শেষের পাতা

ঢাকা মেডিকেলে মাদক চক্র!

শুভ্র দেব

১২ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০৬ পূর্বাহ্ন

৩রা মে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ইয়াবাসহ এক আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ৩৫ বছর বয়সী ওই আনসার সদস্যের নাম মো. আসাদুজ্জামান। গ্রেপ্তারকালে তার কাছ থেকে ৯ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসাদুজ্জামান স্বীকার করে দীর্ঘদিন ধরে সে হাসপাতালে ইয়াবা বিক্রি করছে। পরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে র‌্যাব তাকে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করে। এছাড়া ৫ই মে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এলাকা থেকে ৭ জন মাদকসেবী ও বিক্রেতাকে আটক করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারা হলো- আলম মিয়া, শামীম, সোহেল, রনি, লিটন, সুবির বিশ্বাস ও শামীম মিয়া। পরে তাদের ৬ মাস করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। ওদিকে গত শনিবার রাতে ইয়াবাসহ তুলি নামের ৩০ বছর বয়সী এক মহিলাকে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ। এসব ঘটনাই জানান দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলছে মাদকের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা। হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মী ও বহিরাগতদের যোগসাজশে দেদার বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা। খোদ হাসপাতালের কতিপয় ইন্টার্ন চিকিৎসক, সেবিকা, রোগীর স্বজন, বিভিন্ন শ্রেণির স্টাফ ও এম্বুলেন্স চালক ইয়াবার সেবক ও ক্রেতা। দিনের বেলা কমবেশি হলেও রাতে জমে উঠে ইয়াবার আসর। দিন-রাতে অন্তত ১০/১২টি স্পটে বসানো হয় ইয়াবার আসর। শুধু ইয়াবাই নয় হাসপাতালের পরিত্যক্ত অনেক স্থানেই পাওয়া যায় ফেনসিডিলের খালি বোতল। আর ইয়াবার আসরের পাশাপাশি গাঁজার আসরের কমতি নাই। বিভিন্ন অলিগলিতে দাঁড়িয়ে বা কয়েকজন একসঙ্গে বসেই গাঁজা সেবন করছেন। সূত্র মতে ইয়াবা ও গাঁজার এসব আসর বসাতে উৎকোচ দিতে হয় হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান চলাকালীন সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপাতালে ইয়াবা বিক্রি ও সেবন চলছে সমান তালে। দেশের অন্য সব জায়গায় মাদক সেবন ও ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে থাকলেও এখানে কোনো রকম ভয়ভীতি ছাড়াই চলছে মাদকের অবাধ বিচরণ। জনগুরুত্বপূর্ণ এই স্থানে মাদক নির্মূলে নেই কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগ। কিন্তু হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ বলছে, মাদক নির্র্মূলে তারা কাজ করে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দেয়াসহ, রাতের বেলা পুলিশি টহল, বিভিন্নস্থানে সিসি ক্যামেরা বসানোসহ নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।

মানবজমিনের এক অনুসন্ধানে জানা গেছে ঢামেকে মাদক প্রবেশের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। এখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যরাই বহিরাগতদের মাধ্যমে মাদক প্রবেশে সহযোগিতা করেন। গত কয়েকদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, চাঁনখারপুল, শাহবাগ, চকবাজার, বংশাল এলাকার নামকরা মাদক ব্যবসায়ীরা হাসপাতালের ভেতর মাদক সাপ্লাই দেয়। আবার তাদের নিজস্ব সোর্সদের দিয়ে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল পৌঁছে দেয় হাসপাতালের ভেতরের ক্রেতার কাছে। হাসপাতালে মাদক সরবরাহের পেছনে যারা অন্যতম তাদের মধ্যে রয়েছে জাহাঙ্গীর, হাসান, পাপন, অনিক, জাফর, আসিক সুমন। তাদের আবার হাসপাতালের ভেতরে আলাদা আলাদা বিক্রেতা রয়েছে। বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট এলাকায় রনি ও স্বপন। নতুন ভবনের সামনে চিনচিন, বিল্লাল হেদায়েত, মোমেন। ডা. মিলন অডিটরিয়াম এলাকায় বুলবুলি ও লাবু। এছাড়াও আয়েশা, বুলবুলি, বিল্লাল, লাভলুসহ আরো অনেকে রয়েছে। মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে, যে সব স্থানে ইয়াবা-গাঁজার আসর বসে তার অন্যতম হচ্ছে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পেছনের গাড়ি ও মোটরসাইকেল পার্কিং এরিয়া, মর্গ এলাকা, মেডিকেল কলেজ ভবন থেকে নতুন ভবনে যাওয়ার রাস্তা, শহীদ ডা. মিলন অডিটোরিয়াম এলাকা, মেডিকেল ২ এর ছাদ, পিজি হাসপাতালের কিচেন, নার্সিং হোস্টেল এলাকা, জরুরি বিভাগ সংলগ্ন পানির ট্যাংকি ও শহীদ মিনার এলাকা। রাতের বেলা এসব এলাকায় হাসপাতালের স্টাফ ও বহিরাগতদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এসব আসর থেকে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বাচ্চু মিয়া ও তার সহযোগীরা টাকা নিচ্ছে।

অভিযোগের বিষয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই বাচ্চু মিয়া মানবজমিনকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগই মিথ্যা। এসবের সঙ্গে আমি জড়িত না। এছাড়া মাদকের সঙ্গে আমার কোনো আপস নাই। তবে মেডিকেলের ভেতরে মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের আনাগোনার বিষয়ে বাচ্চু মিয়া বলেন, মেডিকেলটা অনেক বড়। এখানে অনেক কিছুই খেয়াল রাখা সম্ভব নয়। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একে এম নাসির উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, মেডিকেলের ভেতরে মাদক নিয়ে আমরা অনেক আগে থেকেই কাজ করছি। হাসপাতালের ভেতরের কেউ কেউ মাদকের সঙ্গে জড়িত এটা আমরা জানতাম। তবে নির্দিষ্টভাবে আসলে কোন ব্যক্তি জড়িত তা জানতাম না। তাই হাসপাতালের পক্ষ থেকে ডিএমপি কমিশনার, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়েছিলাম। এজন্য কিছুদিন আগে একজন আনসার সদস্য ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছে। ঢামেকের এই পরিচালক বলেন, এর বাইরে আমরা সন্ধ্যার পর থেকে পুলিশ ও আনসারের টহল বাড়িয়েছি। বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে যাতে ফুটেজ দেখে বহিরাগতদের চিহ্নিত করা যায়।

পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। তিনি বলেন, ঢামেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ আসে। এদের মধ্যে কে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা চিহ্নিত করা কঠিন। তারপরও আমরা মাদক নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (ক্লিনিক ও হাসপাতাল) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, মাদক নির্মূল হোক এটা আমরা চাই। তবে মাদকের সঙ্গে যারা জড়িত তারা হচ্ছে উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের। কেউ ফ্যাশনের জন্য আবার কেউ বিনোদনের জন্য মাদক সেবন করে। তবে মাদকের সরবরাহ বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও চাহিদা কমাতে আমরা কাজ করতে পারি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status