দেশ বিদেশ

শোলাকিয়ায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে

১৫ জুন ২০১৮, শুক্রবার, ৯:১৩ পূর্বাহ্ন

ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে এবার ১৯১তম ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০টায় জামাত শুরু হবে। জামাতে ইমামতি করবেন ইসলাহুল মুসলিহীন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। উপমহাদেশের বৃহত্তম এই ঈদজামাত আয়োজনের সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সংস্কার করা হয়েছে মিনার, অজুখানা। মুসল্লিদের প্রাকৃতিক কাজ-কর্ম সারার জন্য তৈরি করা হয়েছে বেশকিছূ অস্থায়ী টয়লেট। দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তা ও সুবিধার্থে এবছর মাঠের পাশেই অবস্থিত আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমে থাকার সু-ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ ঈদগাহে আসা মুসল্লিদের আপ্যায়ন ও প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী স্বেচ্ছাসেবী ক্যাম্প। প্রস্তুত রাখা হয়েছে একাধিক মেডিক্যাল টিম। সব মিলিয়ে বৃহত্তম ঈদজামাতের জন্য ২৬৮ বছরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান এখন পুরোপুরি প্রস্তুত।
প্রতিবারই শান্তিপূর্ণভাবে জামাত আয়োজনে নেয়া হয় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ২০১৬ সালে শোলাকিয়ায় জঙ্গি হানার পর গতবার সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো ঢেলে সাজানো হয়। এবার শোলাকিয়ার ঈদজামাত উপলক্ষে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নজিরবিহীন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হচ্ছে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানকে। নিরাপত্তা পরিকল্পনায় প্রথমবারের মতো যুক্ত করা হয়েছে ড্রোন। নিরবচ্ছিন্ন নজরদারির জন্য ২টি ড্রোন উড়বে শোলাকিয়ার আকাশে। ঈদ জামাতকে নির্বিঘ্ন ও শান্তিপূর্ণ করতে পুলিশের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে চার স্তরের নিরাপত্তা পরিকল্পনা। আরো এক সপ্তাহ আগেই ঈদগাহ ময়দানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে পুলিশ প্রশাসন। পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের এক হাজারেরও বেশি সদস্য ঈদগাহ মাঠকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করছে। পুরো এলাকায় বসানো হচ্ছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। পুরো মাঠ একাধিকবার সুইপিং করা ছাড়াও মাঠে ঢোকার ২১টি প্রবেশ পথের মধ্যে মুসল্লিদের জন্য ছয়টি প্রবেশপথ উন্মুক্ত রাখা হচ্ছে। সেসব প্রবেশপথে স্থাপিত আর্চওয়ে দিয়ে মুসল্লিদের ঢুকতে হবে ঈদগাহ ময়দানে। এর আগে আরো অন্তত তিন দফা মেটাল ডিটেক্টরে মুসল্লিদের দেহ তল্লাসি করা হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে ঈদগাহে আগত মুসল্লিদের কেবল পাতলা জায়নামাজ ছাড়া ছাতা বা কোনো ধরণের ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হবেনা। পুলিশের পাশাপাশি ঈদগাহ ময়দানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি করছে র‌্যাব। ঈদগাহ ময়দানকে ঘিরে মোতায়েন করা হবে বিপুল সংখ্যক র‌্যাব সদস্য। মোতায়েন করা হচ্ছে পাঁচ প্লাটুন বিজিবি। সুষ্ঠুভাবে ঈদজামাত আদায়ের লক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ ফোর্সকে আইনগত দিকনির্দেশনা দেয়াসহ ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব পালনের জন্য ঈদগাহ মাঠের বিভিন্ন পয়েন্ট ও এলাকায় ১৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়েছেন জেলা প্রশাসন। মাঠে স্থাপন করা হয়েছে ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার। এর চারটিতে পুলিশ বাহিনী ও দুইটিতে র‌্যাব বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে ঈদজামাতের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা তদারকি করবেন। এছাড়া সর্বোচ্চ নিশ্ছিন্দ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। শান্তিপূর্ণভাবে ঈদজামাত অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে মাঠের বাইরে, মাঠের ভেতরে ও প্রবেশ পথে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মো. মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম।
পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম জানান, এবার মাঠের বাইরে, মাঠের ভেতরে ও প্রবেশ পথে সর্বোচ্চ ও সুচারূ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। উড়ন্ত ড্রোন থেকে নজরদারি ছাড়াও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া নিরাপত্তা জোরদারের জন্য মাঠের ভিতর-বাহিরে পোশাক ও সাদা পোশাকে অন্যান্য বারের থেকেও বেশিসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। সার্বিক প্রস্তুতির বিবেচনায় নির্বিঘ্নে মুসল্লিগণ ঈদুল ফিতরের ঐতিহ্যবাহী এই জামাতে অংশ নিতে পারবেন বলে পুলিশ সুপার আশা প্রকাশ করেন।
অন্যদিকে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবারও ‘শোলাকিয়া এক্সপ্রেস’ নামে দু’টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। ভৈরব বাজার-ময়মনসিংহ ও ময়মনসিংহ-ভৈরব বাজার রুটে বিশেষ ট্রেন দু’টি চলাচল করবে। বিশেষ ট্রেনের একটি ঈদের দিন সকাল ৬টায় ভৈরববাজার থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে এবং সকাল ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছুবে। জামাত শেষে ট্রেনটি দুপুর ১২টায় পুনরায় ভৈরববাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে এবং বেলা ২টায় ভৈরববাজার পৌঁছুবে। অপর ট্রেনটি ঈদের দিন সকাল পৌনে ৬টায় ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে এবং সকাল সাড়ে ৮টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছুবে। এ ট্রেনটিও জামাত শেষে দুপুর ১২টায় কিশোরগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাবে এবং বেলা ৩টায় ময়মনসিংহ পৌঁছুবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী এ শোলাকিয়া ঈদগাহ। বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশাখাঁ’র ষোড়শ বংশধর হয়বতনগরের জমিদার দেওয়ান মান্নান দাঁদ খান তার মায়ের অসিয়াত মোতাবেক ১৯৫০ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহের জন্য ৪.৩৫ একর জমি ওয়াক্‌ফ করেন। সেই ওয়াক্‌ফ দলিলে উল্লেখ রয়েছে, ১৭৫০ সাল থেকে এ মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সে হিসাব অনুসারে, শোলাকিয়া ঈদগাহের বয়স ২শ’ ৬৭ বছর। প্রতিষ্ঠার ৭৮ বছর পর ১৮২৮ সালে প্রথম বড় জামাতে এই মাঠে একসঙ্গে ১ লাখ ২৫ হাজার অর্থাৎ সোয়ালাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করেন। এই সোয়ালাখ থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়ালাখিয়া’, যা উচ্চারণ বিবর্তনে হয়েছে শোলাকিয়া। বৃহত্তম জামাতের হিসাব অনুযায়ি, এ বছর এ ঈদগাহ মাঠে ১৯০তম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হবে। কিশোরগঞ্জ মৌজার এ মাঠের মূল আয়তন বর্তমানে ৬.৬১ একর। প্রাচীর ঘেরা শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে মোট ২২২টি কাতার রয়েছে যেখানে একসঙ্গে দেড় লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। এছাড়া মাঠে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ঈদগাহ সংলগ্ন খালি জায়গা, রাস্তা এবং নিকটবর্তী এলাকায় দাঁড়িয়ে সমসংখ্যক মুসল্লি এ বৃহত্তম ঈদজামাতে শরিক হন। জনসমুদ্রে পরিণত হওয়া ঈদগাহ ময়দানে আগত মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শর্টগানের গুলি ছুঁড়ে প্রতিবারের মতো এবারও জামাত শুরুর সংকেত দেয়া হয়। রেওয়াজ অনুযায়ী, জামাত শুরুর ৫মিনিট আগে ৩টি, ৩ মিনিট আগে ২টি এবং ১ মিনিট আগে ১টি শর্টগানের গুলি ছোঁড়া হয়।
১৮২৮ সালের প্রথম বড় জামাতে হয়বতনগর সাহেব বাড়ির উর্দ্ধতন পুরুষ শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ (র:) ইমামতি করেন। এ সম্পর্কে নানা তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ (র.) এর পূর্বপূরুষগণ সুদূর মক্কা শরিফ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে বর্তমান ভারতের বর্ধমান জেলার টেংগাপাড়ায় বসবাস শুরু করেন। সৈয়দ আহমদ (র.) এর পিতা সৈয়দ ইবরাহিম (র.) উত্তর কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা প্রচার-প্রসার ও দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে কিশোরগঞ্জ শহর থেকে সাত মাইল দূরবর্তী কান্দাইল গ্রামে পদার্পন করেন। পরবর্তিতে সেখানে স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বিবাহ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু সাংসারিক জীবনকে তিনি আবদ্ধজীবন মনে করে আল্লাহর বাণী প্রচারের তাগিদে বেরিয়ে পড়েন। একপর্যায়ে হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে তাবলীগ জামাতসহ মক্কা শরিফে চলে যান এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন। এদিকে মরহুম সৈয়দ ইবরাহিম (র.) এর বাড়িতে রেখে যাওয়া গর্ভবতী স্ত্রীর এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। স্বামীর পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক পুত্রের নামকরণ ও পরবর্তী সময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ১২ বছর বয়সে শিক্ষা-দীক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ঢাকার আজিমপুর দায়রা শরিফে প্রেরণ করা হয়। বালকপুত্র সৈয়দ আহমদ সেখানে ২৪ বছর অবস্থান করে শিক্ষা-দীক্ষায় পরিপক্ক জ্ঞান লাভের পর পীরের নির্দেশে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় চলে আসেন। সেখানে শহীদ ময়েজ উদ্দিন মজনু (র.) এর মাজারের পাশে একটি ঘর তৈরি করে ইবাদত-বন্দেগীসহ ইসলামের বাণী প্রচারে মনোনিবেশ করেন। ক্রমে সৈয়দ আহমদ (র.)-এর সুনাম ও সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোকজন তার কাছে এসে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। এ সময় ঈশা খাঁ’র বংশধরগণ জঙ্গলবাড়ি ও হয়বতনগর এলাকার জমিদারদ্বয় সৈয়দ আহমদ (র.) কে শ্রদ্ধার আসনে স্থান দেন এবং তার সামগ্রিক দ্বীনি দাওয়াতী কাজের সহযোগিতা করেন। এ সময় সে এলাকায় কোন মসজিদ না থাকায় ১৮২৭ সালে সৈয়দ আহমদ (র.) বাড়ি সংলগ্ন জায়গায় একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর পরই তিনি ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি তার ক্রয়কৃত তালুক সম্পত্তিতে ঈদগাহ মাঠ প্রতিষ্ঠা করার মনস্থির করেন এবং এ ব্যাপারে জঙ্গলবাড়ি ও হয়বতনগরের জমিদারদ্বয়কে সহায়তা করার অনুরোধ জানিয়ে আসন্ন ঈদুল ফিতরের প্রথম জামাতে শরীক হওয়ার দাওয়াত করেন। জমিদারদ্বয় দাওয়াত কবুল করেন এবং এই অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ১৮২৮ সালের ঈদ-উল-ফিতরের ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ (র.)-এর ইমামতিতে অনুষ্ঠিত হয় ঈদের প্রথম জামাত। জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী অন্যান্য বছরের মতো এবারও শোলাকিয়ায় দেশ-বিদেশের লাখো মুসল্লি অংশ নিবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status