পাল্টা জবাব দিতেও পিছিয়ে নেই মেসি ও আর্জেন্টিনা ভক্তরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাস রঞ্জন রয় লিখেন, ভাই বাইরে ঝড় বৃষ্টি হইতেছে। রাতের বেলা পতাকা টা সাবধানে খুইলেন। আমরা সত্যিই চাই না ভ্যামোস খুলতে গিয়ে কোনো বাংলাদেশি ভাইয়ের প্রাণটা যাক। তার থেকে এক কাজ করুন ঘুমিয়ে পড়ুন সকাল সকাল উঠে পতাকাটা খুলে নেবেন।
আবার আর্জেন্টাইন সমর্থক গৃহিণী অদিতি অদি লিখেছেন, আর্জেন্টিনা তিন গোল খাওয়াতে কিছু আবাল মার্কা পাবলিক আছে যারা লাফাইতে লাফাইতে মুখের লালা ফালাইয়া নিজেদের কাপড় ভিজাইয়া ফেসবুকটারে দুর্গন্ধ করে ফেলেছে।
একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের স্ট্যাটাস হিসাব করে দেখা যায় (শুধু ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে দেয়া পোস্ট) ১২০টি পোস্টের মাঝে ৮২টি পোস্ট হয়েছে বিশ্বকাপ সংক্রান্ত। এর মাঝে ৫৪টি ছিল ব্রাজিল সমর্থকদের তার মাঝে ৪৫টি আবার আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় কিংবা সমর্থকদের উদ্দেশ্যে খোঁচা মেরে দেয়া। ১৮ জন আর্জেন্টাইন সমর্থকদের দেয়া স্ট্যাটাসের মূল বিষয় ছিল সেভেন আপ এবং কোস্টারিকা বনাম ব্রাজিলের খেলায় কী ফলাফল হয় তা নিয়ে।
ধানমন্ডি ২৭’র ‘প্লাজা এ আর’ শপিং মলে জগ ওয়ারু নামক দোকানে মেলে খেলাধুলার সামগ্রী ও জার্সি। এই দোকানের মালিক বলেন, এবারের বিশ্বকাপে কল্পনার থেকেও বেশি জার্সি বিক্রি হয়েছে। আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের জার্সি বেশি বিক্রি হয়েছে। তবে ২০ তারিখেই আনিয়েছি অনেকগুলো নতুন জার্সি। আর্জেন্টিনার জার্সি আর বিক্রি হবে বলে মনে হচ্ছে না। জার্সি বিক্রির লাভ মনে হচ্ছে এই খেলাতেই গেল।
কাওরান বাজার, ঢাকার সব থেকে বড় সবজির মার্কেট। ভ্যানে করে লিচু বিক্রি করছিলেন সানোয়ার হোসেন, বয়স আনুমানিক ৫০। তিনি জানান, যুবক বয়সে খেলা দেখতেন রাত জেগে। ম্যারাডোনার খেলা দেখে খুবই আনন্দিত হতেন তিনি। কিন্তু আর্জেন্টিনার খেলায় তার মনে হয়েছে পাড়ার ছেলেরা ফুটবল খেলছে। রক্ষণভাগের দুর্বলতা নিয়ে বলেন, বল নিয়্যা ওরা (ক্রোয়েশিয়া) আইসে আর এমরা সাতে সাতেই বল নিবার চায় আর ঢুকপ্যার জায়গা করি দেয়। আরে আগে দ্যাক কোন দিক যাবার চাওচে। চায়ের দোকানদার আর্জেন্টাইন সমর্থক মনির হোসেন বলেন, খেলা দেখার সময় রেডিওতে খেলা শুনছিলাম অনেকেই। খেলার শেষ সময়ে না পারতেছিলাম রেডিও বন্ধ করতে না পারতেছিলাম শুনতে। এই বাজারেই শরবতের দোকান বশির আলীর। আর্জেন্টিনার হার দেখে অনেক আনন্দ পেয়েছেন। তিনি বলেন, আরে বড় বড় গল্প আর্জেন্টিনা নিয়া। মনে হচ্ছে মেসির একশটে বিশ্বকাপ জিতবে। এখনো দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ায় সম্ভাবনা আছে? এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, ধুর পরের ম্যাচেও হারবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status