এক্সক্লুসিভ

ঈদেও ওদের মুখ যন্ত্রণায় নীল

মরিয়ম চম্পা

১২ জুন ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:৩৪ পূর্বাহ্ন

সড়কে এখন মানুষের জীবনই যেন সবচেয়ে সস্তা, তুচ্ছ। পরিবহন এখানে অপ্রতিরোধ্য। মৃত্যু কারণ শূন্য। চলতি বছরে সড়ক দুর্ঘনায় নিহত রাজীব, রোজিনা, আহত রাসেল, হৃদয়দের পরিবারে আর ঈদের আনন্দ নেই। তাদের পরিবারের সদস্যরা এখনো শোকাচ্ছন্ন। দুই বাসের চাপায় কলেজছাত্র রাজীব হোসেনের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাজীবের পর বাসচাপায় পা হারান রোজিনা আক্তার। এই দুজনের মৃত্যুর পর নগর পরিবহনের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। কিন্তু তার পরও হাত-পা হারিয়েছেন এবং গুরুতর আহত হয়েছেন খালিদ হাসান হৃদয়, রাসেল সরকার, পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, রুনি আক্তার ও আয়েশা খাতুন। কিন্তু কোনো প্রতিকার মিলছে না। দুই বাসের প্রতিযোগিতায় প্রথমে হাত হারালেন রাজীব, শেষে জীবনও। মা-বাবা হারানো পরিবারে বড় ভাই রাজীব হোসেনই ছিলেন ছোট দুই ভাই মেহেদী ও হৃদয়ের একমাত্র আশ্রয়। এ বছর ভাইকে ছাড়া কীভাবে ঈদ করবে মেহেদী হাসান ও আবদুল্লাহ হৃদয়। মেহেদী বলেন, ঈদের ছুটিতে আমি আর ছোট ভাই হৃদয় গ্রামের বাড়ি যেতাম। গ্রামের বাড়ি বলতে পটুয়াখালীর বাউফলে নানাবাড়ী। মা-বাবার কবর এখানেই। তাই ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছাটা তীব্র হতো। আমাদের ভীষণ ইচ্ছা ছিল তিন ভাই মিলে কোনো এক ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাব। যেতে যেতে অনেক আনন্দ করব। বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার কবরের পাশে দাঁড়াব। কিন্তু এবার বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাইয়ার কবরের পাশেও যে দাঁড়াতে হবে কখনোই ভাবতে পারিনি। ৩রা এপ্রিল সার্ক ফোয়ারার কাছে দুই বাসের প্রতিযোগিতায় ডান হাত হারানো রাজীব হোসেন ১৬ই এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজেই মারা যান। রাজিবের বড় খালা জাহানারা বেগম বলেন, ভাইকে ছাড়া এবছর রাজিবের ছোট দুই ভাইয়ের প্রথম ঈদ আসতেছে। আমরা দুই বোন মিলে মেহেদী ও হৃদয়কে নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছি। তারপরেও ওদের দুই ভাইয়ের কান্না যেন থামছে না। ওরা বলে, সবাই যাবে ঈদের আনন্দ করতে আর আমরা যাবো ভাইয়ার কবর জিয়ারত করতে। গত বছরও ঈদে ভাইয়া বেঁচে ছিল। এবছর সেই ভাইয়ার কবর জিয়ারত করবো কীভাবে।
রাজিবের মেজো খালা খাদিজা বেগম বলেন, ওদের মাদরাসা বন্ধ থাকায় এখন বড় খালার বাসায় আছেন। আমার বাসায়ও বেশ কিছুদিন ছিল। রাজিবের দুই ভাই সবসময় বাড়িতে ঈদ করলেও রাজীব রোজার ঈদে ঢাকায় আমাদের সঙ্গে ঈদ করতো আর কোরবানিতে বাড়ি যেত। প্রতি বছর ঈদে ছোট দুই ভাইকে ঈদের জামা-কাপড় কিনে দেয়া, লঞ্চে তুলে দেয়া- তারা ঠিকভাবে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে পেরেছে কি না সব খোঁজখবরই রাজীব করতেন। গত বছর রাজীব আর মেহেদী ঢাকায় ঈদ করেছিল। শুধু ছোট ভাই হৃদয় আব্দুল্লাহ গ্রামের বাড়িতে ছিল। প্রতি বছর কোরবানিতে বাড়িতে যাওয়ার সময় রাজীবই আমাদের লঞ্চে যাওয়ার ব্যবস্থা করতো। অথচ এ বছর ওকে ছাড়াই আমাদের ঈদ করতে হবে। ওর বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিটা ঈদই আমরা এক সঙ্গে করেছি। আজ আমরা সবাই আছি শুধু রাজীব নেই আমাদের মাঝে। ঈদে রাজীব পোলাও-মাংস আর নুডুলসটা বেশি পছন্দ করতো। মিষ্টি জাতীয় খাবারও রাজীবের অনেক পছন্দের ছিল। রাজিব অনেক ভোজনরসিক ছিল। সব ধরনের খাবারই খেতে পছন্দ করতো। ঈদের দিন সকালে বড় খালার বাসায় খেয়ে দুপুরে আমার বাসায় খেতে আসতো। গত বছর ঈদের তিন দিনই আমরা সবাই বড় আপার বাসায় ছিলাম বলে জানান রাজীবের মেজো খালা খাদিজা।
ট্রাকচাপায় ১৭ই এপ্রিল টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস বাসের কর্মচারী খালিদ হাসান হৃদয়ের ডান হাত কাটা পড়ে। হৃদয়ের বাবা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, হৃদয় এখন অনেকটা সুস্থ্য। বার্ন ইউনিটের ডাক্তার ওকে নিয়ে বাড়ি পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ৪


যাওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছে। এখন শুধু কেবিনের টাকাপয়সার আনুষ্ঠানিকতার জন্য আমাদের যেতে দেয়া হচ্ছে না। পরবর্তীকালে কেবিনের খরচের বিষয়ে ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা বলার পর দুপুর আড়াইটার দিকে তাদের হাসপাতাল থেকে বাসায় যাওয়ার চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেয়া হয়। এ সময় মুঠোফোনে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন হৃদয়ের বাবা। তিনি বলেন, এখন হৃদয়কে নিয়ে আমরা বাড়ি যাবো। ওর মা খুলনাতে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে। ছেলে বাসায় যাওয়ার পর তাকে নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করবেন হৃদয়ের মা। আমার ছেলেটা গত বছরও সুস্থ্যভাবে সবার সঙ্গে ঈদ করেছে। অথচ দেখেন এ বছর ছেলেটা একটি হাত বিহীন অবস্থায় ঈদ করবে। তার পরেও আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া যে আমার ছেলে প্রাণে বেঁচে আছে। তবে সরকারের কাছে আবেদন থাকবে যেন আর কোনো বাবা-মাকে সড়ক দুর্ঘটনায় সন্তানের অঙ্গহানী বা সন্তানহারা হতে না হয়। হৃদয় বলেন, আন্টি আজ আমি বাড়ি যাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করবেন। ঈদের পর সুস্থ্য হয়ে ঢাকায় এসে আপনার সঙ্গে দেখা করবো।
২০শে এপ্রিল রাতে বিআরটিসির দোতলা বাসের চাপায় ডান পা হারিয়ে ২৯শে এপ্রিল মারা যান গৃহকর্মী রোজিনা আক্তার। রোজিনার বাবা মো. রসুল মিয়া বলেন, ভালো নাইগো মায়া (মেয়ে)। গত বছর ঈদে আমার মায়া (রোজিনা) আমাদের সঙ্গে ঈদ করেছে। অথচ এ বছর তাকে ছাড়াই ঈদ করতে হবে। আমাদের কোনো ঈদ নাইরে মায়া। আপনে আমারে ঈদের কথা জানতে চাইছেন এদিকে আমার কইলজাডা ভাইঙ্গা যাইতেছে। গত বছর রোজার সময় রোজিনা প্রত্যেক দিন ভোররাতে ঠিক সাহরির সময় ফোন দিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে কথা কইতো। মায়ের কাছে জানতে চাইত আজ রাতে কী রান্না করছো। এ বছর আমার সোনামণি তো আর তার মায়েরে ফোন দিয়া জানতে চায় না, কী রানছে। ওর মা এমনিতেই অসুস্থ্য, তার ওপর মেয়ের জন্য কান্না করতে করতে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। রোজিনার মায়ের লিভারে সমস্যা আছে। ঈদের পর অপারেশন। মেয়ের শোকে ঠিকমতো নাওয়া-খাওয়া নেই। গত বছর ঈদে রোজিনা ১২ হাজার টাকা দিয়েছিল। আমার জন্য আর ওর মায়ের জন্য নতুন পাঞ্জাবি শাড়ি কিনে পাঠিয়েছিল। এ বছর আর কেউ আমাদের জন্য জামা-কাপড় কিনে পাঠাবে না। কিছুদিন আগে রোজিনা যে বাসায় কাজ করতেন সেই বাসার সাহেব ডেকে নিয়ে কিছু টাকা দিলেও আমার মায়ারে নিয়া তো আর ঈদ করতে পারমু না। এ বছর আমার রোজিরে ছাড়া ঈদ করতে হবে ভাবতেই পারি না। আমার রোজি হাতে অনেক সুন্দর করে মেহেন্দি দিতে পারতো। কোথায় গেল আমার রোজি, আর কোথায় গেল তার মেহেন্দি পরা হাত। মারা যাওয়ার আগেও আমার রোজির হাতে অনেক নকশা করা মেহেন্দি পরা ছিল।
২৭শে এপ্রিল রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারের ধোলাইপাড় ঢালে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাসচাপায় রাসেল নামের এক প্রাইভেট কার চালকের বাঁ পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাসেলের স্ত্রী মিম আক্তার বলেন, এখন রাসেলকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছি পায়ের ড্রেসিং করাতে। ২৯শে মে রাসেলকে এ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়েছে। পায়ের ঘা এখনও পুরোপুরি শুকায়নি। একদিন পরপর পায়ের ড্রেসিং করতে হয়। সারা দিন বাসায় শুয়ে থাকে আর ব্যথায় চিল্লাচিল্লি করে। গ্রিন লাইন বাস মালিক কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দেয়া তো দূরের কথা, একবার ফোন দিয়ে খোঁজ পর্যন্ত নেয়নি। পুরো খরচ আমরাই বহন করছি। গত বছর রাসেল মালয়েশিয়াতে ছিল আর এ বছর ঈদের আগে তো পা-টাই হারালো। আসলে আমার কপালে গত বছর থেকেই ঈদের সুখটা জোটেনি। এ বছর যতই ঈদের দিন ঘনিয়ে আসছে ততই আমার কষ্টটা বাড়ছে। ঈদের কেনাকাটা করেছেন কি না জানতে চাইলে মিম বলেন, ঈদের কেনাকাটা তো দূরের কথা এখন আমার ছেলেটার ভবিষ্যৎ কী হবে, কীভাবে বাসা ভাড়া দিব, কী খাবো- এটা নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। প্রতিবার রাসেলের পায়ের ড্রেসিং-এর জন্য প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়। আমার বাবার বাড়ির সম্পত্তি বন্ধক দিয়ে ওর চিকিৎসা খরচ চালাচ্ছি। এভাবে কত দিন পারবো জানি না।
ঢাকায় প্রেস ক্লাবের সামনে গত শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টায় ছামিরুন আক্তার নামে এক নারী খিলগাঁও-মোহাম্মদপুর রুটে চলাচলকারী মিডলাইন পরিবহন বাসের চাপায় নিহত হন। হাইকোর্টের মাজার মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে সূত্রাপুরের বাসা থেকে বাসে করে এখানে এসেছিলেন। তার ছোট বোন সালমা জানান, তার বোন ছামিরুন প্রতি শুক্রবারই হাইকোর্ট মাজার মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন। ছমিরুনের ছেলে মো. উজ্জল বলেন, এখন যাচ্ছি মায়ের কবর জিয়ারত করতে। দুর্ঘটনার দিন রাতে মাকে নিয়ে একসঙ্গে সাহরি করেছিলাম। সকালে মাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে কর্মস্থল গাজীপুরে ফ্যাক্টরিতে চলে যাই। ওটাই যে মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা হবে- কে জানতো। পরে থানা থেকে ফোন দিয়ে জানালো আপনার মা এক্সিডেন্ট করেছে, তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছে- তাড়াতাড়ি আসেন। পরে গিয়ে দেখি আমার মা আর বেচে নেই। খুব আশা ছিল এ বছর ঈদে মাকে নিয়ে অনেক ঘুরবো। মায়ের জন্য শাড়িও কিনেছিলাম দুটা। কিন্তু সব কিছুতো শেষ হয়ে গেছে। এখন আর কীসের ঈদ? আমার আর কোনো ঈদ নাই। দুই ভাই বোনের মধ্যে উজ্জ্বল ছোট। বড় বোন পারভিন ব্যবসায়ী স্বামীর সঙ্গে রাজধানীর শ্যামপুরে থাকে। পুরান ঢাকায় ছেলে উজ্জ্বলের সঙ্গেই থাকতেন মা ছমিরুন। সাত বছর আগে গার্মেন্টকর্মী বাবা আব্দুল বারেক লিভার সিরোসিসে মারা যাওয়ার পর মাই ছিল তাদের একমাত্র আশ্রয়। আজ মা নেই। এ বছর ঈদটা আমার জীবনে আনন্দ নয়, অভিশাপ হয়ে এসেছে বলে জানান উজ্জ্বল।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মানুষ মারা যাবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার নামে এই যে হত্যাকাণ্ড এটাকে তো কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। শুধু আমাদের সড়ক ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার কারণেই এমনটা হচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে অনেকবার বলেছি যে, সড়কের অবস্থাপনা ও দুর্নীতি যদি কমিয়ে আনা যায় তাহলে একদিকে এই অপমৃত্যুগুলো কমানো সম্ভব। ঠিক একইভাবে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে জনগণকে স্বস্তি দেয়া সম্ভব। সড়কে এই যে অনেকগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেছে, কাল যে আপনে বা আমি যাবো না- সেটাওতো সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কাজেই সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন আর কোনো প্রাণহানি না ঘটে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status