বাংলারজমিন

শোলাকিয়ায় বৃহত্তম ঈদ জামাত

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে

১৯ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:১৭ পূর্বাহ্ন

প্রতিবারের মতো এবারও দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। তবে মুসল্লিদের স্বতঃস্ফূর্ত আর ব্যাপক অংশগ্রহণে এবারের ১৯১তম ঈদজামাত ছাপিয়ে গেছে অতীতের সব জামাতকে। শনিবার অনুষ্ঠিত এই ঈদজামাতে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুসল্লি অংশ নেন। ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে আসা দেশের নানা প্রান্তের অন্তত পাঁচ লাখ মুসল্লির ভিড়ে জনসমুদ্রে পরিণত হয় শোলাকিয়া ময়দান। সকাল ১০টায় জামাত শুরু হলেও এর আরো এক ঘণ্টা আগেই সাত একর আয়তনের বিশাল ঈদগাহ ময়দান কানায় কানায় ভরে যায়। আগত মুসল্লিদের অনেকে মাঠে জায়গা না পেয়ে পার্শ্ববর্তী রাস্তা, তিনপাশের ফাঁকা জায়গা, নদীর পাড়, নবনির্মিত শোলাকিয়া সেতু ও বাড়ির ছাদে জায়গা করে নিয়ে জামাতে শরিক হন। দেশের সর্ববৃহৎ এ জামাতে অংশগ্রহণ করতে ভোর থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে শোলাকিয়া ঈদগাহের উদ্দেশ্যে। জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত শোলাকিয়া ঈদগাহমুখি সকল সড়ক চলে যায় মুসল্লিদের দখলে। কয়েক ঘণ্টার জন্য এসব সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। নজিরবিহীন নিরাপত্তার মাঝেও কোন ধরনের বিড়ম্বনা ছাড়াই ধনী-গরিব নির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড়িয়ে শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজ আদায় করেন লাখ লাখ মুসল্লি। ১৮২৮ সালে অনুষ্ঠিত ঈদের প্রথম বড় জামাতের হিসাব অনুযায়ী শোলাকিয়া ময়দানে এবার ছিল ১৯১তম ঈদ জামাত। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া জামাতে ইমামতি করেন বাংলাদেশ ওলামা-মাশায়েখ সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। জামাতকে কেন্দ্র করে নেয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা পরিকল্পনায় যুক্ত করা হয় ড্রোন ক্যামেরা। শোলাকিয়ার আকাশে ড্রোন উড়া ছাড়াও মাঠের চারপাশে বসানো হয় নিরাপত্তা চৌকি। চার স্তরের নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুযায়ী পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এক হাজারেরও বেশি সদস্য ঈদগাহ মাঠকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়। পুরো এলাকায় বসানো হয় অর্ধশতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। পুরো মাঠ একাধিকবার সুইপিং করা ছাড়াও মাঠে ঢোকার ২১টি প্রবেশ পথের মধ্যে মুসল্লিদের জন্য ছয়টি প্রবেশপথ উন্মুক্ত রাখা হয়। সেসব প্রবেশপথে স্থাপিত আর্চওয়ে দিয়ে মুসল্লিদের ঢুকতে হয় ঈদগাহ ময়দানে। এর আগে আরো অন্তত তিন দফা মেটাল ডিটেক্টরে মুসল্লিদের দেহ তল্লাসি করা হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ঈদগাহে আগত মুসল্লিদের কেবল পাতলা জায়নামাজ ছাড়া ছাতা বা কোনো ধরণের ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পুলিশের পাশাপাশি ঈদগাহ ময়দানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি করে র‌্যাব। ঈদগাহ ময়দানকে ঘিরে মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক র‌্যাব সদস্য। মোতায়েন করা হয় পাঁচ প্লাটুন বিজিবি। সুষ্ঠুভাবে ঈদজামাত আদায়ের লক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ ফোর্সকে আইনগত দিকনির্দেশনা দেয়াসহ ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব পালনের জন্য ঈদগাহ মাঠের বিভিন্ন পয়েন্ট ও এলাকায় ১৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয় জেলা প্রশাসন। মাঠে স্থাপন করা হয় ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার। এর চারটিতে পুলিশ বাহিনী ও দুইটিতে র‌্যাব বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে ঈদজামাতের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা তদারকি করেন। এছাড়া সর্বোচ্চ নিশ্ছিন্দ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়ানো হয় গোয়েন্দা নজরদারি। নিরাপত্তা ব্যবস্থার এত আয়োজন ও কড়াকড়ির মধ্যেও ছিল না কোন বাড়াবাড়ি। বরং পূর্ণ স্বস্তিতে মুসল্লিরা হাজির হন ঐতিহাসিক মাঠটিতে। মুসল্লিদের অভাবিত ঢল শোলাকিয়ার ঐহিত্যবাহী জামাতকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। জনসমুদ্রে পরিণত হওয়া ঈদগাহ ময়দানে আগত মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শটগানের গুলি ছুড়ে প্রতিবারের মতো এবারও জামাত শুরুর সংকেত দেয়া হয়। রেওয়াজ অনুযায়ী, জামাত শুরুর ৫মিনিট আগে ৩টি, ৩ মিনিট আগে ২টি এবং ১ মিনিট আগে ১টি শটগানের গুলি ছোড়া হয়। মুসল্লিদের মাথার ওপরে ড্রোন ক্যামেরার নজরদারি আর কঠোর নিরাপত্তায় শন্তিপূর্ণভাবে নামাজ শেষ হয়। নামাজ শেষে দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর জন্য মঙ্গল কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। কয়েক লাখ মুসল্লির উচ্চকিত হাত আর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার আমীন, আমীন ধ্বনিতে এ সময় মুখরিত হয়ে উঠে পুরো ঈদগাহ এলাকা।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী, পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এম এ আফজল, কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মো. আক্তার জামীল, পিপি শাহ আজিজুল হক, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আব্দুল্লাহ আল মাসউদ সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এখানে ঈদের নামাজ আদায় করেন।
মাঠের সুনাম ও নানা জনশ্রুতির কারণে ঈদের কয়েক দিন পূর্ব থেকেই কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সারাদেশের বিভিন্ন জেলা তথা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, জামালপুর, খাগড়াছড়ি, শেরপুর, যশোর, খুলনা ও চট্টগ্রামসহ অধিকাংশ জেলা থেকে শোলাকিয়ায় মুসল্লিদের সমাগম ঘটে। এদের অনেকেই ওঠেছিলেন হোটেলে, কেউবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন মসজিদ ও আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমে। ঈদের দিন শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ২টি স্পেশাল ট্রেন চলাচল করে। একটি ট্রেন ভৈরব থেকে সকাল ৬টায় ছেড়ে আসে এবং সকাল ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছায়। অন্যটি ময়মনসিংহ থেকে সকাল পৌনে ৬টায় ছেড়ে আসে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছায়। এ ঈদ জামাতকে উপলক্ষ করে জেলা প্রশাসন, পৌর প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কর্তৃক মুসল্লিদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, জরুরি স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করেছে। এছাড়া বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি ও কর্মব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মত। প্রতি বছরই ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহ পরিণত হয় মুসলিম সমপ্রদায়ের মহামিলন কেন্দ্রে। আল্লাহর সান্নিধ্য ও অনুকম্পা পেতে ব্যাকুল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ঢল নামে জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় শেষে সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে এক নতুন সমাজ গড়ার শিক্ষা নিয়েই বাড়ির পথে শোলাকিয়া ছাড়েন তাঁরা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status